কক্সবাজারে নামবে বোয়িং-৭৭৭
সৈকতের রানী কক্সবাজারে আন্তর্জাতিক মানের বিমানবন্দর হচ্ছে। কার্যত বর্তমান এয়ারপোর্টই আন্তর্জাতিক মানে রূপান্তরিত হচ্ছে। ফলে পর্যটন শহর কক্সবাজারের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ স্থাপিত হবে সারা বিশ্বের। এয়ারপোর্টে থাকবে শামুক আকৃতির টার্মিনাল, যা এর সৌন্দর্যকে শতগুণ বাড়িয়ে দেবে। ফলে পাল্টে যাবে শহরের চিত্র। দেশের পর্যটন খাতে আসবে বৈপ্লবিক পরিবর্তন। এর প্রভাব পড়বে অর্থনীতিতে। বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের মাধ্যমে লাভবান হবে সরকার। আগামী বছরের শুরু থেকে এখানে বোয়িং ৭৭৭-৩০০ ইআরসহ বিশ্বের সব ধরনের বাণিজ্যিক এয়ারক্রাফট নামতে পারবে। ইতিমধ্যে বোয়িং ৭৩৭-৮০০ মডেলের উড়োজাহাজ অবতরণ শুরু হয়েছে। শনিবার আনুষ্ঠানিকভাবে এ উড়োজাহাজের উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সিভিল এভিয়েশন সূত্রে জানা গেছে, কক্সবাজার বিমানবন্দর সম্প্রসারণের প্রথম পর্যায়ের কাজ প্রায় ৭০ ভাগ সম্পন্ন হয়েছে। ডিসেম্বরের মধ্যে শেষ হবে বাকি কাজ। এর মধ্যে আছে রানওয়ে ও ট্যাক্সিওয়ে সম্প্রসারণ, শোল্ডার নির্মাণ, গ্রাউন্ড ট্রিটমেন্ট ও বাঁধ নির্মাণ অন্যতম। দৃষ্টিনন্দন ও আধুনিক সুযোগ-সুবিধা সমৃদ্ধ টার্মিনাল নির্মাণের প্রক্রিয়াও চূড়ান্ত পর্যায়ে। শামুক আকৃতির এ টার্মিনালটি কক্সবাজার বিমানবন্দরের সৌন্দর্য শতগুণ বাড়িয়ে দেবে। বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটনমন্ত্রী রাশেদ খান মেনন যুগান্তরকে বলেন, প্রথম পর্যায়ের কাজ শেষ হলে ২০১৮ সালের মধ্যেই কক্সবাজার বিমানবন্দরটি আন্তর্জাতিক মানে রূপান্তরিত হবে।
তখন এ বিমানবন্দরে নামবে বোয়িং ৭৭৭-৩০০ উড়োজাহাজ ছাড়াও বিশ্বের সব ধরনের বাণিজ্যিক এয়ারক্রাফট। বিদেশ থেকে পর্যটকরা সরাসরি নামতে পারবেন কক্সবাজারে। আবার কক্সবাজার থেকেও সরাসরি ফ্লাইট চলবে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে। কক্সবাজার বিমানবন্দর উন্নয়ন প্রকল্পের পরিচালক প্রকৌশলী মো. আমিনুল হাসিব বলেন, দিন-রাত ২৪ ঘণ্টা পুরোদমে উন্নয়ন কাজ চলছে। দুই শিফটে শ্রমিকরা কাজ করছেন। চলতি বছরের ডিসেম্বরের মধ্যে মূল বিমানবন্দরের কাজ শেষ হবে এবং প্রকল্পের মেয়াদের মধ্যেই পুরো কাজ সম্পন্ন হবে। ইতিমধ্যে ৫০ থেকে ৭০ শতাংশ কাজ শেষ হয়েছে। রানওয়ের কাজ হয়েছে সবচেয়ে বেশি। তিনি বলেন, রানওয়ের পিসিএন (পেভমেন্ট ক্লাসিফিকেশন নম্বর) বৃদ্ধির ফলে ৩৫০ টনের বেশি ওজনের বিমান এখানে অবতরণ করতে পারবে। বর্তমানে যেখানে ৫৪ টনের বেশি ওজনের বিমান অবতরণের অনুমতি দেয়া হয় না। এক কথায় আন্তর্জাতিক মানের ও স্বপ্নের বিমানবন্দর হবে কক্সবাজার। ব্রিজ নির্মাণ ও পানি উন্নয়ন বোর্ডের বাঁধ নির্মাণসহ প্রকল্পের প্রথম পর্যায়ে ব্যয় ধরা হয়েছে ১ হাজার ১৯৪ কোটি টাকা। এর মধ্যে সরকারি তহবিল থেকে ৮০৩ কোটি এবং সিভিল এভিয়েশনের নিজস্ব ফান্ড থেকে ৩৯২ কোটি টাকা জোগান দেয়া হবে। অপরদিকে টার্মিনাল নির্মাণে ব্যায় হবে ৩৫০ কোটি টাকা। সিভিল এভিয়েশনের নিজস্ব তহবিল থেকে এ টাকা ব্যয় করা হবে। সিভিল এভিয়েশনের প্রকৌশলী ও প্রকল্প পরিচালক আমিনুল হাসিব যুগান্তরকে বলেন, এ প্রকল্পের আওতায় রানওয়ের দৈর্ঘ্য ৬ হাজার ৭৭৫ ফুট থেকে ৯ হাজার ফুট, চওড়া ১২৫ ফুট থেকে ১৪৭ ফুট, রানওয়ের উভয় পাশে ২৫ ফুট চওড়া ১৯ হাজার ২৪ ফুট শোল্ডার নির্মাণ করা হবে। ৫০০ মিলিমিটার (২০ ইঞ্চি) পুরুত্বের এসফল্ট কংক্রিট দিয়ে রানওয়ের পিসিএন শক্তি (পেভমেন্ট ক্লাসিফিকেশন নম্বর) ১৯ হতে ৯০ তে উন্নীত করা হবে।
বিদ্যমান গ্রাউন্ড ট্রিটমেন্ট ও বাঁধের রক্ষা কাজ হবে ২ লাখ ৪২ হাজার ৬৫ বর্গফুট। এছাড়া এয়ারফিল্ড লাইটিং সিস্টেম, ড্রেনেজ সিস্টেম, ফায়ার ফাইটিং যন্ত্রপাতি ক্রয়, সীমানা প্রাচীর ও নিরাপত্তা ফেন্সিং নির্মাণ, যানবাহন ক্রয়, আইএলএস, এজিএ এবং ডিভিওআর স্থাপন করা হচ্ছে। ইতিমধ্যে এসব কাজের প্রায় ৫০ শতাংশ সম্পন্ন হয়েছে। এর আগে রানওয়ে সম্প্রসারণের জন্য মাটি ভরাট ও ড্রেজিংয়ের কাজ সম্পন্ন করে কর্তৃপক্ষ। কক্সবাজার বিমানবন্দর সম্প্রসারণ প্রকল্পের সেফটি অ্যান্ড সিকিউরিটি ইনচার্জ নজরুল ইসলাম বলেন, ‘অত্যন্ত সতর্কতা ও নিরাপত্তার মধ্য দিয়ে রাত-দিন শ্রমিকরা কাজ করছেন। ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান মীর আকতার হোসাইন লিমিটেডের নির্বাহী পরিচালক প্রকৌশলী মানিক কুমার বিশ্বাস বলেন, ‘আন্তর্জাতিক মান বজায় রেখে প্রায় ৫০ শতাংশ নির্মাণ কাজ শেষ হয়েছে। মীর আক্তার ছাড়াও এ প্রকল্পে পরামর্শক প্রতিষ্ঠান হিসেবে কাজ করছে কোরিয়ান কোম্পানি ইউশিন ইঞ্জিনিয়ারিং কর্পোরেশন, ইলশিন লিমিটেড, ডিডিসি (বাংলাদেশ) জেভি, ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান কোরিয়ান হাল্লা কর্পোরেশন, সিয়োকওয়াং লিমিটেড (কোরিয়া) জেভি। বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটনমন্ত্রী রাশেদ খান মেনন বলেন, কক্সবাজার বিমানবন্দর আন্তর্জাতিক মানের হলে এখানে পর্যটনের প্রসার ঘটবে। তিনি আরও বলেন, বিমানবন্দর ছাড়াও এ এলাকায় বর্তমান সরকারের চলমান যেসব উন্নয়ন প্রকল্প রয়েছে, তার মধ্যে মাতারবাড়ি কয়লা বিদ্যুৎ প্রকল্প, মহেশখালী এলএনজি টার্মিনাল ও সমুদ্রবন্দর এবং টেকনাফের অর্থনৈতিক অঞ্চলগুলোর কাজ শেষ হলে প্রচুর বিদেশি পর্যটক কক্সবাজারে আসবেন। এ কারণে কক্সবাজার আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর গুরুত্ব পাবে। তার মতে বিশ্বের দীর্ঘতম সমুদ্র সৈকত কক্সবাজারে যে পর্যটন সম্ভাবনা আছে, তার সব কিছুই নির্ভর করছে বিমানবন্দরকে কেন্দ্র করে। কারণ বিশ্বের নানা প্রান্ত থেকে অনেক পর্যটক সরাসরি কক্সবাজারে আসবেন। এতে করে দেশের পর্যটন শিল্প বিকশিত হবে। বর্তমানে অভ্যন্তরীণ রুটের বিমান শুধু দিনে অবতরণ ও উড্ডয়ন করতে পারে। রাতে বিমান উঠানামার জন্য কোনো ধরনের লাইটিং ও নেভিগেশন যন্ত্রপাতি নেই। আন্তর্জাতিক মানে রূপান্তরের অংশ হিসেবে এ বিমানবন্দরে ভিওআর, ডিএমই, ৯০০ মিটার অ্যাপ্রোচ লাইটিং সিস্টেম স্থাপন করা হবে। এতে দিনের মতো রাতেও বিমান অবতরণ করবে। উন্নত প্রযুক্তির এসব যন্ত্রপাতি ফ্রান্স,
জার্মানি এবং লাইটিং সিস্টেমের সর্বশেষ প্রযুক্তি ইতালি থেকে আমদানির প্রক্রিয়া চলছে। অস্ট্রেলিয়া থেকে আনা হয়েছে এসফল্ট কার্পেট। বিমানবন্দরের অগ্নিনিরাপত্তা নিশ্চিতকরণে ফায়ার ফাইটিং ভেহিক্যাল কেনা হবে। বিমানবন্দর উন্নয়ন প্রকল্পে রয়েছে ৮ হাজার ৩৯০ বর্গমিটার নিরাপত্তা দেয়াল নির্মাণ। প্রকল্পের জন্য ১১২ একর জমি অধিগ্রহণ হয়েছে। একই প্রকল্পে পানি উন্নয়ন বোর্ডের ৩.৮৭ কিলোমিটার সুরক্ষা বাঁধ ও এলজিইডির ৫৯৫ মিটার ব্রিজ নির্মাণ কাজ রয়েছে। সিভিল এভিয়েশনের চেয়ারম্যান এয়ার ভাইস মার্শাল এহসানুল গনি চৌধুরী বলেন, বিমানবন্দরের কাজ শেষ হলে এখানে ৭৭৭-৩০০ বোয়িং বিমান উঠানামা করতে পারবে। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ থেকে পর্যটকরা সরাসরি কক্সবাজার আসতে আবার এখান থেকে চলে যেতে পারবেন। এখন ঢাকা হয়ে আসতে হয় কক্সবাজার আর তখন পর্যটকদের আগ্রহের কারণে কক্সবাজার হয়ে ঢাকা যাবে বিমান। মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর ও থাইল্যান্ডের মতো পর্যটকরা সরাসরি আসতে পারবেন। পর্যটন শিল্প বিকশিত হবে বিমানবন্দরকে ঘিরে। আন্তর্জাতিক মানে উন্নীতকরণকে ঘিরে ইতিমধ্যে বেসরকারি বিমান সংস্থাগুলোর মধ্যে আগ্রহ সৃষ্টি হয়েছে। বিমানের পাশাপাশি ইউএস বাংলা, রিজেন্ট, নভোএয়ার যাত্রী পরিবহন শুরু করছে। প্রতিদিন একাধিক ফ্লাইট পরিচালনার পাশাপাশি ৭৩৭ মডেলের উড়োজাহাজ নামানোরও চিন্তাভাবনা করছে।
No comments