তবু বাড়ছে নিত্যপণ্যের দাম
চাহিদার তুলনায় মজুদ কয়েকগুণ, তারপরও বাড়ছে নিত্যপণ্যের দাম। রোজা সামনে রেখে ফি বছর অবস্থার সৃষ্টি হয়। বিশেষ করে ছোলা, চিনি, মসুর ডাল, ভোজ্যতেল, খেজুরসহ পেঁয়াজ, আদা, রসুনের দামে এখনই উত্তাপ ছড়াতে শুরু করেছে। মাত্র সপ্তাহ খানেকের ব্যবধানে খুচরা বাজারে পণ্যভেদে কেজিপ্রতি দাম ২-৫ টাকা পর্যন্ত বেড়েছে। এ পরিস্থিতিতে দিন কয়েকের মধ্যেই আসছে পবিত্র শবেবরাত উদ্যাপনের পালা। দিনটিতে ঘরে ঘরে ছোলা ও চিনিসহ বিভিন্ন ধরনের মসলার চাহিদা তৈরি হয়। অপরদিকে রমজানজুড়েই থাকে এসব পণ্যের চাহিদা। ক্রেতাদের এই বাড়তি চাহিদারই সুযোগ নিতে শুরু করেছেন ব্যবসায়ীরা। তারা পরিকল্পিতভাবে এখন থেকেই দাম বাড়িয়ে নেয়ার পাঁয়তারা করছেন। রমজাননির্ভর পণ্যে সেটিরই প্রভাব পড়ছে। দেশে এসব নিত্যপণ্যের পর্যাপ্ত মজুদ সত্ত্বেও কেন দাম বাড়ছে- এর নেপথ্য কারণ অনুসন্ধানে পাওয়া গেছে বিস্ময়কর তথ্য। এতে দেখা গেছে, রমজান সামনে রেখে ন্যায্যমূল্যে টিসিবির মাধ্যমে সরকারের যে পণ্য বিক্রয় কর্মসূচি রয়েছে, সেটি চাহিদার তুলনায় খুবই কম। বিপরীতে এসব পণ্যের চাহিদার ৯৬ ভাগই নিয়ন্ত্রণ করছেন ব্যবসায়ীরা। এর মধ্যে ভোজ্যতেল ও ছোলার ৯৬ ভাগ, মসুর ডালে ৯৫ দশমিক ৭৪ ভাগ, চিনির ৯৪ দশমিক ৫ ভাগ ও খেজুরের ৯৯ দশমিক ৬১ ভাগ। অর্থাৎ পণ্যভেদে সর্বোচ্চ মাত্র ৪ শতাংশের সরবরাহ দিতে পারবে টিসিবি। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সরকারি বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান ট্রেডিং কর্পোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) দুর্বল মজুদেরই সুযোগ নিতে শুরু করেছেন ব্যবসায়ীরা। ফলে বাজার পরিস্থিতির ওপর সরকারের কঠোর নজরদারিই হতে পারে ভোক্তার জন্য স্বস্তিদায়ক পদক্ষেপ। নতুবা কারসাজির মাধ্যমে কিছু অসৎ ব্যবসায়ী সরবরাহে কৃত্রিম সংকট তৈরি এবং পণ্যের দাম ইচ্ছেমতো নিয়ন্ত্রণ করে বাজারকে অস্থিতিশীল করে তুলতে পারেন। এ ক্ষেত্রে তারা সাম্প্রতিক সময়ে ডলারের দাম বৃদ্ধির বিষয়টিকেও অজুহাত হিসেবে টেনে আনতে পারেন। এখানেও সরকারের নজরদারি রাখতে হবে। কারণ ডলারের দাম বৃদ্ধির পর যে পণ্যের এলসি খোলা হয়েছে, তার ক্রয়, জাহাজীকরণ, খালাস এবং বাজার পর্যায়ে গড়াতে কমপক্ষে আরও আড়াই মাস সময়ের প্রয়োজন হবে। ফলে রমজানে পণ্যের দাম বাড়ার যৌক্তিক কোনো কারণই থাকতে পারে না। এ ছাড়া পণ্যের পর্যাপ্ত মজুদ তো রয়েছেই। মজুদ বেশি হলে সরবরাহ বাড়বে। সরবরাহ ঠিক থাকলে পণ্যের দামও স্বাভাবিক থাকবে।
এর ব্যত্যয় হওয়া মানেই সেটি কারসাজি বলে বিবেচিত হবে। যদিও এ বিষয়ে বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ একাধিকবার আশ্বস্ত করে বলেছেন, রমজানে কোনো পণ্যের দাম বাড়বে না। কাউকে কারসাজিও করতে দেয়া হবে না। কারণ ছোলা, ডাল, চিনি, তেলসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় সব পণ্যের পর্যাপ্ত মজুদ আছে। এরপরও যে কোনো অস্বাভাবিক পরিস্থিতি এড়াতে প্রতিবছরের মতো এবারও টিসিবির মাধ্যমে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য ন্যায্যমূল্যে বাজারে সরবরাহ করা হবে। আগামী ১৫ মে থেকে সারা দেশে ডিলারের মাধ্যমে এবং প্রধান শহরে ট্রাকের মাধ্যমে এসব পণ্য ন্যায্যমূল্যে বিক্রয় করা হবে। এ বিষয়ে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, আসন্ন রমজানে নিত্যপণ্যের বাজার স্থিতিশীল রাখতে বাফার মজুদে যেতে পারেনি টিসিবি। এখন পর্যন্ত টিসিবি ছোলা, ভোজ্যতেল মসুর ডাল- এই তিন পণ্যের মাত্র ৫ হাজার টনের মজুদ সক্ষমতা অর্জন করেছে। এর মধ্যে অস্ট্রেলিয়া থেকে ২ হাজার টন মসুর ডাল ও ২ হাজার টন ছোলা আমদানি করা হয়েছে। স্থানীয় বাজার থেকে কেনা হয়েছে ১ হাজার টন ভোজ্যতেল। খেজুরও কেনা হবে স্থানীয় বাজার থেকে। তবে এর পরিমাণ এখন পর্যন্ত পরিষ্কার করা হয়নি। তবে একাধিক সূত্র জানিয়েছে, সেটি ১০০ টনের বেশি হবে না। আর এ দুর্বল মজুদ পরিস্থিতিই বাজারে পণ্যের দামকে উসকে দিচ্ছে। বুধবার সরেজমিন রাজধানীর শ্যামবাজার, কারওয়ান বাজার, মৌলভীবাজার ও রহমতগঞ্জ পাইকারি বাজার ঘুরে ও ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, মাঝারি মানের ৫০ কেজি ওজনের প্রতি বস্তা ছোলা বিক্রি হচ্ছে ৩৭০০ টাকায়। এর চেয়ে ভালোমানের একই পরিমাণ ছোলার বস্তা বিক্রি হচ্ছে ৪১০০ টাকায়। অর্থাৎ খুচরা পর্যায়ে প্রতি কেজি ছোলার দাম পড়ছে ন্যূনতম ৭৪ টাকা থেকে ৮২ টাকা। এ ছাড়া ৫০ কেজি ওজনের মাঝারি মানের মসুরের ডাল বিক্রি হচ্ছে ৪ হাজার টাকা। একই ওজনের প্রতি বস্তা চিনি বিক্রি হচ্ছে ৩২৬০ টাকা।
প্রতি লিটার খোলা সয়াবিন বিক্রি হচ্ছে ৮৫ টাকা। অন্যদিকে রাজধানীর নয়াবাজার, শান্তিনগর ও রামপুরা কাঁচা বাজারসহ কয়েকটি সুপার শপ ঘুরে দেখা গেছে, প্রতি কেজি প্যাকেট ও খোলা ছোলা মানভেদে বিক্রি হচ্ছে ৮৫-১১০ টাকায়। যা আগের সপ্তাহে ছিল ৮০-১০০ টাকার মধ্যে। মানভেদে মসুর ডালের দাম কেজি প্রতি বেড়েছে ৩-৫ টাকা। বিক্রি হচ্ছে ১১৫-১৩৫ টাকায়। যা আগের সপ্তাহে ছিল ১১০-১৩০ টাকায়। প্রতি কেজি চিনি বিক্রি হচ্ছে ৭০ টাকা। যা গত সপ্তাহে বিক্রি হয়েছে ৬৫ টাকা। সয়াবিন তেল বিক্রি হচ্ছে ৯০ টাকা। যা সপ্তাহের ব্যবধানে দাম বেড়েছে দুই টাকা। এছাড়া সব ধরনের খেজুরে মানভেদে কেজি প্রতি ১০ থেক ২০ টাকা বেড়েছে। পণ্যের দাম বৃদ্ধি প্রসঙ্গে এক প্রশ্নের জবাবে বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ যুগান্তরকে বলেন, মুক্তবাজার অর্থনীতিতে ব্যবসায় সরকারের হস্তক্ষেপ করা ঠিক না। ব্যবসায়ীরাই ব্যবসা করবে। তাই বাজার নিয়ন্ত্রকের ভূমিকায়ও তারাই থাকবে। সেখানে পণ্যের দাম নির্ভর করবে চাহিদা ও জোগানের ওপর। এ মুহূর্তে দেশে সব নিত্যপণ্যের মজুদ চাহিদার তুলনায় কয়েকগুণ বেশি আছে। তাই শুধু রমজান কেন, সারা বছরই বাজার স্থিতিশীল থাকবে। এরপরও কেউ যাতে কারসাজি করতে না পারে, সরকার সে ক্ষেত্রে একটা পর্যবেক্ষকের ভূমিকায় থেকে কাজ করছে।
No comments