আগুন by সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম
ঢাকায় এখন সময় হিসাব করে কেউ রাস্তায় বেরোতে পারে না। সময়টা মানুষ ছেড়ে দিয়েছে দৈবের হাতে। মাঝরাতেও এখন ট্রাফিকের জট লাগে রাস্তায়, আর মানুষের মূল্যবান সময় ছিনতাই হয়ে যায়। কালাম মিয়া এই বিষয়টা হাড়ে হাড়ে টের পান। কালাম সিএনজি স্কুটার চালান, যানজটে পড়লে যাত্রীদের হাহাকার শোনেন, নিজেরও। এক যাত্রী গাছ থেকে পড়ে জখম হওয়া বাচ্চাকে নিয়ে যাচ্ছে হাসপাতালে। যানজটে পড়ে সে শুধু কপাল চাপড়াতে থাকল, ‘আল্লা, দয়া করো, বাচ্চাটারে বাঁচাও।’ আল্লাহ দয়া করেছিলেন, কালাম তাঁর সিএনজি ফুটপাতের ওপর তুলে দিয়ে, তাঁর আদরের বাহনের বডিতে বাচ্চার জখমগুলো তুলে নিয়ে হাসপাতালে পৌঁছলেন। বাচ্চাটা যে বাঁচল, কালামকে সেটি খোঁজ নিয়ে জানতে হয়নি। যে মুহূর্তে বাচ্চাটার বাবা তাকে কোলে তুলে দৌড় দিল ইমারজেন্সির দিকে, কালাম মিয়ার জানা হয়ে গেল।
কীভাবে, জিজ্ঞেস করলেন?
শুনুন। কালাম মিয়া ছেলেটার ঘোলাটে-সাদা চোখ দুটো দেখেছিলেন। সেখানে তিনি একটা ছোট আলোর নাচন দেখেছিলেন। কালাম মানুষের চোখ দেখেন; চোখ দেখাটা তাঁর একটা বড় কাজ বলে মনে করেন। আনন্দ পান—তবে সব চোখ না, মোটেও না। বরং আনন্দের তুলনায় তাঁর ভয়, আতঙ্কটাই বেশি হয়। কিন্তু যেটুকু ছিটেফোঁটা আনন্দ তিনি পান, তাকেই যথেষ্ট মানেন। যেমন আজকে। বৃষ্টির দিন, একটু যেন ধোঁয়াশা চারদিকে। বাস-ট্রাক ধোঁয়া ছড়াচ্ছে, তাতে বৃষ্টির বাষ্প মিশে একটা ফিনফিনে মশারি যেন মেলে দিয়েছে চারদিকে। এ রকম মশারির ভেতর দিয়ে মানুষের চোখ পড়াটা কঠিন হয়। তারপরও পড়ার চেষ্টা করেন তিনি। এই চেষ্টার একটা সময়ে হঠাৎ একটা মেয়ের চোখ দেখে তিনি চমকে উঠলেন। একবার দেখলেন, দুবার—বারবার দেখলেন; এবং যানজটকে, সামনের থেমে থাকা বাহনগুলোকে ধন্যবাদ জানালেন দেখার সময়টা তাঁকে করে দেওয়ার জন্য। মেয়েটা রাস্তার পাশে ফুটপাতে দাঁড়িয়ে আছে, দৃষ্টি সামনে মেলে। আমি-আপনি দেখলে মেয়েটার মুখে অসহায়তার একটা ছবিই দেখতাম, চোখ দুটোতে জমে থাকা কষ্টের ছায়াটা দেখতাম; এবং আমাদের মনেও কষ্ট জমত। কিন্তু কালাম মিয়া কেন কষ্ট না পেয়ে চমকে উঠলেন? আনন্দও পেলেন—গভীর আনন্দ, যে আনন্দ তিনি একসময় পেতেন দিন শেষে ঘরে ফিরে স্ত্রী নুরুন্নাহারের হাসিভরা চোখ দেখে; যদিও স্ত্রী হঠাৎ এক মাঝরাতে, কোনো ছেলেমেয়ে না রেখে একটা ভিনজগতে চলে গেলেন, যে জগৎ থেকে কেউ কখনো ফিরেছে বলে জানা যায়নি। কিছুদিন থমকে থেকে জীবনের টুকরোগুলো কোনো রকমে জোড়াতালি দিয়ে কালাম পথে নামলেন, তাঁকে বাঁচিয়ে দিল মানুষের চোখ দেখার চর্চাটা। কালাম চমকে দেখলেন, মেয়েটার চোখে আগুন। যে আগুন তিনি মানুষের চোখে খোঁজেন, কিন্তু পান না, অথবা কালেভদ্রে পান। কী সেই আগুন, কালাম মিয়াকে জিজ্ঞেস করলে হাসবেন, কিছু বলবেন না। তাঁর হয়ে নাহয় আমরাই বলি: যে আগুন মানুষকে চারদিকের পতন থেকে, হিংসা-অসূয়া থেকে, হতাশা-বিপন্নতা থেকে বাঁচায়। আগুনের ধর্ম ওপরের দিকে লাফিয়ে ওঠা, মানুষের চোখে আগুন থাকলে তাকে ওপরে টেনে তোলে সেই আগুন। মানুষের ধর্ম বলে পুড়ে শুদ্ধ হওয়ার কথা। আগুন মানুষের ধর্মকে শ্রদ্ধা করে। চোখের আগুন মানুষকে বাঁচায় আরও নানাভাবে। তবে সেগুলো সব বলার দরকার নেই। ফুটপাতে দাঁড়ানো মেয়েটির কাছে গেলে সেসব জানা হয়ে যাবে আপনাদের।
২. মেয়েটির নাম জামিলা। শনির আখড়ার ধনু মিয়ার গলিতে একটা আড়াই ঘরের ভাড়া বাড়িতে বাবা, দুই ভাই, সৎমা ও সৎমায়ের আগের সংসারের এক মেয়ের সঙ্গে সে থাকে। জামিলা কলেজ পাস করেছিল যেন আর কোনো জীবনে। তারপর পড়াশোনার পাট চুকে গেছে। এই জীবনে যে আর তার সম্ভাবনা নেই, জামিলা তা জানে। বিয়ের বয়সে পড়েছে সে, কিন্তু বিয়ে দিচ্ছে না বাবা। কারণ, সৎমা কাজ করেন গার্মেন্টসে। জামিলাকে দেখাশোনা করতে হয় তাঁর মেয়েকে, এক ভাইকে। রান্না করতে হয়। কাপড় ধুতে হয়। বড় ভাইটা চাকরি করে এক ফার্নিচার দোকানে, ধনু মিয়ার গলির মোড়ে। এক বছর থেকে তার আচার-আচরণে উগ্রতা দেখা দিয়েছে। জামিলা ঘর থেকে বেরিয়ে রাস্তায় একটা পা দিলেই সে তাকে মারে। জামিলাকে বাবাও মারেন রান্না মনমতো না হলে, কোনো আবদার ধরলে। অনেক দিন সে অবশ্য কোনো আবদার ধরে না, শেষবার এক ঈদে একটা নতুন জামার জন্য মৃদু একটা আবদার করে মার খাওয়ার পর। সৎমাও এই মার দেওয়ার দলে জুটেছেন কদিন হলো। অবাক কাণ্ড, জামিলার থেকে সাত-আট বছরের মাত্র বড়, অথচ তাকে মারেন; যেন মার দেওয়াটা তাঁর জন্মগত একটা অধিকার। এখন জামিলার দিন কাটে ঘরের কাজে। তার রাত আর দিনের মধ্যে তফাত সামান্যই—রাতটা বেশি অন্ধকার, এটুকুই যা। তাহলে আজ বাইরে বেরোল যে জামিলা, কীভাবে? বড় ভাইটার চোখ ফাঁকি দিয়ে? না, জামিলা বেরিয়েছে বাবার তালাশে। বড় ভাইটাও বেরিয়েছে, কিন্তু তার আগেই হদিস পেয়ে গেছে জামিলা। বাবা সবজি ব্যবসায়ী। মাঝরাতে তাঁর কাজ শুরু। কারওয়ান বাজার থেকে পাইকারি সবজি কিনে পলাশি-ঠাটারি বাজারে সাপ্লাই দেন। দুপুরের পর বাসায় ফেরেন। মেজাজ থাকে চড়া। তাঁর এই ফেরার সময়টাতে ভয়ে সিঁটিয়ে থাকে জামিলা। কিন্তু গতকাল বাবা ঘরে ফেরেননি। বড় ভাইটা অনেকক্ষণ অপেক্ষা করে খেয়ে কাজে চলে গেছে। রাতে যখন ফিরেছে, জামিলাকে অনেক রাগ নিয়ে জিজ্ঞেস করেছে, ‘আব্বা কই? অহনও আসে নাই ক্যান?’
কীভাবে, জিজ্ঞেস করলেন?
শুনুন। কালাম মিয়া ছেলেটার ঘোলাটে-সাদা চোখ দুটো দেখেছিলেন। সেখানে তিনি একটা ছোট আলোর নাচন দেখেছিলেন। কালাম মানুষের চোখ দেখেন; চোখ দেখাটা তাঁর একটা বড় কাজ বলে মনে করেন। আনন্দ পান—তবে সব চোখ না, মোটেও না। বরং আনন্দের তুলনায় তাঁর ভয়, আতঙ্কটাই বেশি হয়। কিন্তু যেটুকু ছিটেফোঁটা আনন্দ তিনি পান, তাকেই যথেষ্ট মানেন। যেমন আজকে। বৃষ্টির দিন, একটু যেন ধোঁয়াশা চারদিকে। বাস-ট্রাক ধোঁয়া ছড়াচ্ছে, তাতে বৃষ্টির বাষ্প মিশে একটা ফিনফিনে মশারি যেন মেলে দিয়েছে চারদিকে। এ রকম মশারির ভেতর দিয়ে মানুষের চোখ পড়াটা কঠিন হয়। তারপরও পড়ার চেষ্টা করেন তিনি। এই চেষ্টার একটা সময়ে হঠাৎ একটা মেয়ের চোখ দেখে তিনি চমকে উঠলেন। একবার দেখলেন, দুবার—বারবার দেখলেন; এবং যানজটকে, সামনের থেমে থাকা বাহনগুলোকে ধন্যবাদ জানালেন দেখার সময়টা তাঁকে করে দেওয়ার জন্য। মেয়েটা রাস্তার পাশে ফুটপাতে দাঁড়িয়ে আছে, দৃষ্টি সামনে মেলে। আমি-আপনি দেখলে মেয়েটার মুখে অসহায়তার একটা ছবিই দেখতাম, চোখ দুটোতে জমে থাকা কষ্টের ছায়াটা দেখতাম; এবং আমাদের মনেও কষ্ট জমত। কিন্তু কালাম মিয়া কেন কষ্ট না পেয়ে চমকে উঠলেন? আনন্দও পেলেন—গভীর আনন্দ, যে আনন্দ তিনি একসময় পেতেন দিন শেষে ঘরে ফিরে স্ত্রী নুরুন্নাহারের হাসিভরা চোখ দেখে; যদিও স্ত্রী হঠাৎ এক মাঝরাতে, কোনো ছেলেমেয়ে না রেখে একটা ভিনজগতে চলে গেলেন, যে জগৎ থেকে কেউ কখনো ফিরেছে বলে জানা যায়নি। কিছুদিন থমকে থেকে জীবনের টুকরোগুলো কোনো রকমে জোড়াতালি দিয়ে কালাম পথে নামলেন, তাঁকে বাঁচিয়ে দিল মানুষের চোখ দেখার চর্চাটা। কালাম চমকে দেখলেন, মেয়েটার চোখে আগুন। যে আগুন তিনি মানুষের চোখে খোঁজেন, কিন্তু পান না, অথবা কালেভদ্রে পান। কী সেই আগুন, কালাম মিয়াকে জিজ্ঞেস করলে হাসবেন, কিছু বলবেন না। তাঁর হয়ে নাহয় আমরাই বলি: যে আগুন মানুষকে চারদিকের পতন থেকে, হিংসা-অসূয়া থেকে, হতাশা-বিপন্নতা থেকে বাঁচায়। আগুনের ধর্ম ওপরের দিকে লাফিয়ে ওঠা, মানুষের চোখে আগুন থাকলে তাকে ওপরে টেনে তোলে সেই আগুন। মানুষের ধর্ম বলে পুড়ে শুদ্ধ হওয়ার কথা। আগুন মানুষের ধর্মকে শ্রদ্ধা করে। চোখের আগুন মানুষকে বাঁচায় আরও নানাভাবে। তবে সেগুলো সব বলার দরকার নেই। ফুটপাতে দাঁড়ানো মেয়েটির কাছে গেলে সেসব জানা হয়ে যাবে আপনাদের।
২. মেয়েটির নাম জামিলা। শনির আখড়ার ধনু মিয়ার গলিতে একটা আড়াই ঘরের ভাড়া বাড়িতে বাবা, দুই ভাই, সৎমা ও সৎমায়ের আগের সংসারের এক মেয়ের সঙ্গে সে থাকে। জামিলা কলেজ পাস করেছিল যেন আর কোনো জীবনে। তারপর পড়াশোনার পাট চুকে গেছে। এই জীবনে যে আর তার সম্ভাবনা নেই, জামিলা তা জানে। বিয়ের বয়সে পড়েছে সে, কিন্তু বিয়ে দিচ্ছে না বাবা। কারণ, সৎমা কাজ করেন গার্মেন্টসে। জামিলাকে দেখাশোনা করতে হয় তাঁর মেয়েকে, এক ভাইকে। রান্না করতে হয়। কাপড় ধুতে হয়। বড় ভাইটা চাকরি করে এক ফার্নিচার দোকানে, ধনু মিয়ার গলির মোড়ে। এক বছর থেকে তার আচার-আচরণে উগ্রতা দেখা দিয়েছে। জামিলা ঘর থেকে বেরিয়ে রাস্তায় একটা পা দিলেই সে তাকে মারে। জামিলাকে বাবাও মারেন রান্না মনমতো না হলে, কোনো আবদার ধরলে। অনেক দিন সে অবশ্য কোনো আবদার ধরে না, শেষবার এক ঈদে একটা নতুন জামার জন্য মৃদু একটা আবদার করে মার খাওয়ার পর। সৎমাও এই মার দেওয়ার দলে জুটেছেন কদিন হলো। অবাক কাণ্ড, জামিলার থেকে সাত-আট বছরের মাত্র বড়, অথচ তাকে মারেন; যেন মার দেওয়াটা তাঁর জন্মগত একটা অধিকার। এখন জামিলার দিন কাটে ঘরের কাজে। তার রাত আর দিনের মধ্যে তফাত সামান্যই—রাতটা বেশি অন্ধকার, এটুকুই যা। তাহলে আজ বাইরে বেরোল যে জামিলা, কীভাবে? বড় ভাইটার চোখ ফাঁকি দিয়ে? না, জামিলা বেরিয়েছে বাবার তালাশে। বড় ভাইটাও বেরিয়েছে, কিন্তু তার আগেই হদিস পেয়ে গেছে জামিলা। বাবা সবজি ব্যবসায়ী। মাঝরাতে তাঁর কাজ শুরু। কারওয়ান বাজার থেকে পাইকারি সবজি কিনে পলাশি-ঠাটারি বাজারে সাপ্লাই দেন। দুপুরের পর বাসায় ফেরেন। মেজাজ থাকে চড়া। তাঁর এই ফেরার সময়টাতে ভয়ে সিঁটিয়ে থাকে জামিলা। কিন্তু গতকাল বাবা ঘরে ফেরেননি। বড় ভাইটা অনেকক্ষণ অপেক্ষা করে খেয়ে কাজে চলে গেছে। রাতে যখন ফিরেছে, জামিলাকে অনেক রাগ নিয়ে জিজ্ঞেস করেছে, ‘আব্বা কই? অহনও আসে নাই ক্যান?’
তার রাগী প্রশ্ন শুনলে আপনার মনে হবে, যেন দোষটা জামিলার, যেন সে বাবাকে লুকিয়ে রেখেছে। রাতে কেউ ঘুমাতে পারেনি। ভোর হতে হতেই বড় ভাই বেরিয়ে গেছে। সৎমাও বেরিয়েছেন, বাচ্চাকে প্রতিবেশী মোমেনা বানুর কাছে রেখে। কড়া গলায় জামিলাকে বলেছেন, ‘বাবারে তালাশ করো।’ জামিলার মা মারা যাওয়ার আগে তাকে তার জীবনের সঞ্চয় বারো শ টাকা দিয়ে গিয়েছিলেন, তাঁর আশা ছিল মেয়ে পড়াশোনা করবে। সেই টাকা যখের ধনের মতো আগলে-লুকিয়ে রেখেছিল জামিলা। সেখান থেকে এক শ টাকা নিয়ে সে বেরোল। এবং বাড়ির বাইরে পা দিয়ে তার হঠাৎ কেন জানি খুব আনন্দ হলো। হঠাৎ উধাও হওয়া বাবাকে নিয়ে তার একটা উদ্বেগ থাকার কথা ছিল, কিন্তু অবাক, তার কোনো উদ্বেগ হলো না। একা রাস্তায় বেরোনোর আনন্দ, নিজেই নিজের সঙ্গী হয়ে খোলা আকাশের নিচে গায়ে হাওয়া লাগিয়ে পথ হাঁটার উচ্ছ্বাস তাকে দোলাতে থাকল। কিন্তু ধনু মিয়ার গলিটা শুধু পার হয়েছে, পেছন থেকে একটা শক্ত হাত তার কাঁধে একটা চাপ দিল। জামিলা চমকে ফিরে তাকাল। মিজু মিয়া। বড় ভাই যে ফার্নিচার দোকানে চাকরি করে তার ম্যানেজার। নোংরা লোক। তার চোখ পড়েছে জামিলার ওপর, তাকে সে বিয়ে করতে চায়, একটা বউ থাকা সত্ত্বেও। বড় ভাইটার আপত্তি নেই; সে চায় জামিলা লোকটাকে বিয়ে করুক। তাতে তার নিজের অনেক লাভ। তা ছাড়া লোকটা থাকেও এই গলিতে, ফলে বাবা আর অন্যদের দেখাশোনাও জামিলা করতে পারবে। যদি জামিলার বাবা রাজি হয়ে যেতেন, তার আর কোনো উপায় থাকত না। মেয়েটার ভাগ্য ভালো, বাবা কী কারণে যেন দেখতে পারেন না লোকটাকে। লোকটাও ভয় পায় জামিলার বাবাকে। আজ যখন সেই বাবা উধাও, লোকটার সাহস তো বাড়বেই। এ কারণে সে বসে ছিল জামিলার জন্য। সে জানত, জামিলা বেরোবে বাবার খোঁজে। সাহসটা এমনি বেড়েছে লোকটার যে জামিলার কাঁধেই হাত দিয়ে বসেছে। নোংরা হাত। হাতটা সরিয়ে জামিলা পা বাড়াল। কিন্তু নোংরা হাত বলে কথা। লোকটার এক হাতে একটা ছাতা মেলা। সেটি দিয়ে হঠাৎ সে জামিলাকে আড়াল করে ফেলল। গলিতে সকালে তেমন ভিড় নেই, থাকলেও ছাতার আড়ালে জামিলা আর লোকটাকে নিয়ে মানুষের কৌতূহল তৈরি হতে কিছুটা সময় লাগত। ওইটুকু সময়ই যথেষ্ট লোকটার জন্য। তার সচল হাতটা অনেক কিছু করত, কিন্তু একটা চিৎকার দিল জামিলা এবং একটা ধাক্কা দিল লোকটাকে। লোকটা হড়কে গিয়ে পড়ল একটা বন্ধ দোকানের শাটারে। ছাতাটা ছিটকে পড়ল হাত থেকে। সে হতভম্ব হয়ে কী করবে, ভাবার আগেই জামিলা দৌড় দিল। কিন্তু গলি পার হওয়ার আগেই সে একটা গালি শুনল এবং একটা হুংকার। গালিটা ঊহ্যই থাকুক। এটি সভ্য সমাজের জন্য নয়।
৩. একটা বাসে উঠে জামিলা মাথাটা ঠান্ডা করল। মাথা ঠান্ডা করার চর্চাটা সে শিখেছে মায়ের কাছ থেকে। ঠান্ডা মাথায় সে ভাবল। না, বাবার শত্রু নেই, লোকজন তাঁকে পছন্দই করে। তাঁর টাকাপয়সাও তেমন নেই। বেআইনি কিছুও তিনি করেন না। বড় ভাইটা শত্রু-টত্রুর চিন্তা থেকেই খোঁজে নেমেছে। কেন, সে-ই জানে। সৎমা গেছেন এক নারীর খোঁজে, যে তার মতোই টার্গেট করেছিল জামিলার বাবাকে। বাবা দেখতে-শুনতে ভালো। জামিলাও বাবার মতোই। সৎমা জানেন, ওই মেয়েটি শেষমেশ তার কাছে হেরে গেলেও আশা ছাড়েনি, একদিন সে দেখেছে, রাস্তায় দাঁড়িয়ে মেয়েটা হেসে কথা বলছে তার স্বামীর সঙ্গে। জামিলাকে মারলেও সৎমা আসলে ভিতু টাইপেরই। স্বামীকে তিনি যথেষ্ট ভয় পান। সে জন্য তাঁকে জিজ্ঞেস করার সাহস হয়নি। জামিলা ভেবেছে, ঢাকা মেডিকেলে খোঁজ নেবে প্রথম। তারপর আরও দু-তিন হাসপাতালে। জামিলা ঠিকই ভেবেছে। ঘণ্টা খানেক খোঁজাখুঁজি করে সে একটা ওয়ার্ডে তার বেহুঁশ বাবাকে আবিষ্কার করল। হাতে-মাথায় ব্যান্ডেজ। এক নার্সের পেছনে কিছুক্ষণ লেগে থেকে জানল, হুঁশ আসার সম্ভাবনা আছে, তবে তার জন্য বাইরে থেকে ওষুধ আনতে হবে। নার্স তাকে জিজ্ঞেস করল, কীভাবে হাসপাতালে ঢুকল সে। এখন তো ঢোকার সময় না। জামিলা দূরে এক ওয়ার্ডবয়কে দেখিয়ে বলল, ‘ওই ভাই ঢুকতে দিছেন।’ বয়ের দিকে তাকিয়ে নার্স বলল, ‘লোকটা বদ। তুমি আমার সঙ্গে চলো।’ নার্স তাকে গেট পর্যন্ত এগিয়ে দিল। কিন্তু রাস্তা পর্যন্ত যাওয়া হলো না জামিলার, বদ ওয়ার্ডবয়টা তাকে ধরে ফেলল। হাত থেকে ওষুধের নাম লেখা কাগজটা নিয়ে বলল, ‘এই ওষুধের দাম আট শ টাকার কম না। তোমার পয়সা আছে?’ জামিলা হাত বাড়িয়ে কাগজটা ছিনিয়ে নিল। বয়টা বলল, ‘ওষুধটা আমি তোমারে দিমু।’ জামিলা অবাক হয়ে তাকাল। বয়টা বলল, ‘ওইহানে আমার ঘরত ওষুধ আছে। চলো।’ জামিলা বলল, ‘আপনার ঘরে আপনি যান। গিয়া শুইয়া থাহেন।’ তারপর জোরে পা চালাল সে। বুঝল, তার জন্য শনির আখড়ার ঘরের ভেতরটার সঙ্গে বাইরের জগতের কোনো তফাত নেই। তার চোখ হঠাৎ জলে ভরে গেল। চোখ দুটো পুড়তে থাকল। সেই জলে ভরা পুড়তে থাকা চোখ নিয়ে সে দাঁড়াল বাসস্টপে। কালাম মিয়া যখন তাকে দেখেন, পুড়তে পুড়তে চোখের জল শুকিয়েছে জামিলার। তিনি জামিলার চোখে আগুন দেখলেন। আমরা দেখলে অবশ্য আগুনটা আমাদের চোখে ধরা পড়ত না। কালাম মিয়ার হঠাৎ কী যে হলো, তিনি সিএনজিটা থামালেন। যাত্রীকে বললেন, ‘স্যার, নামতে হবে। একটু সমস্যা হচ্ছে।’ যাত্রী নেমে পয়সা না দিয়ে হাঁটা দিলেন। বাসটা ছাড়লে সিএনজি নিয়ে তার পিছু নিলেন কালাম মিয়া। বাস বদলাল জামিলা। সেই বাসের পেছন পেছনও তিনি গেলেন। জামিলা ধনু মিয়ার গলিতে ঢুকল। তিনিও ঢুকলেন। জামিলাকে আড়াল দিল তাঁর সিএনজি। ফার্নিচার দোকানের ধূর্ত লোকের চোখটাও বুঝল না, জামিলা তাকে ফাঁকি দিল। জামিলার বাসাটা দেখে গেলেন কালাম মিয়া।
৪. মাস খানেক পর জামিলার চোখটা কলাম মিয়ার স্বপ্নে হানা দিল। স্বপ্নেই খুব আনন্দ পেলেন তিনি। কিন্তু কেন জানি তাঁর একটু আতঙ্কও হলো। তাঁর মনে হলো, কোথায় যেন একটা সর্বনাশ ঘাপটি মেরে আছে। সেটি যখন সক্রিয় হবে, একটা ঘূর্ণি হয়ে ছুটবে, সেই ঘূর্ণিতে কি জামিলা পড়বে?
স্বপ্নে তিনি সর্বনাশের ঘূর্ণি দেখলেন। আগুনও দেখলেন। জেগে উঠে ভাবলেন, কিছু একটা করতে হবে। কী করতে হবে, ভাবতে ভাবতে বিকেল হয়ে গেল। বিকেলে তিনি সিএনজি নিয়ে ছুটলেন ধনু মিয়ার গলিতে। যেতে যেতে একটা সাহস এল তাঁর মনে। জামিলা পারবে। সর্বনাশের ঘূর্ণি তাকে টেনে তার গভীরে নিতে পারবে না। দরজায় টোকা পড়লে জামিলার বাবাই খুললেন, ‘কী চাই?’ জানতে চাইলেন তিনি। কালাম মিয়া বিপদে পড়লেন। ‘মেয়েটা আপনার কে?’
‘কোন মেয়েটা?’
কীভাবে বোঝাবেন মেয়েটা কে—ভাবতে ভাবতেই জামিলাকে পেছনে দেখা গেল। হাতে একটা চা-ভর্তি গ্লাস। কালাম মিয়া জামিলাকে আঙুল তুলে দেখালেন।
‘কী চান আপনে? আমার মাইয়ার তালাশ করেন ক্যান?’
জামিলার বাবার একটা হাত এখনো গলায় টানানো গুলতিতে ঝুলছে। অন্য হাতটাও বেশ দুর্বল। সেই দুর্বল হাত তুলেই তিনি তেড়ে গেলেন কালাম মিয়ার দিকে। কালাম মিয়ার মুখের কথা বন্ধ হয়ে গেল। স্পষ্টতই তিনি ভড়কে গেছেন। তিনি বিড়বিড় করে বললেন, ‘মেয়েডার একটা বিপদ সম্পর্কে জানাইতে আইছি’—বা এ রকম কিছু। কথাটা তিনি শেষ করতে পারলেন না, অর্ধেকটাও শোনাতে পারলেন না। এতে বিপদ যা হলো, এই বিড়বিড় করে বলা কথাগুলো জামিলার বাবার কানে শোনাল ‘মেয়েডার জন্য একটা সম্পর্ক নিয়া আইছি।’ তাঁর মাথায় বিদ্যুৎ খেলে গেল। এবার দুর্বল হাতটা দিয়েই ধাক্কা দিলেন কালাম মিয়াকে। কালাম মাটিতে পড়লেন। প্রতিবেশী মোমেনা বানুর স্বামী ছুটে এল। ‘কী অইছে ভাইজান? লোকটা কে?’ সে জিজ্ঞেস করল। ‘হারামজাদা, আমার মাইয়ারে বিয়া করতে চায়।’ জামিলার বাবা বললেন এবং কালাম মিয়ার দিকে তাকিয়ে হুংকার দিলেন, ‘তোর বিয়া করার খায়েশ মিটামু।’ খায়েশ মেটানোর কাজটা অবশ্য মোমেনার স্বামীই শুরু করল। কালাম অবাক চোখে তাকালেন লোকটার দিকে, ‘ভাই, আমারে মারেন কেন? আমি তো মাইয়াডারে...’
এবারও তিনি বাক্যটা শেষ করতে পারলেন না; বরং যা করলেন, তিন-চারজন মানুষের কাছে প্রমাণই করে ফেললেন, তিনি জামিলাকে বিয়ে করার প্রস্তাব নিয়ে এসেছেন। মোমেনার স্বামী অবশ্য দু-একটা কিলঘুষি মেরে ছেড়ে দিত। কিন্তু দৃশ্যে এবার ঢুকল ওই ফার্নিচার দোকানের ম্যানেজার মিজু মিয়া। সে দোকান থেকে বাড়ি যাচ্ছিল। জটলা দেখে এগিয়ে এসে শুনল, কালাম মিয়া জামিলার জন্য বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে এসেছে। শুনেই তার রাগ চড়ল। কালামকে দু-ঘা মেরে জামিলার বাবাকে সে বলল, ‘আমার প্রস্তাবটা তো ভালো লাগল না। এখন এই সব লাফাঙ্গা লোকরে সামলান।’ জামিলা তার বাবাকে বলল, ‘আব্বা, কাজটা ঠিক হইতেছে না। লোকটারে বাঁচান।’ এই ছোট আবদারে বাবার মারের হাত উঠল জামিলার ওপর। মেয়ের গালে চড় মেরে তিনি একটা গালি দিলেন। গালিটা শুনলে সভ্য সমাজের গাল লাল হবে। এবং বললেন, ‘এইটা কইত্থে জুটাইছিস?’ তারপর মেয়েকে ধাক্কা দিয়ে ঘরের দরজায় নিয়ে বললেন, ‘এই যে মিজু মিয়া, এই ফকিরটার থাইকা মিজু মিয়াও তো ভালো।’ তাঁর রাগ আকাশ ছুঁয়েছে। কাঁপতে কাঁপতে মিজুকে তিনি বললেন, ‘লাফাঙ্গা সামলানো আমার কাম না। আইও, কাইল আইও। কথা কমু। মুরুব্বি নিয়া আইও।’ ফার্নিচার দোকানের ম্যানেজার মিজু মিয়া নিজের কানকেও বিশ্বাস করতে পারল না। তবে সে বুঝল, এটি তার যথাসময়ে যথাপাত্রে বিনিয়োগের ফসল। জামিলার বাবার চিকিৎসার জন্য সে যে যথেষ্ট টাকা দিয়েছে তার ভাইকে, জামিলার বাবা সেটি জানেন। হয়তো তিনি এভাবেই তা ফেরত দিচ্ছেন। মিজু এবার আনন্দে-উৎসাহে কালাম মিয়াকে পেটাতে লাগল। প্রথমে হাত দিয়ে, পরে কালাম মিয়া মাটিতে লুটিয়ে পড়লে, পা দিয়ে। কালাম ভাবলেন, তিনি হয়তো জীবন নিয়ে ফিরতে পারবেন না। তিনি চোখ বন্ধ করলেন, অথবা করতে গেলেন। কারণ, তখনই তিনি দেখলেন জামিলাকে—জামিলার চোখ দুটি। আগুন। তিনি কিছুটা স্বস্তি পেলেন। তারপর চোখ বুজলেন। তখনই ঘটল ঘটনাটা, যা কালাম মিয়া তার স্বপ্নেও ভাবতে পারতেন না। জামিলা দরজায় দাঁড়িয়ে তাকিয়েছে মিজু মিয়ার দিকে। মিজু মিয়ার চোখ হাসছে—বিজয়ে, তৃপ্তিতে। কিন্তু সেই হাসিটা থামিয়ে, তৃপ্তি ছারখার করে একটা আগুনের নাচন শুরু হলো তার চারদিকে। প্রথমে সে আগুন জাপটে ধরল তার হাত। তারপর তার ধর্ম মেনে উঠল ওপরের দিকে। উঠতে উঠতে শুধুই পোড়াল তাকে। শেষে চুল খামচে ধরল, মিজু পা হড়কে মাটিতে পড়ল। লোকজন আতঙ্কে চিৎকার করতে করতে পালাল। মোমেনা বানু এক কলসি পানি ঢাললেন মিজু মিয়ার ওপর। আগুন নিভল। কিন্তু আগুন এবার জামিলার বাবার সামনে কিছুক্ষণ নাচল, তারপর ছুটল মোমেনার স্বামীর দিকে। মোমেনা ঘরে ঢুকে আরেক কলস পানি নিয়ে ছুটলেন স্বামীর পেছন পেছন ছুটতে থাকা আগুনের পেছনে। জামিলা চোখ বন্ধ করল। তারপর কালাম মিয়ার সামনে হাঁটু গেড়ে বসে তাঁকে টেনে তুলল। ‘আপনি কে?’ সে জিজ্ঞেস করল। ‘আমার নাম আবুল কালাম মিয়া। আমি সিএনজি চালাই। তোমারে জানাইতে আইছিলাম, মামণি, তোমার চক্ষে আগুন আছে। সেইটা ব্যবহার করো। তোমার দুঃখ থাকব না।’ জামিলা হাসল। ‘না থাকব না,’ আস্তে করে সে বলল, তারপর উঠে ঘরের ভেতর ঢুকল। মিনিট তিনেকের মধ্যে ফিরল সে, হাতে একটা ছোট ব্যাগ। কালাম মিয়া উঠে দাঁড়িয়ে নিজেকে গোছাচ্ছিলেন। জামিলাকে দেখে বললেন, ‘কই যাবা?’
‘জানি না’, সে বলল, ‘আপনার সিএনজি সঙ্গে আছে?’
‘আছে’, কালাম মিয়া বললেন। কালাম মিয়াকে এক হাতে ধরে গলিতে পা রাখল জামিলা। তাড়াহুড়ার জন্য আমরা জামিলার মুখটা দেখতে পেলাম না। কিন্তু কালাম মিয়ার মুখে একটা হালকা ভরসার হাসি দেখতে পেলাম। তবে গলির লোকজনের মতো আমরাও সে হাসিটা পড়তে পারলাম না।
৩. একটা বাসে উঠে জামিলা মাথাটা ঠান্ডা করল। মাথা ঠান্ডা করার চর্চাটা সে শিখেছে মায়ের কাছ থেকে। ঠান্ডা মাথায় সে ভাবল। না, বাবার শত্রু নেই, লোকজন তাঁকে পছন্দই করে। তাঁর টাকাপয়সাও তেমন নেই। বেআইনি কিছুও তিনি করেন না। বড় ভাইটা শত্রু-টত্রুর চিন্তা থেকেই খোঁজে নেমেছে। কেন, সে-ই জানে। সৎমা গেছেন এক নারীর খোঁজে, যে তার মতোই টার্গেট করেছিল জামিলার বাবাকে। বাবা দেখতে-শুনতে ভালো। জামিলাও বাবার মতোই। সৎমা জানেন, ওই মেয়েটি শেষমেশ তার কাছে হেরে গেলেও আশা ছাড়েনি, একদিন সে দেখেছে, রাস্তায় দাঁড়িয়ে মেয়েটা হেসে কথা বলছে তার স্বামীর সঙ্গে। জামিলাকে মারলেও সৎমা আসলে ভিতু টাইপেরই। স্বামীকে তিনি যথেষ্ট ভয় পান। সে জন্য তাঁকে জিজ্ঞেস করার সাহস হয়নি। জামিলা ভেবেছে, ঢাকা মেডিকেলে খোঁজ নেবে প্রথম। তারপর আরও দু-তিন হাসপাতালে। জামিলা ঠিকই ভেবেছে। ঘণ্টা খানেক খোঁজাখুঁজি করে সে একটা ওয়ার্ডে তার বেহুঁশ বাবাকে আবিষ্কার করল। হাতে-মাথায় ব্যান্ডেজ। এক নার্সের পেছনে কিছুক্ষণ লেগে থেকে জানল, হুঁশ আসার সম্ভাবনা আছে, তবে তার জন্য বাইরে থেকে ওষুধ আনতে হবে। নার্স তাকে জিজ্ঞেস করল, কীভাবে হাসপাতালে ঢুকল সে। এখন তো ঢোকার সময় না। জামিলা দূরে এক ওয়ার্ডবয়কে দেখিয়ে বলল, ‘ওই ভাই ঢুকতে দিছেন।’ বয়ের দিকে তাকিয়ে নার্স বলল, ‘লোকটা বদ। তুমি আমার সঙ্গে চলো।’ নার্স তাকে গেট পর্যন্ত এগিয়ে দিল। কিন্তু রাস্তা পর্যন্ত যাওয়া হলো না জামিলার, বদ ওয়ার্ডবয়টা তাকে ধরে ফেলল। হাত থেকে ওষুধের নাম লেখা কাগজটা নিয়ে বলল, ‘এই ওষুধের দাম আট শ টাকার কম না। তোমার পয়সা আছে?’ জামিলা হাত বাড়িয়ে কাগজটা ছিনিয়ে নিল। বয়টা বলল, ‘ওষুধটা আমি তোমারে দিমু।’ জামিলা অবাক হয়ে তাকাল। বয়টা বলল, ‘ওইহানে আমার ঘরত ওষুধ আছে। চলো।’ জামিলা বলল, ‘আপনার ঘরে আপনি যান। গিয়া শুইয়া থাহেন।’ তারপর জোরে পা চালাল সে। বুঝল, তার জন্য শনির আখড়ার ঘরের ভেতরটার সঙ্গে বাইরের জগতের কোনো তফাত নেই। তার চোখ হঠাৎ জলে ভরে গেল। চোখ দুটো পুড়তে থাকল। সেই জলে ভরা পুড়তে থাকা চোখ নিয়ে সে দাঁড়াল বাসস্টপে। কালাম মিয়া যখন তাকে দেখেন, পুড়তে পুড়তে চোখের জল শুকিয়েছে জামিলার। তিনি জামিলার চোখে আগুন দেখলেন। আমরা দেখলে অবশ্য আগুনটা আমাদের চোখে ধরা পড়ত না। কালাম মিয়ার হঠাৎ কী যে হলো, তিনি সিএনজিটা থামালেন। যাত্রীকে বললেন, ‘স্যার, নামতে হবে। একটু সমস্যা হচ্ছে।’ যাত্রী নেমে পয়সা না দিয়ে হাঁটা দিলেন। বাসটা ছাড়লে সিএনজি নিয়ে তার পিছু নিলেন কালাম মিয়া। বাস বদলাল জামিলা। সেই বাসের পেছন পেছনও তিনি গেলেন। জামিলা ধনু মিয়ার গলিতে ঢুকল। তিনিও ঢুকলেন। জামিলাকে আড়াল দিল তাঁর সিএনজি। ফার্নিচার দোকানের ধূর্ত লোকের চোখটাও বুঝল না, জামিলা তাকে ফাঁকি দিল। জামিলার বাসাটা দেখে গেলেন কালাম মিয়া।
৪. মাস খানেক পর জামিলার চোখটা কলাম মিয়ার স্বপ্নে হানা দিল। স্বপ্নেই খুব আনন্দ পেলেন তিনি। কিন্তু কেন জানি তাঁর একটু আতঙ্কও হলো। তাঁর মনে হলো, কোথায় যেন একটা সর্বনাশ ঘাপটি মেরে আছে। সেটি যখন সক্রিয় হবে, একটা ঘূর্ণি হয়ে ছুটবে, সেই ঘূর্ণিতে কি জামিলা পড়বে?
স্বপ্নে তিনি সর্বনাশের ঘূর্ণি দেখলেন। আগুনও দেখলেন। জেগে উঠে ভাবলেন, কিছু একটা করতে হবে। কী করতে হবে, ভাবতে ভাবতে বিকেল হয়ে গেল। বিকেলে তিনি সিএনজি নিয়ে ছুটলেন ধনু মিয়ার গলিতে। যেতে যেতে একটা সাহস এল তাঁর মনে। জামিলা পারবে। সর্বনাশের ঘূর্ণি তাকে টেনে তার গভীরে নিতে পারবে না। দরজায় টোকা পড়লে জামিলার বাবাই খুললেন, ‘কী চাই?’ জানতে চাইলেন তিনি। কালাম মিয়া বিপদে পড়লেন। ‘মেয়েটা আপনার কে?’
‘কোন মেয়েটা?’
কীভাবে বোঝাবেন মেয়েটা কে—ভাবতে ভাবতেই জামিলাকে পেছনে দেখা গেল। হাতে একটা চা-ভর্তি গ্লাস। কালাম মিয়া জামিলাকে আঙুল তুলে দেখালেন।
‘কী চান আপনে? আমার মাইয়ার তালাশ করেন ক্যান?’
জামিলার বাবার একটা হাত এখনো গলায় টানানো গুলতিতে ঝুলছে। অন্য হাতটাও বেশ দুর্বল। সেই দুর্বল হাত তুলেই তিনি তেড়ে গেলেন কালাম মিয়ার দিকে। কালাম মিয়ার মুখের কথা বন্ধ হয়ে গেল। স্পষ্টতই তিনি ভড়কে গেছেন। তিনি বিড়বিড় করে বললেন, ‘মেয়েডার একটা বিপদ সম্পর্কে জানাইতে আইছি’—বা এ রকম কিছু। কথাটা তিনি শেষ করতে পারলেন না, অর্ধেকটাও শোনাতে পারলেন না। এতে বিপদ যা হলো, এই বিড়বিড় করে বলা কথাগুলো জামিলার বাবার কানে শোনাল ‘মেয়েডার জন্য একটা সম্পর্ক নিয়া আইছি।’ তাঁর মাথায় বিদ্যুৎ খেলে গেল। এবার দুর্বল হাতটা দিয়েই ধাক্কা দিলেন কালাম মিয়াকে। কালাম মাটিতে পড়লেন। প্রতিবেশী মোমেনা বানুর স্বামী ছুটে এল। ‘কী অইছে ভাইজান? লোকটা কে?’ সে জিজ্ঞেস করল। ‘হারামজাদা, আমার মাইয়ারে বিয়া করতে চায়।’ জামিলার বাবা বললেন এবং কালাম মিয়ার দিকে তাকিয়ে হুংকার দিলেন, ‘তোর বিয়া করার খায়েশ মিটামু।’ খায়েশ মেটানোর কাজটা অবশ্য মোমেনার স্বামীই শুরু করল। কালাম অবাক চোখে তাকালেন লোকটার দিকে, ‘ভাই, আমারে মারেন কেন? আমি তো মাইয়াডারে...’
এবারও তিনি বাক্যটা শেষ করতে পারলেন না; বরং যা করলেন, তিন-চারজন মানুষের কাছে প্রমাণই করে ফেললেন, তিনি জামিলাকে বিয়ে করার প্রস্তাব নিয়ে এসেছেন। মোমেনার স্বামী অবশ্য দু-একটা কিলঘুষি মেরে ছেড়ে দিত। কিন্তু দৃশ্যে এবার ঢুকল ওই ফার্নিচার দোকানের ম্যানেজার মিজু মিয়া। সে দোকান থেকে বাড়ি যাচ্ছিল। জটলা দেখে এগিয়ে এসে শুনল, কালাম মিয়া জামিলার জন্য বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে এসেছে। শুনেই তার রাগ চড়ল। কালামকে দু-ঘা মেরে জামিলার বাবাকে সে বলল, ‘আমার প্রস্তাবটা তো ভালো লাগল না। এখন এই সব লাফাঙ্গা লোকরে সামলান।’ জামিলা তার বাবাকে বলল, ‘আব্বা, কাজটা ঠিক হইতেছে না। লোকটারে বাঁচান।’ এই ছোট আবদারে বাবার মারের হাত উঠল জামিলার ওপর। মেয়ের গালে চড় মেরে তিনি একটা গালি দিলেন। গালিটা শুনলে সভ্য সমাজের গাল লাল হবে। এবং বললেন, ‘এইটা কইত্থে জুটাইছিস?’ তারপর মেয়েকে ধাক্কা দিয়ে ঘরের দরজায় নিয়ে বললেন, ‘এই যে মিজু মিয়া, এই ফকিরটার থাইকা মিজু মিয়াও তো ভালো।’ তাঁর রাগ আকাশ ছুঁয়েছে। কাঁপতে কাঁপতে মিজুকে তিনি বললেন, ‘লাফাঙ্গা সামলানো আমার কাম না। আইও, কাইল আইও। কথা কমু। মুরুব্বি নিয়া আইও।’ ফার্নিচার দোকানের ম্যানেজার মিজু মিয়া নিজের কানকেও বিশ্বাস করতে পারল না। তবে সে বুঝল, এটি তার যথাসময়ে যথাপাত্রে বিনিয়োগের ফসল। জামিলার বাবার চিকিৎসার জন্য সে যে যথেষ্ট টাকা দিয়েছে তার ভাইকে, জামিলার বাবা সেটি জানেন। হয়তো তিনি এভাবেই তা ফেরত দিচ্ছেন। মিজু এবার আনন্দে-উৎসাহে কালাম মিয়াকে পেটাতে লাগল। প্রথমে হাত দিয়ে, পরে কালাম মিয়া মাটিতে লুটিয়ে পড়লে, পা দিয়ে। কালাম ভাবলেন, তিনি হয়তো জীবন নিয়ে ফিরতে পারবেন না। তিনি চোখ বন্ধ করলেন, অথবা করতে গেলেন। কারণ, তখনই তিনি দেখলেন জামিলাকে—জামিলার চোখ দুটি। আগুন। তিনি কিছুটা স্বস্তি পেলেন। তারপর চোখ বুজলেন। তখনই ঘটল ঘটনাটা, যা কালাম মিয়া তার স্বপ্নেও ভাবতে পারতেন না। জামিলা দরজায় দাঁড়িয়ে তাকিয়েছে মিজু মিয়ার দিকে। মিজু মিয়ার চোখ হাসছে—বিজয়ে, তৃপ্তিতে। কিন্তু সেই হাসিটা থামিয়ে, তৃপ্তি ছারখার করে একটা আগুনের নাচন শুরু হলো তার চারদিকে। প্রথমে সে আগুন জাপটে ধরল তার হাত। তারপর তার ধর্ম মেনে উঠল ওপরের দিকে। উঠতে উঠতে শুধুই পোড়াল তাকে। শেষে চুল খামচে ধরল, মিজু পা হড়কে মাটিতে পড়ল। লোকজন আতঙ্কে চিৎকার করতে করতে পালাল। মোমেনা বানু এক কলসি পানি ঢাললেন মিজু মিয়ার ওপর। আগুন নিভল। কিন্তু আগুন এবার জামিলার বাবার সামনে কিছুক্ষণ নাচল, তারপর ছুটল মোমেনার স্বামীর দিকে। মোমেনা ঘরে ঢুকে আরেক কলস পানি নিয়ে ছুটলেন স্বামীর পেছন পেছন ছুটতে থাকা আগুনের পেছনে। জামিলা চোখ বন্ধ করল। তারপর কালাম মিয়ার সামনে হাঁটু গেড়ে বসে তাঁকে টেনে তুলল। ‘আপনি কে?’ সে জিজ্ঞেস করল। ‘আমার নাম আবুল কালাম মিয়া। আমি সিএনজি চালাই। তোমারে জানাইতে আইছিলাম, মামণি, তোমার চক্ষে আগুন আছে। সেইটা ব্যবহার করো। তোমার দুঃখ থাকব না।’ জামিলা হাসল। ‘না থাকব না,’ আস্তে করে সে বলল, তারপর উঠে ঘরের ভেতর ঢুকল। মিনিট তিনেকের মধ্যে ফিরল সে, হাতে একটা ছোট ব্যাগ। কালাম মিয়া উঠে দাঁড়িয়ে নিজেকে গোছাচ্ছিলেন। জামিলাকে দেখে বললেন, ‘কই যাবা?’
‘জানি না’, সে বলল, ‘আপনার সিএনজি সঙ্গে আছে?’
‘আছে’, কালাম মিয়া বললেন। কালাম মিয়াকে এক হাতে ধরে গলিতে পা রাখল জামিলা। তাড়াহুড়ার জন্য আমরা জামিলার মুখটা দেখতে পেলাম না। কিন্তু কালাম মিয়ার মুখে একটা হালকা ভরসার হাসি দেখতে পেলাম। তবে গলির লোকজনের মতো আমরাও সে হাসিটা পড়তে পারলাম না।
No comments