রোবট যুগের উন্মেষ by হাসনাইন মেহেদী
বেড়ে
উঠতে উঠতে আমার বিশ্বাস ছিল দ্রুতই আমাদের সবার কাছে থাকবে রোবট। অনেকটা
টিভি অনুষ্ঠান ‘দ্য জেটসনস’-এর রোজির মতো। আমাদের দেখাদেখি ঘরদোর পরিষ্কার
পরিচ্ছন্ন করছে। গৃহস্থালি কাজ করছে। দ্য জেটসনসের কথা যাদের তেমনটা মনে
নেই বা পরিচিত নন তাদের জ্ঞাতার্থে- রোজি হলো পরিবারের জন্য গৃহস্থালি
এড্রয়েট রোবট গৃহপরিচারিকা। ধারণাটা হলো, থালাবাসন পরিষ্কার করে বা কাপড়
চোপড় ভাঁজ করে মানুষ কেন সময় নষ্ট করবে। আমি একটা ড্রয়েড বন্ধু চাইতাম।
স্টার ওয়ার্সে লিউক স্কাইওয়াকারের সি-৩পিও’র মতো। বা রোজির মতো। কিন্তু
রোজি কখনও আসেনি। আমি যা পেয়েছি তা হলো স্বয়ংক্রিয় একটি ভ্যাকুয়াম ক্লিনার-
রুম্বা। আর বাজারে সি-৩পিও’র সব থেকে কাছাকাছি যেটা পাওয়া যায় তা হলো
সিরি। অ্যাপলের আইওএস অপারেটিং সিস্টেমের জন্য তৈরি একটি ডিজিটাল
অ্যাসিস্টেন্ট অ্যাপ্লিকেশন। সিরি আকর্ষণীয় তবে খুব যে চতুর তা নয়।
ভাসাভাসা সক্ষমতার বাইরে আলাপ-আলোচনা চালানোর ক্ষেত্রে সিরির সীমাবদ্ধতা
রয়েছে। ব্যাখ্যা বিশ্লেষণের এ তথ্য প্রযুক্তির যুগে আমরা এখনও অনেক দূরে
রয়েছি যেখানে রোবট আমাদের সঙ্গে কথা বলতে পারবে। আমাদের বাড়িঘর পরিচ্ছন্ন
রাখতে সাহায্য করতে পারবে। বা কাঠামোবিহীন কাজগুলো সম্পাদন করতে পারবে।
‘ডারপা রোবোটিকস চ্যালেঞ্জ’র ভিডিওগুলো যদি আপনি দেখে থাকেন তাহলে হয়তো
আপনার বিশ্বাস হবে যে বাস্তব জীবনে আমরা কখনও রোজির মতো রোবট নাও দেখতে
পারি। রোবটগুলোকে একটি সৃষ্ট বিপর্যয় পরিস্থিতির শিকার এলাকায় ৮টি কাজ করার
চ্যালেঞ্জ দেয়া হয়। এসব কাজের মধ্যে ছিল গাড়ি চালানো, ধ্বংসস্তূপের মধ্য
দিয়ে হাঁটা, সার্কিট ব্রেকার বন্ধ করা, ভালভ ঘুরিয়ে দেয়া আর সিঁড়ি বেয়ে
ওঠা। বিশ্বের সেরা রোবট বিশেষজ্ঞদের সর্বোচ্চ প্রচেষ্টা সত্ত্বেও রোবটগুলো
ছিল ধীরগতির এবং আনাড়ি। তারা বারবার হোঁচট খেয়ে পড়ে গেছে। আর নড়াচড়া করেছে
কচ্ছপের গতিতে। মূলত আমরা মানুষেরা যেসব কাজকে নীরস বলে মনে করি কোন রোবটই
সেসব কাজ দ্রুত করতে পারে না। কাপড়ের বালতি থেকে একটি তোয়ালে উঠিয়ে সুন্দর
করে ভাঁজ করে রাখতে এখনও রোবটগুলোর বেগ পেতে হয়। কাজেই মনে হয় এসব
ড্রয়েডগুলো এখনও মানুষের কাজ বা চাকরির জন্য হুমকি হয়নি। আর কোন দেশের
ত্রাতা হওয়া তো দূরে থাক। কিন্তু ডারপা চ্যালেঞ্জ দেখার পর এবং কম্পিউটিং,
কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা আর সেন্সর প্রযুক্তির দ্রুত অগ্রগতি প্রত্যক্ষ করার পর
আমি দেখছি রোজির বাস্তবে আসাটা খুবই নিকটে। এসব প্রযুক্তিগুলোর অগ্রগতি
হচ্ছে অত্যন্ত দ্রুত। আর এমন প্রযুক্তিগুলো বিভ্রান্তিমূলক হয়ে প্রতীয়মান
হতে পারে। প্রথমে অগ্রগতি হয় খুব ধীরগতিতে। কিন্তু এরপর হতাশা পরিণত হয়
বিস্ময়ে। আমার বিশ্বাস আগামী ৫-১০ বছরে রোবোটিকসেও এমনটাই ঘটবে। রোবোটিকসের
হার্ডওয়্যার ও সফটওয়্যারে অসাধারণ অগ্রগতি হয়েছে। এর পেছনে আংশিক কারণ হলো
ব্যয় কমে যাওয়া। বেশির ভাগ রোবটের হার্ডওয়্যায়ের একটি অংশ-
‘সিঙ্গেল-এক্সিস কন্ট্রোলার’-এর দাম ১ হাজার ডলার থেকে কমে ১০ ডলারে
দাঁড়িয়েছে। আর সিঙ্গুলারিটি বিশ্ববিদ্যালয়ের শীর্ষ নির্বাহী রব নেইলের
বক্তব্য অনুযায়ী, দিকনির্দেশনা এবং প্রতিবন্ধকতা এড়ানোর জন্য যেসব সেন্সর
রয়েছে তার মূল্য ৫ হাজার ডলার থেকে ১০০ ডলারেরও কম হয়েছে। আরেকটি
উল্লেখযোগ্য বিষয় হলো ডারপা চ্যালেঞ্জে কোর্স সম্পন্ন করেছে তিনটি দল। আর
এদের প্রত্যেকের নকশা ভিন্ন। এটা ২০০৪ সালে ডারপা গ্রান্ড চ্যালেঞ্জ থেকে
অনেক ভালো ফল। সেবার স্বেচ্ছাচালিত কোন গাড়ি যাত্রাপথ সম্পন্ন করার ধারে
কাছেও আসতে পারেনি। মাত্র ১১ বছর পর এখন স্বেচ্ছাচালিত যান ৮টি অঙ্গরাজ্যে
বৈধ। আর সমুদ্রসৈকত এলাকার রাস্তাগুলোতে এটা খুবই পরিচিত একই চিত্র।
অগ্রগতি কতটা দ্রুত হবে তা নিয়ে ধারণা পাওয়া যেতে পারে ড্রোনের জগৎ থেকে।
এক দশকেরও কম সময় আগে সত্যিকারের সক্ষমতাসহ ড্রোনগুলো ছিল ব্যয়বহুল। আর
আকারে অনেক বড় এবং উড়াতে কঠিন। এখন, সাধারণ মানুষের ব্যবহার্য ড্রোনগুলোর
সক্ষমতা মার্কিন সেনাবাহিনী ব্যবহৃত ব্যয়বহুল চালকবিহীন আকাশযানের সক্ষমতা
ছুঁয়ে ফেলা শুরু করেছে। শেনজেন-ভিত্তিক ডিজেআই ইনোভেশনস-এর মতো
প্রতিষ্ঠানগুলো মিলিটারি ড্রোনের সমান সক্ষমতা সহ ড্রোন বিক্রি করছে ১
হাজার ডলারেরও কমে। এসব চীনা প্রতিষ্ঠানগুলো প্রতিযোগিতা করছে বিশ্বজুড়ে
সৌখিন ড্রোন নির্মাতাদের অপেক্ষাকৃত সস্তা ড্রোনগুলোর সঙ্গে। এসব সৌখিন
নির্মাতারা অনলাইন কমিউনিটিতে তাদের নকশা বিনামূল্যে শেয়ার করে থাকে। এটা
নির্দ্বিধায় বলা যায় যে, ড্রোন হলো ইতিহাসের প্রথম প্রযুক্তি যেখানে খেলনা
শিল্প আর সৌখিনেরা সামরিক-শিল্প মহলকে তাদের নিজেদের খেলাতেই পরাজিত করছে।
এসব ব্যক্তিগত ড্রোনগুলোর সবকিছু করার সক্ষমতা রয়েছে যা সামরিক ড্রোনগুলো
করতে পারে। শুধুমাত্র বিস্ফোরণ ঘটানো ছাড়া! রোবটের আগে যে ড্রোন তৈরিতে
ব্যয় কমেছে আর স্বাধীনতা এসেছে তাতে বিস্মিত হওয়ার কিছু নেই।
আধা-স্বয়ংক্রিয় দোপেয়ে রোবটকে তার নিজের পায়ে দাঁড়ানোর জন্য প্রয়োজন হয়
ব্যাপক কোডিং। তাছাড়া, পারিপার্শ্বিক পরিবেশ শনাক্ত করার বিষয় তো রয়েছেই।
এলোমেলো, ছড়ানো ছিটানো এবং নিয়ত পরিবর্তনশীল পরিবেশের মধ্যে চলাফেরা করার
মতো কাজগুলো মানুষ করে থাকে ছেলেবেলা থেকেই। কিন্তু রোবটদের সেগুলো হুবহু
নকল করতে বেগ পেতে হয়। আর এধরনের কাজের সক্ষমতা দেয়ার জন্য যে ধরনের
প্রোগ্রামিং প্রয়োজন তা অত্যন্ত ব্যয়বহুল। কণ্ঠ শনাক্তকরণ (ভয়েস
রিকগনিশন)-এর ক্ষেত্রে আমরা ইতিমধ্যে সি-৩পিও ধরনের সক্ষমতার কাছাকাছি চলে
এসেছি। অ্যাপল ও গুগল উভয় প্রতিষ্ঠানই কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা নিয়ে বক্তব্য
থেকে লেখায় রূপান্তর করার মতো দারুণ সব কাজ করাতে সক্ষম হচ্ছে। এমনকি
শব্দমুখর পরিবেশের মধ্যেও সফলভাবে বক্তব্য শনাক্ত করতে পারে প্রোগ্রামগুলো।
কোন রোবট এখনও টুরিন টেস্ট পাস করতে পারেনি ঠিকই। কিন্তু তারা ক্রমেই আরও
কাছে যাচ্ছে। আর যখন সেটা ঘটবে তখন আপনার ড্রয়েড মানুষের মতো করেই জটিল সব
আলাপচারিতা চালাতে পারবে আপনার সঙ্গে। রোবটদের দিয়ে এ ধরনের জটিল কাজ
সম্পন্ন করাতে প্রয়োজনীয় ‘কম্পিউটেশনাল’ ক্ষমতার এখনও অভাব রয়েছে। তারপরও
বিবেচনা করুন, এই ৭-৮ বছর পর আপনার আইফোনের ‘কম্পিউটেশনাল’ ক্ষমতা থাকবে
মানব মস্তিষ্কের মতো। আপনি সহজেই বুঝতে পারছেন আমরা কোনদিকে এগুচ্ছি। রোবট
মানুষের মতো হাঁটতে আর কথা বলতে সক্ষম হবে। এখন যেখানে সিঁড়ি বেয়ে উঠতে
গিয়ে পা থেমে যাচ্ছে, পরবর্তী ডারপা চ্যালেঞ্জে সেটা নিশ্চিতভাবে হবে সঠিক
পদক্ষেপে সিঁড়ি বেয়ে ওপরে ওঠা। আর হ্যাঁ, রোজি মানুষের অনেক কাজ করতে সক্ষম
হবে। সেটা একদিকে যেমন উদ্বিগ্ন হওয়ার কারণ অপরদিকে আনন্দ করার। ভালো
দিকটা হলো, আমরা যেসব কাজ করতাম রোজি সেটা করবে আরও দ্রুত ও আরও কম খরচে।
প্রত্যেকের তার নিজ জীবন উপভোগ করতে আরও বেশি সময় থাকবে। আরও বেশি সময়
থাকবে তাদের সৃষ্টিশীল অনুরাগের ওপর মনোযোগ দিতে। এটা খুব সহজে বলে ফেললাম
বলে মনে হলেও, আমি সত্যিকার অর্থে এটা বিশ্বাস করি যে, হাজারো রোজিতে পূর্ণ
এক বিশ্ব পরিণত হবে আরও সমৃদ্ধির সুযোগে। আর আমরা মানুষদের ওপর থাকবে কম
চাপ। কাউকে আর লন্ড্রির কাপড় ভাঁজ করতে হবে না।
[ওয়াশিংটন পোস্টে প্রকাশিত ‘ওয়েলকাম টু দ্য ডন অব দ্য এজ অব রোবটস’ শীর্ষক লেখার অনুবাদ। মূল প্রবন্ধের লেখক বিবেক ওয়াধ্যা স্ট্যানফোর্ড ইউনিভার্সিটির রক সেন্টার ফর কর্পোরেট গভার্নেন্সের একজন ফেলো, ডিউক ইউনিভার্সিটির সেন্টার ফর এন্ট্রেপ্রেনিউরশিপ অ্যান্ড রিসার্চ কমার্শিয়ালাইজেশনের গবেষণা বিষয়ক পরিচালক এবং সিঙ্গুলারিটি ইউনিভার্সিটির সম্মানিত ফেলো । ]
[ওয়াশিংটন পোস্টে প্রকাশিত ‘ওয়েলকাম টু দ্য ডন অব দ্য এজ অব রোবটস’ শীর্ষক লেখার অনুবাদ। মূল প্রবন্ধের লেখক বিবেক ওয়াধ্যা স্ট্যানফোর্ড ইউনিভার্সিটির রক সেন্টার ফর কর্পোরেট গভার্নেন্সের একজন ফেলো, ডিউক ইউনিভার্সিটির সেন্টার ফর এন্ট্রেপ্রেনিউরশিপ অ্যান্ড রিসার্চ কমার্শিয়ালাইজেশনের গবেষণা বিষয়ক পরিচালক এবং সিঙ্গুলারিটি ইউনিভার্সিটির সম্মানিত ফেলো । ]
No comments