যন্ত্রণা এখনো সঙ্গী by আনোয়ার হোসেন
‘আজাদ
ছিল বেশ আমোদপ্রিয়। এ জন্য আমাদের বিয়েটা হয়েছিল ১৯৯৫ সালের থার্টি
ফার্স্ট নাইটে। এক মেয়ে ও এক ছেলে এল সংসারে। আনন্দেই দিন কাটছিল। কিন্তু
এক বিকেলেই সব অন্ধকার হয়ে গেল। এখন আছে কেবল স্মৃতি, আজাদের ক্ষতবিক্ষত
দেহের ছবি আর রক্তমাখা জামা।’
কথাগুলো মাকসুদা আজাদের। কান্না থামিয়ে দিল তাঁর কথা। পাশে বসা শাশুড়ি আনোয়ারা বেগম, মেয়ে মাহফুজা আজাদ ও ছেলে আল আমিন আজাদও কান্না চেপে রাখতে পারল না। স্মৃতি মনে করে তাঁর জন্য তিন প্রজন্মের অঝোর কান্না।
আজাদের পুরো নাম আবুল কালাম আজাদ। ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউয়ে গ্রেনেড হামলায় নিহত ২২ জনের একজন তৎকালীন ১৫ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক। নিহত অন্যদের মতো তাঁর স্বজনেরাও প্রিয় মানুষকে হারানোর শোক-ব্যথা বয়ে বেড়াচ্ছেন, আঁকড়ে আছেন স্মৃতি। আর ওই হামলায় আহত অনেক নেতা-কর্মীর এখনো সঙ্গী দুঃসহ যন্ত্রণা। কারও পা অচল, কেউ হারিয়েছেন চোখ, কেউ শ্রবণশক্তি। ওই হামলায় আহত হয়েছিলেন বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও।
নিহত ব্যক্তিদের স্বজন ও আহত কয়েকজন বলেছেন, ওই গ্রেনেড হামলায় আহত ব্যক্তিদের আওয়ামী লীগ থেকে চিকিৎসা খরচসহ এককালীন ও মাসিক ভাতা দেওয়া ছাড়াও চিকিৎসা করানো হয়। ২০১৩ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিহত ব্যক্তিদের স্বজনদের ও আহত ব্যক্তিদের ১০ লাখ টাকা করে সঞ্চয়পত্র দেন। এ থেকে মাসে ১০ হাজার ৭০০ টাকা আসে। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মেমোরিয়াল ট্রাস্ট থেকে দেওয়া হয় মাসে পাঁচ হাজার টাকা। নিহত কয়েকজনের স্বজন বললেন, সরকার একটু মাথা গোঁজার ঠাঁই করে দিলে সবচেয়ে উপকার হয়।
সেই দিনের কথা: আজাদের মা, স্ত্রী ও দুই সন্তান থাকে বালুঘাটের বারানটেকে। মিরপুর উড়ালসড়ক দিয়ে মানিকদী গিয়ে ভাঙা সড়ক ধরে এগোলে বালুঘাট বাজার, সেখান থেকে বেশ কিছুটা গেলে বারানটেকে আজাদদের বাড়ি। গত বুধবার ওই বাড়িতে গিয়ে প্রথমেই চোখে পড়ে আজাদের মা বৃদ্ধা আনোয়ারা বেগম ছেলের বাঁধানো একটা ছবিতে পরম মমতায় হাত বোলাচ্ছেন। ছেলের কথা জানতে চাইলে ফুঁপিয়ে কাঁদতে থাকেন। একপর্যায়ে বলেন, ‘ওই দিন যে জামাকাপড় পরে আজাদ সমাবেশে গিয়েছিল, সেগুলো যত্ন করে রেখেছি। এগুলোতে অসংখ্য ছোট ছোট ছিদ্র। স্প্লিন্টারগুলো ঢোকার সময় কত কষ্টই না পেয়েছে আমার সোনার চান।’ স্বামীর ভিটায় একতলা বাড়ির একাংশে তিনি আজাদের বিধবা স্ত্রী মাকসুদা ও দুই সন্তান মাহফুজা ও আল আমিনকে নিয়ে থাকেন। আনোয়ারার আরও তিন ছেলে ও দুই মেয়ে আছে।
বাবাকে হারানোর সময় মাহফুজার বয়স ছিল পাঁচ বছর, আল আমিনের দুই বছর। মাহফুজা এখন বিএএফ শাহীন স্কুল অ্যান্ড কলেজের দশম শ্রেণির ছাত্রী। ২০০৪ সালের ওই দিনটি সম্পর্কে সে প্রথম আলোকে বলে, ‘আমি তখন মানিকদী গ্রিন হ্যাভেন কিন্ডারগার্টেন স্কুলে নার্সারিতে পড়ি। স্কুল শেষে বেরিয়ে দেখি, বাবা ছোট ভাইকে কোলে নিয়ে গেটে অপেক্ষা করছেন। বাসায় আসার পথে বাবা আমাকে একটা পুতুল কিনে দেন। এটাই বাবার দেওয়া শেষ উপহার।’ বলতে বলতে ফুঁপিয়ে ওঠে মাহফুজা।
মাকসুদা বলেন, ‘সেদিন সন্ধ্যার দিকে টিভিতে দেখি আওয়ামী লীগের সমাবেশে বোমা হামলা হয়েছে। তখনই মনটা ছ্যাঁৎ করে ওঠে। আজাদ তো আওয়ামী লীগের সমাবেশ মিস করে না। শাশুড়িকে বললাম পাড়ায় খোঁজ নেন। অনেকে জানাল, আজাদ সমাবেশে গেছেন। সর্বনাশ হয়ে গেছে ভেবে আমি প্রায় অজ্ঞান। এরপর তো ঘটেই গেল।’
গ্রেনেড হামলার পর আজাদ হতাহত অসংখ্য মানুষের মধ্যে উপুড় হয়ে পড়ে ছিলেন। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়ার পর মৃত ভেবে তাঁকে মর্গে নিয়ে যাওয়ার প্রস্তুতির সময় নড়ে ওঠেন। তখন ওই হাসপাতালে চিকিৎসা দেওয়া হয়। খবর পেয়ে ছুটে যান স্বজনেরা। পরে তাঁকে মেট্রোপলিটন হাসপাতালে নেওয়া হয়। চোখ খোলা থাকলেও ছিলেন নির্বাক, অচেতন। ওই অবস্থায় বেঁচে ছিলেন ১০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত। স্বজনেরা গ্রেনেডে ক্ষতবিক্ষত দেহটা দেখেছেন, কিন্তু কথা বলতে পারেননি।
আজাদের স্ত্রী বলেন, ‘দল (আওয়ামী লীগ) ও শেখ হাসিনা আর্থিক সহায়তা করেছেন। অবস্থার সামান্য উন্নতি হলে আজাদকে উন্নত চিকিৎসা করানোর প্রতিশ্রুতিও দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু উন্নতি হয়নি। আসলে আমার ভাগ্যই খারাপ। সবার সহানুভূতিই পাচ্ছি। কিন্তু স্বামীকে তো পাচ্ছি না। সন্তানেরা বাবা ডাকতে পারছে না।’
বিয়েবার্ষিকী করা হয়নি আইরিনের: মোস্তাক আহমেদ (সেন্টু) ও আইরিন সুলতানার বিয়েবার্ষিকী ২২ আগস্ট। ঘরোয়া হলেও প্রতিবছরই দিনটি পালন করতেন এই দম্পতি। ২০০৪ সালেও কিছু প্রস্তুতি ছিল তাঁদের। কিন্তু ২১ আগস্টের বিকেলেই সব শেষ হয়ে যায়। গ্রেনেড কেড়ে নেয় স্বামীকে।
আইরিন বলেন, ‘সাত বছরের সংসার। রাত ১২টার পর বিয়েবার্ষিকী। ঘটনার দিন বিকেলেও আমাকে বলে গেল, তুমি প্রস্তুতি নিয়ে রেখো। আমি আগে আগেই বাসায় আসব। কিন্তু তাঁর আর আসা হলো না। বিয়েবার্ষিকী আর স্বামীর মৃত্যুবার্ষিকী এখন একাকার।’ তিনি বললেন, মোস্তাক আহমেদ ছিলেন আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় উপকমিটির সহসম্পাদক। ছাত্রজীবন থেকেই রাজনীতি করতেন। ২০০৪ সালের ১৫ আগস্ট গ্রামের বাড়ি বরিশালে ত্রাণ কার্যক্রম পরিচালনা করে ২০ আগস্ট ঢাকায় ফিরেছিলেন। ২১ আগস্ট দুপুরের পরই বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউয়ের সমাবেশে যোগ দেন।
আইরিন বলেন, গ্রেনেড হামলা হওয়ার পর তিনি স্বামীর খোঁজে প্রথমে ঢাকা মেডিকেলে যান। সেখানে না পেয়ে এদিক-ওদিক ছোটাছুটি করেন। এরপর খবর পান, পঙ্গু হাসপাতালে আছেন। কিন্তু মারা গেছেন তা জানতেন না। রাত নয়টায় পঙ্গু হাসপাতালে গিয়ে জেনেই জ্ঞান হারান।
মোস্তাক ও আইরিন দম্পতির একমাত্র সন্তান আফসানা আহমেদ। চার বছর বয়সেই বাবাকে হারানো আফসানা এখন আইডিয়াল স্কুলের অষ্টম শ্রেণির ছাত্রী।
আইরিন আহমেদ বলেন, ‘মেয়েটা এখন সবই বোঝে। তবে সেদিনের স্মৃতি মনে করতে পারে না। আমরাও তাকে মনে করাই না। কারণ, আমাদের মনে যে ব্যথা, সেটা তার মধ্যে সংক্রমিত হোক তা চাই না।’
মোস্তাক আহমেদের মা অন্য ছেলেদের সঙ্গে থাকেন। আইরিন মেয়েকে নিয়ে থাকেন তাঁর বাবা-মায়ের সঙ্গে। স্বামীর মৃত্যুর পর আইরিন মার্কেন্টাইল ব্যাংকে চাকরি পেয়েছেন।
দৌলতুন্নাহার অনেকটা ঘরবন্দী: ওই গ্রেনেডে হামলায় বাঁ চোখের দৃষ্টি হারিয়েছেন দৌলতুন্নাহার। পা দুটিতে অসংখ্য স্প্লিন্টারের দাগ, দুটি গভীর ক্ষতচিহ্ন। তাঁর সঙ্গে কথা হয় পল্লবীর বাসায়। একেবারে অচল হয়ে যাননি। তবে অনেকটাই ঘরের মধ্যে বন্দী। তিনি বললেন, গ্রেনেডের স্প্লিন্টার বাঁ চোখে লাগার পরই তিনি আওয়ামী লীগ কার্যালয়ের সামনের ড্রেনে পড়ে যান। এরপর আর কিছু মনে নেই। লাশের সঙ্গে তাঁকে মর্গে ফেলে রাখা হয়েছিল। মর্গ থেকে তাঁকে খুঁজে বের করেন এক স্বজন। বর্তমান সংস্কৃতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর ও সাংসদ সাবের হোসেন চৌধুরী একটি বেসরকারি হাসপাতালে তাঁকে ভর্তি করান। পরে দলীয়ভাবে ভারতে নিয়ে চিকিৎসা করানো হয়।
দৌলতুন্নাহার বলেন, ‘প্রাণে বেঁচে গেলেও জীবন বলতে যা বোঝায় তা নেই। মাস ছয়েক আগে অ্যাপেন্ডিক্সের ব্যথা উঠেছিল। কিন্তু হাসপাতালে যাওয়ার পর চিকিৎসক অস্ত্রোপচারে রাজি হচ্ছিলেন না। কারণ, সারা শরীরে অসংখ্য স্প্লিন্টার। অস্ত্রোপচার করতে গেলে যদি কোনো বিপত্তি বাধে। যা-ই ঘটুক এর দায় আমার—এ নিশ্চয়তা পেয়ে পরে চিকিৎসক অস্ত্রোপচার করেন।’
দৌলতুন্নাহার বলেন, ‘রাতে যখন স্প্লিন্টারের জন্য ব্যথা শুরু হয়, তখন আর নিজেকে ঠিক রাখতে পারি না। হাত, পা, মাথা সর্বত্রই ব্যথা হয়। পুরো শরীরই যেন অবশ হয়ে পড়ে।’
শরীফের ব্যবসায় ভাটা: গেন্ডারিয়ার ধুপখোলা মাঠের পাশে হার্ডওয়্যার ও মেশিনারির কারখানা আছে শরীফ হোসেনের। নিজেই এসব তৈরি করে বিক্রি করেন। গ্রেনেড হামলায় আহত হওয়ার আগে ব্যবসা ভালোই ছিল। আওয়ামী লীগের সক্রিয় কর্মী শরীফ দলের অন্য মিছিল-সমাবেশের মতো ২০০৪ সালের ২১ আগস্টও যোগ দিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউয়ের সমাবেশে। কিন্তু সেদিনের গ্রেনেড হামলায় তাঁর শ্রবণশক্তি প্রায় চলে গেছে। পা দুটিও গ্রেনেডের স্প্লিন্টারের আঘাতে ক্ষতবিক্ষত। কোনোরকমে চলাফেরা করতে পারেন।
বর্তমানে ৪৫ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের কোষাধ্যক্ষ শরীফ বলেন, প্রথমে তাঁকে ঢাকা মেডিকেলে ভর্তি করা হয়, পরে নেওয়া হয় পঙ্গু হাসপাতালে। এরপর একটি বেসরকারি ক্লিনিকে দীর্ঘদিন চিকিৎসা চলে। তিনি চিকিৎসাধীন অবস্থায় কর্মচারী দিয়ে ব্যবসা চালিয়েছেন। কিছুটা সুস্থ হয়ে নিজে যখন ব্যবসার হাল ধরতে গেলেন, তখন আর আগের অবস্থা নেই। কোনোমতে ব্যবসা টিকে ছিল। এখনো চলছে কোনোমতে। অর্ডার পেলে কিছু কিছু মালামাল সরবরাহ করেন। তাঁর দুই মেয়ে সম্মানের ছাত্রী, ছেলে সপ্তম শ্রেণিতে পড়ে।
কথাগুলো মাকসুদা আজাদের। কান্না থামিয়ে দিল তাঁর কথা। পাশে বসা শাশুড়ি আনোয়ারা বেগম, মেয়ে মাহফুজা আজাদ ও ছেলে আল আমিন আজাদও কান্না চেপে রাখতে পারল না। স্মৃতি মনে করে তাঁর জন্য তিন প্রজন্মের অঝোর কান্না।
আজাদের পুরো নাম আবুল কালাম আজাদ। ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউয়ে গ্রেনেড হামলায় নিহত ২২ জনের একজন তৎকালীন ১৫ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক। নিহত অন্যদের মতো তাঁর স্বজনেরাও প্রিয় মানুষকে হারানোর শোক-ব্যথা বয়ে বেড়াচ্ছেন, আঁকড়ে আছেন স্মৃতি। আর ওই হামলায় আহত অনেক নেতা-কর্মীর এখনো সঙ্গী দুঃসহ যন্ত্রণা। কারও পা অচল, কেউ হারিয়েছেন চোখ, কেউ শ্রবণশক্তি। ওই হামলায় আহত হয়েছিলেন বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও।
নিহত ব্যক্তিদের স্বজন ও আহত কয়েকজন বলেছেন, ওই গ্রেনেড হামলায় আহত ব্যক্তিদের আওয়ামী লীগ থেকে চিকিৎসা খরচসহ এককালীন ও মাসিক ভাতা দেওয়া ছাড়াও চিকিৎসা করানো হয়। ২০১৩ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিহত ব্যক্তিদের স্বজনদের ও আহত ব্যক্তিদের ১০ লাখ টাকা করে সঞ্চয়পত্র দেন। এ থেকে মাসে ১০ হাজার ৭০০ টাকা আসে। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মেমোরিয়াল ট্রাস্ট থেকে দেওয়া হয় মাসে পাঁচ হাজার টাকা। নিহত কয়েকজনের স্বজন বললেন, সরকার একটু মাথা গোঁজার ঠাঁই করে দিলে সবচেয়ে উপকার হয়।
সেই দিনের কথা: আজাদের মা, স্ত্রী ও দুই সন্তান থাকে বালুঘাটের বারানটেকে। মিরপুর উড়ালসড়ক দিয়ে মানিকদী গিয়ে ভাঙা সড়ক ধরে এগোলে বালুঘাট বাজার, সেখান থেকে বেশ কিছুটা গেলে বারানটেকে আজাদদের বাড়ি। গত বুধবার ওই বাড়িতে গিয়ে প্রথমেই চোখে পড়ে আজাদের মা বৃদ্ধা আনোয়ারা বেগম ছেলের বাঁধানো একটা ছবিতে পরম মমতায় হাত বোলাচ্ছেন। ছেলের কথা জানতে চাইলে ফুঁপিয়ে কাঁদতে থাকেন। একপর্যায়ে বলেন, ‘ওই দিন যে জামাকাপড় পরে আজাদ সমাবেশে গিয়েছিল, সেগুলো যত্ন করে রেখেছি। এগুলোতে অসংখ্য ছোট ছোট ছিদ্র। স্প্লিন্টারগুলো ঢোকার সময় কত কষ্টই না পেয়েছে আমার সোনার চান।’ স্বামীর ভিটায় একতলা বাড়ির একাংশে তিনি আজাদের বিধবা স্ত্রী মাকসুদা ও দুই সন্তান মাহফুজা ও আল আমিনকে নিয়ে থাকেন। আনোয়ারার আরও তিন ছেলে ও দুই মেয়ে আছে।
বাবাকে হারানোর সময় মাহফুজার বয়স ছিল পাঁচ বছর, আল আমিনের দুই বছর। মাহফুজা এখন বিএএফ শাহীন স্কুল অ্যান্ড কলেজের দশম শ্রেণির ছাত্রী। ২০০৪ সালের ওই দিনটি সম্পর্কে সে প্রথম আলোকে বলে, ‘আমি তখন মানিকদী গ্রিন হ্যাভেন কিন্ডারগার্টেন স্কুলে নার্সারিতে পড়ি। স্কুল শেষে বেরিয়ে দেখি, বাবা ছোট ভাইকে কোলে নিয়ে গেটে অপেক্ষা করছেন। বাসায় আসার পথে বাবা আমাকে একটা পুতুল কিনে দেন। এটাই বাবার দেওয়া শেষ উপহার।’ বলতে বলতে ফুঁপিয়ে ওঠে মাহফুজা।
মাকসুদা বলেন, ‘সেদিন সন্ধ্যার দিকে টিভিতে দেখি আওয়ামী লীগের সমাবেশে বোমা হামলা হয়েছে। তখনই মনটা ছ্যাঁৎ করে ওঠে। আজাদ তো আওয়ামী লীগের সমাবেশ মিস করে না। শাশুড়িকে বললাম পাড়ায় খোঁজ নেন। অনেকে জানাল, আজাদ সমাবেশে গেছেন। সর্বনাশ হয়ে গেছে ভেবে আমি প্রায় অজ্ঞান। এরপর তো ঘটেই গেল।’
গ্রেনেড হামলার পর আজাদ হতাহত অসংখ্য মানুষের মধ্যে উপুড় হয়ে পড়ে ছিলেন। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়ার পর মৃত ভেবে তাঁকে মর্গে নিয়ে যাওয়ার প্রস্তুতির সময় নড়ে ওঠেন। তখন ওই হাসপাতালে চিকিৎসা দেওয়া হয়। খবর পেয়ে ছুটে যান স্বজনেরা। পরে তাঁকে মেট্রোপলিটন হাসপাতালে নেওয়া হয়। চোখ খোলা থাকলেও ছিলেন নির্বাক, অচেতন। ওই অবস্থায় বেঁচে ছিলেন ১০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত। স্বজনেরা গ্রেনেডে ক্ষতবিক্ষত দেহটা দেখেছেন, কিন্তু কথা বলতে পারেননি।
আজাদের স্ত্রী বলেন, ‘দল (আওয়ামী লীগ) ও শেখ হাসিনা আর্থিক সহায়তা করেছেন। অবস্থার সামান্য উন্নতি হলে আজাদকে উন্নত চিকিৎসা করানোর প্রতিশ্রুতিও দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু উন্নতি হয়নি। আসলে আমার ভাগ্যই খারাপ। সবার সহানুভূতিই পাচ্ছি। কিন্তু স্বামীকে তো পাচ্ছি না। সন্তানেরা বাবা ডাকতে পারছে না।’
বিয়েবার্ষিকী করা হয়নি আইরিনের: মোস্তাক আহমেদ (সেন্টু) ও আইরিন সুলতানার বিয়েবার্ষিকী ২২ আগস্ট। ঘরোয়া হলেও প্রতিবছরই দিনটি পালন করতেন এই দম্পতি। ২০০৪ সালেও কিছু প্রস্তুতি ছিল তাঁদের। কিন্তু ২১ আগস্টের বিকেলেই সব শেষ হয়ে যায়। গ্রেনেড কেড়ে নেয় স্বামীকে।
আইরিন বলেন, ‘সাত বছরের সংসার। রাত ১২টার পর বিয়েবার্ষিকী। ঘটনার দিন বিকেলেও আমাকে বলে গেল, তুমি প্রস্তুতি নিয়ে রেখো। আমি আগে আগেই বাসায় আসব। কিন্তু তাঁর আর আসা হলো না। বিয়েবার্ষিকী আর স্বামীর মৃত্যুবার্ষিকী এখন একাকার।’ তিনি বললেন, মোস্তাক আহমেদ ছিলেন আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় উপকমিটির সহসম্পাদক। ছাত্রজীবন থেকেই রাজনীতি করতেন। ২০০৪ সালের ১৫ আগস্ট গ্রামের বাড়ি বরিশালে ত্রাণ কার্যক্রম পরিচালনা করে ২০ আগস্ট ঢাকায় ফিরেছিলেন। ২১ আগস্ট দুপুরের পরই বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউয়ের সমাবেশে যোগ দেন।
আইরিন বলেন, গ্রেনেড হামলা হওয়ার পর তিনি স্বামীর খোঁজে প্রথমে ঢাকা মেডিকেলে যান। সেখানে না পেয়ে এদিক-ওদিক ছোটাছুটি করেন। এরপর খবর পান, পঙ্গু হাসপাতালে আছেন। কিন্তু মারা গেছেন তা জানতেন না। রাত নয়টায় পঙ্গু হাসপাতালে গিয়ে জেনেই জ্ঞান হারান।
মোস্তাক ও আইরিন দম্পতির একমাত্র সন্তান আফসানা আহমেদ। চার বছর বয়সেই বাবাকে হারানো আফসানা এখন আইডিয়াল স্কুলের অষ্টম শ্রেণির ছাত্রী।
আইরিন আহমেদ বলেন, ‘মেয়েটা এখন সবই বোঝে। তবে সেদিনের স্মৃতি মনে করতে পারে না। আমরাও তাকে মনে করাই না। কারণ, আমাদের মনে যে ব্যথা, সেটা তার মধ্যে সংক্রমিত হোক তা চাই না।’
মোস্তাক আহমেদের মা অন্য ছেলেদের সঙ্গে থাকেন। আইরিন মেয়েকে নিয়ে থাকেন তাঁর বাবা-মায়ের সঙ্গে। স্বামীর মৃত্যুর পর আইরিন মার্কেন্টাইল ব্যাংকে চাকরি পেয়েছেন।
দৌলতুন্নাহার অনেকটা ঘরবন্দী: ওই গ্রেনেডে হামলায় বাঁ চোখের দৃষ্টি হারিয়েছেন দৌলতুন্নাহার। পা দুটিতে অসংখ্য স্প্লিন্টারের দাগ, দুটি গভীর ক্ষতচিহ্ন। তাঁর সঙ্গে কথা হয় পল্লবীর বাসায়। একেবারে অচল হয়ে যাননি। তবে অনেকটাই ঘরের মধ্যে বন্দী। তিনি বললেন, গ্রেনেডের স্প্লিন্টার বাঁ চোখে লাগার পরই তিনি আওয়ামী লীগ কার্যালয়ের সামনের ড্রেনে পড়ে যান। এরপর আর কিছু মনে নেই। লাশের সঙ্গে তাঁকে মর্গে ফেলে রাখা হয়েছিল। মর্গ থেকে তাঁকে খুঁজে বের করেন এক স্বজন। বর্তমান সংস্কৃতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর ও সাংসদ সাবের হোসেন চৌধুরী একটি বেসরকারি হাসপাতালে তাঁকে ভর্তি করান। পরে দলীয়ভাবে ভারতে নিয়ে চিকিৎসা করানো হয়।
দৌলতুন্নাহার বলেন, ‘প্রাণে বেঁচে গেলেও জীবন বলতে যা বোঝায় তা নেই। মাস ছয়েক আগে অ্যাপেন্ডিক্সের ব্যথা উঠেছিল। কিন্তু হাসপাতালে যাওয়ার পর চিকিৎসক অস্ত্রোপচারে রাজি হচ্ছিলেন না। কারণ, সারা শরীরে অসংখ্য স্প্লিন্টার। অস্ত্রোপচার করতে গেলে যদি কোনো বিপত্তি বাধে। যা-ই ঘটুক এর দায় আমার—এ নিশ্চয়তা পেয়ে পরে চিকিৎসক অস্ত্রোপচার করেন।’
দৌলতুন্নাহার বলেন, ‘রাতে যখন স্প্লিন্টারের জন্য ব্যথা শুরু হয়, তখন আর নিজেকে ঠিক রাখতে পারি না। হাত, পা, মাথা সর্বত্রই ব্যথা হয়। পুরো শরীরই যেন অবশ হয়ে পড়ে।’
শরীফের ব্যবসায় ভাটা: গেন্ডারিয়ার ধুপখোলা মাঠের পাশে হার্ডওয়্যার ও মেশিনারির কারখানা আছে শরীফ হোসেনের। নিজেই এসব তৈরি করে বিক্রি করেন। গ্রেনেড হামলায় আহত হওয়ার আগে ব্যবসা ভালোই ছিল। আওয়ামী লীগের সক্রিয় কর্মী শরীফ দলের অন্য মিছিল-সমাবেশের মতো ২০০৪ সালের ২১ আগস্টও যোগ দিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউয়ের সমাবেশে। কিন্তু সেদিনের গ্রেনেড হামলায় তাঁর শ্রবণশক্তি প্রায় চলে গেছে। পা দুটিও গ্রেনেডের স্প্লিন্টারের আঘাতে ক্ষতবিক্ষত। কোনোরকমে চলাফেরা করতে পারেন।
বর্তমানে ৪৫ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের কোষাধ্যক্ষ শরীফ বলেন, প্রথমে তাঁকে ঢাকা মেডিকেলে ভর্তি করা হয়, পরে নেওয়া হয় পঙ্গু হাসপাতালে। এরপর একটি বেসরকারি ক্লিনিকে দীর্ঘদিন চিকিৎসা চলে। তিনি চিকিৎসাধীন অবস্থায় কর্মচারী দিয়ে ব্যবসা চালিয়েছেন। কিছুটা সুস্থ হয়ে নিজে যখন ব্যবসার হাল ধরতে গেলেন, তখন আর আগের অবস্থা নেই। কোনোমতে ব্যবসা টিকে ছিল। এখনো চলছে কোনোমতে। অর্ডার পেলে কিছু কিছু মালামাল সরবরাহ করেন। তাঁর দুই মেয়ে সম্মানের ছাত্রী, ছেলে সপ্তম শ্রেণিতে পড়ে।
No comments