মানবিক বিপন্নতা বাড়ছেই
মানবসভ্যতার বিকাশের এই পর্বে মানবতা, মানবপ্রেম, মানবাধিকার ইত্যাদি প্রশ্নে যতই বড় বড় কথা বলা হোক না বাস্তব ক্ষেত্রে অমানবিকতা ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের প্রবণতাই বেশি বেশি করে সভ্যতার অহঙ্কারকে গ্রাস করতে চাইছে। তা না হলে মানুষে মানুষে এতো সংঘাত, এতো বিদ্বেষ, এতো শত্রুতা বাড়বে কেন? কেনই বা জাতীয়তা, আঞ্চলিকতা, ধর্ম, সম্প্রদায়, ভাষা, সংস্কৃতির স্বাতন্ত্র্য সত্তাকে পুঁজি করে উগ্রতা আর হিংস্রতার এতো বাড়বাড়ন্ত? আধুনিক বিশ্বে দু’ দু’টি বিশ্বযুদ্ধ হয়ে গেছে অনেক আগে। তারপর সেই মাত্রার ব্যাপকতা নিয়ে তৃতীয় কোনো যুদ্ধের ঘটনা না ঘটলেও গত সাত দশক ধরে টানা চলছে বহু আঞ্চলিক যুদ্ধ। বস্তুত এই সময়কালে এমন কোনো বছর যায়নি যখন বিশ্বের কোথাও না কোথাও এক বা একাধিক আঞ্চলিক যুদ্ধ চলেনি। আপাতদৃষ্টিতে এই যুদ্ধগুলি দুই বা ততোধিক দেশের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকলেও আড়ালে মদত জোগানো বা সক্রিয় ভূমিকা পালন করেছে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদী শক্তি এবং তাদের সহযোগীরা। দ্বি-দেশীয় বা ত্রি-দেশীয় যুদ্ধ ছাড়া একই দেশের অভ্যন্তরে গোষ্ঠী সংঘাত আরও মারাত্মক। এই সংঘাতের পেছনেও পূর্ণ মদত থাকে সাম্রাজ্যবাদীদের। কোনো দেশের ওপর প্রভাব বিস্তার সম্ভব না হলে সাম্রাজ্যবাদীরা অভ্যন্তরীণ বিরোধগুলিকে চাগিয়ে তোলে ও মদত দেয়। এটা সশস্ত্র সংঘাতে রূপ নিলে অর্থ ও অস্ত্র সাহায্য করা হয় অনুগত গোষ্ঠীকে। এইভাবে বছরের পর বছর বিভিন্ন দেশে গৃহযুদ্ধ জিইয়ে রেখে দেশটাকে দীর্ণ-বিদীর্ণ করে নিজেদের নিয়ন্ত্রণে আনে সাম্রাজ্যবাদীরা, না পারলে দেশটাকেই খণ্ডবিখণ্ড করে খণ্ডিত অংশে প্রভাব বিস্তার করে। এই প্রক্রিয়ায় যুগোস্লোভিয়াকে ভেঙে ৫-৬টি দেশে পরিণত করা হয়েছে। ইরাক ও আফগানিস্তানে এক দশক ধরে সামরিক অভিযান চালিয়ে দু’টি দেশকেই ধ্বংসের শেষ সীমানায় পৌঁছে দিয়ে নতজানু করে রেখেছে। অর্ধদশক ধরে মার্কিন মদতে ফিলিস্তিন গ্রাস করে তার অধিবাসীদের বিতাড়িত করছে ইসরাইল। সিরিয়া সরকারকে উৎখাত করে নিয়ন্ত্রণে আনতে জঙ্গি গোষ্ঠীদের মদত দিচ্ছে আমেরিকা। ইয়েমেনে বোমাবর্ষণ চলছে সেই আমেরিকার মদতে। আফ্রিকার দেশে দেশে মার্কিন ষড়যন্ত্রে চলছে গৃহযুদ্ধ। এইসব যুদ্ধ, সংঘাতের জেরে সবচেয়ে বেশি বিপর্যয়ের মুখে পড়ছে সাধারণ মানুষ। তারা তাদের জীবিকাচ্যুৎ হচ্ছেন, কাজ হারাচ্ছেন, বাস্তুহারা হচ্ছেন। অসহায় মানুষ সর্বস্ব হারিয়ে শুধু বাঁচার জন্য অন্যদেশে আশ্রয় নিয়েছে। অন্যরা দেশের মধ্যে অন্যত্র আশ্রয় নিয়েছে। তথাকথিত সভ্যতা যত এগোচ্ছে ততই বাড়ছে বাস্তুহারা শরণার্থীর ভিড়। শরণার্থী শিবিরে কাটছে মানুষ্যের অমানবিক জীবন। ধুঁকতে ধুঁকতে মৃত্যু হচ্ছে অনেকের। জাতিসংঘের রিপোর্ট অনুযায়ী বর্তমানে বিশ্বের প্রতি ১২২ জনের মধ্যে একজন শরণার্থী। ২০১৪ সালের মোট শরণার্থীর সংখ্যা ৬ কোটি। এদের মধ্যে ২ কোটি অন্যদেশে আশ্রয় নিয়েছে। ৪ কোটি নিজের দেশেই অন্যত্র আশ্রয় নিয়েছে। ইতিহাসে এতো শরণার্থী কোনোদিন দেখা যায়নি। ২০১৩ সালে ছিল ৫.১২ কোটি। ২০০৫ সালে ছিল ৩.৭৫ কোটি। এক বছরে শরণার্থী বৃদ্ধির ক্ষেত্রে ২০১৪ সাল সর্বকালীন শীর্ষে। সবচেয়ে বেশি শরণার্থী ফিলিস্তিনের মানুষ (৫১ লক্ষ)। তারপর সিরিয়ার (৩৯ লক্ষ), আফগানিস্তান (২৬ লক্ষ), সোমালিয়া (১১ লক্ষ)। ভিন দেশের শরণার্থীদের সর্বাধিক আশ্রয় দিয়েছে তুরস্ক (১৬ লক্ষ)। তারপরে আছে পাকিস্তান (১৫ লক্ষ), লেবানন (১২ লক্ষ), ইরান (৯ লক্ষ)। ২০১৪ সালে ভূমধ্যসাগর পেরিয়ে আফ্রিকা থেকে ইউরোপে পাড়ি দিয়েছে ২.১৯ লক্ষ অভিবাসী। এটাও সর্বকালীন রেকর্ড। সম্প্রতি রোহিঙ্গা উদ্বাস্তুদের মর্মন্তুদ কাহিনী অনেক অমানবিকতাকেও লজ্জা দিয়ে দিয়েছে। অজুহাত যাই হোক এই নির্মমতার মূলে আছে পুঁজিবাদের বিকাশ। শোষণের তীব্রতায় সম্পদের কেন্দ্রীভবন ক্রমাগত আঁকড়ে ধরছে অমানবিক বর্বরতাকে। শরণার্থীদের দুঃসহ জীবন এরই পরিণাম।
No comments