কৌশলী আন্দোলনে বছর পার করেছে জামায়াত
আত্মরক্ষামূলক
কৌশলী আন্দোলন ও কর্মসূচির মধ্য দিয়ে বছর পার করেছে জামায়াতে ইসলামী। একের
পর এক কঠোর আন্দোলনের হুঁশিয়ারি দিলেও সারা বছর দলটিকে দেখা গেছে
রক্ষণাত্মক অবস্থানে। এ নিয়ে বিভিন্ন সময় ছড়িয়ে পড়ে নানা গুজব আর গুঞ্জনের
ডালপালা। রাজনৈতিক মিত্রের মাঝে দেখা দিয়েছে সন্দেহ-অবিশ্বাস, মান-অভিমান,
ভুল বোঝাবুঝি। তবে বছর শেষে ২০ দলীয় জোটের শেষ কর্মসূচিতেও সেই ধারাবাহিকতা
দেখা গেছে। নবম সংসদ নির্বাচনে ভরাডুবির পর একের পর এক সঙ্কট মোকাবিলা
করছে জামায়াত। তবে এবারের সঙ্কট ছিল স্মরণকালের ইতিহাসে সবচেয়ে কঠিন এবং
দুর্যোগময়। সবচেয়ে সঙ্কটে পড়ে বছরের শেষ ভাগ অক্টোবর-নভেম্বরে। এ সময় আমীর
মাওলানা মতিউর রহমান নিজামীসহ তিন শীর্ষ নেতার রায়, সাবেক আমীর অধ্যাপক
গোলাম আযমের ইন্তিকাল, রাজনৈতিকভাবে নিষিদ্ধের উদ্যোগ জোরদার হওয়ায় একেবারে
সঙ্গীন অবস্থায় পৌঁছে ২০ দলীয় জোটের শরিক দলটি। এতকিছুর পরও ২০১৩ সালের
তুলনায় বিদায়ী বছরে রাজপথে তাদের উপস্থিতি ছিল অনেকটা নমনীয় নীরব। এ কারণে
সরকারের সঙ্গে দলটি গোপন আঁতাতের আওয়াজ ওঠে বেশ ক’বার। বিশেষ করে উপজেলা
নির্বাচনে জামায়াতের অপ্রত্যাশিত সাফল্য ওই গুঞ্জনে নতুন মাত্রা যোগ করে।
তবে বছরের শেষভাগে সরকারের মাত্রাতিরিক্ত তৎপরতা জামায়াতকে খাদের কিনারে
নিয়ে যায়। বিষয়টি স্বীকার করে দলের বিভিন্ন সারির নেতারা বলছেন, ২০ দলীয়
জোটের সম্ভাব্য আন্দোলনকে আমলে নিয়ে সরকার হঠাৎ বছরের শেষ দিকে এমন আগ্রাসী
ভূমিকা নিয়েছে। উদ্দেশ্য, আন্তর্জাতিক মহলের কাছে গ্রহণযোগ্য একটি
নির্বাচনের আগে জাতীয়তাবাদী এই ইসলামী শক্তিকে নিস্তেজ করে দেয়া। এ জন্য
দলটিকে নেতৃত্বশূন্য করার ষড়যন্ত্রে মেতেছিল। নতুন ফাঁদ পেতেছিল। তবে
জামায়াত সে ফাঁদে পা দেয়নি। ২৩শে অক্টোবর জামায়াতের সাবেক আমীর অধ্যাপক
গোলাম আযম বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালের প্রিজন
সেলে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ইন্তিকাল করেন। মানবতাবিরোধী অপরাধে ৯০ বছর
দণ্ডপ্রাপ্ত ৯২ বছরের এই নেতাকে জামায়াতের মাস্টার মাইন্ড এবং আধ্যাত্মিক
গুরু হিসেবে গণ্য করা হতো। ২৫শে অক্টোবর জাতীয় মসজিদ বায়তুল মোকাররমে গোলাম
আযমের জানাজায় লাখো মানুষের উপস্থিতি জামায়াত-শিবিরের শোকাতুর
নেতাকর্মীদের উজ্জীবিত করে। তবে ওই শোডাউন সরকারকে নতুন করে ভাবনায় ফেলেছে।
তিনি বলেন, সরকার ভেবেছিল জামায়াত নিঃশেষ হয়ে গেছে। কিন্তু গোলাম আযমের
জানাজা দেখে তারা নড়ে চড়ে ওঠে। গোলাম আযমের মৃত্যুর রেশ না কাটতেই দলটির
আমীর মাওলানা মতিউর রহমান নিজামী, নির্বাহী পরিষদ সদস্য মীর কাসেম আলীর
ফাঁসির রায় হয়। তার একদিন পর সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ দলটির সহকারী
সেক্রেটারি জেনারেল মুহাম্মদ কামারুজ্জামানের মামলার চূড়ান্ত রায় দেয়। টানা
তিনটি রায়ে যখন দম বন্ধ হওয়ার উপক্রম জামায়াতের, ঠিক সেই মুহূর্তে
কামারুজ্জামানের রায় কার্যকর করার উদ্যোগ নেয় সরকার। ঘটনার ধারাবাহিকতায়
অনেকটা দিশাহারা হয়ে পড়ে জামায়াত। তিন দফায় পাঁচ দিন হরতাল কর্মসূচি দিয়ে এ
সব ঘটনার প্রতিবাদ করলেও তাতে সরকারের ওপর তেমন প্রভাব ফেলতে পারেনি। এমন
অবস্থায় দলটির অস্তিত্ব, নেতাকর্মীদের মনোবল, আত্মবিশ্বাস কঠিন চ্যালেঞ্জের
মুখে পড়ে। তিন বছরের বেশি সময় ধরে জামায়াতের কেন্দ্রীয় কার্যালয় থেকে শুরু
করে সকল মহানগর এমনকি জেলা-উপজেলা পর্যায়ের কার্যালয়গুলো বন্ধ। অসংখ্য
মামলার বোঝা নিয়ে আত্মগোপনে আছেন দলটির ভারপ্রাপ্ত আমীর মকবুল আহমাদ,
ভারপ্রাপ্ত সেক্রেটারি জেনারেল ডা. শফিকুর রহমানসহ প্রায় সব নেতাকর্মী।
জোটের শরিক হলেও কৌশলগত কারণে এ ক্ষেত্রে কোন ভূমিকা রাখতে পারছে না
বিএনপি। তাছাড়া, বিভিন্ন কারণে এই রাজনৈতিক মিত্রের মধ্যে সাম্প্রতিককালে
খানিকটা মান-অভিমান এমনকি কিছুটা সন্দেহ-অবিশ্বাস ও ভুল বোঝাবুঝির কথাও
শোনা যায়। আপৎকালীন মুহূর্তে বিএনপির পক্ষ থেকে তেমন কোন সহানুভূতি বা
আন্দোলনে সমর্থন না পাওয়ায় জামায়াতের তৃণমূল কর্মীরা হতাশ হয়ে পড়ে। এ
প্রেক্ষাপটে যে কোনভাবে পরিস্থিতি মোকাবিলা করে রাজনৈতিক অঙ্গনে টিকে থাকার
পক্ষে দলের নেতারা। সূত্র জানায়, শীর্ষ নেতাদের ফাঁসির রায়ের প্রতিবাদে
৩০শে অক্টোবর থেকে তিন দফায় ৫ দিন হরতালসহ বিক্ষোভ কর্মসূচি পালন করলেও তা
ছিল শুধুই নিয়ম রক্ষার। যথাসম্ভব সহিংসতা এড়িয়ে রক্ষণাত্মক কৌশলে এসব
কর্মসূচি পালনের জন্য দায়িত্বশীলদের নির্দেশনা ছিল আগ থেকে। এ কারণে
হরতাল-বিক্ষোভে আক্রমণাত্মক বা মারমুখো দেখা যায়নি নেতাকর্মীদের। এমনকি
কামারুজ্জামানের ফাঁসি নিয়ে দলের তৃণমূলের নেতাকর্মীরা উদ্বিগ্ন ও ক্ষুব্ধ
থাকলেও তা কার্যকর হলে খুব বেশি প্রতিক্রিয়া না দেখানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে
নীতিনির্ধারকরা। গতানুগতিক দু’-একদিন হরতাল বা বিক্ষোভের মধ্যেই কর্মসূচি
সীমাবদ্ধ থাকার সম্ভাবনা রয়েছে। বিষয়টি স্বীকার করে দলের এক তরুণ সদস্য
বলেন, বিচার বিভাগ কতটা রাজনৈতিক তা উপর্যুপরি তিনটি রায়ে প্রমাণ হয়েছে।
সরকারি-বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ২১ লাখ শিক্ষার্থীর বার্ষিক পরীক্ষা
ঝুঁকির মুখে ফেলতে সরকার এই ফাঁদ পেতেছিল। পর্যবেক্ষক মহলের মতে, গত বছর
বিভিন্ন ইস্যুতে আন্দোলনের সময় ব্যাপক সন্ত্রাস সহিংসতায় দেশে-বিদেশে
চরমভাবে সমালোচিত হয় জামায়াত। ওই আন্দোলনকে ঘিরে দেশ জুড়ে দলের ব্যাপক
জনশক্তি ও অর্থনৈতিক ভিত্তি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এ প্রেক্ষাপটে আগামীতে সরকার
পতনের মতো চূড়ান্ত আন্দোলন ছাড়া কঠোর কর্মসূচি দেবে না জামায়াত। যদিও চলমান
পরিস্থিতিতে দলের সব স্তরে ক্ষোভ ও হতাশা নেমে এসেছে। এ অবস্থায় দলের কেউ
কেউ রাজপথে কঠোর প্রতিক্রিয়া দেখানোর পক্ষে। তবে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক মহলের
সমালোচনা ও বিতর্ক থেকে রক্ষা পেতে কৌশলী প্রতিবাদের সিদ্ধান্ত নেন
দায়িত্বশীলরা। রাজনৈতিক অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখা এবং নেতাকর্মীদের মনোবল ধরে
রাখতেই প্রতিবাদের সহজ মাধ্যম হিসেবে ঘোষণা দেয়া হয় বিক্ষোভ হরতালের মতো
কর্মসূচি। তবে তা শান্তিপূর্ণভাবে পালনের জন্য নির্দেশ দিয়েছেন ভারপ্রাপ্ত
আমীর মকবুল আহমাদ ও ভারপ্রাপ্ত সেক্রেটারি জেনারেল ডা. শফিকুর রহমান। এ
ব্যাপারে ঢাকা মহানগর জামায়াতের এক নেতা বলেন, আমরা বরাবর নিয়মতান্ত্রিক
এবং স্বাভাবিক আন্দোলন করি। কিন্তু সরকার চায় অস্বাভাবিক কিছু করি। যাতে
আমাদের অগণতান্ত্রিক জঙ্গি ইত্যাদি নামে কলঙ্কিত করা যায়। তবে জামায়াত
সরকারকে সেই সুযোগ দিতে রাজি নয়। এ জন্য প্রতিবাদের ভাষায় প্রতিবাদ
জানাচ্ছে জামায়াত দাবি করে তিনি বলেন, সিনিয়র সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল
কামারুজ্জামানের ফাঁসি-পরবর্তী দলের নেতাকর্মীদের প্রতিক্রিয়া দেখানোর
বিষয়ে দিকনির্দেশনা দিয়েছেন কামারুজ্জামান নিজেই। সম্প্রতি ঢাকা কেন্দ্রীয়
কারাগার থেকে আইনজীবীদের মাধ্যমে দলের সব স্তরের জনশক্তির উদ্দেশে তিনি
বলেছেন, আমার শহীদী খুনের বদলা যেন তারা দ্বীন প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে নেয়।
আমার ওপর যে জুলুম করা হয়েছে, তার কারণে কেউ যেন প্রতিহিংসার শিকার না হয়।
দলীয় সিদ্ধান্ত অনুযায়ী বিক্ষুব্ধ নেতাকর্মীদের শান্ত রাখতেই
কামারুজ্জামানের ওই বক্তব্য ব্যাপকভাবে প্রচার করা হয়। ফলে চলমান
প্রেক্ষাপটে বছরের শেষ আন্দোলনেও জামায়াতের কৌশলী ভূমিকা অব্যাহত আছে।
No comments