আজীবন সংগ্রামী অজয় রায় by জয়ন্তী রায়
অজয় রায়, জন্ম ১৯২৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর।
পৈতৃক বাড়ি কিশোরগঞ্জ জেলার কটিয়াদী থানার বনগ্রাম। ১৯৩৭ সালে বারানসির
স্কুলে চতুর্থ শ্রেণীতে ভর্তি হন অজয় রায়। ১৯৪৩ সালে প্রথম বিভাগে
ম্যাট্রিক পাস করে বারানসি বিশ্ববিদ্যালয়ে আইএসসিতে ভর্তি হন। ১৯৪৫ সালে
প্রথম বিভাগে আইএসসি পাস করে বারানসি বিশ্ববিদ্যালয়ে ফার্মেসি প্রথম বর্ষে
ভর্তি হন। এরই মধ্যে ১৯৪৪ সালে বাবা প্রমথনাথ রায় মারা যান। তার ১ বছরের
ব্যবধানে মা কল্যাণী রায়ও মারা যান। বাবা-মার মৃত্যুর পর ছোট ভাইবোনদের
নিয়ে বারানসি থেকে কিশোরগঞ্জের বনগ্রামে ফিরে আসেন অজয় রায়। গ্রামে আসার
কারণে তার লেখাপড়ায় ছেদ পড়ে। ছোট ভাইবোনরা বনগ্রামের স্কুলেই ভর্তি হয়। ছয়
মাস অপেক্ষার পর তিনি মুন্সীগঞ্জ কলেজে বিকম শ্রেণীতে ভর্তি হন এবং ১৯৪৮
সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ্যক্রমে প্রথম বিভাগে প্রথম স্থান অধিকার
করে বিকম পাস করেন।
অজয় রায় যখন স্কুলের ছাত্র তখন থেকেই রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েন। বারানসিতে যে স্কুলে পড়তেন সেখানে ছিল কমিউনিস্টদের প্রভাব। যখন ক্লাস সেভেনে পড়েন সহজাতভাবেই সেদিকে আকৃষ্ট হয়ে ছাত্র ফেডারেশন ও তার মারফত বারানসির কমিউনিস্ট নেতাদের সংস্পর্শে আসেন। যে সময়ের কথা বলছি, সে সময় কমিউনিস্ট পার্টি ছিল নিষিদ্ধ। বারানসির কমিউনিস্ট নেতাদের মধ্যে অনেকেই ছিলেন বাঙালি এবং বারানসিতে অজয় রায়রা যে পাড়ায় থাকতেন তার অধিবাসীরাও। সেই সুবাদে তাদের মধ্যে ঘনিষ্ঠতা হতে সময় লাগে না।
১৯৪৩ সালে বাংলায় দেখা দেয় মন্বন্তর। কমিউনিস্টরা তাদের সব শক্তি নিয়ে দুর্ভিক্ষ ও মহামারী প্রতিরোধের কাজ সংগঠিত করতে উদ্যোগী হন। বারানসিতেও কমিউনিস্টরা ত্রাণ সংগ্রহে সক্রিয় হন। অজয় রায় এ সময় সেই কাজের মাধ্যমে কমিউনিস্ট পার্টি ও ছাত্র ফেডারেশনের সঙ্গে সক্রিয়ভাবে যুক্ত হয়ে পড়েন।
১৯৪৮ সালে কমিউনিস্ট পার্টি সশস্ত্র সংগ্রামের সিদ্ধান্ত নিলে এর স্লোগানের ভিত্তিতে একটি ছাত্র সম্মেলন করতে গিয়ে তিনি প্রথম গ্রেফতার হন। সেটা ছিল ১৯৪৮ সালের ডিসেম্বর মাস। তখন মাত্র বিকম পরীক্ষা দিয়েছেন তিনি। ১ বছর জেল খেটে ১৯৪৯ সালের ডিসেম্বরে স্বাস্থ্যগত কারণে মুক্তি পান। মুক্তি পেয়ে সংগঠনের কাজের জন্য বাড়ি বা কলকাতায় না গিয়ে মুন্সীগঞ্জে চাঁপাতলী স্কুলে প্রধান শিক্ষকের কাজে যোগ দেন। ১৯৫০ সালের দাঙ্গার পর সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ব্যাপক দেশত্যাগের কারণে ছাত্র সংখ্যা কমে যাওয়ায় স্কুলটি বন্ধ হয়ে যায়। এ অবস্থায় তিনি কাছেই রামপাল হাইস্কুলে শিক্ষকতার কাজ নেন। সে অবস্থাতেই ১৯৫০-এর সেপ্টেম্বরে তিনি আবার গ্রেফতার হন। এবার ১৯৫৪ সালের জানুয়ারি পর্যন্ত আটক থাকতে হয়। ১৯৫৪ সালে জানুয়ারিতে মুক্তি দিয়ে ময়মনসিংহ মিউনিসিপ্যাল এলাকায় তাকে অন্তরীণ করা হয়। সেখানে তিনি যুক্ত হন ময়মনসিংহ জেলা কমিটির সঙ্গে। ১৯৫৪ সালের নির্বাচনের আগে ময়মনসিংহে যখন কমিউনিস্ট পার্টির প্রকাশ্য অফিস খোলা হয়, তখন তার দায়িত্ব নেন তিনি। নির্বাচনের আগে আবারও গ্রেফতার করা হয় তাকে।
১৯৫৭ সালে ন্যাপ গঠিত হওয়ার পর তিনি পার্টির সিদ্ধান্তক্রমেই ন্যাপের সহ-সম্পাদক নির্বাচিত হন। এ সময় ন্যাপের ব্যাপারে পাকিস্তানে যুক্ত নির্বাচনের পক্ষে ময়মনসিংহে জনমত সংগঠনে বিশেষভাবে উদ্যোগী হন। ১৯৫৮ সালে আইয়ুব খান সাময়িক শাসন জারি করলে তিনি আত্মগোপনে চলে যান। আত্মগোপন অবস্থায় তিনি ময়মনসিংহে পার্টি সংগঠন গুছিয়ে তুলতে উদ্যোগী ছিলেন। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে ময়মনসিংহ শহরের মহাখালী স্কুলে ন্যাপ-কমিউনিস্ট পার্টি ও ছাত্র ইউনিয়নের উদ্যোগে ক্যাম্প স্থাপন করা হয়। ময়মনসিংহ শহর যখন পাক হানাদার বাহিনীর দখলে চলে যায় তখন তিনি মূলত কিশোরগঞ্জকে ভিত্তি করে মুক্তিযুদ্ধ সংগঠনের কাজে যুক্ত ছিলেন। জুলাইয়ের শেষভাগে প্রথমে আগরতলা ও পরে কলকাতা হয়ে তিনি মেঘালয়ে বারেংগাপাড়ায় ময়মনসিংহ জেলার ন্যাপ, কমিউনিস্ট পার্টি ও ছাত্র ইউনিয়নের উদ্যোগে স্থাপিত ক্যাম্পে যোগ দেন এবং মুক্তিযুদ্ধের বাকি সময়টা ওই ক্যাম্পকে ভিত্তি করে মুক্তিযুদ্ধের কাজে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেন।
স্বাধীনতার পর ৭২-এর জানুয়ারিতে তিনি ময়মনসিংহে ফিরে আসেন এবং আবারও জেলা কমিউনিস্ট পার্টি ও চলমান আন্দোলনে নিজেকে যুক্ত করেন। এ সময়ে তার উদ্যোগেই ময়মনসিংহে ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্রের শাখা গড়ে ওঠে এবং তাকে স্থানীয় শাখার সভাপতি নির্বাচিত করা হয়।
১৯৭৩ সালে বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির দ্বিতীয় কংগ্রেসে তিনি পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটির সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য নির্বাচিত হন। এ সময় তিনি ঢাকায় স্থায়ীভাবে বাস করতে শুরু করেন। পার্টির সাংগঠনিক কাজ ছাড়াও উপরোক্ত দায়িত্বগুলো ১৯৯২ সালে পার্টির সঙ্গে সম্পর্ক ছেদ করা পর্যন্ত তার ওপরই ন্যস্ত ছিল।
অজয় রায় দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনে ১৮ বছর জেলে কাটিয়েছেন এবং স্বাধীনতার আগে ও পরে ৫ বছরের কিছু বেশি সময় কাটিয়েছেন আত্মগোপনে।
জয়ন্তী রায় : অজয় রায়ের সহধর্মিণী
অজয় রায় যখন স্কুলের ছাত্র তখন থেকেই রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েন। বারানসিতে যে স্কুলে পড়তেন সেখানে ছিল কমিউনিস্টদের প্রভাব। যখন ক্লাস সেভেনে পড়েন সহজাতভাবেই সেদিকে আকৃষ্ট হয়ে ছাত্র ফেডারেশন ও তার মারফত বারানসির কমিউনিস্ট নেতাদের সংস্পর্শে আসেন। যে সময়ের কথা বলছি, সে সময় কমিউনিস্ট পার্টি ছিল নিষিদ্ধ। বারানসির কমিউনিস্ট নেতাদের মধ্যে অনেকেই ছিলেন বাঙালি এবং বারানসিতে অজয় রায়রা যে পাড়ায় থাকতেন তার অধিবাসীরাও। সেই সুবাদে তাদের মধ্যে ঘনিষ্ঠতা হতে সময় লাগে না।
১৯৪৩ সালে বাংলায় দেখা দেয় মন্বন্তর। কমিউনিস্টরা তাদের সব শক্তি নিয়ে দুর্ভিক্ষ ও মহামারী প্রতিরোধের কাজ সংগঠিত করতে উদ্যোগী হন। বারানসিতেও কমিউনিস্টরা ত্রাণ সংগ্রহে সক্রিয় হন। অজয় রায় এ সময় সেই কাজের মাধ্যমে কমিউনিস্ট পার্টি ও ছাত্র ফেডারেশনের সঙ্গে সক্রিয়ভাবে যুক্ত হয়ে পড়েন।
১৯৪৮ সালে কমিউনিস্ট পার্টি সশস্ত্র সংগ্রামের সিদ্ধান্ত নিলে এর স্লোগানের ভিত্তিতে একটি ছাত্র সম্মেলন করতে গিয়ে তিনি প্রথম গ্রেফতার হন। সেটা ছিল ১৯৪৮ সালের ডিসেম্বর মাস। তখন মাত্র বিকম পরীক্ষা দিয়েছেন তিনি। ১ বছর জেল খেটে ১৯৪৯ সালের ডিসেম্বরে স্বাস্থ্যগত কারণে মুক্তি পান। মুক্তি পেয়ে সংগঠনের কাজের জন্য বাড়ি বা কলকাতায় না গিয়ে মুন্সীগঞ্জে চাঁপাতলী স্কুলে প্রধান শিক্ষকের কাজে যোগ দেন। ১৯৫০ সালের দাঙ্গার পর সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ব্যাপক দেশত্যাগের কারণে ছাত্র সংখ্যা কমে যাওয়ায় স্কুলটি বন্ধ হয়ে যায়। এ অবস্থায় তিনি কাছেই রামপাল হাইস্কুলে শিক্ষকতার কাজ নেন। সে অবস্থাতেই ১৯৫০-এর সেপ্টেম্বরে তিনি আবার গ্রেফতার হন। এবার ১৯৫৪ সালের জানুয়ারি পর্যন্ত আটক থাকতে হয়। ১৯৫৪ সালে জানুয়ারিতে মুক্তি দিয়ে ময়মনসিংহ মিউনিসিপ্যাল এলাকায় তাকে অন্তরীণ করা হয়। সেখানে তিনি যুক্ত হন ময়মনসিংহ জেলা কমিটির সঙ্গে। ১৯৫৪ সালের নির্বাচনের আগে ময়মনসিংহে যখন কমিউনিস্ট পার্টির প্রকাশ্য অফিস খোলা হয়, তখন তার দায়িত্ব নেন তিনি। নির্বাচনের আগে আবারও গ্রেফতার করা হয় তাকে।
১৯৫৭ সালে ন্যাপ গঠিত হওয়ার পর তিনি পার্টির সিদ্ধান্তক্রমেই ন্যাপের সহ-সম্পাদক নির্বাচিত হন। এ সময় ন্যাপের ব্যাপারে পাকিস্তানে যুক্ত নির্বাচনের পক্ষে ময়মনসিংহে জনমত সংগঠনে বিশেষভাবে উদ্যোগী হন। ১৯৫৮ সালে আইয়ুব খান সাময়িক শাসন জারি করলে তিনি আত্মগোপনে চলে যান। আত্মগোপন অবস্থায় তিনি ময়মনসিংহে পার্টি সংগঠন গুছিয়ে তুলতে উদ্যোগী ছিলেন। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে ময়মনসিংহ শহরের মহাখালী স্কুলে ন্যাপ-কমিউনিস্ট পার্টি ও ছাত্র ইউনিয়নের উদ্যোগে ক্যাম্প স্থাপন করা হয়। ময়মনসিংহ শহর যখন পাক হানাদার বাহিনীর দখলে চলে যায় তখন তিনি মূলত কিশোরগঞ্জকে ভিত্তি করে মুক্তিযুদ্ধ সংগঠনের কাজে যুক্ত ছিলেন। জুলাইয়ের শেষভাগে প্রথমে আগরতলা ও পরে কলকাতা হয়ে তিনি মেঘালয়ে বারেংগাপাড়ায় ময়মনসিংহ জেলার ন্যাপ, কমিউনিস্ট পার্টি ও ছাত্র ইউনিয়নের উদ্যোগে স্থাপিত ক্যাম্পে যোগ দেন এবং মুক্তিযুদ্ধের বাকি সময়টা ওই ক্যাম্পকে ভিত্তি করে মুক্তিযুদ্ধের কাজে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেন।
স্বাধীনতার পর ৭২-এর জানুয়ারিতে তিনি ময়মনসিংহে ফিরে আসেন এবং আবারও জেলা কমিউনিস্ট পার্টি ও চলমান আন্দোলনে নিজেকে যুক্ত করেন। এ সময়ে তার উদ্যোগেই ময়মনসিংহে ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্রের শাখা গড়ে ওঠে এবং তাকে স্থানীয় শাখার সভাপতি নির্বাচিত করা হয়।
১৯৭৩ সালে বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির দ্বিতীয় কংগ্রেসে তিনি পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটির সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য নির্বাচিত হন। এ সময় তিনি ঢাকায় স্থায়ীভাবে বাস করতে শুরু করেন। পার্টির সাংগঠনিক কাজ ছাড়াও উপরোক্ত দায়িত্বগুলো ১৯৯২ সালে পার্টির সঙ্গে সম্পর্ক ছেদ করা পর্যন্ত তার ওপরই ন্যস্ত ছিল।
অজয় রায় দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনে ১৮ বছর জেলে কাটিয়েছেন এবং স্বাধীনতার আগে ও পরে ৫ বছরের কিছু বেশি সময় কাটিয়েছেন আত্মগোপনে।
জয়ন্তী রায় : অজয় রায়ের সহধর্মিণী
No comments