বেতন-ভাতা বৃদ্ধির সঙ্গে দক্ষতার সামঞ্জস্য থাকতে হবে by ধীরাজ কুমার নাথ
অষ্টম বেতন ও চাকরি কমিশন প্রায় এক বছর
পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও পর্যালোচনা করে গত ২১ ডিসেম্বর সরকারের কাছে তাদের
সুপারিশ পেশ করেছে। ইতিপূর্বে ৭ বার পে-কমিশন গঠিত হয়েছিল ১৯৭৩, ১৯৭৬,
১৯৮৫, ১৯৯০, ১৯৯৭, ২০০৫ ও ২০০৯ সালে। তার মধ্যে ১৯৮৫ সালে বেতন-ভাতা প্রায়
দ্বিগুণ করা হয়েছিল। তবে এবার ২০১৪ সালের সুপারিশে, যা ২০১৫ সালের জুলাই
থেকে বাস্তবায়ন হতে পারে, অধিকাংশ ক্ষেত্রে বেতন-ভাতা দ্বিগুণ বা তারও বেশি
করার সুপারিশ করা হয়েছে। সপ্তম পে-কমিশন সচিবদের বেতন ৪০ হাজার টাকা
সুপারিশ করেছিল, সেখানে বর্তমানে ৮০ হাজার টাকা সুপারিশ করা হয়েছে এবং
সিনিয়র সচিবরা পাবেন ৮৮ হাজার টাকা। মন্ত্রিপরিষদ সচিব ও মুখ্যসচিব পাবেন
৪৫ হাজারের পরিবর্তে ১ লাখ টাকা অর্থাৎ দ্বিগুণেরও বেশি। এটি একটি
উদারভিত্তিক সুপারিশ, যার ফলে সরকারি নিজস্ব কোষাগারের ওপর সরাসরি চাপ
বাড়বে প্রায় ৬৪ শতাংশ। তবে সরকার কর্তৃক ২০১২ সালে প্রদত্ত ২০ শতাংশ
মহার্ঘ্য ভাতা বর্তমান বেতন স্কেল বাস্তবায়নের সঙ্গে সঙ্গে বিলুপ্ত হবে।
একজন বিসিএস কর্মকর্তা চাকরিতে প্রবেশের শুরুতে পাবেন প্রায় ২৫ হাজার টাকা।
অবশ্য কমিশন ২০টি স্কেলের পরিবর্তে ১৬টি গ্রেডের সুপারিশ করেছে। এ ছাড়া
পিতা-মাতাকে পরিবারের সদস্য বিবেচনা করে আগের ৪ সদ্যসের স্থলে ৬ সদস্য করে
পরিবারের সংজ্ঞা নির্ধারণ করা হয়েছে। তবে সর্বনিম্ন বেতন ৮ হাজার ২০০ টাকা
করার প্রস্তারের অর্থ সর্বোচ্চ ও সর্বনিম্ন বেতনের অনুপাত ধার্য করা হয়েছে
১ অনুপাত ৯ দশমিক ৭৬ (১:৯.৭৬) অর্থাৎ নিুপদস্থ কর্মচারীদের বেতন-ভাতা ১ : ৮
করার দাবি পূরণ হয়নি।
বেতন-ভাতা সম্পর্কিত সুপারিশ ছাড়াও এ কমিশনের অন্য কিছু সুপারিশ লক্ষণীয়। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে, প্রেষণসহ সব রকমের ভাতা বাতিল এবং ডেপুটেশন না রাখা। তবে বাড়ি ভাড়া ভাতা যৌক্তিক করতে চার ধরনের প্রস্তাব করা হয়েছে। একটি উল্লেখযোগ্য সুপারিশ হচ্ছে, এমপিওভুক্ত স্কুলগুলো তাদের ছাত্রদের বেতন থেকে যে রাজস্ব পায় তার একটি অংশ সরকারের রাজস্ব খাতে জমা দেয়া। এ ছাড়াও পেনশনের হার শতকার ৯০ ভাগে উন্নীত করা এবং ২০ বছরে স্বেচ্ছা অবসরে যাওয়ার সুপারিশ করা হয়েছে বলে জানা যায়। বর্তমান সরকারি কল্যাণ ফান্ডকে পুনর্গঠিত করে বীমা ব্যবস্থাপনা, পেনশন ফান্ড ব্যবস্থাপনা এবং কল্যাণ ফান্ড ব্যবস্থাপনা করার সুপারিশ করা হয়েছে। এ ছাড়াও স্থায়ী বেতন ও চাকরি কমিশন গঠনের সুপারিশ করা হয়েছে।
লক্ষণীয়, সরকার সবচেয়ে বেশি বরাদ্দ রাখে শিক্ষা খাতে, কিন্তু শিক্ষার মান কি বেড়েছে? দুর্নীতি দমন কমিশনের চেয়ারম্যান ক’দিন আগে অভিমত প্রকাশ করেছেন, বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশি দুর্নীতিগ্রস্ত হচ্ছে শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতের কর্মকাণ্ড। অবশ্যই দুটি খাতে নিয়োজিত সরকারি চাকরিজীবীরা এজন্য বহুলাংশে দায়ী। জাতির দুর্ভাগ্য হচ্ছে, সবচেয়ে সম্মানিত পদে অধিষ্টিত ব্যক্তিরাই দুর্নীতিতে শীর্ষস্থানে অবস্থান করেন। অনেকে সুশাসন নিয়ে বই লিখেছেন, দেশ-বিদেশে প্রশিক্ষণ নিয়ে সুনাম অর্জন করেছেন এবং একই সঙ্গে সব ধরনের দুর্নীতিতে ‘সুনাম’ অর্জন করছেন। বিচিত্র এই দেশ!
শিক্ষাঙ্গনে ছাত্রীদের মান-সম্মান রক্ষা করা কঠিন হয়ে পড়েছে। স্বাস্থ্য খাতে রোগীদের প্রতি চরম অবজ্ঞা প্রদর্শন করা হচ্ছে। রোগীরা দেশের বাইরে চিকিৎসা নেয়ায় প্রতিবছর প্রায় ১ হাজার কোটি টাকা বিদেশে চলে যাচ্ছে। বাংলাদেশে অবস্থিত ভারতীয় হাইকমিশন শুধু চিকিৎসার লক্ষ্যে ভারতযাত্রীদের জন্য ভিসা সেন্টার খুলছে। এমনটি ভাবা যায়!
সাম্প্রতিক কিছু খবর দেশবাসীকে নিদারুণভাবে হতাশ করেছে। শুধু শিক্ষক ও চিকিৎসদের কথা বললে ভুল হবে। প্রশাসনে নিয়োজিত কিছু উচ্চ পর্যায়ের কর্মকর্তা মানসম্মান জলাঞ্জলি দিয়ে জাল মুক্তিযোদ্ধা সাটিফিকেট নিয়ে নৈতিকতাকে বিসর্জনের নির্দশন স্থাপন করেছেন এবং অনেকে সুকৌশলে জনগণকে প্রতারিত করছেন। চরম অবক্ষয় দৃশ্যমান হচ্ছে জনবল নিয়োগে, সরকারি কেনাকাটায় এবং কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের আচরণে।
আমার বক্তব্য বেতন-ভাতা বাড়ানোর বিরুদ্ধে নয়। আমার অভিমত হচ্ছে, বেতন দ্বিগুণ করার সঙ্গে সঙ্গে চারিত্রিক গুণাবলীর উন্নতি হবে কি-না এবং তার কোনো সুপারিশ এই কমিশন করেছে কি-না? খুশি হতে পারতাম যদি দেখা যেত এ কমিশন দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তাদের কঠোর শাস্তির সুপারিশ করেছে। প্রতারণা করে জাল সার্টিফিকেট গ্রহণকারী উচ্চ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের কঠোর শাস্তি প্রদানের সুপারিশ করার প্রয়োজন ছিল। এবারের কমিশন হচ্ছে পে অ্যান্ড সার্ভিসেস কমিশন; তাই সরকারি কর্মচারীদের আচরণ বিধিমালায় কঠোর ও বৈপ্লবিক কিছু সুপারিশ করার প্রয়োজন ছিল। প্রজাতন্ত্রের কর্মচারীরা জনগণের সেবক, প্রভু নয়- এমন মানসিকতার উন্মেষ ঘটাতে না পারলে গণতন্ত্র সুপ্রতিষ্ঠিত হবে না। সরকারি কর্মচারীরা প্রকাশ্যে কোনো দলের হয়ে কথা বলবেন, রাজনৈতিক দলের সভায় উপস্থিত হয়ে স্লোগান দেবেন, শেয়ার মার্কেটে গিয়ে বিচরণ করবেন- এমনটি কি চলতেই থাকবে? সরকারি কর্মচারীদের আচরণ বিধিমালার পরিবর্তন প্রয়োজন। তাছাড়া বর্তমানে প্রচলিত সরকারি কর্মচারী (শৃংখলা ও আপিল) বিধিমালা ১৯৮৫-এর আওতায় শাস্তি প্রদান করা কঠিন। তাই প্রয়োজন ডিজিটাল পদ্ধতি উদ্ভাবন করে সুপারিশ করা যাতে শাস্তি প্রদান কঠোর, অথচ সহজ ও দ্রুত হয়। বেতন-ভাতা বাড়বে কিন্তু সরকারি কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের দক্ষতা বৃদ্ধি, শুদ্ধাচরণের জন্য কোনো সুপারিশ থাকবে না, এমনটি ঠিক নয়।
বর্তমানে সরকারি কর্মকর্তা ও কর্মচারীর সংখ্যা ১৩ লাখ। তাদের অতিরিক্ত বেতন-ভাতা দিতে সরকারি কোষাগার থেকে ব্যয়ের পরিমাণ বাড়বে কয়েক হাজার কোটি টাকা। এর ফলে মুদ্রাস্ফীতি বা দ্রব্যমূল্য বাড়বে বলে অনেকে আশংকা প্রকাশ করলেও সরকারিভাবে তা স্বীকার করা হচ্ছে না। কিন্তু এই যে গত পে-কমিশনের তুলনায় ৫ বছরে বেতন দ্বিগুণ হতে যাচ্ছে, সেক্ষেত্রে ধরে নিতে হবে গত ৫ বছরে দ্রব্যমূল্যও ৫ গুণ বেড়েছে। তাহলে সরকারের স্থিতিশীল প্রবৃদ্ধি অথবা দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে রাখার দাবি কি ভুল?
২০০৩ সালে আমি যখন সচিব হিসেবে অবসর গ্রহণ করি, তখন সচিবদের সর্বোচ্চ বেতন ছিল ১৫ হাজার টাকা এবং সে হিসাবেই পেনশন পেয়েছি। এই ১২
বছরে কি তা ৬ গুণ বৃদ্ধি পেয়েছে? এই হিসাবটা সঠিকভাবে করা হয়েছে কি-না সন্দেহ আছে। বাড়ি ভাড়া ও জমির দাম
ছাড়া অনেক কিছুরই মুদ্রাস্ফীতির সঙ্গে সামঞ্জস্য আছে বলে ধরা যায়। তারপরও বলতে হয়, বেতন বৃদ্ধির প্রস্তাব সমর্থনযোগ্য। কারণ, সরকারি কর্মচারীদের ধার-দেনা করতে হবে কেন?
তবে একটি কথা ভুললে চলবে না, তা হচ্ছে- সরকারি কর্মচারীদের জীবনধারা হতে হবে সুুনিয়ন্ত্রিত ও কঠোর আত্মসংযমী (Strictly self-disciplined life maintaining austerity)। শিক্ষকদের হতে হবে আর্দশ চরিত্রের অধিকারী এবং চিকিসৎকদের
হতে হবে সেবার প্রতিভূ। এগুলো নীতিবাক্যমূলক কথা; কিন্তু জাতির বৃহত্তর স্বার্থে মূল বার্তা এটিই।
একজন প্রশিক্ষকের কথা মনে আছে, যিনি ষাটের দশকে সিভিল সার্ভিস কর্মকর্তাদের নীতিশাস্ত্র ও নৈতিকতা নিয়ে বক্তৃতা দিতেন। তিনি বারবার বলতেন, দুর্বত্তায়নের সুযোগের অবাধ দুয়ার তোমাদের জন্য উন্মুক্ত; কিন্তু তোমাদের কর্মজীবন প্রতিদিন প্রতিপদে সততা ও ন্যায়পরায়ণতার পরীক্ষা। একজন ম্যাজিস্ট্রেট মিথ্যা কথা বলতে পারেন না, একজন সরকারি কর্মকর্তা জনগণের সঙ্গে প্রতারণা করতে পারেন না। তার জীবন পদ্ধতি হবে পরিচ্ছন্ন। তাই সরকারি পদে নিয়োগের প্রাক্কালে নির্ভেজাল প্রতিযোগিতার
মাধ্যমেই মেধাবী ও যোগ্য প্রার্থীদের নিয়োগ করলে এমন একটি প্রত্যাশা পূরণের সম্ভাবনা থাকবে বেশি।
সম্ভবত এমন একটি সুস্থ ভাবনা থেকেই পে-কমিশন সরকারি কর্মচারীদের বেতন-ভাতা বৃদ্ধির সুপারিশ করেছে। তাই দেশবাসীর প্রত্যাশা, তাদের কর প্রদান সার্থক হোক, দেশে সুশাসন প্রতিষ্ঠিত হোক। সুন্দর একটি প্রশাসনিক পরিবেশ দৃশ্যমান করতে হলে সরকারি কর্মকর্তাদের বৃহত্তর প্রাপ্তির লক্ষ্যে ক্ষুদ্রস্বার্থ বির্সজন দিতে হবে। দক্ষতার ও জবাবদিহিতার স্বাক্ষর রাখতে হবে প্রতিটি কর্মকাণ্ডে।
ধীরাজ কুমার নাথ : তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা, সাবেক সচিব
বেতন-ভাতা সম্পর্কিত সুপারিশ ছাড়াও এ কমিশনের অন্য কিছু সুপারিশ লক্ষণীয়। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে, প্রেষণসহ সব রকমের ভাতা বাতিল এবং ডেপুটেশন না রাখা। তবে বাড়ি ভাড়া ভাতা যৌক্তিক করতে চার ধরনের প্রস্তাব করা হয়েছে। একটি উল্লেখযোগ্য সুপারিশ হচ্ছে, এমপিওভুক্ত স্কুলগুলো তাদের ছাত্রদের বেতন থেকে যে রাজস্ব পায় তার একটি অংশ সরকারের রাজস্ব খাতে জমা দেয়া। এ ছাড়াও পেনশনের হার শতকার ৯০ ভাগে উন্নীত করা এবং ২০ বছরে স্বেচ্ছা অবসরে যাওয়ার সুপারিশ করা হয়েছে বলে জানা যায়। বর্তমান সরকারি কল্যাণ ফান্ডকে পুনর্গঠিত করে বীমা ব্যবস্থাপনা, পেনশন ফান্ড ব্যবস্থাপনা এবং কল্যাণ ফান্ড ব্যবস্থাপনা করার সুপারিশ করা হয়েছে। এ ছাড়াও স্থায়ী বেতন ও চাকরি কমিশন গঠনের সুপারিশ করা হয়েছে।
লক্ষণীয়, সরকার সবচেয়ে বেশি বরাদ্দ রাখে শিক্ষা খাতে, কিন্তু শিক্ষার মান কি বেড়েছে? দুর্নীতি দমন কমিশনের চেয়ারম্যান ক’দিন আগে অভিমত প্রকাশ করেছেন, বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশি দুর্নীতিগ্রস্ত হচ্ছে শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতের কর্মকাণ্ড। অবশ্যই দুটি খাতে নিয়োজিত সরকারি চাকরিজীবীরা এজন্য বহুলাংশে দায়ী। জাতির দুর্ভাগ্য হচ্ছে, সবচেয়ে সম্মানিত পদে অধিষ্টিত ব্যক্তিরাই দুর্নীতিতে শীর্ষস্থানে অবস্থান করেন। অনেকে সুশাসন নিয়ে বই লিখেছেন, দেশ-বিদেশে প্রশিক্ষণ নিয়ে সুনাম অর্জন করেছেন এবং একই সঙ্গে সব ধরনের দুর্নীতিতে ‘সুনাম’ অর্জন করছেন। বিচিত্র এই দেশ!
শিক্ষাঙ্গনে ছাত্রীদের মান-সম্মান রক্ষা করা কঠিন হয়ে পড়েছে। স্বাস্থ্য খাতে রোগীদের প্রতি চরম অবজ্ঞা প্রদর্শন করা হচ্ছে। রোগীরা দেশের বাইরে চিকিৎসা নেয়ায় প্রতিবছর প্রায় ১ হাজার কোটি টাকা বিদেশে চলে যাচ্ছে। বাংলাদেশে অবস্থিত ভারতীয় হাইকমিশন শুধু চিকিৎসার লক্ষ্যে ভারতযাত্রীদের জন্য ভিসা সেন্টার খুলছে। এমনটি ভাবা যায়!
সাম্প্রতিক কিছু খবর দেশবাসীকে নিদারুণভাবে হতাশ করেছে। শুধু শিক্ষক ও চিকিৎসদের কথা বললে ভুল হবে। প্রশাসনে নিয়োজিত কিছু উচ্চ পর্যায়ের কর্মকর্তা মানসম্মান জলাঞ্জলি দিয়ে জাল মুক্তিযোদ্ধা সাটিফিকেট নিয়ে নৈতিকতাকে বিসর্জনের নির্দশন স্থাপন করেছেন এবং অনেকে সুকৌশলে জনগণকে প্রতারিত করছেন। চরম অবক্ষয় দৃশ্যমান হচ্ছে জনবল নিয়োগে, সরকারি কেনাকাটায় এবং কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের আচরণে।
আমার বক্তব্য বেতন-ভাতা বাড়ানোর বিরুদ্ধে নয়। আমার অভিমত হচ্ছে, বেতন দ্বিগুণ করার সঙ্গে সঙ্গে চারিত্রিক গুণাবলীর উন্নতি হবে কি-না এবং তার কোনো সুপারিশ এই কমিশন করেছে কি-না? খুশি হতে পারতাম যদি দেখা যেত এ কমিশন দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তাদের কঠোর শাস্তির সুপারিশ করেছে। প্রতারণা করে জাল সার্টিফিকেট গ্রহণকারী উচ্চ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের কঠোর শাস্তি প্রদানের সুপারিশ করার প্রয়োজন ছিল। এবারের কমিশন হচ্ছে পে অ্যান্ড সার্ভিসেস কমিশন; তাই সরকারি কর্মচারীদের আচরণ বিধিমালায় কঠোর ও বৈপ্লবিক কিছু সুপারিশ করার প্রয়োজন ছিল। প্রজাতন্ত্রের কর্মচারীরা জনগণের সেবক, প্রভু নয়- এমন মানসিকতার উন্মেষ ঘটাতে না পারলে গণতন্ত্র সুপ্রতিষ্ঠিত হবে না। সরকারি কর্মচারীরা প্রকাশ্যে কোনো দলের হয়ে কথা বলবেন, রাজনৈতিক দলের সভায় উপস্থিত হয়ে স্লোগান দেবেন, শেয়ার মার্কেটে গিয়ে বিচরণ করবেন- এমনটি কি চলতেই থাকবে? সরকারি কর্মচারীদের আচরণ বিধিমালার পরিবর্তন প্রয়োজন। তাছাড়া বর্তমানে প্রচলিত সরকারি কর্মচারী (শৃংখলা ও আপিল) বিধিমালা ১৯৮৫-এর আওতায় শাস্তি প্রদান করা কঠিন। তাই প্রয়োজন ডিজিটাল পদ্ধতি উদ্ভাবন করে সুপারিশ করা যাতে শাস্তি প্রদান কঠোর, অথচ সহজ ও দ্রুত হয়। বেতন-ভাতা বাড়বে কিন্তু সরকারি কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের দক্ষতা বৃদ্ধি, শুদ্ধাচরণের জন্য কোনো সুপারিশ থাকবে না, এমনটি ঠিক নয়।
বর্তমানে সরকারি কর্মকর্তা ও কর্মচারীর সংখ্যা ১৩ লাখ। তাদের অতিরিক্ত বেতন-ভাতা দিতে সরকারি কোষাগার থেকে ব্যয়ের পরিমাণ বাড়বে কয়েক হাজার কোটি টাকা। এর ফলে মুদ্রাস্ফীতি বা দ্রব্যমূল্য বাড়বে বলে অনেকে আশংকা প্রকাশ করলেও সরকারিভাবে তা স্বীকার করা হচ্ছে না। কিন্তু এই যে গত পে-কমিশনের তুলনায় ৫ বছরে বেতন দ্বিগুণ হতে যাচ্ছে, সেক্ষেত্রে ধরে নিতে হবে গত ৫ বছরে দ্রব্যমূল্যও ৫ গুণ বেড়েছে। তাহলে সরকারের স্থিতিশীল প্রবৃদ্ধি অথবা দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে রাখার দাবি কি ভুল?
২০০৩ সালে আমি যখন সচিব হিসেবে অবসর গ্রহণ করি, তখন সচিবদের সর্বোচ্চ বেতন ছিল ১৫ হাজার টাকা এবং সে হিসাবেই পেনশন পেয়েছি। এই ১২
বছরে কি তা ৬ গুণ বৃদ্ধি পেয়েছে? এই হিসাবটা সঠিকভাবে করা হয়েছে কি-না সন্দেহ আছে। বাড়ি ভাড়া ও জমির দাম
ছাড়া অনেক কিছুরই মুদ্রাস্ফীতির সঙ্গে সামঞ্জস্য আছে বলে ধরা যায়। তারপরও বলতে হয়, বেতন বৃদ্ধির প্রস্তাব সমর্থনযোগ্য। কারণ, সরকারি কর্মচারীদের ধার-দেনা করতে হবে কেন?
তবে একটি কথা ভুললে চলবে না, তা হচ্ছে- সরকারি কর্মচারীদের জীবনধারা হতে হবে সুুনিয়ন্ত্রিত ও কঠোর আত্মসংযমী (Strictly self-disciplined life maintaining austerity)। শিক্ষকদের হতে হবে আর্দশ চরিত্রের অধিকারী এবং চিকিসৎকদের
হতে হবে সেবার প্রতিভূ। এগুলো নীতিবাক্যমূলক কথা; কিন্তু জাতির বৃহত্তর স্বার্থে মূল বার্তা এটিই।
একজন প্রশিক্ষকের কথা মনে আছে, যিনি ষাটের দশকে সিভিল সার্ভিস কর্মকর্তাদের নীতিশাস্ত্র ও নৈতিকতা নিয়ে বক্তৃতা দিতেন। তিনি বারবার বলতেন, দুর্বত্তায়নের সুযোগের অবাধ দুয়ার তোমাদের জন্য উন্মুক্ত; কিন্তু তোমাদের কর্মজীবন প্রতিদিন প্রতিপদে সততা ও ন্যায়পরায়ণতার পরীক্ষা। একজন ম্যাজিস্ট্রেট মিথ্যা কথা বলতে পারেন না, একজন সরকারি কর্মকর্তা জনগণের সঙ্গে প্রতারণা করতে পারেন না। তার জীবন পদ্ধতি হবে পরিচ্ছন্ন। তাই সরকারি পদে নিয়োগের প্রাক্কালে নির্ভেজাল প্রতিযোগিতার
মাধ্যমেই মেধাবী ও যোগ্য প্রার্থীদের নিয়োগ করলে এমন একটি প্রত্যাশা পূরণের সম্ভাবনা থাকবে বেশি।
সম্ভবত এমন একটি সুস্থ ভাবনা থেকেই পে-কমিশন সরকারি কর্মচারীদের বেতন-ভাতা বৃদ্ধির সুপারিশ করেছে। তাই দেশবাসীর প্রত্যাশা, তাদের কর প্রদান সার্থক হোক, দেশে সুশাসন প্রতিষ্ঠিত হোক। সুন্দর একটি প্রশাসনিক পরিবেশ দৃশ্যমান করতে হলে সরকারি কর্মকর্তাদের বৃহত্তর প্রাপ্তির লক্ষ্যে ক্ষুদ্রস্বার্থ বির্সজন দিতে হবে। দক্ষতার ও জবাবদিহিতার স্বাক্ষর রাখতে হবে প্রতিটি কর্মকাণ্ডে।
ধীরাজ কুমার নাথ : তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা, সাবেক সচিব
No comments