শুরু ও শেষ চ্যালেঞ্জেই by কাফি কামাল
৫ই
জানুয়ারি একতরফা নির্বাচন প্রতিহতের চ্যালেঞ্জ সামনে রেখে বছর শুরু হয়েছিল
বিএনপির। বছর শেষ হয়েছে সরকার পতন আন্দোলনের চ্যালেঞ্জ সামনে রেখে। দুই
মাস ধরে ফের কঠোর আন্দোলনে যাবার হুঁশিয়ারি দিয়ে আসছে দলটির শীর্ষ নেতারা।
নতুন করে টাইম ফ্রেম ধরা হয়েছে জানুয়ারি। যার কেন্দ্রবিন্দু রাখা হয়েছে ৫ই
জানুয়ারি একতরফা নির্বাচনের দিনটিকে। গাজীপুরের সমাবেশের মাধ্যমে বছর শেষ
করার কথা ছিল বিএনপির। কিন্তু একই দিন একই স্থানে ছাত্রলীগ সমাবেশের ঘোষণা
দিলে রাজনৈতিক অঙ্গনে তৈরি হয় আন্দোলনের আগাম উত্তাপ। তবে শেষ মুহূর্তে
প্রশাসন ১৪৪ ধারা জারি করে সে উত্তাপে পানি ঢেলে দেয়। প্রতিবাদে ২৭শে
ডিসেম্বর গাজীপুর ও ২৯শে ডিসেম্বর সারা দেশে হরতাল এবং দেশব্যাপী বিক্ষোভ
কর্মসূচির মাধ্যমেই শেষ হয় বিএনপির ২০১৪ সাল। এদিকে বছরজুড়েই ছিল সাংগঠনিক
পুনর্গঠন, জনমত গঠন, জেলা সফর আর ধারাবাহিক মতবিনিময়। সব মিলিয়ে আন্দোলন
প্রস্তুতির বছর হিসেবে ২০১৪ কেটেছে দলটির। ঘুরে দাঁড়ানোর বছরও এটি। ৫ই
জানুয়ারির নির্বাচনের পরপরই হঠাৎ করে আন্দোলন কর্মসূচি থেকে সরে আসে
বিএনপি। তারপর অন্তত বারবার কঠোর আন্দোলনের টাইম ফ্রেম ঘোষণা করেও
নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতির মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল তারা। তবে টানা অবরোধ দিয়ে বছর
শুরু করলেও এক সপ্তাহের মাথায় কড়া কর্মসূচি থেকে সরে নির্বিরোধ একটি বছর
পার করেছেন দলের নেতারা। ২০১৪ সালে হাইকোর্টের বিচারকদের অভিশংসন আইনকে
কেন্দ্র করে একদিন মাত্র হরতাল পালন করেছে বিএনপি। ফলে রাজপথে আইন-শৃঙ্খলা
বাহিনীর দমন-পীড়ন থেকে অনেকটাই নিরাপদে ছিলেন তারা। বছরের শেষ দিকে বিশেষ
আদালতে খালেদা জিয়ার হাজিরাকে কেন্দ্র করে পুরান ঢাকার বকশীবাজার এলাকায়
ছাত্রলীগের হামলার শিকার হয় বিএনপি ও অঙ্গদলের নেতাকর্মীরা। ওদিকে বিগত
বছরগুলোতে দায়ের নানা মামলায় আনুষ্ঠানিক বিচারের মুখোমুখি হয়েছেন দলটির
নেতারা। ২০১৪ সালে রাজপথের কড়া আন্দোলনের বাইরে থাকলেও প্রতিকূল রাজনৈতিক
পরিস্থিতিতে দলের ঐক্য ধরে রাখতে সফল হয়েছেন খালেদা জিয়া। এছাড়া ২০১৪ সালে
বিএনপির রাজনীতির সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট্য হচ্ছে রাজনৈতিক ইস্যুতে বক্তব্যের
মাধ্যমে রাজনীতিকে সক্রিয় হয়ে ওঠেছেন দলের সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক
রহমান। রাজনীতিতে ঐতিহাসিক ইস্যু নিয়ে তার দেয়া নানা বক্তব্য সরকার ও
বিএনপি নেতাকর্মীদের মধ্যে তৈরি করেছে রাজনৈতিক বাহাস। বছরের শেষ দিকে এসে
নতুন বছরের শুরুতেই কঠোর আন্দোলনের ঘোষণা দিয়েছে বিএনপি। দলটির
আত্মবিশ্বাসের টনিক হিসেবে কাজ করেছে ৫ই জানুয়ারির নির্বাচনে ভোটারদের
অনুপস্থিতি ও জেলা সমাবেশগুলোতে মানুষের স্রোত।
আন্দোলনের অংশ হিসেবে উপজেলা নির্বাচনে অংশ নেন বিএনপি নেতারা। দলের পক্ষ থেকে অনানুষ্ঠানিকভাবে প্রার্থী সমর্থন দেয়া হয়। জনসমর্থনের পালে নতুন করে হাওয়া বইয়ে দিতেই স্থানীয় নির্বাচনকে চ্যালেঞ্জ হিসেবে নেয় বিএনপি। একক প্রার্থী সমর্থন দিতে দলের সিনিয়র নেতাদের দায়িত্ব দেয়া হলেও কেন্দ্রীয় নেতার প্রভাব বিস্তার, জেলা নেতাদের কোন্দল ও সংশ্লিষ্ট আসনের বিএনপিদলীয় সাবেক এমপিদের প্রতিবন্ধকতার কারণে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে ব্যর্থ হয় সে সব সাংগঠনিক টিম। উপজেলা নির্বাচনকে কেন্দ্র করে তৃণমূলের বিদ্রোহী নেতাদের বহিষ্কার ও প্রত্যাহারের হিড়িক পড়েছে বিএনপিতে। উপজেলা নির্বাচনকে কেন্দ্র করে বহিষ্কারের মুখে পড়েন জেলা থেকে উপজেলা পর্যায়ে শ’ শ’ গুরুত্বপূর্ণ নেতা। সাংগঠনিক শক্তি সুসংহত করতে দলে ফেরানো ও সমর্থন দেয়া হয় কাউকে কাউকে। তৃণমূলকে এড়িয়ে নেতাদের হস্তক্ষেপে সমর্থন দেয়া প্রার্থীদের বেশির ভাগের ভাগ্যে জোটে পরাজয়। এছাড়া উপজেলা নির্বাচনে জোটের শরিক দল জামায়াতকে নিয়ে দারুণ অস্বস্তিতে পড়ে বিএনপি। জামায়াতের ভূমিকায় নির্বাচনী ফল ও রাজনৈতিকভাবে বিপর্যয়ের মুখে পড়ে দলটি। আলোচনার ভিত্তিতে ভাইস চেয়ারম্যান পদে বিএনপি ছাড় দিলেও চেয়ারম্যান পদে পর্যাপ্ত সহযোগিতা করেনি জামায়াত। তৃণমূল নেতাকর্মীদের অভিযোগ বিএনপিকে হারাতে আওয়ামী লীগের সহযোগী হয়ে কাজ করেছে জামায়াত। যেখানে নির্বাচনের দিন কেন্দ্রে কেন্দ্রে বিএনপি প্রার্থীর এজেন্টকে বের করে দেয়া হয়েছে সেখানে বহাল তবিয়তে ছিলেন জামায়াতের এজেন্টরা। এছাড়া দলটি প্যারালাল প্রার্থী দেয়ায় অর্ধশত বিএনপি প্রার্থী হারেন স্বল্প ব্যবধানে। এ নিয়ে বিএনপি-জামায়াতের তৃণমূল নেতৃত্বে তৈরি হয় ভুল বোঝাবুঝি, বাড়ে দূরত্ব। জামায়াত ইস্যুতে কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের ওপর দারুণ চাপ সৃষ্টি করেছে তৃণমূল। এদিকে বছরজুড়ে বিএনপি নেতাদের অভিযোগ ছিল, সরকার বিরোধী জোটের ভাঙন ধরানোর ষড়যন্ত্র করছে। বছরের মাঝামাঝি এসে বিএনপির নেতৃত্বাধীন জোট ছেড়ে গেছেন ব্যক্তি ও প্যাডসর্বস্ব কয়েকটি দলের কয়েকজন নেতা। যদিও বছরের প্রথম দিকেই সাবেক প্রধানমন্ত্রী কাজী জাফরের নেতৃত্বে জাতীয় পার্টির একটি অংশ ও সাম্যবাদী দলের একটি খণ্ডিত অংশ যোগ দেয় ২০দলীয় জোটে।
চতুর্থ উপজেলা নির্বাচনে ফল-বিপর্যয়কে সাফল্যের পূর্বাভাস ও সাংগঠনিক রাজনীতিতে ঘুরে দাঁড়ানোর উপলক্ষ হিসেবে বিবেচনা করে বিএনপি। নেতারা বলেন, দৃশ্যত সরকারি দলের বিজয় হলেও রাজনীতিতে তাদের অপমৃত্যু ঘটেছে। উপজেলা নির্বাচনে বিএনপির তত্ত্বাবধায়ক সরকার দাবিকে যৌক্তিক ভিত্তি দিয়েছে। উপজেলা নির্বাচনে ব্যাপক অনিয়মের মাধ্যমে তত্ত্বাবধায়ক দাবির যৌক্তিকতা পাকাপোক্ত হওয়ায় নির্বাচন কমিশনকে দিয়েই শুরু হতে পারে পরবর্তী আন্দোলন। এভাবে উপজেলা নির্বাচন, বাজেট ঘোষণা, ঈদুল ফিতর, ঈদুল আজহার পর আন্দোলনে যাওয়ার ঘোষণা দেন বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া। তবে বারবার সে ঘোষণা থেকে সরে আসে দলটি। রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের মতে, আন্দোলনের কথা বললেও সার্বিক পরিস্থিতিতে আন্দোলনের ডাক দেয়ার মতো ভরসা পায়নি বিএনপি। এদিকে ২০১৪ সালের প্রথম থেকেই বিএনপির রাজনৈতিক কর্মসূচি পালনে চলছে একধরনের অঘোষিত নিষেধাজ্ঞা। রাজপথে বিরোধী দলের শান্তিপূর্ণ কর্মসূচিগুলোও পণ্ড করে দেয় পুলিশ। একাধিকবার মেলেনি সভা-সমাবেশের অনুমতিও। জাতীয় বিপ্লব ও সংহতি দিবস উপলক্ষে ৮ই নভেম্বর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে সমাবেশের অনুমতিও দেয়া হয়নি বিএনপিকে। অনুমতির অভাবেই বাতিল হয়েছে খালেদা জিয়ার কয়েকটি সমাবেশের আয়োজন। কয়েকটি সমাবেশে অনুমতি মিলেছে একবারে শেষ মুহূর্তে। বছরের বেশির ভাগ সময়ই দলের নয়াপল্টন কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে জড়ো হতে দেয়া হয়নি বিএনপি নেতাকর্মীদের। তবে মহাজোট সরকারের প্রথম থেকেই বিএনপির আন্দোলনের গতিপ্রকৃতি নিয়ে নানা প্রশ্ন তৈরি হয়েছে দলীয় মহলে। দলের তরফে কিছু কর্মসূচি প্রণয়নে ইস্যু ও সময়ের যৌক্তিকতা বিবেচনায় না আনা, জনস্বার্থ সংশ্লিষ্ট ইস্যুতে অপেক্ষার মোড়কে নীরবতা পালন এবং কার্যকর ইস্যুকে এড়িয়ে যাওয়ার কারণে আন্দোলনের গতিপথকে চূড়ান্ত লক্ষ্যে নেয়া যায়নি বলে মনে করেন কর্মীরা। আঞ্চলিক ইস্যু ও জনস্বার্থ সংশ্লিষ্ট জাতীয় ইস্যুতে শান্তিপূর্ণ কর্মসূচির ভেতর দিয়েই গণতান্ত্রিক আন্দোলনকে তুঙ্গে নেয়ার একটি পরিকল্পনা ছিল বিএনপি। এ জন্য পানির ন্যায্য হিস্যার দাবিতে তিস্তা ব্যারেজ অভিমুখে লংমার্চটিও তারই একটি অংশ। ৫ই জানুয়ারির নির্বাচনের পর বিএনপির নেতৃত্বে ২০ দলের আন্দোলনের সাফল্য-ব্যর্থতা ও ত্রুটি-বিচ্যুতি নিয়ে পর্যালোচনা করে বিএনপি। পেশাজীবী নেতাদের সঙ্গে একাধিক বৈঠকে সে সব ত্রুটি-বিচ্যুতি নিয়ে কথা বলেন খালেদা জিয়া। বিশ্লেষণের পাশাপাশি তা থেকে উত্তরণের উপায় সন্ধান করে নীতিনির্ধারক মহল। সাম্প্রতিক সময়ে বিএনপি চেয়ারপারসন বলছেন, ডিসেম্বরের পর ৫ই জানুয়ারি সরকারের এক বছর পূর্তিকে কেন্দ্র করে আন্দোলন শুরু হবে। রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের মতে, একতরফা নির্বাচনের পর হঠাৎ করে আন্দোলন থেকে সরে আসা ছিল একটি ভুল সিদ্ধান্ত। এদিকে নির্বাচনকালীন নির্দলীয় সরকারের দাবিতে হতাশাগ্রস্ত ও দ্বিধান্বিত নেতাকর্মীদের মনোবল চাঙ্গা ও জনমত গঠনে বছরজুড়ে চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াসহ দলের সিনিয়র নেতারা কয়েক দফায় দেশজুড়ে সফর করেছেন। ১৫ই জানুয়ারি রাজধানীর হোটেল ওয়েস্টিনে অনুষ্ঠিত সংবাদ সম্মেলনে দলের সিনিয়র নেতৃবৃন্দসহ সারা দেশ সফর করার ঘোষণা দেন খালেদা জিয়া। সিনিয়র নেতাদের নেতৃত্বে অন্তত ৩০টি টিম সারা দেশে সাংগঠনিক সফর করেন। ২রা মার্চ রাজবাড়ি, ১৪ই মে নারায়ণগঞ্জ, ২৮শে মে মুন্সীগঞ্জ, ২২শে জুন জয়পুরহাট, ২৪শে সেপ্টেম্বর ব্রাহ্মণবাড়িয়া, ২৮শে সেপ্টেম্বর জামালপুর, ২৪শে অক্টোবর নীলফামারী, ২রা নভেম্বর নাটোর, ১৩ই নভেম্বর কিশোরগঞ্জ, ২৯শে নভেম্বর কুমিল্লা ও ১৩ই ডিসেম্বর নারায়ণগঞ্জ ২০দলীয় জোট আয়োজিত জনসভায় যোগ দেন খালেদা জিয়া।
বছরজুড়ে উল্টো সন্দেহের দোলাচলে এগিয়েছে প্রধান দু’দল বিএনপি-জামায়াতের সম্পর্ক। রাজনৈতিক মহলে বারবার আলোচনায় জন্ম দিয়েছে সরকারের সঙ্গে জামায়াতের সমঝোতার গুজব। ফলে উপজেলা নির্বাচন ও যুদ্ধাপরাধের বিচারসহ সার্বিক পরিস্থিতিতে বছরের শুরু থেকেই জামায়াতকে পর্যবেক্ষণে রেখেছে বিএনপি। ‘জামায়াতের সঙ্গ ত্যাগ না করলে বিএনপির সঙ্গে কোন আলোচনা বা সমঝোতা নয়’- কথাটি প্রধানমন্ত্রী থেকে শুরু করে তার দলের নেতারাও বলছেন প্রতিনিয়ত। ইউরোপীয় পার্লামেন্টের গৃহীত প্রস্তাবেও জামায়াত-হেফাজতের সঙ্গে বিএনপির সম্পর্ক ছেদের বিষয়টি গুরুত্ব পায়। পাশাপাশি ঢাকায় দায়িত্বরত বিদেশী কূটনীতিকদের অনেকেই বিএনপিকে একই পরামর্শ দিয়েছেন। অন্যদিকে জামায়াত জোটের দ্বিতীয় প্রধান শরিক দল হলেও হাইকোর্টের রায়ে নির্বাচন কমিশনের নিবন্ধন হারিয়েছে দলটি। রয়েছে নিষিদ্ধের ঝুঁকিতে। এতে জামায়াতের চেয়ে কম ক্ষতিগ্রস্ত হয়নি জোটের প্রধান শরিক দল বিএনপিও। কিন্তু প্রতিকূল রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে দেশী-বিদেশী চাপের মুখেও জামায়াতের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করেনি বিএনপি। অন্যদিকে মাওলানা সাঈদীর রায় ও গোলাম আযমের মৃত্যুকে কেন্দ্র করে বিএনপি ও জামায়াতের মধ্যে নতুন করে টানাপড়েন তৈরি হয়। বিএনপির নীতি-নির্ধারকদের শোক প্রকাশ না করায় ক্ষুব্ধ হন জামায়াত-শিবিরের নেতাকর্মীরা। এ প্রেক্ষাপটেই বছরের মাঝামাঝি সময়ে একটি আন্তর্জাতিক সংবাদ সংস্থাকে দেয়া সাক্ষাৎকারে বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া বলেছেন, জামায়াতের সঙ্গে সম্পর্কটা সাময়িক বলে উল্লেখ করেছেন একটি আন্তর্জাতিক সংবাদ সংস্থাকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে। সরকারবিরোধী আন্দোলনে মাঠে নামা নিয়ে বিএনপির সঙ্গে জামায়াতের তৈরি হয়েছে কৌশলগত দূরত্ব।
৫ই জানুয়ারির নির্বাচনের পর সাংগঠনিকভাবে ঘুরে দাঁড়ানোর উদ্দেশে জেলা কমিটি পুনর্গঠনের উদ্যোগ নেয় বিএনপি। সময়সীমা বেঁধে দিয়ে গঠন করা হয় ডজনখানেক নতুন জেলা আহ্বায়ক কমিটি। কিন্তু তৃণমূলের বিরোধ ও প্রতিবাদের মুখে অচিরেই থেমে যায় সে উদ্যোগ। পরে নির্বাচন কমিশনে বিধি অনুসরণ, সাংগঠনিক পুনর্গঠন, নেতৃত্বের পুনর্বিন্যাস ও চেইন অব কমান্ড প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে দলের জাতীয় কাউন্সিল আয়োজনের নীতিগত সিদ্ধান্ত নেয় বিএনপি। তবে সে উদ্যোগ আলোর মুখ দেখেনি। এদিকে দলের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ইউনিট ঢাকা মহানগর কমিটি নিয়ে সমালোচনা চলছিল দীর্ঘদিন ধরেই। এক পর্যায়ে সংবাদ সম্মেলন ডেকে অব্যাহতি চান মহানগরের আহ্বায়ক সাদেক হোসেন খোকা। জুলাই মাসে দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাসকে আহ্বায়ক, স্বেচ্ছাসেবক দলের সভাপতি হাবিব-উন-নবী খান সোহেল, দলের স্থায়ী কমিটি, ভাইস চেয়ারম্যান, চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা ও যুগ্ম মহাসচিবদের যুগ্ম আহ্বায়ক করে এ কমিটি ঘোষণা দেয়া হয়। তবে নেতাদের দ্বন্দ্ব ও কোন্দলের কারণে শুরুতেই প্রতিবন্ধকতার মুখে পড়ে নতুন কমিটি। নভেম্বরে সিনিয়র নেতাদের সঙ্গে ধারাবাহিক তিনটি বৈঠক করেন খালেদা জিয়া। বৈঠকে নিষ্ক্রিয় ভূমিকার কারণে নীতিনির্ধারক ফোরামের ওপর ক্ষোভ ঝাড়েন তিনি। খালেদা জিয়ার হস্তক্ষেপে সেটার অবসান হলেও সাংগঠনিকভাবে গুছিয়ে উঠতে পারেনি মহানগর বিএনপি। উল্টো কিছু কিছু এলাকায় প্রতিবাদ-প্রতিরোধের মুখে পড়েছেন দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতারা। আন্দোলনের স্বার্থে তারুণ্যনির্ভর ছাত্রদলের কমিটি গঠন হলেও পদ-পদবি নিয়ে সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে দু’পক্ষ। বছরের শেষ দিকে সেটারও অবসান ঘটে। এছাড়া আন্দোলনকে কেন্দ্র করে উপজেলা নির্বাচনের সময় বহিষ্কৃত তৃণমূল নেতাদের দলে ফেরানোর উদ্যোগ নেয় বিএনপি। জুন-আগস্ট মাসে বহিষ্কারাদেশ প্রত্যাহার হয়েছে ২ শতাধিক নেতার। ভুল স্বীকার করে দলে ফেরার আকাঙ্ক্ষা ব্যক্ত ও দলের পক্ষে নানাভাবে ভূমিকা রাখার প্রেক্ষিতে দীর্ঘদিন পর দলের সংস্কারপন্থি হিসেবে পরিচিত নেতাদের দলে ফেরানোর ব্যাপারে ইতিবাচক মনোভাব দেখিয়েছে বিএনপির শীর্ষ নেতৃত্ব। নিজ নিজ এলাকায় কাজ করার জন্য দলের পক্ষ থেকে কয়েকজনকে অলিখিত নির্দেশনাও দেয়া হয়েছে।
২০১৩ সালে বিএনপির বিরুদ্ধে প্রচারণা ছিল অতিমাত্রায় কূটনীতিক-নির্ভর হয়ে পড়েছে দলটি। দলটির নেতাদের অভিযোগ ছিল বাংলাদেশের রাজনীতিতে হস্তক্ষেপ করছে প্রতিবেশী দেশ ভারত। তাই ভারতের জাতীয় নির্বাচনে আওয়ামী লীগের ঐতিহাসিক রাজনৈতিক মিত্র কংগ্রেসের পরাজয় এ হস্তক্ষেপ কমাবে বলে ধারণা ছিল তাদের। ভারতে কংগ্রেসকে হারিয়ে বিজেপি ক্ষমতায় এলেও বাংলাদেশ ইস্যুতে দেশটির দৃষ্টিভঙ্গির বড় কোন পরিবর্তন লক্ষণীয় হয়নি। বিজেপিকে মিত্র মনে করলেও এখন পর্যন্ত ভারতের সঙ্গে কূটনীতিক সম্পর্কের বড় কোন উন্নতি ঘটাতে পারেনি বিএনপি। তবে বছরের মাঝামাঝি সময়ে চীনা কমিউনিস্ট পার্টির আমন্ত্রণে বিএনপির উচ্চপর্যায়ের একটি প্রতিনিধি দল চীন সফর করেছে। তাদের দাবি, আলাপ-আলোচনায় চীন যে বার্তা দিয়েছে তার অর্থ হচ্ছে- একমুখী নয়, বহুমুখী সম্পর্কে বিশ্বাসী চীন। তবে বছরজুড়ে কূটনীতিকদের সঙ্গে বৈঠক করে সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টির চেষ্টা করেছে দলটি। পাশাপাশি সরকারের দুর্নীতি ও দমন-পীড়নের চিত্র তুলে ধরেছে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক মহলে।
অতীতের ধারাবাহিকতায় ২০১৪ সাল জুড়ে বিভিন্ন মামলায় জড়ানো হয়েছে বিএনপি নেতাকর্মীদের। বিশেষ করে ২১শে আগস্ট গ্রেনেড হামলা ও সাবেক অর্থমন্ত্রী কিবরিয়া হত্যাকাণ্ডের মতো স্পর্শকাতর কিছু মামলায় জড়ানো হয়েছে সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমানসহ দলটির কয়েকজন গুরুত্বপূর্ণ নেতা, সিলেট সিটি ও হবিগঞ্জ পৌর মেয়রসহ জনপ্রতিনিধিকে। বিগত বছরগুলোতে উপর্যুপরি মামলার মাধ্যমে আইনি জালে আটকানো হয়েছিল বিএনপি নেতাকর্মীদের। ২০১৪ সালে সে সব মামলায় আনুষ্ঠানিক বিচার শুরু হয়েছে। আদালতে চার্জ গঠন হয়েছে একের পর এক মামলায়। দলের চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া, সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমানসহ স্থায়ী কমিটি থেকে তৃণমূল নেতাদের অনেকেই এখন ১-২৫ মামলায় আনুষ্ঠানিক বিচারের মুখোমুখি। হত্যা, বিস্ফোরণ, ভাঙচুর-অগ্নিসংযোগ ও পুলিশের কাজে বাধা দেয়ার অভিযোগে দ্রুত বিচার আইনে দায়ের করা মামলার পাশাপাশি রয়েছে তথ্য-প্রযুক্তি আইন, রাষ্ট্রদ্রোহ, দুর্নীতির মামলাও। উচ্চ আদালতে আবেদন করেও বাতিল বা স্থগিত করা যায়নি না বিচার প্রক্রিয়া। খালেদা জিয়াকে জিয়া অরফানেজ ও জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট মামলায় চার্জগঠনের মাধ্যমে বিচারের মুখোমুখি করা হয়েছে। মামলা দুটি স্থানান্তর করা হয়েছে পুরান ঢাকার আলিয়া মাদরাসা মাঠে স্থাপিত বিশেষ আদালতে। একই ভাবে দলের সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান লন্ডনে অবস্থানরত তারেক রহমানের নামে নতুন অন্তত অর্ধশতাধিক মামলার পাশাপাশি আগের কয়েকটি মামলায় চার্জ গঠন করা হয়েছে। চার্জগঠনের মাধ্যমে সর্বাধিক মামলায় বিচার শুরু হয়েছে দলের ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের। বিএনপির অভিযোগ জনবিচ্ছিন্ন সরকার মামলা-হামলার মাধ্যমে ক্ষমতায় আঁকড়ে থাকতে চায়। রাজনীতি ও নির্বাচন থেকে দূরে সরিয়ে রাখতে চায় বিএনপি নেতাদের। বিএনপি নেতা ও তাদের আইনজীবীরা বলছেন, মামলার মেরিট যাই থাকুক সরকার সাজা দিতে চায়। বিচার কার্যক্রমে তাড়াহুড়া ও আইনি লড়াইয়ে যুক্তিতর্ককে পাশ কাটিয়ে যাওয়ার মধ্যেই তাদের উদ্দেশ্য পরিষ্কার হয়ে গেছে। মহাজোট সরকারের প্রথম থেকে নানা অভিযোগে গ্রেপ্তার করা হয় বিএনপির একাধিক কেন্দ্রীয় নেতাকে। পরে কিছু নেতা মুক্তি পেলেও অনেকেই এখনও কারাভোগ করছেন। গ্রেপ্তারের তালিকায় ২০১৪ সালে যুক্ত হয়েছেন স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন কয়েকজন সিনিয়র নেতা। স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী, ভাইস চেয়ারম্যান আবদুস সালাম পিন্টু ও সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক নাসিরউদ্দিন আহমেদ পিন্টু বর্তমানে সাজা ভোগ করছেন। এছাড়া মৃত্যুবরণ করেছেন স্থায়ী কমিটির সাবেক সদস্য এডভোকেট খন্দকার মাহবুব আহম্মাদ, সাবেক ডেপুটি স্পিকার ও ভাইস চেয়ারপারসন এলকে সিদ্দিকী, চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা মুহাম্মদ মোশাররফ হোসেন, সাবেক এমপি আমানউল্লাহ চৌধুরী সহ বিএনপি ও অঙ্গদলের অর্ধশত সিনিয়র জেলা পর্যায়ের নেতা।
আন্দোলনের অংশ হিসেবে উপজেলা নির্বাচনে অংশ নেন বিএনপি নেতারা। দলের পক্ষ থেকে অনানুষ্ঠানিকভাবে প্রার্থী সমর্থন দেয়া হয়। জনসমর্থনের পালে নতুন করে হাওয়া বইয়ে দিতেই স্থানীয় নির্বাচনকে চ্যালেঞ্জ হিসেবে নেয় বিএনপি। একক প্রার্থী সমর্থন দিতে দলের সিনিয়র নেতাদের দায়িত্ব দেয়া হলেও কেন্দ্রীয় নেতার প্রভাব বিস্তার, জেলা নেতাদের কোন্দল ও সংশ্লিষ্ট আসনের বিএনপিদলীয় সাবেক এমপিদের প্রতিবন্ধকতার কারণে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে ব্যর্থ হয় সে সব সাংগঠনিক টিম। উপজেলা নির্বাচনকে কেন্দ্র করে তৃণমূলের বিদ্রোহী নেতাদের বহিষ্কার ও প্রত্যাহারের হিড়িক পড়েছে বিএনপিতে। উপজেলা নির্বাচনকে কেন্দ্র করে বহিষ্কারের মুখে পড়েন জেলা থেকে উপজেলা পর্যায়ে শ’ শ’ গুরুত্বপূর্ণ নেতা। সাংগঠনিক শক্তি সুসংহত করতে দলে ফেরানো ও সমর্থন দেয়া হয় কাউকে কাউকে। তৃণমূলকে এড়িয়ে নেতাদের হস্তক্ষেপে সমর্থন দেয়া প্রার্থীদের বেশির ভাগের ভাগ্যে জোটে পরাজয়। এছাড়া উপজেলা নির্বাচনে জোটের শরিক দল জামায়াতকে নিয়ে দারুণ অস্বস্তিতে পড়ে বিএনপি। জামায়াতের ভূমিকায় নির্বাচনী ফল ও রাজনৈতিকভাবে বিপর্যয়ের মুখে পড়ে দলটি। আলোচনার ভিত্তিতে ভাইস চেয়ারম্যান পদে বিএনপি ছাড় দিলেও চেয়ারম্যান পদে পর্যাপ্ত সহযোগিতা করেনি জামায়াত। তৃণমূল নেতাকর্মীদের অভিযোগ বিএনপিকে হারাতে আওয়ামী লীগের সহযোগী হয়ে কাজ করেছে জামায়াত। যেখানে নির্বাচনের দিন কেন্দ্রে কেন্দ্রে বিএনপি প্রার্থীর এজেন্টকে বের করে দেয়া হয়েছে সেখানে বহাল তবিয়তে ছিলেন জামায়াতের এজেন্টরা। এছাড়া দলটি প্যারালাল প্রার্থী দেয়ায় অর্ধশত বিএনপি প্রার্থী হারেন স্বল্প ব্যবধানে। এ নিয়ে বিএনপি-জামায়াতের তৃণমূল নেতৃত্বে তৈরি হয় ভুল বোঝাবুঝি, বাড়ে দূরত্ব। জামায়াত ইস্যুতে কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের ওপর দারুণ চাপ সৃষ্টি করেছে তৃণমূল। এদিকে বছরজুড়ে বিএনপি নেতাদের অভিযোগ ছিল, সরকার বিরোধী জোটের ভাঙন ধরানোর ষড়যন্ত্র করছে। বছরের মাঝামাঝি এসে বিএনপির নেতৃত্বাধীন জোট ছেড়ে গেছেন ব্যক্তি ও প্যাডসর্বস্ব কয়েকটি দলের কয়েকজন নেতা। যদিও বছরের প্রথম দিকেই সাবেক প্রধানমন্ত্রী কাজী জাফরের নেতৃত্বে জাতীয় পার্টির একটি অংশ ও সাম্যবাদী দলের একটি খণ্ডিত অংশ যোগ দেয় ২০দলীয় জোটে।
চতুর্থ উপজেলা নির্বাচনে ফল-বিপর্যয়কে সাফল্যের পূর্বাভাস ও সাংগঠনিক রাজনীতিতে ঘুরে দাঁড়ানোর উপলক্ষ হিসেবে বিবেচনা করে বিএনপি। নেতারা বলেন, দৃশ্যত সরকারি দলের বিজয় হলেও রাজনীতিতে তাদের অপমৃত্যু ঘটেছে। উপজেলা নির্বাচনে বিএনপির তত্ত্বাবধায়ক সরকার দাবিকে যৌক্তিক ভিত্তি দিয়েছে। উপজেলা নির্বাচনে ব্যাপক অনিয়মের মাধ্যমে তত্ত্বাবধায়ক দাবির যৌক্তিকতা পাকাপোক্ত হওয়ায় নির্বাচন কমিশনকে দিয়েই শুরু হতে পারে পরবর্তী আন্দোলন। এভাবে উপজেলা নির্বাচন, বাজেট ঘোষণা, ঈদুল ফিতর, ঈদুল আজহার পর আন্দোলনে যাওয়ার ঘোষণা দেন বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া। তবে বারবার সে ঘোষণা থেকে সরে আসে দলটি। রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের মতে, আন্দোলনের কথা বললেও সার্বিক পরিস্থিতিতে আন্দোলনের ডাক দেয়ার মতো ভরসা পায়নি বিএনপি। এদিকে ২০১৪ সালের প্রথম থেকেই বিএনপির রাজনৈতিক কর্মসূচি পালনে চলছে একধরনের অঘোষিত নিষেধাজ্ঞা। রাজপথে বিরোধী দলের শান্তিপূর্ণ কর্মসূচিগুলোও পণ্ড করে দেয় পুলিশ। একাধিকবার মেলেনি সভা-সমাবেশের অনুমতিও। জাতীয় বিপ্লব ও সংহতি দিবস উপলক্ষে ৮ই নভেম্বর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে সমাবেশের অনুমতিও দেয়া হয়নি বিএনপিকে। অনুমতির অভাবেই বাতিল হয়েছে খালেদা জিয়ার কয়েকটি সমাবেশের আয়োজন। কয়েকটি সমাবেশে অনুমতি মিলেছে একবারে শেষ মুহূর্তে। বছরের বেশির ভাগ সময়ই দলের নয়াপল্টন কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে জড়ো হতে দেয়া হয়নি বিএনপি নেতাকর্মীদের। তবে মহাজোট সরকারের প্রথম থেকেই বিএনপির আন্দোলনের গতিপ্রকৃতি নিয়ে নানা প্রশ্ন তৈরি হয়েছে দলীয় মহলে। দলের তরফে কিছু কর্মসূচি প্রণয়নে ইস্যু ও সময়ের যৌক্তিকতা বিবেচনায় না আনা, জনস্বার্থ সংশ্লিষ্ট ইস্যুতে অপেক্ষার মোড়কে নীরবতা পালন এবং কার্যকর ইস্যুকে এড়িয়ে যাওয়ার কারণে আন্দোলনের গতিপথকে চূড়ান্ত লক্ষ্যে নেয়া যায়নি বলে মনে করেন কর্মীরা। আঞ্চলিক ইস্যু ও জনস্বার্থ সংশ্লিষ্ট জাতীয় ইস্যুতে শান্তিপূর্ণ কর্মসূচির ভেতর দিয়েই গণতান্ত্রিক আন্দোলনকে তুঙ্গে নেয়ার একটি পরিকল্পনা ছিল বিএনপি। এ জন্য পানির ন্যায্য হিস্যার দাবিতে তিস্তা ব্যারেজ অভিমুখে লংমার্চটিও তারই একটি অংশ। ৫ই জানুয়ারির নির্বাচনের পর বিএনপির নেতৃত্বে ২০ দলের আন্দোলনের সাফল্য-ব্যর্থতা ও ত্রুটি-বিচ্যুতি নিয়ে পর্যালোচনা করে বিএনপি। পেশাজীবী নেতাদের সঙ্গে একাধিক বৈঠকে সে সব ত্রুটি-বিচ্যুতি নিয়ে কথা বলেন খালেদা জিয়া। বিশ্লেষণের পাশাপাশি তা থেকে উত্তরণের উপায় সন্ধান করে নীতিনির্ধারক মহল। সাম্প্রতিক সময়ে বিএনপি চেয়ারপারসন বলছেন, ডিসেম্বরের পর ৫ই জানুয়ারি সরকারের এক বছর পূর্তিকে কেন্দ্র করে আন্দোলন শুরু হবে। রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের মতে, একতরফা নির্বাচনের পর হঠাৎ করে আন্দোলন থেকে সরে আসা ছিল একটি ভুল সিদ্ধান্ত। এদিকে নির্বাচনকালীন নির্দলীয় সরকারের দাবিতে হতাশাগ্রস্ত ও দ্বিধান্বিত নেতাকর্মীদের মনোবল চাঙ্গা ও জনমত গঠনে বছরজুড়ে চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াসহ দলের সিনিয়র নেতারা কয়েক দফায় দেশজুড়ে সফর করেছেন। ১৫ই জানুয়ারি রাজধানীর হোটেল ওয়েস্টিনে অনুষ্ঠিত সংবাদ সম্মেলনে দলের সিনিয়র নেতৃবৃন্দসহ সারা দেশ সফর করার ঘোষণা দেন খালেদা জিয়া। সিনিয়র নেতাদের নেতৃত্বে অন্তত ৩০টি টিম সারা দেশে সাংগঠনিক সফর করেন। ২রা মার্চ রাজবাড়ি, ১৪ই মে নারায়ণগঞ্জ, ২৮শে মে মুন্সীগঞ্জ, ২২শে জুন জয়পুরহাট, ২৪শে সেপ্টেম্বর ব্রাহ্মণবাড়িয়া, ২৮শে সেপ্টেম্বর জামালপুর, ২৪শে অক্টোবর নীলফামারী, ২রা নভেম্বর নাটোর, ১৩ই নভেম্বর কিশোরগঞ্জ, ২৯শে নভেম্বর কুমিল্লা ও ১৩ই ডিসেম্বর নারায়ণগঞ্জ ২০দলীয় জোট আয়োজিত জনসভায় যোগ দেন খালেদা জিয়া।
বছরজুড়ে উল্টো সন্দেহের দোলাচলে এগিয়েছে প্রধান দু’দল বিএনপি-জামায়াতের সম্পর্ক। রাজনৈতিক মহলে বারবার আলোচনায় জন্ম দিয়েছে সরকারের সঙ্গে জামায়াতের সমঝোতার গুজব। ফলে উপজেলা নির্বাচন ও যুদ্ধাপরাধের বিচারসহ সার্বিক পরিস্থিতিতে বছরের শুরু থেকেই জামায়াতকে পর্যবেক্ষণে রেখেছে বিএনপি। ‘জামায়াতের সঙ্গ ত্যাগ না করলে বিএনপির সঙ্গে কোন আলোচনা বা সমঝোতা নয়’- কথাটি প্রধানমন্ত্রী থেকে শুরু করে তার দলের নেতারাও বলছেন প্রতিনিয়ত। ইউরোপীয় পার্লামেন্টের গৃহীত প্রস্তাবেও জামায়াত-হেফাজতের সঙ্গে বিএনপির সম্পর্ক ছেদের বিষয়টি গুরুত্ব পায়। পাশাপাশি ঢাকায় দায়িত্বরত বিদেশী কূটনীতিকদের অনেকেই বিএনপিকে একই পরামর্শ দিয়েছেন। অন্যদিকে জামায়াত জোটের দ্বিতীয় প্রধান শরিক দল হলেও হাইকোর্টের রায়ে নির্বাচন কমিশনের নিবন্ধন হারিয়েছে দলটি। রয়েছে নিষিদ্ধের ঝুঁকিতে। এতে জামায়াতের চেয়ে কম ক্ষতিগ্রস্ত হয়নি জোটের প্রধান শরিক দল বিএনপিও। কিন্তু প্রতিকূল রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে দেশী-বিদেশী চাপের মুখেও জামায়াতের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করেনি বিএনপি। অন্যদিকে মাওলানা সাঈদীর রায় ও গোলাম আযমের মৃত্যুকে কেন্দ্র করে বিএনপি ও জামায়াতের মধ্যে নতুন করে টানাপড়েন তৈরি হয়। বিএনপির নীতি-নির্ধারকদের শোক প্রকাশ না করায় ক্ষুব্ধ হন জামায়াত-শিবিরের নেতাকর্মীরা। এ প্রেক্ষাপটেই বছরের মাঝামাঝি সময়ে একটি আন্তর্জাতিক সংবাদ সংস্থাকে দেয়া সাক্ষাৎকারে বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া বলেছেন, জামায়াতের সঙ্গে সম্পর্কটা সাময়িক বলে উল্লেখ করেছেন একটি আন্তর্জাতিক সংবাদ সংস্থাকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে। সরকারবিরোধী আন্দোলনে মাঠে নামা নিয়ে বিএনপির সঙ্গে জামায়াতের তৈরি হয়েছে কৌশলগত দূরত্ব।
৫ই জানুয়ারির নির্বাচনের পর সাংগঠনিকভাবে ঘুরে দাঁড়ানোর উদ্দেশে জেলা কমিটি পুনর্গঠনের উদ্যোগ নেয় বিএনপি। সময়সীমা বেঁধে দিয়ে গঠন করা হয় ডজনখানেক নতুন জেলা আহ্বায়ক কমিটি। কিন্তু তৃণমূলের বিরোধ ও প্রতিবাদের মুখে অচিরেই থেমে যায় সে উদ্যোগ। পরে নির্বাচন কমিশনে বিধি অনুসরণ, সাংগঠনিক পুনর্গঠন, নেতৃত্বের পুনর্বিন্যাস ও চেইন অব কমান্ড প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে দলের জাতীয় কাউন্সিল আয়োজনের নীতিগত সিদ্ধান্ত নেয় বিএনপি। তবে সে উদ্যোগ আলোর মুখ দেখেনি। এদিকে দলের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ইউনিট ঢাকা মহানগর কমিটি নিয়ে সমালোচনা চলছিল দীর্ঘদিন ধরেই। এক পর্যায়ে সংবাদ সম্মেলন ডেকে অব্যাহতি চান মহানগরের আহ্বায়ক সাদেক হোসেন খোকা। জুলাই মাসে দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাসকে আহ্বায়ক, স্বেচ্ছাসেবক দলের সভাপতি হাবিব-উন-নবী খান সোহেল, দলের স্থায়ী কমিটি, ভাইস চেয়ারম্যান, চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা ও যুগ্ম মহাসচিবদের যুগ্ম আহ্বায়ক করে এ কমিটি ঘোষণা দেয়া হয়। তবে নেতাদের দ্বন্দ্ব ও কোন্দলের কারণে শুরুতেই প্রতিবন্ধকতার মুখে পড়ে নতুন কমিটি। নভেম্বরে সিনিয়র নেতাদের সঙ্গে ধারাবাহিক তিনটি বৈঠক করেন খালেদা জিয়া। বৈঠকে নিষ্ক্রিয় ভূমিকার কারণে নীতিনির্ধারক ফোরামের ওপর ক্ষোভ ঝাড়েন তিনি। খালেদা জিয়ার হস্তক্ষেপে সেটার অবসান হলেও সাংগঠনিকভাবে গুছিয়ে উঠতে পারেনি মহানগর বিএনপি। উল্টো কিছু কিছু এলাকায় প্রতিবাদ-প্রতিরোধের মুখে পড়েছেন দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতারা। আন্দোলনের স্বার্থে তারুণ্যনির্ভর ছাত্রদলের কমিটি গঠন হলেও পদ-পদবি নিয়ে সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে দু’পক্ষ। বছরের শেষ দিকে সেটারও অবসান ঘটে। এছাড়া আন্দোলনকে কেন্দ্র করে উপজেলা নির্বাচনের সময় বহিষ্কৃত তৃণমূল নেতাদের দলে ফেরানোর উদ্যোগ নেয় বিএনপি। জুন-আগস্ট মাসে বহিষ্কারাদেশ প্রত্যাহার হয়েছে ২ শতাধিক নেতার। ভুল স্বীকার করে দলে ফেরার আকাঙ্ক্ষা ব্যক্ত ও দলের পক্ষে নানাভাবে ভূমিকা রাখার প্রেক্ষিতে দীর্ঘদিন পর দলের সংস্কারপন্থি হিসেবে পরিচিত নেতাদের দলে ফেরানোর ব্যাপারে ইতিবাচক মনোভাব দেখিয়েছে বিএনপির শীর্ষ নেতৃত্ব। নিজ নিজ এলাকায় কাজ করার জন্য দলের পক্ষ থেকে কয়েকজনকে অলিখিত নির্দেশনাও দেয়া হয়েছে।
২০১৩ সালে বিএনপির বিরুদ্ধে প্রচারণা ছিল অতিমাত্রায় কূটনীতিক-নির্ভর হয়ে পড়েছে দলটি। দলটির নেতাদের অভিযোগ ছিল বাংলাদেশের রাজনীতিতে হস্তক্ষেপ করছে প্রতিবেশী দেশ ভারত। তাই ভারতের জাতীয় নির্বাচনে আওয়ামী লীগের ঐতিহাসিক রাজনৈতিক মিত্র কংগ্রেসের পরাজয় এ হস্তক্ষেপ কমাবে বলে ধারণা ছিল তাদের। ভারতে কংগ্রেসকে হারিয়ে বিজেপি ক্ষমতায় এলেও বাংলাদেশ ইস্যুতে দেশটির দৃষ্টিভঙ্গির বড় কোন পরিবর্তন লক্ষণীয় হয়নি। বিজেপিকে মিত্র মনে করলেও এখন পর্যন্ত ভারতের সঙ্গে কূটনীতিক সম্পর্কের বড় কোন উন্নতি ঘটাতে পারেনি বিএনপি। তবে বছরের মাঝামাঝি সময়ে চীনা কমিউনিস্ট পার্টির আমন্ত্রণে বিএনপির উচ্চপর্যায়ের একটি প্রতিনিধি দল চীন সফর করেছে। তাদের দাবি, আলাপ-আলোচনায় চীন যে বার্তা দিয়েছে তার অর্থ হচ্ছে- একমুখী নয়, বহুমুখী সম্পর্কে বিশ্বাসী চীন। তবে বছরজুড়ে কূটনীতিকদের সঙ্গে বৈঠক করে সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টির চেষ্টা করেছে দলটি। পাশাপাশি সরকারের দুর্নীতি ও দমন-পীড়নের চিত্র তুলে ধরেছে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক মহলে।
অতীতের ধারাবাহিকতায় ২০১৪ সাল জুড়ে বিভিন্ন মামলায় জড়ানো হয়েছে বিএনপি নেতাকর্মীদের। বিশেষ করে ২১শে আগস্ট গ্রেনেড হামলা ও সাবেক অর্থমন্ত্রী কিবরিয়া হত্যাকাণ্ডের মতো স্পর্শকাতর কিছু মামলায় জড়ানো হয়েছে সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমানসহ দলটির কয়েকজন গুরুত্বপূর্ণ নেতা, সিলেট সিটি ও হবিগঞ্জ পৌর মেয়রসহ জনপ্রতিনিধিকে। বিগত বছরগুলোতে উপর্যুপরি মামলার মাধ্যমে আইনি জালে আটকানো হয়েছিল বিএনপি নেতাকর্মীদের। ২০১৪ সালে সে সব মামলায় আনুষ্ঠানিক বিচার শুরু হয়েছে। আদালতে চার্জ গঠন হয়েছে একের পর এক মামলায়। দলের চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া, সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমানসহ স্থায়ী কমিটি থেকে তৃণমূল নেতাদের অনেকেই এখন ১-২৫ মামলায় আনুষ্ঠানিক বিচারের মুখোমুখি। হত্যা, বিস্ফোরণ, ভাঙচুর-অগ্নিসংযোগ ও পুলিশের কাজে বাধা দেয়ার অভিযোগে দ্রুত বিচার আইনে দায়ের করা মামলার পাশাপাশি রয়েছে তথ্য-প্রযুক্তি আইন, রাষ্ট্রদ্রোহ, দুর্নীতির মামলাও। উচ্চ আদালতে আবেদন করেও বাতিল বা স্থগিত করা যায়নি না বিচার প্রক্রিয়া। খালেদা জিয়াকে জিয়া অরফানেজ ও জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট মামলায় চার্জগঠনের মাধ্যমে বিচারের মুখোমুখি করা হয়েছে। মামলা দুটি স্থানান্তর করা হয়েছে পুরান ঢাকার আলিয়া মাদরাসা মাঠে স্থাপিত বিশেষ আদালতে। একই ভাবে দলের সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান লন্ডনে অবস্থানরত তারেক রহমানের নামে নতুন অন্তত অর্ধশতাধিক মামলার পাশাপাশি আগের কয়েকটি মামলায় চার্জ গঠন করা হয়েছে। চার্জগঠনের মাধ্যমে সর্বাধিক মামলায় বিচার শুরু হয়েছে দলের ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের। বিএনপির অভিযোগ জনবিচ্ছিন্ন সরকার মামলা-হামলার মাধ্যমে ক্ষমতায় আঁকড়ে থাকতে চায়। রাজনীতি ও নির্বাচন থেকে দূরে সরিয়ে রাখতে চায় বিএনপি নেতাদের। বিএনপি নেতা ও তাদের আইনজীবীরা বলছেন, মামলার মেরিট যাই থাকুক সরকার সাজা দিতে চায়। বিচার কার্যক্রমে তাড়াহুড়া ও আইনি লড়াইয়ে যুক্তিতর্ককে পাশ কাটিয়ে যাওয়ার মধ্যেই তাদের উদ্দেশ্য পরিষ্কার হয়ে গেছে। মহাজোট সরকারের প্রথম থেকে নানা অভিযোগে গ্রেপ্তার করা হয় বিএনপির একাধিক কেন্দ্রীয় নেতাকে। পরে কিছু নেতা মুক্তি পেলেও অনেকেই এখনও কারাভোগ করছেন। গ্রেপ্তারের তালিকায় ২০১৪ সালে যুক্ত হয়েছেন স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন কয়েকজন সিনিয়র নেতা। স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী, ভাইস চেয়ারম্যান আবদুস সালাম পিন্টু ও সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক নাসিরউদ্দিন আহমেদ পিন্টু বর্তমানে সাজা ভোগ করছেন। এছাড়া মৃত্যুবরণ করেছেন স্থায়ী কমিটির সাবেক সদস্য এডভোকেট খন্দকার মাহবুব আহম্মাদ, সাবেক ডেপুটি স্পিকার ও ভাইস চেয়ারপারসন এলকে সিদ্দিকী, চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা মুহাম্মদ মোশাররফ হোসেন, সাবেক এমপি আমানউল্লাহ চৌধুরী সহ বিএনপি ও অঙ্গদলের অর্ধশত সিনিয়র জেলা পর্যায়ের নেতা।
No comments