ভিন্নমত দমন মুক্তিযুদ্ধের চেতনার পরিপন্থী by মো. আবুসালেহ সেকেন্দার
ডিসেম্বর-মার্চ এলেই আমরা মুক্তিযুদ্ধের
চেতনায় গদগদ করি। যদিও প্রকৃত মুক্তিযুদ্ধের চেতনা কী, তা বোঝার চেষ্টা করি
না। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ভেতরে ধারণ করতে চাইলে ধান্ধাবাজি করা যাবে না সে
বিষয়টি অবশ্য জানি! তাই বাইরেই কেবল মুক্তিযুদ্ধের চেতনার ধারক হতে চাই!
এমন চেতনাধারীর সংখ্যাই এখন বেশি এটা নির্দ্ধিধায় বলা যায়। আর এ কথিত
চেতনাধারীরা তাদের স্বার্থবিরোধী সত্য কথা বললে যাকে-তাকে রাজাকার আখ্যা
দিতে উঠেপড়ে লেগে যায়। কিন্তু এরা জানে না, সব শুদ্ধ মতের মানুষের নিরাপদ
আবাসভূমি প্রতিষ্ঠা ছিল মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম লক্ষ্য।
সত্য প্রকাশকারীদের পাকিস্তানিদের মতো দেশবিরোধী, ইসলামবিরোধী আখ্যা দেয়াটা আর যাই হোক মুক্তিযুদ্ধের চেতনা হতে পারে না। তবে সাম্প্রতিক সময়ে মনে হয়, আমরা মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে দূরে ঠেলে দিয়ে পাকিস্তানি চেতনায় ফিরে যাচ্ছি। তাই ভিন্নমতাবলম্বীদের দমনে পাকিস্তানিদের কৌশল অবলম্বন করে যাকে-তাকে স্বাধীনতাবিরোধী, রাজাকার অথবা ইসলাম ধর্মবিরোধী, নাস্তিক ইত্যাদি বলছি।
দুই. ১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের পর পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী তাদের স্বার্থবিরোধী হিসেবে যাদের চিহ্নিত করেছিল, তাদের হয় ভারতের চর নয়তো নাস্তিক উপাধি দিয়ে দেশ ছাড়ার সব বন্দোবস্ত করেছিল। যারা জম্মভূমির মায়ায় এদেশ ছেড়ে যেতে চায়নি, তাদের ওপর নেমে এসেছিল জুলুম-নির্যাতন-নিপীড়ন। আর এক্ষেত্রে বুদ্ধিজীবীরা ছিল তাদের চোখের বালি। বাঙালিদের ন্যায্য অধিকার ও দাবি-দাওয়াকে সমর্থন করলেই মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ ও ইয়াহিয়া গংদের দৃষ্টিতে বুদ্ধিজীবীদের হতে হয়েছিল ধর্মদ্রোহী অথবা ভারতের দালাল। ১৯৭১ সালে পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী এবং তাদের এদেশীয় সহযোগী আল-বদর, আল-শামস, রাজাকাররা বাঙালি নিধনকে বৈধতা দিতেও এ তত্ত্ব ব্যবহার করেছিল। তারা প্রচার করেছিল, ইসলাম ধর্মকে রক্ষা ও ভারতের দালালকে প্রতিহত করতেই তাদের এ অভিযান। ১৯৭১ সালে প্রকাশিত সংগ্রাম পত্রিকার পাতায় পাতায় তৎকালীন বদর বাহিনী নেতাদের বক্তৃতা-বিবৃতিতে বিষয়টি স্পষ্ট।
তিন. শুধু একাত্তরে অথবা পাকিস্তানি সামরিক শাসনামলে নয়, প্রতিটি যুগে বা দেশে সত্য কথা বলা, মজলুমদের পক্ষে অবস্থান নেয়া মানুষদের শাসকগোষ্ঠী নানা মিথ্যা অভিযোগে অভিযুক্ত করে হয় দেশ ছাড়া, নয়তো হত্যা করেছে। নির্যাতন-নিপীড়ন করেছে। সে কারণেই হয়তো বিশ্বকবি বলেছেন : সত্য যে কঠিন, কঠিনেরে ভালোবাসিলাম। সভ্যতার ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যাবে, যেসব ক্ষণজন্মা মনীষী বিশ্বকবির মতো সত্যকে ভালোবেসেছেন, তারা সবাই পদে পদে হয়েছেন লাঞ্ছিত, বঞ্চিত, অপমানিত। শাসকগোষ্ঠী তাদের ওপর চালিয়েছে নির্যাতন-নিপীড়নের স্টিম রোলার। বিশ্ববিখ্যাত জ্যোতির্বিজ্ঞানী গ্যালিলিও সত্য বলার কারণে পেয়েছিলেন ধর্মদ্রোহী উপাধি। বাইবেলে আছে : পৃথিবী স্থির, অনড়, সৌরজগতের কেন্দ্র। তিনি বলেছিলেন : পৃথিবী সূর্যের চারদিকে ঘোরে। তার এ কথা শুনে ধর্মযাকরা ক্ষেপে গেল। ১৬৩৩ সালে অসুস্থ, বৃদ্ধ বিজ্ঞানীকে করা হল বিচারের মুখোমুখি। আদালত থেকে তার ধ্যান-ধারণাকে ভ্রান্ত ও ধর্মবিরোধী আখ্যায়িত করে পরিত্যাগের কঠোর নির্দেশ দেয়া হল। পাশাপাশি দণ্ডাদেশের কার্যকারিতা প্রমাণের জন্য তাকে সিয়েনায় একঘরে জীবনযাপন করতে হয়েছিল দীর্ঘদিন। খ্রিস্টধর্মের প্রবর্তক যিশু খ্রিস্টকেও সত্য কথনের কারণে ক্রুসবিদ্ধ করে হত্যা করেছিল ইহুদিরা।
চার. আরবে জাহেলিয়া যুগে বিশ্বনবী হজরত মোহাম্মদ (সা.) জন্মেছিলেন সত্যের আলোকবর্তিকা হয়ে। তিনি প্রচার করেছিলেন মহান আল্লাহ প্রেরিত সত্য ধর্ম ইসলাম। আরবদের কাছে আল-আমিন বা বিশ্বাসী হয়ে ওঠা মহানবী (সা.) যখনই মহান আল্লাহর সত্য বাণী প্রচার শুরু করলেন, আরবদের প্রচলিত ধর্মমতের বিরুদ্ধে কথা বললেন, তখনই তিনি আরবদের কাছে হয়ে উঠলেন ধর্মদ্রোহী। নানা নির্যাতন-নিপীড়ন নেমে এল মহানবী (সা.) ও তার অনুসারীদের ওপর। আরবরা মহানবীকে (সা.) শুধু রক্তাক্ত করেই ক্ষান্ত হয়নি, তাঁকে বলা হল নাস্তিক। শত লাঞ্ছনা-গঞ্জনা ও প্রলোভনেও যখন মহানবীকে (সা.) ইসলাম প্রচার থেকে বিরত রাখা সম্ভব হয়নি, তখন মক্কার কোরাইশ দলপতিরা হজরত মোহাম্মদের (সা.) মতাদর্শ প্রতিহত করতে সামাজিক সভা আহ্বান করে তাঁকে নাস্তিক বলে অভিহিত করে। মোহাম্মদ আকরম খাঁর ভাষায় : বর্তমান সভায় সেইজন্য সামাজিক শাসনের প্রস্তাব গৃহীত হয়। প্রতিজ্ঞাপত্রে লিখিত হয়, হাশেম ও মোত্তালেব গোত্রের সহায়তার ফলেই মোহাম্মদের স্পর্ধা এতদূর বেড়ে যাচ্ছে। অতএব তাদের এবং মোহাম্মদ ও তার দলের সাহাবিদের (নাস্তিক বা লা-মজহাবি) একদম বয়কট করতে হবে (মোস্তফা-চরিত্র, কাকলী প্রকাশনী, ঢাকা, ১৯৯৮, পৃষ্ঠা ১৯৫)।
তাই প্রশ্ন জাগে, স্বাধীন বাংলাদেশে একশ্রেণীর ধর্ম ব্যবসায়ী বাছবিচার না করে বিরুদ্ধ মতের হলেই যাকে-তাকে নাস্তিক বলে কি সেই জাহেলিয়া যুগের আরবদের মতোই আচরণ করছে না? আর যাকে-তাকে রাজাকার বলাও কি পাকিস্তানিদের মানসিকতার বহিঃপ্রকাশ নয়?
পাঁচ. ভিন্নমতাবলম্বীদের মতকে যুক্তি নয়, অস্ত্রের মাধ্যমে মোকাবেলা করার পাকিস্তানি মানসিকতা স্বাধীন বাংলাদেশেও দেখা যায়। সামরিক শাসনামলে ভিন্ন মত বা পথের মানুষ হওয়ার কারণে গোপনে বহু সামরিক-বেসামরিক মানুষকে হত্যা করা হয়েছে।
গণতান্ত্রিক বাংলাদেশে বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করা না হলেও নানাভাবে হয়রানি করা হয়েছে। হামলা-মামলার বহু ঘটনা ঘটেছে। সত্য বলায় বারবার বাধা সৃষ্টি করা হয়েছে। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার দাবি করায় শহীদ জননী জাহানারা ইমামের মতো মহীয়সী নারীর বিরুদ্ধে মামলা করা হয়েছে।
আওয়ামী লীগ শাসনামলেও যে অবস্থার খুব একটা পরিবর্তন হয়েছে, তা বলা যাচ্ছে না। কেউ আওয়ামী লীগ বা সরকারের সমালোচনা করলেই তাকে রাজাকার, স্বাধীনতাবিরোধী, মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরোধী ইত্যাদি বলে দমানোর চেষ্টা করা হচ্ছে। শুধু মতের পার্থক্য থাকার কারণে অনেককে নিষিদ্ধ করা হয়েছে শহীদ মিনারে। অথচ পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর ভিন্নমত সহজে গ্রহণ না করার ফলই আজকের শহীদ মিনার, স্বাধীন বাংলাদেশ। আজ আমরা সেই স্বাধীন বাংলাদেশেই ভিন্নমতকে যুক্তির মাধ্যমে নয়, শক্তির মাধ্যমে প্রতিহত করার চেষ্টা করছি। প্রশ্ন হতে পারে, তাহলে আমরা চিন্তাচেতনায় কি সেই পাকিস্তানের দিকেই ফেরত যাচ্ছি?
আমরা ব্যক্তিগতভাবে অনেকের সব মতের সঙ্গে সর্বক্ষেত্রে একমত নাও হতে পারি। তবে এই মতভিন্নতার কারণে যারা তাদের শহীদ মিনারে নিষিদ্ধ করছে অথবা রাজাকার বলছে তাদেরও সমর্থক নই। ফরাসি দার্শনিক ভলতেয়ারের ভাষায় বলতে চাই : আমি তোমার মত মানি না, কিন্তু তুমি যাতে অবাধে বলতে পার, তার জন্য আমি নিজের প্রাণ পর্যন্ত বিসর্জন দিতে প্রস্তুত। এটা শুধু ভলতেয়ারের কথা নয়, আমাদের মুক্তিযুদ্ধ ও ভাষা আন্দোলনের চেতনাও বটে।
ছয়. সরকারের অন্যায় কাজের বিরুদ্ধে কথা বললেই সেটি রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র হয়ে যায় না। রাষ্ট্র ও সরকার আলাদা দুটি সত্তা। ১৯৪৭ থেকে ৭১ (যুক্তফ্রন্ট সরকারের সময়ে বাদে) দেশপ্রেমিক রাজনীতিকরা পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছিলেন। শিক্ষক, সাংবাদিক তথা বুদ্ধিজীবীরা সত্য কথা বলেছিলেন। এই রুখে দাঁড়ানোর কারণ ছিল গণতন্ত্রহীনতা। আজ দেশ যদি আবার সেই গণতন্ত্রহীনতার পথে হাঁটে, আর কেউ গণতন্ত্রের পক্ষে কথা বলেন, তবে তিনি মুক্তিযুদ্ধের চেতনার শত্র“ নন, বরং প্রকৃত বন্ধু।
আজ যারা দেশের স্বার্থে, গণতন্ত্রের স্বার্থে কথা বলছেন, তাদের রাজাকার বলে গালি দেয়া, শহীদ মিনারে নিষিদ্ধ করা ইত্যাদি আর যাই হোক মুক্তিযুদ্ধের চেতনা নয়। তবে হ্যাঁ, কেউ যদি রাষ্ট্রবিরোধী ষড়যন্ত্র করে, তাকে প্রতিহত করা যেতেই পারে। আর সেই ষড়যন্ত্রকারী যে শুধু বিরোধী দলেই থাকবে এমনটি ভাবার কারণ নেই। সরকারি দলে থেকেও কেউ রাষ্ট্রবিরোধী ষড়যন্ত্র করতে পারে। এমন উদাহরণ পৃথিবীর ইতিহাসে আছে ভূরি ভূরি। তাই মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বিশ্বাসীদের উচিত হবে কাউকে রাজাকার বলার আগে তার অবস্থানকে বা বক্তব্যকে দলীয় দৃষ্টিকোণ থেকে না দেখে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার করা। কেউ সত্য বললে তা মেনে নেয়া। বিশ্বকবির ভাষায়: ভালো মন্দ যাহাই আসকু/সত্যেরে লও সহজে।
মো. আবুসালেহ সেকেন্দার : সহকারী অধ্যাপক, ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়
সত্য প্রকাশকারীদের পাকিস্তানিদের মতো দেশবিরোধী, ইসলামবিরোধী আখ্যা দেয়াটা আর যাই হোক মুক্তিযুদ্ধের চেতনা হতে পারে না। তবে সাম্প্রতিক সময়ে মনে হয়, আমরা মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে দূরে ঠেলে দিয়ে পাকিস্তানি চেতনায় ফিরে যাচ্ছি। তাই ভিন্নমতাবলম্বীদের দমনে পাকিস্তানিদের কৌশল অবলম্বন করে যাকে-তাকে স্বাধীনতাবিরোধী, রাজাকার অথবা ইসলাম ধর্মবিরোধী, নাস্তিক ইত্যাদি বলছি।
দুই. ১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের পর পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী তাদের স্বার্থবিরোধী হিসেবে যাদের চিহ্নিত করেছিল, তাদের হয় ভারতের চর নয়তো নাস্তিক উপাধি দিয়ে দেশ ছাড়ার সব বন্দোবস্ত করেছিল। যারা জম্মভূমির মায়ায় এদেশ ছেড়ে যেতে চায়নি, তাদের ওপর নেমে এসেছিল জুলুম-নির্যাতন-নিপীড়ন। আর এক্ষেত্রে বুদ্ধিজীবীরা ছিল তাদের চোখের বালি। বাঙালিদের ন্যায্য অধিকার ও দাবি-দাওয়াকে সমর্থন করলেই মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ ও ইয়াহিয়া গংদের দৃষ্টিতে বুদ্ধিজীবীদের হতে হয়েছিল ধর্মদ্রোহী অথবা ভারতের দালাল। ১৯৭১ সালে পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী এবং তাদের এদেশীয় সহযোগী আল-বদর, আল-শামস, রাজাকাররা বাঙালি নিধনকে বৈধতা দিতেও এ তত্ত্ব ব্যবহার করেছিল। তারা প্রচার করেছিল, ইসলাম ধর্মকে রক্ষা ও ভারতের দালালকে প্রতিহত করতেই তাদের এ অভিযান। ১৯৭১ সালে প্রকাশিত সংগ্রাম পত্রিকার পাতায় পাতায় তৎকালীন বদর বাহিনী নেতাদের বক্তৃতা-বিবৃতিতে বিষয়টি স্পষ্ট।
তিন. শুধু একাত্তরে অথবা পাকিস্তানি সামরিক শাসনামলে নয়, প্রতিটি যুগে বা দেশে সত্য কথা বলা, মজলুমদের পক্ষে অবস্থান নেয়া মানুষদের শাসকগোষ্ঠী নানা মিথ্যা অভিযোগে অভিযুক্ত করে হয় দেশ ছাড়া, নয়তো হত্যা করেছে। নির্যাতন-নিপীড়ন করেছে। সে কারণেই হয়তো বিশ্বকবি বলেছেন : সত্য যে কঠিন, কঠিনেরে ভালোবাসিলাম। সভ্যতার ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যাবে, যেসব ক্ষণজন্মা মনীষী বিশ্বকবির মতো সত্যকে ভালোবেসেছেন, তারা সবাই পদে পদে হয়েছেন লাঞ্ছিত, বঞ্চিত, অপমানিত। শাসকগোষ্ঠী তাদের ওপর চালিয়েছে নির্যাতন-নিপীড়নের স্টিম রোলার। বিশ্ববিখ্যাত জ্যোতির্বিজ্ঞানী গ্যালিলিও সত্য বলার কারণে পেয়েছিলেন ধর্মদ্রোহী উপাধি। বাইবেলে আছে : পৃথিবী স্থির, অনড়, সৌরজগতের কেন্দ্র। তিনি বলেছিলেন : পৃথিবী সূর্যের চারদিকে ঘোরে। তার এ কথা শুনে ধর্মযাকরা ক্ষেপে গেল। ১৬৩৩ সালে অসুস্থ, বৃদ্ধ বিজ্ঞানীকে করা হল বিচারের মুখোমুখি। আদালত থেকে তার ধ্যান-ধারণাকে ভ্রান্ত ও ধর্মবিরোধী আখ্যায়িত করে পরিত্যাগের কঠোর নির্দেশ দেয়া হল। পাশাপাশি দণ্ডাদেশের কার্যকারিতা প্রমাণের জন্য তাকে সিয়েনায় একঘরে জীবনযাপন করতে হয়েছিল দীর্ঘদিন। খ্রিস্টধর্মের প্রবর্তক যিশু খ্রিস্টকেও সত্য কথনের কারণে ক্রুসবিদ্ধ করে হত্যা করেছিল ইহুদিরা।
চার. আরবে জাহেলিয়া যুগে বিশ্বনবী হজরত মোহাম্মদ (সা.) জন্মেছিলেন সত্যের আলোকবর্তিকা হয়ে। তিনি প্রচার করেছিলেন মহান আল্লাহ প্রেরিত সত্য ধর্ম ইসলাম। আরবদের কাছে আল-আমিন বা বিশ্বাসী হয়ে ওঠা মহানবী (সা.) যখনই মহান আল্লাহর সত্য বাণী প্রচার শুরু করলেন, আরবদের প্রচলিত ধর্মমতের বিরুদ্ধে কথা বললেন, তখনই তিনি আরবদের কাছে হয়ে উঠলেন ধর্মদ্রোহী। নানা নির্যাতন-নিপীড়ন নেমে এল মহানবী (সা.) ও তার অনুসারীদের ওপর। আরবরা মহানবীকে (সা.) শুধু রক্তাক্ত করেই ক্ষান্ত হয়নি, তাঁকে বলা হল নাস্তিক। শত লাঞ্ছনা-গঞ্জনা ও প্রলোভনেও যখন মহানবীকে (সা.) ইসলাম প্রচার থেকে বিরত রাখা সম্ভব হয়নি, তখন মক্কার কোরাইশ দলপতিরা হজরত মোহাম্মদের (সা.) মতাদর্শ প্রতিহত করতে সামাজিক সভা আহ্বান করে তাঁকে নাস্তিক বলে অভিহিত করে। মোহাম্মদ আকরম খাঁর ভাষায় : বর্তমান সভায় সেইজন্য সামাজিক শাসনের প্রস্তাব গৃহীত হয়। প্রতিজ্ঞাপত্রে লিখিত হয়, হাশেম ও মোত্তালেব গোত্রের সহায়তার ফলেই মোহাম্মদের স্পর্ধা এতদূর বেড়ে যাচ্ছে। অতএব তাদের এবং মোহাম্মদ ও তার দলের সাহাবিদের (নাস্তিক বা লা-মজহাবি) একদম বয়কট করতে হবে (মোস্তফা-চরিত্র, কাকলী প্রকাশনী, ঢাকা, ১৯৯৮, পৃষ্ঠা ১৯৫)।
তাই প্রশ্ন জাগে, স্বাধীন বাংলাদেশে একশ্রেণীর ধর্ম ব্যবসায়ী বাছবিচার না করে বিরুদ্ধ মতের হলেই যাকে-তাকে নাস্তিক বলে কি সেই জাহেলিয়া যুগের আরবদের মতোই আচরণ করছে না? আর যাকে-তাকে রাজাকার বলাও কি পাকিস্তানিদের মানসিকতার বহিঃপ্রকাশ নয়?
পাঁচ. ভিন্নমতাবলম্বীদের মতকে যুক্তি নয়, অস্ত্রের মাধ্যমে মোকাবেলা করার পাকিস্তানি মানসিকতা স্বাধীন বাংলাদেশেও দেখা যায়। সামরিক শাসনামলে ভিন্ন মত বা পথের মানুষ হওয়ার কারণে গোপনে বহু সামরিক-বেসামরিক মানুষকে হত্যা করা হয়েছে।
গণতান্ত্রিক বাংলাদেশে বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করা না হলেও নানাভাবে হয়রানি করা হয়েছে। হামলা-মামলার বহু ঘটনা ঘটেছে। সত্য বলায় বারবার বাধা সৃষ্টি করা হয়েছে। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার দাবি করায় শহীদ জননী জাহানারা ইমামের মতো মহীয়সী নারীর বিরুদ্ধে মামলা করা হয়েছে।
আওয়ামী লীগ শাসনামলেও যে অবস্থার খুব একটা পরিবর্তন হয়েছে, তা বলা যাচ্ছে না। কেউ আওয়ামী লীগ বা সরকারের সমালোচনা করলেই তাকে রাজাকার, স্বাধীনতাবিরোধী, মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরোধী ইত্যাদি বলে দমানোর চেষ্টা করা হচ্ছে। শুধু মতের পার্থক্য থাকার কারণে অনেককে নিষিদ্ধ করা হয়েছে শহীদ মিনারে। অথচ পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর ভিন্নমত সহজে গ্রহণ না করার ফলই আজকের শহীদ মিনার, স্বাধীন বাংলাদেশ। আজ আমরা সেই স্বাধীন বাংলাদেশেই ভিন্নমতকে যুক্তির মাধ্যমে নয়, শক্তির মাধ্যমে প্রতিহত করার চেষ্টা করছি। প্রশ্ন হতে পারে, তাহলে আমরা চিন্তাচেতনায় কি সেই পাকিস্তানের দিকেই ফেরত যাচ্ছি?
আমরা ব্যক্তিগতভাবে অনেকের সব মতের সঙ্গে সর্বক্ষেত্রে একমত নাও হতে পারি। তবে এই মতভিন্নতার কারণে যারা তাদের শহীদ মিনারে নিষিদ্ধ করছে অথবা রাজাকার বলছে তাদেরও সমর্থক নই। ফরাসি দার্শনিক ভলতেয়ারের ভাষায় বলতে চাই : আমি তোমার মত মানি না, কিন্তু তুমি যাতে অবাধে বলতে পার, তার জন্য আমি নিজের প্রাণ পর্যন্ত বিসর্জন দিতে প্রস্তুত। এটা শুধু ভলতেয়ারের কথা নয়, আমাদের মুক্তিযুদ্ধ ও ভাষা আন্দোলনের চেতনাও বটে।
ছয়. সরকারের অন্যায় কাজের বিরুদ্ধে কথা বললেই সেটি রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র হয়ে যায় না। রাষ্ট্র ও সরকার আলাদা দুটি সত্তা। ১৯৪৭ থেকে ৭১ (যুক্তফ্রন্ট সরকারের সময়ে বাদে) দেশপ্রেমিক রাজনীতিকরা পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছিলেন। শিক্ষক, সাংবাদিক তথা বুদ্ধিজীবীরা সত্য কথা বলেছিলেন। এই রুখে দাঁড়ানোর কারণ ছিল গণতন্ত্রহীনতা। আজ দেশ যদি আবার সেই গণতন্ত্রহীনতার পথে হাঁটে, আর কেউ গণতন্ত্রের পক্ষে কথা বলেন, তবে তিনি মুক্তিযুদ্ধের চেতনার শত্র“ নন, বরং প্রকৃত বন্ধু।
আজ যারা দেশের স্বার্থে, গণতন্ত্রের স্বার্থে কথা বলছেন, তাদের রাজাকার বলে গালি দেয়া, শহীদ মিনারে নিষিদ্ধ করা ইত্যাদি আর যাই হোক মুক্তিযুদ্ধের চেতনা নয়। তবে হ্যাঁ, কেউ যদি রাষ্ট্রবিরোধী ষড়যন্ত্র করে, তাকে প্রতিহত করা যেতেই পারে। আর সেই ষড়যন্ত্রকারী যে শুধু বিরোধী দলেই থাকবে এমনটি ভাবার কারণ নেই। সরকারি দলে থেকেও কেউ রাষ্ট্রবিরোধী ষড়যন্ত্র করতে পারে। এমন উদাহরণ পৃথিবীর ইতিহাসে আছে ভূরি ভূরি। তাই মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বিশ্বাসীদের উচিত হবে কাউকে রাজাকার বলার আগে তার অবস্থানকে বা বক্তব্যকে দলীয় দৃষ্টিকোণ থেকে না দেখে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার করা। কেউ সত্য বললে তা মেনে নেয়া। বিশ্বকবির ভাষায়: ভালো মন্দ যাহাই আসকু/সত্যেরে লও সহজে।
মো. আবুসালেহ সেকেন্দার : সহকারী অধ্যাপক, ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়
No comments