জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় ইউজিসি মুখোমুখি by নুর মোহাম্মদ
জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে সরকারি কলেজকে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে ছেড়ে দেয়ার ইস্যুতে পাল্টাপাল্টি বক্তব্য দিচ্ছে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় ও মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি)। শুধু তাই নয় বিষয়টি নিয়ে পাল্টাপাল্টি কমিটিও গঠন করেছে দুটি সংস্থা। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ বলছে, সরকারি কলেজকে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে ছেড়ে দিলে অরাজকতা তৈরি হবে। নিরসন হবে না ২১ লাখ শিক্ষার্থীর সেশনজট। বাড়বে বিশৃঙ্খলা ও বৈষম্য। অন্যদিকে ইউজিসি বলছে, সরকারি কলেজগুলোকে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে নেয়ার সিদ্ধান্ত ভুল ছিল। বিশৃঙ্খলা ও বৈষম্য দূর করতেই এ উদ্যোগ। শনিবার জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশেষ সিনেট অধিবেশনে সদস্যরা অভিযোগ করে বলেছেন, সরকারি কলেজের ১৫ হাজার শিক্ষক বিষয়টি ভালভাবে নিচ্ছেন না। এ প্রসঙ্গে ইউজিসি’র চেয়ারম্যান এ কে আজাদ চৌধুরী মানবজমিনকে বলেন, সরকারি কলেজ আলাদা হলে কোন বিশৃঙ্খলা তৈরি হবে না। বরং একটি শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতেই প্রধানমন্ত্রী উদ্যোগ নিয়েছেন। গত শুত্রুবার একটি অনুষ্ঠানে তিনি বলেন, ১৯৯২ সালে সরকারি কলেজগুলোকে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে নেয়ার সিদ্ধান্ত ছিল ভুল। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে বিশেষ সিনেট অধিবেশনে সদস্যরা বলেন, প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনাকে ইস্যু করে কিছু ব্যক্তি তৎপরতা চালাচ্ছেন। এটি বাস্তবায়িত হলে সরকারকে বিব্রত হতে হবে। তারা এ বিষয়ে সরকারকে সতর্কতার সঙ্গে এগুনোর পরামর্শ দেন। এ ব্যাপারে ইউজিসি’র চেয়ারম্যান বলেন, আমরা সতর্কতার সঙ্গে কাজ করছি। সবার পরামর্শ নিচ্ছি। কোন তাড়াহুড়া নেই। বরং জাতীয় স্বার্থে যেটা করা দরকার তাই করবো। এখানে পক্ষ-বিপক্ষ দেখা হবে না। এর আগে চলতি মাসে দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসিদের নিয়ে মতবিনিময় করেন ইউজিসি। সেখানে বেশির ভাগ ভিসি প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনার পক্ষে মত দেন। এটি বাস্তবায়ন করতে গত ৭ তারিখ তিন সদস্যের একটি ও শনিবার এটি প্রতিহত করতে ৭ সদস্যের আরেকটি কমিটি গঠন করেছে সংস্থা দুটি। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে সেশনজট ও শিক্ষার মানোন্নয়ন ইস্যুতে শনিবার আয়োজিত এক বিশেষ সিনেট অধিবেশনে এর সদস্যরা উদ্বেগ জানিয়ে বলেন, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো নিজেদের সেশনজট ও সমস্যা নিয়েই ব্যস্ত। সেখানে ভাগাভাগি করে সরকারি কলেজের ২ থেকে ৩ লাখ করে শিক্ষার্থী নেয়ার পর পরিস্থিতি আরও জটিল হবে। এ সময় তারা এক শ্রেণীর শিক্ষাবিদের সমালোচনা করে বলেন, অসৎ উদ্দেশ্যে তারা প্রধানমন্ত্রীকে এ পরামর্শ দিয়েছেন। এতে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা-বাণিজ্যের পথ উন্মুক্ত হবে। সরকারি-বেসরকারি কলেজের মধ্যে নতুন করে বৈষম্য দেখা দেবে। মধ্যবিত্ত ও নিম্নমধ্যবিত্ত শ্রেণীর উচ্চশিক্ষার দরজা বন্ধ হবে। অধিবেশনে সিনেটের একটি প্রতিনিধি দল প্রধানমন্ত্রীর সক্ষে সাক্ষাৎ করে প্রকৃত চিত্র তুলে ধরাসহ ২০ দফা প্রস্তাব উত্থাপন করা হয়। এ লক্ষ্যে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি ও পিএসসি সদস্য অধ্যাপক ড. শরীফ এনামুল কবীরকে প্রধান করে ৭ সদস্যের কমিটি গঠন করা হয়। অধিবেশনে সিনেটের ৬৯ জন সদস্যের মধ্যে ৩৭ ও দু’জন অতিথি উপস্থিত ছিলেন। এতে বেশির ভাগ সদস্য আলোচনায় অংশ নেন। তাদের প্রস্তাবনার মধ্যে রয়েছে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে সিনেট-সিন্ডিকেটে প্রস্তাব পাসের পর সরকারি কলেজ পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে ছেড়ে দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়া, সেশনজট নিরসনের আঞ্চলিক কেন্দ্র ৬টিসহ ১৯টি স্থাপন, প্রত্যেক কেন্দ্র একজন করে প্রো-ভিসি নিয়োগ, যততত্র অনার্স ও মাস্টার্স কোর্স চালু না করা, বিদ্যামান ও ভবিষতে অনার্স ও মাস্টার্স চালু থাকার প্রতিষ্ঠানে প্রয়োজনীয় সংখ্যক শিক্ষক, ক্লাসরুম সংখ্যা বৃদ্ধি, সমৃদ্ধ লাইব্রেরি ও গবেষণাগার নিশ্চিত, প্রতি বছর একটি করে বিশেষ সিনেট অধিবেশন, তিন মাসের মধ্যে সব ধরনের পরীক্ষার ফল প্রকাশ, মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিকে ফলের ভিত্তিতে স্নাতকোত্তর ভর্তি বা একটি অভিন্ন ভর্তি পরীক্ষা চালু, সরকারি কলেজের শিক্ষকের বদলি পদায়নে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে অনুমোদন, কলেজগুলোর শিক্ষার মানোন্নয়নে কার্যক্রর পদক্ষেপ গ্রহণ, সব সেশনের জন্য একাডেমিক ক্যালেন্ডার প্রণয়ন, শিক্ষার মান্নোয়নের মনিটরিং কমিটি প্রণয়ন, শিক্ষার্থীদের জীবনের কথা বিবেচনায় হরতাল, ধর্মঘট কর্মসূচি না থাকার ব্যাপারে রাজনৈতিক দলগুলোকে আহ্বান, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে অধীনে আরোপিত বিভিন্ন ফি কমানো, বেসরকারি কলেজের এমপিওভুক্তি ব্যবস্থা, প্রতি বছর জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় বিশেষ বরাদ্দ ইত্যাদি। সাবেক হুইপ ও উপাধ্যক্ষ আবদুস শহীদ এমপি বলেন, অনার্স কলেজ পাবলিক অধীনে যাচ্ছে এবং বেসরকারি কলেজ এ বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে থাকলে একটা বৈষম্য সৃষ্টি হবে। এ বিষয়ে একটি সমন্বিত ও সুষ্ঠু পদক্ষেপ নেয়ার পরামর্শ দেন তিনি। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভিসি ও পিএসসি সদস্য অধ্যাপক শরীফ এনামুল কবীর বলেন, সরকারি কলেজগুলোকে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে অধিভুক্ত করার ব্যাপারে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনাকে পুঁজি করে একটি গোষ্ঠীর ব্যাপক তৎপরতা রহস্যজনক। প্রধানমন্ত্রী যে বক্তব্য দিয়েছেন তা শিক্ষাবিদদের মতামত নিয়েই একটি কমিটি করে গবেষণার মাধ্যমে খতিয়ে দেখা উচিত। না হয় দীর্ঘমেয়াদি ক্ষতির সম্মুখীন হবে দেশের বৃহত্তম এ বিশ্ববিদ্যালয়টি। অনেক বিশ্ববিদ্যালয় নিজেরাই সেশনজটে হাবুডুবু খাচ্ছে, তারা কিভাবে আরেকটি কলেজের সেশনজটমুক্ত করবে। তিনি বলেন, অনেক কলেজে ৫০ থেকে ৫৫ হাজার শিক্ষার্থী আছে, যা দেশের কোন বিশ্ববিদ্যালয়ে নেই। তাই সরকারি কলেজগুলোকে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় অধীনে নিলে পুরো ব্যবস্থাপনায় হ-য-ব-র-ল অবস্থা তৈরি হবে। ইউনিভার্সিটি অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি চট্টগ্রামের (ইউএসটিসি) ভিসি অধ্যাপক ড. মুহম্মদ সামাদ বলেন, যদি জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় খণ্ডবিখণ্ড করা হয়, তাহলে সাধারণ মানুষ ও সরকারের জন্য ক্ষতির কারণ হবে। প্রধানমন্ত্রী প্রজ্ঞাবান। তিনি এমন সিদ্ধান্ত নেবেন না বলে বিশ্বাস করি। তিনি আরও বলেন, এ সিদ্ধান্ত পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্যও ক্ষতির কারণ হবে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ওয়াহিদুজামান বলেন, যারা জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে এমন কথা বলছেন তারা মূলত বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়কে পৃষ্ঠপোষকতা করতে চাচ্ছেন। আমরা জেনেছি, ৩১শে আগস্ট শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে প্রধানমন্ত্রীর বৈঠক শুরুর আগে একজন ব্যক্তি এ বিষয়টি তার (প্রধানমন্ত্রীর) নজরে নিয়েছেন। কিন্তু ওই শিক্ষাবিদ প্রকৃত চিত্র এবং পাশাপাশি সমাধানের বিষয়টি প্রধানমন্ত্রীর সামনে তুলে ধরেননি। শিক্ষানীতি প্রণয়ন কমিটির সদস্য ইতিহাসবিদ অধ্যাপক সিরাজউদ্দিন হোসেন বলেন, সরকারি কলেজ পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে ছেড়ে দেয়ার প্রস্তাবনা একটি উদ্ভট চিন্তাধারা। এমন সিদ্ধান্ত ২০১০ সালের জাতীয় শিক্ষানীতিতে নেই। প্রধানমন্ত্রীকে এটা অবহিত করতে হবে। এজন্য একটি কমিটি গঠন করা দরকার। তিতুমীর কলেজের সহকারী অধ্যাপক আফরোজ বেগম বলেন, আমাদের কলেজের ৫৫ হাজার শিক্ষার্থীর সেখানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কিভাবে এ শিক্ষার্থীদের দায়ভার গ্রহণ করবে, নিজেরা যেখানে একাডেমিক কার্যত্রুম পরিচালনা করতে হাবুডুবু খাচ্ছে? এর আগে অধ্যাপক ড. হারুন-অর-রশিদ সেশনজট নিরসন ও শিক্ষার মানোন্নয়নে ২৬ দফা প্রস্তাব উত্থাপন করেন। তিনি বলেন, সেশনজট এ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান সমস্যা। প্রস্তাবনা বাস্তবায়ন করা সম্ভব হলে তা শূন্যে নামিয়ে আনা সম্ভব হবে। জাতীয় সংগীতের সুর, পবিত্র কোরআনসহ বিভিন্ন ধর্মগ্রন্থ পাঠের মাধ্যমে অধিবেশন শুরু হয়।
No comments