অবিস্মরণীয় মওলানা ভাসানী by ফকির আলমগীর
উপমহাদেশীয় রাজনীতিতে এক অবিস্মরণীয় নাম মওলানা ভাসানী। উপমহাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলন থেকে শুরু করে বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলন, সেই আন্দোলন থেকে বাংলাদেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব সংরক্ষণ লড়াইয়ে এ দেশের মজলুম জনমানুষের মুক্তির সংগ্রামে সব ক্ষেত্রেই মওলানা ভাসানী নিয়েছিলেন অগ্রণী ভূমিকা। দাঁড়িয়েছিলেন সামনের কাতারে। সাধারণ মানুষের মুক্তির লড়াইয়ে তিনি টাঙ্গাইলের সন্তোষ থেকে ছুটে গেছেন আসামের নির্যাতিত মানুষের পাশে, সেখান থেকে ছুটে গেছেন সিন্ধুর কোনো শহরে। তাই উপমহাদেশের প্রান্তরে সাধারণ মানুষের হৃদয়ে স্থান করে নিয়েছেন মওলানা ভাসানী। এ আপসহীন সংগ্রামীর ৩৮তম মৃত্যুবার্ষিকী আজ। বাংলাদেশের মানুষ কৃতজ্ঞ চিত্তে স্মরণ করবেন মহান জননায়ক মওলানা ভাসানীকে।
আমাদের রাজনৈতিক অঙ্গনে সম্পূর্ণ এক ভিন্ন প্রকৃতিক মানুষ ছিলেন মওলান ভাসানী। তার রাজনীতির প্রধান লক্ষ্য ছিল নির্যাতিত-শোষিত সাধারণ মানুষের শোষণ-বঞ্চনার অবসান ঘটানো। সে কারণেই তিনি সারা জীবন অন্যায়-অবিচারের প্রতিবাদ করেছেন, নির্যাতন-শোষণ-বঞ্চনার অবসানের জন্য লড়াই করে গেছেন- সর্বক্ষণ জনতার পাশে দাঁড়িয়ে থেকেছেন এক বিশাল মহীরুহের মতো। ক্ষমতার কাড়াকাড়িতে যাননি কখনও। যে কোনো দুর্যোগে, যে কোনো বিপর্যয়ে এ অভিভাবককে জনসাধারণ সব সময়ই পাশে পেয়েছেন। তাই মওলানা ভাসানী ছিলেন তাদের ঘরের মানুষ। এখনও ঘরে ঘরে উচ্চারিত তার নাম।
এ মহান জননায়ক ছিলেন অনেক দূরের অভিযাত্রী, দুর্গম পথের পথিক। অথচ সাদাসিধা এক অনন্যসাধারণ মানুষ। এ জনপদের মানুষের ভিড়ের মধ্যে, তাদের রুচি আর আচার-আচরণের মধ্যে তিনি মিশে ছিলেন আজীবন। সাদা লুঙ্গি, পাঞ্জাবি আর মাথায় বেতের টুপি পরা এ মানুষটিকে এ দেশের মানুষ থেকে কখনও আলাদা করে দেখা যায়নি। কিন্তু যখন তিনি সব দুঃশাসনের বিরুদ্ধে এক বিশাল জলোচ্ছ্বাসের মতো গর্জন করে উঠেছেন, তখনই সবাই তাকে চিনেছে আলাদা করে। তবু তিনি ছিলেন আত্মীয়ের মতো, অভিভাবকের মতো, বিপদের বন্ধুর মতো।
আসামের লাইন প্রথাবিরোধী আন্দোলন থেকে শুরু করে ১৯৭৬ সালের ঐতিহাসিক ফরাক্কা মার্চ- মওলানা ভাসানীর রাজনৈতির জীবনের এক ধারাবাহিক লড়াইয়ের ইতিহাস। এ সংগ্রামের ধারা অভিন্ন সূত্রে গ্রথিত- মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য সে সংগ্রাম।
মওলানা ভাসানীর বিভিন্ন ভাবমূর্তি আছে আমাদের সামনে। কখনও তিনি রাজনৈতিক নেতা, কখনও সমাজ-সংস্কারক, কখনওবা ধর্মীয় নেতা। আবার অনেকের চোখেই তিনি ছিলেন লাল পতাকা বিপ্লবের অগ্রদূত। এসব কারণে কখনও কখনও তিনি যে ভুল বোঝাবুঝির শিকার হননি তা নয়। কেউ সরে গেছে, কেউ কাছে এসেছে, কেউ ফিরে এসেছে মওলানার পাশে। কিন্তু তিনি ছিলেন তার আদর্শে অবিচল। এখানেই মওলানা ভাসানী স্বাতন্ত্র্যে উদ্ভাসিত। এটাই ভাসানীর রাজনীতি। আর সে আদর্শ ছিল দেশের দরিদ্র জনসাধারণের মুক্তি। এ আদর্শ বাস্তবায়নের জন্যই তিনি লড়াই করেছেন, অন্যায়-অবিচারের প্রতিবাদ করেছেন আমৃত্যু।
আসামের লাইন প্রথা আন্দোলনের মধ্য দিয়ে শুরু তার রাজনৈতিক জীবন। ব্রিটিশের ঔপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে তার লড়াই, বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে তার অবদান এবং সর্বশেষে স্বাধীন বাংলাদেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা ও এর স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব সংরক্ষণে তিনি যে অবদান রেখে গেছেন তা শুধু বাংলাদেশের মানুষ নয়, উপমহাদেশের মানুষও স্মরণ করবেন দীর্ঘদিন। যেখানেই শোষণ, যেখানেই বঞ্চনা, যেখানেই সাধারণ মানুষের মুক্তির লড়াইয়ের প্রশ্ন- সেখানেই আছেন মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী।
পাকিস্তান প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর দরিদ্র জনসাধারণের মুক্তির লক্ষ্যে তিনিই প্রথম মুসলিম লীগ থেকে বেরিয়ে এসে গড়ে তুলেছিলেন বিরোধী দল। কারণ তিনি জানতেন, মুসলিম লীগ সরকার ক্ষমতার মোহে একসময় এক অন্ধশক্তিতে পরিণত হতে পারে। আর তার ফলে সাধারণ মানুষ পড়বে সংকটে। মুসলিম লীগ শাসনামলে সাধারণ মুনুষের কল্যাণ নিশ্চিত হয়নি। মওলানা ভাসানী জানতেন, এ দেশের রাজনীতিতে চেক অ্যান্ড ব্যালেন্স প্রতিষ্ঠার জন্যই তিনি বিরোধী দল প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। ভাষা আন্দোলন, স্বায়ত্তশাসনের আন্দোলন, ১৯৫৪ সালের নির্বাচন, জোটনিরপেক্ষ পররাষ্ট্রনীতি, বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংরক্ষণ- প্রতিটি ক্ষেত্রেই তিনি ছিলেন পথিকৃত। সেই ১৯৫৭ সালে কাগমারী সম্মেলনে তিনি পাকিস্তানের বিমাতাসুলভ শাসক গোষ্ঠীকে ‘আসসালামু আলাইকুম’ বলে বিদায় জানিয়েছিলেন, বীজ বপন করেছিলেন স্বাধীন বাংলাদেশের। মওলানা ভাসানী বুঝতে পেরেছিলেন, পাকিস্তানের পশ্চিম অংশের শাসকরা ধর্ম ও জাতীয় সংহতির নামে পূর্ব বাংলার মানুষকে শোষণ করছে। তাই তাদের সঙ্গে একই রাষ্ট্রের বাঁধনে অবস্থান করা আর সম্ভব নয়। সে কারণে ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থানে তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। পূর্ব পাকিস্তান তথা বাংলাদেশের মানুষের স্বাধীন স্বতন্ত্র জাতিসত্তা সম্পর্কেও মওলানা ভাসানী সম্যক অবহিত ছিলেন। এ কারণেই তিনি জনগণকে সঙ্গে নিয়ে পাকিস্তানি স্বৈরাচারী সরকারের বিরুদ্ধে প্রবল গণআন্দোলন গড়ে তোলেন। ১৯৭০ সালের নভেম্বরে পল্টন ময়দানে ভাষণদানকালে এ কথাটিই বারবার উচ্চারণ করে জাতিকে সতর্ক করে দিয়েছিলেন তিনি। তার স্বাধীনতার স্বপ্ন সফল হয়েছিল। মহান মুক্তিযুদ্ধে তিনি প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের উপদেষ্টা কমিটির সদস্য হিসেবে বিশেষ ভূমিকা পালন করেন।
শহর তার রাজনীতির কেন্দ্র ছিল না, গ্রামে গ্রামে ঘুরতেন তিনি। সব সময় তার সংযোগ ছিল গ্রামের কামার-কুমার-তাঁতি-জেলে, কৃষক-শ্রমিক-মজুরের সঙ্গে। কখনও তিনি ঘুরতেন নৌকায়, কখনও হেঁটে। সন্তোষই তার ঠিকানা ছিল। রাজধানীর প্রাসাদ রাজনীতিতে বিশ্বাস ছিল না তার। শহরের রাজনীতিকরা নিজেদের প্রয়োজনেই যেতেন মওলানা ভাসানীর কাছে। তারাই কখনও কখনও ভাসানীকে আমন্ত্রণ করে আনতেন শহরে। তিনি ছিলেন সংগ্রামে ও সংকটে বিশাল সহায়। কখনোই কোনো পদমর্যাদা, লোভ-লালসা-মোহ তাকে আকৃষ্ট করতে পারেনি। তিনি সব সময় জনগণের পাশে থেকে বিভিন্ন জনমুখী কর্মসূচি পালন করেন। সরল-সহজ জীবনযাপন করেছেন তিনি। একই সঙ্গে সরল প্রাণের কৃষক-মজুররা তার প্রিয় ছিল।
স্বাধীন বাংলাদেশে যখন গণতন্ত্রের নামে মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকার কেড়ে নেয়া হচ্ছিল একের পর এক, কেড়ে নেয়া হচ্ছিল বাক-ব্যক্তি স্বাধীনতা, তখনও সিংহের মতো গর্জে উঠেছেন মজলুম জননেতা মওলানা ভাসানী। আদর্শ থেকে তিনি বিচ্যুত হননি কখনও। তিনি লড়াই করেছেন সব কালাকানুনেরও বিরুদ্ধে। আজ যখন সারা দেশে বিভেদ-বিভাজন-হানাহানি, তখন মওলানা ভাসানী হতে পারতেন সংহতির কণ্ঠস্বর। মিলিত প্রাণের সংগ্রাম। তিনি হতে পারতেন জাতীয় ঐক্যের প্রতীক।
মনে পড়ে, গঙ্গার পানির ন্যায্য হিস্যার জন্য তিনি এক বিশাল জনতা নিয়ে ফারাক্কা বাঁধ পর্যন্ত মিছিল করেছেন। আন্তর্জাতিক নদীর পানির হিস্যা চাই আমরা- এ দাবিও এক বিশাল সাহসের সঞ্চার করেছে এ দেশের অধিকার সচেতন মানুষের মনে। কানসাট থেকে ফুলবাড়ীর আন্দোলন কিংবা তেল-গ্যাসের যে আন্দোলন- সবকিছুর মূলেই রয়েছে মওলানা ভাসানীর প্রেরণা।
বর্তমান রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে মজলুম জননেতার প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করছে সবাই। তাই আজ তাকে রাজনৈতিক বিতর্কের ঊর্ধ্বে রেখে গণমানুষের কল্যাণে তার অভিজ্ঞতা ও শিক্ষাকে কাজে লাগাতে হবে। আজ সেই মহান জননায়ক মওলানা ভাসানীর মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে তার স্মৃতির প্রতি আমরা গভীর শ্রদ্ধা জানাই।
ফকির আলমগীর : গণসঙ্গীত শিল্পী
আমাদের রাজনৈতিক অঙ্গনে সম্পূর্ণ এক ভিন্ন প্রকৃতিক মানুষ ছিলেন মওলান ভাসানী। তার রাজনীতির প্রধান লক্ষ্য ছিল নির্যাতিত-শোষিত সাধারণ মানুষের শোষণ-বঞ্চনার অবসান ঘটানো। সে কারণেই তিনি সারা জীবন অন্যায়-অবিচারের প্রতিবাদ করেছেন, নির্যাতন-শোষণ-বঞ্চনার অবসানের জন্য লড়াই করে গেছেন- সর্বক্ষণ জনতার পাশে দাঁড়িয়ে থেকেছেন এক বিশাল মহীরুহের মতো। ক্ষমতার কাড়াকাড়িতে যাননি কখনও। যে কোনো দুর্যোগে, যে কোনো বিপর্যয়ে এ অভিভাবককে জনসাধারণ সব সময়ই পাশে পেয়েছেন। তাই মওলানা ভাসানী ছিলেন তাদের ঘরের মানুষ। এখনও ঘরে ঘরে উচ্চারিত তার নাম।
এ মহান জননায়ক ছিলেন অনেক দূরের অভিযাত্রী, দুর্গম পথের পথিক। অথচ সাদাসিধা এক অনন্যসাধারণ মানুষ। এ জনপদের মানুষের ভিড়ের মধ্যে, তাদের রুচি আর আচার-আচরণের মধ্যে তিনি মিশে ছিলেন আজীবন। সাদা লুঙ্গি, পাঞ্জাবি আর মাথায় বেতের টুপি পরা এ মানুষটিকে এ দেশের মানুষ থেকে কখনও আলাদা করে দেখা যায়নি। কিন্তু যখন তিনি সব দুঃশাসনের বিরুদ্ধে এক বিশাল জলোচ্ছ্বাসের মতো গর্জন করে উঠেছেন, তখনই সবাই তাকে চিনেছে আলাদা করে। তবু তিনি ছিলেন আত্মীয়ের মতো, অভিভাবকের মতো, বিপদের বন্ধুর মতো।
আসামের লাইন প্রথাবিরোধী আন্দোলন থেকে শুরু করে ১৯৭৬ সালের ঐতিহাসিক ফরাক্কা মার্চ- মওলানা ভাসানীর রাজনৈতির জীবনের এক ধারাবাহিক লড়াইয়ের ইতিহাস। এ সংগ্রামের ধারা অভিন্ন সূত্রে গ্রথিত- মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য সে সংগ্রাম।
মওলানা ভাসানীর বিভিন্ন ভাবমূর্তি আছে আমাদের সামনে। কখনও তিনি রাজনৈতিক নেতা, কখনও সমাজ-সংস্কারক, কখনওবা ধর্মীয় নেতা। আবার অনেকের চোখেই তিনি ছিলেন লাল পতাকা বিপ্লবের অগ্রদূত। এসব কারণে কখনও কখনও তিনি যে ভুল বোঝাবুঝির শিকার হননি তা নয়। কেউ সরে গেছে, কেউ কাছে এসেছে, কেউ ফিরে এসেছে মওলানার পাশে। কিন্তু তিনি ছিলেন তার আদর্শে অবিচল। এখানেই মওলানা ভাসানী স্বাতন্ত্র্যে উদ্ভাসিত। এটাই ভাসানীর রাজনীতি। আর সে আদর্শ ছিল দেশের দরিদ্র জনসাধারণের মুক্তি। এ আদর্শ বাস্তবায়নের জন্যই তিনি লড়াই করেছেন, অন্যায়-অবিচারের প্রতিবাদ করেছেন আমৃত্যু।
আসামের লাইন প্রথা আন্দোলনের মধ্য দিয়ে শুরু তার রাজনৈতিক জীবন। ব্রিটিশের ঔপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে তার লড়াই, বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে তার অবদান এবং সর্বশেষে স্বাধীন বাংলাদেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা ও এর স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব সংরক্ষণে তিনি যে অবদান রেখে গেছেন তা শুধু বাংলাদেশের মানুষ নয়, উপমহাদেশের মানুষও স্মরণ করবেন দীর্ঘদিন। যেখানেই শোষণ, যেখানেই বঞ্চনা, যেখানেই সাধারণ মানুষের মুক্তির লড়াইয়ের প্রশ্ন- সেখানেই আছেন মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী।
পাকিস্তান প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর দরিদ্র জনসাধারণের মুক্তির লক্ষ্যে তিনিই প্রথম মুসলিম লীগ থেকে বেরিয়ে এসে গড়ে তুলেছিলেন বিরোধী দল। কারণ তিনি জানতেন, মুসলিম লীগ সরকার ক্ষমতার মোহে একসময় এক অন্ধশক্তিতে পরিণত হতে পারে। আর তার ফলে সাধারণ মানুষ পড়বে সংকটে। মুসলিম লীগ শাসনামলে সাধারণ মুনুষের কল্যাণ নিশ্চিত হয়নি। মওলানা ভাসানী জানতেন, এ দেশের রাজনীতিতে চেক অ্যান্ড ব্যালেন্স প্রতিষ্ঠার জন্যই তিনি বিরোধী দল প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। ভাষা আন্দোলন, স্বায়ত্তশাসনের আন্দোলন, ১৯৫৪ সালের নির্বাচন, জোটনিরপেক্ষ পররাষ্ট্রনীতি, বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংরক্ষণ- প্রতিটি ক্ষেত্রেই তিনি ছিলেন পথিকৃত। সেই ১৯৫৭ সালে কাগমারী সম্মেলনে তিনি পাকিস্তানের বিমাতাসুলভ শাসক গোষ্ঠীকে ‘আসসালামু আলাইকুম’ বলে বিদায় জানিয়েছিলেন, বীজ বপন করেছিলেন স্বাধীন বাংলাদেশের। মওলানা ভাসানী বুঝতে পেরেছিলেন, পাকিস্তানের পশ্চিম অংশের শাসকরা ধর্ম ও জাতীয় সংহতির নামে পূর্ব বাংলার মানুষকে শোষণ করছে। তাই তাদের সঙ্গে একই রাষ্ট্রের বাঁধনে অবস্থান করা আর সম্ভব নয়। সে কারণে ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থানে তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। পূর্ব পাকিস্তান তথা বাংলাদেশের মানুষের স্বাধীন স্বতন্ত্র জাতিসত্তা সম্পর্কেও মওলানা ভাসানী সম্যক অবহিত ছিলেন। এ কারণেই তিনি জনগণকে সঙ্গে নিয়ে পাকিস্তানি স্বৈরাচারী সরকারের বিরুদ্ধে প্রবল গণআন্দোলন গড়ে তোলেন। ১৯৭০ সালের নভেম্বরে পল্টন ময়দানে ভাষণদানকালে এ কথাটিই বারবার উচ্চারণ করে জাতিকে সতর্ক করে দিয়েছিলেন তিনি। তার স্বাধীনতার স্বপ্ন সফল হয়েছিল। মহান মুক্তিযুদ্ধে তিনি প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের উপদেষ্টা কমিটির সদস্য হিসেবে বিশেষ ভূমিকা পালন করেন।
শহর তার রাজনীতির কেন্দ্র ছিল না, গ্রামে গ্রামে ঘুরতেন তিনি। সব সময় তার সংযোগ ছিল গ্রামের কামার-কুমার-তাঁতি-জেলে, কৃষক-শ্রমিক-মজুরের সঙ্গে। কখনও তিনি ঘুরতেন নৌকায়, কখনও হেঁটে। সন্তোষই তার ঠিকানা ছিল। রাজধানীর প্রাসাদ রাজনীতিতে বিশ্বাস ছিল না তার। শহরের রাজনীতিকরা নিজেদের প্রয়োজনেই যেতেন মওলানা ভাসানীর কাছে। তারাই কখনও কখনও ভাসানীকে আমন্ত্রণ করে আনতেন শহরে। তিনি ছিলেন সংগ্রামে ও সংকটে বিশাল সহায়। কখনোই কোনো পদমর্যাদা, লোভ-লালসা-মোহ তাকে আকৃষ্ট করতে পারেনি। তিনি সব সময় জনগণের পাশে থেকে বিভিন্ন জনমুখী কর্মসূচি পালন করেন। সরল-সহজ জীবনযাপন করেছেন তিনি। একই সঙ্গে সরল প্রাণের কৃষক-মজুররা তার প্রিয় ছিল।
স্বাধীন বাংলাদেশে যখন গণতন্ত্রের নামে মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকার কেড়ে নেয়া হচ্ছিল একের পর এক, কেড়ে নেয়া হচ্ছিল বাক-ব্যক্তি স্বাধীনতা, তখনও সিংহের মতো গর্জে উঠেছেন মজলুম জননেতা মওলানা ভাসানী। আদর্শ থেকে তিনি বিচ্যুত হননি কখনও। তিনি লড়াই করেছেন সব কালাকানুনেরও বিরুদ্ধে। আজ যখন সারা দেশে বিভেদ-বিভাজন-হানাহানি, তখন মওলানা ভাসানী হতে পারতেন সংহতির কণ্ঠস্বর। মিলিত প্রাণের সংগ্রাম। তিনি হতে পারতেন জাতীয় ঐক্যের প্রতীক।
মনে পড়ে, গঙ্গার পানির ন্যায্য হিস্যার জন্য তিনি এক বিশাল জনতা নিয়ে ফারাক্কা বাঁধ পর্যন্ত মিছিল করেছেন। আন্তর্জাতিক নদীর পানির হিস্যা চাই আমরা- এ দাবিও এক বিশাল সাহসের সঞ্চার করেছে এ দেশের অধিকার সচেতন মানুষের মনে। কানসাট থেকে ফুলবাড়ীর আন্দোলন কিংবা তেল-গ্যাসের যে আন্দোলন- সবকিছুর মূলেই রয়েছে মওলানা ভাসানীর প্রেরণা।
বর্তমান রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে মজলুম জননেতার প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করছে সবাই। তাই আজ তাকে রাজনৈতিক বিতর্কের ঊর্ধ্বে রেখে গণমানুষের কল্যাণে তার অভিজ্ঞতা ও শিক্ষাকে কাজে লাগাতে হবে। আজ সেই মহান জননায়ক মওলানা ভাসানীর মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে তার স্মৃতির প্রতি আমরা গভীর শ্রদ্ধা জানাই।
ফকির আলমগীর : গণসঙ্গীত শিল্পী
No comments