চায়ের কাপে তুফান by আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী
ইংরেজিতে একটা কথা আছে Storm in the tea cup. বাংলা করলে তার অর্থ দাঁড়ায় চায়ের কাপে তুফান। বাংলাদেশে এখন এই চায়ের কাপে তুফান প্রায়ই ওঠে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে তোলে দু-একটি মুখচেনা মিডিয়া। বর্তমান সরকার যত বেশি বিতর্কমুক্ত হয়ে ক্ষমতায় স্থিতিশীল হচ্ছে, তত বেশি তাদের গাত্রদাহ বাড়ছে। সুযোগ পেলেই তারা তিলকে তাল করে এমন প্রচারণা চালায় যাতে সরকার বেকায়দায় পড়ে এবং দেশে যে শান্তি ও স্থিতিশীলতা বিরাজ করছে তা নষ্ট হয়।
লতিফ সিদ্দিকীর কিছু বক্তব্য নিয়ে সম্প্রতি যে ঝড় উঠেছে, তা চায়ের পেয়ালায় তুফান নয়, সত্যিকার ঝড়। তিনি সত্য সত্যই ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের মনে আঘাত লাগে এমন কিছু কথা বলেছেন। কিন্তু নিউইয়র্কের বন্ধুদের কাছে খবর নিয়ে জেনেছি, লতিফ সিদ্দিকীও মিডিয়া চক্রান্তের শিকার হয়েছেন। অন্তত জয় ওয়াজেদ সম্পর্কে তার বক্তব্য টুয়িস্ট করা হয়েছে। ঢাকাতেও এখন দেখছি, যারে দেখতে নারি তার চলন বাঁকা এটা প্রমাণ করার জন্য একটি দুটি নিরপেক্ষতার মুখোশধারী ইংরেজি ও বাংলা দৈনিক উঠেপড়ে লেগেছে।
লতিফ সিদ্দিকীর বক্তব্য নিয়ে সরকারকে বেকায়দায় ফেলতে না পেরে এবার টার্গেট করা হয়েছে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার রাজনৈতিক উপদেষ্টা এইচটি ইমামকে। গত বুধবার (১২ নভেম্বর) ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসি মিলনায়তনে ছাত্রলীগ আয়োজিত এক আলোচনা সভায় তিনি কিছু বক্তব্য রেখেছেন। কাগজে তার বক্তব্য পাঠের আগেই ঢাকা থেকে আওয়ামী লীগের সমর্থক ও বিরোধী দুই ধরনেরই কিছু লোকের টেলিফোন পেতে শুরু করি। তারা জানান, এইচটি ইমাম এমন কথা বলেছেন যাতে সরকারের ভাবমূর্তি দারুণভাবে নষ্ট হয়েছে। সরকার যে নির্বাচনে অনিয়ম করেছেন সেটাও তিনি খোলাসা করে দিয়েছেন। তাকে অবিলম্বে সরকারি গদি থেকে অপসারণ করা উচিত।
এইচটি ইমাম সত্যই কী বলেছেন তা জানতে উদগ্রীব হলাম। তাকে আমি জানি ছাত্রাবস্থা থেকে। মুক্তিযুদ্ধের সময় আমরা আগরতলায় ছিলাম। এই যুদ্ধে তার সাহসী ভূমিকা দেখেছি। দোষেগুণে মানুষ। তাকে নিয়ে অনেক বিতর্ক। সরকারের ভেতরে-বাইরে অনেকে তাকে ঈর্ষা করেন। কারণ তিনি প্রধানমন্ত্রীর কাছের মানুষ। তার রাজনৈতিক উপদেষ্টা। ক্ষমতার খুব কাছাকাছি যারা থাকেন, তারা সব সময়ই ঈর্ষা ও অপবাদের শিকার হন। এসব অপবাদের কোনোটা সত্য, কোনোটা মিথ্যা।
এইচটি ইমামের সম্পর্কেও সত্য-মিথ্যা অনেক অপবাদ আছে। কিন্তু তার সঙ্গে দীর্ঘদিনের ঘনিষ্ঠতার সুবাদে জানি, তিনি একজন বিচক্ষণ ও অভিজ্ঞ মানুষ। কাঁচা রাজনীতিকদের মতো বেফাঁস কথা বলার লোক তিনি নন। ফলে তার বক্তব্য সম্পর্কিত খবর ও খবরভাষ্য দুদিন ধরে ছেপেছে যে নিরপেক্ষ দৈনিকটি, তার পাতা উল্টালাম। পত্রিকাটি প্রথম দিন (১৩ নভেম্বর) ছেপেছে এইচটি ইমামের বক্তব্য। তা কিছুটা টুয়িস্ট করা (আমি ঢাকায় ছাত্রলীগের এক নেতাকে টেলিফোন করে তার বক্তব্যের রেকর্ড করা পুরো ভাষণটি শুনেছি)। পরদিন নির্বাচনী অনিয়ম খোলাসা করলেন এইচটি ইমাম শীর্ষক প্রতিবেদনে তার বক্তব্যের ভাষ্য নিজেদের মনমতো করে সাজানো হল এবং এই ভাষ্যের পক্ষে সুধীজন বলে যাদের প্রতিক্রিয়া ছাপানো হয়েছে তারা সবাই এই পত্রিকাগোষ্ঠীর নিজস্ব ঘরানার লোক। যেমন- সাবেক নির্বাচন কমিশনার এম সাখাওয়াত হোসেন। সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা হোসেন জিল্লুর রহমান, টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান। এদের লেখা আমি পড়ি। এরাও নিরপেক্ষতার ভান করে সব সময় সরকারের খুঁত ধরেন এবং ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে যে অনিয়ম হয়েছে, নিরপেক্ষ দৈনিকটির এই প্রচারণার সহযোগী।
এইচটি ইমাম তো কোনো বড় রাজনৈতিক নেতা নন। কিন্তু অসৎ সাংবাদিকতা দ্বারা বড় বড় রাজনৈতিক নেতার বক্তব্যও যে টুয়িস্ট ও বিকৃত করে তাদের রাজনৈতিক জীবন শেষ করে দেয়ার চেষ্টা করা হয়, তার ভূরি ভূরি প্রমাণ আমার জানা। একবার শেরেবাংলা ফজলুল হক ঢাকার আরমানিটোলা ময়দানের এক জনসভায় মওলানা ভাসানীর মুক্তি দাবি করে (মওলানা ভাসানী তখন জেলে) বলেছিলেন, মওলানা ভাসানী একজন নিঃস্বার্থ রাজনৈতিক নেতা। কখনও পদ বা ক্ষমতার লোভে রাজনীতি করেন না। আমারও রাজনীতি করার স্বার্থ ছিল। মন্ত্রী বা প্রধানমন্ত্রী হওয়ার আশা ছিল। কিন্তু মওলানা ভাসানী এ রকম কোনো আশা বা স্বার্থ নিয়ে রাজনীতি করেননি। পরদিন মুসলিম লীগ সমর্থক একটি কাগজ হক সাহেবের বক্তব্যের আগের ও পরের অংশ বাদ দিয়ে বিরাটভাবে ছেপেছিল, সারা জীবন স্বার্থের জন্য রাজনীতি করেছি, ফজলুল হক সাহেবের স্বীকৃতি। কারও বক্তব্য টুয়িস্ট বা বিকৃত করে ছাপার সাংবাদিকতা সবচেয়ে অসৎ সাংবাদিকতা। ব্রিটেন স্বাধীন সাংবাদিকতার দেশ। কিন্তু এই দেশেও এই ধরনের অসৎ সাংবাদিকতাকে শাস্তিযোগ্য অপরাধের আওতায় আনা হয়েছে। ছাত্রলীগের আলোচনা সভায় দেয়া এইচটি ইমামের বক্তব্যকেও টুয়িস্ট করা হয়েছে। তার রেকর্ডকৃত যে বক্তৃতা শুনেছি, তাতে ছাত্রদের চাকরি-বাকরি পাওয়া প্রসঙ্গে বলা হয়েছে, লিখিত পরীক্ষায় তোমাদের ভালো করতেই হবে। তোমরা পড়াশোনা করে ভালোভাবে পরীক্ষা দাও। ভাইভা পরীক্ষা সম্পর্কে তিনি বলেছেন, এই পরীক্ষাতেও তোমাদের ভালো করতে হবে। প্রয়োজনে আমি তোমাদের কোচিং ক্লাস নিতে পারি।
এখানে অন্যায় কী বলা হল? নিরপেক্ষ পত্রিকাটি তার বক্তব্য ছাঁটকাট করে ছেপেছে, তোমাদের লিখিত পরীক্ষায় ভালো করতে হব। তারপরে আমরা দেখব। ছাত্রছাত্রীরা লিখিত পরীক্ষা দিলেই আমরা দেখব। অর্থাৎ তাদের চাকরির ব্যবস্থা হয়ে যাবে! বক্তব্য এমনভাবে টুয়িস্ট করা কি অসৎ সাংবাদিকতা নয়? লক্ষণীয় নিরপেক্ষ দৈনিকটির খবর ভাষ্যের শেষের দিকে আমি প্রয়োজনে কোচিং ক্লাস নিতে রাজি আছি কথাটি বলা আছে। কিন্তু কথাটি এমন অসংলগ্নভাবে বসানো হয়েছে, তার প্রকৃত অর্থ বোঝা সচেতন পাঠকের পক্ষেও কষ্টকর। যেমন খবর ভাষ্যে বলা হয়েছে, তোমাদের মধ্য থেকে যারা প্রতিষ্ঠিত হতে চাও, আমি প্রয়োজনে কোচিং ক্লাস নিতে রাজি আছি। কোচিং ক্লাস করার কথা বলা হয়েছিল ভাইভা পরীক্ষা সম্পর্কে। নিরপেক্ষ পত্রিকাটি এই বক্তব্যেও অসংলগ্নতা সৃষ্টি করে পাঠকদের বিভ্রান্ত করতে চেয়েছে।
অসৎ সাংবাদিকতা কতটা নিুগামী হতে পারে, তার প্রমাণ পাওয়া যায় এইচটি ইমামের নির্বাচন সংক্রান্ত বক্তব্যের বিকৃত ভাষ্য প্রচারের মধ্যে। শুধু তার বক্তব্যকে বিকৃত করা নয়, তার মধ্যে অসংলগ্নতাও তৈরি করা হয়েছে। এইচটি ইমাম বলেছেন, বিএনপি শুধু যে আলোচনায় আসেনি বা নির্বাচন বয়কট করেছে তা নয়, তারা নির্বাচন প্রতিরোধ করার নামে যে ধ্বংসযজ্ঞ, যে নিষ্ঠুরতা ২০১৩ সালে পুরো বছর করেছে তার কোনো নজির নেই। তারা জামায়াতকে নিয়ে রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছিল। নির্বাচনের সময়ের প্রত্যেকটি উপজেলায় কথা বলছি। পুলিশ প্রশাসনের ভূমিকা দেখেছি। আমাদের যারা রিক্রুটেড, তাদের দ্বারা মোবাইল কোর্ট করিয়ে নির্বাচন করেছি। আমাদের যে ১৯ জন পুলিশ ভাই প্রাণ দিয়েছে জামায়াত-শিবিরের আক্রমণে, তারা কারা? সব আমাদের মানুষ। এই বক্তব্য দ্বারা কি স্বীকার করা হল, সরকার নির্বাচনে হস্তক্ষেপ করেছেন বা তাতে অনিয়ম করেছেন? এটা তো নিরপেক্ষ পত্রিকাটির এবং তাদের সুশীল সমাজের প্রচারণা। নির্বাচন কমিশনার আবদুল মোবারক স্পষ্টই বলেছেন, নির্বাচন পরিচালনা করেছে নির্বাচন কমিশন। আইন-শৃংখলা বাহিনী নির্বাচন কমিশনের আওতায় কাজ করেছে। তথাপি নিরক্ষেপ দৈনিকটির ভাষ্য, ৫ জানুয়ারির একতরফা নির্বাচন নিয়ে মানুষের ধারণা এতদিন অনুমাননির্ভর ছিল। এখন এইচটি ইমাম তা খোলাসা করে দিয়েছেন।
উদোর পিণ্ডি বুধোর ঘাড়ে দেয়া আর কাকে বলে? এইচটি ইমাম বলেছেন, নির্বাচন প্রতিহত করতে জামায়াত-শিবিরের যে সশস্ত্র গুণ্ডামি আরম্ভ হয়েছিল তা মোকাবেলা করার কথা। বলেছেন এই মোকাবেলায় যেসব পুলিশ প্রাণ দিয়েছেন তাদের কথা। পশ্চিমবঙ্গে একবার রাজ্য নির্বাচনের সময় মাওবাদীরা কয়েকটি নির্বাচন কেন্দ্রে সশস্ত্র হামলা চালায়। সিপিএম সরকারের সমর্থক ক্যাডার বাহিনী একদল পুলিশের সহায়তায় এই হামলা প্রতিরোধ করে। মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসু এই পুলিশদের সাহসিকতার প্রশংসা করে তাদের আমাদের লোক বলে উল্লেখ করেছিলেন। নির্বাচন কমিশন তো তাদের দায়িত্ব পালন করছিলেনই, তাদের শান্তি রক্ষার কাজে সহায়তা দানের জন্য জ্যোতি বসু এই বিশেষ ব্যবস্থা করেছিলেন। তাতে কেউ বলেনি বামফ্রন্ট সরকার নির্বাচনে অনিয়ম করেছে বা হস্তক্ষেপ করেছে।
এসব প্রচারণা উপলক্ষ মাত্র। আসল লক্ষ্য শেখ হাসিনা। ভালো হোক আর মন্দ হোক, যেসব সহযোগীর পরামর্শ ও বিচক্ষণতার ওপর নির্ভর করে হাসিনা সরকার টিকে আছে তাদের মধ্যে এইচটি ইমাম একজন। এদের বিতর্কিত করে সরানো গেলে প্রধানমন্ত্রী দুর্বল হবেন, তার পতন ঘটানো সহজ হবে এটাই এই চায়ের কাপে তুফান তোলার লক্ষ্য। এইচটি ইমামের বিরুদ্ধে বাজারে অনেক অভিযোগ আছে। সেই অভিযোগের সত্যতার প্রমাণ পেলে তার ভিত্তিতে তাকে তার পদ থেকে অপসারণের দাবি তোলা যেতে পারে। তা না করে তার বক্তব্যকে বিকৃত করে যারা আপাতত তাকে আক্রমণের টার্গেট করেছে তাদের আসল টার্গেট শেখ হাসিনা।
এই খেলা আমরা ভারতেও দেখেছি। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর দুই প্রভাবশালী উপদেষ্টা ছিলেন পিএন হাকসার এবং ডিপি ধর। তারাও ছিলেন আমলা। তবে কংগ্রেসের অনেক রাজনৈতিক নেতার চেয়ে প্রজ্ঞাবান ও দূরদর্শী ছিলেন। ইন্দিরা গান্ধী তাদের পরামর্শের ওপর নির্ভরশীল ছিলেন। কংগ্রেসের ভেতরে ও বাইরে যারা ইন্দিরাবিরোধী ছিলেন, তারা ইন্দিরাকে ঘায়েল করতে না পেরে পিএন হাকসার ও ডিপি ধরের বিরুদ্ধে প্রথমে প্রচারণায় নামেন। এ দুজনের সঙ্গেই ইন্দিরা গান্ধীর ভুল বোঝাবুঝি সৃষ্টি করেন। ভুল বোঝাবুঝি এমন পর্যায়ে গিয়েছিল যে, হাকসারের সঙ্গে ইন্দিরা গান্ধী মুখ দেখাদেখি বন্ধ করে দেন। ডিপি ধরের মৃত্যু ঘটে আকস্মিক হৃদরোগে। পিএন হাকসার চাকরি ছেড়ে দেন। ইন্দিরা গান্ধী সম্পূর্ণ একা ও অসহায় হয়ে পড়েন। তাকে নির্বাচনে পরাজিত করে ক্ষমতা থেকে সরাতে বিরোধী শিবিরের আর কোনো অসুবিধা হয়নি। বাংলাদেশেও এখন এই একই ধরনের হাসিনাবিরোধী চক্রান্ত শুরু হয়েছে। এই চক্রান্ত শুধু আওয়ামী লীগের বাইরে নয়, ভেতরেও রয়েছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার এ সম্পর্কে সজাগ ও সতর্ক থাকা দরকার। এইচটি ইমামের বক্তব্যকে টুয়িস্ট করে চায়ের কাপে যে ঝড় তোলা হয়েছে, তার লক্ষ্য অদূর ভবিষ্যতে আসল ঝড় সৃষ্টি করা- তার টার্গেট হবেন শেখ হাসিনা। সময় থাকতে প্রধানমন্ত্রীর শক্ত অবস্থান গ্রহণ করা প্রয়োজন।
লতিফ সিদ্দিকীর কিছু বক্তব্য নিয়ে সম্প্রতি যে ঝড় উঠেছে, তা চায়ের পেয়ালায় তুফান নয়, সত্যিকার ঝড়। তিনি সত্য সত্যই ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের মনে আঘাত লাগে এমন কিছু কথা বলেছেন। কিন্তু নিউইয়র্কের বন্ধুদের কাছে খবর নিয়ে জেনেছি, লতিফ সিদ্দিকীও মিডিয়া চক্রান্তের শিকার হয়েছেন। অন্তত জয় ওয়াজেদ সম্পর্কে তার বক্তব্য টুয়িস্ট করা হয়েছে। ঢাকাতেও এখন দেখছি, যারে দেখতে নারি তার চলন বাঁকা এটা প্রমাণ করার জন্য একটি দুটি নিরপেক্ষতার মুখোশধারী ইংরেজি ও বাংলা দৈনিক উঠেপড়ে লেগেছে।
লতিফ সিদ্দিকীর বক্তব্য নিয়ে সরকারকে বেকায়দায় ফেলতে না পেরে এবার টার্গেট করা হয়েছে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার রাজনৈতিক উপদেষ্টা এইচটি ইমামকে। গত বুধবার (১২ নভেম্বর) ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসি মিলনায়তনে ছাত্রলীগ আয়োজিত এক আলোচনা সভায় তিনি কিছু বক্তব্য রেখেছেন। কাগজে তার বক্তব্য পাঠের আগেই ঢাকা থেকে আওয়ামী লীগের সমর্থক ও বিরোধী দুই ধরনেরই কিছু লোকের টেলিফোন পেতে শুরু করি। তারা জানান, এইচটি ইমাম এমন কথা বলেছেন যাতে সরকারের ভাবমূর্তি দারুণভাবে নষ্ট হয়েছে। সরকার যে নির্বাচনে অনিয়ম করেছেন সেটাও তিনি খোলাসা করে দিয়েছেন। তাকে অবিলম্বে সরকারি গদি থেকে অপসারণ করা উচিত।
এইচটি ইমাম সত্যই কী বলেছেন তা জানতে উদগ্রীব হলাম। তাকে আমি জানি ছাত্রাবস্থা থেকে। মুক্তিযুদ্ধের সময় আমরা আগরতলায় ছিলাম। এই যুদ্ধে তার সাহসী ভূমিকা দেখেছি। দোষেগুণে মানুষ। তাকে নিয়ে অনেক বিতর্ক। সরকারের ভেতরে-বাইরে অনেকে তাকে ঈর্ষা করেন। কারণ তিনি প্রধানমন্ত্রীর কাছের মানুষ। তার রাজনৈতিক উপদেষ্টা। ক্ষমতার খুব কাছাকাছি যারা থাকেন, তারা সব সময়ই ঈর্ষা ও অপবাদের শিকার হন। এসব অপবাদের কোনোটা সত্য, কোনোটা মিথ্যা।
এইচটি ইমামের সম্পর্কেও সত্য-মিথ্যা অনেক অপবাদ আছে। কিন্তু তার সঙ্গে দীর্ঘদিনের ঘনিষ্ঠতার সুবাদে জানি, তিনি একজন বিচক্ষণ ও অভিজ্ঞ মানুষ। কাঁচা রাজনীতিকদের মতো বেফাঁস কথা বলার লোক তিনি নন। ফলে তার বক্তব্য সম্পর্কিত খবর ও খবরভাষ্য দুদিন ধরে ছেপেছে যে নিরপেক্ষ দৈনিকটি, তার পাতা উল্টালাম। পত্রিকাটি প্রথম দিন (১৩ নভেম্বর) ছেপেছে এইচটি ইমামের বক্তব্য। তা কিছুটা টুয়িস্ট করা (আমি ঢাকায় ছাত্রলীগের এক নেতাকে টেলিফোন করে তার বক্তব্যের রেকর্ড করা পুরো ভাষণটি শুনেছি)। পরদিন নির্বাচনী অনিয়ম খোলাসা করলেন এইচটি ইমাম শীর্ষক প্রতিবেদনে তার বক্তব্যের ভাষ্য নিজেদের মনমতো করে সাজানো হল এবং এই ভাষ্যের পক্ষে সুধীজন বলে যাদের প্রতিক্রিয়া ছাপানো হয়েছে তারা সবাই এই পত্রিকাগোষ্ঠীর নিজস্ব ঘরানার লোক। যেমন- সাবেক নির্বাচন কমিশনার এম সাখাওয়াত হোসেন। সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা হোসেন জিল্লুর রহমান, টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান। এদের লেখা আমি পড়ি। এরাও নিরপেক্ষতার ভান করে সব সময় সরকারের খুঁত ধরেন এবং ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে যে অনিয়ম হয়েছে, নিরপেক্ষ দৈনিকটির এই প্রচারণার সহযোগী।
এইচটি ইমাম তো কোনো বড় রাজনৈতিক নেতা নন। কিন্তু অসৎ সাংবাদিকতা দ্বারা বড় বড় রাজনৈতিক নেতার বক্তব্যও যে টুয়িস্ট ও বিকৃত করে তাদের রাজনৈতিক জীবন শেষ করে দেয়ার চেষ্টা করা হয়, তার ভূরি ভূরি প্রমাণ আমার জানা। একবার শেরেবাংলা ফজলুল হক ঢাকার আরমানিটোলা ময়দানের এক জনসভায় মওলানা ভাসানীর মুক্তি দাবি করে (মওলানা ভাসানী তখন জেলে) বলেছিলেন, মওলানা ভাসানী একজন নিঃস্বার্থ রাজনৈতিক নেতা। কখনও পদ বা ক্ষমতার লোভে রাজনীতি করেন না। আমারও রাজনীতি করার স্বার্থ ছিল। মন্ত্রী বা প্রধানমন্ত্রী হওয়ার আশা ছিল। কিন্তু মওলানা ভাসানী এ রকম কোনো আশা বা স্বার্থ নিয়ে রাজনীতি করেননি। পরদিন মুসলিম লীগ সমর্থক একটি কাগজ হক সাহেবের বক্তব্যের আগের ও পরের অংশ বাদ দিয়ে বিরাটভাবে ছেপেছিল, সারা জীবন স্বার্থের জন্য রাজনীতি করেছি, ফজলুল হক সাহেবের স্বীকৃতি। কারও বক্তব্য টুয়িস্ট বা বিকৃত করে ছাপার সাংবাদিকতা সবচেয়ে অসৎ সাংবাদিকতা। ব্রিটেন স্বাধীন সাংবাদিকতার দেশ। কিন্তু এই দেশেও এই ধরনের অসৎ সাংবাদিকতাকে শাস্তিযোগ্য অপরাধের আওতায় আনা হয়েছে। ছাত্রলীগের আলোচনা সভায় দেয়া এইচটি ইমামের বক্তব্যকেও টুয়িস্ট করা হয়েছে। তার রেকর্ডকৃত যে বক্তৃতা শুনেছি, তাতে ছাত্রদের চাকরি-বাকরি পাওয়া প্রসঙ্গে বলা হয়েছে, লিখিত পরীক্ষায় তোমাদের ভালো করতেই হবে। তোমরা পড়াশোনা করে ভালোভাবে পরীক্ষা দাও। ভাইভা পরীক্ষা সম্পর্কে তিনি বলেছেন, এই পরীক্ষাতেও তোমাদের ভালো করতে হবে। প্রয়োজনে আমি তোমাদের কোচিং ক্লাস নিতে পারি।
এখানে অন্যায় কী বলা হল? নিরপেক্ষ পত্রিকাটি তার বক্তব্য ছাঁটকাট করে ছেপেছে, তোমাদের লিখিত পরীক্ষায় ভালো করতে হব। তারপরে আমরা দেখব। ছাত্রছাত্রীরা লিখিত পরীক্ষা দিলেই আমরা দেখব। অর্থাৎ তাদের চাকরির ব্যবস্থা হয়ে যাবে! বক্তব্য এমনভাবে টুয়িস্ট করা কি অসৎ সাংবাদিকতা নয়? লক্ষণীয় নিরপেক্ষ দৈনিকটির খবর ভাষ্যের শেষের দিকে আমি প্রয়োজনে কোচিং ক্লাস নিতে রাজি আছি কথাটি বলা আছে। কিন্তু কথাটি এমন অসংলগ্নভাবে বসানো হয়েছে, তার প্রকৃত অর্থ বোঝা সচেতন পাঠকের পক্ষেও কষ্টকর। যেমন খবর ভাষ্যে বলা হয়েছে, তোমাদের মধ্য থেকে যারা প্রতিষ্ঠিত হতে চাও, আমি প্রয়োজনে কোচিং ক্লাস নিতে রাজি আছি। কোচিং ক্লাস করার কথা বলা হয়েছিল ভাইভা পরীক্ষা সম্পর্কে। নিরপেক্ষ পত্রিকাটি এই বক্তব্যেও অসংলগ্নতা সৃষ্টি করে পাঠকদের বিভ্রান্ত করতে চেয়েছে।
অসৎ সাংবাদিকতা কতটা নিুগামী হতে পারে, তার প্রমাণ পাওয়া যায় এইচটি ইমামের নির্বাচন সংক্রান্ত বক্তব্যের বিকৃত ভাষ্য প্রচারের মধ্যে। শুধু তার বক্তব্যকে বিকৃত করা নয়, তার মধ্যে অসংলগ্নতাও তৈরি করা হয়েছে। এইচটি ইমাম বলেছেন, বিএনপি শুধু যে আলোচনায় আসেনি বা নির্বাচন বয়কট করেছে তা নয়, তারা নির্বাচন প্রতিরোধ করার নামে যে ধ্বংসযজ্ঞ, যে নিষ্ঠুরতা ২০১৩ সালে পুরো বছর করেছে তার কোনো নজির নেই। তারা জামায়াতকে নিয়ে রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছিল। নির্বাচনের সময়ের প্রত্যেকটি উপজেলায় কথা বলছি। পুলিশ প্রশাসনের ভূমিকা দেখেছি। আমাদের যারা রিক্রুটেড, তাদের দ্বারা মোবাইল কোর্ট করিয়ে নির্বাচন করেছি। আমাদের যে ১৯ জন পুলিশ ভাই প্রাণ দিয়েছে জামায়াত-শিবিরের আক্রমণে, তারা কারা? সব আমাদের মানুষ। এই বক্তব্য দ্বারা কি স্বীকার করা হল, সরকার নির্বাচনে হস্তক্ষেপ করেছেন বা তাতে অনিয়ম করেছেন? এটা তো নিরপেক্ষ পত্রিকাটির এবং তাদের সুশীল সমাজের প্রচারণা। নির্বাচন কমিশনার আবদুল মোবারক স্পষ্টই বলেছেন, নির্বাচন পরিচালনা করেছে নির্বাচন কমিশন। আইন-শৃংখলা বাহিনী নির্বাচন কমিশনের আওতায় কাজ করেছে। তথাপি নিরক্ষেপ দৈনিকটির ভাষ্য, ৫ জানুয়ারির একতরফা নির্বাচন নিয়ে মানুষের ধারণা এতদিন অনুমাননির্ভর ছিল। এখন এইচটি ইমাম তা খোলাসা করে দিয়েছেন।
উদোর পিণ্ডি বুধোর ঘাড়ে দেয়া আর কাকে বলে? এইচটি ইমাম বলেছেন, নির্বাচন প্রতিহত করতে জামায়াত-শিবিরের যে সশস্ত্র গুণ্ডামি আরম্ভ হয়েছিল তা মোকাবেলা করার কথা। বলেছেন এই মোকাবেলায় যেসব পুলিশ প্রাণ দিয়েছেন তাদের কথা। পশ্চিমবঙ্গে একবার রাজ্য নির্বাচনের সময় মাওবাদীরা কয়েকটি নির্বাচন কেন্দ্রে সশস্ত্র হামলা চালায়। সিপিএম সরকারের সমর্থক ক্যাডার বাহিনী একদল পুলিশের সহায়তায় এই হামলা প্রতিরোধ করে। মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসু এই পুলিশদের সাহসিকতার প্রশংসা করে তাদের আমাদের লোক বলে উল্লেখ করেছিলেন। নির্বাচন কমিশন তো তাদের দায়িত্ব পালন করছিলেনই, তাদের শান্তি রক্ষার কাজে সহায়তা দানের জন্য জ্যোতি বসু এই বিশেষ ব্যবস্থা করেছিলেন। তাতে কেউ বলেনি বামফ্রন্ট সরকার নির্বাচনে অনিয়ম করেছে বা হস্তক্ষেপ করেছে।
এসব প্রচারণা উপলক্ষ মাত্র। আসল লক্ষ্য শেখ হাসিনা। ভালো হোক আর মন্দ হোক, যেসব সহযোগীর পরামর্শ ও বিচক্ষণতার ওপর নির্ভর করে হাসিনা সরকার টিকে আছে তাদের মধ্যে এইচটি ইমাম একজন। এদের বিতর্কিত করে সরানো গেলে প্রধানমন্ত্রী দুর্বল হবেন, তার পতন ঘটানো সহজ হবে এটাই এই চায়ের কাপে তুফান তোলার লক্ষ্য। এইচটি ইমামের বিরুদ্ধে বাজারে অনেক অভিযোগ আছে। সেই অভিযোগের সত্যতার প্রমাণ পেলে তার ভিত্তিতে তাকে তার পদ থেকে অপসারণের দাবি তোলা যেতে পারে। তা না করে তার বক্তব্যকে বিকৃত করে যারা আপাতত তাকে আক্রমণের টার্গেট করেছে তাদের আসল টার্গেট শেখ হাসিনা।
এই খেলা আমরা ভারতেও দেখেছি। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর দুই প্রভাবশালী উপদেষ্টা ছিলেন পিএন হাকসার এবং ডিপি ধর। তারাও ছিলেন আমলা। তবে কংগ্রেসের অনেক রাজনৈতিক নেতার চেয়ে প্রজ্ঞাবান ও দূরদর্শী ছিলেন। ইন্দিরা গান্ধী তাদের পরামর্শের ওপর নির্ভরশীল ছিলেন। কংগ্রেসের ভেতরে ও বাইরে যারা ইন্দিরাবিরোধী ছিলেন, তারা ইন্দিরাকে ঘায়েল করতে না পেরে পিএন হাকসার ও ডিপি ধরের বিরুদ্ধে প্রথমে প্রচারণায় নামেন। এ দুজনের সঙ্গেই ইন্দিরা গান্ধীর ভুল বোঝাবুঝি সৃষ্টি করেন। ভুল বোঝাবুঝি এমন পর্যায়ে গিয়েছিল যে, হাকসারের সঙ্গে ইন্দিরা গান্ধী মুখ দেখাদেখি বন্ধ করে দেন। ডিপি ধরের মৃত্যু ঘটে আকস্মিক হৃদরোগে। পিএন হাকসার চাকরি ছেড়ে দেন। ইন্দিরা গান্ধী সম্পূর্ণ একা ও অসহায় হয়ে পড়েন। তাকে নির্বাচনে পরাজিত করে ক্ষমতা থেকে সরাতে বিরোধী শিবিরের আর কোনো অসুবিধা হয়নি। বাংলাদেশেও এখন এই একই ধরনের হাসিনাবিরোধী চক্রান্ত শুরু হয়েছে। এই চক্রান্ত শুধু আওয়ামী লীগের বাইরে নয়, ভেতরেও রয়েছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার এ সম্পর্কে সজাগ ও সতর্ক থাকা দরকার। এইচটি ইমামের বক্তব্যকে টুয়িস্ট করে চায়ের কাপে যে ঝড় তোলা হয়েছে, তার লক্ষ্য অদূর ভবিষ্যতে আসল ঝড় সৃষ্টি করা- তার টার্গেট হবেন শেখ হাসিনা। সময় থাকতে প্রধানমন্ত্রীর শক্ত অবস্থান গ্রহণ করা প্রয়োজন।
No comments