নয় মাসে খেলাপি ঋণ বেড়েছে ১৭ হাজার কোটি টাকা
চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত- নয় মাসে দেশের ব্যাংকিং খাতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ বেড়েছে প্রায় ১৭ হাজার কোটি টাকা। ওই সময়ে বিতরণ করা মোট ঋণের মধ্যে ১১ দশমিক ৬০ শতাংশই খেলাপিতে পরিণত হয়েছে। গত সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ব্যাংকিং খাতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৫৭ হাজার ৩০০ কোটি টাকা। গত ডিসেম্বরে এর পরিমাণ ছিল ৪০ হাজার ৫৮৩ কোটি টাকা। ওই সময়ে মোট বিতরণ করা ঋণের ৯ শতাংশ খেলাপি ছিল। ওই নয় মাসে ব্যাংকিং খাতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ও শতকরা হার দুই ভাবেই বেড়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের এক প্রতিবেদন থেকে এ তথ্য পাওয়া গেছে। সূত্র জানায়, রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে ব্যবসায়ীক মন্দায় অনেক ব্যবসায়ীর ঋণ পরিশোধের সক্ষমতা কমে যাওয়ায় ঋণের কিস্তি পরিশোধ কমে গেছে, জাল-জালিয়াতির পরিমাণ বেড়ে যাওয়ার কারণে ওইসব ঋণ খেলাপি হয়ে পড়েছে। ফলে ওই সময়ে দেশের ব্যাংকিং খাতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ বেড়েছে।
এ বিষয়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক অর্থ উপদেষ্টা ড. এবি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেছেন, ব্যাংকের খেলাপি ঋণ বাড়লে মুনাফা কমে যায়। এতে সামগ্রিকভাবে এ খাতের জন্য চ্যালেঞ্জ তৈরি হয়। আর ব্যাংকগুলো আয় বাড়াতে গ্রাহকের ওপর সার্ভিস চার্জ আরোপ করে, ঋণের সুদের হার বাড়িয়ে দেয়। খেলাপি ঋণ কমলে গ্রাহকরা স্বল্প সুদে ঋণ পাওয়ার সুযোগ তৈরি হয়।
এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ যুগান্তরকে বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংক রাজনৈতিক বিবেচনায় পুনঃতফসিলের সুযোগ দেয়ায় ঢালাওভাবে সবাই সুবিধা নিচ্ছে। ফলে খেলাপি ঋণের পরিমাণ অনেক কমেছে। তা না হলে এর পরিমাণ আরও বেড়ে যেত।
তিনি বলেন, রাজনৈতিক প্রভাবের কারণে কিছু ব্যবসায়ী ঋণ পরিশোধ করছে না। সার্বিকভাবে ব্যবসায়ীদের ঋণ পরিশোধের ব্যাপারে সক্ষমতাও বাড়েনি। কারণ ব্যবসা বাণিজ্যের অবস্থা এখন ভালো হয়নি। বিষয়গুলো বিবেচনা করে খেলাপি ঋণ আদায়ে ব্যাংকগুলোকে দ্রুত ব্যবস্থা নিতে হবে। তা না হলে খেলাপি ঋণের পরিমাণ আরও বেড়ে যাবে বলে আশংকা প্রকাশ করেছেন তিনি।
বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদনে দেখা যায়, গত জুন পর্যন্ত খেলাপি ঋণের মধ্যে অবলোপনের পরিমাণ ৩১ হাজার ৪৩৯ কোটি টাকা। খেলাপি ঋণের সঙ্গে অবলোপনের পরিমাণ মিলিয়ে খেলাপি ঋণের মোট পরিমাণ আরও বেড়ে দাঁড়ায় প্রায় ৮৮ হাজার কোটি টাকার বেশি। আলোচ্য সময়ে ব্যাংকিং খাতে মোট ঋণের স্থিতি ৪ লাখ ৯৩ হাজার কোটি টাকা। কিন্তু ৩ মাস আগে জুন শেষে মোট ঋণের পরিমাণ ছিল ৪ লাখ ৭৭ হাজার ৪৩৭ কোটি টাকা। অর্থাৎ ঋণ যে হারে বেড়েছে, তার চেয়ে বেশি হারে খেলাপি বেড়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদন থেকে দেখা যায়, জানুয়ারি থেকে মার্চ পর্যন্ত সময়ে ব্যাংকিং খাতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ বেড়েছিল ৭ হাজার ৫৮৯ কোটি টাকা। আর জুন পর্যন্ত তা ১০ হাজার ৭৬২ টাকা এবং সেপ্টেম্বর পর্যন্ত তা ১৬ হাজার ৭১৭ কোটি টাকায় উন্নীত হয়েছে।
খেলাপি ঋণ বাড়ার কারণে একদিকে ব্যাংকগুলো ঝুঁকিতে পড়েছে, অন্যদিকে আয় থেকে বাড়তি প্রভিশন রাখতে হচ্ছে। এখন পর্যন্ত আটটি ব্যাংকের ৩ হাজার ৫৪৩ কোটি টাকার প্রভিশন ঘাটতি রয়েছে। মুনাফা থেকে এই প্রভিশন করায় ব্যাংকগুলোর লভ্যাংশ দেয়ার পরিমাণ কমে যাচ্ছে। একই কারণে বেড়ে যাচ্ছে সুদের হার। অথচ ব্যাংকগুলোর পরিচালকদের চাপে রাজনৈতিক বিবেচনায় ঋণ বিতরণ, ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষের দুর্বলতায় খেলাপি ঋণ বাড়ছে, কিন্তু তাদের কিছুই হচ্ছে না। এর দায় পড়ছে ঋণ গ্রহীতা ও শেয়ারহোল্ডারদের ওপর। বাড়ছে আমানতাকীদের ঝুঁকির মাত্রা।
সরকারি ব্যাংক : সরকারি চারটি ব্যাংকে খেলাপি ঋণের পরিমাণ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২০ হাজার ৭৮০ কোটি টাকায়। প্রভিশন ঘাটতির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১ হাজার ১৭৫ কোটি টাকায়। গত ডিসেম্বর শেষে সরকারি চার ব্যাংকের খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল ১৬ হাজার ৬০৬ কোটি টাকা। ওই সময়ে এদের খেলাপি ঋণ বেড়েছে ৪ হাজার কোটি টাকার বেশি। এর মধ্যে সোনালী ব্যাংকের খেলাপি ঋণ ১০ হাজার ৯৫০ কোটি, জনতা ব্যাংকের ৩ হাজার ৯৩১ কোটি, অগ্রণী ব্যাংকের ৪ হাজার ১৮৫ কোটি এবং রূপালী ব্যাংকের ১ হাজার ৭৩১ কোটি টাকা।
খেলাপি ঋণ বৃদ্ধির প্রসঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ যুগান্তরকে বলেন, সাম্প্রতিক সময়ে খেলাপি ঋণ বেশি মাত্রায় বেড়েছে। এটি উদ্বেগজনক। তার মতে, তিন কারণে খেলাপি ঋণ বাড়ছে। এরমধ্যে রয়েছে- সরকারি ব্যাংকে সরকার এবং বেসরকারি ব্যাংক মালিকদের চাপে ব্যাংকগুলো অসৎ ব্যবসায়ীদের ঋণ দিতে বাধ্য হচ্ছে। মালিক পক্ষের কথা না শুনলে এমডি ও শীর্ষ কর্মকর্তাদের চাকরি চলে যায়। তিনি বলেন, হলমার্ক কেলেংকারিতে জড়িতদের কীভাবে সরকার দায় মুক্তি দেয়ার চেষ্টা করছে। এটি গ্রহণযোগ্য নয়। আর ব্যাংকের মালিকরা কোনো নিয়মের তোয়াক্কা করে না। দ্বিতীয়ত, ব্যাংকারদের মধ্যে পেশাদারিত্বের মান কমে গেছে। তৃতীয়ত, তাদের মধ্যে সততা এবং নৈতিকতার অভাব রয়েছে।
বেসরকারি ব্যাংকগুলোতে গত ডিসেম্বর শেষে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল ১৪ হাজার ৩১৫ কোটি টাকা- যা ওই সময়ে বিতরণ করা মোট ঋণের ৪ দশমিক ৫৪ শতাংশ। গত সেপ্টেম্বর শেষে এর পরিমাণ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২২ হাজার ১৯৩ কোটি টাকা- যা মোট ঋণের ৬ দশমিক ৩৪ শতাংশ। ওই সময়ে বেসরকারি ব্যাংকগুলোতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ বেড়েছে প্রায় ৮ হাজার কোটি টাকা।
বেসরকারি ব্যাংকগুলোর মধ্যে এবি ব্যাংকের খেলাপি ঋণ ৪৫৭ কোটি, আল-আরাফাহ্ ইসলামী ব্যাংকের ৬৪৩ কোটি, বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংকের ২৫৪ কোটি, ব্যাংক এশিয়ার ৮৯৫ কোটি, ব্র্যাক ব্যাংকের ৮১২ কোটি, ঢাকা ব্যাংকের ৮২০ কোটি, ডাচ্-বাংলা ব্যাংকের ৪৫২ কোটি, ইস্টার্ন ব্যাংকের ৬৫২ কোটি টাকা। বেসরকারি এক্সিম ব্যাংকের ৪৭১ কোটি, ফার্স্ট সিকিউরিটি ব্যাংকের ৩২৮ কোটি, আইসিবি ইসলামী ব্যাংকের ৭৪৪ কোটি, আইএফআইসি ব্যাংকের ৫২৯ কোটি, ইসলামী ব্যাংকের ২ হাজার ৮৬৯ কোটি, যমুনা ব্যাংকের ৫৩৮ কোটি, মার্কেন্টাইল ব্যাংকের ৬৩০ কোটি, মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের ৩১৬ কোটি, ন্যাশনাল ব্যাংকের ৯৬২ কোটি, ন্যাশনাল ক্রেডিট অ্যান্ড কমার্স ব্যাংকের ৮২৪ কোটি, ওয়ান ব্যাংকের ৪৬২ কোটি, প্রিমিয়ার ব্যাংকের ৮৩০ কোটি, প্রাইম ব্যাংকের ১ হাজার ২৬৭ কোটি টাকা খেলাপি ঋণ রয়েছে। বেসরকারি ব্যাংকের মধ্যে পূবালী ব্যাংকের ৯৬০ কোটি, শাহ্জালাল ইসলামী ব্যাংকের ৬৩৩ কোটি, সোস্যাল ইসলামী ব্যাংকের ৪৬৮ কোটি, সাউথইস্ট ব্যাংকের ৭৬৪ কোটি, স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংকের ৮১৫ কোটি, সিটি ব্যাংকের ৬৫৯ কোটি, ট্রাস্ট ব্যাংকের ২৯৬ কোটি, ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংকের ১ হাজার ৭৫ কোটি এবং উত্তরা ব্যাংকের ৭২০ কোটি টাকা খেলাপি ঋণ রয়েছে।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক মাহফুজুর রহমান যুগান্তরকে বলেন, খেলাপি ঋণ সব সময় এক রকম থাকে না। কখনও বাড়ে, আবার কখনও কমে। তবে এখনও তা নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়নি। আমরা ঋণ আদায় বাড়িয়ে খেলাপি ঋণ কমিয়ে আনার চেষ্টা করছি। তিনি বলেন, সার্বিকভাবে দেশের অর্থনীতি ভালো হচ্ছে, এটাই আমাদের জন্য সুখবর। ফলে খেলাপি ঋণের মাত্রাও কমে যাবে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদন থেকে দেখা যায়, বিশেষায়িত ব্যাংকগুলোতে নয় মাসে খেলাপি ঋণ বেড়েছে প্রায় সাড়ে চার হাজার কোটি টাকা। গত ডিসেম্বর শেষে এদের খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল ৮ হাজার ৩৫৭ কোটি টাকা- যা মোট ঋণের ২৬ দশমিক ৭৮ শতাংশ। সেপ্টেম্বরে তা বেড়ে হয়েছে ১২ হাজার ৬৬১ কোটি টাকা, যা মোট ঋণের প্রায় ৩৮ শতাংশ।
এর মধ্যে বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংকের ৪৯১ কোটি, বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংকের ৪ হাজার ৫৬৮ কোটি, বেসিক ব্যাংকের ৬ হাজার ১৪৮ কোটি এবং রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংকের ১ হাজার ৪৬১ কোটি টাকা খেলাপি ঋণ রয়েছে।
বিদেশী ব্যাংকগুলোর মধ্যে ব্যাংক আল ফালাহর ৬১ কোটি, সিটি ব্যাংক এনএর ২২ কোটি, কমার্স ব্যাংক অব সিলোনের ২২ কোটি, হাবিব ব্যাংকের ৬৩ কোটি, হংকং অ্যান্ড সাংহাই ব্যাংকিং কর্পোরেশনের ১৩৭ কোটি, ন্যাশনাল ব্যাংক অব পাকিস্তানের ৬৪৬ কোটি, স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাংকের ৫৮৩ কোটি, স্টেট ব্যাংক অব ইন্ডিয়ার ৮৮ কোটি এবং উরি ব্যাংকের ১৫ কোটি টাকা খেলাপি ঋণ রয়েছে। দেশের ৮টি ব্যাংকের প্রভিশন ঘাটতি রয়েছে। এর মধ্যে সরকারি খাতের সোনালী ব্যাংকের ১ হাজার ৮৬ কোটি, রূপালী ব্যাংকের ১০০ কোটি টাকা। বেসরকারি খাতের বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংকের ৫১ কোটি, ন্যাশনাল ব্যাংকের ৫৩ কোটি, স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংকের ১২০ কোটি টাকা। বিদেশী ন্যাশনাল ব্যাংক অব পাকিস্তানের ৩১৬ কোটি টাকা। বিশেষায়িত বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংকের ১ হাজার ৫৮১ কোটি এবং রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংকের ২৩৫ কোটি টাকা।
এ বিষয়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক অর্থ উপদেষ্টা ড. এবি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেছেন, ব্যাংকের খেলাপি ঋণ বাড়লে মুনাফা কমে যায়। এতে সামগ্রিকভাবে এ খাতের জন্য চ্যালেঞ্জ তৈরি হয়। আর ব্যাংকগুলো আয় বাড়াতে গ্রাহকের ওপর সার্ভিস চার্জ আরোপ করে, ঋণের সুদের হার বাড়িয়ে দেয়। খেলাপি ঋণ কমলে গ্রাহকরা স্বল্প সুদে ঋণ পাওয়ার সুযোগ তৈরি হয়।
এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ যুগান্তরকে বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংক রাজনৈতিক বিবেচনায় পুনঃতফসিলের সুযোগ দেয়ায় ঢালাওভাবে সবাই সুবিধা নিচ্ছে। ফলে খেলাপি ঋণের পরিমাণ অনেক কমেছে। তা না হলে এর পরিমাণ আরও বেড়ে যেত।
তিনি বলেন, রাজনৈতিক প্রভাবের কারণে কিছু ব্যবসায়ী ঋণ পরিশোধ করছে না। সার্বিকভাবে ব্যবসায়ীদের ঋণ পরিশোধের ব্যাপারে সক্ষমতাও বাড়েনি। কারণ ব্যবসা বাণিজ্যের অবস্থা এখন ভালো হয়নি। বিষয়গুলো বিবেচনা করে খেলাপি ঋণ আদায়ে ব্যাংকগুলোকে দ্রুত ব্যবস্থা নিতে হবে। তা না হলে খেলাপি ঋণের পরিমাণ আরও বেড়ে যাবে বলে আশংকা প্রকাশ করেছেন তিনি।
বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদনে দেখা যায়, গত জুন পর্যন্ত খেলাপি ঋণের মধ্যে অবলোপনের পরিমাণ ৩১ হাজার ৪৩৯ কোটি টাকা। খেলাপি ঋণের সঙ্গে অবলোপনের পরিমাণ মিলিয়ে খেলাপি ঋণের মোট পরিমাণ আরও বেড়ে দাঁড়ায় প্রায় ৮৮ হাজার কোটি টাকার বেশি। আলোচ্য সময়ে ব্যাংকিং খাতে মোট ঋণের স্থিতি ৪ লাখ ৯৩ হাজার কোটি টাকা। কিন্তু ৩ মাস আগে জুন শেষে মোট ঋণের পরিমাণ ছিল ৪ লাখ ৭৭ হাজার ৪৩৭ কোটি টাকা। অর্থাৎ ঋণ যে হারে বেড়েছে, তার চেয়ে বেশি হারে খেলাপি বেড়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদন থেকে দেখা যায়, জানুয়ারি থেকে মার্চ পর্যন্ত সময়ে ব্যাংকিং খাতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ বেড়েছিল ৭ হাজার ৫৮৯ কোটি টাকা। আর জুন পর্যন্ত তা ১০ হাজার ৭৬২ টাকা এবং সেপ্টেম্বর পর্যন্ত তা ১৬ হাজার ৭১৭ কোটি টাকায় উন্নীত হয়েছে।
খেলাপি ঋণ বাড়ার কারণে একদিকে ব্যাংকগুলো ঝুঁকিতে পড়েছে, অন্যদিকে আয় থেকে বাড়তি প্রভিশন রাখতে হচ্ছে। এখন পর্যন্ত আটটি ব্যাংকের ৩ হাজার ৫৪৩ কোটি টাকার প্রভিশন ঘাটতি রয়েছে। মুনাফা থেকে এই প্রভিশন করায় ব্যাংকগুলোর লভ্যাংশ দেয়ার পরিমাণ কমে যাচ্ছে। একই কারণে বেড়ে যাচ্ছে সুদের হার। অথচ ব্যাংকগুলোর পরিচালকদের চাপে রাজনৈতিক বিবেচনায় ঋণ বিতরণ, ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষের দুর্বলতায় খেলাপি ঋণ বাড়ছে, কিন্তু তাদের কিছুই হচ্ছে না। এর দায় পড়ছে ঋণ গ্রহীতা ও শেয়ারহোল্ডারদের ওপর। বাড়ছে আমানতাকীদের ঝুঁকির মাত্রা।
সরকারি ব্যাংক : সরকারি চারটি ব্যাংকে খেলাপি ঋণের পরিমাণ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২০ হাজার ৭৮০ কোটি টাকায়। প্রভিশন ঘাটতির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১ হাজার ১৭৫ কোটি টাকায়। গত ডিসেম্বর শেষে সরকারি চার ব্যাংকের খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল ১৬ হাজার ৬০৬ কোটি টাকা। ওই সময়ে এদের খেলাপি ঋণ বেড়েছে ৪ হাজার কোটি টাকার বেশি। এর মধ্যে সোনালী ব্যাংকের খেলাপি ঋণ ১০ হাজার ৯৫০ কোটি, জনতা ব্যাংকের ৩ হাজার ৯৩১ কোটি, অগ্রণী ব্যাংকের ৪ হাজার ১৮৫ কোটি এবং রূপালী ব্যাংকের ১ হাজার ৭৩১ কোটি টাকা।
খেলাপি ঋণ বৃদ্ধির প্রসঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ যুগান্তরকে বলেন, সাম্প্রতিক সময়ে খেলাপি ঋণ বেশি মাত্রায় বেড়েছে। এটি উদ্বেগজনক। তার মতে, তিন কারণে খেলাপি ঋণ বাড়ছে। এরমধ্যে রয়েছে- সরকারি ব্যাংকে সরকার এবং বেসরকারি ব্যাংক মালিকদের চাপে ব্যাংকগুলো অসৎ ব্যবসায়ীদের ঋণ দিতে বাধ্য হচ্ছে। মালিক পক্ষের কথা না শুনলে এমডি ও শীর্ষ কর্মকর্তাদের চাকরি চলে যায়। তিনি বলেন, হলমার্ক কেলেংকারিতে জড়িতদের কীভাবে সরকার দায় মুক্তি দেয়ার চেষ্টা করছে। এটি গ্রহণযোগ্য নয়। আর ব্যাংকের মালিকরা কোনো নিয়মের তোয়াক্কা করে না। দ্বিতীয়ত, ব্যাংকারদের মধ্যে পেশাদারিত্বের মান কমে গেছে। তৃতীয়ত, তাদের মধ্যে সততা এবং নৈতিকতার অভাব রয়েছে।
বেসরকারি ব্যাংকগুলোতে গত ডিসেম্বর শেষে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল ১৪ হাজার ৩১৫ কোটি টাকা- যা ওই সময়ে বিতরণ করা মোট ঋণের ৪ দশমিক ৫৪ শতাংশ। গত সেপ্টেম্বর শেষে এর পরিমাণ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২২ হাজার ১৯৩ কোটি টাকা- যা মোট ঋণের ৬ দশমিক ৩৪ শতাংশ। ওই সময়ে বেসরকারি ব্যাংকগুলোতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ বেড়েছে প্রায় ৮ হাজার কোটি টাকা।
বেসরকারি ব্যাংকগুলোর মধ্যে এবি ব্যাংকের খেলাপি ঋণ ৪৫৭ কোটি, আল-আরাফাহ্ ইসলামী ব্যাংকের ৬৪৩ কোটি, বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংকের ২৫৪ কোটি, ব্যাংক এশিয়ার ৮৯৫ কোটি, ব্র্যাক ব্যাংকের ৮১২ কোটি, ঢাকা ব্যাংকের ৮২০ কোটি, ডাচ্-বাংলা ব্যাংকের ৪৫২ কোটি, ইস্টার্ন ব্যাংকের ৬৫২ কোটি টাকা। বেসরকারি এক্সিম ব্যাংকের ৪৭১ কোটি, ফার্স্ট সিকিউরিটি ব্যাংকের ৩২৮ কোটি, আইসিবি ইসলামী ব্যাংকের ৭৪৪ কোটি, আইএফআইসি ব্যাংকের ৫২৯ কোটি, ইসলামী ব্যাংকের ২ হাজার ৮৬৯ কোটি, যমুনা ব্যাংকের ৫৩৮ কোটি, মার্কেন্টাইল ব্যাংকের ৬৩০ কোটি, মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের ৩১৬ কোটি, ন্যাশনাল ব্যাংকের ৯৬২ কোটি, ন্যাশনাল ক্রেডিট অ্যান্ড কমার্স ব্যাংকের ৮২৪ কোটি, ওয়ান ব্যাংকের ৪৬২ কোটি, প্রিমিয়ার ব্যাংকের ৮৩০ কোটি, প্রাইম ব্যাংকের ১ হাজার ২৬৭ কোটি টাকা খেলাপি ঋণ রয়েছে। বেসরকারি ব্যাংকের মধ্যে পূবালী ব্যাংকের ৯৬০ কোটি, শাহ্জালাল ইসলামী ব্যাংকের ৬৩৩ কোটি, সোস্যাল ইসলামী ব্যাংকের ৪৬৮ কোটি, সাউথইস্ট ব্যাংকের ৭৬৪ কোটি, স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংকের ৮১৫ কোটি, সিটি ব্যাংকের ৬৫৯ কোটি, ট্রাস্ট ব্যাংকের ২৯৬ কোটি, ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংকের ১ হাজার ৭৫ কোটি এবং উত্তরা ব্যাংকের ৭২০ কোটি টাকা খেলাপি ঋণ রয়েছে।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক মাহফুজুর রহমান যুগান্তরকে বলেন, খেলাপি ঋণ সব সময় এক রকম থাকে না। কখনও বাড়ে, আবার কখনও কমে। তবে এখনও তা নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়নি। আমরা ঋণ আদায় বাড়িয়ে খেলাপি ঋণ কমিয়ে আনার চেষ্টা করছি। তিনি বলেন, সার্বিকভাবে দেশের অর্থনীতি ভালো হচ্ছে, এটাই আমাদের জন্য সুখবর। ফলে খেলাপি ঋণের মাত্রাও কমে যাবে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদন থেকে দেখা যায়, বিশেষায়িত ব্যাংকগুলোতে নয় মাসে খেলাপি ঋণ বেড়েছে প্রায় সাড়ে চার হাজার কোটি টাকা। গত ডিসেম্বর শেষে এদের খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল ৮ হাজার ৩৫৭ কোটি টাকা- যা মোট ঋণের ২৬ দশমিক ৭৮ শতাংশ। সেপ্টেম্বরে তা বেড়ে হয়েছে ১২ হাজার ৬৬১ কোটি টাকা, যা মোট ঋণের প্রায় ৩৮ শতাংশ।
এর মধ্যে বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংকের ৪৯১ কোটি, বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংকের ৪ হাজার ৫৬৮ কোটি, বেসিক ব্যাংকের ৬ হাজার ১৪৮ কোটি এবং রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংকের ১ হাজার ৪৬১ কোটি টাকা খেলাপি ঋণ রয়েছে।
বিদেশী ব্যাংকগুলোর মধ্যে ব্যাংক আল ফালাহর ৬১ কোটি, সিটি ব্যাংক এনএর ২২ কোটি, কমার্স ব্যাংক অব সিলোনের ২২ কোটি, হাবিব ব্যাংকের ৬৩ কোটি, হংকং অ্যান্ড সাংহাই ব্যাংকিং কর্পোরেশনের ১৩৭ কোটি, ন্যাশনাল ব্যাংক অব পাকিস্তানের ৬৪৬ কোটি, স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাংকের ৫৮৩ কোটি, স্টেট ব্যাংক অব ইন্ডিয়ার ৮৮ কোটি এবং উরি ব্যাংকের ১৫ কোটি টাকা খেলাপি ঋণ রয়েছে। দেশের ৮টি ব্যাংকের প্রভিশন ঘাটতি রয়েছে। এর মধ্যে সরকারি খাতের সোনালী ব্যাংকের ১ হাজার ৮৬ কোটি, রূপালী ব্যাংকের ১০০ কোটি টাকা। বেসরকারি খাতের বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংকের ৫১ কোটি, ন্যাশনাল ব্যাংকের ৫৩ কোটি, স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংকের ১২০ কোটি টাকা। বিদেশী ন্যাশনাল ব্যাংক অব পাকিস্তানের ৩১৬ কোটি টাকা। বিশেষায়িত বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংকের ১ হাজার ৫৮১ কোটি এবং রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংকের ২৩৫ কোটি টাকা।
No comments