থানাই দোহারের কোর্ট কাচারি!
দোহার থানা যেন বিকল্প কোর্ট কাচারি। জমিসংক্রান্ত বিরোধের ঘটনা পেলেই ‘আকাশের চাঁদ’ হাতে পেয়ে যান ওসি মাহমুদুল হক। নোটিশের নামে রীতিমতো ‘সমন’ দিয়ে অথবা দারোগা পাঠিয়ে ডেকে নিয়ে আসেন বিবাদীদের। দু’পক্ষকে থানায় বসিয়ে মর্জিমাফিক ফয়সালা করেন ওসি। যে পক্ষ বেশি ঘুষ দিতে পারবে রায় নিশ্চিতভাবে তার পক্ষে। কোনো পক্ষ ওসির ফয়সালা মানতে না চাইলে তার জন্য আছে পেন্ডিং মামলায় গ্রেফতার দেখিয়ে রিমান্ডে নিয়ে নির্যাতনের খড়গ। এ ধরনের অসংখ্য অভিযোগ দোহারবাসীর। দোহারের একজন ইউপি চেয়ারম্যান প্রশ্ন করে বলেন, ‘দোহার থানা কি বিকল্প আদালত? দোহার থানায় রীতিমতো কোর্ট কাচারির কাজও হয়! থানায় ওসির নেতৃত্বে বসে এজলাশ। এসআইদের পাঠিয়ে অভিযুক্তদের ধরে নিয়ে আসা হয়। করা হয় জরিমানা। গ্রামের নিরীহ, অক্ষরজ্ঞানহীন সহজ-সরল মানুষ পুলিশের অত্যাচারে জর্জরিত। হয়রানি ও নির্যাতনের ভয়ে তারা ওসির সিদ্ধান্ত মেনে নিতে বাধ্য হন।’খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ওসি ও তার দালালদের সিদ্ধান্ত না মানায় নির্যাতন নেমে আসে মাহমুদপুর ইউনিয়নের সংরক্ষিত আসনের মহিলা মেম্বার হেলেনা ও তার পরিবারের ওপর। এখন তার স্বামী দেলোয়ার হোসেন পেন্ডিং মামলায় জেল খাটছেন। এ ছাড়াও এলাকার বহু ভুক্তভোগী থানায় ডেকে নিয়ে জমির মামলা ফয়সালা করার নামে তাদের হয়রানি করার কথা জানিয়েছেন। কিন্তু সঙ্গতকারণেই তারা নাম প্রকাশ করতে চাননি।দোহারের একজন গণমাধ্যমকর্মী জানান, জমি-জমার ঝামেলা ও বিরোধ মীমাংসার জন্য ওসি নোটিশ পাঠিয়ে থানায় ডেকে নিয়েছেন এরকম অসংখ্য উদাহরণ আছে। অনেকেই অহেতুক ঝামেলার কথা ভেবে এগুলো প্রকাশ করতে চান না। ওসির নোটিশ পেলেই মানুষ দৌড়ে থানায় যান। ‘বিচার’ করার জন্য ওসির পাঠানো এরকম কয়েকটি নোটিশ যুগান্তরের হাতে এসেছে।গত ২৫ অক্টোবর দোহার থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেন ইসলামপুর গ্রামের তাহের শেখের ছেলে শেখ গিয়াস উদ্দিন। ওই জিডির পর ফৌজদারি কার্যবিধির ১৬০ ধারা ব্যবহার করে ওসির নির্দেশে দোহার থানার এসআই আবদুল কাদের আমিরপুর গ্রামের শেখ মো. মাজেদের স্ত্রী মর্জিনা বেগম, নবাবগঞ্জের কাশিমপুর গ্রামের শামীমের স্ত্রী মুক্তার আক্তার, ইসলামপুর জয়পাড়ার আমির উদ্দিনের ছেলে শেখ বাবুল, হাসমত আলীর ছেলে খন্দকার আলমাছ উদ্দিন, খলপাড়া গ্রামের ইমান আলীর ছেলে আমজাদ হোসেনকে নোটিশ পাঠিয়ে থানায় ডেকে আনেন। দুই পক্ষকে জিজ্ঞাসাবাদের নামে কয়েক দফা থানায় ডেকে নেয়া হয়। না গেলে আইনগত ব্যবস্থা নেয়ার হুমকি দেয়া হয়। পুলিশের নোটিশ পেয়ে ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে তারা থানায় হাজিরা দিতে বাধ্য হন।গত ৩ নভেম্বর ওসি স্বাক্ষরিত নোটিশ পাঠানো হয় সুতারপাড়া গ্রামের হাশেম বেপারিসহ ৩ জনকে। সেখানে প্রথম পক্ষ ছিলেন সিদ্দিক মৃধা। জমির দাগ, খতিয়ান নম্বর উল্লেখ করে ১৫ নভেম্বর দুই পক্ষকে থানায় ডাকেন ওসি। এ ছাড়া রাইপাড়া বালুঘাটা বউবাজার এলাকার একটি পরিবারকে এরকম নোটিশ পাঠান ওসির ঘনিষ্ঠ এসআই আবদুল কাদের। নোটিশে ওই মহিলাকে থানায় হাজির হতে বলা হয়। নোটিশ পাওয়ার পরও ওই গৃহবধূ থানায় না যাওয়ায় এসআই কাদের নিজেই তার বাড়িতে গিয়ে ভয়ভীতি দেখিয়ে থানায় নিয়ে আসেন। পুলিশ বিভিন্নভাবে ভয় দেখিয়ে তাদের কাছ থেকে দুই লাখ টাকা আদায় করেন বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।রাহুগ্রাসে হেলেনা মেম্বারের পরিবার : মাহমুদপুর ইউনিয়ন পরিষদের মহিলা মেম্বার হেলেনা বেগম। ওসির দালাল হিসেবে পরিচিত স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা আইয়ুব আলী ও যুবলীগ নেতা শহীদুল ইসলাম গত ১৪ অক্টোবর তাকে ডেকে বলেন, ‘তুমি তোমার জমি-জমা নাঈমের কাছে বিক্রি করে এলাকা থেকে চলে যাও।’ জমির জন্য শতাংশপ্রতি হেলেনাকে ১০ হাজার টাকা করে দেয়ার প্রস্তাব করেন আইয়ুব আলী। এর বেশি যা বিক্রি করবে তা আইয়ুব আলী ও শহীদুল ভাগ করে নেবে বলে জানান। হেলেনা নিজের ভিটেমাটিসহ জমি বিক্রি করতে রাজি না হওয়ায় গত ১৬ অক্টোবর তাকে মারধর ও ধর্ষণের চেষ্টা করে দুর্বৃত্তরা। গুরুতর আহত অবস্থায় হেলেনা থানায় মামলা করতে যান। ওসি মামলা না নিয়ে তাকে হাসপাতালে ভর্তি হয়ে চিকিৎসা নিতে বলেন। হেলেনা ৬ দিন হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়ে ২২ অক্টোবর থানায় গেলে পুলিশ তার মামলা নিতে চায়নি। উল্টো ওসি তাকে বলেন, মামলা করতে হলে আইয়ুব আলী ও শহীদুলের মাধ্যমে আসতে হবে। অথচ এ অভিযোগের বিবাদী তারাই। এ ছাড়া হেলেনার কাছে জমিসংক্রান্ত বিরোধের মামলা নিতে শতাংশপ্রতি এক হাজার টাকা করে দাবি করেন ওসি। একই সঙ্গে বিবাদীদের সঙ্গে বিরোধ মিটিয়ে হেলেনাকে অন্যত্র চলে যাওয়ার প্রস্তাবও দেন। ওসির নির্দেশ না মানায় হেলেনার স্বামী দেলোয়ার হোসেনকে গ্রেফতার করে যুবদলকর্মী আখ্যা দিয়ে হামলা-ভাংচুরের একটি পেন্ডিং মামলায় আদালতে পাঠানো হয়। মিথ্যা মামলায় দেলোয়ার এখন জেল খাটছেন।হেলেনা ক্ষোভের সঙ্গে বলেন, ‘আমি জনপ্রতিনিধি। এলাকার মানুষ নানান অভিযোগ নিয়ে আমার কাছে আসে। আমি সেগুলোর সালিশ-দরবার করি। আর আমার সঙ্গেই ওসি এ আচরণ করেছে।’ তিনি আরও জানান, তার ওপর হামলা, জমি দখলের চেষ্টার অভিযোগে থানায় মামলা না নেয়ায় তিনি নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালে মামলা করেছেন। মামলা নম্বর ১৫৯। ওসি ওই মামলার সাক্ষীদেরও চাঁদাবাজির মিথ্যা মামলায় জড়িয়ে হয়রানি করছেন। এর মধ্যে একজনকে গ্রেফতারও করেছেন। হেলেনা বলেন, ‘ওসি মাহমুদুল হকের কারণে দোহার এলাকায় আইনশৃংখলা বলতে কিছু নেই। মাহমুদপুর ইউনিয়নে ওসির দালাল আইয়ুব আলী ও শহীদুল। তাদের নির্দেশে লোকজনকে ধরা হয় আবার ছাড়া হয়। তাদের কথা না শুনলেই বিপদ। আমি ইউপি মেম্বার হওয়া সত্ত্বেও আমাকে বাড়ি ছেড়ে চলে যেতে বলেছে। আমার এ অবস্থা হলে সাধারণ মানুষের কি হবে?’প্রবাসীর কান্না : নারিশার চৈতাপাথর এলাকার প্রবাসী ও আইটি ইঞ্জিনিয়ার শহীদুল ইসলাম জানান, তিনি ২০ বছর ধরে সৌদি আরবে অবস্থান করছেন। চৈতাপাথর এলাকায় স্থায়ী লিজ নেয়া ২৭ শতাংশ জমি আছে তার। থানা পুলিশকে ম্যানেজ করে স্থানীয় রজ্জব আলী মোল্লা, কালাম ডাক্তার ও তার ভাগ্নে মতিয়ার রহমান মতিসহ কয়েকজন তার জমি জবরদখল করার চেষ্টা করেন। এ নিয়ে আদালতে মামলাও হয়েছে। ওসি মাহমুদুল হক ও থানার সেকেন্ড অফিসারের দায়িত্বপ্রাপ্ত দারোগা মো. মালেক খসরুর সহযোগিতায় ওই জমি জবরদখলের চেষ্টা চলছে। দখলদাররা ভুয়া লিজ পেপার তৈরি, ওসি ও সেকেন্ড অফিসারের সহযোগিতায় ওই জমিতে ঘর তোলা ও টিউবওয়েল বসানোর চেষ্টা করে। যদিও এ জমির বিষয়ে আদালতের আদেশে স্থিতাবস্থা জারি রয়েছে।শহীদুল বলেন, তার স্ত্রী ও সন্তানরা গ্রামে থাকে। বড় ছেলে ক্লাস থ্রিতে পড়ে। ছোট ছেলে এখনও স্কুলে যেতে শুরু করেনি। এই প্রবাসীর পরিবারের সদস্যদের জীবন দুর্বিষহ করে রেখেছে থানা পুলিশ। তাদের হয়রানির কারণে তার ভাই এলাকায় ঠিকমতো দোকানদারি করতে পারেন না। শহীদুল কাঁদতে কাঁদতে বলেন, প্রতিনিয়ত গ্রামের বাড়ি থেকে পুলিশি হয়রানির খবর আসে। কাউকে জানিয়েও কোনো প্রতিকার হয়নি। ফলে বিদেশের মাটিতে বসে কান্না ছাড়া আর কিছুই করার থাকে না। দু-একটি নয় একজন ওসি ও তার সহযোগীদের অন্যায়, অবিচারের এরকম অসংখ্য কাহিনী আর ভুক্তভোগীদের হাহাকার এখন দোহারজুড়ে।
No comments