রূপকথার এক প্রেমকাহিনী by হাসনাইন মেহেদী
অস্ট্রেলিয়ার মেলবোর্ন নিবাসী আমিনা হার্ট। অচেনা এক পুরুষের শুক্রাণু ধারণ করে সন্তানের মা হওয়ার স্বপ্ন পূরণ হয়েছে তার। এরপর তার জীবনের ঘটনাপ্রবাহ রূপকথার মতো বললে ভুল হবে না। তিনি খুঁজে পান সেই অচেনা পুরুষকে। এরপরই দু’জন দু’জনার প্রেমে পড়ে যান। আমিনা হার্টের সন্তানের মা হওয়ার দীর্ঘ যাত্রা আর হৃদয়স্পর্শী পুনর্মিলনের ঘটনা উঠে এসেছে ডেইল মেইলের প্রতিবেদনে। এতে বলা হয়, সন্তানের মা হতে চেয়েছিলেন আমিনা। বিরল জেনেটিক ব্যাধিতে তিনি হারান দুই পুত্রসন্তান। কিন্তু দমে যাননি আমিনা। মা হওয়ার তীব্র আকাঙ্ক্ষা লালন করে চেষ্টা অব্যাহত রাখেন। ৪২ বছর বয়সে তিনি শুক্রাণু দাতার সহযোগিতায় সন্তান ধারণের সিদ্ধান্ত নেন। এ সিদ্ধান্তই বদলে দেয় আমিনার জীবন। ফুটফুটে সুস্থ এক কন্যা সন্তানের জন্ম দেন তিনি। অনেক হারানোর বেদনা তাড়িত হওয়ার পর স্বপ্ন সফল হয় তার। সাবেক স্বামীর ঘরে আমিনার প্রথম পুত্র সন্তান মার্লোন মাত্র ৪ মাস বয়সে মারা যায়। এরপর ২০১০-এ আরেক সঙ্গীর ঔরসজাত সন্তান লুইস মারা যায় মাত্র ১৪ মাস বয়সে। আমিনা বলেন, দুই সন্তান হারানোর পীড়া ভাষায় প্রকাশ করার মতো নয়। ২য় সন্তানের অসুস্থতার সময় জেনেটিক সমস্যা ধরা পড়ে। সন্তানের মা হওয়ার তীব্র আকাঙ্ক্ষা পূরণে সম্ভাব্য উপায়গুলো বিবেচনা করতে শুরু করেন তিনি। সিদ্ধান্ত নেন শুক্রাণু দাতার সহযোগিতায় গর্ভধারণের চেষ্টা করবেন। আমিনা জানান, সিদ্ধান্তটা নিতে অনেক সময় লেগেছিল। আমি সবকিছু বিবেচনা করছিলাম- আমার বয়স, সামাজিক মর্যাদা আর মারাত্মক একটি জেনেটিক সমস্যা, যা আমি বয়ে বেড়াচ্ছিলাম। সম্ভাবনা যে খুব জোরালো ছিল না আমি তা জানতাম। শেষবারের মতো চেষ্টা করার সিদ্ধান্ত নিই। আমিনাকে ফার্টিলিটি ক্লিনিক থেকে তিনজন অচেনা শুক্রাণু দাতার প্রয়োজনীয় তথ্য সংবলিত তিনটি কাগজ দেয়া হয়। আমিনা জানতেন না তিনি শুধু তার সন্তানের শুক্রাণু দাতা পিতাকেই না একই সঙ্গে বেছে নিচ্ছিলেন তার ভবিষ্যৎ জীবনসঙ্গীকে। আমিনা বললেন, ওই কাগজে কোন ছবি থাকে না। আক্ষরিক অর্থে লিঙ্কডইন পেজের থেকেও কম তথ্য সংবলিত একটি প্রোফাইল। এতে শুধু শুক্রাণু দাতার শারীরিক সুস্থতা সম্পর্কিত তথ্য, বয়স, শরীরের গড়ন, চুলের রঙ, তার শিশুকালের পছন্দের বিষয়সমূহ আর চাকরির তথ্য ছিল। তিন দাতার মধ্যে আমিনা যাকে বেছে নিয়েছিলেন তিনি নিজেকে খুশি আর মিশুক প্রকৃতির পাশাপাশি পেশাদারী নৈতিকতা সম্পন্ন ব্যক্তি বলে উল্লেখ করেছেন। আমিনা বলেন, এছাড়া শারীরিক অক্ষমতা সংক্রান্ত বিষয়ে তার পূর্বাপর জেনেটিক ব্যাকগ্রাউন্ড ছিল পরিচ্ছন্ন। তাছাড়া আমি তার মানসিক স্বাস্থ্যের বিষয়টাও প্রাধান্য দিয়েছিলাম। কেননা আমার নিজের দৃঢ় মানসিকতা আমাকে অতীতের মানসিক পীড়া থেকে সফলভাবে বের হয়ে আসতে সাহায্য করেছে। আমার চাওয়া ছিল আমার সন্তানের মানসিকতাও হবে একইরকম দৃঢ়। আমিনা শুক্রাণু দাতা হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন স্কট অ্যান্ডারসনকে। স্কট তখন চার সুস্থ সন্তানের পিতা। এতে আমিনা আরও আশ্বস্ত হয়েছিলেন। আমিনা নিজে বড় হয়েছেন নিজের পিতাকে তেমন একটা না জেনে। শেষ যখন তার জন্মদাতাকে দেখেছিলেন তখন তার বয়স ছিল মাত্র ১১ বছর। আর এ কারণেই আমিনা প্রথম থেকেই চেয়েছিলেন, তার ভবিষ্যৎ সন্তান যেন তার প্রকৃত পিতার সঙ্গে সাক্ষাত করতে পারে। তাছাড়া স্কট প্রোফাইলে উল্লেখ করেছিলেন, তার শুক্রাণুতে কোন সন্তানের জন্ম হলে তিনি তার সঙ্গে সাক্ষাতে আগ্রহী। ২০১২ সালের ১৪ই আগস্ট আমিনার কোল আলো করে জন্ম নেয় কন্যা সন্তান লেইলা। সবল সুস্থ অবস্থায় জন্ম নেয় সে। কিন্তু তিন সপ্তাহ পর আবার হাসপাতালে নিয়ে যেতে হয় লেইলাকে। শ্বাস-প্রশ্বাস জনিত সমস্যায় ভুগছিল সে। ডাক্তাররা জরুরি অস্ত্রোপচার করে তার জীবন বাঁচাতে সক্ষম হন। এদিকে লেইলার জন্মদাতা পিতা কে ছিলেন- তা জানতে আগ্রহী হয়ে ওঠেন আমিনার মা হেলেন। আমিনা বলেন, ছয় মাস পর আমার মা গুগলে খোঁজা শুরু করেন। তিনি জানতেন যে, স্কট ছিলেন একজন গবাদি পশুপালক এবং ফুটি খেলার অপেশাদার কোচ। মায়ের আগ্রহ দেখে হেলেন ওই ফার্টিলিটি এজেন্সির সঙ্গে যোগাযোগ করে তার ও লেইলার আরও বিস্তারিত তথ্য দিয়ে রাখেন। একই সঙ্গে তাদেরকে জানিয়ে রাখেন, স্কট যদি কখনও জানতে চান তাহলে তাকে যেন সবরকম তথ্য দেয়া হয়। স্কট খবরটি পাওয়ার পর তাদের মধ্যে ই-মেইল আদান-প্রদান শুরু হয়। তাদের মেয়ের বয়স এক বছর হওয়ার পর তারা সিদ্ধান্ত নেন সামনা-সামনি দেখা করার। ২০১৩ সালের ১৮ই আগস্ট লেইলাকে নিয়ে আমিনা দেড় ঘণ্টা গাড়ি চালিয়ে মেলবোর্নের ১৪০ কিলোমিটার দক্ষিণ-পূর্বে ফিলিপ আইল্যান্ডের কাছে স্কটের বাড়িতে যান। সেখানে শুধু স্কটই নয়, দেখা হয় স্কটের দুই সন্তানের সঙ্গেও। প্রথম দিকে কিছুটা বিচলিত ছিলেন আমিনা। অচেনা এক ব্যক্তির সঙ্গে দেখা করতে চলেছেন, যার সন্তান তার কোলে। কেমন হবে সাক্ষাতের অভিজ্ঞতা, তা নিয়ে দোলাচালে ছিলেন তিনি। কিন্তু দেখা হওয়ার পরপরই দুজনের মধ্যে স্বাভাবিক এক শখ্য গড়ে ওঠে। তাদের সন্তানরা একসঙ্গে খেলা করছিল। আর লেইলার দিকে স্কট কিভাবে বারবার তাকাচ্ছিলেন সেটা আমিনার নজরে পড়ে। লেইলার চেহারার সঙ্গে স্কটের অনেক মিল। প্রথম সাক্ষাতের অভিজ্ঞতা দারুণ ছিল। এরপর তারা কয়েক সপ্তাহ পরপর দেখা করার সিদ্ধান্ত নেন। একপর্যায়ে স্কট ই-মেইলে আমিনাকে জানান, তিনি চান তাদের আরও নিয়মিত দেখা হোক। এরপর তারা প্রতি দুই সপ্তাহ অন্তর দেখা করতে সম্মত হন। এরপর দেখা করা শুরু হয় প্রতি সপ্তাহে। ক্রমে সবকিছু পরিবর্তন হতে শুরু করে। অনেকটা অজান্তেই দুজনের মধ্যে গড়ে ওঠে ভালবাসার বন্ধন। কিন্তু স্কটকে কিছু বলতে চাননি আমিনা। এত সুন্দর একটা সম্পর্ক যদি ভেঙে যায় সে আশঙ্কায়। একদিন আমিনার কাছে স্কট জানতে চান, সপ্তাহে যদি দু’বার সাক্ষাতের কথা বলি তাহলে কি অনেক বেশি চাওয়া হবে? এতে হেসে ফেলেন আমিনা। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এ যুগলের সম্পর্কের বন্ধন আরও দৃঢ় হতে থাকে। তার কিছুদিন পরই ছিল বড়দিন। সেবার স্কট ও আমিনা সন্তানদের নিয়ে একসঙ্গে বড়দিন উদযাপন করেন। এক পরিবার হয়ে। শুক্রাণু দাতা হিসেবে লেইলার ওপর স্কটের কোন আইনি অধিকার না থাকলেও আমিনা তাকে আশ্বস্ত করে বলেছে, যা-ই হোক না কেন লেইলাকে কখনই তার পিতার স্নেহ থেকে দূরে সরিয়ে নেবেন না তিনি। স্কটের সঙ্গে সম্পর্ককে আমিনা আনন্দঘন সমাপ্তি হিসেবে নয় বরং জীবনের সুন্দর এক অধ্যায়ের শুরু হিসেবে দেখতে চান।
No comments