যোগ্য প্রচার পায়, না প্রচার যোগ্য বানায়? by মাহবুব কামাল
একটা ধাঁধা দিয়ে শুরু করি, এরপর কলম পিছলাতে পিছলাতে কোথায় যায় যাবে। ধাঁধাটা- যোগ্য প্রচার পায়, নাকি প্রচার যোগ্য বানায়? উদাহরণ দিয়ে বলি- মির্জা ফখরুল যোগ্য ছিলেন বলেই কি প্রচার পাওয়া শুরু করেছেন, নাকি ক্রমাগত প্রচারের ফলেই তাকে যোগ্য মনে হয়? হ্যাঁ, এই ধাঁধার মীমাংসা হতে হবে, কারণ এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে জগৎ-সংসারের অনেক অর্থ-অনর্থের প্রশ্ন।
পাঠক লক্ষ্য করুন, যেসব পত্রিকায় জিল্লুর রহমান সিদ্দিকীর মৃত্যু-সংবাদ প্রথম পাতায় গুরুত্ব দিয়ে ছাপা হয়েছে, সেগুলোর পাঠক ভাববেন যে, তিনি বড় মাপের মানুষ ছিলেন। আবার সংবাদটি ছোট করে ভেতরের পাতায় ছাপা হয়েছে যেগুলোয়, সেগুলোর পাঠক মনে করেছেন, তিনি অন্য দশজন শিক্ষকের মতোই একজন। মৃত্যু-সংবাদে মহাপ্রয়াণ শব্দটি ব্যবহার করলে পাঠক ধরে নিতেন তিনি একজন মহাপুরুষ ছিলেন। অর্থাৎ দেখা যাচ্ছে, সত্যটা আসলে কী, সেটা নির্ধারণ করে থাকে মিডিয়াই, সাধারণ মানুষ নয়। মিডিয়া ক্রপ-আপ করলে বস্তুটা ছোট, ব্লো-আপ করলে বড়।
গ্লোবাল পারসপেক্টিভটা একটু দেখি নিই আমরা। বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী ব্যক্তির নাম কি ওবামা? না। তাহলে কে? এর উত্তর বহুবচনে হবে- টেড টার্নার, রুপার্ট মারডকসহ মিডিয়া সম্রাটরাই বেশি শক্তিশালী। ওবামা আমাকে ধ্বংস করে দিতে পারেন (তিনি আফগানিস্তান-ইরাকে এমনটা করেছেনও), নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন না। কিন্তু টেড টার্নাররা নিয়ন্ত্রণ করছেন (এই নিয়ন্ত্রণ প্রতিরোধ করার ক্ষমতা সবার থাকে না) আমাদের চিন্তা-পদ্ধতি, ব্যবহারিক জীবন, সংস্কৃতি, এমনকি জিহ্বার রুচিও। আগে খেতাম ম্যাগডোনাল্ডস, এখন কেএফসিও খেতে শিখেছি। এই নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতিটি এত সূক্ষ্ম এবং কখনও কখনও এত দীর্ঘমেয়াদি যে, মনেই হবে না আমি নিয়ন্ত্রিত হচ্ছি।
মিডিয়া তাৎক্ষণিকভাবে সরাসরিও নিয়ন্ত্রণ অথবা প্রভাবিত করতে পারে মানুষের জীবন। অনেক আগে দূরদর্শনে কলকাতার জনপ্রিয় লেখক শংকরের একটি সাক্ষাৎকার দেখেছিলাম। বললেন- দ্বারে দ্বারে ঘুরি, কেউ লেখা ছাপে না, কেউ কেউ জানোয়ার ভেবে দূর দূর করে তাড়িয়ে দেয়। তো একদিন সাগরদা (দেশ-এর সাবেক সম্পাদক সাগরময় ঘোষ) দয়াপরবশ হয়ে একটা গল্প ছাপলেন। ব্যস মানুষ হয়ে গেলাম! এবার উল্টোটা দেখুন। এ দেশে প্রভা নামের একটি মেয়ে করে খাচ্ছিলো। সামান্য ঘটনা, বাইরে থেকে ছিটকিনি খোলা সম্ভব হলে রাজধানীর অন্তত ৫ শতাংশ ঘরে এমন ঘটনা দেখতে পাওয়া যাবে; অথচ সেই দোষে মিডিয়া তাকে মানুষ থেকে জন্তুতে (প্রকাশ্য যৌনতা অর্থে) নামিয়ে দিল! বেশ কিছুদিন পর আবার খেয়াল চাপলো মিডিয়ার- মেয়েটা অনেক ভুগেছে যখন, দিলাম মাফ করে। ভালো লাগছে যে, সে ক্রমশই আবার মানুষের আকার ধারণ করছে।
মিডিয়া যেহেতু সত্যি সত্যিই শক্তিমান, স্বৈরশাসকের মতো কাগুজে বাঘ নয়, তাই হুঙ্কার তার সঙ্গে যায় না। দুর্বলের মস্তক উদ্ধত থাকে থাকুক, সবলের মাথা অবনত থাকলেই তাকে আরও সুন্দর দেখায়। অথচ একটি শক্তিশালী দৈনিক বক্সিং রিংয়ের বাইরে থাকা, প্রতিদ্বন্দ্বী নয় এমন এক নির্দোষকে কীভাবে ঘুষি মারছে, দেখুন।
বছর পাঁচেক আগে স্পেশাল ট্রিটমেন্টে প্রথম পাতায় শিরোনাম করা হলো- রাষ্ট্রপতির সামরিক সচিবের জঙ্গি কানেকশন। প্রয়াত জিল্লুর রহমানের সামরিক সচিব এই মেজর জেনারেল (এখন অবসরে) এহতেশাম উল হককে আমি চিনি। পাপ্পু (তার ডাক নাম) আমার এক অনুজপ্রতিমের ঘনিষ্ঠ বন্ধু। যা হোক, হেডিং পড়ে মনে হতে পারে, পাপ্পু কোনো জঙ্গি-অপারেশন কমান্ড করেছেন বা তার ক্যাপাসিটিতে জঙ্গিদের অস্ত্র সরবরাহ করেছেন অথবা জঙ্গিদের প্রচারপত্র ছাপানোর টাকা দিয়েছেন কিংবা কোনো জঙ্গির সঙ্গে তার টেলিফোন-আলাপ ট্যাপ করে জানা গেছে অনেক তথ্য। না, এসব কিছুই নয়। হেডিং পড়ার পর পাপ্পুর আত্মীয়-স্বজনদের প্রেসার একসেলারেটেড হাইপার টেনশনে ২০০তে উঠে গেলে কী হবে, রিপোর্টের বডিতে ঢোকার পর তা নেমে এসেছে ১২০-এরও নিচে। তো, তিনি কীভাবে জঙ্গি? রিপোর্টটিতে যতই কায়দা করা হোক, আসলে তিনি যখন সিলেটে বিডিআরের কমান্ডিং অফিসার ছিলেন, তখন এক অসহায় যুবকের জন্য একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরির ব্যবস্থা করেছিলেন। সে পরে জঙ্গি হিসেবে শনাক্ত হয়েছে। প্রতিবেদনটি ছাপা হওয়ার পর পাপ্পুকে রংপুরের জিওসি হিসেবে বদলি করা হয়েছিল। আমার নিয়মিত রংপুর সফরের একটিতে তার সঙ্গে দেখা হলে তিনি বলেছিলেন- আপনি তো সাংবাদিক, আপনি কি সব জঙ্গিকেই চেনেন? আপনিই যদি না চেনেন, আমি চিনবো কীভাবে? বলে রাখি, পরবর্তী সময়ে সামরিক অথবা অন্য কোনো গোয়েন্দা সংস্থার তদন্তে পাপ্পুর জঙ্গি কানেকশন খুঁজে পাওয়া যায়নি। তাই প্রশ্ন ওঠাই স্বাভাবিক, এই সংবাদের পেছনে কি ছিল কোনো বিশেষ এজেন্ডা, নাকি এটা স্রেফ সেনসেশনাল জার্নালিজম?
অবশ্য উপরের প্রতিবেদনটির নিচে সামান্য হলেও মাটি ছিল। কোনো কোনো পত্রিকা কখনও কখনও শূন্যের মাঝারে দরজা-জানালা-বারান্দাসহ ঘর তৈরি করে। আমার উদ্দিষ্ট পত্রিকাটি সমাজের অনেক উপকার করে থাকে। আমি নিজেও এটি বাসায় রাখি। পত্রিকার কর্তৃপক্ষের কাছে তাই দুটি নিবেদন। এক. অর্ধসত্য কখনও কখনও মিথ্যার চেয়েও ভয়ঙ্কর হয়ে ওঠে। দুই. উপকার করতে চাইলে ষোলো আনাই করবেন, না হলে দরকার নেই। বারো আনা করলে আমরা বলতেই থাকব- শালা বাকি চার আনা দেয়নি বলেই আমার এক টাকা হয়নি।
কোনো ঝুঁকিপূর্ণ ভালো লেখা ছাপা না হওয়া এবং আরও অনেক ক্ষেত্রে পত্রিকাগুলোর কর্তৃপক্ষ বলে থাকেন- এটা আমাদের সম্পাদকীয় নীতির পরিপন্থী। যুক্তিশাস্ত্রের এই ফ্যালাসি বেশ মজার। চর্ম রক্ষার বর্ম অথচ বলা হচ্ছে নীতি! বছর পনেরো আগে বিদেশ থেকে ফেরার সময় শাহ্জালালে যখন কাস্টমস করছিলাম, মাইকে শুনতে পেলাম- পাঁচ হাজার ডলারের বেশি থাকলে ডিক্লায়ার করতে হবে, নতুবা শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়া হবে। আমি প্যান্টের দুই পকেটের ভেতরের কাপড় বের করে উল্টিয়ে দেখাতে দেখাতে বললাম- পৃথিবীর কোন্ এয়ারপোর্টে এমন আপমানজনক ঘোষণা দেয়া হয়? কাস্টমস কর্মকর্তা বললেন- এটা আমাদের নিয়ম। বললাম- আমি তো নিয়মটাকেই চ্যালেঞ্জ করছি, কার নিয়ম জিজ্ঞেস করিনি। এবার বলি, আমরা বলছি নীতি বা পলিসির কথা। এটা সম্পাদকের কি-না, সেটা দ্বিতীয় প্রশ্ন। এডিটোরিয়াল পলিসি এডিটর কিংবা প্রকাশকের নয়, পাঠকের স্বার্থ দেখবে- এটাই হওয়ার কথা। কিন্তু আমরা দেখছি, এডিটোরিয়াল পলিসিটি এডিটোরিয়াল ইন্টারেস্টের ভিত্তিতেই সাজানো হয়। সবচেয়ে বড় কথা, মুক্তবাজার অর্থনীতি ও মুক্তবাজার চিন্তার এই দুনিয়ায় একটা পলিসি দিয়ে আরেকটা পলিসি কি আটকানো যায়? নাকি তা সম্ভব?
ক্লিনটন বলেছিলেন, অভিবাসনই (immigration) আমেরিকার শক্তি। তিনি ভুল বলেছেন; আমেরিকার শক্তি হচ্ছে, সমাজটা ফেসলেস- মুখাবয়বহীন। কেউ কারও চেহারার দিকে তাকায় না, পারফরমেন্সই সেখানে শেষ কথা। ম্যাডোনার চেহারার দিকে তাকালে ওকে আর পৃষ্ঠপোষকতা দেয়া হতো না, কারণ ও তো একটা স্ট্রিট গার্ল! চেহারায় না তাকিয়ে গলা শুনেছে বলেই তাকে শিরোনাম করতে পেরেছে মিডিয়া। সোফিয়া লরেন জন্মের পর ইতালির নেপল্সেই থেকে গেলে কী হতেন বলা মুশকিল। ইউরোপ এখনও পুরোপুরি কনজারভেটিজম থেকে মুক্ত হতে পারেনি। বাস্টার্ড হিসেবে হয়তো অনাদৃতই থেকে যেতেন তিনি, হলিউডে হয়েছেন বিপুল সমাদৃত। আবার তার বিরুদ্ধে যখন আয়কর ফাঁকির অভিযোগ আনা হলো, মিডিয়া তার পক্ষে দাঁড়ালো না। কেন দাঁড়াবে? তিনি কোটি কোটি মানুষের হৃদয় ভেঙেছেন ভালো কথা, শৃঙ্খলা তো ভাঙতে পারেন না।
উপরের পত্রিকাটি সাকিবের পক্ষে দাঁড়িয়েছে। তিনি দেশের গৌরব মানি, নিক্সন কি আমেরিকার গৌরব ছিলেন না? তিনিই একমাত্র আমেরিকান, যিনি দুই টার্মে ভাইস-প্রেসিডেন্ট ও দুই টার্মে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হতে পেরেছিলেন; তিনি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে আমেরিকার ন্যাভাল ফোর্সকে সার্ভ করেছেন; ভিয়েতনাম যুদ্ধের পরিসমাপ্তি ঘটিয়ে ভিয়েতনামিজ তো বটেই, অনেক আমেরিকানের প্রাণ বাঁচিয়েছেন। তিনি শুধু আমেরিকানদের নয়, সমগ্র মানবজাতির গর্ব ছিলেন। তারই কল্যাণে (অ্যাপোলো ১১-এর উৎক্ষেপক হিসেবে) এই মর্ত্যরে মানুষ দূর স্বপ্নলোকে পৌঁছেছিল, তিনিই এই গ্রহের প্রথম মানুষ, যিনি চাঁদের মানুষের সঙ্গে কথা বলেছেন। তাহলে ব্রাডলি কেন লাগলেন তার পেছনে, যে কারণে তাকে প্রেসিডেন্ট পদ থেকে নেমে যেতে হলো? আমেরিকানদের জন্য কন্ট্রিবিউশনের বিপরীতে তার ওয়াটারগেট কেলেঙ্কারি কতটা বড় বা ছোট অপরাধ? উত্তর হলো, কোনো কোনো অপরাধ অখণ্ড, স্বয়ংসম্পূর্ণ; তাকে টুকরো করা যায় না। আর তাই, সাজাটা কী হওয়া উচিত, ভাবতে এক সেকেন্ডও লাগেনি আমেরিকানদের। আবার ইমপিচমেন্ট প্রক্রিয়ার আগেই পদত্যাগ করে নিক্সন অপেক্ষার সময় কমিয়ে দিয়েছেন (নিক্সন যেদিন পদত্যাগ করেন, সেদিন আমাদের মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতার শাস্তি দেখতে পেয়ে আমেরিকানদের সঙ্গে আমিও খুশি হয়েছিলাম)। সাকিবের শাস্তি নিয়ে গবেষণার হেতু কী?
বস্তুত, সমাজটাকে মুখাবয়বহীন করে তুলতে না পারলে কিছুই হওয়ার নেই। মামা-চাচা-খালু, ভাগ্নে-ভাগ্নি-ভাতিজা-ভাতিজি, শ্বশুর-শাশুড়ি, শ্যালক-শ্যালিকা, চেয়ারম্যান-এমডি, মন্ত্রী-সচিব, এমনকি প্রধানমন্ত্রী- সব পরিচয় মুছে ফেলে নাগরিক-এর স্টিকার লাগাতে হবে সবার কপালে। এবং নিজ নিজ অবস্থানে থেকে কার কী করা চলে, কী করা চলে না; কার দায়িত্ব কী, অধিকার কী- এসব দিয়েই বিচার করতে হবে তাকে, অন্যকিছু দিয়ে নয়। সবচেয়ে বড় কথা, জার্নালিজম ফেভার-ডিসফেভারের কোনো মাধ্যম নয়, it is a gentleman's game- এই খেলায় ফাউল করার চেয়ে ওয়াক-আউট অনেক ভালো।
মাহবুব কামাল : সাংবাদিক
পাঠক লক্ষ্য করুন, যেসব পত্রিকায় জিল্লুর রহমান সিদ্দিকীর মৃত্যু-সংবাদ প্রথম পাতায় গুরুত্ব দিয়ে ছাপা হয়েছে, সেগুলোর পাঠক ভাববেন যে, তিনি বড় মাপের মানুষ ছিলেন। আবার সংবাদটি ছোট করে ভেতরের পাতায় ছাপা হয়েছে যেগুলোয়, সেগুলোর পাঠক মনে করেছেন, তিনি অন্য দশজন শিক্ষকের মতোই একজন। মৃত্যু-সংবাদে মহাপ্রয়াণ শব্দটি ব্যবহার করলে পাঠক ধরে নিতেন তিনি একজন মহাপুরুষ ছিলেন। অর্থাৎ দেখা যাচ্ছে, সত্যটা আসলে কী, সেটা নির্ধারণ করে থাকে মিডিয়াই, সাধারণ মানুষ নয়। মিডিয়া ক্রপ-আপ করলে বস্তুটা ছোট, ব্লো-আপ করলে বড়।
গ্লোবাল পারসপেক্টিভটা একটু দেখি নিই আমরা। বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী ব্যক্তির নাম কি ওবামা? না। তাহলে কে? এর উত্তর বহুবচনে হবে- টেড টার্নার, রুপার্ট মারডকসহ মিডিয়া সম্রাটরাই বেশি শক্তিশালী। ওবামা আমাকে ধ্বংস করে দিতে পারেন (তিনি আফগানিস্তান-ইরাকে এমনটা করেছেনও), নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন না। কিন্তু টেড টার্নাররা নিয়ন্ত্রণ করছেন (এই নিয়ন্ত্রণ প্রতিরোধ করার ক্ষমতা সবার থাকে না) আমাদের চিন্তা-পদ্ধতি, ব্যবহারিক জীবন, সংস্কৃতি, এমনকি জিহ্বার রুচিও। আগে খেতাম ম্যাগডোনাল্ডস, এখন কেএফসিও খেতে শিখেছি। এই নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতিটি এত সূক্ষ্ম এবং কখনও কখনও এত দীর্ঘমেয়াদি যে, মনেই হবে না আমি নিয়ন্ত্রিত হচ্ছি।
মিডিয়া তাৎক্ষণিকভাবে সরাসরিও নিয়ন্ত্রণ অথবা প্রভাবিত করতে পারে মানুষের জীবন। অনেক আগে দূরদর্শনে কলকাতার জনপ্রিয় লেখক শংকরের একটি সাক্ষাৎকার দেখেছিলাম। বললেন- দ্বারে দ্বারে ঘুরি, কেউ লেখা ছাপে না, কেউ কেউ জানোয়ার ভেবে দূর দূর করে তাড়িয়ে দেয়। তো একদিন সাগরদা (দেশ-এর সাবেক সম্পাদক সাগরময় ঘোষ) দয়াপরবশ হয়ে একটা গল্প ছাপলেন। ব্যস মানুষ হয়ে গেলাম! এবার উল্টোটা দেখুন। এ দেশে প্রভা নামের একটি মেয়ে করে খাচ্ছিলো। সামান্য ঘটনা, বাইরে থেকে ছিটকিনি খোলা সম্ভব হলে রাজধানীর অন্তত ৫ শতাংশ ঘরে এমন ঘটনা দেখতে পাওয়া যাবে; অথচ সেই দোষে মিডিয়া তাকে মানুষ থেকে জন্তুতে (প্রকাশ্য যৌনতা অর্থে) নামিয়ে দিল! বেশ কিছুদিন পর আবার খেয়াল চাপলো মিডিয়ার- মেয়েটা অনেক ভুগেছে যখন, দিলাম মাফ করে। ভালো লাগছে যে, সে ক্রমশই আবার মানুষের আকার ধারণ করছে।
মিডিয়া যেহেতু সত্যি সত্যিই শক্তিমান, স্বৈরশাসকের মতো কাগুজে বাঘ নয়, তাই হুঙ্কার তার সঙ্গে যায় না। দুর্বলের মস্তক উদ্ধত থাকে থাকুক, সবলের মাথা অবনত থাকলেই তাকে আরও সুন্দর দেখায়। অথচ একটি শক্তিশালী দৈনিক বক্সিং রিংয়ের বাইরে থাকা, প্রতিদ্বন্দ্বী নয় এমন এক নির্দোষকে কীভাবে ঘুষি মারছে, দেখুন।
বছর পাঁচেক আগে স্পেশাল ট্রিটমেন্টে প্রথম পাতায় শিরোনাম করা হলো- রাষ্ট্রপতির সামরিক সচিবের জঙ্গি কানেকশন। প্রয়াত জিল্লুর রহমানের সামরিক সচিব এই মেজর জেনারেল (এখন অবসরে) এহতেশাম উল হককে আমি চিনি। পাপ্পু (তার ডাক নাম) আমার এক অনুজপ্রতিমের ঘনিষ্ঠ বন্ধু। যা হোক, হেডিং পড়ে মনে হতে পারে, পাপ্পু কোনো জঙ্গি-অপারেশন কমান্ড করেছেন বা তার ক্যাপাসিটিতে জঙ্গিদের অস্ত্র সরবরাহ করেছেন অথবা জঙ্গিদের প্রচারপত্র ছাপানোর টাকা দিয়েছেন কিংবা কোনো জঙ্গির সঙ্গে তার টেলিফোন-আলাপ ট্যাপ করে জানা গেছে অনেক তথ্য। না, এসব কিছুই নয়। হেডিং পড়ার পর পাপ্পুর আত্মীয়-স্বজনদের প্রেসার একসেলারেটেড হাইপার টেনশনে ২০০তে উঠে গেলে কী হবে, রিপোর্টের বডিতে ঢোকার পর তা নেমে এসেছে ১২০-এরও নিচে। তো, তিনি কীভাবে জঙ্গি? রিপোর্টটিতে যতই কায়দা করা হোক, আসলে তিনি যখন সিলেটে বিডিআরের কমান্ডিং অফিসার ছিলেন, তখন এক অসহায় যুবকের জন্য একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরির ব্যবস্থা করেছিলেন। সে পরে জঙ্গি হিসেবে শনাক্ত হয়েছে। প্রতিবেদনটি ছাপা হওয়ার পর পাপ্পুকে রংপুরের জিওসি হিসেবে বদলি করা হয়েছিল। আমার নিয়মিত রংপুর সফরের একটিতে তার সঙ্গে দেখা হলে তিনি বলেছিলেন- আপনি তো সাংবাদিক, আপনি কি সব জঙ্গিকেই চেনেন? আপনিই যদি না চেনেন, আমি চিনবো কীভাবে? বলে রাখি, পরবর্তী সময়ে সামরিক অথবা অন্য কোনো গোয়েন্দা সংস্থার তদন্তে পাপ্পুর জঙ্গি কানেকশন খুঁজে পাওয়া যায়নি। তাই প্রশ্ন ওঠাই স্বাভাবিক, এই সংবাদের পেছনে কি ছিল কোনো বিশেষ এজেন্ডা, নাকি এটা স্রেফ সেনসেশনাল জার্নালিজম?
অবশ্য উপরের প্রতিবেদনটির নিচে সামান্য হলেও মাটি ছিল। কোনো কোনো পত্রিকা কখনও কখনও শূন্যের মাঝারে দরজা-জানালা-বারান্দাসহ ঘর তৈরি করে। আমার উদ্দিষ্ট পত্রিকাটি সমাজের অনেক উপকার করে থাকে। আমি নিজেও এটি বাসায় রাখি। পত্রিকার কর্তৃপক্ষের কাছে তাই দুটি নিবেদন। এক. অর্ধসত্য কখনও কখনও মিথ্যার চেয়েও ভয়ঙ্কর হয়ে ওঠে। দুই. উপকার করতে চাইলে ষোলো আনাই করবেন, না হলে দরকার নেই। বারো আনা করলে আমরা বলতেই থাকব- শালা বাকি চার আনা দেয়নি বলেই আমার এক টাকা হয়নি।
কোনো ঝুঁকিপূর্ণ ভালো লেখা ছাপা না হওয়া এবং আরও অনেক ক্ষেত্রে পত্রিকাগুলোর কর্তৃপক্ষ বলে থাকেন- এটা আমাদের সম্পাদকীয় নীতির পরিপন্থী। যুক্তিশাস্ত্রের এই ফ্যালাসি বেশ মজার। চর্ম রক্ষার বর্ম অথচ বলা হচ্ছে নীতি! বছর পনেরো আগে বিদেশ থেকে ফেরার সময় শাহ্জালালে যখন কাস্টমস করছিলাম, মাইকে শুনতে পেলাম- পাঁচ হাজার ডলারের বেশি থাকলে ডিক্লায়ার করতে হবে, নতুবা শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়া হবে। আমি প্যান্টের দুই পকেটের ভেতরের কাপড় বের করে উল্টিয়ে দেখাতে দেখাতে বললাম- পৃথিবীর কোন্ এয়ারপোর্টে এমন আপমানজনক ঘোষণা দেয়া হয়? কাস্টমস কর্মকর্তা বললেন- এটা আমাদের নিয়ম। বললাম- আমি তো নিয়মটাকেই চ্যালেঞ্জ করছি, কার নিয়ম জিজ্ঞেস করিনি। এবার বলি, আমরা বলছি নীতি বা পলিসির কথা। এটা সম্পাদকের কি-না, সেটা দ্বিতীয় প্রশ্ন। এডিটোরিয়াল পলিসি এডিটর কিংবা প্রকাশকের নয়, পাঠকের স্বার্থ দেখবে- এটাই হওয়ার কথা। কিন্তু আমরা দেখছি, এডিটোরিয়াল পলিসিটি এডিটোরিয়াল ইন্টারেস্টের ভিত্তিতেই সাজানো হয়। সবচেয়ে বড় কথা, মুক্তবাজার অর্থনীতি ও মুক্তবাজার চিন্তার এই দুনিয়ায় একটা পলিসি দিয়ে আরেকটা পলিসি কি আটকানো যায়? নাকি তা সম্ভব?
ক্লিনটন বলেছিলেন, অভিবাসনই (immigration) আমেরিকার শক্তি। তিনি ভুল বলেছেন; আমেরিকার শক্তি হচ্ছে, সমাজটা ফেসলেস- মুখাবয়বহীন। কেউ কারও চেহারার দিকে তাকায় না, পারফরমেন্সই সেখানে শেষ কথা। ম্যাডোনার চেহারার দিকে তাকালে ওকে আর পৃষ্ঠপোষকতা দেয়া হতো না, কারণ ও তো একটা স্ট্রিট গার্ল! চেহারায় না তাকিয়ে গলা শুনেছে বলেই তাকে শিরোনাম করতে পেরেছে মিডিয়া। সোফিয়া লরেন জন্মের পর ইতালির নেপল্সেই থেকে গেলে কী হতেন বলা মুশকিল। ইউরোপ এখনও পুরোপুরি কনজারভেটিজম থেকে মুক্ত হতে পারেনি। বাস্টার্ড হিসেবে হয়তো অনাদৃতই থেকে যেতেন তিনি, হলিউডে হয়েছেন বিপুল সমাদৃত। আবার তার বিরুদ্ধে যখন আয়কর ফাঁকির অভিযোগ আনা হলো, মিডিয়া তার পক্ষে দাঁড়ালো না। কেন দাঁড়াবে? তিনি কোটি কোটি মানুষের হৃদয় ভেঙেছেন ভালো কথা, শৃঙ্খলা তো ভাঙতে পারেন না।
উপরের পত্রিকাটি সাকিবের পক্ষে দাঁড়িয়েছে। তিনি দেশের গৌরব মানি, নিক্সন কি আমেরিকার গৌরব ছিলেন না? তিনিই একমাত্র আমেরিকান, যিনি দুই টার্মে ভাইস-প্রেসিডেন্ট ও দুই টার্মে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হতে পেরেছিলেন; তিনি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে আমেরিকার ন্যাভাল ফোর্সকে সার্ভ করেছেন; ভিয়েতনাম যুদ্ধের পরিসমাপ্তি ঘটিয়ে ভিয়েতনামিজ তো বটেই, অনেক আমেরিকানের প্রাণ বাঁচিয়েছেন। তিনি শুধু আমেরিকানদের নয়, সমগ্র মানবজাতির গর্ব ছিলেন। তারই কল্যাণে (অ্যাপোলো ১১-এর উৎক্ষেপক হিসেবে) এই মর্ত্যরে মানুষ দূর স্বপ্নলোকে পৌঁছেছিল, তিনিই এই গ্রহের প্রথম মানুষ, যিনি চাঁদের মানুষের সঙ্গে কথা বলেছেন। তাহলে ব্রাডলি কেন লাগলেন তার পেছনে, যে কারণে তাকে প্রেসিডেন্ট পদ থেকে নেমে যেতে হলো? আমেরিকানদের জন্য কন্ট্রিবিউশনের বিপরীতে তার ওয়াটারগেট কেলেঙ্কারি কতটা বড় বা ছোট অপরাধ? উত্তর হলো, কোনো কোনো অপরাধ অখণ্ড, স্বয়ংসম্পূর্ণ; তাকে টুকরো করা যায় না। আর তাই, সাজাটা কী হওয়া উচিত, ভাবতে এক সেকেন্ডও লাগেনি আমেরিকানদের। আবার ইমপিচমেন্ট প্রক্রিয়ার আগেই পদত্যাগ করে নিক্সন অপেক্ষার সময় কমিয়ে দিয়েছেন (নিক্সন যেদিন পদত্যাগ করেন, সেদিন আমাদের মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতার শাস্তি দেখতে পেয়ে আমেরিকানদের সঙ্গে আমিও খুশি হয়েছিলাম)। সাকিবের শাস্তি নিয়ে গবেষণার হেতু কী?
বস্তুত, সমাজটাকে মুখাবয়বহীন করে তুলতে না পারলে কিছুই হওয়ার নেই। মামা-চাচা-খালু, ভাগ্নে-ভাগ্নি-ভাতিজা-ভাতিজি, শ্বশুর-শাশুড়ি, শ্যালক-শ্যালিকা, চেয়ারম্যান-এমডি, মন্ত্রী-সচিব, এমনকি প্রধানমন্ত্রী- সব পরিচয় মুছে ফেলে নাগরিক-এর স্টিকার লাগাতে হবে সবার কপালে। এবং নিজ নিজ অবস্থানে থেকে কার কী করা চলে, কী করা চলে না; কার দায়িত্ব কী, অধিকার কী- এসব দিয়েই বিচার করতে হবে তাকে, অন্যকিছু দিয়ে নয়। সবচেয়ে বড় কথা, জার্নালিজম ফেভার-ডিসফেভারের কোনো মাধ্যম নয়, it is a gentleman's game- এই খেলায় ফাউল করার চেয়ে ওয়াক-আউট অনেক ভালো।
মাহবুব কামাল : সাংবাদিক
No comments