মতিউর রহমান নিজামীর ফাঁসি- বিভিন্ন স্থানে সংঘর্ষ, গ্রেপ্তার ৩ শতাধিক, ৭২ ঘণ্টা হরতাল by উৎপল রায়
মুক্তিযুদ্ধকালীন মানবতাবিরোধী অপরাধে
দোষী সাব্যস্ত করে জামায়াতে ইসলামীর আমীর মতিউর রহমান নিজামীর বিরুদ্ধে
মৃত্যুদণ্ডের রায় দিয়েছে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল। বিচারপতি এম
ইনায়েতুর রহিমের নেতৃত্বাধীন তিন সদস্যের ট্রাইব্যুনাল গতকাল এ রায় ঘোষণা
করে। তার বিরুদ্ধে আনা ১৬টি অভিযোগের মধ্যে ৮টি প্রমাণিত হয়েছে বলে
ট্রাইব্যুনালের রায়ে বলা হয়েছে। এর মধ্যে ৪টি অভিযোগে মৃত্যুদণ্ড এবং অন্য
৪টি অভিযোগে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেয়া হয়েছে। এ রায়ের প্রতিবাদে জামায়াত তিন
দিনের হরতালসহ বিভিন্ন কর্মসূচি ঘোষণা করেছে। এদিকে রায়ে সন্তোষ প্রকাশ
করেছে আওয়ামী লীগ ও ক্ষমতাসীন ১৪দলীয় জোট। শাহবাগের গণজাগরণ মঞ্চ রায়ে
সন্তোষ প্রকাশ করে আনন্দ মিছিল করেছে। রায়ে সন্তোষ প্রকাশ করে আইনমন্ত্রী
এডভোকেট আনিসুল হক সংবাদ মাধ্যমকে বলেছেন, রায় দ্রুততম সময়ে কার্যকর করতে
যা করার তা-ই করবে সরকার। রায় ঘোষণার পর নিজামীর পক্ষের আইনজীবীরা
জানিয়েছেন, রায়ে নিজামী ন্যায়বিচার পাননি। ট্রাইব্যুনালের রায়ের বিরুদ্ধে
উচ্চ আদালতে আপিল করা হবে। রায়ের পর দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে বিচ্ছিন্ন
সহিংসতার খবর পাওয়া গেছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী প্রায় ৩০০
নেতা-কর্মীকে গ্রেপ্তার করেছে বলে দাবি করেছে জামায়াত। রায়ের প্রতিক্রিয়ায়
আসামী পক্ষের প্রধান আইনজীবী ব্যারিস্টার আবদুর রাজ্জাক আল-জাজিরাকে বলেন,
পৃথিবীর অন্যান্য দেশে যুদ্ধাপরাধের বিচার হয়েছে ইতিহাসের একটি অধ্যায়ের
সমাপ্তি টানার জন্য। কিন্তু বাংলাদেশে সে উদ্দেশ্যে বিচার হচ্ছে না। এ
বিচার জাতিকে বিভক্ত করে ফেলেছে।
নিজামীর বিরুদ্ধে প্রসিকিউশনের দাখিলকৃত ২, ৪, ৬ ও ১৬ নম্বর অভিযোগ সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হওয়ায় ফাঁসির আদেশ, ১, ৩, ৭ ও ৮ নম্বর অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় যাবজ্জীবন এবং দাখিলকৃত অপর ৮টি অভিযোগ প্রমাণিত না হওয়ায় এসব অভিযোগ থেকে তাকে খালাস দেয়া হয়েছে। এর আগে চলতি বছরের ২৪শে জুন নিজামীর রায় ঘোষণার কথা থাকলেও ওই দিন নিজামী কারাগারে অসুস্থ হলে রায় অপেক্ষাধীন রাখে ট্রাইব্যুনাল-১।
নিজামীর রায়কে কেন্দ্র করে সকাল থেকে হাইকোর্ট সংলগ্ন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল ও এর আশপাশের এলাকা লোকারণ্য হয়ে যায়। এ সময় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পক্ষ থেকে ট্রাইব্যুনাল ও তার আশপাশ এলাকাজুড়ে নেয়া হয় কড়া নিরাপত্তা ব্যবস্থা। নিরাপত্তার অংশ হিসেবে বন্ধ করে দেয়া হয় হাইকোর্ট, জাতীয় ঈদগা ময়দান ও সচিবালয় সংলগ্ন সকল রাস্তা। বিশেষ পাস ছাড়া এ সময় ট্রাইব্যুনালের ভেতর কাউকে প্রবেশ করতে দেয়া হয়নি। এরই মধ্যে সকাল ৯টা ২০ মিনিটে জামায়াতের আমীর মাওলানা মতিউর রহমান নিজামীকে পুলিশের বিশেষ ভ্যানে করে কড়া নিরাপত্তায় ট্রাইব্যুনালের কয়েদখানায় নিয়ে আসা হয়। সেখানে তিনি প্রায় ১ ঘণ্টা ৪০ মিনিট অবস্থান করেন। ঘড়ির কাঁটা তখন সকাল এগারটা। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল ১-এ তখন তিল ধারণের ঠাঁই নেই। এর মধ্যেই মতিউর রহমান নিজামীকে ট্রাইব্যুনালের কাঠগড়ায় হাজির করা হয়। সাদা পাজামা, পাঞ্জাবি ও খয়েরি রঙের টুপি পরা নিজামী ছিলেন কিছুটা বিমর্ষ। এর একটু পরেই বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিমের নেতৃত্বে ট্রাইব্যুনালের আরও দুই সদস্য বিচারপতি জাহাঙ্গীর হোসেন ও বিচারপতি আনোয়ারুল হক এজলাশে তাদের নিজ নিজ আসন গ্রহণ করেন। ট্রাইব্যুনালে তখন পিনপতন নীরবতা। সবার চোখ এজলাসের বিচারপতিদের দিকে। ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিম রায় ঘোষণার আগে রাষ্ট্র ও আসামি উভয়পক্ষের আইনজীবীদের ধন্যবাদ জানিয়ে তাদের উদ্দেশ্যে তিনি বলেন, আপনারা সবাই এই মামলার জন্য অনেক ত্যাগ স্বীকার করেছেন। সবাই এই রায়ের জন্য অপেক্ষমাণ ছিলেন। আমরাও অপেক্ষায় ছিলাম- কখন এই রায় দিতে পারবো। এই দীর্ঘ অপেক্ষার কারণে বিভিন্ন মহলে প্রশ্ন উঠেছে। আমরা আদালতে যারা কাজ করি, তারা রাস্তায় অথবা টকশোতে গিয়ে তাদের মতো কথা বলতে পারি না। রাস্তায় কিংবা টকশোতে গিয়ে আমরা সমালোচনার জবাব দিতে পারি না। তিনি বলেন, আমরা আমাদের বিবেক, আইন ও সংবিধান দ্বারা পরিচালিত হই। আমরা কখনও কারও সঙ্গে আপস ও সমঝোতা করি না। আমরা আপস ও সমঝোতা করি সংবিধান ও আইনের সঙ্গে। ২০৪ পৃষ্ঠার রায় পড়ার আগে বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিম উপস্থিত আইনজীবী ও সাংবাদিকসহ সবার উদ্দেশ্যে বলেন, ২০৪ পৃষ্ঠার রায়ের পুরোটাই পাঠ করা হবে। এর আগে তিনটি রায়ে সারসংক্ষেপ পাঠ করা হয়েছিল। এবার তা করা হচ্ছে না। অভিযোগ ও সাক্ষীর ওপর কোন ব্যাখ্যা দেয়া হবে না। তবে রায়ে কিছু পর্যবেক্ষণ করা হবে। রায় পাঠের এক ঘণ্টা পরে ট্রাইব্যুনালের ওয়েব সাইটে বিস্তারিত পাওয়া যাবে। এরপর তিনি রায়ের প্রারম্ভিক বিষয় পাঠের জন্য তার সহকর্মী বিচারপতি আয়োয়ারুল হককে অনুরোধ করেন। বিচারপতি আনোয়ারুল হক বেলা এগারটা ৩৮ মিনিট পর্যন্ত নিজামীর বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগগুলো পড়ে শোনান। এরপর রায়ের দ্বিতীয় অংশ পড়ে শোনান বিচারপতি জাহাঙ্গীর হোসেন। তিনি অভিযোগগুলোর সঙ্গে নিজামীর সম্পৃক্ততা, তার দায়, বুদ্বিজীবী হত্যাসহ নানা দিক নিয়ে আলোকপাত করেন। এরপর রায়ের শেষ অংশ ও দণ্ডদান সম্পর্কিত বিষয়টি উপস্থাপন করেন ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান বিচাপতি এম ইনায়েতুর রহিম।
তাকে মন্ত্রী করা ছিল শহীদদের গালে চড়: রায়ের পর্যবেক্ষণে ট্রাইব্যুনালের বিচারপতিরা বলেন, মতিউর রহমান নিজামীকে বাংলাদেশের মন্ত্রী করাটা ছিল ভুল ও মুক্তিযুদ্ধে শহীদদের গালে চড় দেয়ার শামিল। নিজামী ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় রাজনীতিতে ধর্মের অপব্যবহার করেছিলেন। তার বিরুদ্ধে ১১ থেকে ১৪ নম্বর অভিযোগে মানবতাবিরোধী অপরাধে উস্কানির যেসব অভিযোগ আনা হয়েছে, সেগুলো বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় একাত্তরের ৩রা আগস্ট চট্টগ্রাম মুসলিম ইনস্টিটিউটে ইসলামী ছাত্রসংঘের সভায় তিনি পাকিস্তানকে ‘আল্লাহর ঘর’ বলেন। স্পষ্টতই তিনি এবং তার দল জামায়াতে ইসলামী ইসলামের মূল কথার বিকৃতি ঘটিয়ে তা রাজনীতিতে ব্যবহার করেছেন। আলবদর বাহিনী সম্পর্কে ট্রাইব্যুনাল বলেন, নিজামী শুধু আলবদর বাহিনীর প্রধানই ছিলেন না, এটি গঠনের ক্ষেত্রে মূল হোতাও ছিলেন তিনি। এ ছাড়া ১৯৬৬ সাল থেকে ১৯৭১ সালের ৩০শে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত তিনি নিখিল পাকিস্তান ছাত্রসংঘের সভাপতি ছিলেন, যা বর্তমানে ছাত্রশিবির নামে পরিচিত। আলবদর বাহিনী ছিল ছাত্রসংঘের ‘অ্যাকশন সেকশন’। স্পষ্টতই ইসলামী ছাত্রসংঘ ও আলবদরের ওপরে নিজামীর দৃঢ় নিয়ন্ত্রণ ছিল। ইসলামী ছাত্রসংঘ ও আলবদর বাহিনী ছিল সম্পূরক। যারা মুক্তিযুদ্ধে গুরুতর অপরাধ করেছে। ট্রাইব্যুনাল বলেন, এটা সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত যে, ইসলামী ছাত্রসংঘের সদস্যদের নিয়ে গঠিত আলবদর বাহিনীর সকল কর্মকাণ্ডের দায়ভার তাকেই (নিজামী) নিতে হবে। কারণ তিনিই ছিলেন এ বাহিনীর সুপিরিয়র কমান্ডার ও মাস্টার মাইন্ড। বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডে আলবদর বাহিনী ছিল সামনের সারিতে। আর মতিউর রহমান নিজামী এর সঙ্গে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জড়িত ছিলেন বলে এই মামলার সাক্ষীদের সাক্ষ্য ও তথ্য প্রমাণে প্রমাণিত হয়েছে। পর্যবেক্ষণে ট্রাইব্যুনাল আরও বলেন, নিজামী মনপ্রাণ দিয়ে শুধু বাংলাদেশের বিরোধিতাই করেননি, তিনি পরিকল্পিতভাবে বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত ছিলেন। বুদ্ধিজীবী ডা. আলীম চৌধুরী, আজহারুল হক ও হুমায়ুন কবিরের হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে তার সংশ্লিষ্ট সাক্ষ্য ও তথ্য-উপাত্তের মাধ্যমে প্রমাণ হয়েছে। অথচ এই নিজামীকেই বাংলাদেশের মন্ত্রী করা হয়েছিল! বিচারপতিরা বলেন, নিজামীর বিরুদ্ধে দাখিলকৃত অভিযোগগুলোর প্রেক্ষিতে সাক্ষ্য ও দালিলিক প্রমাণের মাধ্যমে আমরা খুব সতর্কভাবে সেগুলো পর্যবেক্ষণ করে দেখেছি। তাতে তার সংশ্লিষ্টতার প্রমাণ আমরা পেয়েছি। আমাদের কাছে মনে হয়েছে এজন্য সর্বোচ্চ শাস্তিই তার প্রাপ্য।
যে ৪ অভিযোগে মৃত্যুদণ্ড: জামায়াতে ইসলামীর আমীর মতিউর রহমান নিজামীর বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধে গঠিত আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ চারটি অভিযোগে ফাঁসির রায় দিয়েছেন। এছাড়া আরও চারটি অভিযোগে তাকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেয়া হয়েছে। অন্য একটিতে প্রসিকিউশন কোন সাক্ষ্যপ্রমাণ হাজির করেনি। আর আটটি অভিযোগ প্রমাণিত হয়নি মর্মে তাকে এ সব অভিযোগ থেকে নিষ্কৃতি দেয়া হয়েছে। নিজামীর বিরুদ্ধে মোট ১৬টি অভিযোগ আনা হয়। এরমধ্যে ২, ৪, ৬ ও ১৬ নম্বর অভিযোগের প্রতিটিতে আলাদাভাবে তার ফাঁসির রায় হয়েছে। ১, ৩, ৭, ৮ অভিযোগে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দিয়েছেন ট্রাইব্যুনাল। আর ৫ নম্বর অভিযোগে সাক্ষ্যপ্রমাণ হাজির করেনি প্রসিকিউশন। ৯ থেকে ১৫ নম্বর অভিযোগ প্রমাণিত হয়নি।
দ্বিতীয় অভিযোগে বলা হয়েছে, একাত্তরের ১০ই মে সকাল ১১টার দিকে পাবনার সাঁথিয়া উপজেলার বাউশগাড়ি গ্রামের রূপসী প্রাথমিক বিদ্যালয়ে একটি সভা অনুষ্ঠিত হয়। স্থানীয় শান্তি কমিটির সদস্য ও রাজাকারদের উপস্থিতিতে অনুষ্ঠিত ওই সভায় নিজামী বলেন, শিগগিরই পাকিস্তানি সেনারা শান্তি রক্ষার জন্য আসবে। ওই সভার পরিকল্পনা অনুসারে পরে বাউশগাড়িসহ দু’টি গ্রামের প্রায় ৪৫০ মানুষকে পাকিস্তানি সেনারা হত্যা করে। একই সঙ্গে প্রায় ৩০-৪০ জন নারীকে ধর্ষণ করে রাজাকাররা।
চতুর্থ অভিযোগে বলা হয়েছে, পাবনার করমজা গ্রামে নিজামীর নির্দেশনা ও পরিকল্পনায় হাবিবুর রহমান নামে একজনকে হত্যা করা হয়। একাত্তরের ৮ই মে নিজামীর নির্দেশে রাজাকার ও আলবদর বাহিনী করমজা গ্রাম ঘিরে ফেলে ৯ জনকে হত্যা করে। রাজাকার বাহিনী একজন নারীকে ধর্ষণসহ বাড়িঘর লুটপাট ও অগ্নিসংযোগ করে।
ষষ্ঠ অভিযোগে বলা হয়েছে, নিজামীর নির্দেশে একাত্তরের ২৭শে নভেম্বর পাবনার ধুলাউড়ি গ্রামে মুক্তিযোদ্ধাদের খুঁজতে অভিযান চালায় রাজাকার ও পাকিস্তানি সেনারা। তারা গ্রামের ডা. আব্দুল আউয়াল ও তার আশেপাশের বাড়িতে হামলা চালিয়ে নারী, পুরুষ ও শিশুসহ ৫২ জনকে হত্যা করে।
১৬ নম্বর অভিযোগে বলা হয়েছে, একাত্তরের ১৬ই ডিসেম্বর বিজয়ের ঊষালগ্নে অসংখ্য বুদ্ধিজীবীকে হত্যা করে আলবদর বাহিনী। দেশের বুদ্ধিজীবী শ্রেণীকে সম্পূর্ণ বা আংশিকভাবে ধ্বংস করার জন্য পরিকল্পিতভাবে আলবদর সদস্যরা ওই গণহত্যা ঘটায়। জামায়াতের ততকালীন ছাত্রসংগঠন ইসলামী ছাত্রসংঘ ও আলবদর বাহিনীর প্রধান হিসেবে ওই গণহত্যার দায় নিজামীর ওপর পড়ে।
যে চার অভিযোগে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড: যে সব অভিযোগে নিজামীকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেয়া হয়েছে এর মধ্যে প্রথম অভিযোগে বলা হয়েছে, পাবনা জিলা স্কুলের প্রধান শিক্ষক মাওলানা কছিমুদ্দিন বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষে প্রচার চালাতেন। একাত্তরের ৪ঠা জুন পাকিস্তানি সেনারা তাকে অপহরণ করে নূরপুর পাওয়ার হাউজের ক্যাম্পে নিয়ে যায়। সেখানে নিজামীর উপস্থিতিতে তার ওপর অকথ্য নির্যাতন চালানো হয়। ১০ই জুন তাকে ইছামতি নদীর পাড়ে অন্যান্য ব্যক্তির সঙ্গে হত্যা করা হয়।
তৃতীয় অভিযোগে বলা হয়েছে, একাত্তরের মে মাসের শুরু থেকে ১৬ই ডিসেম্বর পর্যন্ত মোহাম্মদপুরের ফিজিক্যাল ট্রেনিং ইনস্টিটিউটে পাকিস্তানি সেনাদের ক্যাম্প ছিল। রাজাকার ও আলবদর বাহিনীও সেখানে ক্যাম্প স্থাপন করে বিভিন্ন অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড চালাতে থাকে। নিজামী ওই ক্যাম্পে নিয়মিত যাতায়াত ও মানবতাবিরোধী অপরাধের ষড়যন্ত্র করতেন।
সপ্তম অভিযোগে বলা হয়েছে, একাত্তরের ৩রা নভেম্বর মধ্যরাতে নিজামীর তথ্যমতে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী পাবনার বৃশালিখা গ্রাম ঘিরে ফেলে সোহরাব আলীকে আটক করে তার স্ত্রী ও সন্তানদের সামনে সোহরাব আলীকে হত্যা করে।
অষ্টম অভিযোগে বলা হয়েছে, একাত্তরের ৩০শে আগস্ট নিজামী ঢাকার নাখালপাড়ার পুরোনো এমপি হোস্টেলে গিয়ে সেখানে আটক রুমী, বদি, জালালদের হত্যার জন্য পাকিস্তানি সেনাদের প্ররোচনা দেন।
রায়ে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠিত হয়েছে: রাষ্ট্রপক্ষ
রায়ে সন্তোষ প্রকাশ করে রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবীরা বলেছেন ঐতিহাসিক এই রায়ে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। প্রসিকিউটর হায়দার আলী রায়ের প্রতিক্রিয়ায় বলেন, এই রায় ঐতিহাসিক। রায়ে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। তিনি আরও বলেন, মতিউর রহমান নিজামী ১৯৭১ সালে সরাসরি অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে জড়িত ছিলেন। উস্কানি দিয়েছেন। ষড়যন্ত্র করেছেন। তিনি নিজেকে ইসলামী স্কলার দাবি করা সত্ত্বেও হত্যাকাণ্ড সংঘটিত করেছেন। হত্যা, ধর্ষণসহ নানা অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে সহযোগিতা করেছেন। তার বিরুদ্ধে আদালত যে রায় দিয়েছেন তা ঐতিহাসিক। প্রসিকিউটর তুরিন আফরোজ বলেন, নিজামীর মামলা পরিচালনায় আমরা সর্বোচ্চ আন্তরিকতা নিয়ে কাজ করেছি। সাক্ষ্যপ্রমাণকে ভিত্তি করে পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে নিজামীর বিরুদ্ধে দাখিলকৃত প্রতিটি অভিযোগ প্রমাণের চেষ্টা করেছি। রায়ে আমরা খুবই সন্তুষ্ট। আশা করি উচ্চ আদালতে এই রায় বহাল থাকবে। প্রসিকিউটর জেয়াদ আল মালুম বলেন, একাত্তরে নিজামীর অপরাধের যে গভীরতা তার জন্য মৃত্যুদণ্ডই ছিল তার একমাত্র শাস্তি। তাই এই রায়ে আমরা সন্তুষ্টি প্রকাশ করছি। যেসব অভিযোগে নিজামী খালাস পেয়েছেন সেসব অভিযোগে আপিল বিভাগে আপিল করা হবে কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, পূর্ণাঙ্গ রায় দেখে এবিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয়া হবে।
মামলার ধারাবাহিক কার্যক্রম: ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দেয়ার অভিযোগের একটি মামলায় ২০১০ সালের ২৯শে জুন জামায়াতের আমীর মাওলানা মতিউর রহমান নিজামীকে গ্রেপ্তার দেখানো হয়। একই বছরের ২রা আগস্ট তাকে মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে ‘শোন এরেস্ট’ দেখায় পুলিশ। ২০১১ সালের ১১ই ডিসেম্বর নিজামীর বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগ ট্রাইব্যুনালের রেজিস্ট্রার বরাবর দাখিল করে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থা। এ বিষয়ে ৩৩৬ পৃষ্ঠার তদন্ত প্রতিবেদন ও আনুষঙ্গিক নথিপত্রসহ প্রায় ৩ হাজার পৃষ্ঠার ডকুমেন্ট তৈরি করা হয় তার বিরুদ্ধে। ২০১২ সালের ৯ই জানুয়ারি নিজামীর বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের ১৫টি অভিযোগে গঠিত অভিযোগপত্র আমলে নেন ট্রাইব্যুনাল-১। এই মামলায় নিজামীর বিরুদ্ধে ২০১২ সালের ২৬শে আগস্ট থেকে ২০১৩ সালের শেষ সময় পর্যন্ত প্রায় ১৭ মাসে ৩০ জন সাক্ষী সাক্ষ্য দিয়েছেন। তবে রাষ্ট্রপক্ষের সপ্তম সাক্ষী প্রদীপ কুমার দেবকে বৈরী সাক্ষী হিসেবে জেরা করেন প্রসিকিউশনের কৌঁসুলিরা। নিজামীর পক্ষে সাফাই সাক্ষ্য দেয়ার জন্য ১০ হাজার ১১১ জন সাক্ষীর তালিকা দেয়া হয়। সাক্ষীদের দীর্ঘ তালিকা জমা দেয়া হলেও পরে আসামিপক্ষ ২৫ জন সাক্ষীর সাক্ষ্যগ্রহণের জন্য ট্রাইব্যুনাল ১ এ আবেদন করেন। কিন্তু ট্রাইব্যুনাল তা নাকচ করে সর্বোচ্চ ৪ জন সাফাই সাক্ষী হাজিরের জন্য অনুমতি দেন। গত বছরের ৩রা নভেম্বর থেকে ৬ই নভেম্বর পর্যন্ত রাষ্ট্রপক্ষে প্রসিকিউটর সৈয়দ হায়দার আলী, মোহাম্মদ আলী ও ব্যারিস্টার তুরিন আফরোজ চারদিন নিজামীর বিরুদ্ধে দাখিলকৃত অভিযোগ, সাক্ষীদের জবানবন্দি ও আইনি বিষয়ে তাদের যুক্তি উপস্থাপন শেষ করেন। রাষ্ট্রপক্ষের যুক্তিতর্ক উপস্থাপন শেষে ট্রাইব্যুনাল এক আদেশে ৬, ৭, ১০ ও ১১ই নভেম্বর চার কার্যদিবসে আসামিপক্ষকে তাদের যুক্তি উপস্থাপনের জন্য সময় বেঁধে দেয়। নিজামীর পক্ষে ৭ই নভেম্বর যুক্তি উপস্থাপন শুরু করেন তার আইনজীবী মিজানুল ইসলাম। পরে হরতালের অজুহাতে বাকি কার্যদিবসে নিজামীর আইনজীবীরা ট্রাইব্যুনালে হাজির হননি। তিন কার্যদিবস অপেক্ষার পর ১৩ই নভেম্বর যুক্তিতর্ক অসমাপ্ত রেখে এই মামলার বিচার কার্যক্রম সমাপ্ত ঘোষণা করে রায়ের জন্য অপেক্ষাধীন (সিএভি) রাখেন ট্রাইব্যুনাল। একই সঙ্গে আসামিপক্ষের আইনজীবীদের তাদের অসমাপ্ত যুক্তি লিখিত আকারে ট্রাইব্যুনালে পেশ করার জন্যও নির্দেশ দেয়া হয়। ১৭ই নভেম্বর আসামিপক্ষের আইনজীবীদের রিভিউ আবেদন মঞ্জুরের মাধ্যমে বিচার কার্যক্রম আবারও শুরু হয়। ১৭ ও ১৮ই নভেম্বর নিজামীর পক্ষে এডভোকেট মিজানুল ইসলাম ও এডভোকেট তাজুল ইসলাম অভিযোগ ও সাক্ষ্যগ্রহণের বিভিন্ন অসঙ্গতি তুলে ধরে তাদের যুক্তি উপস্থাপন শেষ করেন। ২০শে নভেম্বর (রিভাইটাল) পাল্টা যুক্তি শেষ হয়। ওই দিনই এক আদেশে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ এর চেয়ারম্যান বিচারপতি এটিএম ফজলে কবীর নিজামীর বিরুদ্ধে মামলার রায় দ্বিতীয়বারের মতো অপেক্ষমাণ রাখেন। ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান পদে নতুন বিচারপতি হিসেবে এম ইনায়েতুর রহিম দায়িত্বভার গ্রহণ করে নতুন ভাবে এই মামলার যুক্তিতর্ক উপস্থাপন শেষে চলতি বছরের ২৩শে মার্চ এই মামলার রায় আবারও অপেক্ষমাণ রাখেন।
৩ দিনের হরতাল জামায়াতের
আজ এবং আগামী রোববার ও সোমবার ৭২ ঘণ্টার হরতালের ডাক দিয়েছে জামায়াতে ইসলামী। গতকাল আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে দলের আমীর মাওলানা মতিউর রহমান নিজামীর মৃত্যুদণ্ডাদেশ ঘোষণার পর দলের এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এ হরতালের ঘোষণা দেয়া হয়। বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, আজ ভোর ছয়টা থেকে পরবর্তী ২৪ ঘণ্টা এবং রোববার ভোর ছয়টা থেকে পরবর্তী ৪৮ ঘণ্টা হরতাল পালিত হবে। এম্বুলেন্স, লাশবাহী গাড়ি, হাসপাতাল, ফায়ার সার্ভিসের গাড়ি হরতালের আওতামুক্ত থাকবে বলে জানানো হয়েছে। এছাড়া, কাল শুক্রবার সারা দেশে দোয়া দিবস ও শনিবার বিক্ষোভ কর্মসূচি পালন করার কথাও জানানো হয়। দলের ভারপ্রাপ্ত আমীর মকবুল আহমাদ ও ভারপ্রাপ্ত সেক্রেটারি জেনারেল ডা. শফিকুর রহমান এক বিবৃতিতে বলেন, মাওলানা নিজামীকে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত করায় দেশবাসী বিস্মিত, হতবাক ও গভীরভাবে মর্মাহত। এ রায়ে মাওলানা নিজামী ন্যায়বিচার থেকে বঞ্চিত হয়েছেন। দেশবাসী এ রায় প্রত্যাখ্যান করছে। এ রায়ের বিরুদ্ধে মাওলানা নিজামী উচ্চ আদালতে আপিল করবেন। উচ্চ আদালত ন্যায়বিচার নিশ্চিত করলে মাওলানা নিজামী অবশ্যই বেকসুর খালাস পাবেন বলে আমরা গভীরভাবে বিশ্বাস করি। বিবৃতিতে বলা হয়, সরকার রাজনৈতিক প্রতিহিংসা চরিতার্থ করার জন্য মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারের নামে জামায়াতে ইসলামীর নেতৃবৃন্দকে হত্যার পরিকল্পনা গ্রহণ করে। তারা বলেন, শুরু থেকেই সরকার এই বিচার কার্যক্রমকে বিভিন্নভাবে প্রভাবিত করার অপচেষ্টা চালায়। ট্রাইব্যুনাল গঠন হওয়ার পর পরই ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যানের সঙ্গে তদানীন্তন আইনমন্ত্রীর বৈঠক, পরে স্কাইপ কেলেঙ্কারি, ট্রাইব্যুনালের গেট থেকে সাক্ষী অপহরণ, মামলার রায়ের দিন-তারিখ ঘোষণা করে সরকার ও সরকারদলীয় নেতৃবৃন্দের বক্তব্য থেকে প্রতীয়মান হয় যে, ট্রাইব্যুনালের বিচার কার্যক্রমে তাদের সরাসরি নিয়ন্ত্রণ রয়েছে। তাই রায় কোনভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়।
শিবিরের প্রত্যাখ্যান
এদিকে মাওলানা মতিউর রহমান নিজামীর রায়কে প্রত্যাখ্যান করেছে ছাত্রশিবির। গতকাল সংগঠনের সভাপতি আবদুল জব্বার ও সেক্রেটারি জেনারেল আতিকুর রহমান বলেন, নির্ধারিত ছকে রাজনৈতিক প্রতিহিংসামূলক মামলায় যে প্রহসনের রায় দেয়া হয়েছে তা ট্রাইব্যুনালের বক্তব্যে আবারও প্রমাণ হয়েছে। রাজনৈতিক এই রায় ন্যায়বিচারের ইতিহাসকে কলঙ্কিত করেছে। এ রায় জামায়াতকে নেতৃত্বশূন্য করার ষড়যন্ত্রেরই অংশ যা ট্রাইব্যুনালের রাজনৈতিক বক্তব্যের মাধ্যমে প্রমাণ হয়েছে। দেশ-বিদেশের বিবেকবান কেউ এ রায় মেনে নিতে পারে না। আমরা এ সাজানো রায় ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করছি। তারা বলেন, মাওলানা নিজামীর বিরুদ্ধে মামলা এবং সাক্ষী ছিল সাজানো যা সরকার পক্ষের অন্যতম সাক্ষী নান্নু মিয়ার গোপন ভিডিও প্রকাশ হওয়ার মাধ্যমে প্রমাণ হয়েছে। ট্রাইব্যুনাল বীর মুক্তিযোদ্ধাদের সাক্ষ্যকে কোন মূল্যায়ন না করে আত্মস্বীকৃত ভাড়াটে সাক্ষীদের মিথ্যাচারকে গ্রহণ করেছে। তাছাড়া, ট্রাইব্যুনাল বলেছে, ‘মাওলানা নিজামীর গাড়িতে জাতীয় পতাকা দেয়া ঠিক হয়নি, রায়ে জনমতের ইচ্ছার প্রকাশ পেয়েছে’- যা সরাসরি আওয়ামী লীগ নেতাদের বক্তব্যের প্রতিফলন। এমন বক্তব্য কোন নিরপেক্ষ বিচারপতি বা ট্রাইব্যুনাল দিতে পারে না। সুতরাং এ রায় যে আওয়ামী লীগ এবং তাদের দোসরদের সাজানো ছকে দেয়া হয়েছে তাতে কোন সন্দেহ নেই।
No comments