ফারুকীর ‘পিঁপড়াবিদ্যা’ ও সমাজ-বাস্তবতা by ড. মাহফুজ পারভেজ
মসাময়িক সমাজ-বাস্তবতার যথার্থ উপস্থাপন হয়েছে জনপ্রিয় পরিচালক মোস্তফা সরয়ার ফারুকীর সাম্প্রতিক ‘পিঁপড়াবিদ্যা’ চলচ্চিত্রে লাভ ও লোভের জীবনে পিপীলিকার মতো আগ্রাসী মানবসত্তা বর্তমান সময় ও সমাজ বাস্তবতায় উদ্ভাসিত হয়েছে। কাহিনীর প্রয়োজনে পাত্র-পাত্রীর মনঃসমীক্ষণে বেকার যুবকের উচ্চাশা, নায়িকার গোপন জীবন ইত্যাকার বিষয় এসেছে। এসেছে আধুনিক প্রযুক্তি, মোবাইল ফোন, নেট ইত্যাদির বিকৃত ও অপব্যবহারের বিষয়ও। যেমনটি ফারুকী আগের বিভিন্ন চলচ্চিত্রে লিভটুগেদারসহ নানা সামাজিক অবক্ষয়, যৌন অবদমন ও তারুণ্যের গুপ্ত বা প্রকাশ্য জীবনের ধারাভাষ্য চলচ্চিত্রায়িত করার ক্ষেত্রেও সফলভাবে প্রয়োগ করেছেন। ফারুকীর কৃতিত্ব হলো সমাজের প্রকৃত পরিস্থিতিকে অনুধাবন। উট পাখির মতো মরুবালিকে চোখ-মুখ ঢেকে রাখলেও বাংলাদেশের মুক্তবাজার অর্থনীতিতে তীব্র বেগে ধাবমান ভোগ্যপণ্যবাদ তরুণ প্রজন্মকে কোথায় নিয়ে চলেছে, সে কথা আজ আর লুকিয়ে রাখা যাচ্ছে না। জীবন-যাপনের চাহিদার পাগলা ঘোড়ায় চড়ে বৈধ আর অবৈধের সংজ্ঞাও অনেকে মনে রাখছেন না; বিশ্বাস বা মান্য করছেন না। এই বেপোরোয়া, উদভ্রান্ত, ভোগ-কাম-মোহ সর্বস্ব জীবন পরিশেষে হতাশা ডেকে আনছে; কিংবা খুন, হত্যা, আত্মহত্যা, পরকীয়া ইত্যাদির মতো অপরাধের কারণ হচ্ছে। অভিভাবক, পরিবার-পরিজন, সামাজিক ও রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ এবং সমাজতাত্ত্বিকরা তরুণ প্রজন্মের এই নেতিবাচক পরিবর্তনের কুফল নিয়ে এখনও সতর্ক হচ্ছেন না বা এ বিষয়ে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে মানুষ ও সমাজকে সতর্কও করছেন না। বরং সবাই যেন না-দেখার ভান করে এমন একটি স্পর্শকাতর ও নাজুক বিষয়কে এড়িয়ে যাচ্ছেন। পরিচালক হিসেবে ফারুকীর কৃতিত্ব হলো সঠিক বিষয়টিকে ধরতে পারা এবং সেটাকে প্রয়োজনীয় নাটকীয়তা, রস ও শৈলীর মাধ্যমে উপস্থাপনা করা। এসব কারণে সিনেমা হল-বিমুখ-মানুষ তার ছবি দেখতে ভিড় করছেন এবং তার ছবি দেশে-বিদেশে পুরস্কৃতও হচ্ছে। পরিবারের সবাইকে নিয়ে একসঙ্গে এ ছবি দেখার ব্যাপারে অনেকের মধ্যে আপত্তি ও বিরোধিতা থাকলেও তার ছবির বক্তব্য ও বাস্তবতাকে অস্বীকার করা যাবে না। আশির দশকের শেষে ঢাকার নাখালপাড়ার তরুণ ফারুকীর সঙ্গে পরিচয়ের সময়ই দেখেছি চলচ্চিত্রের প্রতি তার অদম্য আগ্রহ এবং সে সময়ই তিনি সমাজ নির্ভর বিভিন্ন গল্প-উপন্যাস মন্থন করে কাহিনীর সন্ধানে মগ্ন। তারকোভস্কি তার অন্যতম প্রিয় লেখক, যার প্রসঙ্গে তিনি দিনের পর দিন আমার সঙ্গে আলোচনা করেছেন। লেখালেখিও করেছেন। তার প্রথম দিকের ছবিগুলোর ‘প্রিমিয়ার শো’তে নিয়মিত আমন্ত্রণ জানালেও চট্টগ্রামে বসবাসের সুবাদে এখন নিয়মিত যোগাযোগ রাখার বিষয়টি আর সম্ভব হয় না। তারপরেও এ কথা বলতে দ্বিধা নেই, ফারুকী কাল্পনিক ফ্যান্টাসি তৈরি করেন না; সমাজের মন্তাজ করেন শৈল্পিক দক্ষতায় এবং বাণিজ্যিক আর বিনোদনের বিষয়গুলোকে ঠিক রেখেও সমাজতাত্ত্বিক দৃষ্টিকোণকে প্রাধান্য দিয়েই চলচ্চিত্র নির্মাণ করেন। যেমনটি পশ্চিমবঙ্গে সত্যজিৎ রায়, ঋত্বিক ঘটক, মৃণাল সেন এবং হালের গৌতম ঘোষ ও ঋতুপর্ণ ঘোষ সফলভাবে করেছেন। বাংলাদেশে মূলধারা বা বিকল্পধারার চলচ্চিত্র, উভয়ই, হয়তো অতি-বাণিজ্যিক ও স্থ্থল কিংবা রোমান্টিক দার্শনিকতার দ্বারা আচ্ছন্ন; প্রকৃত সমাজ-বাস্তবতার কাছ থেকে বহুদূরবর্তী।
প্রসঙ্গত বলা ভাল, ইলেক্ট্রনিক মিডিয়ার মতো শক্তিশালী একটি বিষয়, যার মধ্যে টিভি, সিনেমা, ওয়েবসাইটসহ বর্তমানকালের যোগাযোগ মাধ্যমের প্রায়-সব কিছুই অন্তর্ভুক্ত, সেখানেও সামাজিক প্রসঙ্গ এবং প্রপঞ্চ গুরুত্বের সঙ্গে, কৃতিত্বের সঙ্গে, নান্দনিক শৈলীর সঙ্গে স্থান পায়নি বা পাচ্ছে না। আশির দশকে যে পশ্চিমবঙ্গ পাগলের মতো বাংলাদেশের নাটক দেখতো, এখন সে পশ্চিমবঙ্গের নাটকগুলো বাংলাদেশ দেখতে উন্মাদের মতো। সন্ধ্যায় কলকাতার সিরিয়াল চালু হলে কাউকেই আর পাওয়া যাচ্ছে না। সবাই টিভি’র সামনে বুঁদ! যেমনটি হুমায়ূন আহমেদের ‘এইসব দিনরাত্রি’, ‘অয়োময়’, ‘কোথাও কেউ নেই’ ইত্যাদির ক্ষেত্রে লক্ষ্য করা গিয়েছিল। এমন কি, বিটিভি’র ‘গল্প থেকে নাটক’, ‘বিদেশী গল্পের নাটক’ কিংবা সাপ্তাহিক নাটকেও আতিকুল হক চৌধুরী, মমতাজ উদ্দীন আহমদ, সেলিম আল দীন, আবদল্ল্লাহ আল মামুন, মামুনুর রশীদ যে কৃতিত্ব ও সফলতা দেখিয়েছেন, আজকে সেটাও বিরল। বাংলাদেশের অসংখ্য চ্যানেলে কি নাটক দেখাচ্ছে, সেটা গ্রাহ্যও করছে না দর্শকরা। কোন কোন চ্যানেলওয়ালারাও একচ্ছত্রতার-মনোপলি-দাপটে ‘আমার যা ইচ্ছা, তা-ই দেখাবো’-মার্কা উন্নাসিকতায় আজেবাজে নাটক দেখিয়ে সংস্কৃতির মান এবং দর্শক রুচির বারোটা বাজাচ্ছেন। অনেক ক্ষেত্রেই প্রদর্শনী-যোগ্যতা হিসেবে নাট্য-গুণের বদলে রাজনৈতিক যোগাযোগ, অর্থের লেনদেন, যৌন সুবিধার মতো অভিযোগও উত্থাপিত হয়। ফলে সমাজ-বাস্তবতা, প্রজন্মের পরিবর্তন, সংস্কৃতি ও জীবন-যাপনের নানা অদল-বদলের ইতিবাচকতা ও নেতিবাচকতার মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ছোট বা বড় পর্দায় আসছে না। আসছে অতি স্থ্থল, সস্তা, ভাঁড়ামিপূর্ণ বিষয়-আশয়। যেখানে শেখার বদলে বিকৃত হওয়ার সুযোগই দর্শকের সামনে বেশি থাকছে। ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতায় বলতে পারি, এখন অনেকেই খবর আর গুরুত্বপূর্ণ টক শো-আলোচনা ছাড়া এখানকার চ্যানেলগুলোর অন্য কোন অনুষ্ঠান বিশেষ-একটা দেখেন না। মিডিয়া ও যোগাযোগ নিয়ে যারা কাজ করেন, তারা হয়তো এ বিষয়ে গবেষণা করে আরো অনেক তথ্য-উপাত্ত দিতে পারবেন। এবং এটা করাও দরকার। কারণ, অসংখ্য প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের সবগুলোই যেমন উন্নত ও মানসম্পন্ন নয় এবং অনেকগুলোই ‘সার্টিফিকেট বিক্রির দোকান’, তেমনি সকল চ্যানেলই সংস্কৃতির মানোন্নয়ন ও বিকাশের হাতিয়ার হিসেবে কাজ করছে, সেটা মনে করার কোন কারণ নেই! সামাজিক শিক্ষা, উন্নত মানসিকতা, ব্যক্তি ও সমাজ জীবনের ক্ষয় ও দাগ দেখিয়ে সেটাকে দূর করার কাজ সব মিডিয়া করছে না। করতে পারছেনও না। পারবেও না। কেননা, এজন্য গণতান্ত্রিক সুশাসন, আইনের নৈর্ব্যক্তিক প্রয়োগ, বহুত্ববাদ, পরমতসহিষ্ণুতার প্রতিষ্ঠা করা দরকার হবে; রাজনৈতিক হিংসা ও বলপ্রয়োগের অবসান ঘটাতে হবে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে রাজনৈতিক নেতৃত্ব, মন্ত্রী, পুলিশ, চিকিৎসক, প্রকৌশলী, শিক্ষক প্রভৃতি ব্যক্তি ও পেশার দুর্নীতি, অন্যান্য নিয়ে লেখালেখির মতোই নাটক-সিনেমা তৈরি হয় এবং সেগুলো ব্যাপক জয়প্রিয়তাও লাভ করে। আমাদের দেশে এমনটি করা কি সম্ভব হবে? হবে না। রাজনৈতিক ইস্যু বাদ দিলেও সামাজিক বা সাংস্কৃতিক ইস্যুতে নানা সমস্যার বিরুদ্ধে লেখা বা ছবি করাও এখানে দুরূহ। তারপরেও ফারুকী ‘পিঁপড়াবিদ্যা’ ছবিতে ব্যক্তি ও সমাজের কিছু কঠিন সমস্যা ও বাস্তবতাকে যেভাবে তুলে ধরতে পেরেছেন- সেটাই কয় জন পারে?
প্রসঙ্গত বলা ভাল, ইলেক্ট্রনিক মিডিয়ার মতো শক্তিশালী একটি বিষয়, যার মধ্যে টিভি, সিনেমা, ওয়েবসাইটসহ বর্তমানকালের যোগাযোগ মাধ্যমের প্রায়-সব কিছুই অন্তর্ভুক্ত, সেখানেও সামাজিক প্রসঙ্গ এবং প্রপঞ্চ গুরুত্বের সঙ্গে, কৃতিত্বের সঙ্গে, নান্দনিক শৈলীর সঙ্গে স্থান পায়নি বা পাচ্ছে না। আশির দশকে যে পশ্চিমবঙ্গ পাগলের মতো বাংলাদেশের নাটক দেখতো, এখন সে পশ্চিমবঙ্গের নাটকগুলো বাংলাদেশ দেখতে উন্মাদের মতো। সন্ধ্যায় কলকাতার সিরিয়াল চালু হলে কাউকেই আর পাওয়া যাচ্ছে না। সবাই টিভি’র সামনে বুঁদ! যেমনটি হুমায়ূন আহমেদের ‘এইসব দিনরাত্রি’, ‘অয়োময়’, ‘কোথাও কেউ নেই’ ইত্যাদির ক্ষেত্রে লক্ষ্য করা গিয়েছিল। এমন কি, বিটিভি’র ‘গল্প থেকে নাটক’, ‘বিদেশী গল্পের নাটক’ কিংবা সাপ্তাহিক নাটকেও আতিকুল হক চৌধুরী, মমতাজ উদ্দীন আহমদ, সেলিম আল দীন, আবদল্ল্লাহ আল মামুন, মামুনুর রশীদ যে কৃতিত্ব ও সফলতা দেখিয়েছেন, আজকে সেটাও বিরল। বাংলাদেশের অসংখ্য চ্যানেলে কি নাটক দেখাচ্ছে, সেটা গ্রাহ্যও করছে না দর্শকরা। কোন কোন চ্যানেলওয়ালারাও একচ্ছত্রতার-মনোপলি-দাপটে ‘আমার যা ইচ্ছা, তা-ই দেখাবো’-মার্কা উন্নাসিকতায় আজেবাজে নাটক দেখিয়ে সংস্কৃতির মান এবং দর্শক রুচির বারোটা বাজাচ্ছেন। অনেক ক্ষেত্রেই প্রদর্শনী-যোগ্যতা হিসেবে নাট্য-গুণের বদলে রাজনৈতিক যোগাযোগ, অর্থের লেনদেন, যৌন সুবিধার মতো অভিযোগও উত্থাপিত হয়। ফলে সমাজ-বাস্তবতা, প্রজন্মের পরিবর্তন, সংস্কৃতি ও জীবন-যাপনের নানা অদল-বদলের ইতিবাচকতা ও নেতিবাচকতার মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ছোট বা বড় পর্দায় আসছে না। আসছে অতি স্থ্থল, সস্তা, ভাঁড়ামিপূর্ণ বিষয়-আশয়। যেখানে শেখার বদলে বিকৃত হওয়ার সুযোগই দর্শকের সামনে বেশি থাকছে। ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতায় বলতে পারি, এখন অনেকেই খবর আর গুরুত্বপূর্ণ টক শো-আলোচনা ছাড়া এখানকার চ্যানেলগুলোর অন্য কোন অনুষ্ঠান বিশেষ-একটা দেখেন না। মিডিয়া ও যোগাযোগ নিয়ে যারা কাজ করেন, তারা হয়তো এ বিষয়ে গবেষণা করে আরো অনেক তথ্য-উপাত্ত দিতে পারবেন। এবং এটা করাও দরকার। কারণ, অসংখ্য প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের সবগুলোই যেমন উন্নত ও মানসম্পন্ন নয় এবং অনেকগুলোই ‘সার্টিফিকেট বিক্রির দোকান’, তেমনি সকল চ্যানেলই সংস্কৃতির মানোন্নয়ন ও বিকাশের হাতিয়ার হিসেবে কাজ করছে, সেটা মনে করার কোন কারণ নেই! সামাজিক শিক্ষা, উন্নত মানসিকতা, ব্যক্তি ও সমাজ জীবনের ক্ষয় ও দাগ দেখিয়ে সেটাকে দূর করার কাজ সব মিডিয়া করছে না। করতে পারছেনও না। পারবেও না। কেননা, এজন্য গণতান্ত্রিক সুশাসন, আইনের নৈর্ব্যক্তিক প্রয়োগ, বহুত্ববাদ, পরমতসহিষ্ণুতার প্রতিষ্ঠা করা দরকার হবে; রাজনৈতিক হিংসা ও বলপ্রয়োগের অবসান ঘটাতে হবে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে রাজনৈতিক নেতৃত্ব, মন্ত্রী, পুলিশ, চিকিৎসক, প্রকৌশলী, শিক্ষক প্রভৃতি ব্যক্তি ও পেশার দুর্নীতি, অন্যান্য নিয়ে লেখালেখির মতোই নাটক-সিনেমা তৈরি হয় এবং সেগুলো ব্যাপক জয়প্রিয়তাও লাভ করে। আমাদের দেশে এমনটি করা কি সম্ভব হবে? হবে না। রাজনৈতিক ইস্যু বাদ দিলেও সামাজিক বা সাংস্কৃতিক ইস্যুতে নানা সমস্যার বিরুদ্ধে লেখা বা ছবি করাও এখানে দুরূহ। তারপরেও ফারুকী ‘পিঁপড়াবিদ্যা’ ছবিতে ব্যক্তি ও সমাজের কিছু কঠিন সমস্যা ও বাস্তবতাকে যেভাবে তুলে ধরতে পেরেছেন- সেটাই কয় জন পারে?
No comments