রাজনীতি ও পিছিয়ে পড়া সমাজ by ড. ফজলুল হক সৈকত
সভ্যতার অগ্রগতি সময়ের একটি ধারাবাহিক প্রক্রিয়া। কত দূর গেলে ঠিক সভ্যতার শীর্ষ স্পর্শ হবে, তা বলা কঠিন। তবে সমাজ এগিয়ে চলেছে। বদলাচ্ছে সভ্যতার ছবি ও দাবি। সমাজের সর্বত্র আজ রাজনীতির প্রবল ছায়া ও ছবি দৃশ্যমান। সংস্কৃতি কিংবা শিক্ষা যে রাজনীতিতে তেমন কোনো ইতিবাচক প্রবণতা তৈরি করতে পারছে না, তা অনুভব করা যায় বাংলাদেশের সাম্প্রতিক রাজনৈতিক হালচালে। এখনো এখানে চলছে গায়ের জোরের বা গোষ্ঠী-ক্ষমতার দাপট। বুদ্ধিবৃত্তিক রাজনীতির ভিত আজো আমরা নির্মাণ করতে পারিনি। আর দৃশ্যত রুগ্ণ বা অসুস্থ রাজনীতি নষ্ট করছে আমাদের জনপ্রশান-শিক্ষা-স্বাস্থ্য-যোগাযোগ-শৃঙ্খলা-মিডিয়া-অর্থনীতি-কৃষি এবং চলমান জীবনধারা। মানুষ মুখ ফুটে বলতে না পারলেও নীরবে সইছে সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় অনিরাপত্তার ভীষণ এই জ্বালা। সমাজ আজ অসহায় স্বীকার হয়েছে নেতিবাচক রাজনীতির।
আমরা জানি, রাজনীতি সমাজ-কাঠামো তৈরি করতে কিংবা রাষ্ট্রীয় নানা প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলতে সরাসরি ভূমিকা পালন করে। সমাজে নির্মাণ করে সুস্থিত ব্যবস্থাপনা। মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠা এবং নিরাপত্তা নিশ্চিত করাও রাজনীতির কাজ। মৌলিক অধিকার প্রতিষ্ঠা কিংবা মর্যাদা রাখার জন্য সব সময়ই রাজনীতি চেষ্টা করে থাকে। রাজনীতি জ্ঞান-বিজ্ঞানের একটি পরিচ্ছন্ন ও সমন্বিত প্রক্রিয়ার নাম। এই সিস্টেমকে আশ্রয় করে গড়ে ওঠে সমাজ-বিকাশের সব কলা ও কৌশল; কিন্তু সারা পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ আজ এগিয়ে চললেও বাংলাদেশের সমাজগতি পিছিয়ে পড়ছে। এর জন্য কেবল দায়ী অশুভ রাজনীতি। আমরা ভুলে গেছি সমাজ কিংবা রাষ্ট্রের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান সৃষ্টি ও লালন করে যে রাজনীতি, সেটিও একটি প্রতিষ্ঠানের নাম। তবে ধীরে ধীরে আমাদের পলিটিক্স নিজস্ব ধারা থেকে দূরে সরে পড়েছে। এখন এই ভুবনে যারা বিচরণ করছেন, তারা কেবল ব্যক্তিগত লাভ-সুবিধাকে বিবেচনায় রাখছেন। কী পেলাম আর কিভাবে পাওয়া যাবেÑ এই হলো এখনকার রাজনীতির সমকালীন মূল দর্শন। কী দিলাম আর কী কী দিতে পারিÑ এমন ভাবনা রাজনীতি থেকে হারিয়ে গেছে যেন। রাজনীতি এখন আর বর্তমান প্রজন্মের জন্য কোনো সুখবরের নাম নয়। এই প্রজন্মের একটি বিরাট অংশ হয় রাজনীতি থেকে নিজেদের দূরে রাখছে, অথবা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে ঘৃণা প্রকাশ করছে রাজনীতি সম্পর্কে। ভবিষ্যতে কোনো মেধাবী শিক্ষার্থী কিংবা কৃষক-শ্রমিক-জনতা রাজনীতির প্রতি বিপুলভাবে আকৃষ্ট হবে বলেও মনে হয় না। কাজেই বর্তমানের অশুভ-প্রবণতা রাজনীতির ভবিষ্যৎও বিনষ্ট করে দিচ্ছে বলেই মনে হয়।
জনপ্রশাসন থেকে শুরু করে আইনশৃঙ্খলার সব বাহিনী এবং রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তার প্রধান প্রকোষ্ঠ সেনাবাহিনীতে প্রবেশ করেছে রাজনীতির প্রবল প্রভাব কিংবা ছায়া। আর এমনটি এক দিনে কিংবা কোনো বিশেষ রাজনৈতিক দলের সরকারে থাকাকালীন সময়ে হয়নি। এটি গড়ে উঠেছে ধীরে ধীরে। এ দেশের সব রাজনৈতিক দলকে এর দায়ভার গ্রহণ করতে হবে। যে দল যখন সরকার পরিচালনার দায়িত্বে আসে, তারাই এসব সংস্থাকে সাজিয়ে তোলে নিজেদের সুবিধা আদায়ের সূত্র অনুযায়ী। সব সচেতন নাগরিকই স্বীকার করবেন যে, নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে পছন্দের ব্যক্তিকে নিয়োগ, প্রমোশন ও দায়িত্ব প্রদানের মধ্যে ভালো কিছু আশা করা যায় না। সিনিয়রকে অতিক্রম করে জুনিয়রকে পদোন্নতি দিলে সমাজে অসম্মান এবং ঔদ্ধত্যকেই প্রতিষ্ঠা করা হয়। ভেঙে পড়ে সামাজিক শৃঙ্খলা। ভিন্নমতের লোকদের ওএসডি করে রেখে বিরূপ সংস্কৃতি তৈরি করছে প্রশাসন বা ক্ষমতাসীন দল কিংবা জোট। বিপুলসংখ্যক যোগ্য-প্রশিক্ষিত-অভিজ্ঞ লোককে বসিয়ে রেখে সরকারি কোষাগার থেকে প্রতি বছর ব্যয় করা হচ্ছে হাজার কোটি টাকা। এটি মারাত্মক অপচয়। সরকারকে কিংবা রাষ্ট্রীয় সম্পদকে এভাবে অপচয়ের ক্ষমতা কিংবা দায়িত্ব নিশ্চয়ই কোনো রাজনৈতিক দলকে জনগণ প্রদান করে না। নির্বাচনী ইশতেহারেও কোনো দলকে আমরা এমন দাবি উত্থাপন করতে দেখিনি। কিংবা এসবের পক্ষে প্রকাশ্যে কোনো প্রচারণাও করে না তারা। রাষ্ট্রকে পঙ্গু ও দেউলিয়া করার এমন কাজে যারা লিপ্ত, তাদের আর যা-ই বলি না কেন অন্তত দেশপ্রেমিক রাজনীতিবিদ বলা চলা না। সর্বত্র তারা জেদাজেদি আর ভাগাভাগির দৌরাত্ম্য সৃষ্টি করে চলেছেন। রাষ্ট্রকে বানিয়ে তুলছেন নিজেদের সম্পত্তি। জাগিয়ে তুলছেন সামাজিক বৈষম্য। জনগণের মধ্যে প্রবলভাবে ঢুকিয়ে দিচ্ছেন চিন্তার অন্ধত্ব। অপরাধ-বিজ্ঞানের ভাষায় এমনসব কর্মকাণ্ড কিভাবে বিবেচিত হবে, তা ভবিষ্যৎই কেবল বলতে পারে।
নিয়োগ-বাণিজ্য, টেন্ডারবাজি আর স্বজনপ্রীতি ও দলীয়করণের ফলে শিক্ষাক্ষেত্র আজ অচলপ্রায়। শিক্ষিত লোকের সম্মানও সমাজ থেকে বিলুপ্ত হয়েছে বলা চলে। শিক্ষা অর্জনের চেয়ে বর্তমান প্রজন্ম বরং রাতারাতি টাকা বানানোর কৌশল রপ্তকরণে দিন-রাত ব্যস্ত। আর শিক্ষা গ্রহণ করে চাকরির বাজারে কোন কোন ক্ষেত্রে কিভাবে প্রতিযোগিতায় অংশ নেবে কিংবা পেশাগত জীবনে কিভাবে সাফল্য লাভ করা যেতে পারে এসব ব্যাপারে বিশেষ ভাবনা-চিন্তা আজো প্রবর্তন করতে পারিনি আমরা। শিক্ষার সাথে সামাজিক দায়বদ্ধতার ব্যাপারাদিও যুক্ত হয়নি। শিক্ষার বৈষম্য, সার্টিফিকেটের মানের তারতম্য, শিক্ষকের যোগ্যতার দৃশ্যমান অসামঞ্জস্য, শিক্ষার পরিবেশ ও প্রতিবেশের নিম্নগতি, গ্রন্থ ও পাঠাগারের অপ্রতুলতা, শিক্ষা-উপকরণ সরবরাহ এবং প্রযুক্তিসুবিধা নিশ্চিত করতে না পারা প্রভৃতি ঘটনা জাতির মাথায় যেন অভিশাপ হয়ে দাঁড়িয়েছে। কোচিং-বাণিজ্য, ভর্তি-আতঙ্কÑ অভিভাবকসমাজ এবং শিক্ষার্থীর মাঝে তৈরি করেছে নেতিবাচক ধারণা। অন্য দিকে, অপরিকল্পিত ইংরেজি শিক্ষার প্রভাব সমাজে বাড়িয়ে দিয়েছে দুর্নীতি-প্রবণতা ও অশুভ প্রতিযোগিতা। পারিবারিক ও সামাজিক সম্প্রীতিতে আঘাত হানছে অহেতুক ইংরেজিপ্রীতির দৃষ্টিভঙ্গি। সমাজে বিভক্তিও তৈরি করছে শিক্ষাব্যবস্থার এই নানামুখীনতা। Ñএই সব কিছুর পেছনে নীরবে শক্তিমত্তা নিয়ে অবস্থান করছে রাজনীতির অপ্রতিরোধ্য কুপ্রবৃত্তি।
চিকিৎসকদের বিরাট অংশ সেবাকে পরিহার করে ব্যবসায়ীর ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়ে পড়েছেন। সরকারি হাসপাতালের তুলনায় বেসরকারি কিনিক কিংবা প্রাইভেট চেম্বারের প্রতি তাদের আকর্ষণ বেশি। বিভিন্ন কিনিকে ঘুরে ঘুরে সকাল থেকে রাত অবধি বাণিজ্যিক ডাক্তাররা টাকার পাহাড় বানাচ্ছেন। রোগীর গলায়-পেটে আর অভিভাবকের পকেটে চালাচ্ছেন ধারালো চাকু। ছিনিয়ে নিচ্ছেন লক্ষ-কোটি টাকা। গড়ে তুলছেন বাড়ি, কিনছেন নতুন মডেলের গাড়ি। কোথাও কোথাও মেডিসিন ব্যবসায়ের অন্তরালে জেঁকে বসেছে ড্রাগ-বাণিজ্য। সমাজে ছড়িয়ে পড়ছে মাদকের সহজলভ্যতা ও প্রভাব। কেউ হয়তো বলবেন, এর পেছনেও কি রাজনীতি জড়িত? হ্যাঁ, এখানেও রয়েছে রাজনীতির ব্যর্থতা। রাজনৈতিক ব্যক্তিবর্গ, দল-গোষ্ঠী কিংবা সরকারি ব্যবস্থাপনাই পারে চিকিৎসাসেবার এই করালগ্রাস থেকে জাতিকে মুক্তি দিতে। এর জন্য দরকার পরিচ্ছন্ন ও কল্যাণমুখী নীতিমালা।
শিল্প-কারখানা এমনকি শিল্প-সংস্কৃতিই আজ আর রাজনীতির বাণিজ্য এবং বিভাজন থেকে আলাদা নয়। কারখানাগুলোতে কিংবা ন্যাশনাল-মাল্টিন্যাশনাল অফিসগুলোতে প্রবেশ করেছে রাজনীতির থাবা। ব্যবসায়ীরা সরাসরি রাজনীতিতে নাম লিখিয়ে অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক বাণিজ্যে বিস্তার করছেন প্রভাব। শ্রমিক-আন্দোলন না কমে বরং বেড়ে চলেছে। আছে বেতনভাতা ও সুযোগ-সুবিধার বিরাট বৈষম্য। আইন-প্রণেতারা প্রত্যক্ষভাবে ব্যবসায়ের সাথে জড়িয়ে পড়লে দেশের মঙ্গল কতটা আশা করা যায়, তা ভেবে দেখা দরকার। আর শিল্প-সংস্কৃতিই এখন নানাভাবে করপোরেট হাউজের নিয়ন্ত্রণে। কাজেই কলকারখানায় ও শিল্প-সাহিত্যে সৃজনশীলতা ও যোগ্যতার বিকাশ না ঘটে সম্প্রসারিত হচ্ছে রাজনৈতিক লেজুড়বৃত্তি।
মিডিয়ায়ও যেন প্রবেশ করেছে রাজনীতির প্রবল বাতাস। প্রচারমাধ্যমে নীতিমালা বা চিন্তার কিংবা মতাদর্শের পার্থক্য থাকতেই পারে; কিন্তু যখন দেখি রাজনীতিই নিয়ন্ত্রণ করছে মিডিয়ার মত ও প্রকাশধারাÑ তখন? তখন হয়তো আমাদের আর কিছুই বলার থাকে না। যেখানে রাজনৈতিক পরিচয় কিংবা দৃষ্টিভঙ্গিটি মিডিয়ার পরিকল্পনা মতো নয়Ñ বরং প্রচার হচ্ছে রাজনৈতিক দলগুলোর ধারণা অনুযায়ী, তখন আমাদের বুঝতে বাকি থাকে না যে সেখানেও ঢুকে পড়েছে সমূহ নেতিবাচকতা। রাজনীতির চিন্তাধারা অথবা দলের কর্মসূচি দেশকে এগিয়ে নিতে পারেÑ আমরা সে চিন্তায় গভীর আস্থা এবং পরিপূর্ণ বিশ্বাস রাখি। কেননা কেবল রাজনীতিই পারে সমাজকে সবপর্যায়ে ইতিবাচক প্রবাহের দিকে নিয়ে যেতে। রাষ্ট্রের অন্য দিকগুলোর নিয়ন্ত্রক রাজনীতিই বটে! কিন্তু দেশকে এগিয়ে নিতে হলে নাগরিকের ব্যক্তিগত মত, পরামর্শ, কোনো বিশেষ সমাজ-রূপান্তরকামী গোষ্ঠী বা সংস্থার মতামতÑ যারা রাজনীতির সাথে প্রত্যক্ষভাবে সম্পৃক্ত নয়, গুরুত্বসহকারে বিবেচনায় নিতে হবে। বিদ্বৎসমাজকে তাদের মতো করে চিন্তা প্রকাশের সুযোগ দিতে হবে। সরকার, রাজনৈতিক দল, মিডিয়া, পেশাজীবী, সুশীলসমাজÑ সবার অংশগ্রহণের মধ্য দিয়েই প্রতিষ্ঠিত হতে পারে সামাজিক ব্যবস্থার সুন্দর স্থিতি কিংবা বিকাশধারা।
চীন, ভুটান ও মালয়েশিয়া বর্তমানে নানা কারণে পৃথিবীতে বিবেচ্য। রাজনৈতিক সুস্থিতি, অর্থনৈতিক সংস্কার এবং জীবনধারা পরিবর্তনে ও বিকাশে তারা আন্তরিকতার সাথে অগ্রগামী। অথচ অল্প কিছু দিন আগেও এসব দেশ খুব বেশি পরিচিত ছিল না; কিন্তু এখন তারা বিশ্বরাজনীতিতে পরিচিত নাম। আজ চীন তো রীতিমতো বিশ্বরাজনীতি নিয়ন্ত্রণের দরোজার কাছাকাছি পৌঁছে গেছে। আর বর্তমানের ইউরোপ-আমেরিকা-অস্ট্রেলিয়া প্রভৃতি মহাদেশের নাগরিকগণ তো এক সময় আমাদের এই ভূমিতেই বিচরণ করেছেÑ জ্ঞান ও বাণিজ্যের প্রয়োজনে। অতঃপর তারা সামাজিক-রাজনীতিও প্রতিষ্ঠা করেছে বটে! তাদের অগ্রগতির ইতিহাস বেশি দিনের নয়; কিন্তু আমাদের রয়েছে ঐতিহ্যিক বিপুল অহঙ্কার। আছে প্রাকৃতিক সম্পদের বিপুলতা ও সৌন্দর্য। মানুষের মনের সরলতাও আমাদের অনন্য সম্পদ। তাহলে অন্যরা যদি পারে অর্থনীতি-শিক্ষা-সেবা প্রভৃতিতে অগ্রগতি ও শান্তি প্রতিষ্ঠা করতে, আমরা কেন পারছি না? সত্যি কথা বলতে কী, আমাদের অনেক কিছু থাকলেও রয়েছে সদিচ্ছার অভাব। আর তাই পিছিয়ে পড়ছে সমাজ। সব অনিরাপত্তার জন্য দায়ী আমাদেরই নেতিবাচক চিন্তা। সব কিছুতে নিজের আধিপত্য প্রতিষ্ঠার মানসিকতা ঝেড়ে ফেলে মানুষের কল্যাণের জন্য আত্মনিয়োগ করতে পারলে পরিবর্তন আসতে পারে সমাজে। বাংলাদেশের রাজনীতি হয়ে উঠুক গণমুখী ও ইতিবাচক, পিছিয়ে পড়া সমাজে প্রবাহিত হোক সামনে যাওয়ার প্রবণতাÑ এই প্রত্যাশা।
লেখক : শিক্ষাবিদ, গবেষক, সাহিত্যিক
আমরা জানি, রাজনীতি সমাজ-কাঠামো তৈরি করতে কিংবা রাষ্ট্রীয় নানা প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলতে সরাসরি ভূমিকা পালন করে। সমাজে নির্মাণ করে সুস্থিত ব্যবস্থাপনা। মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠা এবং নিরাপত্তা নিশ্চিত করাও রাজনীতির কাজ। মৌলিক অধিকার প্রতিষ্ঠা কিংবা মর্যাদা রাখার জন্য সব সময়ই রাজনীতি চেষ্টা করে থাকে। রাজনীতি জ্ঞান-বিজ্ঞানের একটি পরিচ্ছন্ন ও সমন্বিত প্রক্রিয়ার নাম। এই সিস্টেমকে আশ্রয় করে গড়ে ওঠে সমাজ-বিকাশের সব কলা ও কৌশল; কিন্তু সারা পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ আজ এগিয়ে চললেও বাংলাদেশের সমাজগতি পিছিয়ে পড়ছে। এর জন্য কেবল দায়ী অশুভ রাজনীতি। আমরা ভুলে গেছি সমাজ কিংবা রাষ্ট্রের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান সৃষ্টি ও লালন করে যে রাজনীতি, সেটিও একটি প্রতিষ্ঠানের নাম। তবে ধীরে ধীরে আমাদের পলিটিক্স নিজস্ব ধারা থেকে দূরে সরে পড়েছে। এখন এই ভুবনে যারা বিচরণ করছেন, তারা কেবল ব্যক্তিগত লাভ-সুবিধাকে বিবেচনায় রাখছেন। কী পেলাম আর কিভাবে পাওয়া যাবেÑ এই হলো এখনকার রাজনীতির সমকালীন মূল দর্শন। কী দিলাম আর কী কী দিতে পারিÑ এমন ভাবনা রাজনীতি থেকে হারিয়ে গেছে যেন। রাজনীতি এখন আর বর্তমান প্রজন্মের জন্য কোনো সুখবরের নাম নয়। এই প্রজন্মের একটি বিরাট অংশ হয় রাজনীতি থেকে নিজেদের দূরে রাখছে, অথবা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে ঘৃণা প্রকাশ করছে রাজনীতি সম্পর্কে। ভবিষ্যতে কোনো মেধাবী শিক্ষার্থী কিংবা কৃষক-শ্রমিক-জনতা রাজনীতির প্রতি বিপুলভাবে আকৃষ্ট হবে বলেও মনে হয় না। কাজেই বর্তমানের অশুভ-প্রবণতা রাজনীতির ভবিষ্যৎও বিনষ্ট করে দিচ্ছে বলেই মনে হয়।
জনপ্রশাসন থেকে শুরু করে আইনশৃঙ্খলার সব বাহিনী এবং রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তার প্রধান প্রকোষ্ঠ সেনাবাহিনীতে প্রবেশ করেছে রাজনীতির প্রবল প্রভাব কিংবা ছায়া। আর এমনটি এক দিনে কিংবা কোনো বিশেষ রাজনৈতিক দলের সরকারে থাকাকালীন সময়ে হয়নি। এটি গড়ে উঠেছে ধীরে ধীরে। এ দেশের সব রাজনৈতিক দলকে এর দায়ভার গ্রহণ করতে হবে। যে দল যখন সরকার পরিচালনার দায়িত্বে আসে, তারাই এসব সংস্থাকে সাজিয়ে তোলে নিজেদের সুবিধা আদায়ের সূত্র অনুযায়ী। সব সচেতন নাগরিকই স্বীকার করবেন যে, নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে পছন্দের ব্যক্তিকে নিয়োগ, প্রমোশন ও দায়িত্ব প্রদানের মধ্যে ভালো কিছু আশা করা যায় না। সিনিয়রকে অতিক্রম করে জুনিয়রকে পদোন্নতি দিলে সমাজে অসম্মান এবং ঔদ্ধত্যকেই প্রতিষ্ঠা করা হয়। ভেঙে পড়ে সামাজিক শৃঙ্খলা। ভিন্নমতের লোকদের ওএসডি করে রেখে বিরূপ সংস্কৃতি তৈরি করছে প্রশাসন বা ক্ষমতাসীন দল কিংবা জোট। বিপুলসংখ্যক যোগ্য-প্রশিক্ষিত-অভিজ্ঞ লোককে বসিয়ে রেখে সরকারি কোষাগার থেকে প্রতি বছর ব্যয় করা হচ্ছে হাজার কোটি টাকা। এটি মারাত্মক অপচয়। সরকারকে কিংবা রাষ্ট্রীয় সম্পদকে এভাবে অপচয়ের ক্ষমতা কিংবা দায়িত্ব নিশ্চয়ই কোনো রাজনৈতিক দলকে জনগণ প্রদান করে না। নির্বাচনী ইশতেহারেও কোনো দলকে আমরা এমন দাবি উত্থাপন করতে দেখিনি। কিংবা এসবের পক্ষে প্রকাশ্যে কোনো প্রচারণাও করে না তারা। রাষ্ট্রকে পঙ্গু ও দেউলিয়া করার এমন কাজে যারা লিপ্ত, তাদের আর যা-ই বলি না কেন অন্তত দেশপ্রেমিক রাজনীতিবিদ বলা চলা না। সর্বত্র তারা জেদাজেদি আর ভাগাভাগির দৌরাত্ম্য সৃষ্টি করে চলেছেন। রাষ্ট্রকে বানিয়ে তুলছেন নিজেদের সম্পত্তি। জাগিয়ে তুলছেন সামাজিক বৈষম্য। জনগণের মধ্যে প্রবলভাবে ঢুকিয়ে দিচ্ছেন চিন্তার অন্ধত্ব। অপরাধ-বিজ্ঞানের ভাষায় এমনসব কর্মকাণ্ড কিভাবে বিবেচিত হবে, তা ভবিষ্যৎই কেবল বলতে পারে।
নিয়োগ-বাণিজ্য, টেন্ডারবাজি আর স্বজনপ্রীতি ও দলীয়করণের ফলে শিক্ষাক্ষেত্র আজ অচলপ্রায়। শিক্ষিত লোকের সম্মানও সমাজ থেকে বিলুপ্ত হয়েছে বলা চলে। শিক্ষা অর্জনের চেয়ে বর্তমান প্রজন্ম বরং রাতারাতি টাকা বানানোর কৌশল রপ্তকরণে দিন-রাত ব্যস্ত। আর শিক্ষা গ্রহণ করে চাকরির বাজারে কোন কোন ক্ষেত্রে কিভাবে প্রতিযোগিতায় অংশ নেবে কিংবা পেশাগত জীবনে কিভাবে সাফল্য লাভ করা যেতে পারে এসব ব্যাপারে বিশেষ ভাবনা-চিন্তা আজো প্রবর্তন করতে পারিনি আমরা। শিক্ষার সাথে সামাজিক দায়বদ্ধতার ব্যাপারাদিও যুক্ত হয়নি। শিক্ষার বৈষম্য, সার্টিফিকেটের মানের তারতম্য, শিক্ষকের যোগ্যতার দৃশ্যমান অসামঞ্জস্য, শিক্ষার পরিবেশ ও প্রতিবেশের নিম্নগতি, গ্রন্থ ও পাঠাগারের অপ্রতুলতা, শিক্ষা-উপকরণ সরবরাহ এবং প্রযুক্তিসুবিধা নিশ্চিত করতে না পারা প্রভৃতি ঘটনা জাতির মাথায় যেন অভিশাপ হয়ে দাঁড়িয়েছে। কোচিং-বাণিজ্য, ভর্তি-আতঙ্কÑ অভিভাবকসমাজ এবং শিক্ষার্থীর মাঝে তৈরি করেছে নেতিবাচক ধারণা। অন্য দিকে, অপরিকল্পিত ইংরেজি শিক্ষার প্রভাব সমাজে বাড়িয়ে দিয়েছে দুর্নীতি-প্রবণতা ও অশুভ প্রতিযোগিতা। পারিবারিক ও সামাজিক সম্প্রীতিতে আঘাত হানছে অহেতুক ইংরেজিপ্রীতির দৃষ্টিভঙ্গি। সমাজে বিভক্তিও তৈরি করছে শিক্ষাব্যবস্থার এই নানামুখীনতা। Ñএই সব কিছুর পেছনে নীরবে শক্তিমত্তা নিয়ে অবস্থান করছে রাজনীতির অপ্রতিরোধ্য কুপ্রবৃত্তি।
চিকিৎসকদের বিরাট অংশ সেবাকে পরিহার করে ব্যবসায়ীর ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়ে পড়েছেন। সরকারি হাসপাতালের তুলনায় বেসরকারি কিনিক কিংবা প্রাইভেট চেম্বারের প্রতি তাদের আকর্ষণ বেশি। বিভিন্ন কিনিকে ঘুরে ঘুরে সকাল থেকে রাত অবধি বাণিজ্যিক ডাক্তাররা টাকার পাহাড় বানাচ্ছেন। রোগীর গলায়-পেটে আর অভিভাবকের পকেটে চালাচ্ছেন ধারালো চাকু। ছিনিয়ে নিচ্ছেন লক্ষ-কোটি টাকা। গড়ে তুলছেন বাড়ি, কিনছেন নতুন মডেলের গাড়ি। কোথাও কোথাও মেডিসিন ব্যবসায়ের অন্তরালে জেঁকে বসেছে ড্রাগ-বাণিজ্য। সমাজে ছড়িয়ে পড়ছে মাদকের সহজলভ্যতা ও প্রভাব। কেউ হয়তো বলবেন, এর পেছনেও কি রাজনীতি জড়িত? হ্যাঁ, এখানেও রয়েছে রাজনীতির ব্যর্থতা। রাজনৈতিক ব্যক্তিবর্গ, দল-গোষ্ঠী কিংবা সরকারি ব্যবস্থাপনাই পারে চিকিৎসাসেবার এই করালগ্রাস থেকে জাতিকে মুক্তি দিতে। এর জন্য দরকার পরিচ্ছন্ন ও কল্যাণমুখী নীতিমালা।
শিল্প-কারখানা এমনকি শিল্প-সংস্কৃতিই আজ আর রাজনীতির বাণিজ্য এবং বিভাজন থেকে আলাদা নয়। কারখানাগুলোতে কিংবা ন্যাশনাল-মাল্টিন্যাশনাল অফিসগুলোতে প্রবেশ করেছে রাজনীতির থাবা। ব্যবসায়ীরা সরাসরি রাজনীতিতে নাম লিখিয়ে অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক বাণিজ্যে বিস্তার করছেন প্রভাব। শ্রমিক-আন্দোলন না কমে বরং বেড়ে চলেছে। আছে বেতনভাতা ও সুযোগ-সুবিধার বিরাট বৈষম্য। আইন-প্রণেতারা প্রত্যক্ষভাবে ব্যবসায়ের সাথে জড়িয়ে পড়লে দেশের মঙ্গল কতটা আশা করা যায়, তা ভেবে দেখা দরকার। আর শিল্প-সংস্কৃতিই এখন নানাভাবে করপোরেট হাউজের নিয়ন্ত্রণে। কাজেই কলকারখানায় ও শিল্প-সাহিত্যে সৃজনশীলতা ও যোগ্যতার বিকাশ না ঘটে সম্প্রসারিত হচ্ছে রাজনৈতিক লেজুড়বৃত্তি।
মিডিয়ায়ও যেন প্রবেশ করেছে রাজনীতির প্রবল বাতাস। প্রচারমাধ্যমে নীতিমালা বা চিন্তার কিংবা মতাদর্শের পার্থক্য থাকতেই পারে; কিন্তু যখন দেখি রাজনীতিই নিয়ন্ত্রণ করছে মিডিয়ার মত ও প্রকাশধারাÑ তখন? তখন হয়তো আমাদের আর কিছুই বলার থাকে না। যেখানে রাজনৈতিক পরিচয় কিংবা দৃষ্টিভঙ্গিটি মিডিয়ার পরিকল্পনা মতো নয়Ñ বরং প্রচার হচ্ছে রাজনৈতিক দলগুলোর ধারণা অনুযায়ী, তখন আমাদের বুঝতে বাকি থাকে না যে সেখানেও ঢুকে পড়েছে সমূহ নেতিবাচকতা। রাজনীতির চিন্তাধারা অথবা দলের কর্মসূচি দেশকে এগিয়ে নিতে পারেÑ আমরা সে চিন্তায় গভীর আস্থা এবং পরিপূর্ণ বিশ্বাস রাখি। কেননা কেবল রাজনীতিই পারে সমাজকে সবপর্যায়ে ইতিবাচক প্রবাহের দিকে নিয়ে যেতে। রাষ্ট্রের অন্য দিকগুলোর নিয়ন্ত্রক রাজনীতিই বটে! কিন্তু দেশকে এগিয়ে নিতে হলে নাগরিকের ব্যক্তিগত মত, পরামর্শ, কোনো বিশেষ সমাজ-রূপান্তরকামী গোষ্ঠী বা সংস্থার মতামতÑ যারা রাজনীতির সাথে প্রত্যক্ষভাবে সম্পৃক্ত নয়, গুরুত্বসহকারে বিবেচনায় নিতে হবে। বিদ্বৎসমাজকে তাদের মতো করে চিন্তা প্রকাশের সুযোগ দিতে হবে। সরকার, রাজনৈতিক দল, মিডিয়া, পেশাজীবী, সুশীলসমাজÑ সবার অংশগ্রহণের মধ্য দিয়েই প্রতিষ্ঠিত হতে পারে সামাজিক ব্যবস্থার সুন্দর স্থিতি কিংবা বিকাশধারা।
চীন, ভুটান ও মালয়েশিয়া বর্তমানে নানা কারণে পৃথিবীতে বিবেচ্য। রাজনৈতিক সুস্থিতি, অর্থনৈতিক সংস্কার এবং জীবনধারা পরিবর্তনে ও বিকাশে তারা আন্তরিকতার সাথে অগ্রগামী। অথচ অল্প কিছু দিন আগেও এসব দেশ খুব বেশি পরিচিত ছিল না; কিন্তু এখন তারা বিশ্বরাজনীতিতে পরিচিত নাম। আজ চীন তো রীতিমতো বিশ্বরাজনীতি নিয়ন্ত্রণের দরোজার কাছাকাছি পৌঁছে গেছে। আর বর্তমানের ইউরোপ-আমেরিকা-অস্ট্রেলিয়া প্রভৃতি মহাদেশের নাগরিকগণ তো এক সময় আমাদের এই ভূমিতেই বিচরণ করেছেÑ জ্ঞান ও বাণিজ্যের প্রয়োজনে। অতঃপর তারা সামাজিক-রাজনীতিও প্রতিষ্ঠা করেছে বটে! তাদের অগ্রগতির ইতিহাস বেশি দিনের নয়; কিন্তু আমাদের রয়েছে ঐতিহ্যিক বিপুল অহঙ্কার। আছে প্রাকৃতিক সম্পদের বিপুলতা ও সৌন্দর্য। মানুষের মনের সরলতাও আমাদের অনন্য সম্পদ। তাহলে অন্যরা যদি পারে অর্থনীতি-শিক্ষা-সেবা প্রভৃতিতে অগ্রগতি ও শান্তি প্রতিষ্ঠা করতে, আমরা কেন পারছি না? সত্যি কথা বলতে কী, আমাদের অনেক কিছু থাকলেও রয়েছে সদিচ্ছার অভাব। আর তাই পিছিয়ে পড়ছে সমাজ। সব অনিরাপত্তার জন্য দায়ী আমাদেরই নেতিবাচক চিন্তা। সব কিছুতে নিজের আধিপত্য প্রতিষ্ঠার মানসিকতা ঝেড়ে ফেলে মানুষের কল্যাণের জন্য আত্মনিয়োগ করতে পারলে পরিবর্তন আসতে পারে সমাজে। বাংলাদেশের রাজনীতি হয়ে উঠুক গণমুখী ও ইতিবাচক, পিছিয়ে পড়া সমাজে প্রবাহিত হোক সামনে যাওয়ার প্রবণতাÑ এই প্রত্যাশা।
লেখক : শিক্ষাবিদ, গবেষক, সাহিত্যিক
No comments