আধুনিকতা অনাধুনিকতা by ফরহাদ মজহার
আমি ‘আধুনিক’ নই। এর মানে এই নয় যে আমি
অনাধুনিক। কিম্বা আমি অনাধুনিকতাকে মহিমান্বিত করতে চাই। আধুনিক যুগের
আবির্ভাবের আগে প্রাক-আধুনিক যুগ নামক যদি কিছু থাকে সেখানে প্রত্যাবর্তন
করার ইচ্ছা বা সংকল্প কোনোটিই আমার রাজনীতি না। আমি কোথাও প্রত্যাবর্তন
করছি না, ফিরছি না; বরং আধুনিকতা/অনাধুনিকতার বিভাজন অতিক্রমের চেষ্টা
করছি। যে কারণে আমি আধুনিকতা বনাম অনাধুনিকতা এই দুইয়ের একটিকে মহিমান্বিত
করে অপরটির বিরুদ্ধে দাঁড়াই না। বরং চিন্তা ও চর্চার যে অভ্যাস এই ধরনের
বিভাজন তৈরি করে, সেই অভ্যাস থেকে নিজেকে মুক্ত রাখতে চাই। চিন্তা যেন
সপ্রাণ ও সজীব থাকার চেষ্টায় বিরতি দিয়ে কোনো একটা ‘মত’ বা বদ্ধমূল
সিদ্ধান্তে পর্যবসিত না হয় সেটাই আমার সাধনা। চিন্তায় বিরতি না দেয়াই
বিভাজনের ফাঁদে পা না দেয়ার প্রধান শর্ত। এ ধরনের বিভাজনের মধ্যে নিজের
তৈরি কাদাজলে খাবি খেতে চাই না। সেই বিপদ থেকে নিজেকে সন্তর্পণে রা করে
ভাবতে চেষ্টা করি মানবেতিহাসের গন্তব্য ভিন্ন কোনো জায়গা থেকে ভাবা সম্ভব
কি না। গন্তব্য আগাম নির্ণয় করে নিচ্ছি না, বর্তমানে বসে বর্তমানের মধ্যেই
সম্ভাবনা বিচার করতে চাইছি। আমরা যা হয়েছি আর যে দিকে যাচ্ছি, সেটা তো
বুঝতেই পারছি। পুঁজিতান্ত্রিক বিশ্বব্যবস্থার মধ্যে কী হয়েছি, আর কোনো দিকে
যাচ্ছি সেটা বোঝার পর যারা মনে করেন পুঁজিতান্ত্রিক বিশ্বব্যবস্থাই
মানুষের একমাত্র নিয়তি, আমি তাদের কাতারে না। শুধু যুক্তি বা ইতিহাস বিচার
করে নয়, এমনকি আমার নিজের স্বভাবের ভেতর থেকে কেউ একজন নিরন্তর বলতে থাকে
পুঁজিতান্ত্রিক সম্পর্কের মধ্যে মানুষের যে রূপ আমি দেখছি সেটাই তার শেষ
অবস্থা নয়। মানুষের এই দুর্দশা কেন সেটা বুঝতেই আমি ধর্ম, দর্শন,
অর্থশাস্ত্র, বিজ্ঞান ইত্যাদির দ্বারস্থ হই। এই সকল শাস্ত্র পাঠে এতটুকু
অনায়াসেই বুঝি এটাই মানুষের নিয়তি এটা বিশ্বাস করা কঠিন। তাই ভাবতে চেষ্টা
করি, যে পথ মানুষকে এই দুর্শার পথে নিয়ে এসেছে সে পথ পরিহার করে ভিন্ন পথ
নেবার সম্ভাবনা মানুষের মধ্যে আছে কি? যদি থাকে তাহলে তা কিভাবে বিরাজ করে।
কিভাবে তার রূপায়ন বা বাস্তবায়ন সম্ভব। এই বিবেচনা থেকেই বারবারই আমি
বৈপ্লবিক চিন্তা-চেতনার রণনীতি ও রণকৌশলে আগ্রহান্বিত হই। এত দিন মানুষের
অপার সম্ভাবনায় আমার আস্থা যেহেতু কমে নি, বরং বেড়েছে, অতএব যে কোনো
বৈপ্লবিক রূপান্তরের আকাক্সায় আলোড়িত না হওয়া আমার পে অসম্ভব। অতএব বর্তমান
‘আধুনিক’ যুগই মানুষের শেষ গন্তব্য, আর এখানেই ইতিহাসের শেষ ইস্টিশান এটা
আমি মানি না। কিন্তু ‘না’ বললে সমস্যা মেটে না, বাড়ে। প্রশ্ন হচ্ছে এই
যুগকে অতিক্রম করে যাবার ত্রেগুলো শনাক্ত করব কিভাবে?
দুই.
পুঁজিতান্ত্রিক আধুনিক বিশ্বব্যবস্থার এই যুগকে অতিক্রম করতে হলে প্রথমেই দরকার পুরানা চিন্তার অভ্যাস ত্যাগ করা। পুরানা চিন্তার অর্থ হচ্ছে আধুনিক ও অনাধুনিকতার বিভাজনকে বিচারের মানদণ্ড জ্ঞান করে আধুনিকতার পে সাফাই গাওয়া। চিন্তাহীনতার এরচেয়ে আর ভালো নজির হতে পারে না, যা সামনে হাজির তাকেই নির্বিচারে গ্রহণ করার চেয়ে অজ্ঞানতা বা জাহেলি আর কিছুই হতে পারে না। পরীা-নিরীার, উদ্ভাবনের কিম্বা নতুন ভাবে চিন্তা করবার কোনো দায় নেই। চিন্তায় বিরতি দিয়ে যে মত সমাজে প্রবল তাকেই সত্য বলে নির্বিচারে মেনে নেয়ার চিন্তাশীলের কাজ হতে পারে না। নতুন ভাবে চিন্তা নিছকই দর্শনের প্রশ্ন নয়। সরাসরি রাজনীতিরও প্রশ্ন। কী করতে হবে তার হদিস চিন্তাশীল ভাবনাই দিতে সম। কোনো আগাম বানানো মতাদর্শ, ছক বা পাথরে খোদাই করা কর্মসূচি নয়।
যারা গন্তব্য আগাম নির্ণয় (teleology) করে ভবিষ্যৎ নিয়ে ভাবাকে দার্শনিক কারণে গ্রহণযোগ্য মনে করেন না, তাদের কাছে একই প্রশ্ন ভিন্ন ভাবে তোলা যাতে পারে। যেমন, নিজেদের বিগত ইতিহাসের ফল হিসাবে আমরা এখন যেভাবে নিজেদের দেখছি, জানছি বা বুঝছি এটাই মানুষের সর্বশেষ রূপান্তর কি না। পুঁজিতান্ত্রিক সম্পর্ক আমাদের ইচ্ছা-অনিচ্ছার বাইরে আমাদের নিরন্তর তৈয়ারি করছে। পুঁজির ইচ্ছা হয়ে উঠছে আমাদের ইচ্ছা ও সংকল্প। টেলিভিশনের বিজ্ঞাপন হয়ে উঠছে আমাদের কামনা, বাসনা ইত্যাদি। আমাদের অজান্তে টেকনলোজি আমাদের ইন্দ্রিয়, বুদ্ধি ও চিন্তার ধরন বদলে দিচ্ছে; মতা কখনো রাষ্ট্রের রূপ নিয়ে, কখনো মতাদর্শের বোঝা চাপিয়ে দিয়ে মাথা ধোলাই করছে; দৈনন্দিন জীবনের আরো নানান কারিগরি ও কারবারের মধ্য দিয়ে আমরা বদলে যাচ্ছি। আমরা কি টের পাই? বুঝি?
এই পরিস্থিতিতে ‘মানুষ’ নামক ভিন্ন কোনো কর্তাসত্তার চিন্তা সম্ভব কি না, সেটা আমি ভাবি। এমন এক কর্তা যে বিদ্যমান ব্যবস্থার বাইরে দাঁড়িয়ে ইতিহাস ও বর্তমানকে বিচার করতে পারে? কী ‘আছে’ আর কী করা ‘উচিত’ এই দুইয়ের মধ্যে ফারাক করতে সম হয় যেন বর্তমান থেকে বেরিয়ে গিয়ে নতুন বর্তমান নির্মাণ করা মানুষের পে সম্ভবপর সেটা সে প্রমাণ করতে পারে। শুধু জ্ঞানের কর্তার কথা বলছি না, ইতিহাসের কর্তা মানে কী, সেটাই আমি বুঝতে চাই।
তিন.
এই ধরনের কর্তাসত্তার অনুমান করা এবং বাস্তবে তার আবির্ভাব নিশ্চিত করা সহজ নয়। কথাগুলো তুলছি এ কারণে যে অনেকেই বিদ্যমান ব্যবস্থার বাইরে দাঁড়িয়ে বিদ্যমান ব্যবস্থার বিচার এমন তার রূপান্তর ঘটাতে সম এমন কর্তাসত্তার অস্তিত্ব সম্ভব এটা মানতে রাজি না। একদল মনে করে মানুষের বৈষয়িক জীবন বা বিদ্যমান ব্যবস্থাই মানুষ কী করতে পারে বা না পারে তা নির্ধারণ করে। এই েেত্র তার বৈষয়িক বা রক্তমাংসের অস্তিত্বের বাইরে এমন কোনো সত্তা নাই যে বিদ্যমান ব্যবস্থার বাইরে গিয়ে রূপান্তরের জন্য লড়তে সম। আমি মনে করি বৈপ্লবিক কর্তাসত্তা শুধু বিদ্যমান ব্যবস্থার দ্বন্দ্ব-সংঘাত থেকে তৈয়ার হয়, এই অনুমানকে পর্যালোচনার অধীন করা জরুরি। কথাটার মানে বোঝা জরুরি একটি কাজ। বৈপ্লবিক কর্তাসত্তার উদ্ভব ও চরিত্র আমার আগ্রহের বিষয়। তাকে যেমন, বস্তু ও বিষয়জ্ঞানে ইহলোকিকতার মাপজোখ দিয়ে নির্ণয় করা অসম্পূর্ণ মনে হয়, তেমনি বর্তমান দ্বন্দ্ব-সংঘাতের মধ্য দিয়ে তার আবির্ভাব কোনো বিধিবিধান মেনে চলে এটা মেনে নেওয়াও কঠিন। এই এক আধ্যাত্মিকতা যাকে ধর্মতত্ত্ব দিয়ে বোঝা যেমন কঠিন, অন্য দিকে ইতিহাস ও সমাজতত্ত্ব দিয়ে নির্ণয় করাও সমুদ্রের মধ্যে লবণের কণা অনুসন্ধানের মতো ব্যাপার। এ কালের দর্শন এই কর্তাসত্তাকে কোনো খাপে ফেলতে না পেরে এর নাম দিয়েছে রাজনৈতিক আধ্যাত্মিকতা (Political Spirituality)।
চার.
দাবি করা হয় আধুনিক বিশ্বব্যবস্থায় কেউ আধুনিক অথবা অনাধুনিক। হয় কেউ প্রগতির পে অথবা প্রতিক্রিয়াশীলতার। এই দুই খাপের বাইরে নাকি যাওয়া নিষেধ। তো এই নিষেধ আমি অমান্য করে চলেছি। যারা আধুনিকতার পূজারি তাদের কাছে ‘প্রগতি’র অর্থ বর্তমানকে মেনে নেওয়া। বর্তমানের বিরুদ্ধে তাদের নালিশ বা আপত্তি নেই তা নয়, কিন্তু তারা আধুনিকতার পরিমণ্ডলে সেই নালিশের মীমাংসা খোঁজে। যেখানে যেখানে আপত্তি আধুনিকতার সেই জায়গাগুলো শুদ্ধ করে নিতে চান। সেটা সংস্কারমূলক হোক কিম্বা বৈপ্লবিক কায়দায়, কিন্তু বিধান হচ্ছে আধুনিকতার গোড়ার ভিত্তি ঠিক রেখেই সেটা করতে হবে। ফলে আমি যে রাজনীতির কথা বলি সেখানে প্রগতিবাদীদের সঙ্গে যেমন মেলে না, তেমনি স্বঘোষিত প্রগতিবাদীদের মানদণ্ডে যারা প্রতিক্রিয়াশীল চিহ্নিত হয়েছেন তাদের সঙ্গেও নয়। কারণ আধুনিকতার বিরুদ্ধে অনাধুনিকতা কায়েম আমার রাজনীতি না। যে অনুমান, জ্ঞানগত ভিত্তি ও ঔচিত্যবোধ ‘আধুনিকতা’ নামক বর্তমানকে পয়দা করেছে, তাকে আমি মানুষের কাম্য জ্ঞান করি না শেষ গন্তব্য তো নয়ইÑ আমার কাজ তাকে বদলে দেওয়া। নিদেনপে আদৌ তা সম্ভব কি না সেটা যাচাই করে দেখা। তার জন্য বিভিন্ন দিক থেকে কাজ করা। অতএব ধর্ম, দর্শন, কাব্য, শিল্পকলা, গান, সিনেমা, নাটক ইত্যাদির প্রতি আমার আগ্রহ তুমুল। একই সঙ্গে বর্তমানের মুখে তুড়ি মেরে যে জীবন একা, নিঃসঙ্গ ও দ্রোহী সেই জীবনের প্রতি আমি একাত্ম বোধ করি। যদিও চোর থালা চুরি করে নিয়ে গিয়েছে চোরের ওপর রাগ করে থাকা আমার পথ নয়। আমি আজ বিরাগী নই। সমাজ আমাকে সমাজছাড়া করতে চাইলেও আমি সমাজত্যাগী হতে চাই না। অন্য দিকে দ্রোহী হতে গিয়ে নৈরাজ্যবাদীও নয়। সব কিছুতেই ‘না’ বলা, শূন্যতার পূজা বা নিহিলিস্ট হওয়া আমার ধাতে নাই। সকল প্রকার মূল্যবোধে আস্থা হারানো বা তাদের বিসর্জন দিয়ে সুপারম্যান হওয়াও আমাকে আকৃষ্ট করে না। আমার মনে হয় এ সবই চরম ব্যক্তিতান্ত্রিক সমাজের পরিণতি। কিন্তু তাই বলে আমি ব্যক্তিকে অস্বীকার করি না, ব্যক্তির আবির্ভাবও আমার কাছে এক ধরনের আধ্যাত্মিক ঘটনা বলেই মনে হয়, কারণ এই আবির্ভাবের কোনো বস্তুবাদী ব্যাখ্যা সম্ভব না। যা হাজির হয়ে গিয়েছে ও বর্তমান তাকে এখন আমি অস্বীকার করি কিভাবে? বরং যে সমাজে মানুষ একই সঙ্গে ব্যক্তি ও সামাজিক সেই সমাজের সন্ধান আমি করি। ব্যক্তিতান্ত্রিক সমাজের বিরুদ্ধে পাল্টা লড়ি। কিন্তু সে লড়াই লড়তে গিয়ে ব্যক্তির পাবলম্বনও করি। ইচ্ছা, কামনা, বাসনা, বিদ্রোহ ও নিজের জীবন অনায়াসে ঝুঁকিতে ফেলতে পারার মতাসম্পন্ন এই ব্যক্তি সে এক রহস্যময় ব্যাপার। বিস্ময় যে ব্যক্তির মধ্যেই বৈপ্লবিক কর্তাসত্তার আবির্ভাব ঘটে, যার সামাজিক ও ঐতিহাসিক হওয়ার ব্যাপারটা পরের বিষয়। অতএব সব ধরনের ব্যক্তি আমার আগ্রহের বিষয়। বিশেষত সমাজের প্রান্তে তাড়িয়ে নিয়ে গিয়ে যে মানুষগুলোকে সমাজ, আইন ও রাষ্ট্র অদৃশ্য ও অবাঞ্ছিত করে রাখেÑ আইনবহির্ভূত যাদের মেরে ফেলতে আমাদের নীতিনৈতিকতাতে বাধে নাÑ তাদের প্রতি আমার আগ্রহও চরম। রাষ্ট্র ও আইন কিভাবে আমদের জীবমাত্রে পরিণত করে, ফাঁসিতে ঝোলায়, গুলি করে লাশ বানায়, আইন ও জীবজীবনের এই মাঝখানের জমিনটুকু আমি চিন্তে চাই, অন্বেষণই আমার ধর্ম।
পাঁচ.
ঠিক। আমার বিরুদ্ধে প্রগতিবাদীদের অভিযোগের প্রধান একটি কারণ হচ্ছে ধর্ম। আমি ধর্মে উৎসাহী, আগ্রহী। ধর্ম আমার কাছে পরিত্যাগের বিষয় নয়। আধুনিকতার কালে এসে ধর্ম বা ধর্মতত্ত্ব তার গুরুত্ব হারিয়েছে, তার কিছু দেবার নাইÑ এমন আমি মনে করি না। নিজেকে যেমন নিজে ত্যাগ করতে পারি না, ধর্ম ও ধর্মতত্ত্বও তেমনি। তবে আধুনিকতার কালে ধর্মের উপস্থাপন ও তাৎপর্য ভিন্ন। ভিন্ন বলে তা ধর্ম বা ধর্মতত্ত্ব কি না নাকি নিছকই মতাদর্শ তা নিয়ে তর্ক হতে পারে। কিন্তু তারা বহাল তবিয়তেই আছে। থাকবে। একসময় দাবি করা হোত আধুনিকতার প্রাবল্যে ধর্মের লয় ঘটবে। আধুনিক হলে মানুষ বিভিন্ন কুসংস্কার থেকে মুক্ত হয়ে ধর্মের কুপ্রভাব থেকে মুক্ত হবে। ধর্মের শত্রুর মুখে ছাই দিয়ে সেটা ঘটেনি। এই ধারণার পেছনকার অনুমান হচ্ছে আধুনিকতা মানেই ধর্মহীনতা। এই অর্থে আধুনিকতার কারণে ধীরে ধীরে মানুষ যুক্তিবাদী হবে, ধর্ম শুকিয়ে মরবে। কিন্তু ধর্ম লোপ পাওয়া দূরে থাকুক, ফিরে এসেছে আরো শক্তি নিয়ে। এখন পাল্টা অভিযোগ উঠেছে খোদ ‘আধুনিকতা’ই কুসংস্কার। সংস্কারের মধ্যে কোনটা ‘কু’ আর কোনটা ‘সু’ সেই তর্ক আমার জন্য অর্থহীন। নীতিবাগিশগিরি আমার কর্তব্য না। নীতিবাদিতা মতা চর্চার অংশ। মতার বিচার ছাড়া নীতির মর্ম ঠাহর করা মুশকিল। আর সেটা করতে হলে আমাকে দর্শনে ফিরে আসতেই হয়। নতুন করে বর্তমানকে পর্যালোচনার দরকারে। মানুষের বিভিন্ন অভিজ্ঞতা পর্যালোচনা করে আমরা নিজ নিজ অবস্থান ও কর্তব্য নির্ণয় করি। আমি কিভাবে সেটা নির্ণয় করা হোল, তার অনুমান ও ভিত্তি নিয়ে প্রশ্ন তুলি। কারণ বিদ্যমান অনুমান বা চিন্তার ভিত্তির বাইরেও ভিন্ন অনুমান ও ভিত্তি থাকতেই পারে। আমার অন্বেষণ এই প্রশ্ন দিয়েই শুরু হয়।
ছয়.
আমার কাছে ধর্ম দার্শনিক অন্বেষণের বিষয় তো বটেই একই সঙ্গে রাজনীতিরও। এ ছাড়া বাংলাদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের ধর্ম ইসলাম সম্পর্কে আমার আগ্রহ থাকা খুবই স্বাভাবিক। বাংলাদেশের মানুষকে বুঝতে গেলে ইসলাম বোঝা আমার কাছে খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। আমি মনে করি, বাংলাদেশের বাস্তবতায় ইসলামের উপস্থিতির চরিত্র ও চর্চার ধরনই বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ নির্ণয় করবে। সেটা আমাদের ইচ্ছা অনিচ্ছার ওপর নির্ভর করবে না। প্রশ্ন হচ্ছে এই চর্চার চরিত্রে আমরা এমন কিছু ছাপ ফেলতে পারি কি না যা বর্তমানকে অতিক্রম করে যাবার অনুকূল হবে। সাম্রাজ্যবাদের ধ্বংস ও পুঁজিতান্ত্রিক বিশ্বব্যবস্থার বিনাশের পরে যে নতুন জগত গড়ে উঠবে এবং উঠতে বাধ্য, সেই জগতের নির্মাণে ইসলামের ভূমিকা কী হবে? কিম্বা কী হতে পারে? ইসলামের আবির্ভাব মুহূর্তে চিন্তার এমন কোনো প্রকাশ ছিল কি না যার হদিস নেয়া ছাড়া বর্তমান অতিক্রম করে যাওয়া নতুন জগতের কল্পনা অসম্ভব হয়ে ওঠে? ইসলামের রাজনৈতিক প্রস্তাব ও সংকল্পে বৈশ্বিক ও সার্বজনীন কী ছিল, যার পাশে আধুনিকতার সার্বজনীনতা ও বৈশ্বিকতাকে প্রাদেশিক দাবির অধিক কিছু মনে হয় না। কী সেই উপলব্ধি, অভিজ্ঞতা বা সত্য যা সকল প্রকার নিহিলিজমকে অসম্ভব করে তোলে? ইসলাম কিসের ‘স্যা’ দেয়? মানুষের জীবনের যদি কোনো অর্থই না থাকে তাহলে কিসের সমাজ? কিসের ইতিহাস? কিসের রাজনীতি? এই প্রশ্নগুলো গোলকায়নের এই কালে আমরা আগের চেয়েও আরো তীব্র ভাবে শুনতে পারছি, আগে প্রশ্নগুলোর তাৎপর্য এখনকার মতো স্পষ্ট ছিলনা? নিজের ইতিহাস কিম্বা ঐতিহ্য থেকে ইসলাম এই সকল প্রশ্নের মীমাংসার েেত্র কিছু যোগ করতে পারবে কি না, কিম্বা নতুন নির্মাণের ভিত্তি চেনা ও বিকশিত করে তোলার েেত্র ইসলাম আদৌ নতুন চিন্তার সহায়ক কি না সেটা খোলা মনে আমি খুঁজে দেখতে বদ্ধপরিকর। সংেেপ, আধুনিক/অনাধুনিকের বিভাজন অতিক্রম করে বাংলাদেশে ইসলাম আদৌ কোনো নতুন চিন্তা ও চর্চার দিশা দিতে পারবে কি না সেটা নিরীণ ও বোঝা। অতএব আমি আমার চিন্তা ও তৎপরতার জায়গা থেকেই জরুরি কর্তব্য বলে গণ্য করি। এতে কোনোই সন্দেহ নেই।
সাত.
আমি কার্ল মার্কসের ছাত্র। তাঁর গুরু হেগেলের কাছ থেকেই আমি শিখেছি যে ধর্ম বা ধর্মতত্ত্বের মধ্য দিয়ে যা চর্চা হয় সেটাও চিন্তা। মানুষেরই চিন্তা। ধর্মতত্ত্ব দর্শনের মতোই সমান গুরুত্বপূর্ণ চিন্তা। অবশ্যই। দর্শনের সঙ্গে তার পার্থক্য হচ্ছে তার উপস্থাপনার রূপে। অর্থাৎ মানুষের নিজ নিজ অভিজ্ঞতাকে হাজির করবার েেত্র চিন্তার নিজের একটা বিশেষ ধরন আছে; চিন্তা নিজের স্বরূপে নিজেকে হাজির না করলে শুধু ধর্ম কেন বিজ্ঞান, নীতিবিদ্যা বা রাষ্ট্রতত্ত্ব কোনো কিছুকেই ‘দর্শন’ বলা যায় না। হেগেল প্রটেস্টান্ট ধর্মকে দার্শনিক জায়গা থেকে পাঠ করেছেন। তাহলে ইসলামকে দর্শনের জায়গা থেকে বোঝার একটা কর্তব্য বাংলাদেশের জনগণের রয়েছে। সে কর্তব্যে আমি লিপ্ত আছি, থাকতে চাই। অর্থাৎ ধর্ম ও ধর্মতত্ত্ব অবশ্যই দর্শন ও রাজনীতির গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। মার্কস, লেনিন বা অ্যাঙ্গেলস কিভাবে ধর্মের মোকাবিলা করেছেন সেটা আমি ‘মোকাবিলা’ বইতে দেখাবার চেষ্টা করেছি। একে মোকাবিলা না করে সমাজের কোনো মৌলিক রূপান্তর অসম্ভব। একে কিভাবে আমরা মোকাবিলা করছি ও আমাদের ঐতিহাসিক ভূমিকা নির্মাণে আত্মস্থ করছি তার ওপর আগামী দিনের বাংলাদেশের রাজনীতি নির্ভর করবে। কিন্তু প্রগতিবাদীরা পরিশ্রমে আগ্রহী নন। তাদের ফতোয়া হচ্ছে, আমি এককালে কমিউনিস্ট ছিলাম, এখন ইসলামপন্থী হয়েছি। আমি দোষী! ঘোড়াও হাসে!!! তাই না?
মজার ব্যাপার হচ্ছে, ইসলামপন্থীদের মধ্যে যারা ধর্ম/অধর্মের বিভাজন দিয়ে জগৎ বিচার করেন তারাও তাই মনে করেন। কমিউনিজম নাস্তিক্যবাদীদের দর্শন। সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে যাবার পর কার্ল মার্কসসহ নাস্তিক্যবাদীদের জগৎ ভেঙে গিয়েছে। কমিউনিজমের ভবিষ্যৎ শেষ হয়ে গিয়েছে। তাদের অনেকে মনে করেন, আমি এক কালে কমিউনিস্ট ছিলাম। কমিউনিজমের এই দুর্দশা দেখে আমি ধর্মে প্রত্যাবর্তন করেছি। তাদের সামনে কবি আল মাহমুদের উদাহরণ আছে। তারা এর বেশি ভাবতে সম নন। তাদের আমি দোষ দেই না। আল মাহমুদকেও নয়। কারণ এর বেশি বাংলাদেশে আমরা এখনো ভাবতে পারি না। আমার দুর্ভাগ্য, দুই পই ভুল করেন, ভুল বোঝেন। সাধারণ ভাবে বাংলাদেশের চিন্তার দৈন্যতাই এর জন্য দায়ী। আধুনিকতা ও অনাধুনিকতার যে বিভাজন আমি পরিহার করি সেই একই তাগিদে ধর্মতত্ত্ব বনাম দর্শনের বিভাজনও আমি পরিহার করে চলি। অর্থাৎ চিন্তার যে অভ্যাস এই বিভাজনকে ন্যায্যতা দেয়, আমি তা স্বীকার করি না। তাহলে আধুনিকতা ও ধর্ম নিয়ে বিস্তর কথা বলার আছে। বিষয়গুলো জটিল নয়। মুশকিল হোল, দৈনিক পত্রিকার উপসম্পাদকীয় সেই সব আলোচনার প্রশস্ত ত্রে নয়। তবে প্রথাগত চিন্তা থেকে বেরিয়ে আসার অভ্যাস চর্চা না করলে এই বিষয়ে অগ্রসর হওয়া কঠিন। নিজের কৈফিয়ত হিসেবে এই কথাগুলো বলে রাখা আপাতত যথেষ্ট। তবে আধুনিকতা নিয়ে আরো দুই-একটি কথা এখানে বলা দরকার।
আট.
‘আধুনিক’ হওয়ার অর্থ নিয়ে অনেক আলোচনা হতে পারে। তবে যে অর্থের প্রতাপ সবচেয়ে বেশি সেটা হচ্ছে পাশ্চাত্যসভ্যতাকে নির্বিচারে গ্রহণ করা এবং যারা এর বিপরীতে দাঁড়ায় তাদের অসভ্য ও পশ্চাতপদ গণ্য করা। মুখে বলি বা না বলি ‘প্রগতি’র অর্থ দাঁড়ায় ইংরেজ, ইউরোপীয় বা মার্কিন হওয়ার সাধনা; তবে এই দেশগুলোর মধ্য একাট্টা একপ্রকারের সংস্কৃতি ও সভ্যতার চর্চা চলে, ব্যাপারটা তা না। কিন্তু সেভাবেই এদের দেখতে আমরা অভ্যস্ত। এই দেশগুলো বাংলাদেশের মতো অনাধুনিক (?) দেশে আধুনিকদের চিন্তাচেতনা, কল্পনা ও সংকল্পের মডেল হয়ে হাজির থাকে। চিন্তাচেতনা, পোশাক পরিচ্ছদ, গানবাজনা, খাওয়াদাওয়া, বাড়িঘর সব কিছুই পাশ্চাত্য আধুনিকতার ছকে বা মডেল মান্য করে গড়ে ওঠে। এমনকি নীতিনৈতিকতা, রাষ্ট্রব্যবস্থা ইত্যাদি সব কিছুরই প্রেরণা হয়ে দাঁড়ায় পাশ্চাত্য। আধুনিকতার সাধনা দেশে থেকে করি, কিম্বা বিদেশে পাড়ি দিয়ে তাতে বিশেষ কিছুই আসে যায় না। যারা নানান কারণে সচেতন হয়ে এর বিরোধিতা করেন, তারা আধুনিকতা, সভ্যতা ও প্রগতির ধারণা থেকে বেরিয়ে আসেন সেটা বলা যাবে না। তারা নিজের একটা ভিন্ন পরিচয় নির্মাণের চেষ্টা করেন। তার ভিত্তি হতে পারে নিজের ভাষা, সংস্কৃতি, ধর্ম, ঐতিহ্য বা অন্য কিছু। নিজেকে বিদ্যমান ব্যবস্থা থেকে আলাদা ভাবা ও নিজের ভিন্ন পরিচয় নির্মাণ ও আঁকড়ে ধরে রাখার চেষ্টা করেন তারা। তবে আধুনিকতার পরিমণ্ডলের মধ্যে থেকেই আত্মপরিচয় নির্মাণ, জাতীয়তা নির্ণয় বা শত্রুমিত্র নির্ধারণ আধুনিকতার বাইরের কোনো ব্যাপার না। আধুনিকতারই অন্তর্গত বিষয়। আধুনিকতার মধ্যে নিজেকে ভিন্ন ভাবা ও নিজের আলাদা আত্মপরিচয় নির্মাণের দুটো সম্ভাব্য পরিণতি হতে পারে। এক. আধুনিকতার পরিমণ্ডলের মধ্যে নিজের স্বার্থের জায়গা হাসিল করবার কাজেই সেটা ব্যয় করা। নিজের ভিন্নতা নিয়ে ‘আধুনিক’ হয়ে থাকা যাতে আধুনিকতার মধ্যে নিজের আর্থসামাজিক ও সাংস্কৃতিক স্বার্থ রা করা যায়। এটা পাশ্চাত্য সভ্যতাকে নির্বিচারে গ্রহণ করবারই ধারাবাহিকতা। দ্বিতীয়টি হচ্ছে, আধুনিকতা ও পাশ্চাত্যের একাট্টা বিরোধিতা। সেটা অসহায়ের আর্তি হয়ে গুমরে মরতে পারে, অথবা হান্টিংটন মার্কা সভ্যতার দ্বন্দ্ব তত্ত্বের ওপর দাঁড়িয়ে পাশ্চাত্যের বিরুদ্ধে লড়াই হয়েও উঠতে পারে। ‘রাজনৈতিক ইসলাম’ নাম দিয়ে যার বিরুদ্ধে পাশ্চাত্য সব শক্তি নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছে। সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে অনন্তযুদ্ধ হিসেবে এ কালে যা আমাদের সামনে দৃশ্যমান। ইসলামের পতাকা নিয়ে তার বিরুদ্ধে প্রতিরোধ ও পাল্টা আঘাত হানার চেষ্টাও চলছে।
নয়
প্রথম ধারাকে আমরা অনায়াসেই শনাক্ত করতে পারি। যেমন, নিজের ভাষা ও সংস্কৃতিকে আধুনিক করে তোলা ও আধুনিক পরিমণ্ডলের মধ্যে স্বীকৃতি আদায়। আধুনিক বাংলা সাহিত্য ও আধুনিক বাংলা গান যেমন দৃষ্টান্ত। তেমনি, ধর্মের আধুনিকায়ন। দাবি করা যে ধর্মের সঙ্গে আধুনিক বিজ্ঞান, প্রগতি, গণতন্ত্র, আধুনিক রাষ্ট্রব্যবস্থা ইত্যাদির কোনো বিরোধ নেই। দরকার ধর্মের সঙ্গে আধুনিকতার সঙ্ঘাতের ত্রেগুলো দূর করা। আধুনিকতাকে নয়, আধুনিকতার আলোকে ধর্মের সংস্কার করা। ইসলামকে ‘আধুনিক’ ও ‘যুগোপযোগী’ করে তোলা যেমন। তথাকথিত ‘ইসলামি সভ্যতা’র কল্পনা ও তার আধুনিক নির্মাণ; কিম্বা, আধুনিকতার আলোকে হিন্দু সভ্যতার ধারণা নির্মাণ; দাবি করা যে ‘হিন্দুত্ববাদ’ পাশ্চাত্যসভ্যতার স্বাভাবিক মিত্র (natural ally) ইত্যাদি। বিভিন্নতা ও বৈচিত্র্যের জগৎ থেকে তথাকথিত ‘সভ্যতার’ কাল পর্বে প্রবেশের পেছনে অনুমান হচ্ছে যারা সভ্যতার দাবিদার তারা অপরকে ‘অসভ্য’ বলে চিহ্নিত করতে ও তাদের অধীনস্থ করতে পারে এবং তা ন্যায্য। দেখা যাচ্ছে ‘সভ্যতার’ ধারণার মধ্যেই গোলমাল আছে। একে পরিহার করে চলাই বুদ্ধিমানের কাজ। এটা মনে রাখতে হবে তথাকথিত ‘সভ্যতা’র ধারণা আসলেই একটি আধুনিক ধারণা। এর সঙ্গে দখলদারি, উপনিবেশ স্থাপন, সাম্রাজ্যবাদ এবং এক জনগোষ্ঠীর দ্বারা অন্য জনগোষ্ঠীর দমন পীড়নের ইতিহাস জড়িত। সেই রক্তাক্ত ইতিহাস বাদ দিলে ‘পাশ্চাত্যসভ্যতা’ নামক কোনো সার্বজনীন সভ্যতার অস্তিত্ব নেই। ইতিহাস ভুলে গেলে ‘সভ্যতা’ কথাটার কোনো অর্থই দাঁড়ায় না। নিজেকে অন্যদের চেয়ে ‘সভ্য’ দাবি করার অর্থ অন্যকে বা অপরকে সামরিক ভাবে কিম্বা সার্বজনীন আইন, বিধিবিধান, নীতিনৈতিকতা কিম্বা সার্বজনীন সাংস্কৃতিক মানদণ্ডের দোহাই দিয়ে অধীনস্থ রাখার ধারাবাহিক ইতিহাস অুণœ রাখা এবং তা ন্যায্য বলে দাবি করা। সার কথা হচ্ছে যেকোনো জাতিবাদী কিম্বা সভ্যতাবাদী আত্মপরিচয় কিম্বা নিজের ধর্ম ও সংস্কৃতিকে অন্যদের চেয়ে শ্রেষ্ঠ দাবি করার রাজনীতি আধুনিকতার বাইরের কিছু না। এই সব আধুনিকতারই অন্তর্গত প্রক্রিয়ার অংশ।
দশ
আধুনিকতা বা পাশ্চাত্যসভ্যতার একাট্টা বিরোধিতার আদৌ কোনো ভবিষ্যৎ আছে কি না আমি সন্দেহ করি। বিদ্যমান কোনো ব্যবস্থার পর্যালোচনা, বিদ্যমান ব্যবস্থা থেকে নিজের দূরত্ব অনুভব করা এবং সেই ভিন্নতার উপলব্ধির (intuition) তাগিদে বিদ্যমান ব্যবস্থাকে নতুন করে জানা, বোঝা, বিশ্লেষণ করার চেষ্টা এবং তাকে রাজনৈতিক ও সামরিক ভাবে প্রতিরোধ খুবই স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। এই প্রক্রিয়া থেকে অবশ্যই মানুষের ভবিষ্যৎ চলার পথ কী হতে পারে তার বহু কিছুরই মীমাংসা হবে। কিন্তু সেটা বিদ্যমান ‘সভ্যতা’ বিলুপ্তি ও বিনাশ ঘটিয়ে বিদ্যমান সভ্যতা যাদের ‘অসভ্য’ ও ‘বর্বর’ বলে চিহ্নিত করে তাদের অধিষ্ঠিত করা কি না সে বিষয়ে সন্দেহ পোষণ করি। কারণ এই বিভাজন অতিক্রম করাই কাজ, তাকে প্রতিষ্ঠিত করা নয়। ইতিহাসের অভিমুখ সেই দিকে নয়। আধুনিকতার প বা বিপ হয়ে আমরা একালে আধুনিকতার এই কালপর্ব অতিক্রম করে যেতে পারব না। আধুনিকতার ধারণা মাথায় রেখে কোনো নতুন প্রণোদনার আবির্ভাব অসম্ভব। অথচ বিশ্বব্যবস্থার রূপান্তর নিয়ে চিন্তা ও সম্ভাব্য রাজনৈতিক নীতি ও কৌশল নিয়ে ভাবনার মানে হচ্ছে সম্পূর্ণ নতুন ভাবে চিন্তা করবার মতা অর্জন করা, যেসব বিষয় এতকাল মীমাংসিত বলে ধরে নেয়া হয়েছিল সেসব কিছুকে নির্ভয়ে প্রশ্ন করতে শেখা। বলাবাহুল্য, এটাই এ কালের রাজনীতি। এই কাজকে যদি চিন্তার পরিমণ্ডলে আমরা সীমিত রাখি তাহলে আধুনিকতার পরিমণ্ডল ভাঙা কঠিন বলেই আমরা মনে হয়। সেই দিক থেকে জালিম ব্যবস্থার বিরুদ্ধে মজলুমের লড়াইয়ের েেত্রর প্রাধান্য অনস্বীকার্য। আমার লেখায় বারবার এই দিকটির ওপর এ কারণেই আমি জোর দিয়ে থাকি। অর্থাৎ বিদ্যমান ব্যবস্থার বিরুদ্ধে লড়তে গিয়েই মানুষ নতুন ভাবে ভাবতে শেখে, অর্থাৎ সেই ভাবনাই দরকার যা একই সঙ্গে লড়াইকে তীব্র ও পরিবর্তনকে অবশ্যম্ভাবী করে তোলে। নতুন চিন্তা স্রেফ নতুন বলেই সমাজ বদলাতে পারে না, বিদ্যমান ব্যবস্থা রূপান্তরের তাগিদই মানুষকে নতুন চিন্তার প্রতি আগ্রহী করে তোলে।
এগারো
এক কালে সাম্রাজ্যবাদের অর্থনৈতিক অসাম্যের বিরুদ্ধে কমিউনিস্টরা লড়েছিলেন। এখনো লড়েন। কিন্তু এ লড়াই আধুনিকতার বিরুদ্ধে নয়। এমনকি কমিউনিজমের জন্যও নয়। সমাজতন্ত্রের জন্য। কিম্বা বলা যায়, আরো ‘আধুনিক’ হয়ে ওঠার জন্য। বাস্তবে তার যে রূপ ও নানান পরীা-নিরীা সেই পর্বের (actually existing socialism) পরিসমাপ্তি ঘটেছে। এখন সেই পর্ব আবার ফিরে আসার আর কোনোই সম্ভাবনা নাই। এটা ঠিক যে এতে কার্ল মার্কস বা বিপ্লবী রাজনীতির শিা ও অভিজ্ঞতা বাতিল হয়ে যায় নি। মার্কস পুরা মাত্রায় তার অর্থশাস্ত্র নিয়ে বহাল আছেন। প্রশ্ন ওঠে, তিনি মানবেতিহাসের যে অনিবার্য ভবিষ্যৎ অনুমান করেছিলেন, সেটাও কি তাহলে বাতিল করে দিতে হবে? আধুনিকতার অর্থনৈতিক ভিত্তি হচ্ছে পুঁজিতান্ত্রিক উৎপাদন সম্পর্ক। কিন্তু এই সম্পর্কই আবার উৎপাদন শক্তি বিকাশের পথে বাধা। এ কারণে মার্কস পুঁজিতান্ত্রিক ব্যবস্থার দ্বন্দ্ব নিরসনের কথা বলেছিলেন। এর ওপরই তাঁর কেন্দ্রীভূত নজর নিবদ্ধ ছিল। বাস্তবের সমাজতন্ত্রের ব্যর্থতার কথা বাদ দিলে আজো কমিউনিস্টদের লড়াই অর্থনৈতিক েেত্রই কেন্দ্রীভূত। সংস্কৃতি, নীতিনৈতিকতা ও রাজনীতির প্রশ্ন গৌণ। আধুনিকতার বিরোধী তারা নন, আধুনিকতার অন্তর্নিহিত অর্থনৈতিক দ্বন্দ্ব নিরসনের মধ্যেই তারা তাদের কর্তব্য নির্ধারণ করেন। এর জন্যই তারা লড়েন। যে কারণে বলা হয় কমিউনিস্ট আন্দোলন তার অনেক ইতিবাচক অর্জন সত্ত্বেও শেষ বিচারে আধুনিকতার অসম্পূর্ণ প্রকল্প বাস্তবায়নের চেষ্টা মাত্র। তার অর্থনৈতিক ভিত্তির মুশকিল আসান। এটাই কমিউনিজমের ঐতিহাসিক রূপÑ এটাই আমরা এ যাবৎ দেখেছি। আরো নানান কারণের মধ্যে বাস্তবে চর্চিত সমাজতন্ত্রে কমিউনিজমের পতনের দুঃসংবাদ এখানেও সম্ভবত নিহিত ছিল। ইতিহাসের যে অনিবার্য অভিমুখের কথা তরুণ কার্ল মার্কসের কাছে শোনা গিয়েছিল যে,Ñ একদিন মানুষের সঙ্গে মানুষের আর ভেদ থাকবে না, এক ও অবিভাজ্য মানুষের ‘সমাজ’ একদিন গঠিত হবেÑ এই প্রতিশ্রুতিই সবাইকে উজ্জীবিত করেছিল। এখনো করে। কিন্তু পরবর্তীকালে অর্থনৈতিক তত্ত্বের ভারে তরুণ স্বপ্নদর্শী মার্কস চাপা পড়ে গিয়েছেন। জন্ম নিয়েছে উৎপাদনবাদী কার্ল মার্কস। উৎপাদন শক্তির নির্বিচার বিকাশ মানবেতিহাসের পরমার্থ এই দাবি নিয়ে বাস্তবে গড়ে ওঠা কমিউনিজম নিয়ে এ কালে নানান দিক থেকে এখন প্রশ্ন উঠেছে। উৎপাদন শক্তির নির্বিচার বিকাশই কার্ল মার্কস চেয়েছেন কি না তা নিয়ে তর্ক হতে পারে, কিন্তু বাস্তবের কমিউনিস্ট আন্দোলন এই ঘেরাটোপের বাইরে যেতে পারে নি।
বারো
প্রশ্নগুলো নিয়ে বিস্তৃত আলোচনা এখানে করব না। দুই-একটি উল্লেখ করে রাখছি মাত্র। প্রথম প্রশ্ন উঠছে নারীদের দিক থেকে। নারী যেভাবে উৎপাদনের উপায় হিসাবে গরু, ঘোড়া, জায়গা জমির মতো ইতিহাসে ব্যবহৃত হয়ে এসেছে উৎপাদনশক্তির বিকাশের প্রকল্পের মধ্যে নারীর ওপর জুলুমের মীমাংসা কি এর মধ্যে সম্ভব? নারী সন্তান জন্ম দিতে না চাইলে তার জন্য জন্মনিরোধকই কি পথ? নাকি প্রজাতি পুনরুৎপাদনকে প্রযুক্তির কারিগরিতে পর্যবসিত করে পুরা নারীজাতিকে মনুষ্য প্রজাতি রার দায় থেকে মুক্তি দেয়াই একমাত্র পথ? টেস্টটিউব বেবি, কিম্বা ল্যাবরেটরির মধ্যে কারখানার মতো মানুষ পয়দা হবে। অসুবিধা কী? ইত্যাদি। নারী-পুরুষের যে সম্পর্কের ভিত্তি প্রজাতি পুনরুৎপাদন নিশ্চিত করা সম্ভব, তাকে কি শুধুই উৎপাদন সম্পর্ক বিবেচনা করব? নাকি ইচ্ছা-আকাক্সা-প্রেম-ভালোবাসা ইত্যাদিকে আমলে নিয়ে মানুষ নামক ব্যাপারকে উৎপাদনের বাইরেও চিন্তা করা ছাড়া গত্যন্তর নাই। আরেকটি প্রশ্ন ওঠে প্রাণ, পরিবেশ, প্রাণবৈচিত্র্য রা ইত্যাদির দায়বোধ থেকে। প্রাণ হিসেবে যদি মানুষ বেঁচে থাকতেই না পারে, তাহলে উৎপাদন কার জন্য? কিসের জন্য? প্রকৃতি, প্রাণ ও পরিবেশের যে ধ্বংসযজ্ঞ চলছে তার পরিপ্রেেিত উৎপাদন শক্তির বিকাশই প্রগতি এটা মেনে নেয়া কঠিন। প্রাণ, প্রকৃতি ও পরিবেশ শুধু পুঁজিতান্ত্রিক সম্পর্কের কারণে ঘটেছে তা নয়, ভয়াবহ পরিবেশ বিপর্যয় বাস্তবের সমাজতন্ত্র যেসব দেশে একদা কায়েম হয়েছিল সেইসব দেশেও ঘটেছে।
এটা এখন পরিষ্কার যে কমিউনিজম ডাকনামে ঐতিহাসিক যে আন্দোলন সংগ্রামের সঙ্গে আমরা পরিচিত, সেটা আধুনিকতাকে তার গোড়াসুদ্ধ চ্যালেঞ্জ করতে পারে নি। আধুনিকতার মধ্যেই সে মুখ থুবড়ে পড়ে গিয়েছে। এই পরিস্থিতিতে সমাজকে নতুন কোন্ ভিত্তির ওপর দাঁড় করানো যায় তা নিয়ে নতুন চিন্তাভাবনা অনেক দিন ধরেই চলছে। মাও জে দং নতুন মানুষ তৈরির কথা বলেছিলেন বটে, কিন্তু চীন পুঁজিতান্ত্রিক পথ পরিগ্রহণের ফলে সেই চিন্তা অপরীতি রয়ে গেছে। চীন বলি কি ভারত বলি আধুনিকতার যে রূপ আমরা ইউরোপে বা আমেরিকায় দেখেছি তার চেয়ে ভিন্ন কিছু এই নব্য ধনি দেশগুলো প্রদর্শন করতে পারবে সেটা ঘোরতর সন্দেহের বিষয়। তবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকেন্দ্রিক দুনিয়া জোড়া যে পুঁজিতান্ত্রিক ব্যবস্থা বিদ্যমান, সেখানে অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক মতার ভারসাম্যে বদল আসন্ন। এই বদল একটা বিশাল ঝড় ও তাণ্ডব ঘটিয়েই ঘটবে। এর ফলে বিশ্বব্যবস্থার ধসের কারণে দুনিয়ার বৈপ্লবিক রূপান্তরের আন্দোলন সংগ্রামে নতুন চিন্তার আবির্ভাব, পরীা-নিরীার উদয় ঘটতে পারে। অসম্ভব নয়। কিন্তু আধুনিকতার গোড়ার ভিত্তিকে প্রশ্ন করতে না পারলে এটা শুধু বিশ্বব্যবস্থার মতার ভারকেন্দ্রের বদল ঘটবে। মৌলিক কোনো রূপান্তর ঘটবে না।
এই সব কারণে অর্থনৈতিক প্রশ্নের মীমাংসার পাশাপাশি ধর্ম ও সংস্কৃতির প্রশ্ন এ কালে গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক বিষয়ে পরিণত হয়েছে। অর্থনৈতিক উন্নতি ও অর্থনৈতিক দ্বন্দ্ব সমাধানের গুরুত্ব কমেনি, কিন্তু তার চেয়েও ধর্ম ও সংস্কৃতির প্রশ্ন গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। ধর্ম ও সংস্কৃতির প্রশ্নকে আগে যেভাবে গুরুত্বহীন মনে করা হোত তারা যে আসলে মোটেও গৌণ বিষয় নয়, সেটাই সামনে চলে এসেছে। আগের মতো এটা ভাববার কোনো কারণ নেই যে অর্থনৈতিক প্রশ্নের মীমাংসা হলে সব কিছুরই সমাধান হয়ে যাবে। না, তা হবে না, এটা নিশ্চিত। পুঁজিতান্ত্রিক বিশ্বব্যবস্থার অন্তর্গত প্রক্রিয়া হিসেবে যে আধুনিকতা ও আধুনিক সংস্কৃতির মধ্যে আমাদের বসবাস তার অনুমানগুলো আমাদের মেনে নেবার কোনোই কারণ নেই। এখন আধুনিকতার জগৎ বা তার পরিমণ্ডল থেকে বেরিয়ে যাওয়ার লড়াই চালিয়ে যাওয়া অনেক বেশি জরুরি এ কালের রাজনীতিতে এটাই প্রধান বিষয়। যারা এটা টের পেয়েছেন, তারা আধুনিকতা/অনাধুনিকতার বিভাজন ভেঙে নতুনকে সহজে শনাক্ত করতে শিখবেন।
একালে এটাই এগিয়ে যাওয়ার পথ।
দুই.
পুঁজিতান্ত্রিক আধুনিক বিশ্বব্যবস্থার এই যুগকে অতিক্রম করতে হলে প্রথমেই দরকার পুরানা চিন্তার অভ্যাস ত্যাগ করা। পুরানা চিন্তার অর্থ হচ্ছে আধুনিক ও অনাধুনিকতার বিভাজনকে বিচারের মানদণ্ড জ্ঞান করে আধুনিকতার পে সাফাই গাওয়া। চিন্তাহীনতার এরচেয়ে আর ভালো নজির হতে পারে না, যা সামনে হাজির তাকেই নির্বিচারে গ্রহণ করার চেয়ে অজ্ঞানতা বা জাহেলি আর কিছুই হতে পারে না। পরীা-নিরীার, উদ্ভাবনের কিম্বা নতুন ভাবে চিন্তা করবার কোনো দায় নেই। চিন্তায় বিরতি দিয়ে যে মত সমাজে প্রবল তাকেই সত্য বলে নির্বিচারে মেনে নেয়ার চিন্তাশীলের কাজ হতে পারে না। নতুন ভাবে চিন্তা নিছকই দর্শনের প্রশ্ন নয়। সরাসরি রাজনীতিরও প্রশ্ন। কী করতে হবে তার হদিস চিন্তাশীল ভাবনাই দিতে সম। কোনো আগাম বানানো মতাদর্শ, ছক বা পাথরে খোদাই করা কর্মসূচি নয়।
যারা গন্তব্য আগাম নির্ণয় (teleology) করে ভবিষ্যৎ নিয়ে ভাবাকে দার্শনিক কারণে গ্রহণযোগ্য মনে করেন না, তাদের কাছে একই প্রশ্ন ভিন্ন ভাবে তোলা যাতে পারে। যেমন, নিজেদের বিগত ইতিহাসের ফল হিসাবে আমরা এখন যেভাবে নিজেদের দেখছি, জানছি বা বুঝছি এটাই মানুষের সর্বশেষ রূপান্তর কি না। পুঁজিতান্ত্রিক সম্পর্ক আমাদের ইচ্ছা-অনিচ্ছার বাইরে আমাদের নিরন্তর তৈয়ারি করছে। পুঁজির ইচ্ছা হয়ে উঠছে আমাদের ইচ্ছা ও সংকল্প। টেলিভিশনের বিজ্ঞাপন হয়ে উঠছে আমাদের কামনা, বাসনা ইত্যাদি। আমাদের অজান্তে টেকনলোজি আমাদের ইন্দ্রিয়, বুদ্ধি ও চিন্তার ধরন বদলে দিচ্ছে; মতা কখনো রাষ্ট্রের রূপ নিয়ে, কখনো মতাদর্শের বোঝা চাপিয়ে দিয়ে মাথা ধোলাই করছে; দৈনন্দিন জীবনের আরো নানান কারিগরি ও কারবারের মধ্য দিয়ে আমরা বদলে যাচ্ছি। আমরা কি টের পাই? বুঝি?
এই পরিস্থিতিতে ‘মানুষ’ নামক ভিন্ন কোনো কর্তাসত্তার চিন্তা সম্ভব কি না, সেটা আমি ভাবি। এমন এক কর্তা যে বিদ্যমান ব্যবস্থার বাইরে দাঁড়িয়ে ইতিহাস ও বর্তমানকে বিচার করতে পারে? কী ‘আছে’ আর কী করা ‘উচিত’ এই দুইয়ের মধ্যে ফারাক করতে সম হয় যেন বর্তমান থেকে বেরিয়ে গিয়ে নতুন বর্তমান নির্মাণ করা মানুষের পে সম্ভবপর সেটা সে প্রমাণ করতে পারে। শুধু জ্ঞানের কর্তার কথা বলছি না, ইতিহাসের কর্তা মানে কী, সেটাই আমি বুঝতে চাই।
তিন.
এই ধরনের কর্তাসত্তার অনুমান করা এবং বাস্তবে তার আবির্ভাব নিশ্চিত করা সহজ নয়। কথাগুলো তুলছি এ কারণে যে অনেকেই বিদ্যমান ব্যবস্থার বাইরে দাঁড়িয়ে বিদ্যমান ব্যবস্থার বিচার এমন তার রূপান্তর ঘটাতে সম এমন কর্তাসত্তার অস্তিত্ব সম্ভব এটা মানতে রাজি না। একদল মনে করে মানুষের বৈষয়িক জীবন বা বিদ্যমান ব্যবস্থাই মানুষ কী করতে পারে বা না পারে তা নির্ধারণ করে। এই েেত্র তার বৈষয়িক বা রক্তমাংসের অস্তিত্বের বাইরে এমন কোনো সত্তা নাই যে বিদ্যমান ব্যবস্থার বাইরে গিয়ে রূপান্তরের জন্য লড়তে সম। আমি মনে করি বৈপ্লবিক কর্তাসত্তা শুধু বিদ্যমান ব্যবস্থার দ্বন্দ্ব-সংঘাত থেকে তৈয়ার হয়, এই অনুমানকে পর্যালোচনার অধীন করা জরুরি। কথাটার মানে বোঝা জরুরি একটি কাজ। বৈপ্লবিক কর্তাসত্তার উদ্ভব ও চরিত্র আমার আগ্রহের বিষয়। তাকে যেমন, বস্তু ও বিষয়জ্ঞানে ইহলোকিকতার মাপজোখ দিয়ে নির্ণয় করা অসম্পূর্ণ মনে হয়, তেমনি বর্তমান দ্বন্দ্ব-সংঘাতের মধ্য দিয়ে তার আবির্ভাব কোনো বিধিবিধান মেনে চলে এটা মেনে নেওয়াও কঠিন। এই এক আধ্যাত্মিকতা যাকে ধর্মতত্ত্ব দিয়ে বোঝা যেমন কঠিন, অন্য দিকে ইতিহাস ও সমাজতত্ত্ব দিয়ে নির্ণয় করাও সমুদ্রের মধ্যে লবণের কণা অনুসন্ধানের মতো ব্যাপার। এ কালের দর্শন এই কর্তাসত্তাকে কোনো খাপে ফেলতে না পেরে এর নাম দিয়েছে রাজনৈতিক আধ্যাত্মিকতা (Political Spirituality)।
চার.
দাবি করা হয় আধুনিক বিশ্বব্যবস্থায় কেউ আধুনিক অথবা অনাধুনিক। হয় কেউ প্রগতির পে অথবা প্রতিক্রিয়াশীলতার। এই দুই খাপের বাইরে নাকি যাওয়া নিষেধ। তো এই নিষেধ আমি অমান্য করে চলেছি। যারা আধুনিকতার পূজারি তাদের কাছে ‘প্রগতি’র অর্থ বর্তমানকে মেনে নেওয়া। বর্তমানের বিরুদ্ধে তাদের নালিশ বা আপত্তি নেই তা নয়, কিন্তু তারা আধুনিকতার পরিমণ্ডলে সেই নালিশের মীমাংসা খোঁজে। যেখানে যেখানে আপত্তি আধুনিকতার সেই জায়গাগুলো শুদ্ধ করে নিতে চান। সেটা সংস্কারমূলক হোক কিম্বা বৈপ্লবিক কায়দায়, কিন্তু বিধান হচ্ছে আধুনিকতার গোড়ার ভিত্তি ঠিক রেখেই সেটা করতে হবে। ফলে আমি যে রাজনীতির কথা বলি সেখানে প্রগতিবাদীদের সঙ্গে যেমন মেলে না, তেমনি স্বঘোষিত প্রগতিবাদীদের মানদণ্ডে যারা প্রতিক্রিয়াশীল চিহ্নিত হয়েছেন তাদের সঙ্গেও নয়। কারণ আধুনিকতার বিরুদ্ধে অনাধুনিকতা কায়েম আমার রাজনীতি না। যে অনুমান, জ্ঞানগত ভিত্তি ও ঔচিত্যবোধ ‘আধুনিকতা’ নামক বর্তমানকে পয়দা করেছে, তাকে আমি মানুষের কাম্য জ্ঞান করি না শেষ গন্তব্য তো নয়ইÑ আমার কাজ তাকে বদলে দেওয়া। নিদেনপে আদৌ তা সম্ভব কি না সেটা যাচাই করে দেখা। তার জন্য বিভিন্ন দিক থেকে কাজ করা। অতএব ধর্ম, দর্শন, কাব্য, শিল্পকলা, গান, সিনেমা, নাটক ইত্যাদির প্রতি আমার আগ্রহ তুমুল। একই সঙ্গে বর্তমানের মুখে তুড়ি মেরে যে জীবন একা, নিঃসঙ্গ ও দ্রোহী সেই জীবনের প্রতি আমি একাত্ম বোধ করি। যদিও চোর থালা চুরি করে নিয়ে গিয়েছে চোরের ওপর রাগ করে থাকা আমার পথ নয়। আমি আজ বিরাগী নই। সমাজ আমাকে সমাজছাড়া করতে চাইলেও আমি সমাজত্যাগী হতে চাই না। অন্য দিকে দ্রোহী হতে গিয়ে নৈরাজ্যবাদীও নয়। সব কিছুতেই ‘না’ বলা, শূন্যতার পূজা বা নিহিলিস্ট হওয়া আমার ধাতে নাই। সকল প্রকার মূল্যবোধে আস্থা হারানো বা তাদের বিসর্জন দিয়ে সুপারম্যান হওয়াও আমাকে আকৃষ্ট করে না। আমার মনে হয় এ সবই চরম ব্যক্তিতান্ত্রিক সমাজের পরিণতি। কিন্তু তাই বলে আমি ব্যক্তিকে অস্বীকার করি না, ব্যক্তির আবির্ভাবও আমার কাছে এক ধরনের আধ্যাত্মিক ঘটনা বলেই মনে হয়, কারণ এই আবির্ভাবের কোনো বস্তুবাদী ব্যাখ্যা সম্ভব না। যা হাজির হয়ে গিয়েছে ও বর্তমান তাকে এখন আমি অস্বীকার করি কিভাবে? বরং যে সমাজে মানুষ একই সঙ্গে ব্যক্তি ও সামাজিক সেই সমাজের সন্ধান আমি করি। ব্যক্তিতান্ত্রিক সমাজের বিরুদ্ধে পাল্টা লড়ি। কিন্তু সে লড়াই লড়তে গিয়ে ব্যক্তির পাবলম্বনও করি। ইচ্ছা, কামনা, বাসনা, বিদ্রোহ ও নিজের জীবন অনায়াসে ঝুঁকিতে ফেলতে পারার মতাসম্পন্ন এই ব্যক্তি সে এক রহস্যময় ব্যাপার। বিস্ময় যে ব্যক্তির মধ্যেই বৈপ্লবিক কর্তাসত্তার আবির্ভাব ঘটে, যার সামাজিক ও ঐতিহাসিক হওয়ার ব্যাপারটা পরের বিষয়। অতএব সব ধরনের ব্যক্তি আমার আগ্রহের বিষয়। বিশেষত সমাজের প্রান্তে তাড়িয়ে নিয়ে গিয়ে যে মানুষগুলোকে সমাজ, আইন ও রাষ্ট্র অদৃশ্য ও অবাঞ্ছিত করে রাখেÑ আইনবহির্ভূত যাদের মেরে ফেলতে আমাদের নীতিনৈতিকতাতে বাধে নাÑ তাদের প্রতি আমার আগ্রহও চরম। রাষ্ট্র ও আইন কিভাবে আমদের জীবমাত্রে পরিণত করে, ফাঁসিতে ঝোলায়, গুলি করে লাশ বানায়, আইন ও জীবজীবনের এই মাঝখানের জমিনটুকু আমি চিন্তে চাই, অন্বেষণই আমার ধর্ম।
পাঁচ.
ঠিক। আমার বিরুদ্ধে প্রগতিবাদীদের অভিযোগের প্রধান একটি কারণ হচ্ছে ধর্ম। আমি ধর্মে উৎসাহী, আগ্রহী। ধর্ম আমার কাছে পরিত্যাগের বিষয় নয়। আধুনিকতার কালে এসে ধর্ম বা ধর্মতত্ত্ব তার গুরুত্ব হারিয়েছে, তার কিছু দেবার নাইÑ এমন আমি মনে করি না। নিজেকে যেমন নিজে ত্যাগ করতে পারি না, ধর্ম ও ধর্মতত্ত্বও তেমনি। তবে আধুনিকতার কালে ধর্মের উপস্থাপন ও তাৎপর্য ভিন্ন। ভিন্ন বলে তা ধর্ম বা ধর্মতত্ত্ব কি না নাকি নিছকই মতাদর্শ তা নিয়ে তর্ক হতে পারে। কিন্তু তারা বহাল তবিয়তেই আছে। থাকবে। একসময় দাবি করা হোত আধুনিকতার প্রাবল্যে ধর্মের লয় ঘটবে। আধুনিক হলে মানুষ বিভিন্ন কুসংস্কার থেকে মুক্ত হয়ে ধর্মের কুপ্রভাব থেকে মুক্ত হবে। ধর্মের শত্রুর মুখে ছাই দিয়ে সেটা ঘটেনি। এই ধারণার পেছনকার অনুমান হচ্ছে আধুনিকতা মানেই ধর্মহীনতা। এই অর্থে আধুনিকতার কারণে ধীরে ধীরে মানুষ যুক্তিবাদী হবে, ধর্ম শুকিয়ে মরবে। কিন্তু ধর্ম লোপ পাওয়া দূরে থাকুক, ফিরে এসেছে আরো শক্তি নিয়ে। এখন পাল্টা অভিযোগ উঠেছে খোদ ‘আধুনিকতা’ই কুসংস্কার। সংস্কারের মধ্যে কোনটা ‘কু’ আর কোনটা ‘সু’ সেই তর্ক আমার জন্য অর্থহীন। নীতিবাগিশগিরি আমার কর্তব্য না। নীতিবাদিতা মতা চর্চার অংশ। মতার বিচার ছাড়া নীতির মর্ম ঠাহর করা মুশকিল। আর সেটা করতে হলে আমাকে দর্শনে ফিরে আসতেই হয়। নতুন করে বর্তমানকে পর্যালোচনার দরকারে। মানুষের বিভিন্ন অভিজ্ঞতা পর্যালোচনা করে আমরা নিজ নিজ অবস্থান ও কর্তব্য নির্ণয় করি। আমি কিভাবে সেটা নির্ণয় করা হোল, তার অনুমান ও ভিত্তি নিয়ে প্রশ্ন তুলি। কারণ বিদ্যমান অনুমান বা চিন্তার ভিত্তির বাইরেও ভিন্ন অনুমান ও ভিত্তি থাকতেই পারে। আমার অন্বেষণ এই প্রশ্ন দিয়েই শুরু হয়।
ছয়.
আমার কাছে ধর্ম দার্শনিক অন্বেষণের বিষয় তো বটেই একই সঙ্গে রাজনীতিরও। এ ছাড়া বাংলাদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের ধর্ম ইসলাম সম্পর্কে আমার আগ্রহ থাকা খুবই স্বাভাবিক। বাংলাদেশের মানুষকে বুঝতে গেলে ইসলাম বোঝা আমার কাছে খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। আমি মনে করি, বাংলাদেশের বাস্তবতায় ইসলামের উপস্থিতির চরিত্র ও চর্চার ধরনই বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ নির্ণয় করবে। সেটা আমাদের ইচ্ছা অনিচ্ছার ওপর নির্ভর করবে না। প্রশ্ন হচ্ছে এই চর্চার চরিত্রে আমরা এমন কিছু ছাপ ফেলতে পারি কি না যা বর্তমানকে অতিক্রম করে যাবার অনুকূল হবে। সাম্রাজ্যবাদের ধ্বংস ও পুঁজিতান্ত্রিক বিশ্বব্যবস্থার বিনাশের পরে যে নতুন জগত গড়ে উঠবে এবং উঠতে বাধ্য, সেই জগতের নির্মাণে ইসলামের ভূমিকা কী হবে? কিম্বা কী হতে পারে? ইসলামের আবির্ভাব মুহূর্তে চিন্তার এমন কোনো প্রকাশ ছিল কি না যার হদিস নেয়া ছাড়া বর্তমান অতিক্রম করে যাওয়া নতুন জগতের কল্পনা অসম্ভব হয়ে ওঠে? ইসলামের রাজনৈতিক প্রস্তাব ও সংকল্পে বৈশ্বিক ও সার্বজনীন কী ছিল, যার পাশে আধুনিকতার সার্বজনীনতা ও বৈশ্বিকতাকে প্রাদেশিক দাবির অধিক কিছু মনে হয় না। কী সেই উপলব্ধি, অভিজ্ঞতা বা সত্য যা সকল প্রকার নিহিলিজমকে অসম্ভব করে তোলে? ইসলাম কিসের ‘স্যা’ দেয়? মানুষের জীবনের যদি কোনো অর্থই না থাকে তাহলে কিসের সমাজ? কিসের ইতিহাস? কিসের রাজনীতি? এই প্রশ্নগুলো গোলকায়নের এই কালে আমরা আগের চেয়েও আরো তীব্র ভাবে শুনতে পারছি, আগে প্রশ্নগুলোর তাৎপর্য এখনকার মতো স্পষ্ট ছিলনা? নিজের ইতিহাস কিম্বা ঐতিহ্য থেকে ইসলাম এই সকল প্রশ্নের মীমাংসার েেত্র কিছু যোগ করতে পারবে কি না, কিম্বা নতুন নির্মাণের ভিত্তি চেনা ও বিকশিত করে তোলার েেত্র ইসলাম আদৌ নতুন চিন্তার সহায়ক কি না সেটা খোলা মনে আমি খুঁজে দেখতে বদ্ধপরিকর। সংেেপ, আধুনিক/অনাধুনিকের বিভাজন অতিক্রম করে বাংলাদেশে ইসলাম আদৌ কোনো নতুন চিন্তা ও চর্চার দিশা দিতে পারবে কি না সেটা নিরীণ ও বোঝা। অতএব আমি আমার চিন্তা ও তৎপরতার জায়গা থেকেই জরুরি কর্তব্য বলে গণ্য করি। এতে কোনোই সন্দেহ নেই।
সাত.
আমি কার্ল মার্কসের ছাত্র। তাঁর গুরু হেগেলের কাছ থেকেই আমি শিখেছি যে ধর্ম বা ধর্মতত্ত্বের মধ্য দিয়ে যা চর্চা হয় সেটাও চিন্তা। মানুষেরই চিন্তা। ধর্মতত্ত্ব দর্শনের মতোই সমান গুরুত্বপূর্ণ চিন্তা। অবশ্যই। দর্শনের সঙ্গে তার পার্থক্য হচ্ছে তার উপস্থাপনার রূপে। অর্থাৎ মানুষের নিজ নিজ অভিজ্ঞতাকে হাজির করবার েেত্র চিন্তার নিজের একটা বিশেষ ধরন আছে; চিন্তা নিজের স্বরূপে নিজেকে হাজির না করলে শুধু ধর্ম কেন বিজ্ঞান, নীতিবিদ্যা বা রাষ্ট্রতত্ত্ব কোনো কিছুকেই ‘দর্শন’ বলা যায় না। হেগেল প্রটেস্টান্ট ধর্মকে দার্শনিক জায়গা থেকে পাঠ করেছেন। তাহলে ইসলামকে দর্শনের জায়গা থেকে বোঝার একটা কর্তব্য বাংলাদেশের জনগণের রয়েছে। সে কর্তব্যে আমি লিপ্ত আছি, থাকতে চাই। অর্থাৎ ধর্ম ও ধর্মতত্ত্ব অবশ্যই দর্শন ও রাজনীতির গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। মার্কস, লেনিন বা অ্যাঙ্গেলস কিভাবে ধর্মের মোকাবিলা করেছেন সেটা আমি ‘মোকাবিলা’ বইতে দেখাবার চেষ্টা করেছি। একে মোকাবিলা না করে সমাজের কোনো মৌলিক রূপান্তর অসম্ভব। একে কিভাবে আমরা মোকাবিলা করছি ও আমাদের ঐতিহাসিক ভূমিকা নির্মাণে আত্মস্থ করছি তার ওপর আগামী দিনের বাংলাদেশের রাজনীতি নির্ভর করবে। কিন্তু প্রগতিবাদীরা পরিশ্রমে আগ্রহী নন। তাদের ফতোয়া হচ্ছে, আমি এককালে কমিউনিস্ট ছিলাম, এখন ইসলামপন্থী হয়েছি। আমি দোষী! ঘোড়াও হাসে!!! তাই না?
মজার ব্যাপার হচ্ছে, ইসলামপন্থীদের মধ্যে যারা ধর্ম/অধর্মের বিভাজন দিয়ে জগৎ বিচার করেন তারাও তাই মনে করেন। কমিউনিজম নাস্তিক্যবাদীদের দর্শন। সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে যাবার পর কার্ল মার্কসসহ নাস্তিক্যবাদীদের জগৎ ভেঙে গিয়েছে। কমিউনিজমের ভবিষ্যৎ শেষ হয়ে গিয়েছে। তাদের অনেকে মনে করেন, আমি এক কালে কমিউনিস্ট ছিলাম। কমিউনিজমের এই দুর্দশা দেখে আমি ধর্মে প্রত্যাবর্তন করেছি। তাদের সামনে কবি আল মাহমুদের উদাহরণ আছে। তারা এর বেশি ভাবতে সম নন। তাদের আমি দোষ দেই না। আল মাহমুদকেও নয়। কারণ এর বেশি বাংলাদেশে আমরা এখনো ভাবতে পারি না। আমার দুর্ভাগ্য, দুই পই ভুল করেন, ভুল বোঝেন। সাধারণ ভাবে বাংলাদেশের চিন্তার দৈন্যতাই এর জন্য দায়ী। আধুনিকতা ও অনাধুনিকতার যে বিভাজন আমি পরিহার করি সেই একই তাগিদে ধর্মতত্ত্ব বনাম দর্শনের বিভাজনও আমি পরিহার করে চলি। অর্থাৎ চিন্তার যে অভ্যাস এই বিভাজনকে ন্যায্যতা দেয়, আমি তা স্বীকার করি না। তাহলে আধুনিকতা ও ধর্ম নিয়ে বিস্তর কথা বলার আছে। বিষয়গুলো জটিল নয়। মুশকিল হোল, দৈনিক পত্রিকার উপসম্পাদকীয় সেই সব আলোচনার প্রশস্ত ত্রে নয়। তবে প্রথাগত চিন্তা থেকে বেরিয়ে আসার অভ্যাস চর্চা না করলে এই বিষয়ে অগ্রসর হওয়া কঠিন। নিজের কৈফিয়ত হিসেবে এই কথাগুলো বলে রাখা আপাতত যথেষ্ট। তবে আধুনিকতা নিয়ে আরো দুই-একটি কথা এখানে বলা দরকার।
আট.
‘আধুনিক’ হওয়ার অর্থ নিয়ে অনেক আলোচনা হতে পারে। তবে যে অর্থের প্রতাপ সবচেয়ে বেশি সেটা হচ্ছে পাশ্চাত্যসভ্যতাকে নির্বিচারে গ্রহণ করা এবং যারা এর বিপরীতে দাঁড়ায় তাদের অসভ্য ও পশ্চাতপদ গণ্য করা। মুখে বলি বা না বলি ‘প্রগতি’র অর্থ দাঁড়ায় ইংরেজ, ইউরোপীয় বা মার্কিন হওয়ার সাধনা; তবে এই দেশগুলোর মধ্য একাট্টা একপ্রকারের সংস্কৃতি ও সভ্যতার চর্চা চলে, ব্যাপারটা তা না। কিন্তু সেভাবেই এদের দেখতে আমরা অভ্যস্ত। এই দেশগুলো বাংলাদেশের মতো অনাধুনিক (?) দেশে আধুনিকদের চিন্তাচেতনা, কল্পনা ও সংকল্পের মডেল হয়ে হাজির থাকে। চিন্তাচেতনা, পোশাক পরিচ্ছদ, গানবাজনা, খাওয়াদাওয়া, বাড়িঘর সব কিছুই পাশ্চাত্য আধুনিকতার ছকে বা মডেল মান্য করে গড়ে ওঠে। এমনকি নীতিনৈতিকতা, রাষ্ট্রব্যবস্থা ইত্যাদি সব কিছুরই প্রেরণা হয়ে দাঁড়ায় পাশ্চাত্য। আধুনিকতার সাধনা দেশে থেকে করি, কিম্বা বিদেশে পাড়ি দিয়ে তাতে বিশেষ কিছুই আসে যায় না। যারা নানান কারণে সচেতন হয়ে এর বিরোধিতা করেন, তারা আধুনিকতা, সভ্যতা ও প্রগতির ধারণা থেকে বেরিয়ে আসেন সেটা বলা যাবে না। তারা নিজের একটা ভিন্ন পরিচয় নির্মাণের চেষ্টা করেন। তার ভিত্তি হতে পারে নিজের ভাষা, সংস্কৃতি, ধর্ম, ঐতিহ্য বা অন্য কিছু। নিজেকে বিদ্যমান ব্যবস্থা থেকে আলাদা ভাবা ও নিজের ভিন্ন পরিচয় নির্মাণ ও আঁকড়ে ধরে রাখার চেষ্টা করেন তারা। তবে আধুনিকতার পরিমণ্ডলের মধ্যে থেকেই আত্মপরিচয় নির্মাণ, জাতীয়তা নির্ণয় বা শত্রুমিত্র নির্ধারণ আধুনিকতার বাইরের কোনো ব্যাপার না। আধুনিকতারই অন্তর্গত বিষয়। আধুনিকতার মধ্যে নিজেকে ভিন্ন ভাবা ও নিজের আলাদা আত্মপরিচয় নির্মাণের দুটো সম্ভাব্য পরিণতি হতে পারে। এক. আধুনিকতার পরিমণ্ডলের মধ্যে নিজের স্বার্থের জায়গা হাসিল করবার কাজেই সেটা ব্যয় করা। নিজের ভিন্নতা নিয়ে ‘আধুনিক’ হয়ে থাকা যাতে আধুনিকতার মধ্যে নিজের আর্থসামাজিক ও সাংস্কৃতিক স্বার্থ রা করা যায়। এটা পাশ্চাত্য সভ্যতাকে নির্বিচারে গ্রহণ করবারই ধারাবাহিকতা। দ্বিতীয়টি হচ্ছে, আধুনিকতা ও পাশ্চাত্যের একাট্টা বিরোধিতা। সেটা অসহায়ের আর্তি হয়ে গুমরে মরতে পারে, অথবা হান্টিংটন মার্কা সভ্যতার দ্বন্দ্ব তত্ত্বের ওপর দাঁড়িয়ে পাশ্চাত্যের বিরুদ্ধে লড়াই হয়েও উঠতে পারে। ‘রাজনৈতিক ইসলাম’ নাম দিয়ে যার বিরুদ্ধে পাশ্চাত্য সব শক্তি নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছে। সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে অনন্তযুদ্ধ হিসেবে এ কালে যা আমাদের সামনে দৃশ্যমান। ইসলামের পতাকা নিয়ে তার বিরুদ্ধে প্রতিরোধ ও পাল্টা আঘাত হানার চেষ্টাও চলছে।
নয়
প্রথম ধারাকে আমরা অনায়াসেই শনাক্ত করতে পারি। যেমন, নিজের ভাষা ও সংস্কৃতিকে আধুনিক করে তোলা ও আধুনিক পরিমণ্ডলের মধ্যে স্বীকৃতি আদায়। আধুনিক বাংলা সাহিত্য ও আধুনিক বাংলা গান যেমন দৃষ্টান্ত। তেমনি, ধর্মের আধুনিকায়ন। দাবি করা যে ধর্মের সঙ্গে আধুনিক বিজ্ঞান, প্রগতি, গণতন্ত্র, আধুনিক রাষ্ট্রব্যবস্থা ইত্যাদির কোনো বিরোধ নেই। দরকার ধর্মের সঙ্গে আধুনিকতার সঙ্ঘাতের ত্রেগুলো দূর করা। আধুনিকতাকে নয়, আধুনিকতার আলোকে ধর্মের সংস্কার করা। ইসলামকে ‘আধুনিক’ ও ‘যুগোপযোগী’ করে তোলা যেমন। তথাকথিত ‘ইসলামি সভ্যতা’র কল্পনা ও তার আধুনিক নির্মাণ; কিম্বা, আধুনিকতার আলোকে হিন্দু সভ্যতার ধারণা নির্মাণ; দাবি করা যে ‘হিন্দুত্ববাদ’ পাশ্চাত্যসভ্যতার স্বাভাবিক মিত্র (natural ally) ইত্যাদি। বিভিন্নতা ও বৈচিত্র্যের জগৎ থেকে তথাকথিত ‘সভ্যতার’ কাল পর্বে প্রবেশের পেছনে অনুমান হচ্ছে যারা সভ্যতার দাবিদার তারা অপরকে ‘অসভ্য’ বলে চিহ্নিত করতে ও তাদের অধীনস্থ করতে পারে এবং তা ন্যায্য। দেখা যাচ্ছে ‘সভ্যতার’ ধারণার মধ্যেই গোলমাল আছে। একে পরিহার করে চলাই বুদ্ধিমানের কাজ। এটা মনে রাখতে হবে তথাকথিত ‘সভ্যতা’র ধারণা আসলেই একটি আধুনিক ধারণা। এর সঙ্গে দখলদারি, উপনিবেশ স্থাপন, সাম্রাজ্যবাদ এবং এক জনগোষ্ঠীর দ্বারা অন্য জনগোষ্ঠীর দমন পীড়নের ইতিহাস জড়িত। সেই রক্তাক্ত ইতিহাস বাদ দিলে ‘পাশ্চাত্যসভ্যতা’ নামক কোনো সার্বজনীন সভ্যতার অস্তিত্ব নেই। ইতিহাস ভুলে গেলে ‘সভ্যতা’ কথাটার কোনো অর্থই দাঁড়ায় না। নিজেকে অন্যদের চেয়ে ‘সভ্য’ দাবি করার অর্থ অন্যকে বা অপরকে সামরিক ভাবে কিম্বা সার্বজনীন আইন, বিধিবিধান, নীতিনৈতিকতা কিম্বা সার্বজনীন সাংস্কৃতিক মানদণ্ডের দোহাই দিয়ে অধীনস্থ রাখার ধারাবাহিক ইতিহাস অুণœ রাখা এবং তা ন্যায্য বলে দাবি করা। সার কথা হচ্ছে যেকোনো জাতিবাদী কিম্বা সভ্যতাবাদী আত্মপরিচয় কিম্বা নিজের ধর্ম ও সংস্কৃতিকে অন্যদের চেয়ে শ্রেষ্ঠ দাবি করার রাজনীতি আধুনিকতার বাইরের কিছু না। এই সব আধুনিকতারই অন্তর্গত প্রক্রিয়ার অংশ।
দশ
আধুনিকতা বা পাশ্চাত্যসভ্যতার একাট্টা বিরোধিতার আদৌ কোনো ভবিষ্যৎ আছে কি না আমি সন্দেহ করি। বিদ্যমান কোনো ব্যবস্থার পর্যালোচনা, বিদ্যমান ব্যবস্থা থেকে নিজের দূরত্ব অনুভব করা এবং সেই ভিন্নতার উপলব্ধির (intuition) তাগিদে বিদ্যমান ব্যবস্থাকে নতুন করে জানা, বোঝা, বিশ্লেষণ করার চেষ্টা এবং তাকে রাজনৈতিক ও সামরিক ভাবে প্রতিরোধ খুবই স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। এই প্রক্রিয়া থেকে অবশ্যই মানুষের ভবিষ্যৎ চলার পথ কী হতে পারে তার বহু কিছুরই মীমাংসা হবে। কিন্তু সেটা বিদ্যমান ‘সভ্যতা’ বিলুপ্তি ও বিনাশ ঘটিয়ে বিদ্যমান সভ্যতা যাদের ‘অসভ্য’ ও ‘বর্বর’ বলে চিহ্নিত করে তাদের অধিষ্ঠিত করা কি না সে বিষয়ে সন্দেহ পোষণ করি। কারণ এই বিভাজন অতিক্রম করাই কাজ, তাকে প্রতিষ্ঠিত করা নয়। ইতিহাসের অভিমুখ সেই দিকে নয়। আধুনিকতার প বা বিপ হয়ে আমরা একালে আধুনিকতার এই কালপর্ব অতিক্রম করে যেতে পারব না। আধুনিকতার ধারণা মাথায় রেখে কোনো নতুন প্রণোদনার আবির্ভাব অসম্ভব। অথচ বিশ্বব্যবস্থার রূপান্তর নিয়ে চিন্তা ও সম্ভাব্য রাজনৈতিক নীতি ও কৌশল নিয়ে ভাবনার মানে হচ্ছে সম্পূর্ণ নতুন ভাবে চিন্তা করবার মতা অর্জন করা, যেসব বিষয় এতকাল মীমাংসিত বলে ধরে নেয়া হয়েছিল সেসব কিছুকে নির্ভয়ে প্রশ্ন করতে শেখা। বলাবাহুল্য, এটাই এ কালের রাজনীতি। এই কাজকে যদি চিন্তার পরিমণ্ডলে আমরা সীমিত রাখি তাহলে আধুনিকতার পরিমণ্ডল ভাঙা কঠিন বলেই আমরা মনে হয়। সেই দিক থেকে জালিম ব্যবস্থার বিরুদ্ধে মজলুমের লড়াইয়ের েেত্রর প্রাধান্য অনস্বীকার্য। আমার লেখায় বারবার এই দিকটির ওপর এ কারণেই আমি জোর দিয়ে থাকি। অর্থাৎ বিদ্যমান ব্যবস্থার বিরুদ্ধে লড়তে গিয়েই মানুষ নতুন ভাবে ভাবতে শেখে, অর্থাৎ সেই ভাবনাই দরকার যা একই সঙ্গে লড়াইকে তীব্র ও পরিবর্তনকে অবশ্যম্ভাবী করে তোলে। নতুন চিন্তা স্রেফ নতুন বলেই সমাজ বদলাতে পারে না, বিদ্যমান ব্যবস্থা রূপান্তরের তাগিদই মানুষকে নতুন চিন্তার প্রতি আগ্রহী করে তোলে।
এগারো
এক কালে সাম্রাজ্যবাদের অর্থনৈতিক অসাম্যের বিরুদ্ধে কমিউনিস্টরা লড়েছিলেন। এখনো লড়েন। কিন্তু এ লড়াই আধুনিকতার বিরুদ্ধে নয়। এমনকি কমিউনিজমের জন্যও নয়। সমাজতন্ত্রের জন্য। কিম্বা বলা যায়, আরো ‘আধুনিক’ হয়ে ওঠার জন্য। বাস্তবে তার যে রূপ ও নানান পরীা-নিরীা সেই পর্বের (actually existing socialism) পরিসমাপ্তি ঘটেছে। এখন সেই পর্ব আবার ফিরে আসার আর কোনোই সম্ভাবনা নাই। এটা ঠিক যে এতে কার্ল মার্কস বা বিপ্লবী রাজনীতির শিা ও অভিজ্ঞতা বাতিল হয়ে যায় নি। মার্কস পুরা মাত্রায় তার অর্থশাস্ত্র নিয়ে বহাল আছেন। প্রশ্ন ওঠে, তিনি মানবেতিহাসের যে অনিবার্য ভবিষ্যৎ অনুমান করেছিলেন, সেটাও কি তাহলে বাতিল করে দিতে হবে? আধুনিকতার অর্থনৈতিক ভিত্তি হচ্ছে পুঁজিতান্ত্রিক উৎপাদন সম্পর্ক। কিন্তু এই সম্পর্কই আবার উৎপাদন শক্তি বিকাশের পথে বাধা। এ কারণে মার্কস পুঁজিতান্ত্রিক ব্যবস্থার দ্বন্দ্ব নিরসনের কথা বলেছিলেন। এর ওপরই তাঁর কেন্দ্রীভূত নজর নিবদ্ধ ছিল। বাস্তবের সমাজতন্ত্রের ব্যর্থতার কথা বাদ দিলে আজো কমিউনিস্টদের লড়াই অর্থনৈতিক েেত্রই কেন্দ্রীভূত। সংস্কৃতি, নীতিনৈতিকতা ও রাজনীতির প্রশ্ন গৌণ। আধুনিকতার বিরোধী তারা নন, আধুনিকতার অন্তর্নিহিত অর্থনৈতিক দ্বন্দ্ব নিরসনের মধ্যেই তারা তাদের কর্তব্য নির্ধারণ করেন। এর জন্যই তারা লড়েন। যে কারণে বলা হয় কমিউনিস্ট আন্দোলন তার অনেক ইতিবাচক অর্জন সত্ত্বেও শেষ বিচারে আধুনিকতার অসম্পূর্ণ প্রকল্প বাস্তবায়নের চেষ্টা মাত্র। তার অর্থনৈতিক ভিত্তির মুশকিল আসান। এটাই কমিউনিজমের ঐতিহাসিক রূপÑ এটাই আমরা এ যাবৎ দেখেছি। আরো নানান কারণের মধ্যে বাস্তবে চর্চিত সমাজতন্ত্রে কমিউনিজমের পতনের দুঃসংবাদ এখানেও সম্ভবত নিহিত ছিল। ইতিহাসের যে অনিবার্য অভিমুখের কথা তরুণ কার্ল মার্কসের কাছে শোনা গিয়েছিল যে,Ñ একদিন মানুষের সঙ্গে মানুষের আর ভেদ থাকবে না, এক ও অবিভাজ্য মানুষের ‘সমাজ’ একদিন গঠিত হবেÑ এই প্রতিশ্রুতিই সবাইকে উজ্জীবিত করেছিল। এখনো করে। কিন্তু পরবর্তীকালে অর্থনৈতিক তত্ত্বের ভারে তরুণ স্বপ্নদর্শী মার্কস চাপা পড়ে গিয়েছেন। জন্ম নিয়েছে উৎপাদনবাদী কার্ল মার্কস। উৎপাদন শক্তির নির্বিচার বিকাশ মানবেতিহাসের পরমার্থ এই দাবি নিয়ে বাস্তবে গড়ে ওঠা কমিউনিজম নিয়ে এ কালে নানান দিক থেকে এখন প্রশ্ন উঠেছে। উৎপাদন শক্তির নির্বিচার বিকাশই কার্ল মার্কস চেয়েছেন কি না তা নিয়ে তর্ক হতে পারে, কিন্তু বাস্তবের কমিউনিস্ট আন্দোলন এই ঘেরাটোপের বাইরে যেতে পারে নি।
বারো
প্রশ্নগুলো নিয়ে বিস্তৃত আলোচনা এখানে করব না। দুই-একটি উল্লেখ করে রাখছি মাত্র। প্রথম প্রশ্ন উঠছে নারীদের দিক থেকে। নারী যেভাবে উৎপাদনের উপায় হিসাবে গরু, ঘোড়া, জায়গা জমির মতো ইতিহাসে ব্যবহৃত হয়ে এসেছে উৎপাদনশক্তির বিকাশের প্রকল্পের মধ্যে নারীর ওপর জুলুমের মীমাংসা কি এর মধ্যে সম্ভব? নারী সন্তান জন্ম দিতে না চাইলে তার জন্য জন্মনিরোধকই কি পথ? নাকি প্রজাতি পুনরুৎপাদনকে প্রযুক্তির কারিগরিতে পর্যবসিত করে পুরা নারীজাতিকে মনুষ্য প্রজাতি রার দায় থেকে মুক্তি দেয়াই একমাত্র পথ? টেস্টটিউব বেবি, কিম্বা ল্যাবরেটরির মধ্যে কারখানার মতো মানুষ পয়দা হবে। অসুবিধা কী? ইত্যাদি। নারী-পুরুষের যে সম্পর্কের ভিত্তি প্রজাতি পুনরুৎপাদন নিশ্চিত করা সম্ভব, তাকে কি শুধুই উৎপাদন সম্পর্ক বিবেচনা করব? নাকি ইচ্ছা-আকাক্সা-প্রেম-ভালোবাসা ইত্যাদিকে আমলে নিয়ে মানুষ নামক ব্যাপারকে উৎপাদনের বাইরেও চিন্তা করা ছাড়া গত্যন্তর নাই। আরেকটি প্রশ্ন ওঠে প্রাণ, পরিবেশ, প্রাণবৈচিত্র্য রা ইত্যাদির দায়বোধ থেকে। প্রাণ হিসেবে যদি মানুষ বেঁচে থাকতেই না পারে, তাহলে উৎপাদন কার জন্য? কিসের জন্য? প্রকৃতি, প্রাণ ও পরিবেশের যে ধ্বংসযজ্ঞ চলছে তার পরিপ্রেেিত উৎপাদন শক্তির বিকাশই প্রগতি এটা মেনে নেয়া কঠিন। প্রাণ, প্রকৃতি ও পরিবেশ শুধু পুঁজিতান্ত্রিক সম্পর্কের কারণে ঘটেছে তা নয়, ভয়াবহ পরিবেশ বিপর্যয় বাস্তবের সমাজতন্ত্র যেসব দেশে একদা কায়েম হয়েছিল সেইসব দেশেও ঘটেছে।
এটা এখন পরিষ্কার যে কমিউনিজম ডাকনামে ঐতিহাসিক যে আন্দোলন সংগ্রামের সঙ্গে আমরা পরিচিত, সেটা আধুনিকতাকে তার গোড়াসুদ্ধ চ্যালেঞ্জ করতে পারে নি। আধুনিকতার মধ্যেই সে মুখ থুবড়ে পড়ে গিয়েছে। এই পরিস্থিতিতে সমাজকে নতুন কোন্ ভিত্তির ওপর দাঁড় করানো যায় তা নিয়ে নতুন চিন্তাভাবনা অনেক দিন ধরেই চলছে। মাও জে দং নতুন মানুষ তৈরির কথা বলেছিলেন বটে, কিন্তু চীন পুঁজিতান্ত্রিক পথ পরিগ্রহণের ফলে সেই চিন্তা অপরীতি রয়ে গেছে। চীন বলি কি ভারত বলি আধুনিকতার যে রূপ আমরা ইউরোপে বা আমেরিকায় দেখেছি তার চেয়ে ভিন্ন কিছু এই নব্য ধনি দেশগুলো প্রদর্শন করতে পারবে সেটা ঘোরতর সন্দেহের বিষয়। তবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকেন্দ্রিক দুনিয়া জোড়া যে পুঁজিতান্ত্রিক ব্যবস্থা বিদ্যমান, সেখানে অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক মতার ভারসাম্যে বদল আসন্ন। এই বদল একটা বিশাল ঝড় ও তাণ্ডব ঘটিয়েই ঘটবে। এর ফলে বিশ্বব্যবস্থার ধসের কারণে দুনিয়ার বৈপ্লবিক রূপান্তরের আন্দোলন সংগ্রামে নতুন চিন্তার আবির্ভাব, পরীা-নিরীার উদয় ঘটতে পারে। অসম্ভব নয়। কিন্তু আধুনিকতার গোড়ার ভিত্তিকে প্রশ্ন করতে না পারলে এটা শুধু বিশ্বব্যবস্থার মতার ভারকেন্দ্রের বদল ঘটবে। মৌলিক কোনো রূপান্তর ঘটবে না।
এই সব কারণে অর্থনৈতিক প্রশ্নের মীমাংসার পাশাপাশি ধর্ম ও সংস্কৃতির প্রশ্ন এ কালে গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক বিষয়ে পরিণত হয়েছে। অর্থনৈতিক উন্নতি ও অর্থনৈতিক দ্বন্দ্ব সমাধানের গুরুত্ব কমেনি, কিন্তু তার চেয়েও ধর্ম ও সংস্কৃতির প্রশ্ন গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। ধর্ম ও সংস্কৃতির প্রশ্নকে আগে যেভাবে গুরুত্বহীন মনে করা হোত তারা যে আসলে মোটেও গৌণ বিষয় নয়, সেটাই সামনে চলে এসেছে। আগের মতো এটা ভাববার কোনো কারণ নেই যে অর্থনৈতিক প্রশ্নের মীমাংসা হলে সব কিছুরই সমাধান হয়ে যাবে। না, তা হবে না, এটা নিশ্চিত। পুঁজিতান্ত্রিক বিশ্বব্যবস্থার অন্তর্গত প্রক্রিয়া হিসেবে যে আধুনিকতা ও আধুনিক সংস্কৃতির মধ্যে আমাদের বসবাস তার অনুমানগুলো আমাদের মেনে নেবার কোনোই কারণ নেই। এখন আধুনিকতার জগৎ বা তার পরিমণ্ডল থেকে বেরিয়ে যাওয়ার লড়াই চালিয়ে যাওয়া অনেক বেশি জরুরি এ কালের রাজনীতিতে এটাই প্রধান বিষয়। যারা এটা টের পেয়েছেন, তারা আধুনিকতা/অনাধুনিকতার বিভাজন ভেঙে নতুনকে সহজে শনাক্ত করতে শিখবেন।
একালে এটাই এগিয়ে যাওয়ার পথ।
লেখক : কবি, চিন্তাবিদ, কলামিস্ট
No comments