সামাজিক ব্যবসা পৃথিবীকে বদলে দিতে পারে by মুহাম্মদ ইউনূস
আমি বাজারের স্বাধীনতা জোরদার করার প।ে আর একই সময়ে আমি বাজারে যেসব শক্তি কাজ করে সেসবের ওপর ধারণামূলক বিধিনিষেধ আরোপের একান্ত বিরোধী। এর উৎপত্তি হলো এই অনুমানে যে উদ্যোক্তারা ব্যবসায় জীবনে একটিমাত্র মিশনে নিবেদিত। বলাবাহুল্য সেটি হলো মুনাফা সর্বাধিক করা। পুঁজিবাদের এই ব্যাখ্যা উদ্যোক্তাদেরকে তাদের জীবনের সব রাজনৈতিক, আবেগীয়, সামাজিক, আধ্যাত্মিক ও পরিবেশগত দিকমাত্রা থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেয়। সম্ভবত এটি করা হয় এক যুক্তিনির্ভর সরলীকরণ হিসেবে। কিন্তু তাতে মানবজীবনের একান্ত নির্যাসকে ঝেঁটিয়ে বিদায় করা হয়েছে। মানুষ এক অপূর্ব সৃষ্টি, যার সত্তায় মিশে আছে অনন্ত মানবীয় গুণ ও সামর্থ্য। আমাদের গড়া তত্ত্বগুলোতে তাই এসব মানবীয় গুণের কুসুমকলি ভাববাচ্যে দূরে না সরিয়ে রেখে প্রস্ফুটিত করার ব্যবস্থা অন্তর্ভুক্ত থাকা উচিত। মুক্তবাজারে ভূমিকাপালকদের ওপর এ বিধিনিষেধই বিশ্বের বহু সমস্যার কারণ। পৃথিবীর মোট জনসমষ্টির অর্ধেকই হতদরিদ্র। কিন্তু তাদের এই সমস্যার সমাধান বিশ্ব করেনি। স্বাস্থ্য পরিচর্যার সুবিধা বিশ্বের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের নাগালে নেই। সবচেয়ে সমৃদ্ধ ও মুক্তবাজার রয়েছে এমন দেশও তাদের জনসংখ্যার পঞ্চমাংশের স্বাস্থ্য পরিচর্যার সুবিধা দিতে পারেনি।
মুক্তবাজারের সাফল্যে আমরা এতই চমৎকৃত যে, আমরা আমাদের মৌলিক ধারণাগুলোর ব্যাপারে কোনোরকম সংশয় প্রকাশ করতেও কখনো সাহস পাইনি। ব্যাপারটা আরো জঘন্য করে তোলার জন্য আমরা বরং যতটা পারা যায় আমাদের নিজেদেরকে তাত্ত্বিক নিরিখে একমাত্রিক মানুষে রূপান্তরিত করার জন্য বাড়তি খাটুনি খেটেছি যাতে করে মুক্তবাজার কার্যব্যবস্থা সাবলীল কাজ করতে পারে।
‘উদ্যোক্তা’র একটা বিস্তৃততর সংজ্ঞায় সংজ্ঞায়িত করে আমরা মুক্তবাজারের চৌহদ্দির মধ্যে পুঁজিবাদের বৈশিষ্ট্যে বৈপ্লবিক পরিবর্তন এনে আমরা বিশ্বের বহু অমীমাংসিত সমস্যার সমাধান করতে পারি। মনে করুন, একজন উদ্যোক্তার প্রেরণার একক উৎসের (যেমন, সর্বাধিক মুনাফা করা) বদলে দু’টি উৎস রয়েছে এবং এ দুই উৎস আবার পরস্পরবিরোধী অথচ সমান বাধ্যবাধকতাসম্পন্নÑ ক. সর্বাধিক মুনাফা করা এবং খ. মানুষ ও জগতের কল্যাণসাধন।
এখন এ দুয়ের প্রতিটি প্রেরণা একটি পৃথক ধরনের ব্যবসা অভিমুখী। আমরা প্রথম ধরনের প্রেরণাকে বলব মুনাফা সর্বাধিকারক ব্যবসা আর দ্বিতীয় ধরনের ব্যবসাকে বলব সামাজিক ব্যবসা। এই সামাজিক ব্যবসা হবে বাজারে প্রবর্তিত নতুন একধরনের ব্যবসা, যার উদ্দেশ্য পৃথিবীকে বদলে দেয়া। এই সামাজিক ব্যবসায় বিনিয়োগকারীরা তাদের বিনিয়োজিত পুঁজি ফিরে পেতে পারবে কিন্তু কোম্পানি থেকে কোনো মুনাফা নিতে পারবে না। বরং মুনাফা ফিরে যাবে কোম্পানিতে, যা দিয়ে ব্যবসার সম্প্রসারণ ঘটবে আরো দূরবর্তী এলাকায় আর সেই সাথে পণ্য বা সেবার মান আরো উন্নত হবে। এ ধরনের সামাজিক ব্যবসায় হবে লোকসান ও মুনাফাবিহীন কোম্পানি।
আমাদের প্রস্তাবিত সামাজিক ব্যবসা আইনে স্বীকৃত। বহু কোম্পানি রয়েছে যারা তাদের মূল ব্যবসায় তৎপরতা ছাড়াও সামাজিক ব্যবসা গড়তে এগিয়ে আসবে। মুনাফাবিহীন খাতের বহু কর্মীও এটিকে আকর্ষণীয় বিকল্প হিসেবে গ্রহণ করবেন। মুনাফাবিহীন খাতে যেখানে প্রতিষ্ঠানকে তার কর্মতৎপরতা চালিয়ে যাওয়ার জন্য চাঁদা সংগ্রহ করতে হয়, সেখানে সামাজিক ব্যবসা হয় স্বনির্ভর আর সেই সাথে সম্প্রসারণের প্রয়োজনে উদ্বৃত্ত তৈরি করতে পারে কেননা, এটা মুনাফাবিহীন উদ্যোগ প্রতিষ্ঠান। সামাজিক ব্যবসা প্রতিষ্ঠান তার পুঁজি সংগ্রহের জন্য তার নিজস্ব নতুন ধরনের মুলধন বাজারে যাবে।
বিশ্বজুড়ে, বিশেষ করে বিত্তবান দেশগুলোর যুবক-তরুণেরা সামাজিক ব্যবসার ধারণাকে অত্যন্ত আবেদনময় বলেই দেখবেন। এ কারণে যে, এ ব্যবসা তাদেরকে তাদের সৃষ্টিধর্মী প্রতিভা কাজে লাগিয়ে অনেক কিছু বদলে দেবার চ্যালেঞ্জ নেয়ার আমন্ত্রণ জানায়। আজকের বহু তরুণ-তরুণী বর্তমান পুঁজিবাদী বিশ্বে কোনো অর্থবহ, রোমাঞ্চকর চ্যালেঞ্জ নেবার সুযোগ দেখতে পায় না বলে হতাশায় ভোগে। অথচ এর পাশাপাশি সমাজতন্ত্র তাদের লড়াই করার স্বপ্ন দেখায়। তরুণেরা তাদের একান্ত নিজের নিটোল, নিখুঁত এক বিশ্ব গড়ার স্বপ্ন দেখে।
সামাজিক ব্যবসা বিশ্বের প্রায় সব আর্থসামাজিক সমস্যার প্রতিকার দেবে। কেবল চ্যালেঞ্জ হলো ব্যবসায়ের উদ্ভাবনীমূলক মডেল তৈরি করে তা সাশ্রয় ও কার্যকরভাবে কাজে লাগিয়ে বাঞ্ছিত সামাজিক সুফল নিয়ে আসা। দরিদ্রের জন্য স্বাস্থ্য পরিচর্যা, তথ্যপ্রযুক্তি, শিা ও প্রশিণ, বিপণন ও নবায়নযোগ্য ইন্ধনশক্তিÑ এসবই হলো সামাজিক ব্যবসার রোমাঞ্চকর কর্মত্রে। সামাজিক ব্যবসা গুরুত্বপূর্ণ, কেননা, এ ব্যবসা মানবজাতির অতীব গুরুত্ববহ বিষয়গুলোর সুরাহা করে। বিশ্বের মোট জনসমষ্টির যে ৬০ শতাংশ দারিদ্র্যরেখার নিচে অবহেলিত রয়ে গেছে এ ব্যবসা তাদের জীবনের খোলনলচে বদলে দিতে পারে। তাদেরকে দারিদ্র্য থেকে বেরিয়ে আসতে সহায়তা করতে পারে।
গ্রামীণের সামাজিক ব্যবসা
এমনকি সর্বাধিক মুনাফাকারী কোম্পানিগুলোকে পরিকল্পিত উপায়ে সামাজিক ব্যবসায় রূপান্তরিত করা যায়। এটা করা যায় ওই কোম্পানিতে গরিবদের পূর্ণ বা বেশির ভাগের মালিকানা দিয়ে। এ হলো দ্বিতীয় ধরনের সামাজিক ব্যবসায় কোম্পানির দৃষ্টান্ত। গ্রামীণ ব্যাংক সামাজিক ব্যবসার এই শ্রেণিভুক্ত। দরিদ্র মানুষ এসব কোম্পানির শেয়ারদাতাদের প থেকে উপহার হিসেবে পেতে পারে অথবা তারা তাদের নিজের টাকা দিয়ে এসব কোম্পানির শেয়ার কিনতে পারে। ঋণগ্রাহকেরা তাদের নিজের টাকা দিয়ে গ্রামীণ ব্যাংকের শেয়ার কিনেছেন। তাদের এই শেয়ার, যারা ঋণগ্রাহক নন, তাদের কাছে হস্তান্তরযোগ্য নয়। পেশাদার ও নিবেদিতপ্রাণ একদল লোক এ ব্যাংকের দৈনন্দিন কর্মতৎপরতা পরিচালনার কাজ করে থাকে।
দ্বিপীয় বা বহুপীয় দাতারা সহজেই এ ধরনের সামাজিক ব্যবসা প্রতিষ্ঠা করতে পারে। যখন কোনো দাতা কোনো গ্রহীতা দেশে কোনো সেতু নির্মাণের জন্য কোনো ঋণ বা মঞ্জুরি দেয় তখন ওই দাতা স্থানীয় দরিদ্রদের মালিকানায় একটা সেতু কোম্পানি গঠন করতে পারে। আর এই কোম্পানি পরিচালনার দায়িত্ব দিতে হবে একটি অঙ্গীকারবদ্ধ কোনো ব্যবস্থাপনা কোম্পানিকে। এই কোম্পানির যে মুনাফা হবে তা স্থানীয় মালিক দরিদ্র মানুষগুলো মুনাফা হিসেবেও আরো সেতু নির্মাণের অর্থ জোগানোর কাজে ব্যয় হবে। এভাবে বহু অবকাঠামো প্রকল্প যেমন, সড়ক, বিমানবন্দর, সমুদ্রবন্দর, উপযোগী কোম্পানি এভাবে গড়ে তোলা যায়।
গ্রামীণ প্রথম ধরনের দু’টি সামাজিক ব্যবসা গড়ে তুলেছে। এর একটা হলো দই তৈরির কারখানা বা ইয়োগার্ট কারখানা। এ কারখানায় পুষ্টিমানযুক্ত দই তৈরি হবে অপুষ্টির শিকার দরিদ্র শিশুদের জন্য। এ প্রতিষ্ঠান স্থাপন করা হচ্ছে ফ্রান্সের ডানোনের সাথে যৌথ উদ্যোগ প্রতিষ্ঠান হিসেবে। বাংলাদেশে অপুষ্টিপীড়িত সব শিশুর কাছে এই দই না পৌঁছানো অবধি এই ফ্যাক্টরির সম্প্রসারণ চলবে। এই ব্যবস্থার আওতায় আরেকটি চেইন প্রতিষ্ঠান হবে চু হাসপাতাল। এসব হাসপাতালের প্রতিটিতে বছরে ১০ হাজার চোখের ছানির অস্ত্রোপচার করা হবে। তবে এর জন্য খরচ ধরা হবে ধনী-গরিব ভিত্তিতে বিভিন্ন অঙ্কে।
সামাজিক স্টকমার্কেট
সামাজিক ব্যবসাগুলোর সাথে বিনিয়োগকারীদের যোগাযোগ করিয়ে দেয়ার জন্য আমাদের দরকার সামাজিক স্টকবাজার গড়ে তোলা, যেখানে কেবল সামাজিক ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানগুলোর স্টক-শেয়ারের বেচাকেনা চলবে। এই স্টক এক্সচেঞ্জে বিনিয়োগকারী আসবেন কোনো সামাজিক ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানকে তহবিল জোগানোর স্পষ্ট উদ্দেশ্য নিয়ে। এক্সচেঞ্জেও অনুরূপ উদ্দেশ্য থাকবে। আর যদি কারো নিছক টাকা বানানোর ইচ্ছে থাকে তাহলে তিনি এখনকার স্টক এক্সচেঞ্জে যাবেন।
সামাজিক স্টক এক্সচেঞ্জগুলোর যথাকর্ম পরিচালনা নিশ্চিত করার জন্য আমদের কিছু রেটিং এজেন্সি স্থাপন করা, পরিভাষাসমূহ প্রমিত করা, সংজ্ঞা নির্ধারণ করা, প্রভাব-প্রতিক্রিয়া পরিমাপ করা, প্রতিবেদন ফরম্যাট গড়ে তোলা এবং দ্য ওয়াল স্ট্রিট জার্নালের মতো নতুন অর্থনৈতিক প্রকাশনা প্রকাশের ব্যবস্থা করার দরকার হবে। এ ছাড়া প্রতিষ্ঠা করতে হবে বিজনেস স্কুলের মতো বিশেষ শিাপ্রতিষ্ঠান। এসব শিাপ্রতিষ্ঠানে ব্যবসায় ব্যবস্থাপনার ওপর কোর্স ও ডিগ্রি প্রদানের ব্যবস্থা থাকবে তরণ ব্যবস্থাপক প্রশিণের জন্য। শিার্থীরা এখানে সামাজিক ব্যবসা উদ্যোগ প্রতিষ্ঠান সবচেয়ে দতার সাথে ব্যবস্থাপনা শিখবেন। সর্বোপরি, এসব প্রতিষ্ঠান শিার্থীদের নিজেদের একেকজন সামাজিক ব্যবসা উদ্যোক্তা হওয়ার প্রেরণা দেবে।
বিশ্বায়নে সামাজিক ব্যবসায়ের ভূমিকা
আমি বিশ্বায়নের সমর্থক। আমি বিশ্বাস করি দারিদ্র্য বিমোচনের অন্যান্য বিকল্পের তুলনায় বিশ্বায়ন গরিবদের বরং ঢের বেশি উপকার করতে পারে। তবে বিশ্বায়ন হতে হবে যথার্থ ধরনের বিশ্বায়ন। আমার ধারণায় বিশ্বায়ন হলো শত লেনযুক্ত একটা জনপথের মতো কিছু যা সারা বিশ্বের ওপর দিয়ে চলে গেছে। যদি আমরা ধরে নিই, এ সড়ক সবার জন্য খোলা তাহলে এর লেনগুলোর নিয়ন্ত্রণ শক্তিশালী অর্থনীতির দেশগুলোর কাছ থেকে নেবে বিশাল আকারের ট্রাকগুলো। এই মহাসড়ক থেকে বাংলাদেশী রিকশাগুলো তুলে দেয়া হবে। আর সবার জন্য লাভজনক বিশ্বায়নের ল্েয এ বিশ্ব মহাসড়কের জন্য আমাদের অবশ্যই ট্রাফিক আইন, ট্রাফিক পুলিশ ও ট্রাফিক কর্তৃপ থাকতে হবে যা দরিদ্র্যদের জন্য এ ব্যবস্থায় একটা জায়গা ও কর্মতৎপরতার ব্যবস্থা নিশ্চিত থাকবে যাতে তারা সবলদের কনুইয়ের ঠেলায় মহাসড়ক থেকে ছিটকে না পড়ে। বিশ্বায়নকে আর যা-ই হোক আর্থসাম্রাজ্যবাদে পর্যবসিত হওয়া চলবে না।
শক্তিশালী বহুজাতিক সামাজিক ব্যবসায়ও গড়ে তোলা যেতে পারে দরিদ্র মানুষ ও দেশগুলোর জন্য বিশ্বায়নের সুবিধা নিশ্চিত করতে। সামাজিক ব্যবসা হয় গরিবদের তাতে মালিকানা দেবে নয় এ ব্যবসায় লব্ধ মুনাফা দরিদ্র দেশের মধ্যেই রাখবে যেহেতু এসব প্রতিষ্ঠানের উদ্দেশ্য মুনাফা নেয়া নয়। যদি বিদেশী সামাজিক ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান সরাসরি অন্য কোনো দেশে পুঁজি বিনিয়োগ করে তাহলে যে দেশে এই বিনিয়োগ হচ্ছে সে দেশটির জন্য রীতিমতো এক রোমাঞ্চকর সুসংবাদ। লুটেরা কোম্পানিগুলোর কবলমুক্ত থেকে ও জাতীয় স্বার্থ রা করে দরিদ্র দেশগুলোর মজবুত অর্থনীতি গড়া হবে সামাজিক ব্যবসার প্রধান আগ্রহের ত্রে।
লেখক : নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ
মুক্তবাজারের সাফল্যে আমরা এতই চমৎকৃত যে, আমরা আমাদের মৌলিক ধারণাগুলোর ব্যাপারে কোনোরকম সংশয় প্রকাশ করতেও কখনো সাহস পাইনি। ব্যাপারটা আরো জঘন্য করে তোলার জন্য আমরা বরং যতটা পারা যায় আমাদের নিজেদেরকে তাত্ত্বিক নিরিখে একমাত্রিক মানুষে রূপান্তরিত করার জন্য বাড়তি খাটুনি খেটেছি যাতে করে মুক্তবাজার কার্যব্যবস্থা সাবলীল কাজ করতে পারে।
‘উদ্যোক্তা’র একটা বিস্তৃততর সংজ্ঞায় সংজ্ঞায়িত করে আমরা মুক্তবাজারের চৌহদ্দির মধ্যে পুঁজিবাদের বৈশিষ্ট্যে বৈপ্লবিক পরিবর্তন এনে আমরা বিশ্বের বহু অমীমাংসিত সমস্যার সমাধান করতে পারি। মনে করুন, একজন উদ্যোক্তার প্রেরণার একক উৎসের (যেমন, সর্বাধিক মুনাফা করা) বদলে দু’টি উৎস রয়েছে এবং এ দুই উৎস আবার পরস্পরবিরোধী অথচ সমান বাধ্যবাধকতাসম্পন্নÑ ক. সর্বাধিক মুনাফা করা এবং খ. মানুষ ও জগতের কল্যাণসাধন।
এখন এ দুয়ের প্রতিটি প্রেরণা একটি পৃথক ধরনের ব্যবসা অভিমুখী। আমরা প্রথম ধরনের প্রেরণাকে বলব মুনাফা সর্বাধিকারক ব্যবসা আর দ্বিতীয় ধরনের ব্যবসাকে বলব সামাজিক ব্যবসা। এই সামাজিক ব্যবসা হবে বাজারে প্রবর্তিত নতুন একধরনের ব্যবসা, যার উদ্দেশ্য পৃথিবীকে বদলে দেয়া। এই সামাজিক ব্যবসায় বিনিয়োগকারীরা তাদের বিনিয়োজিত পুঁজি ফিরে পেতে পারবে কিন্তু কোম্পানি থেকে কোনো মুনাফা নিতে পারবে না। বরং মুনাফা ফিরে যাবে কোম্পানিতে, যা দিয়ে ব্যবসার সম্প্রসারণ ঘটবে আরো দূরবর্তী এলাকায় আর সেই সাথে পণ্য বা সেবার মান আরো উন্নত হবে। এ ধরনের সামাজিক ব্যবসায় হবে লোকসান ও মুনাফাবিহীন কোম্পানি।
আমাদের প্রস্তাবিত সামাজিক ব্যবসা আইনে স্বীকৃত। বহু কোম্পানি রয়েছে যারা তাদের মূল ব্যবসায় তৎপরতা ছাড়াও সামাজিক ব্যবসা গড়তে এগিয়ে আসবে। মুনাফাবিহীন খাতের বহু কর্মীও এটিকে আকর্ষণীয় বিকল্প হিসেবে গ্রহণ করবেন। মুনাফাবিহীন খাতে যেখানে প্রতিষ্ঠানকে তার কর্মতৎপরতা চালিয়ে যাওয়ার জন্য চাঁদা সংগ্রহ করতে হয়, সেখানে সামাজিক ব্যবসা হয় স্বনির্ভর আর সেই সাথে সম্প্রসারণের প্রয়োজনে উদ্বৃত্ত তৈরি করতে পারে কেননা, এটা মুনাফাবিহীন উদ্যোগ প্রতিষ্ঠান। সামাজিক ব্যবসা প্রতিষ্ঠান তার পুঁজি সংগ্রহের জন্য তার নিজস্ব নতুন ধরনের মুলধন বাজারে যাবে।
বিশ্বজুড়ে, বিশেষ করে বিত্তবান দেশগুলোর যুবক-তরুণেরা সামাজিক ব্যবসার ধারণাকে অত্যন্ত আবেদনময় বলেই দেখবেন। এ কারণে যে, এ ব্যবসা তাদেরকে তাদের সৃষ্টিধর্মী প্রতিভা কাজে লাগিয়ে অনেক কিছু বদলে দেবার চ্যালেঞ্জ নেয়ার আমন্ত্রণ জানায়। আজকের বহু তরুণ-তরুণী বর্তমান পুঁজিবাদী বিশ্বে কোনো অর্থবহ, রোমাঞ্চকর চ্যালেঞ্জ নেবার সুযোগ দেখতে পায় না বলে হতাশায় ভোগে। অথচ এর পাশাপাশি সমাজতন্ত্র তাদের লড়াই করার স্বপ্ন দেখায়। তরুণেরা তাদের একান্ত নিজের নিটোল, নিখুঁত এক বিশ্ব গড়ার স্বপ্ন দেখে।
সামাজিক ব্যবসা বিশ্বের প্রায় সব আর্থসামাজিক সমস্যার প্রতিকার দেবে। কেবল চ্যালেঞ্জ হলো ব্যবসায়ের উদ্ভাবনীমূলক মডেল তৈরি করে তা সাশ্রয় ও কার্যকরভাবে কাজে লাগিয়ে বাঞ্ছিত সামাজিক সুফল নিয়ে আসা। দরিদ্রের জন্য স্বাস্থ্য পরিচর্যা, তথ্যপ্রযুক্তি, শিা ও প্রশিণ, বিপণন ও নবায়নযোগ্য ইন্ধনশক্তিÑ এসবই হলো সামাজিক ব্যবসার রোমাঞ্চকর কর্মত্রে। সামাজিক ব্যবসা গুরুত্বপূর্ণ, কেননা, এ ব্যবসা মানবজাতির অতীব গুরুত্ববহ বিষয়গুলোর সুরাহা করে। বিশ্বের মোট জনসমষ্টির যে ৬০ শতাংশ দারিদ্র্যরেখার নিচে অবহেলিত রয়ে গেছে এ ব্যবসা তাদের জীবনের খোলনলচে বদলে দিতে পারে। তাদেরকে দারিদ্র্য থেকে বেরিয়ে আসতে সহায়তা করতে পারে।
গ্রামীণের সামাজিক ব্যবসা
এমনকি সর্বাধিক মুনাফাকারী কোম্পানিগুলোকে পরিকল্পিত উপায়ে সামাজিক ব্যবসায় রূপান্তরিত করা যায়। এটা করা যায় ওই কোম্পানিতে গরিবদের পূর্ণ বা বেশির ভাগের মালিকানা দিয়ে। এ হলো দ্বিতীয় ধরনের সামাজিক ব্যবসায় কোম্পানির দৃষ্টান্ত। গ্রামীণ ব্যাংক সামাজিক ব্যবসার এই শ্রেণিভুক্ত। দরিদ্র মানুষ এসব কোম্পানির শেয়ারদাতাদের প থেকে উপহার হিসেবে পেতে পারে অথবা তারা তাদের নিজের টাকা দিয়ে এসব কোম্পানির শেয়ার কিনতে পারে। ঋণগ্রাহকেরা তাদের নিজের টাকা দিয়ে গ্রামীণ ব্যাংকের শেয়ার কিনেছেন। তাদের এই শেয়ার, যারা ঋণগ্রাহক নন, তাদের কাছে হস্তান্তরযোগ্য নয়। পেশাদার ও নিবেদিতপ্রাণ একদল লোক এ ব্যাংকের দৈনন্দিন কর্মতৎপরতা পরিচালনার কাজ করে থাকে।
দ্বিপীয় বা বহুপীয় দাতারা সহজেই এ ধরনের সামাজিক ব্যবসা প্রতিষ্ঠা করতে পারে। যখন কোনো দাতা কোনো গ্রহীতা দেশে কোনো সেতু নির্মাণের জন্য কোনো ঋণ বা মঞ্জুরি দেয় তখন ওই দাতা স্থানীয় দরিদ্রদের মালিকানায় একটা সেতু কোম্পানি গঠন করতে পারে। আর এই কোম্পানি পরিচালনার দায়িত্ব দিতে হবে একটি অঙ্গীকারবদ্ধ কোনো ব্যবস্থাপনা কোম্পানিকে। এই কোম্পানির যে মুনাফা হবে তা স্থানীয় মালিক দরিদ্র মানুষগুলো মুনাফা হিসেবেও আরো সেতু নির্মাণের অর্থ জোগানোর কাজে ব্যয় হবে। এভাবে বহু অবকাঠামো প্রকল্প যেমন, সড়ক, বিমানবন্দর, সমুদ্রবন্দর, উপযোগী কোম্পানি এভাবে গড়ে তোলা যায়।
গ্রামীণ প্রথম ধরনের দু’টি সামাজিক ব্যবসা গড়ে তুলেছে। এর একটা হলো দই তৈরির কারখানা বা ইয়োগার্ট কারখানা। এ কারখানায় পুষ্টিমানযুক্ত দই তৈরি হবে অপুষ্টির শিকার দরিদ্র শিশুদের জন্য। এ প্রতিষ্ঠান স্থাপন করা হচ্ছে ফ্রান্সের ডানোনের সাথে যৌথ উদ্যোগ প্রতিষ্ঠান হিসেবে। বাংলাদেশে অপুষ্টিপীড়িত সব শিশুর কাছে এই দই না পৌঁছানো অবধি এই ফ্যাক্টরির সম্প্রসারণ চলবে। এই ব্যবস্থার আওতায় আরেকটি চেইন প্রতিষ্ঠান হবে চু হাসপাতাল। এসব হাসপাতালের প্রতিটিতে বছরে ১০ হাজার চোখের ছানির অস্ত্রোপচার করা হবে। তবে এর জন্য খরচ ধরা হবে ধনী-গরিব ভিত্তিতে বিভিন্ন অঙ্কে।
সামাজিক স্টকমার্কেট
সামাজিক ব্যবসাগুলোর সাথে বিনিয়োগকারীদের যোগাযোগ করিয়ে দেয়ার জন্য আমাদের দরকার সামাজিক স্টকবাজার গড়ে তোলা, যেখানে কেবল সামাজিক ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানগুলোর স্টক-শেয়ারের বেচাকেনা চলবে। এই স্টক এক্সচেঞ্জে বিনিয়োগকারী আসবেন কোনো সামাজিক ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানকে তহবিল জোগানোর স্পষ্ট উদ্দেশ্য নিয়ে। এক্সচেঞ্জেও অনুরূপ উদ্দেশ্য থাকবে। আর যদি কারো নিছক টাকা বানানোর ইচ্ছে থাকে তাহলে তিনি এখনকার স্টক এক্সচেঞ্জে যাবেন।
সামাজিক স্টক এক্সচেঞ্জগুলোর যথাকর্ম পরিচালনা নিশ্চিত করার জন্য আমদের কিছু রেটিং এজেন্সি স্থাপন করা, পরিভাষাসমূহ প্রমিত করা, সংজ্ঞা নির্ধারণ করা, প্রভাব-প্রতিক্রিয়া পরিমাপ করা, প্রতিবেদন ফরম্যাট গড়ে তোলা এবং দ্য ওয়াল স্ট্রিট জার্নালের মতো নতুন অর্থনৈতিক প্রকাশনা প্রকাশের ব্যবস্থা করার দরকার হবে। এ ছাড়া প্রতিষ্ঠা করতে হবে বিজনেস স্কুলের মতো বিশেষ শিাপ্রতিষ্ঠান। এসব শিাপ্রতিষ্ঠানে ব্যবসায় ব্যবস্থাপনার ওপর কোর্স ও ডিগ্রি প্রদানের ব্যবস্থা থাকবে তরণ ব্যবস্থাপক প্রশিণের জন্য। শিার্থীরা এখানে সামাজিক ব্যবসা উদ্যোগ প্রতিষ্ঠান সবচেয়ে দতার সাথে ব্যবস্থাপনা শিখবেন। সর্বোপরি, এসব প্রতিষ্ঠান শিার্থীদের নিজেদের একেকজন সামাজিক ব্যবসা উদ্যোক্তা হওয়ার প্রেরণা দেবে।
বিশ্বায়নে সামাজিক ব্যবসায়ের ভূমিকা
আমি বিশ্বায়নের সমর্থক। আমি বিশ্বাস করি দারিদ্র্য বিমোচনের অন্যান্য বিকল্পের তুলনায় বিশ্বায়ন গরিবদের বরং ঢের বেশি উপকার করতে পারে। তবে বিশ্বায়ন হতে হবে যথার্থ ধরনের বিশ্বায়ন। আমার ধারণায় বিশ্বায়ন হলো শত লেনযুক্ত একটা জনপথের মতো কিছু যা সারা বিশ্বের ওপর দিয়ে চলে গেছে। যদি আমরা ধরে নিই, এ সড়ক সবার জন্য খোলা তাহলে এর লেনগুলোর নিয়ন্ত্রণ শক্তিশালী অর্থনীতির দেশগুলোর কাছ থেকে নেবে বিশাল আকারের ট্রাকগুলো। এই মহাসড়ক থেকে বাংলাদেশী রিকশাগুলো তুলে দেয়া হবে। আর সবার জন্য লাভজনক বিশ্বায়নের ল্েয এ বিশ্ব মহাসড়কের জন্য আমাদের অবশ্যই ট্রাফিক আইন, ট্রাফিক পুলিশ ও ট্রাফিক কর্তৃপ থাকতে হবে যা দরিদ্র্যদের জন্য এ ব্যবস্থায় একটা জায়গা ও কর্মতৎপরতার ব্যবস্থা নিশ্চিত থাকবে যাতে তারা সবলদের কনুইয়ের ঠেলায় মহাসড়ক থেকে ছিটকে না পড়ে। বিশ্বায়নকে আর যা-ই হোক আর্থসাম্রাজ্যবাদে পর্যবসিত হওয়া চলবে না।
শক্তিশালী বহুজাতিক সামাজিক ব্যবসায়ও গড়ে তোলা যেতে পারে দরিদ্র মানুষ ও দেশগুলোর জন্য বিশ্বায়নের সুবিধা নিশ্চিত করতে। সামাজিক ব্যবসা হয় গরিবদের তাতে মালিকানা দেবে নয় এ ব্যবসায় লব্ধ মুনাফা দরিদ্র দেশের মধ্যেই রাখবে যেহেতু এসব প্রতিষ্ঠানের উদ্দেশ্য মুনাফা নেয়া নয়। যদি বিদেশী সামাজিক ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান সরাসরি অন্য কোনো দেশে পুঁজি বিনিয়োগ করে তাহলে যে দেশে এই বিনিয়োগ হচ্ছে সে দেশটির জন্য রীতিমতো এক রোমাঞ্চকর সুসংবাদ। লুটেরা কোম্পানিগুলোর কবলমুক্ত থেকে ও জাতীয় স্বার্থ রা করে দরিদ্র দেশগুলোর মজবুত অর্থনীতি গড়া হবে সামাজিক ব্যবসার প্রধান আগ্রহের ত্রে।
লেখক : নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ
No comments