গেঁটে বাতের লক্ষণ ও চিকিৎসা by ডা. শাহজাদা সেলিম

গেঁটে বাতের লক্ষণ ও চিকিৎসা
‘গেঁটে বাত’ বা গাউট এমনই একটা রোগ, যা অসুস্থতা নির্ণয়ের পাশাপাশি বুঝিয়ে দেয় রোগীর আর্থিক সামর্থ্য কতটুকু। কারণ সোজাসাপ্টা কথা, না খাওয়া, অভাবী বা অপুষ্টির শিকার কোনো মানুষেরই কখনও গেঁটে বাত রোগটি হয় না। তাই বলা যায়, এ রোগটি তথাকথিত একটি রোগ। গেঁটে বাত কিন্তু মহিলাদের চেয়ে পুরুষদেরই বেশি হয়। এবং সাধারণত মধ্য বয়সে এ রোগটির আবির্ভাব ঘটে। এমনকি ষাট-সত্তর বছর বয়সেও এ রোগ হতে পারে।
এই তথ্যগুলোর ওপর ভিত্তি করে বাতকে প্রধানত দুই ভাগে ভাগ করা হয়।
ক) প্রাইমারি বাত বা গাউট: যা প্রধানত ছেলেদের হয় এবং প্রদাহজনিত কারণই এই রোগ সৃষ্টির মূল কারণ। সাধারণত ৪০ বছর বয়সের উপরে এই রোগে আক্রান্ত হওয়ার প্রবণতা বেশি।
খ) সেকেন্ডারি গাউট : এটি মূলত কিডনি বিকলতার কারণে অথবা ওষুধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ায় হয়ে থাকে। এটি অবশ্য মহিলাদের ক্ষেত্রে বেশি এবং সাধারণত ৬৫ বছরের বেশি বয়সে দেখা যায়।
লক্ষণ
গেঁটে বাত রোগটির উপস্থিতি প্রাথমিক পর্যায়ে খুব বেশি অনুভব করা যায় না। গেঁটে বাত শরীরের জয়েন্টগুলোকে মূলত ক্ষতিগ্রস্ত করে। শরীরের জোড়াস্থানগুলো ফুলে যায়, লাল হয়ে যায় এবং যন্ত্রণা করে। সাধারণত হঠাৎ করেই এর লক্ষণ প্রকাশ পায় এবং ২-৬ ঘণ্টার মাঝে এর তীব্রতা প্রকাশ পায়। সচরাচর সকালে ঘুম থেকে উঠার পর রোগী এ ব্যথা অনুভব করে। এই কষ্টকর রোগটা সাধারণত বেশি হয়- পায়ের বুড়ো আঙুলে অথবা হাঁটুতে। তখন এ রোগটিকে চিকিৎসকদের পরিভাষায় : পোডাগ্রা’ বলে। এ ছাড়া আক্রান্ত অন্য জয়েন্টগুলো হলো—
ক) গোড়ালির জয়েন্ট;
খ) মধ্য পায়ের জয়েন্ট;
গ) হাঁটুর জয়েন্ট;
ঘ) হাতের ছোট ছোট জয়েন্ট;
ঙ) কব্জির জয়েন্ট;
চ) কনুইর জয়েন্ট।
এ রোগ ধীরে ধীরে আপনা আপনি প্রশমিত হয়ে যায় সাধারণত ৫-১০ দিনের মধ্যে।
তবে কখনও কখনও এক ধরনের নকল গেঁটে বাত ধোকা দিতে পারে এবং ঝামেলা বাড়তে পারে। এতেও গিরা ফুলে যায়, লাল হয় এবং ব্যথা হয়। সব লক্ষণগুলো একই রকমের। পরীক্ষাগারে কোনো রাকম পরীক্ষা-নিরীক্ষা না করেই যদি কোনো চিকিৎসক এই নকল গেঁটে বাতের লক্ষণগুলো শুনেই চিকিৎসাপত্র দিয়ে দেন তবে শুধু চিকিৎসা বিভ্রাটই হবে।
রোগের সৃষ্টি
রক্তে যখন ‘ইউরিক এসিড’ বেড়ে যায়, তখন ধীরে ধীরে এই বেড়ে যাওয়া এসিড অল্প অল্প করে শরীরের বিভিন্ন খাঁজে বা পকেটগুলোয় জমা হতে থাকে এবং ক্রিস্টাল ধারণ করে। ধীরে ধীরে জমতে জমতে একদিন হঠাৎ করে দেখা যায় জয়েন্ট ফুলে যায়, লাল হয়ে যায় এবং ব্যথা হতে থাকে। যেহেতু ইউরিক এসিড ক্রিস্টালগুলো দেখতে সুঁচের মতো, তাই যন্ত্রণা হওয়াটা স্বাভাবিক ব্যাপার।
কিন্তু একটা কথা হলো— শরীরের রক্তে এই ইউরিক এসিডের মাত্রা বেড়ে গেলেই যে সবসময় গেঁটে বাত রোগটি হবেই এমন কথা কিন্তু নেই। কারণ এই ইউরিক এসিডের পরিমাণ স্বাভাবিকের চাইতে বেড়ে গিয়ে যদি দেহের কিডনিতে জমা হয়, তবে তা থেকে হতে পারে রেনাল বা কিডনি স্টোন। আর যদি ত্বকের নিচে জমা হয় তবে তা থেকেও এ রকম বাত হয়।
রোগ সৃষ্টির উপযুক্ত সময়
প্রথমত, রক্তে ইউরিক এসিডের পরিমাণ স্বাভাবিকের চেয়ে বেড়ে গেলে এবং তা জয়েন্টে জমা হয়ে বিদ্রোহ করে বসে তবে গেঁটে বাত হয়। সহজভাবে বলতে হয়, মূলত তিনটি কারণে এটা হয়।
ক) যদি আমাদের দৈনন্দিন খাদ্য তালিকায় খাসির মাংসসহ লালজাতীয় মাংস, শুকনো শিমজাতীয় দানা, মটরশুটি, মাশরুম, মাছের ডিম, কলিজা, কচু, লাল পুঁইশাক বা অ্যালকোহলের পরিমাণ বেশি থাকে, যা রক্তে ইউরিক এসিড বাড়তে পারে।
খ) এটা বংশানুক্রম বা জেনেটিক কারণে হতে পারে।
গ) আবার যারা শরীর হালকা বা মেদহীন রাখার জন্য কঠোর ডায়েটিং করেন তাদের ওজন অস্বাভাবিকভাবে কমে যাওয়ার কারণেও হতে পারে।
ঘ) দীর্ঘদিন উপোস থাকার কারণে শরীরের রক্তে এই ইউরিক এসিডের মাত্রা বেড়ে যায়।
ঙ) যাদের কিডনির সমস্যা আছে তাদের শরীর থেকে ঠিকমতো তৈরি হওয়া ইউরিক এসিড যখন প্রস্রাবের সাথে বেরিয়ে যেতে পারে না।
পরীক্ষা-নিরীক্ষা
ক) যদি রক্তে স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি পরিমাণ ইউরিক এসিডের উপস্থিতি থাকে, তবে ধরে নেওয়া চলে যে এটা গেঁটে বাতের ইঙ্গিত। তবে অনেক সময় গেঁটে বাত থাকা সত্ত্বেও রক্ত পরীক্ষায় ইউরিক এসিডের মাত্রায় কোনো অস্বাভাবিকতা ধরা পড়ে না।
আবার গেঁটে বাত একেবারেই হয়নি কিন্তু পরীক্ষায় দেখা যায়, রক্তে ইউরিক এসিডের মাত্রা বেশি। মাঝে মধ্যে রক্ত পরীক্ষায় এমন ফলাফল আসতে পারে। তখন চিকিৎসকরা গেঁটে বাত আক্রান্ত রোগীর গিরা হতে ‘জয়েন্টের ভিতর থেকে পানি’ নিয়ে পরীক্ষা করে দেখেন যে, আক্রান্ত স্থানে ইউরিক এসিড ক্রিস্টাল আছে কিনা। আর এই পরীক্ষা করা হয় গিরায় গেঁটে বাতের মারাত্মক আক্রমণের সময়টাতে। অন্য সময় করলে কিছুই বোঝা যাবে না। তবে চিকিৎসকরা প্রথমেই এই দ্বিতীয় পরীক্ষাটি করার পরামর্শ দেন না।
খ) ২৪ ঘণ্টার প্রস্রাবের ইউরিক এসিডের মাত্রা। সাথে কিডনির কার্যকারিতার স্বাভাবিক পরীক্ষাসমূহ।
গ) প্রাইমারি গাউট সন্দেহ হলে অভুক্ত অবস্থায় লাইপোপ্রোটিনের মাত্রা দেখা হয়।
ঘ) রক্তের ইএসআরের মাত্রা বৃদ্ধি বরাবরই টোফিয়াস গাউটে বেশি দেখা যায়।
ঙ) আক্রান্ত জয়েন্টে এক্স-রে করা যেতে পারে।
চিকিৎসা
প্রাথমিকভাবে বাত সৃষ্টিকারী কারণ দমন করাই মূল লক্ষ্য হতে পারে। এ জন্য খাদ্যগ্রহণসহ দৈনন্দিন জীবনে বিভিন্ন ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। পাশাপাশি ব্যথা নিরাময় ও রোগ দমনের জন্য ওষুধ সেবন করা অপরিহার্য। চিকিৎসা সুবিধার জন্য নিম্নলিখিত তিনভাগে বর্ণনা করা হলো—
ক) হঠাৎ আক্রান্ত বাত
ক.১ এক্ষেত্রে দ্রুত কার্যক্ষম ননস্টেরয়েডাল অ্যান্টিইনফ্লামেটরি ড্রাগ। যেমন— ন্যাপ্রোক্সেন, ডাইক্লোফেনাক ও ইনডোমেথাসিন জোরাল ভূমিকা রাখে ব্যথা নিরাময়ে।
ক.২ অপরদিকে ওরাল কলচিসিনও জোরাল ভূমিকা রাখতে পারে। তবে এক্ষেত্রে বমি ও ডায়রিয়া প্রধান প্রতিবন্ধকতা হিসেবে দেখা দেয়।
ক.৩ তীব্র ব্যথার সময় আক্রান্ত জয়েন্ট থেকে সিরিঞ্জের সাহায্যে তরল পদার্থ বের করে আনলে রোগী বেশ সুস্থতা বোধ করেন। পাশাপাশি জয়েন্টের অবস্থা বেশি তীব্র আকার ধারণ করলে তরল পদার্থ বের করার পাশাপাশি ওই জয়েন্টে ইনজেকশনের সাহায্যে স্টেরয়েডও প্রবেশ করানো হয়।
খ) দীর্ঘস্থায়ী চিকিৎসা
এক্ষেত্রে রোগীকে পরামর্শ দেওয়াটাই প্রধান। প্রধানত রোগীকে শরীর থেকে মেদ ঝরানোর পাশাপাশি অ্যালকোহল বা সে রকম পদার্থ গ্রহণে সতর্কতার কথা শিখেয়ে দেওয়া হয়। দীর্ঘমেয়াদি চিকিৎসায় ইউরিক এসিডের মাত্রা কম রাখার জন্য মূলত ড্রাগ ব্যবহৃত হয়। সেক্ষেত্রে শর্তগুলো হলো—
খ.১ বার বার গেঁটে বাতে আক্রান্ত হওয়া
খ.২ টফিতে আক্রান্ত হওয়া;
খ.৩ হাড় ক্ষয় বা অস্থি সন্ধিতে প্রখর সমস্যা;
খ.৪ গেঁটে বাতের সাথে কিডনি সমস্যা;
খ.৫ বাত এবং তার সাথে রক্তে ইউরিক এসিডের উচ্চমাত্রা।
গ.১ অ্যালোপুরিনল : প্রারম্ভিক মাত্রা হলো— ১০০-৩০০ মিলিগ্রাম প্রতিদিন। তবে কিডনি রোগে আক্রান্তদের ক্ষেত্রে মাত্রা কম হবে। ধীরে ধীরে এ মাত্রা কমিয়ে আনতে হবে। অথবা মাত্রা কমানোর পাশাপাশি ওরাল কলচিসিন ০.৫ মিলিগ্রাম করে ১২ ঘণ্টা পর পর প্রথম কয়েক সপ্তাহ চালিয়ে যেতে হবে।
গ.২ প্রোবিনেসিড : ০.৫ মিলিগ্রাম ১ গ্রাম প্রতি ১২ পর পর অথবা সালফিন পাইরাজোন : ১০০ মিলিগ্রাম প্রতি ৮ ঘণ্টা পর পর দেওয়া যেতে পারে।
উল্লেখ্য, এসব ড্রাগের সাথে স্যালিসাইলেট জাতীয় ওষুধ প্রয়োগ নিষেধ।
গ.৩ লক্ষণবিহীন হাইপার ইউরেসিমিয়া।
এক্ষেত্রে লক্ষণীয় যে, একা একাই এই রোগ সৃষ্টির জন্য যথেষ্ট নয়।
উল্লেখ্য, সেকেন্ডারি হাইপার ইউরেসেমিয়ার কারণ বের করে তবেই চিকিৎসা দিতে হবে।
সতর্কতা
প্রথমত অন্য ধরনের কতগুলো জয়েন্ট সম্পর্কিত অসুখের সাথে গেঁটে বাতের বাহ্যিক লক্ষণগুলো প্রায় একই রকম হয়ে থাকে। ফলে এর সাথে অন্য বাতের পার্থক্যটা প্রাথমিকভাবে সহজে ধরা যায় না। আর বিপত্তিটা ঘটে তখনই। না বুঝে বা আনাড়ি চিকিৎসকের হাতে পড়ে ওষুধ খাওয়া শুরু করলে মারাত্মক বিপর্যয় ঘটতে পারে। অপরদিকে টোটকা চিকিৎসা, ঝাড়ফুঁক বা মালিশ তা যত বৈজ্ঞানিকই হোক না কেন, ব্যথা হয়তো সাময়িকভাবে উপশম হতে পারে কিন্তু স্থায়ী কাজ হবে না। আর সত্যি কথা বলতে কি গেঁটে বাত একবার শরীরে বাসা বাঁধলে কোনো চিকিৎসা দ্বারা একেবারে মুক্তি পাওয়া সম্ভব না। সতর্ক ও নিয়ম-মাফিক জীবনযাপন করলে গেঁটে বাতকে দমিয়ে রাখা সম্ভব।
তবে সারা পৃথিবীতে অন্যান্য রোগের মতো গেঁটে বাতের চিকিৎসার কাজ করেছেন অনেক চিকিৎসা বিজ্ঞানী। চলছে নানা ধরনের সাধনা। শুধু রক্তে ইউরিক এসিডের বেড়ে যাওয়াটাকে প্রতিহত করতে পারলেই গেঁটে বাত রোগ থেকে পরিত্রাণ পাওয়া যাবে।
গেঁটে বাতের হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য সাধারণ পরামর্শ
ক) মদ না খাওয়া, ডায়েটিং করার নামে খাওয়া দাওয়া একেবারে ছেড়ে না দেওয়া। প্রচুর পরিমাণে নিয়মিত পানি পান করা যাতে অন্তত কিডনি স্বাভাবিক কাজকর্ম করতে পারে। নিয়মিত ব্যয়াম করলে অনেক সময় এই গেঁটে বাত রোগ হতে বাঁচতে পারা যায়।
খ) বেশি তেল-মশলা যুক্ত এবং বেশি প্রোটিন যুক্ত খাবার পরিহার করা।
গ) ওজন কমানোর জন্য বা অন্য কোনো কারণে দীর্ঘমেয়াদি উপোস থাকা উচিত নয়।
ঘ) প্রচুর পরিমাণে পানি খাওয়া দরকার প্রতিদিন। অবশ্য যারা হার্ট কিংবা কিডনির রোগে ভুগছেন তাদের জন্য এ পরামর্শ নয়।
ঙ) খাওয়া-দাওয়ার ব্যাপারে সতর্ক হতে হবে। যে সব খাদ্য শরীরে মেদ বা ওজন বাড়ায়, তা একেবারেই বর্জন করতে হবে।
চ) রেড মিট মানে অতি লাল মাংস, শুকনো সিম, মটরশুটি, কচু, লাল পুঁইশাক এবং সি-ফুড পরিহার করা উচিত।
ছ) একেবারে ২৪ ঘণ্টা শুয়ে-বসে থাকলে চলবে না। পরিমিত ব্যায়াম করতে হবে।
লেখক : ডা. শাহজাদা সেলিম
এমবিবিএস, এমডি (এন্ডোক্রাইনোলজি ও মেটাবলিজম)
এমএসিই (ইউএসএ)
হরমোন ও ডায়াবেটিস বিশেষজ্ঞ
শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল
কমফোর্ট ডক্টরস্ চেম্বার
১৬৫-১৬৬, গ্রীন রোড, ঢাকা
ফোন : ৮১২৪৯৯০, ৮১২৯৬৬৭, ০১৯১৯০০০০২২
Email: selimshahjada@gmail.com
দিরিপোর্ট২৪.কম’

No comments

Powered by Blogger.