ট্র্যাজিক প্রেম, দুটি গান এবং নির্দোষ কুদ্দুসের ফাসি by শফিক রেহমান

পঞ্চাশের দশকে গ্র্যাজুয়েশন অথবা মাস্টার্সের শেষে যখন আমার সহপাঠী ও সমসাময়িকরা সিভিল সার্ভিসে যোগ দেওয়ার জন্য মনোনিবেশ করেছিলেন আমি তখন লন্ডনে যাওয়ার জন্য সর্বাত্মক চেষ্টা করেছিলাম। এর প্রধান দুটি লক্ষ্য ছিল :
এক. লেখা ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতা অর্জনের জন্য চার্টার্ড একাউন্টেন্ট হওয়া এবং দুই. হাওয়াইয়ান স্টাইলে হাওইয়ান গিটার বাজানো শেখা।
৮ নভেম্বর ১৯৫৭-তে ঢাকা ছেড়ে করাচি পৌছাই পিআইএ-র সুপার কনস্টেলেশন প্লেনে। সেই সময়ে ঢাকা ছিল ডমেস্টিক এয়ারপোর্ট। করাচি ছিল ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্ট এবং সেখানেই হতো কাস্টমস ও ইমিগ্রেশন চেকিং। ১০ নভেম্বর করাচি ছেড়ে বৃটিশ ওভারসিজ এয়ারওয়েজ (বিওএসি নামে পরিচিত)-এর বৃস্টল ব্রাবাজন টারবো প্রপ প্লেনে জুরিখ হয়ে ১১ নভেম্বর সন্ধ্যায় পৌছাই প্যারিসে। ওরলি এয়ারপোর্টে। আমার দুই প্রিয় বন্ধু, ফারুক চৌধুরী ও আবদুল বারি আমাকে এয়ারপোর্টে রিসিভ করেছিলেন। তারা তখন পাকিস্তান ফরেন সার্ভিসে নিয়োগপ্রাপ্ত এবং প্যারিসে ফ্রেঞ্চ ভাষা শিখছিলেন।
সেখানে চার দিন থেকে ১৫ নভেম্বর ১৯৫৭-র সন্ধ্যায় পৌছাই লন্ডনে হিথরো এয়ারপোর্টে। তখন আমার পিতা সাইদুর রহমান একটি স্কলারশিপে ছিলেন লন্ডন ইউনিভার্সিটিতে। তারপর একটানা দশ বছরেরও বেশি ছিলাম লন্ডনে এবং দুটি লক্ষ্যই অর্জনে সফল হয়েছিলাম।
প্রথম লক্ষ্যটি অর্জনের সুফলে আমি লেখালেখি ও অন্যান্য কর্মকাণ্ডে স্বাধীনভাবে আমার মত প্রকাশ করতে পেরেছি এবং মৃত্যুদণ্ডে অতি উৎসাহী আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকা সত্ত্বেও এই চরম অসভ্যতার বিরুদ্ধে লিখতে পারছি। আর দ্বিতীয় লক্ষ্যটি অর্জনের সুফলে ওয়েস্টার্ন মিউজিকের সঙ্গে আমার পরিচয়ের সুবাদে মৃত্যুদণ্ড বিষয়ে গান শুনতে এবং গিটারে সেই সুর তুলতে পেরেছিলাম।
মৃত্যুদণ্ড বিষয়ে গান?
এ রকম কঠিন বিষয়ে গান?
হ্যা।
মৃত্যুদণ্ড বিষয়ে দুটি গান এক সময়ে পশ্চিমের বিভিন্ন দেশে খুবই জনপ্রিয় হয়েছিল।
১৯৫৮-তে ইংল্যান্ডে হিট হয় টম ডুলি (Tom Dooley) গানটি। প্রথমে আটলান্টিকের অপর পারে আমেরিকান গায়কত্রয় দি কিংসটন টৃও (The Kingston Trio) এই গানটি জনপ্রিয় করেন। তারপর ইংল্যান্ডে লনি ডোনেগান গানটি জনপ্রিয় করেন।
এই গানটির আট বছর পরে ১৯৬৬-তে লন্ডনে টম জোনস (Tom Jones) জনপ্রিয় করেন গৃন, গৃন গ্রাস অফ হোম (Green, Green Grass of Home) গানটি।
এই দুটি গানের জনপ্রিয়তা বৃটেনে মৃত্যুদণ্ড রহিত করতে জনমত গঠনে খুব সহায়ক হয়েছিল। বিশেষত টম ডুলি গানটি। কারণ, ধারণা করা হয় টম ডুলি ছিলেন নিরপরাধ এবং ত্রুটিপূর্ণ বিচারে তার ফাসি হয়েছিল।
ঘটনাটি জেনে নিন।
টম ডুলির ট্র্যাজিক ত্রিভুজ প্রেম
টম ডুলি-র জন্মগত নাম ছিল টমাস সি ডুলা (Thomas C Dula)। আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের পূর্বাঞ্চলীয় অঙ্গরাজ্য নর্থ ক্যারোলাইনার অ্যাপালেচিয়ান পাহাড়ি এলাকায় উইলক্সবরোতে একটি গরিব পরিবারে টম ডুলির জন্ম হয়েছিল ২২ জুন ১৮৪৬-এ। স্থানীয় উচ্চারণে ডুলাকে বলা হতো ডুলি। তাই তিনি পরিচিত হন টম ডুলি নামে।
তিন ভাইয়ের মধ্যে টম ছিলেন সর্বকনিষ্ঠ। তার ছোট ছিলেন এলিজা নামে এক বোন। শৈশবে স্কুলে টমের পরিচয় হয়েছিল এলিজার বান্ধবী অ্যান এবং অ্যানের দুই কাজিন সিস্টার লরা ও পলিনের সঙ্গে।
শৈশব পেরিয়ে যৌবনে ঢোকার মুহূর্তে টম আর অ্যানের সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ হয়। অ্যানের বয়স যখন মাত্র চৌদ্দ তখন তার মা একদিন অ্যানকে আবিষ্কার করেন টমের সঙ্গে একই বিছানায়। টম ঘটনাটা কোনো রকমে সামলে নেন।
মায়ের কাছে ধরা পড়ার পর অ্যান বাধ্য হয়েছিলেন টমকে এড়িয়ে চলতে। তাদের দুজনের প্রতিবেশী ছিলেন একজন বয়স্ক কিন্তু ধনী কৃষক ও মুচি জেমস মেলটন। অ্যানের মা চেয়েছিলেন জেমসের সঙ্গে অ্যানের বিয়ে হোক। তাই হয়েছিল।
আমেরিকায় তখন গৃহযুদ্ধ (১৮৬১ Ñ ১৮৬৫) শুরু হতে যাচ্ছিল। অ্যান আর জেমসের বিয়ে হয়ে যায়। তারপর কনফেডারেট আর্মির পক্ষে যোগ দিয়ে জেমস চলে যান যুদ্ধে। কনফেডারেট আর্মি দাসত্ব প্রথার বিরুদ্ধে লড়ছিল। গৃহযুদ্ধে তারা বিজয়ী হয়েছিল এবং আমেরিকাতে দাসত্ব প্রথা নিষিদ্ধ হয়েছিল।
টমও আমেরিকান গৃহযুদ্ধে যোগ দিতে চান। কিন্তু বয়স কম থাকায় তার আবেদনপত্র নাকচ হয়ে যায়। তারপরও তিনি চেষ্টা চালিয়ে যান। ১৫ মার্চ ১৮৬২-তে তিনি তখন কনফেডারেট আর্মিতে যোগ দেওয়ার অনুমতি পান তখন তার বয়স আঠার হতে তিন মাস বাকি ছিল।
জেমস ও টম উভয়ে ব্যাটল অফ গেটিসবার্গ-এ অংশ নেন। তারা দুজনই বন্দি হয়েছিলেন।
অল্প বয়স থেকেই টম কয়েকটি বিষয়ে ছিলেন ব্যতিক্রমী।
খুব গরিব পরিবারে জন্ম এবং একটি অখ্যাত স্কুলে পড়াশোনা করলেও তার সাক্ষরতা ছিল অসাধারণ। সেই বয়সেই তিনি ১৫ পৃষ্ঠাব্যাপী আত্মজীবনী লিখে ফেলেছিলেন। তিনি বাশি ও ড্রাম বাজাতে পারতেন। এসব গুণের জন্য টম অল্প বয়স থেকেই হয়েছিলেন লেডিজম্যান Ñ নারীদের প্রিয়পাত্র। নারীরা তাকে কাছে পেতে চাইত।
গৃহযুদ্ধের সময়ে সেনাবাহিনীতে তিনি তার ঊর্ধ্বতন অফিসার কর্নেল ভান্স-এর মন জয় করেছিলেন এবং সহযোদ্ধাদের প্রিয়পাত্র হয়েছিলেন। কারণ টমের ছিল সাহস। যুদ্ধের সময় একাধিকবার তিনি আহত হয়েছিলেন। তার ভাইরা যুদ্ধে মারা গিয়েছিলেন।
যুদ্ধ শেষে টম ও জেমস দুজনই বাড়ি ফিরে আসেন। যদিও তখন অ্যান ছিলেন জেমসের স্ত্রী তবু আত্মবিশ্বাসে ভরপুর টম তার সঙ্গে পূর্ব সম্পর্কের নবায়ন করলেন। অর্থাৎ পরকীয়া প্রেমে লিপ্ত হলেন। কিন্তু সেখানেই তিনি থেমে থাকলেন না। অ্যানের কাজিন সিস্টার লরা ফস্টারের সঙ্গেও অন্তরঙ্গ সম্পর্ক গড়ে তুললেন।
কয়েক মাস পরে লরা অন্তঃসত্ত্বা হয়ে পড়েন। টম ও লরা ঠিক করেন তারা পালিয়ে যাবেন। পালানোর দিনক্ষণ ধার্য হয় ২৫ মে ১৮৬৬-তে সকাল বেলা।
লরা থাকতেন তার পিতামাতার সঙ্গে। পিতা মি. ফস্টার ঘোড়া পালতেন। সেদিন ভোরে উঠে বেলে নামে একটি ঘোড়ার পিঠে চেপে সবার অজ্ঞাতসারে লরা চলে যান। এরপর তাকে জীবিত অবস্থায় আর পাওয়া যায়নি।
সেদিন যে কি ঘটেছিল তার সত্য ও পূর্ণ বিবরণ পাওয়া যায়নি। এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন গুজব ও কল্পকাহিনীর প্রতি মানুষ ঝুকে পড়ে।
কেউ কেউ মনে করেন অ্যানই খুন করেছিলেন লরাকে। কারণ অ্যান তখনো ভালোবাসতেন টমকে এবং লরা বিয়ে করবেন টমকে Ñ এটা জানার পর থেকে অ্যান প্রচণ্ড ঈর্ষাপরায়ণ হয়েছিলেন।
আবার কেউ কেউ মনে করেন টম জানতেন অথবা সন্দেহ করেছিলেন অ্যানই ছিলেন লরার খুনি। কিন্তু যেহেতু টমও তখনো ভালোবাসতেন অ্যানকে সেহেতু তিনি (টম) গ্রেফতার হওয়ার পরে অ্যানকে বাচানোর জন্য খুনের দায়িত্ব নিয়েছিলেন।
ওই সময়ে অ্যানের দেওয়া তথ্য থেকে লরার মৃতদেহ পুলিশ খুজে পায়। এর ফলে অনেকেই মনে করেন, টম নয় Ñ প্রকৃত খুনি ছিলেন অ্যান।
এই সন্দেহ আরো বিশ্বাসযোগ্যতা পায় যখন অ্যানের আরেক কাজিন সিস্টার পলিন (লরার বোন) সাক্ষ্য দেন যে, এক রাতে তাকে (পলিন) নিয়ে অ্যান গিয়েছিলেন লরার কবর চেক করতে। অ্যান নিশ্চিত হতে চেয়েছিলেন কবরটা কেউ খুজে পায়নি।
এদিকে আদালতে কয়েকজন সাক্ষী জানায় যে টমের যৌন রোগ (সিফিলিস) হয়েছিল এবং সেজন্য টম প্রচণ্ড ক্ষুব্ধ ছিলেন। তিনি তাদের (সাক্ষীদের) বলেছিলেন, যে নারী তাকে এই রোগ দিয়েছে তাকে তিনি খতম করবেন। সাক্ষীরা আরো বলেন, টমের বদ্ধমূল বিশ্বাস হয়েছিল রোগটা এসেছিল লরার কাছ থেকে এবং টম পরবর্তী সময়ে রোগটা সংক্রমিত করেছিলেন অ্যানের দেহে। স্থানীয় ডাক্তার সাক্ষ্য দেন যে, তিনি টম এবং অ্যানের সিফিলিসের চিকিৎসা করেছিলেন। তবে তিনি আরো বলেন, পলিনেরও এই রোগ হয়েছিল এবং প্রথম চিকিৎসাটি করিয়েছিলেন পলিন। তাই অনেকের ধারণা হয় পলিনের কাছ থেকে রোগটি পেয়েছিলেন টম, যিনি ভুল করে ভেবেছিলেন লরার কাছ থেকে রোগটি পেয়েছিলেন। এরা ধারণা করেন, নিজের দোষ ঢাকার জন্য এবং টমের হুমকির হাত থেকে বাচার জন্য পলিনই হয়তো তার আপন বোন লরাকে খুন করেছিলেন।
টম, অ্যান আর পলিন Ñ এই তিনজনের মধ্যে কে তাহলে ছিলেন প্রকৃত খুনি?
লরার গলিত দেহাবশেষ পাওয়া গিয়েছিল একটি অগভীর ছোট কবরে। কবরটি ছোট ছিল বলে লরার হাটু ভাজ করে সেখানে তাকে শায়িত করা হয়েছিল। তার বুকে শুধু একটি ছুরিকাঘাতের চিহ্ন ছিল।
শান্ত একটি শহরে এ ধরনের একটি খুন যেখানে তিনজন ছিলেন খুনিরূপে সন্দেহভাজন এবং যেখানে খুনের মোটিভ হতে পারত তিনটি :
প্রেম (অ্যানের প্রতি টমের) অথবা
ঈর্ষা (লরার প্রতি অ্যানের) অথবা
অপরাধ গোপন (পলিনের)।

ঘটনাটি সারা দেশে বিশাল পাবলিসিটি পায়। দি নিউ ইয়র্ক টাইমস এই মামলার বিস্তারিত বিবরণ ছাপতে থাকে। জীবিত অবস্থাতেই টম ডুলি লেজেন্ড (Legend, উচ্চারণ লিজেন্ড নয়) বা কিংবদন্তিতে পরিণত হন।
আদালতে টমের পক্ষে সাক্ষ্য দিতে এগিয়ে আসেন নর্থ ক্যারোলাইনার গভর্নর জেবুলন ভান্স যিনি গৃহযুদ্ধের সময় ছিলেন টমের ঊর্ধ্বতন অফিসার।
তিনি বিশ্বাস করেছিলেন টম নিরপরাধ এবং রাজনৈতিক কারণেও তিনি চাননি যে একজন বীর যোদ্ধা অন্যায়ভাবে দণ্ডিত হোক। কিন্তু টমের স্থানীয় এলাকা উইলক্সবরোতে তার বিরুদ্ধে জনমত প্রবল হয়ে উঠছিল। গভর্নর ভান্স সিদ্ধান্তে আসেন স্থানীয় এলাকায় বিচারকরা প্রভাবিত হতে পারেন স্থানীয় জনমতের দ্বারা। টম ন্যায়বিচার পাবেন না। তাই তিনি টমের বিচার স্টেটসভিল-এ স্থানান্তরিত করেন।
স্টেটসভিলে টমের সঙ্গে অভিযুক্ত হন তার বন্ধু জ্যাক কিটন। বলা হয় খুনের সহযোগী ছিলেন জ্যাক। কিন্তু আদালতে টম বলেন, তিনি একাই খুন করেছিলেন লরাকে। টমের কথায় জ্যাক মুক্তি পান। টমের মৃত্যুদণ্ড হয়। টম আপিল করেন। কিন্তু তার আপিল নাকচ হয়ে যায়।
ফাসিতে টমের (২২) মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয় ১ মে ১৮৬৮-তে Ñ লরা খুন হওয়ার প্রায় দুই বছর পরে। টমের ছোট বোন ও তার স্বামী মৃতদেহ নিয়ে কবর দেন।
কথিত আছে, ফাসির পূর্ব মুহূর্তে টম বলেছিলেন, জেন্টলমেন, আপনারা এই হাতটি দেখছেন? আমি ওই মেয়েটির মাথার একটি চুলেরও ক্ষতি করিনি (Gentlemen, do you see this hand? I didn-t harm a hair on the girl-s head)।
এভাবে মৃত্যুর আগে টম জানিয়ে যান আদালতে আত্মস্বীকৃত খুনি হলেও আসলে তিনি খুনি ছিলেন না।
এরপর ক্রমেই টম ডুলির পক্ষে জনমত গড়ে উঠতে থাকে। তাকে নিয়ে কবিতা, গান ও কাহিনী ছড়িয়ে পড়তে থাকে। টমাস ল্যান্ড নামে একজন স্থানীয় কবি একটি গান লেখেন। সেই গান ১৯৫৮-তে আমেরিকান গায়কত্রয় দি কিংসটন টৃও-র গাওয়া, হ্যাং ডাউন ইয়োর হেড টম ডুলি (Hang down your head Tom Dooley, 1958) ওয়ার্ল্ড হিট হয়। ইউটিউবে ১ আগস্ট ২০১৪-তে এই গানের হিট সংখ্যা ছিল ৮৮০,৪৩৭। এই গানের ৬০ লাখের বেশি রেকর্ড বিক্রি হয়। গানটির জার্মান, ফ্রেঞ্চ, স্প্যানিশ, ইটালিয়ান ভার্সন বিভিন্ন গায়ক রেকর্ড করেন। ইউটিউবে গেলে এই গানটির বিভিন্ন সংস্করণ পাওয়া যাবে। সর্বাধুনিক একটি সংস্করণ বেনজামিন মাসের-এর গাওয়া ইন্টারনেট হিট হয়েছে। ইউটিউবে ১ আগস্ট ২০১৪-এ এই সংস্করণের হিট সংখ্যা ছিল ৬৩৫,৬২৫। কিক করুন।
নিচে গানটির বাংলা ভাষান্তর প্রকাশিত হলো। তবে গানটির পূর্ণ আবেদন বুঝতে হলে দি কিংসটন টৃও (The Kingston Trio) এবং বেনজামিন মাসের (Benjamin Musser)-এর গান, দুটিই ইউটিউবে শুনে নিন।
১৩৩ বছর পর নির্দোষ ঘোষিত
টম ডুলি কাহিনীর চূড়ান্ত পরিসমাপ্তি নাটকীয়ভাবে ঘটে তার মৃত্যুর ১৩৩ বছর পরে ২০০১-এ। উইলক্সবরোর অধিবাসীরা স্বাক্ষর সংগ্রহ অভিযান শুরু করেন। তারা বলেন, টম ডুলি নির্দোষ ছিলেন এবং সেই সত্যটা প্রতিষ্ঠিত হওয়া উচিত। উইলক্সবরো অধিবাসীদের এই ক্যামপেইন ছিল বেসরকারি এবং এর কোনো আইনগত ভিত্তি ছিল না। কিন্তু উইলক্সবরোর অধিবাসীদের স্বাক্ষরিত এই আবেদনপত্রটি নৈতিক বৈধতা পেয়েছে।
১৩৩ বছর জুড়ে টম ডুলি সম্পর্কে অনেক কাহিনী ছড়িয়ে পড়েছিল। টম ডুলি ভালো বাশি এবং হয়তো ব্যানজো বাজাতে পারতেন। তাই হ্যাং ডাউন ইয়োর টম ডুলি গানে ব্যানজো বাজানো হয়েছে।
আরেকটি কাহিনী হলো, অ্যান তার মৃত্যুশয্যায় স্বীকার করে যান, প্রচণ্ড ঈর্ষায় উন্মত্ত হয়ে তিনি লরাকে খুন করেছিলেন। তারপর তিনি টমের কাছে সাহায্য চান এবং টম তাকে সাহায্য করেছিলেন লরার মৃতদেহ লুকিয়ে রাখতে।
এসব কারণে লরার খুনে টমের সম্পৃক্ততা সঠিকভাবে নিরূপণ সম্ভব হয়নি। টমকে সন্দেহভাজন ঘোষণার পর তিনি উইলক্সবরো থেকে পালিয়ে গিয়েছিলেন টেনেসি-র ট্রেড শহরে। লরার মৃতদেহ পাওয়া যায় টমের পালানোর পরে। টেনেসিতে টম ডুলি নিজের নাম বদলে টম হল রাখেন। কর্নেল জেমস গ্রেইসন নামে এক রিটায়ার্ড আর্মি অফিসারের ব্যবসায়ে কাজ করতে থাকেন টম। গ্রেইসন জানতেন না উইলক্সবরোতে কি ঘটেছিল। গ্রেইসন চিনতেন না লরাকে। কিন্তু বিভিন্ন কাহিনীতে টমের প্রতিদ্বন্দ্বী প্রেমিকরূপে গ্রেইসনকে বর্ণনা করা হয়। এটা সত্যি ছিল না।
হ্যাং ডাউন ইয়োর হেড টম ডুলি গানে গ্রেইসনের কথা আছে। গানে বলা হয়েছে, গ্রেইসনই পুলিশের কাছে টমকে ধরিয়ে দিয়েছিলেন। এটা সত্যি ছিল। উইলক্সবরোর পুলিশ যখন জানতে পারে টম পরিচয় গোপন করে টেনেসিতে আছে তখন তারা যোগাযোগ করে গ্রেইসনের সঙ্গে। গ্রেইসন তখন টমকে পুলিশের হাতে সোপর্দ করেন।
টম ডুলিকে নিয়ে গান, লেখালেখি ও মুভি এখনো চলছে। ১৯৫৯-তে দি লেজেন্ড অফ টম ডুলি মুভিটি রিলিজ হয়। ২০১১-তে শ্যারিন ম্যাক ক্রামবি-র উপন্যাস দি ব্যালাড অফ টম ডুলি প্রকাশিত হয়। নিচে গানটির ভাষান্তর প্রকাশিত হলো :
Hang down your head, Tom Dooley
Hang down your head and cry
Hang down your head, Tom Dooley
Poor boy, you-re bound to die...
(কোরাস)
তোমার মাথা নিচু করো টম ডুলি
মাথা নিচু করে কাদো টম ডুলি
বেচারা টম, তুমি মরতে যাচ্ছ।
(সলো)
তার সঙ্গে দেখা করেছিলাম পাহাড়ে
সেখানে তাকে খুন করেছিলাম
ছুরি দিয়ে মেরেছিলাম।
আগামীকাল এই সময়ে
ভেবে দেখ আমি কোথায় থাকব?
গ্রেইসন ধরিয়ে না দিলে
আমি টেনেসিতে থাকতাম।
আগামীকাল এই সময়ে
ভেবে দেখ আমি কোথায় থাকব?
কোনো এক নির্জন উপত্যকায়
একটা শাদা ওক গাছ থেকে ঝুলে থাকব।
হ্যাং ডাউন ইয়োর হেড টম ডুলি গানটির রেশ মিলিয়ে যাওয়ার আগেই ১৯৬৬-তে রিলিজড হয় টম জোন্স-এর (Tom Jones) গৃন, গৃন গ্রাস অফ হোম (Green, Green Grass of Home)। কড কার্লি পাটম্যান জুনিয়রের লেখা এ গানটি টম ডুলির চাইতেও অনেক বেশি জনপ্রিয়তা অর্জন করে এবং টম ডুলির মতো অনেক গায়ক এ গানটি গেয়েছেন। ইউটিউবে কিক করলে দেখবেন এই গানের জনপ্রিয়তা। এলভিস প্রেসলি (Elvis Presley, যাকে টম জোন্স শ্রদ্ধা করতেন ও যার বন্ধু হয়েছিলেন) তার গাওয়া এই গানে ১ আগস্ট ২০১৪ পর্যন্ত হিট হয়েছে ১,২৬৩,১১৬ বার। আর জোন বেইজ (Joan Baez)-এর গাওয়া এই গানে ১ আগস্ট পর্যন্ত হিট হয়েছে ৩,১৬৫,২৩১ বার। টম জোন্সের অরিজিনাল ভার্সনে কত হিট হয়েছে সেটা জানা সম্ভব হয়নি। টম জোন্স ইংল্যান্ডে রানির কাছ থেকে স্যার উপাধিতে ভূষিত হয়েছেন এবং এখনো গানটি নিয়মিতভাবে গাইছেন লাস ভেগাস-এ তার লাইভ শো-তে।
এই গানটির দুটি পার্ট আছে। প্রথম পার্টে বোঝা যায় এক ব্যক্তি তার শৈশবকালের গ্রামের বাড়িতে ফিরে এসেছে। যৌবনে এই গ্রাম ছেড়ে যাওয়ার পরে সম্ভবত এই প্রথম সে ফিরেছে। ট্রেন থেকে নামার পরে সে দেখতে পায় তার পিতামাতা এবং আদরের ছোট বোন মেরিকে। তারা সবাই তাকে দেখতে আসছে। মেরি ছুটে আসছে। ওই ব্যক্তি তার পুরনো বাড়িঘর, ওক গাছ আর সবুজ ঘাস দেখতে পায়। সে ছুতে চায় সবুজ ঘাসকে।
প্রথম পার্টে এটি শুনলে মনে হবে ব্যক্তিটি স্মৃতিচারণা করছে। কিন্তু হঠাৎ দৃশ্যপট বদলে যায়। দ্বিতীয় পার্টে বোঝা যায় ওই ব্যক্তিকে তার গ্রামে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে তার মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করতে। ব্যক্তিটি বুঝতে পারে তার শেষ সময়ের জন্য উপস্থিত আছেন এক বৃদ্ধ পাদরি। সে বুঝতে পারে তার মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের পর তার মৃতদেহ কবর দেওয়া হবে সেই পুরনো ওক গাছের ছায়ায় সবুজ ঘাসের নিচে।
মানবতাবাদী গায়িকা জোন বেইজ, যিনি ১৯৭১-এ বাংলাদেশের নির্যাতিত জনগণের পক্ষে ভূমিকা নিয়েছিলেন, তিনি তার গাওয়া গানের শেষে আরো যোগ করেছেন, হ্যা, আমরা সবাই পুরনো ওক গাছের ছায়ায়, যখন আমরা সবাই মিলিত হব বাড়ির সবুজ, সবুজ ঘাসের নিচে।
পুরো গানটির ভাষান্তর :
ট্রেন থেকে নেমে আমি দেখছি
সেই পুরনো বাড়ি ঘর ঠিক সেই রকমই আছে।
আর আমাকে দেখতে সেখানে এসেছেন
আমার মা, বাবা।
পথে দৌড়ে আসছে আমার ছোট বোন মেরি
তার চুল সোনালি, ঠোট দুটো চেরি ফলের মতো।
বাড়ির সবুজ, সবুজ ঘাস ছুতে লাগে ভালো।
হ্যা, তারা সবাই আসবে আমার সঙ্গে দেখা করতে।
দুই হাত বাড়িয়ে মিষ্টি হাসি মুখে।
বাড়ির সবুজ, সবুজ ঘাস ভালো লাগে ছুতে।
সেই পুরনো বাড়িটা এখনো দাড়িয়ে আছে
যদিও বাড়ির রং ফেটে গেছে, ময়লা হয়ে গিয়েছে।
আর ওই যে সেই ওক গাছটা আছে
যার নিচে আমি খেলতাম।
আমি পথে হাটছি।
সোনালি চুল আর চেরি ঠোটে আমার মিষ্টি বোন
মেরি ছুটে আসছে।
হ্যা, তারা সবাই আসবে আমার সঙ্গে দেখা করতে।
হঠাৎ আমার স্বপ্ন ভেঙ্গে গেল।
আমি চারদিকে তাকিয়ে দেখি
আমি তো চার দেয়ালের মধ্যে বন্দি।
আমি বুঝতে পারি
আমি স্বপ্ন দেখছিলাম।
ওই তো আমাকে একটা গার্ড পাহারা দিচ্ছে।
তার পাশে আছেন বিষণœ মুখে এক বুড়ো পাদরি।
কাল ভোরে সূর্য উঠলে ওরা আমাকে ধরে নিয়ে যাবে।
আমি আবার বাড়ির সবুজ, সবুজ ঘাস ছোবো।
হ্যা, তারা সবাই আসবে
সেই পুরনো ওক গাছের ছায়ায়
আমাকে দেখতে।
আমাকে যখন তারা সবুজ, সবুজ ঘাসের নিচে
শুইয়ে দেবে।
বাংলাদেশে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত বহু ব্যক্তির মৃতদেহ শায়িত করা হয়েছে তাদের গ্রামের বাড়িতে সবুজ ঘাসের নিচে।
কোনো বাংলাদেশি গায়ক একদিন নিশ্চয়ই গাইবেন বাংলাদেশে টম ডুলির মতো মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত কিন্তু নিরপরাধ ব্যক্তির কাহিনী।
অথবা কোনো বাংলাদেশি গায়ক একদিন নিশ্চয়ই গাইবেন বাংলাদেশে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত যেকোনো ব্যক্তির তার গ্রামের বাড়িতে সবুজ ঘাসের নিচে চিরঘুমের কাহিনী।
সেটি হতে পারে কুদ্দুসের জীবনী নির্ভর।
কুদ্দুস কে ছিলেন সেটা লিখেছিলেন রিটায়ার্ড ডেপুটি জেইলার মোহাম্মদ আমিনুর রহমান পত্রিকায় প্রকাশিত তার একটি স্মৃতিচারণায় যার শিরোনাম ছিল :
ফাসি হওয়া কুদ্দুস এখনো আমার সামনে এসে দাড়ায়-।
ডেপুটি জেইলার হিসেবে যোগদানের এগার মাস পরই ১৯৬৪ সালে একটি ফাসি কার্যকরের দায়িত্ব পড়ে আমার ওপর। এর আগে ফাসি দেওয়ার অভিজ্ঞতা আমার ছিল না।
আমি তখন বরিশাল জেলা কারাগারে চাকরি করি। ফাসি কার্যকরের মতো একটি দায়িত্ব পাওয়ার পর আমার খারাপ লাগছিল। এরপরও চাকরি করি, তাই এই দায়িত্ব আমাকে পালন করতেই হবে। জেনেশুনেই এই চাকরিতে যোগ দিয়েছি। এরপরও তো আমি একজন মানুষ। আমার সামনে ফাসির রশিতে ঝুলে একজন তরতাজা মানুষ জীবন হারাবে Ñ ভাবতেই কেমন জানি লাগছিল।
স্মৃতিতে যত দূর মনে পড়ে, যার ফাসি কার্যকর করেছিলাম তার নাম কুদ্দুস। বাড়ি বরিশালের উজিরপুর এলাকায়। পেশায় কৃষিজীবী হলেও সে ছিল সুদর্শন যুবক। বাবাকে জবাই করার দায়ে তার ফাসির রায় হয়েছিল।
তারিখ মনে নেই। তবে ঘটনাটা মনে আছে।
সিনিয়র অফিসারের নির্দেশে আমি ফাসি কার্যকরের দিন বিকেলে কুদ্দুসের সেলে যাই। গিয়ে দেখি কুদ্দুস মনমরা হয়ে বসে আছে। তখনো সে জানে না আজ রাতেই তার ফাসি হবে। আমি গিয়ে জানালাম। ভেবেছিলাম শুনেই সে আতকে উঠবে। কিন্তু দেখলাম তার মাঝে তেমন কোনো প্রতিক্রিয়া হলো না। মনে হলো সে প্রস্তুতি নিয়েই রেখেছে। শুধু বড় একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলল, স্যার, ফাসি-টাসি কেয়ার করি না। তবে কি, পিতাকে হত্যা না করেও হত্যার অভিযোগ নিয়ে দুনিয়া ছেড়ে যেতে হচ্ছে, এটাই দুঃখ।
তার কথা শুনে চমকে উঠলাম এই কারণে যে, তার কথা অনুযায়ী অপরাধ না করেও তাকে ফাসিতে ঝুলতে হচ্ছে!
আগ্রহ জন্মাল ঘটনাটি জানার।
কুদ্দুস আমাকে জানাল, তার বাবা দুই বিয়ে করেছে। প্রথম স্ত্রীর ছেলে সে। মা মারা যাওয়ার পর তার বাবা দ্বিতীয় বিয়ে করে। ওই ঘরে দুই মেয়ের জন্ম হয়। প্রত্যেকেই বড় হয়, বিয়েশাদি করে। কুদ্দুসেরও এক ছেলে হয়। তার বাবার বিষয়-সম্পত্তি দখলের জন্য সৎ বোনের জামাই হন্যে হয়ে ওঠে। তার বোন, বোনজামাই ও সৎ মা মিলে পরিকল্পনা করে তার বাবাকে হত্যার। সেই হত্যার দায় চাপানোর জন্য তাকে আসামি করার পরিকল্পনাও করে।
এক রাতে স্ত্রীর সঙ্গে ঝগড়া করে কুদ্দুস তার বাবার বিছানায় শুয়ে থাকে। বাবা চলে গিয়েছিল অন্য ঘরে। ওই রাতে তার বোনজামাাই বাবাকে হত্যার জন্য যায়। গিয়ে কাথা সরিয়ে দেখতে পায় কুদ্দুসকে। তাকে দেখে দ্রুত চলে যায়। সেদিন কুদ্দুস বুঝতে পেরেছিল তার বাবাকে হত্যার জন্যই চেষ্টা করছে তারা। এর ক-দিন পর এক রাতে তার বোন ও বোনজামাই তার বাবাকে জবাই করে।
বিষয়টি কুদ্দুস আচ করতে পেরেও কিছুই করতে পারেনি। বরং তার মা বাদী হয়ে কুদ্দুসকেই প্রধান আসামি করে মামলা দায়ের করে।
মা, বোন ও বোনজামাই প্রত্যেকেই কুদ্দুস হত্যা করেছে বলে আদালতে সাক্ষ্য দেয়। মায়ের সাক্ষ্যকে আদালত গ্রহণ করে। সেই সাক্ষ্যের ভিত্তিতে কুদ্দুসের ফাসির রায় হয় বলে সে আমাকে জানায়।
এসব কথা বলার সময় কুদ্দুস অঝোর ধারায় কাদতে থাকে। সেই কান্না দেখাও ছিল বেশ কষ্টকর। কুদ্দুসের ইচ্ছা কি জানতে চাওয়া হলে সে একটি চিঠি লেখার আগ্রহ প্রকাশ করে।
তাকে চিঠি লেখার জন্য কাগজ-কলম দিয়ে সেল থেকে বিদায় হই।
কুদ্দুসকে ফাসি দেওয়ার সব আয়োজন সম্পন্ন করা হলো। রাত দশটার দিকে কুদ্দুসের সেলে যাই আমি। কুদ্দুস তার লেখা চিঠিটি দেয় আমার হাতে।
অনুরোধ করে বলল, স্যার আমি আপনার পায়ে ধরি। চিঠিটি আমার মায়ের কাছে পৌছে দেবেন।
আমি তাকে কথা দিলাম তার চিঠি অবশ্যই আমি পৌছে দেওয়ার ব্যবস্থা করব।
চিঠিটি নিয়ে পড়ার আগ্রহ বোধ করলাম। দেখলাম সে লিখেছে,
মা, তুমি তোমার জামাই মিলে বাবারে হত্যা করলা আর আমারে দিলা ফাসি। কোর্টে সাক্ষী দিলা যে আমিই মারছি। ঠিক আছে আমি তো চলে যাচ্ছি, তোমার সঙ্গে দেখা হবে ওপারে। রোজ হাশরের মাঠে। তোমার সঙ্গে ওইখানে মোকাবেলা হবে। আর একটা কথা, আমার বউ যদি অন্য কোথাও বিয়ে করতে চায় তুমি বাধা দিও না। তুমি যত দিন বাইচা থাকবা তত দিন আমার ছেলেকে দেখবা। তুমি আমার ছেলেকে পড়াবা। আমি যখন একা কবরে যাচ্ছি, তোমাকেও একা কবরে যেতে হবে। সে সময় তোমার মেয়ের জামাই ও মেয়ে কিন্তু সঙ্গে যাবে না। দুনিয়ায় তাদেরকে সঙ্গে নিয়ে এত বড় অপরাধ করলা। কিন্তু তাদের কাউকে তুমি পাবা না। তোমার সঙ্গে চূড়ান্ত হিসাব-নিকাশ হবে হাশরের ময়দানে।
এই কথাগুলো কুদ্দুস কয়েকবার লিখেছিল। চিঠির কাগজটি ভেজা ছিল। বোঝাই যাচ্ছিল লেখার সময় তার চোখ বেয়ে পানি ঝরছিল খুব। যে কারণে চোখের পানিতে কালি লেপটে যায়।
চিঠিটি নিয়ে সিনিয়র অফিসারকে দিলাম। তার কাছে জানতে চাইলাম চিঠিটি কিভাবে পাঠাব। তিনি পরামর্শ দিলেন রেজিস্টৃ ডাকে পাঠানোর জন্য। নিজের টাকা খরচ করে সেই চিঠিটি আমি পাঠিয়েছিলাম।
রাত আড়াইটার দিকে ফাসি দেওয়ার সময় নির্ধারণ করা হলো। নিয়ম অনুযায়ী এক ঘণ্টা আগে গিয়ে কুদ্দুসকে গোসল করানো হলো। এরপর সে নামাজ আদায় করল। মসজিদের ইমাম গিয়ে তাকে তওবা পড়ান। ফাসির কিছুক্ষণ আগে কুদ্দুসের কাছে জানতে চাইলাম, সে শেষবারের মতো কিছু খেতে চায় কি না।
সে বলল, একটু দুধ খাবে।
আমরা দ্রুত দুধের ব্যবস্থা করলাম।
দুধটুকু খাওয়ার পর কুদ্দুসই বলল, স্যার চলেন।
নিয়ম অনুযায়ী তার দুই হাতে হ্যান্ডকাফ পরিয়ে দিলাম। সেল থেকে পঞ্চাশ গজের মতো দূরে ফাসির মঞ্চে আমরা তাকে নিয়ে গেলাম। কারণ ফাসির আসামি যদি মঞ্চে না গিয়ে দৌড় দেয় বা অন্য কিছু করে বসে সে কারণে হ্যান্ডকাফ পরিয়ে নিতে হয়।
সেখানে গিয়ে কুদ্দুস কোনো ঝামেলা না করেই ফাসির রশি গলায় ঝোলাল।
এ সময় ম্যাজিস্ট্রেট ডি জি সেনগুপ্ত, সিভিল সার্জন আবদুল লতিফ, পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা ও কারাগারের কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।
সকালে লাশ নেওয়ার জন্য পরিবারের সদস্যদের ডাকা হয়। লাশ গ্রহণ করতে তার মা আসেনি। এসেছিল তার বড় বোন ও তার স্বামী। কয়েক ঘণ্টা আগেই আমি কুদ্দুসের মুখ থেকে শুনেছিলাম তার সৎ বোন ও স্বামী তার বাবাকে জবাই করেছে। এ কারণে নিজের আগ্রহ থেকে তাদের দুজনকে জানালাম যে, কুদ্দুস মৃত্যুর আগে বলে গেছে আপনারা হত্যা করে সেই দায় কুদ্দুসের ওপর চাপিয়েছেন।
এ সময় তারা দুজনই থতমত খেয়ে গেলেও পুরো ঘটনাটি অস্বীকার করে।
দীর্ঘ দিন কারাগারে চাকরি করেছি। অনেক মানুষের ফাসি কার্যকরের সময় উপস্থিত ছিলাম।
কিন্তু কুদ্দুসের ফাসিটি এখনো আমার মনে পড়ে।
কুদ্দুস স্বপ্নে এখনো আমার সামনে এসে দাড়ায়।
নতুন করে বলে, তার মৃত্যুর কাহিনী।

তারিখ : ২৯ অক্টোবর ২০১৪
facebook.com/Shafik Rehman Presents

No comments

Powered by Blogger.