নিঃশব্দ হুইসেল by মোবাশ্বির আলম মজুমদার
শিল্পীর অনুভবে থাকা বিষয়কে শিল্পকর্মে প্রকাশ করাই শিল্পীর সাফল্য বলে বিবেচিত। এ প্রদর্শনীর শিরোনাম ‘হুইসেল’ -এ ছয়জন তরুণশিল্পীর গড়া গোষ্ঠী ‘জংশন’। তাঁরা দর্শকদের মধ্যে নিজেদের অভিজ্ঞতার বিনিময় করতে চান শিল্পকর্ম দিয়ে। ছয়জন শিল্পীর ৩৪টি কাজের মাধ্যম হলো সিরামিকস, পোড়ামাটি, ছাপচিত্র, তেলরং ও অ্যাক্রিলিক। গত দুইদশকে আমাদের শিল্পকলায় প্রথাগত মাধ্যম ও নির্মাণ-প্রক্রিয়ায় ব্যাপক পরিবর্তন এসেছে। একে আমরা উত্তরণ বলতে পারি। সৃষ্টিকর্মের ধারণা, মাধ্যম ও ভাষার গতি পরিবর্তনের কারণে শিল্পকর্মে সৃজনশীল আচরণ স্পষ্ট হয়। শিল্পী প্রতিনিয়ত সৃজনভাবনার মধ্য দিয়েই সময় পার করেন। আধুনিক শিল্পকলার সব সংজ্ঞাকে পেছনে ফেলে বিশ্বশিল্পে স্থান করে নিয়েছে প্রযুক্তিনির্ভর মাধ্যম। মনঃসমীক্ষণের রূপকল্প প্রকাশের সঙ্গে মানুষের জীবনাচরণের প্রতি মুহূর্ত শিল্পরচনার বিষয় হয়েছে। জংশন বা জংশন প্লাটফর্মে কাজ করা হয় শিল্পীর শিল্পকর্মে নতুন ভাবনা আছে। উপস্থাপনের মধ্যে চিন্তাশৈলী স্পষ্ট। আমজাদ আকাশ, উম্মে সোহাগ, ইকবাল বাহার চৌধুরী, তপন হালদার, ফাতেমা মুন্নী, আনিকা মারিয়াম আহমেদ প্রত্যেকেই এই শতকের প্রথম দশকে শিল্পকলায় প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা অর্জন করেছেন। মাধ্যমগত পরিবর্তন সৃষ্টিকর্মের মধ্যেও নতুন সুর তৈরি করে। জংশনের এটি দ্বিতীয় প্রদর্শনী। প্রদর্শনীর শিল্পী আমজাদ আকাশ ছবিতে কখনো ব্যাকরণ মানেন। আবার কোনো কোনো কাজে এর বাইরে গিয়ে সাদা-কালো রেখা প্রয়োগ করে রেখার ছায়া লেপ্টে দেন আশপাশে।
এতে নির্মাণে এক নতুন রূপের খোঁজ দেয়। কালো-সাদা রেখায় আঁকা কাজের মাধ্যম কাগজে অয়েল প্যাস্টেল, বাস্তবধর্মী ফুলের সঙ্গে চৌচির করা তলের উপস্থিতি দৃষ্টিতে বিভ্রম তৈরি করে। এ ছবির মাধ্যম অ্যাক্রিলিক। আমজাদ আকাশের মানুষের অবয়ব একটি যন্ত্র বা সিলিন্ডার আকৃতি ধারণ করে। কখনো ওই ফাঁপা গোলক আকৃতির মানুষেরাই হয়ে ওঠে ছবির চরিত্র। মনোভাবনায় লালিত পুষ্পিত সৌরভের সঙ্গে আলোচনায় রূপের মোহ আকাশের কাজে বোঝা যায়। শুধু প্রদর্শনীর জন্য শিল্প সৃষ্টি নয়, এ দলের কাজে স্বভাবজাত সৃষ্টির খোঁজ মেলে। কয়েকটি কাজে চিন্তার স্থূল প্রকাশ স্পষ্ট হলেও প্রদর্শনীর অন্য সব কাজের ভিড়ে দুর্বল কাজগুলো উতরে যায়। আনিকা মারিয়াম আহমেদ স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদ থেকে। তাঁর পাঁচটি কাজের মধ্যে তিনটি অ্যাক্রিলিক রঙে আঁকা পোস্টারের নকশা। অন্য দুটি অতিচেনা বিষয় ‘অ্যা জার্নি বাই বাস’ ও ‘দি আন বিয়েরেবল হেভিনেস অব রিং’ পার্কের আলোকসজ্জার সঙ্গে ঘূর্ণমান খেলনার মুহূর্ত এঁকেছেন তিনি। এর সামনে দাঁড়িয়ে আছে নারীর অবয়ব। উজ্জ্বল রং, যেমন গাঢ় হলুদ, কমলা ও সিঁদুর লালের ব্যবহারে ছবিটি একটি মুহূর্তের ঘোষণা দেয়। আনিকা জার্নি বাই বাস ছবিতে স্যাটায়ার করেছেন। শহর এলাকায় মানুষে ঠাসা লোকাল বাসের অভ্যন্তরীণ অবস্থাকে তুলে ধরেছেন। এ ছবিতে শিল্পী নিজেও হয়ে যান ওই যানবাহনের একজন যাত্রী। উজ্জ্বল বর্ণ ব্যবহার আনিকা মারিয়ামের স্বভাব। নন্দন পরিকল্পনা প্রসূত ক্যানভাস তিনি হয়তো নির্মাণে পারদর্শী।
কিন্তু ব্যঙ্গ-বিদ্রূপের মাধ্যমে সামাজিক ক্ষত নিরাময়ে তিনি স্বস্তি পান। ইকবাল বাহার চৌধুরী ছাপচিত্র নিয়ে হাজির হয়েছেন এ প্রদর্শনীতে। কোনো কাজের শিরোনাম রিলেশন, কোনোটি জার্নি বিফোর ডেসটিনেশন। কাজের কৌশলে মিল আছে। ছবির মানুষের অবয়বে প্রিমিটিভ প্যাটার্ন বা প্রাগৈতিহাসিক যুগের আঁকা ছবির সংযোগ পাওয়া যায়। ইকবালের কাজের ক্যানভাসে গাঢ় রঙের সঙ্গে বিপরীত রং রেখে দেন সাদা কাগজের রংকে। ফাতিমা মুন্নী অ্যাক্রিলিক ও মিশ্র মাধ্যমে দেহভঙ্গি তৈরি করেন। নারী তাঁর অবস্থানে নিজেকে স্থির ও বোধ বিবেচনায় সমৃদ্ধ থাকেন। কিন্তু নীরবতা নারীকে নিরাপত্তা দেয় না। সেটিকে মুন্নী ছবির ভাষা হিসেবে ব্যবহার করেছেন। নারীর অবয়বের সৌকর্যের পাশাপাশি তীব্র গহনের কথা তিনি বলেছেন। তপন হালদার ছাপচিত্র মাধ্যমে বুদ্ধ ও রাজার আলংকারিক প্রতিকৃতি হাজির করেছেন এ প্রদর্শনীতে। সিরামিকস মাধ্যমে নিরীক্ষাধর্মী পোড়ামাটির ফলক ও গ্লেজ সিরামিকসে প্রকৃতির নির্দিষ্ট বৃত্তাকার পাত্রের মধ্যে ‘রুটস’ বা শিকড়ের আকৃতি উপস্থাপন করেছেন। তরুণ শিল্পীদের দলগত আয়োজনে নতুন নিরীক্ষার সন্ধান মেলে। এ প্রদর্শনী আমাদের সে কথাই বলে দেয়। প্রদর্শনীটি রাজধানীর শিল্পাঙ্গন গ্যালারিতে ৫ থেকে ১৪ জুলাই অনুষ্ঠিত হয়।
No comments