অপরাধী সংগঠনের প্রতিকার করবে কে? by এম বদি-উজ-জামান
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের দেওয়া
একের পর এক রায়ে জামায়াতে ইসলামীকে একটি অপরাধী সংগঠন হিসেবে বর্ণনা করা
হচ্ছে। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় এই দলটির শীর্ষস্থানীয় নেতারা
বুদ্ধিজীবী হত্যা, গণহত্যা, হত্যা,
অগি্নসংযোগসহ
মানবতাবিরোধী অপরাধের সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ার পাশাপাশি
অপরাধী সংগঠন হিসেবে দলের ভূমিকাও উঠে আসছে ট্রাইব্যুনালের রায়ে। এ অবস্থায়
রাজনৈতিক দলটিকে নিষিদ্ধ করার দাবি জোরালো হচ্ছে। বিশিষ্টজনরা বলছেন,
জামায়াতের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার এখনই উত্তম সময়। কিন্তু দলটির বিরুদ্ধে
ট্রাইব্যুনালের রায় কার্যকর করতে সরকারের পক্ষ থেকে কোনো উদ্যোগ লক্ষ করা
যাচ্ছে না। এ বিষয়ে সরকারের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। জানা গেছে, সরকার
নিজে দায়িত্ব না নিয়ে সুপ্রিম কোর্ট ও নির্বাচন কমিশনের (ইসি) দিকে চেয়ে
আছে।
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল জামায়াতে ইসলামীর সাবেক আমির গোলাম আযম, বর্তমান নায়েবে আমির দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী, সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মুহাম্মদ মুজাহিদ, দুই সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল আবদুল কাদের মোল্লা ও মুহাম্মদ কামারুজ্জামান এবং সাবেক রুকন আবুল কালাম আযাদের বিরুদ্ধে রায় দিয়েছেন। সব কয়টি রায়েই একাত্তরে জামায়াতের ভূমিকা নিয়ে বিশদ বর্ণনা দেওয়া হয়েছে। বিশেষ করে গোলাম আযম, মুজাহিদ ও কামারুজ্জামানের মামলার রায়ে জামায়াতে ইসলামীকে অপরাধী সংগঠন বলা হয়েছে। গোলাম আযমের মামলায় আরো এক ধাপ এগিয়ে ট্রাইব্যুনাল দলটির সদস্যদের কোনো রাজনৈতিক দল, সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠন, সরকারি বা বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কোনো পদে না রাখার সুপারিশ করেছেন। এসব রায়ের পর জামায়াতের রাজনীতি নিষিদ্ধ করার বিষয়টি সরকারের দায়িত্বের মধ্যে পড়ে গেছে। কিন্তু সরকার এখনো দলটির বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। সরকার নির্বাচন কমিশন ও সুপ্রিম কোর্টের দিকে তাকিয়ে আছে। আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ও প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ সহকারী মাহবুব-উল-আলম হানিফের এক বক্তব্যে এর প্রমাণ মিলেছে। গতকাল বৃহস্পতিবার তিনি যুবলীগের এক অনুষ্ঠানে বলেছেন, 'আশা করি নির্বাচন কমিশন জামায়াতের নিবন্ধন বাতিল করবে।'
আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ গতকাল কালের কণ্ঠকে বলেন, ট্রাইব্যুনাল বেশ কয়েকটি রায়ে জামায়াতে ইসলামীকে অপরাধী সংগঠন হিসেবে উল্লেখ করেছেন। তাই এ দলের বিরুদ্ধে আইনগত পদক্ষেপ নেওয়ার সময় এসেছে। তিনি বলেন, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থা বা প্রসিকিউশন এ বিষয়ে উদ্যোগ নিতে পারে। এ ক্ষেত্রে আইন মন্ত্রণালয়ের কিছু করার নেই। বিশেষ ক্ষমতা আইন ও সন্ত্রাস দমন আইনে সরকার দলটিকে নিষিদ্ধ করতে পারে- এ বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে আইনমন্ত্রী বলেন, সরকার করতে পারে। এখানে সরকার বলতে আইন মন্ত্রণালয় নয়; স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ব্যবস্থা নিতে পারে।
ভারপ্রাপ্ত অ্যাটর্নি জেনারেল ও আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী টিমের প্রধান সমন্বয়কারী এম কে রহমান গতকাল কালের কণ্ঠকে বলেন, ১৯৭১ সালে দলটির ভূমিকার কারণে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল ইতিমধ্যে বিভিন্ন রায়ে বলেছেন, জামায়াত একটি অপরাধী সংগঠন। ট্রাইব্যুনালের এসব রায়ের পর এদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার এখনই উপযুক্ত সময়। ১৯৭১ সালে ওই দলের যে ভূমিকা ছিল, সেই প্রেক্ষাপট আমলে নিয়ে দলটির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে দেরি করার সুযোগ নেই। আইনগতভাবেই সরকারকে ব্যবস্থা নিতে হবে- এ অভিমত ব্যক্ত করে তিনি বলেন, জামায়াত নিষিদ্ধ করার বিষয়ে সরকারকে সিদ্ধান্ত নিতে ট্রাইব্যুনালের রায় কার্যকর সহায়ক ভূমিকা নেবে। তিনি বলেন, ৩০ লাখ শহীদের প্রাণের বিনিময়ে অর্জিত এই বাংলাদেশে সন্ত্রাসী ওই দলটিকে নিষিদ্ধ করার বিষয়ে রাষ্ট্র নির্বিকার থাকতে পারে না।
বাংলাদেশের সংবিধান, ১৯৭৪ সালের বিশেষ ক্ষমতা আইন ও সন্ত্রাস দমন আইনে কোনো অপরাধী সংগঠনকে নিষিদ্ধ করার ক্ষমতা সরকারকে দেওয়া হয়েছে। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের রায়ের ফলে মানবতাবিরোধী অপরাধে জড়িত দলটির বিরুদ্ধে আইনগত পদক্ষেপ নেওয়ার সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। কিন্তু এখন পর্যন্ত কোনো ব্যবস্থা বা পদক্ষেপ নেয়নি সরকার। সরকারের এই নির্বিকার ভূমিকা নিয়ে সচেতন মহলে প্রশ্ন উঠেছে।
সুপ্রিম কোর্টের বিশিষ্ট আইনজীবী ড. শাহদীন মালিক কালের কণ্ঠকে বলেন, 'ট্রাইব্যুনাল বেশ কয়েকটি রায়ে জামায়াতে ইসলামীকে অপরাধী সংগঠন হিসেবে উল্লেখ করেছেন। এ অবস্থায় এ দলটিকে এখনই নিষিদ্ধ করার উত্তম সময়। সরকার নির্বাহী আদেশে এটা করতে পারে। যেমনটি হিযবুত তাহ্রীর, হরকাতুল জিহাদকে নিষিদ্ধ সংগঠন হিসেবে ঘোষণা দিয়েছে সরকার। আদালত বা নির্বাচন কমিশনের দিকে তাকিয়ে থাকার দরকার নেই। আমরা সবাই সেটাই দাবি করছি। কিন্তু সরকার যেভাবে এগোচ্ছে তাতে মনে হচ্ছে সরকার সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগছে। এভাবেই সরকারের মেয়াদ পার হয়ে যাওয়ার আশঙ্কাও অমূলক নয়।' তিনি বলেন, ট্রাইব্যুনালের একের পর এক রায়ের পরও পদক্ষেপ নিতে সরকার অদূরদর্শিতার পরিচয় দিচ্ছে। সরকারের এই অদূরদর্শিতার খেসারত আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে দিতে হতে পারে।
ট্রাইব্যুনাল থেকে দেওয়া ছয়টি রায়েই বলা হয়েছে, পাকিস্তান রক্ষার নামে সশস্ত্র সহযোগী বাহিনী গঠন করে নিরস্ত্র বাঙালি, হিন্দু সম্প্রদায়, বুদ্ধিজীবী, আওয়ামী লীগ ও স্বাধীনতার পক্ষের রাজনৈতিক দলের নেতা-কর্মীদের নিশ্চিহ্ন করার জন্য জামায়াতে ইসলামী বিশেষ ভূমিকা রাখে। ওই সময় তারা পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সহযোগী বাহিনী হিসেবে রাজাকার, আলবদর, আলশামস, শান্তি কমিটি গঠন করে।
সংবিধানের ৩৮ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী নাগরিকদের মধ্যে ধর্মীয়, সামাজিক ও সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি নষ্ট করার উদ্দেশ্যে কোনো দল গঠিত হলে, ধর্ম, গোষ্ঠী, বর্ণ, নারী, পুরুষ, জন্মস্থান বা ভাষার ক্ষেত্রে নাগরিকদের মধ্যে বৈষম্য সৃষ্টি করলে, রাষ্ট্র বা নাগরিকদের বিরুদ্ধে কিংবা অন্য কোনো দেশের বিরুদ্ধে সন্ত্রাসী বা জঙ্গি কার্য পরিচালনা করলে সংগঠন করার অধিকার থাকবে না। মুক্তিযুদ্ধের সময় জামায়াত সামাজিক ও সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্ট করেছে। এ ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের রায় ও অভিমত সরকারের আমলে নেওয়ার সুযোগ আছে।
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থার সমন্বয়কারী আবদুল হান্নান খান গতকাল কালের কণ্ঠকে বলেন, 'আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আইনে অপরাধী সংগঠনের বিরুদ্ধে ট্রাইব্যুনালে অভিযোগ দাখিলের সুযোগ আছে ঠিক। কিন্তু আইনে দল বা সংগঠন দোষী প্রমাণিত হলে শাস্তি কি তা বলা নেই। আইনের ২০ ধারায় শুধু ব্যক্তির বিরুদ্ধে শাস্তির বিধান আছে। তাই জামায়াতে ইসলামীর বিরুদ্ধে কোন প্রক্রিয়ায় আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া যায় তা খতিয়ে দেখছি। আমরা আইনজীবীদের মতামত নিয়ে পদক্ষেপ নেব।' তিনি বলেন, ট্রাইব্যুনাল জামায়াতে ইসলামীকে অপরাধী সংগঠন হিসেবে উল্লেখ করায় ওই দলটির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার এখনই উত্তম সময়।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি অধ্যাপক আনোয়ার হোসেন গত ১৫ জুলাই সাংবাদিকদের বলেন, জামায়াত একটি অপরাধী সংগঠন, তা আদালতের রায়ে প্রমাণিত হয়েছে। তাই এ দলটি বাংলাদেশের মাটিতে নিষিদ্ধ করা জরুরি। সরকারের এখনই এ কাজটি করা উচিত।
আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনালস) আইনের ২(এ) ধারায় সহায়ক বাহিনীর একটি সংজ্ঞা দেওয়া হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, 'দল বা সহায়ক বাহিনী সমূহ- এর অন্তর্গত বুঝাবে সক্রিয়, প্রশাসনিক, সংরক্ষিত দল ও অন্যান্য উদ্দেশ্যে সশস্ত্র বাহিনীর নিয়ন্ত্রণে ন্যস্ত দলকে।' আপিল বিভাগের সাবেক বিচারপতি গোলাম রাব্বানী আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনালস) আইন নিয়ে লেখা বইয়ে দল বলতে জামায়াতে ইসলামী, মুসলিম লীগ, নেজামে ইসলাম, পিডিপি ইত্যাদিকে ইঙ্গিত করেছেন। তিনি লিখেছেন, এসব দল নিয়ে শান্তি কমিটি গঠন করা হয়। ১৯৭১ সালের ১৬ এপ্রিল নুরুল আমিনের নেতৃত্বে তাঁরা টিক্কা খানের সঙ্গে বৈঠক করেন। বৈঠকে শান্তি কমিটির নেতারা টিক্কা খানকে জানান, 'পাকিস্তানের সংহতি ও অখণ্ডতা রক্ষায় তারা পাকিস্তানি সেনাবাহিনীকে মদদ জুগিয়ে যেতে অটল রয়েছে।' এই ক্ষেত্রে জামায়াত দলগতভাবেই মানবতাবিরোধী অপরাধে সহায়তা করেছে বলেই প্রমাণিত হয়।
এদিকে জামায়াতে ইসলামীকে নির্বাচন কমিশনের দেওয়া নিবন্ধনের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে হাইকোর্টে একটি রিট আবেদন বিচারাধীন। তরিকত ফেডারেশনসহ কয়েকটি সংগঠন ও ব্যক্তি এ রিট আবেদন করেন। এ রিট আবেদনের ওপর এরই মধ্যে হাইকোর্টে শুনানি শেষ হয়েছে। আদালত রায়ের জন্য অপেক্ষমাণ রেখেছেন। যেকোনো দিন রায় হতে পারে। এ রায়ের ওপর নির্ভর করছে নির্বাচন কমিশনে দলটির নিবন্ধন থাকবে কি না। হাইকোর্ট দলটির নিবন্ধন অবৈধ ঘোষণা করলেও দলটির রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড চালাতে আইনগত বাধা থাকবে না। নিবন্ধন বাতিল হলে শুধু নির্বাচনে প্রার্থী দিতে পারবে না।
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল জামায়াতে ইসলামীর সাবেক আমির গোলাম আযম, বর্তমান নায়েবে আমির দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী, সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মুহাম্মদ মুজাহিদ, দুই সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল আবদুল কাদের মোল্লা ও মুহাম্মদ কামারুজ্জামান এবং সাবেক রুকন আবুল কালাম আযাদের বিরুদ্ধে রায় দিয়েছেন। সব কয়টি রায়েই একাত্তরে জামায়াতের ভূমিকা নিয়ে বিশদ বর্ণনা দেওয়া হয়েছে। বিশেষ করে গোলাম আযম, মুজাহিদ ও কামারুজ্জামানের মামলার রায়ে জামায়াতে ইসলামীকে অপরাধী সংগঠন বলা হয়েছে। গোলাম আযমের মামলায় আরো এক ধাপ এগিয়ে ট্রাইব্যুনাল দলটির সদস্যদের কোনো রাজনৈতিক দল, সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠন, সরকারি বা বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কোনো পদে না রাখার সুপারিশ করেছেন। এসব রায়ের পর জামায়াতের রাজনীতি নিষিদ্ধ করার বিষয়টি সরকারের দায়িত্বের মধ্যে পড়ে গেছে। কিন্তু সরকার এখনো দলটির বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। সরকার নির্বাচন কমিশন ও সুপ্রিম কোর্টের দিকে তাকিয়ে আছে। আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ও প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ সহকারী মাহবুব-উল-আলম হানিফের এক বক্তব্যে এর প্রমাণ মিলেছে। গতকাল বৃহস্পতিবার তিনি যুবলীগের এক অনুষ্ঠানে বলেছেন, 'আশা করি নির্বাচন কমিশন জামায়াতের নিবন্ধন বাতিল করবে।'
আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ গতকাল কালের কণ্ঠকে বলেন, ট্রাইব্যুনাল বেশ কয়েকটি রায়ে জামায়াতে ইসলামীকে অপরাধী সংগঠন হিসেবে উল্লেখ করেছেন। তাই এ দলের বিরুদ্ধে আইনগত পদক্ষেপ নেওয়ার সময় এসেছে। তিনি বলেন, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থা বা প্রসিকিউশন এ বিষয়ে উদ্যোগ নিতে পারে। এ ক্ষেত্রে আইন মন্ত্রণালয়ের কিছু করার নেই। বিশেষ ক্ষমতা আইন ও সন্ত্রাস দমন আইনে সরকার দলটিকে নিষিদ্ধ করতে পারে- এ বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে আইনমন্ত্রী বলেন, সরকার করতে পারে। এখানে সরকার বলতে আইন মন্ত্রণালয় নয়; স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ব্যবস্থা নিতে পারে।
ভারপ্রাপ্ত অ্যাটর্নি জেনারেল ও আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী টিমের প্রধান সমন্বয়কারী এম কে রহমান গতকাল কালের কণ্ঠকে বলেন, ১৯৭১ সালে দলটির ভূমিকার কারণে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল ইতিমধ্যে বিভিন্ন রায়ে বলেছেন, জামায়াত একটি অপরাধী সংগঠন। ট্রাইব্যুনালের এসব রায়ের পর এদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার এখনই উপযুক্ত সময়। ১৯৭১ সালে ওই দলের যে ভূমিকা ছিল, সেই প্রেক্ষাপট আমলে নিয়ে দলটির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে দেরি করার সুযোগ নেই। আইনগতভাবেই সরকারকে ব্যবস্থা নিতে হবে- এ অভিমত ব্যক্ত করে তিনি বলেন, জামায়াত নিষিদ্ধ করার বিষয়ে সরকারকে সিদ্ধান্ত নিতে ট্রাইব্যুনালের রায় কার্যকর সহায়ক ভূমিকা নেবে। তিনি বলেন, ৩০ লাখ শহীদের প্রাণের বিনিময়ে অর্জিত এই বাংলাদেশে সন্ত্রাসী ওই দলটিকে নিষিদ্ধ করার বিষয়ে রাষ্ট্র নির্বিকার থাকতে পারে না।
বাংলাদেশের সংবিধান, ১৯৭৪ সালের বিশেষ ক্ষমতা আইন ও সন্ত্রাস দমন আইনে কোনো অপরাধী সংগঠনকে নিষিদ্ধ করার ক্ষমতা সরকারকে দেওয়া হয়েছে। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের রায়ের ফলে মানবতাবিরোধী অপরাধে জড়িত দলটির বিরুদ্ধে আইনগত পদক্ষেপ নেওয়ার সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। কিন্তু এখন পর্যন্ত কোনো ব্যবস্থা বা পদক্ষেপ নেয়নি সরকার। সরকারের এই নির্বিকার ভূমিকা নিয়ে সচেতন মহলে প্রশ্ন উঠেছে।
সুপ্রিম কোর্টের বিশিষ্ট আইনজীবী ড. শাহদীন মালিক কালের কণ্ঠকে বলেন, 'ট্রাইব্যুনাল বেশ কয়েকটি রায়ে জামায়াতে ইসলামীকে অপরাধী সংগঠন হিসেবে উল্লেখ করেছেন। এ অবস্থায় এ দলটিকে এখনই নিষিদ্ধ করার উত্তম সময়। সরকার নির্বাহী আদেশে এটা করতে পারে। যেমনটি হিযবুত তাহ্রীর, হরকাতুল জিহাদকে নিষিদ্ধ সংগঠন হিসেবে ঘোষণা দিয়েছে সরকার। আদালত বা নির্বাচন কমিশনের দিকে তাকিয়ে থাকার দরকার নেই। আমরা সবাই সেটাই দাবি করছি। কিন্তু সরকার যেভাবে এগোচ্ছে তাতে মনে হচ্ছে সরকার সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগছে। এভাবেই সরকারের মেয়াদ পার হয়ে যাওয়ার আশঙ্কাও অমূলক নয়।' তিনি বলেন, ট্রাইব্যুনালের একের পর এক রায়ের পরও পদক্ষেপ নিতে সরকার অদূরদর্শিতার পরিচয় দিচ্ছে। সরকারের এই অদূরদর্শিতার খেসারত আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে দিতে হতে পারে।
ট্রাইব্যুনাল থেকে দেওয়া ছয়টি রায়েই বলা হয়েছে, পাকিস্তান রক্ষার নামে সশস্ত্র সহযোগী বাহিনী গঠন করে নিরস্ত্র বাঙালি, হিন্দু সম্প্রদায়, বুদ্ধিজীবী, আওয়ামী লীগ ও স্বাধীনতার পক্ষের রাজনৈতিক দলের নেতা-কর্মীদের নিশ্চিহ্ন করার জন্য জামায়াতে ইসলামী বিশেষ ভূমিকা রাখে। ওই সময় তারা পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সহযোগী বাহিনী হিসেবে রাজাকার, আলবদর, আলশামস, শান্তি কমিটি গঠন করে।
সংবিধানের ৩৮ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী নাগরিকদের মধ্যে ধর্মীয়, সামাজিক ও সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি নষ্ট করার উদ্দেশ্যে কোনো দল গঠিত হলে, ধর্ম, গোষ্ঠী, বর্ণ, নারী, পুরুষ, জন্মস্থান বা ভাষার ক্ষেত্রে নাগরিকদের মধ্যে বৈষম্য সৃষ্টি করলে, রাষ্ট্র বা নাগরিকদের বিরুদ্ধে কিংবা অন্য কোনো দেশের বিরুদ্ধে সন্ত্রাসী বা জঙ্গি কার্য পরিচালনা করলে সংগঠন করার অধিকার থাকবে না। মুক্তিযুদ্ধের সময় জামায়াত সামাজিক ও সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্ট করেছে। এ ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের রায় ও অভিমত সরকারের আমলে নেওয়ার সুযোগ আছে।
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থার সমন্বয়কারী আবদুল হান্নান খান গতকাল কালের কণ্ঠকে বলেন, 'আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আইনে অপরাধী সংগঠনের বিরুদ্ধে ট্রাইব্যুনালে অভিযোগ দাখিলের সুযোগ আছে ঠিক। কিন্তু আইনে দল বা সংগঠন দোষী প্রমাণিত হলে শাস্তি কি তা বলা নেই। আইনের ২০ ধারায় শুধু ব্যক্তির বিরুদ্ধে শাস্তির বিধান আছে। তাই জামায়াতে ইসলামীর বিরুদ্ধে কোন প্রক্রিয়ায় আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া যায় তা খতিয়ে দেখছি। আমরা আইনজীবীদের মতামত নিয়ে পদক্ষেপ নেব।' তিনি বলেন, ট্রাইব্যুনাল জামায়াতে ইসলামীকে অপরাধী সংগঠন হিসেবে উল্লেখ করায় ওই দলটির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার এখনই উত্তম সময়।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি অধ্যাপক আনোয়ার হোসেন গত ১৫ জুলাই সাংবাদিকদের বলেন, জামায়াত একটি অপরাধী সংগঠন, তা আদালতের রায়ে প্রমাণিত হয়েছে। তাই এ দলটি বাংলাদেশের মাটিতে নিষিদ্ধ করা জরুরি। সরকারের এখনই এ কাজটি করা উচিত।
আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনালস) আইনের ২(এ) ধারায় সহায়ক বাহিনীর একটি সংজ্ঞা দেওয়া হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, 'দল বা সহায়ক বাহিনী সমূহ- এর অন্তর্গত বুঝাবে সক্রিয়, প্রশাসনিক, সংরক্ষিত দল ও অন্যান্য উদ্দেশ্যে সশস্ত্র বাহিনীর নিয়ন্ত্রণে ন্যস্ত দলকে।' আপিল বিভাগের সাবেক বিচারপতি গোলাম রাব্বানী আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনালস) আইন নিয়ে লেখা বইয়ে দল বলতে জামায়াতে ইসলামী, মুসলিম লীগ, নেজামে ইসলাম, পিডিপি ইত্যাদিকে ইঙ্গিত করেছেন। তিনি লিখেছেন, এসব দল নিয়ে শান্তি কমিটি গঠন করা হয়। ১৯৭১ সালের ১৬ এপ্রিল নুরুল আমিনের নেতৃত্বে তাঁরা টিক্কা খানের সঙ্গে বৈঠক করেন। বৈঠকে শান্তি কমিটির নেতারা টিক্কা খানকে জানান, 'পাকিস্তানের সংহতি ও অখণ্ডতা রক্ষায় তারা পাকিস্তানি সেনাবাহিনীকে মদদ জুগিয়ে যেতে অটল রয়েছে।' এই ক্ষেত্রে জামায়াত দলগতভাবেই মানবতাবিরোধী অপরাধে সহায়তা করেছে বলেই প্রমাণিত হয়।
এদিকে জামায়াতে ইসলামীকে নির্বাচন কমিশনের দেওয়া নিবন্ধনের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে হাইকোর্টে একটি রিট আবেদন বিচারাধীন। তরিকত ফেডারেশনসহ কয়েকটি সংগঠন ও ব্যক্তি এ রিট আবেদন করেন। এ রিট আবেদনের ওপর এরই মধ্যে হাইকোর্টে শুনানি শেষ হয়েছে। আদালত রায়ের জন্য অপেক্ষমাণ রেখেছেন। যেকোনো দিন রায় হতে পারে। এ রায়ের ওপর নির্ভর করছে নির্বাচন কমিশনে দলটির নিবন্ধন থাকবে কি না। হাইকোর্ট দলটির নিবন্ধন অবৈধ ঘোষণা করলেও দলটির রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড চালাতে আইনগত বাধা থাকবে না। নিবন্ধন বাতিল হলে শুধু নির্বাচনে প্রার্থী দিতে পারবে না।
No comments