শৌখিনদার হুমায়ূন by সালেহ চৌধুরী
নন্দিত কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদের প্রথম মৃত্যুবার্ষিকী আজ। এ উপলক্ষে আমাদের এই আয়োজন।
হুমায়ূন আহমেদ চলে যাওয়ার পর বছর ঘুরে এল।
হুমায়ূন আহমেদ চলে যাওয়ার পর বছর ঘুরে এল।
এই পুরো সময়টাই হুমায়ূন আছেন আমার কাছাকাছি। যখনই ইচ্ছে করে, আমি তাঁকে
খুঁজে নিই। কখনো খুঁজি তাঁর বিচিত্র সৃষ্টির পরতে পরতে, কখনো উঁকি দিই
স্মৃতির কুঠরিতে। আমি তাঁর আনন্দময় রূপই অবলোকন করি। কে না জানে, সৃষ্টির
সঙ্গে বেদনা জড়িয়ে থাকলেও সৃষ্টিশীলতার জগৎ আনন্দের ধাম। আর হুমায়ূন ছিলেন
সে জগতেরই বাসিন্দা।
হুমায়ূন বেশ কিছু আঞ্চলিক শব্দকে সাহিত্যে স্থায়ী ঠাঁই করে দিয়ে গেছেন, যার একটি শৌখিনদার। শৌখিনদার মানে বাংলার শৌখিন। তা আনন্দের সঙ্গে শখ-শৌখিনতার একটি যোগ তো আছেই। হয়তো সেই সুবাদেই হুমায়ূন আমার দেখা সেরা শৌখিনদার। তাঁর সৃষ্টিরাজির অনেক কিছুই শৌখিনতার ফসল বললে খুব একটা ভুল হবে না বলেই মনে হয়। এ প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, শামসুর রাহমান কিংবা শরৎচন্দ্র-বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের নাম স্মরণ করা যেতে পারে। শৌখিনদারিতে ওঁরাও কম যেতেন না।
ভ্রমণ নিয়ে বিস্তর লিখেছেন। যদিও ভ্রমণোপাখ্যান মাত্রেরই শুরুতে ঘুরে বেড়ানোর ব্যাপারে তাঁর তীব্র অনীহার কথা জানিয়ে দিতে ভুলতেন না। তবু তাঁর জীবনে এমন বছর খুঁজে পাওয়া মুশকিল, যখন তিনি একাধিকবার দেশে কিংবা বিদেশে এদিক-ওদিক পা না বাড়িয়েছেন। তাঁর লেখাগুলো পড়লেই বোঝা যায়, নিজেকে বারবার ঘরকুনো বলে জাহির করা মানুষটি এই ঘুরে বেড়ানোকে কেমন উপভোগ করতেন। এতে তাঁর শৌখিনদারি এমনই প্রবল ছিল যে পরিবার-পরিজন তো বটেই, বন্ধুবান্ধবকে সঙ্গে না টানতে পারলে তৃপ্তি পেতেন না।
এমনই শৌখিনদারির জের টানতে গিয়েই সেন্ট মার্টিনে যাওয়া। এরই ফলে সমুদ্রবিলাসের গড়ে ওঠা। সেন্ট মার্টিনের হয়ে ওঠা দেশের অন্যতম প্রধান পর্যটন আকর্ষণ। নিরিবিলিতে ছবি তোলার একটা জায়গার খোঁজে পিরুজালি গ্রামে যাওয়া আর ‘নন্দন কানন’ অভিধায় চিহ্নিত নুহাশপল্লীর গড়ে ওঠা। যে উদ্যানের প্রতিটি গাছ-পাতায় জড়িয়ে আছে শৌখিনদার হুমায়ূন আহমেদের স্বপ্ন।
বন্ধু-স্বজনদের নিয়ে আনন্দের হাট বসানো, আপ্যায়নের চমক লাগানো উপায় উদ্ভাবন আর এসব খাতে ঢালাও ব্যয়ের জোগান দেওয়ার বর্ণনায় আমি যাব না। এ দিক নিয়ে অনেকেই লিখেছেন। আমি কেবল বলব, বড় মাপের শৌখিনদার ছাড়া অন্য কারও পক্ষে এমনটা কল্পনা করাও সম্ভব নয়।
বাইরের এই উদ্দামতা বাদ দিয়ে তাঁর ব্যক্তিগত জীবন-চর্যার দিকে চোখ ফেরালেও দেখা যাবে, ঢিলেঢালা ভেকের আড়ালে একজন শৌখিনদার বিচরণ করে গেছেন। তাঁর শৌখিনতায় লোকদেখানো আড়ম্বরের ছাপ ছিল না। চলাফেরায় ছিল অনেকটা আলাভোলা ভাব। তবে বাইরে থেকে বোঝা না গেলেও পোশাকের ব্যাপারে ছিলেন খুবই শৌখিন। জামা-পাতলুন যা পরতেন, সবই হতো, বিদেশে যাকে বলে ব্র্যান্ডেড আইটেম, তাই। দেশি পাজামা-পাঞ্জাবিও হতো সযত্নে বাছাই করা। যাঁরা তাঁকে জানতেন বা ঘনিষ্ঠভাবে দেখেছেন, সবাই তা স্বীকার করবেন।
শখ জাগল তো কোনো কিছুতেই পিছপা হতে রাজি ছিলেন না। সীতাকুণ্ড পাহাড়ের আগাছায় ছাওয়া পথ ধরে উঠতে গিয়ে দিনের বেলাতেই ছুটে সাপ মারতে হলো। এর দিন কয়েক পর এক রাতে মনে হলো, পাহাড়ে চড়ে জোছনা দেখতে হবে। অতএব চলো সবাই। মধ্যরাতের সেই চাঁদ দেখা অভিযানে দেড়-দুই বছরের নুহাশকেও সঙ্গী করে নিলেন কোলে করে। ভয়ংকর বলে খ্যাত শনির হাওর দেখতে গিয়ে শখ জাগল মধ্য হাওরে সাঁতার কাটবেন। নামলেন পানিতে। খুদে নুহাশই বা এখন অভিজ্ঞতা থেকে বাদ যাবে কেন? অতএব তাকেও নামিয়ে নিলেন অথই পানিতে।
শৌখিনদার হুমায়ূনের শখের ফিরিস্তি বলে শেষ করার নয়। এককালের শখের জাদুকর হুমায়ূন আহমেদ আমাদের কথাসাহিত্য, নাটক আর সিনেমাতে বিচিত্র রসের যে ভিয়েন দিয়ে জাদুকরি আকর্ষণে ঋদ্ধ করতে পেরেছেন, তার অনেক রসদেরই জোগান দিয়েছে এই শৌখিনদারি। হুমায়ূনকে মনে রেখে তাঁর লেখাগুলো পড়লেই এ বক্তব্যের অর্থ স্পষ্ট হতে পারে।
শৌখিনদার হুমায়ূন একটি ক্ষেত্রে কিন্তু তেমন সফল হতে পারেননি। তা হচ্ছে, কুকুর পালন। আজ সে গল্পই বলি। হুমায়ূন কুকুর ভালোবাসতেন। আমারও কিছু আগ্রহ ছিল কুকুর নিয়ে। মাঝেমধ্যেই কুকুর নিয়ে আমাদের মধ্যে কথা হতো। কুকুর নিয়ে একাত্তরে আমার এক অভিজ্ঞতায় হুমায়ূন এমনই অভিভূত হন যে, কয়েকবারই আগ্রহ প্রকাশ করেছেন—এ গল্পটা যদি আমি না লিখি তিনিই লিখবেন। আমি লেখার ইচ্ছে প্রকাশ করায় এ নিয়ে তাঁর আর কিছু করা হয়নি। তবে কুকুর নিয়ে মত্ত হওয়ার একটা সুযোগ পাওয়া গেল।
দৈনিক বাংলায় আমার সহকর্মী জহিরুল হকও (প্রয়াত) ছিলেন একজন শৌখিনদার মানুষ। তাঁর বিচিত্র শখের একটি ছিল কুকুর পোষা। এক জোড়া বড় আর এক জোড়া ছোট (ল্যাপ ডগ) কুকুর জহির তাঁর বাসায় পুষতেন। জহির একদিন জানালেন, ল্যাপ ডগের বাচ্চা হয়েছে। আমি তাঁকে ধরে বসলাম, একটা বাচ্চা আমাকে দিতে হবে।
সজ্জন জহির আমাকে পছন্দ করতেন। বয়সের সুবাদে হয়তো কিছু শ্রদ্ধাও। আমার অনুরোধ তাই ঠেলতে পারলেন না। আমাকে একটা বাচ্চা দেবেন বলে কথা দিলেন। বিকেলে দেখা হতেই আমার এ আনন্দসংবাদ হুমায়ূনকে জানালাম। শুনেই হুমায়ূন লাফিয়ে উঠলেন। ল্যাপ ডগের একটা ছানা তাঁরও চাই। থাকতেন তখন শহীদুল্লাহ হলে। আমি চেষ্টা করব বলেও তাঁকে শান্ত করতে পারলাম না। তখনই ছুটতে হলো জহিরের বাসায়।
মাস দেড়েক পর দুটি বাচ্চা নিয়ে গেলাম হুমায়ূনের বাসায়। একটি তুষারধবল, অপরটি ধূসর। হুমায়ূনের আনন্দের সীমা রইল না। হুমায়ূন আর তাঁর তিন কন্যা নোভা-শীলা-বিপাশা সাদা বাচ্চাটাই বেছে নিলেন। নাম রাখলেন উইন্ডি। ছোট কুকুরের বিরক্তিকর উৎপাত সম্পর্কে হুঁশিয়ার করে দিয়ে বাসায় ফিরলাম।
সপ্তাহ খানেক যেতে না-যেতেই হুমায়ূন বাসায় ডাকলেন। গিয়ে দেখি, তাঁর মুখ বেশ গম্ভীর। বললেন, কুকুরছানাটা ফিরিয়ে নিয়ে যান। আমি এটা রাখতে পারছি না। ব্যাপার কী জানতে চেয়ে শুনলাম, আগের রাতে এই দুষ্টু টিংকুর (গুলতেকিন খান) দুই জোড়া নতুন স্যান্ডেল চিবিয়ে বরবাদ করে দিয়েছে। বুঝলাম, বাচ্চা কুকুর জুতা-স্যান্ডেল নষ্ট করতে পারে বলে সাবধান করে এলেও ওঁরা অসতর্ক ছিলেন। কুকুরছানা তার স্বভাব মেনে গৃহকর্ত্রীর বিরাগভাজন হয়েছে। এমনটা আরও ঘটতে পারে বলায় হুমায়ূন বললেন, এ ঝামেলায় আর কাজ নেই। ওটা নিয়ে যান।
বছর কয়েক পরের কথা। সেন্ট মার্টিন থেকে হুমায়ূন ঘুরে আসার পর প্রায়ই তাঁকে ওখানকার কুকুর নিয়ে উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠতে দেখতাম। বিশাল আকারের কুকুর। প্রধান বৈশিষ্ট্য চামরের মতো ছড়ানো লেজ। একদিন বললাম, অতই যখন পছন্দ, একটা বাচ্চা নিয়ে এলেই পারো। হুমায়ূন বললেন, তিনিও ও কথা ভেবেছিলেন। তবে খবর নিয়ে জেনেছেন, দ্বীপ থেকে মূল ভূখণ্ডে নিয়ে আসার কয়েক দিনের মধ্যেই বাচ্চাগুলো মরে যায়। এর কারণ নিয়ে হুমায়ূন ভাবিত। আমিও ভাবতে থাকলাম। সেন্ট মার্টিন আর বাংলাদেশের আবহাওয়ায় এমন কিছু তফাত তো নেই যে কুকুরগুলো মূল ভূখণ্ডে এলেই মরে যাবে। আমি এ নিয়ে ভাবতে থাকলাম।
একসময় কুকুর নিয়ে কিছু পড়াশোনা করা ছিল। সেই সূত্র ধরে ভাবতে গিয়ে খাদ্যাভ্যাসের কথা মাথায় এল। সেন্ট মার্টিনের এই কুকুরগুলো কী খেয়ে বেঁচে আছে, জানতে চাইলে হুমায়ূন বললেন, ওখানে কী আর খাবে, জেলেদের ফেলে দেওয়া ফালতু মাছই ওদের প্রধান নির্ভর। তা ছাড়া জোয়ারের ঠেলায় দ্বীপের কিনারায় চলে আসা মাছ ধরেও ওদের খেতে দেখা যায়।
আমি জবাব পেয়ে গেলাম। বললাম, আমরা তো কুকুরকে রাতিব (গোশতের ছাঁট) আর ভাত খেতে দিই। যুগের পর যুগ ধরে সামুদ্রিক মাছ খেয়ে বেঁচে থাকা কুকুরের পেটে এ খাবার সয় না বলেই ওরা মরে যায়। সামুদ্রিক মাছ খাইয়ে বড় করার ফাঁকে ফাঁকে আমাদের প্রচলিত খাদ্যে অভ্যস্ত করে তুললে বাচ্চাগুলো এভাবে মরবে না। আমার যুক্তি তাঁর মনে ধরল। পরের বার সেন্ট মার্টিন থেকে ফেরার সময় চমৎকার একটা কুকুরছানা নিয়ে এলেন। ওর নাম দিলেন ডিংগো।
সময় প্রকাশনীর ফরিদ আহমদ তখন অনেক কিছুর জন্যই ছিলেন হুমায়ূননির্ভর। তাঁকে বুঝিয়ে দেওয়া হলো, সামুদ্রিক মাছ একটু হলুদ আর লবণ দিয়ে সেদ্ধ করে খাইয়ে ওকে রান্না করা খাবারে অভ্যস্ত করে তুলতে হবে। পরে এর সঙ্গে যুক্ত করতে হবে একমুঠো চাল। আরও বড় হলে রাতিব বা গোশত দেওয়া যাবে।
ফরিদ পরম যত্নে ডিংগোকে বড় করে তোলেন। ওঁর বাসা ছিল তখন আজিমপুর, চায়না বিল্ডিংয়ের গলিতে। আমাকে মাঝেমধ্যে ওখানে গিয়ে দেখে আসতে হতো। কুকুরটা খুবই দ্রুত এবং সুন্দরভাবে বেড়ে ওঠে। এমন বিশাল আকার নেয়, যা সেন্ট মার্টিনেও বড় একটা দেখা যায় না।
ধানমন্ডির বাসায় (গুলতেকিন) উঠে আসার পর হুমায়ূন ডিংগোকে নিজের কাছে নিয়ে এলেন। প্রাকৃতিক কারণেই বড় জাতের কুকুরকে বেশ ছোটাছুটি করতে হয়। পরিচারকদের ঘুরিয়ে আনায় হয়তো ওর চাহিদা মিটত না। ডিংগো তাই অনেক সময় উঁচু দেয়াল লাফিয়ে বাইরে ছুটে যেত। তার ভয়াল আকৃতি পাড়ার লোককে করে তুলত সন্ত্রস্ত। একদিন এক প্রতিবেশী নালিশ নিয়ে হুমায়ূনের কাছে আসেন। তাঁর বক্তব্য ছিল শালীনতাবর্জিত। হুমায়ূনও তাই ক্ষুব্ধ হন। তবে ক্ষিপ্ত প্রতিবেশীকে কিছু না বলে ডিংগোকেই করেন বাড়িছাড়া। দিয়ে দেন দূরের এক বন্ধুকে।
পরে তো হুমায়ূন হলেন দখিন হাওয়ায় ফ্ল্যাটবাসী। ফ্ল্যাটে বড় কুকুর পোষার উপায় নেই। বার কয়েক উচ্চ দাম দিয়ে নিয়ে আসেন ল্যাপ ডগ। কুকুর পোষার ঝক্কি সামলানোর মতো সময় তাঁর ছিল না। তাই সম্ভব হতো না আগ্রহ ধরে রাখা। কিছুদিন পরই কুকুর চালান হতো নুহাশপল্লীতে।
নুহাশপল্লীতে একদঙ্গল দেশি কুকুর বহাল তবিয়তে থাকলেও অপটু পরিচারকদের হাতে পড়ে এদের অবস্থা হতো হতশ্রী এবং একসময় শিকার হতো আধিব্যাধির।
হুমায়ূনের কুকুরের শখ কিন্তু মিলিয়ে যায়নি। পরে দেখলাম, আরও চড়া দাম দিয়ে নিয়ে এসেছেন পুতুল পুতুল চেহারার খুদে কুকুরের ছানা। যাদের অনেকে বলেন পকেট ডগ। ওদের ভাগ্যও যে খুব প্রসন্ন হতো, তা মনে হয় না। শৌখিনদার হুমায়ূন ওদের ঘরে এনেই শখ মেটাতেন। যত্নআত্তি করার সময় তাঁর ছিল না বলেই ওগুলোও একইভাবে মারা যেত কিংবা চালান হতো অন্য কোথাও।
অনেক কিছুতেই ছিল তাঁর দুর্বার শখ। অকল্পনীয়ভাবে তিনি তা মিটিয়েও গেছেন। তবে আমার মনে হয়, শৌখিনদার হুমায়ূন আহমেদের কুকুরপ্রীতি অপূর্ণই থেকে গেছে!
হুমায়ূন বেশ কিছু আঞ্চলিক শব্দকে সাহিত্যে স্থায়ী ঠাঁই করে দিয়ে গেছেন, যার একটি শৌখিনদার। শৌখিনদার মানে বাংলার শৌখিন। তা আনন্দের সঙ্গে শখ-শৌখিনতার একটি যোগ তো আছেই। হয়তো সেই সুবাদেই হুমায়ূন আমার দেখা সেরা শৌখিনদার। তাঁর সৃষ্টিরাজির অনেক কিছুই শৌখিনতার ফসল বললে খুব একটা ভুল হবে না বলেই মনে হয়। এ প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, শামসুর রাহমান কিংবা শরৎচন্দ্র-বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের নাম স্মরণ করা যেতে পারে। শৌখিনদারিতে ওঁরাও কম যেতেন না।
ভ্রমণ নিয়ে বিস্তর লিখেছেন। যদিও ভ্রমণোপাখ্যান মাত্রেরই শুরুতে ঘুরে বেড়ানোর ব্যাপারে তাঁর তীব্র অনীহার কথা জানিয়ে দিতে ভুলতেন না। তবু তাঁর জীবনে এমন বছর খুঁজে পাওয়া মুশকিল, যখন তিনি একাধিকবার দেশে কিংবা বিদেশে এদিক-ওদিক পা না বাড়িয়েছেন। তাঁর লেখাগুলো পড়লেই বোঝা যায়, নিজেকে বারবার ঘরকুনো বলে জাহির করা মানুষটি এই ঘুরে বেড়ানোকে কেমন উপভোগ করতেন। এতে তাঁর শৌখিনদারি এমনই প্রবল ছিল যে পরিবার-পরিজন তো বটেই, বন্ধুবান্ধবকে সঙ্গে না টানতে পারলে তৃপ্তি পেতেন না।
এমনই শৌখিনদারির জের টানতে গিয়েই সেন্ট মার্টিনে যাওয়া। এরই ফলে সমুদ্রবিলাসের গড়ে ওঠা। সেন্ট মার্টিনের হয়ে ওঠা দেশের অন্যতম প্রধান পর্যটন আকর্ষণ। নিরিবিলিতে ছবি তোলার একটা জায়গার খোঁজে পিরুজালি গ্রামে যাওয়া আর ‘নন্দন কানন’ অভিধায় চিহ্নিত নুহাশপল্লীর গড়ে ওঠা। যে উদ্যানের প্রতিটি গাছ-পাতায় জড়িয়ে আছে শৌখিনদার হুমায়ূন আহমেদের স্বপ্ন।
বন্ধু-স্বজনদের নিয়ে আনন্দের হাট বসানো, আপ্যায়নের চমক লাগানো উপায় উদ্ভাবন আর এসব খাতে ঢালাও ব্যয়ের জোগান দেওয়ার বর্ণনায় আমি যাব না। এ দিক নিয়ে অনেকেই লিখেছেন। আমি কেবল বলব, বড় মাপের শৌখিনদার ছাড়া অন্য কারও পক্ষে এমনটা কল্পনা করাও সম্ভব নয়।
বাইরের এই উদ্দামতা বাদ দিয়ে তাঁর ব্যক্তিগত জীবন-চর্যার দিকে চোখ ফেরালেও দেখা যাবে, ঢিলেঢালা ভেকের আড়ালে একজন শৌখিনদার বিচরণ করে গেছেন। তাঁর শৌখিনতায় লোকদেখানো আড়ম্বরের ছাপ ছিল না। চলাফেরায় ছিল অনেকটা আলাভোলা ভাব। তবে বাইরে থেকে বোঝা না গেলেও পোশাকের ব্যাপারে ছিলেন খুবই শৌখিন। জামা-পাতলুন যা পরতেন, সবই হতো, বিদেশে যাকে বলে ব্র্যান্ডেড আইটেম, তাই। দেশি পাজামা-পাঞ্জাবিও হতো সযত্নে বাছাই করা। যাঁরা তাঁকে জানতেন বা ঘনিষ্ঠভাবে দেখেছেন, সবাই তা স্বীকার করবেন।
শখ জাগল তো কোনো কিছুতেই পিছপা হতে রাজি ছিলেন না। সীতাকুণ্ড পাহাড়ের আগাছায় ছাওয়া পথ ধরে উঠতে গিয়ে দিনের বেলাতেই ছুটে সাপ মারতে হলো। এর দিন কয়েক পর এক রাতে মনে হলো, পাহাড়ে চড়ে জোছনা দেখতে হবে। অতএব চলো সবাই। মধ্যরাতের সেই চাঁদ দেখা অভিযানে দেড়-দুই বছরের নুহাশকেও সঙ্গী করে নিলেন কোলে করে। ভয়ংকর বলে খ্যাত শনির হাওর দেখতে গিয়ে শখ জাগল মধ্য হাওরে সাঁতার কাটবেন। নামলেন পানিতে। খুদে নুহাশই বা এখন অভিজ্ঞতা থেকে বাদ যাবে কেন? অতএব তাকেও নামিয়ে নিলেন অথই পানিতে।
শৌখিনদার হুমায়ূনের শখের ফিরিস্তি বলে শেষ করার নয়। এককালের শখের জাদুকর হুমায়ূন আহমেদ আমাদের কথাসাহিত্য, নাটক আর সিনেমাতে বিচিত্র রসের যে ভিয়েন দিয়ে জাদুকরি আকর্ষণে ঋদ্ধ করতে পেরেছেন, তার অনেক রসদেরই জোগান দিয়েছে এই শৌখিনদারি। হুমায়ূনকে মনে রেখে তাঁর লেখাগুলো পড়লেই এ বক্তব্যের অর্থ স্পষ্ট হতে পারে।
শৌখিনদার হুমায়ূন একটি ক্ষেত্রে কিন্তু তেমন সফল হতে পারেননি। তা হচ্ছে, কুকুর পালন। আজ সে গল্পই বলি। হুমায়ূন কুকুর ভালোবাসতেন। আমারও কিছু আগ্রহ ছিল কুকুর নিয়ে। মাঝেমধ্যেই কুকুর নিয়ে আমাদের মধ্যে কথা হতো। কুকুর নিয়ে একাত্তরে আমার এক অভিজ্ঞতায় হুমায়ূন এমনই অভিভূত হন যে, কয়েকবারই আগ্রহ প্রকাশ করেছেন—এ গল্পটা যদি আমি না লিখি তিনিই লিখবেন। আমি লেখার ইচ্ছে প্রকাশ করায় এ নিয়ে তাঁর আর কিছু করা হয়নি। তবে কুকুর নিয়ে মত্ত হওয়ার একটা সুযোগ পাওয়া গেল।
দৈনিক বাংলায় আমার সহকর্মী জহিরুল হকও (প্রয়াত) ছিলেন একজন শৌখিনদার মানুষ। তাঁর বিচিত্র শখের একটি ছিল কুকুর পোষা। এক জোড়া বড় আর এক জোড়া ছোট (ল্যাপ ডগ) কুকুর জহির তাঁর বাসায় পুষতেন। জহির একদিন জানালেন, ল্যাপ ডগের বাচ্চা হয়েছে। আমি তাঁকে ধরে বসলাম, একটা বাচ্চা আমাকে দিতে হবে।
সজ্জন জহির আমাকে পছন্দ করতেন। বয়সের সুবাদে হয়তো কিছু শ্রদ্ধাও। আমার অনুরোধ তাই ঠেলতে পারলেন না। আমাকে একটা বাচ্চা দেবেন বলে কথা দিলেন। বিকেলে দেখা হতেই আমার এ আনন্দসংবাদ হুমায়ূনকে জানালাম। শুনেই হুমায়ূন লাফিয়ে উঠলেন। ল্যাপ ডগের একটা ছানা তাঁরও চাই। থাকতেন তখন শহীদুল্লাহ হলে। আমি চেষ্টা করব বলেও তাঁকে শান্ত করতে পারলাম না। তখনই ছুটতে হলো জহিরের বাসায়।
মাস দেড়েক পর দুটি বাচ্চা নিয়ে গেলাম হুমায়ূনের বাসায়। একটি তুষারধবল, অপরটি ধূসর। হুমায়ূনের আনন্দের সীমা রইল না। হুমায়ূন আর তাঁর তিন কন্যা নোভা-শীলা-বিপাশা সাদা বাচ্চাটাই বেছে নিলেন। নাম রাখলেন উইন্ডি। ছোট কুকুরের বিরক্তিকর উৎপাত সম্পর্কে হুঁশিয়ার করে দিয়ে বাসায় ফিরলাম।
সপ্তাহ খানেক যেতে না-যেতেই হুমায়ূন বাসায় ডাকলেন। গিয়ে দেখি, তাঁর মুখ বেশ গম্ভীর। বললেন, কুকুরছানাটা ফিরিয়ে নিয়ে যান। আমি এটা রাখতে পারছি না। ব্যাপার কী জানতে চেয়ে শুনলাম, আগের রাতে এই দুষ্টু টিংকুর (গুলতেকিন খান) দুই জোড়া নতুন স্যান্ডেল চিবিয়ে বরবাদ করে দিয়েছে। বুঝলাম, বাচ্চা কুকুর জুতা-স্যান্ডেল নষ্ট করতে পারে বলে সাবধান করে এলেও ওঁরা অসতর্ক ছিলেন। কুকুরছানা তার স্বভাব মেনে গৃহকর্ত্রীর বিরাগভাজন হয়েছে। এমনটা আরও ঘটতে পারে বলায় হুমায়ূন বললেন, এ ঝামেলায় আর কাজ নেই। ওটা নিয়ে যান।
বছর কয়েক পরের কথা। সেন্ট মার্টিন থেকে হুমায়ূন ঘুরে আসার পর প্রায়ই তাঁকে ওখানকার কুকুর নিয়ে উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠতে দেখতাম। বিশাল আকারের কুকুর। প্রধান বৈশিষ্ট্য চামরের মতো ছড়ানো লেজ। একদিন বললাম, অতই যখন পছন্দ, একটা বাচ্চা নিয়ে এলেই পারো। হুমায়ূন বললেন, তিনিও ও কথা ভেবেছিলেন। তবে খবর নিয়ে জেনেছেন, দ্বীপ থেকে মূল ভূখণ্ডে নিয়ে আসার কয়েক দিনের মধ্যেই বাচ্চাগুলো মরে যায়। এর কারণ নিয়ে হুমায়ূন ভাবিত। আমিও ভাবতে থাকলাম। সেন্ট মার্টিন আর বাংলাদেশের আবহাওয়ায় এমন কিছু তফাত তো নেই যে কুকুরগুলো মূল ভূখণ্ডে এলেই মরে যাবে। আমি এ নিয়ে ভাবতে থাকলাম।
একসময় কুকুর নিয়ে কিছু পড়াশোনা করা ছিল। সেই সূত্র ধরে ভাবতে গিয়ে খাদ্যাভ্যাসের কথা মাথায় এল। সেন্ট মার্টিনের এই কুকুরগুলো কী খেয়ে বেঁচে আছে, জানতে চাইলে হুমায়ূন বললেন, ওখানে কী আর খাবে, জেলেদের ফেলে দেওয়া ফালতু মাছই ওদের প্রধান নির্ভর। তা ছাড়া জোয়ারের ঠেলায় দ্বীপের কিনারায় চলে আসা মাছ ধরেও ওদের খেতে দেখা যায়।
আমি জবাব পেয়ে গেলাম। বললাম, আমরা তো কুকুরকে রাতিব (গোশতের ছাঁট) আর ভাত খেতে দিই। যুগের পর যুগ ধরে সামুদ্রিক মাছ খেয়ে বেঁচে থাকা কুকুরের পেটে এ খাবার সয় না বলেই ওরা মরে যায়। সামুদ্রিক মাছ খাইয়ে বড় করার ফাঁকে ফাঁকে আমাদের প্রচলিত খাদ্যে অভ্যস্ত করে তুললে বাচ্চাগুলো এভাবে মরবে না। আমার যুক্তি তাঁর মনে ধরল। পরের বার সেন্ট মার্টিন থেকে ফেরার সময় চমৎকার একটা কুকুরছানা নিয়ে এলেন। ওর নাম দিলেন ডিংগো।
সময় প্রকাশনীর ফরিদ আহমদ তখন অনেক কিছুর জন্যই ছিলেন হুমায়ূননির্ভর। তাঁকে বুঝিয়ে দেওয়া হলো, সামুদ্রিক মাছ একটু হলুদ আর লবণ দিয়ে সেদ্ধ করে খাইয়ে ওকে রান্না করা খাবারে অভ্যস্ত করে তুলতে হবে। পরে এর সঙ্গে যুক্ত করতে হবে একমুঠো চাল। আরও বড় হলে রাতিব বা গোশত দেওয়া যাবে।
ফরিদ পরম যত্নে ডিংগোকে বড় করে তোলেন। ওঁর বাসা ছিল তখন আজিমপুর, চায়না বিল্ডিংয়ের গলিতে। আমাকে মাঝেমধ্যে ওখানে গিয়ে দেখে আসতে হতো। কুকুরটা খুবই দ্রুত এবং সুন্দরভাবে বেড়ে ওঠে। এমন বিশাল আকার নেয়, যা সেন্ট মার্টিনেও বড় একটা দেখা যায় না।
ধানমন্ডির বাসায় (গুলতেকিন) উঠে আসার পর হুমায়ূন ডিংগোকে নিজের কাছে নিয়ে এলেন। প্রাকৃতিক কারণেই বড় জাতের কুকুরকে বেশ ছোটাছুটি করতে হয়। পরিচারকদের ঘুরিয়ে আনায় হয়তো ওর চাহিদা মিটত না। ডিংগো তাই অনেক সময় উঁচু দেয়াল লাফিয়ে বাইরে ছুটে যেত। তার ভয়াল আকৃতি পাড়ার লোককে করে তুলত সন্ত্রস্ত। একদিন এক প্রতিবেশী নালিশ নিয়ে হুমায়ূনের কাছে আসেন। তাঁর বক্তব্য ছিল শালীনতাবর্জিত। হুমায়ূনও তাই ক্ষুব্ধ হন। তবে ক্ষিপ্ত প্রতিবেশীকে কিছু না বলে ডিংগোকেই করেন বাড়িছাড়া। দিয়ে দেন দূরের এক বন্ধুকে।
পরে তো হুমায়ূন হলেন দখিন হাওয়ায় ফ্ল্যাটবাসী। ফ্ল্যাটে বড় কুকুর পোষার উপায় নেই। বার কয়েক উচ্চ দাম দিয়ে নিয়ে আসেন ল্যাপ ডগ। কুকুর পোষার ঝক্কি সামলানোর মতো সময় তাঁর ছিল না। তাই সম্ভব হতো না আগ্রহ ধরে রাখা। কিছুদিন পরই কুকুর চালান হতো নুহাশপল্লীতে।
নুহাশপল্লীতে একদঙ্গল দেশি কুকুর বহাল তবিয়তে থাকলেও অপটু পরিচারকদের হাতে পড়ে এদের অবস্থা হতো হতশ্রী এবং একসময় শিকার হতো আধিব্যাধির।
হুমায়ূনের কুকুরের শখ কিন্তু মিলিয়ে যায়নি। পরে দেখলাম, আরও চড়া দাম দিয়ে নিয়ে এসেছেন পুতুল পুতুল চেহারার খুদে কুকুরের ছানা। যাদের অনেকে বলেন পকেট ডগ। ওদের ভাগ্যও যে খুব প্রসন্ন হতো, তা মনে হয় না। শৌখিনদার হুমায়ূন ওদের ঘরে এনেই শখ মেটাতেন। যত্নআত্তি করার সময় তাঁর ছিল না বলেই ওগুলোও একইভাবে মারা যেত কিংবা চালান হতো অন্য কোথাও।
অনেক কিছুতেই ছিল তাঁর দুর্বার শখ। অকল্পনীয়ভাবে তিনি তা মিটিয়েও গেছেন। তবে আমার মনে হয়, শৌখিনদার হুমায়ূন আহমেদের কুকুরপ্রীতি অপূর্ণই থেকে গেছে!
No comments