শাহরি রমজানতারাবি নামাজ ও কিয়ামুল লাইল by মাওলানা সালেহ আহমদ রাজু
তখন হজরত উমর ফারুক (রা.) ছিলেন মুসলিম
বিশ্বের খলিফা। তিনি মুসলমানদের সব সুখ-দুঃখের অংশীদার। মুসলমানদের
উন্নতি-অগ্রগতির কথা ভাবেন। রাতের বেলায় ঘুরে বেড়ান লোকালয়ে। দুর্বল, অসহায়
ও অনাথদের খোঁজে ঘুরে বেড়ান তাঁবুতে তাঁবুতে, পাড়ায় পাড়ায়।
কখনো গিয়ে হাজির হন মসজিদে। গিয়ে দেখেন, নবীজি (সা.)-এর রেখে যাওয়া পবিত্র ইসলামে বিন্দু-
বিসর্গ রদ-বদল হচ্ছে কি না? ইসলামের বিধিনিষেধ পালনে কোনোরূপ আলসেমি পেয়ে বসছে কি না? তিনি এসব বিষয় সর্বদাই ভাবেন, ঘুরে ফেরেন সতর্ক প্রহরির মতো।
এক রমজানুল মোবারকের ঘটনা। নীরব রাত। হজরত উমর (রা.) যথারীতি টহলে নেমেছেন। সঙ্গে আবদুর রহমান ইবনে আবদুল কাদির। হাঁটছেন উভয়ে। মসজিদে নববীতে গিয়ে দেখলেন কেউ খণ্ড জামায়াত কেউবা একাকী নামাজ পড়ছেন। উমর (রা.) বিষয়টি গভীরভাবে লক্ষ করলেন। বললেন, সবাই মিলে একটি জামায়াতে তারাবি পড়লে খুব ভালো হতো। দৃঢ় সংকল্পবদ্ধ হলেন। স্মরণ করলেন বিশিষ্ট সাহাবি উবাই ইবনে কাব (রা.)-কে। পরের দিন থেকে এক জামায়াতে তারাবি পড়ার কথা জানালেন। জানালেন, এই জামায়াতের ইমাম হবেন হজরত উবাই। তাঁর সুললিত কণ্ঠ, অকৃত্রিম মাধুরিমাধৌত তেলাওয়াত সবার হৃদয় ছুঁয়ে যেত। সাহাবায়ে কেরামের যথেষ্ট অনুরাগ ছিল তাঁর তেলাওয়াতের প্রতি। পরের রাতে উমর (রা.) মসজিদে গিয়ে দেখলেন, তারাবির জামায়াত হচ্ছে। বিশাল জামায়াত। একই ইমামের পেছনে নামাজের সৌম্য শান্ত-সুনিবিড় এ দৃশ্য প্লাবিত করে উমরের আত্মা, শান্তির আলতো পরশ মেখে দেয় তাঁর চেতনা-অনুভূতি। তিনি বলে ওঠেন, 'কত সুন্দর নতুন সংস্কৃতি এটি!' জামায়াতের সঙ্গে বিশ রাকাত তারাবির প্রচলন এখান থেকেই শুরু। এর অর্থ এই নয়, তারাবি হজরত উমর (রা.)-এর আবিষ্কার কিংবা জামায়াতে তারাবির প্রচলন ঘটেছে তাঁর আমলে। তারাবি প্রিয় নবীজী (সা.)-এর সুন্নত। হজরত আবু হোরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুল (সা.) বলেছেন, 'যে ব্যক্তি আল্লাহর প্রতি ইমান ও পরকালীন প্রতিদান প্রত্যাশায় রমজানের রোজা রাখে, তার অতীতকালের সব অপরাধ ক্ষমা করে দেওয়া হবে। যে ব্যক্তি আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস ও পরকালীন পুরস্কার লাভের আশায় নির্ঘুম রাত কাটাবে, রমজানের রাতগুলোর কারণে তার অতীতকালের সব গোনাহ ক্ষমা করে দেওয়া হবে।' (বুখারি শরিফ)। এ হাদিসে নির্ঘুম রাত যাপন বলতে তারাবি বোঝানো হয়েছে। এর মর্যাদা বর্ণনায় বলা হয়েছে, কেউ ইমানের তাড়নায় ও পরকালীন প্রতিদানের প্রত্যাশায় তারাবি পড়লে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির অতীতকালের সব অপরাধ ক্ষমা করে দেওয়া হবে। সব ধরনের সুন্দর, শুভ ও কল্যাণের কাজে প্রতিযোগিতা হয়েছে সাহাবায়ে কেরামের মধ্যে। ইবাদত-বন্দেগিতে নির্ঘুম রাত যাপন ছিল তাঁদের অনন্য বৈশিষ্ট্য। 'রাতে সাধক-পুরুষ, দিনে অশ্বারোহী মুজাহিদ' ছিল তাঁদের পরিচয়। তাই তাঁরা রমজানের রাত যাপনের এই অপার ফজিলতের কথা শুনেই এতে যুক্ত হয়েছেন প্রাণের তাগিদে। নবীজী (সা.) নিজেও তারাবি পড়েছেন। তবে নিয়মিত বিশ রাকাত পড়তেন না। কারণ ছিল, নবীজী (সা.) কোনো কাজ নিয়মিত করলে তা উম্মতের জন্য ওয়াজিব হয়ে যায়। নবীজী (সা.) উম্মতের প্রতি এই করুণাদৃষ্টিতেই রোজ বিশ রাকাত পূর্ণ তারাবির জামায়াত হতে দেননি। রহমতের সেই পরশেই তারাবি সুন্নতে মুয়াক্কাদা; ওয়াজিব নয়। দুর্বল উম্মতের প্রতি এতটুকু করুণা দেখাতে গিয়েই নবীজী (সা.) কখনো তারাবি একা পড়েছেন, কখনো কম পড়েছেন, কখনো বেশি।
হজরত উমর (রা.) জামায়াতের সঙ্গে বিশ রাকাত তারাবি পড়ার ঘোষণা দেওয়ার সময় সাহাবায়ে কেরামের বিরাট কাফেলা মদিনায় উপস্থিত ছিলেন। তাঁদের কেউ এর প্রতিবাদ করেননি। প্রশংসা করেছেন অনেকেই। হজরত উমরের ইন্তেকালের পর আলোকময় তারাবির জামায়াত লক্ষ করে হজরত আলী (রা.) বলেছিলেন, 'উমর আমাদের মসজিদগুলোকে উদ্ভাসিত করেছেন, আল্লাহ তাঁর কবরকেও আলোকোজ্জ্বল করুন।' সাহাবায়ে কেরামের এই ঐকমত্যও 'শরিয়তের স্বতন্ত্র দলিল।' রাসুল (সা.) বলেছেন, 'তোমাদের জন্য আমার এবং খোলাফায়ে রাশেদার আদর্শ অনুসরণ অবশ্য কর্তব্য।' তারাবি জামায়াতসহ নিয়মিত বিশ রাকাতের প্রচলন হজরত উমর করলেও তা বহালতবিয়তে বজায় ছিল পরবর্তী হজরত ওসমান, হজরত আলী (রা.)-সহ সব খলিফার আমলে। তা ছাড়া রাসুল (সা.) কর্তৃক বিশ রাকাত তারাবি পড়ার প্রমাণ তো আছেই। জামায়াতসহ বিশ রাকাত তারাবি সাহাবায়ে কেরামের ইজমা, খোলাফায়ে রাশেদার সুন্নত, নবীজীর হাদিসসহ পরবর্তীকালের ইমামদের বক্তব্যের দ্বারাও সত্য প্রমাণিত। পবিত্র এ রমজান মাসেই নাজিল হয়েছে কোরআন শরিফ। এ মাসে কোরআন তেলাওয়াতের স্বতন্ত্র গুরুত্ব রয়েছে। তারাবিতে পুরো কোরআন শরিফ পড়াও একটি স্বতন্ত্র সুন্নত। এর ফজিলতও অপরিসীম। রাসুল (সা.) বলেছেন, 'রোজা এবং কোরআন বান্দার জন্য সুপারিশ করবে। রোজা বলবে, হে আমার প্রভু, আমি তাকে দিনের বেলা পানাহার ও জৈবিক চাহিদা থেকে বিরত রেখেছি। তার জন্য আমার সুপারিশ কবুল করুন। কোরআন বলবে, আমি তাকে রাতের বেলা ঘুমাতে দেইনি। তার জন্য আমার সুপারিশ কবুল করুন।' (বায়হাকি শরিফ)
রমজানুল মোবারকে দিনে রোজা রাখা এবং রাতে তারাবি নামাজের পাশাপাশি কোরআন তেলাওয়াত, জিকির-আজকার, ইবাদত-বন্দেগিতে কাটিয়ে দেওয়া ইমানের দাবি। এতে করে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির দুনিয়া ও আখেরাত- দোজাহানের কল্যাণ নিশ্চিত হয়। আল্লাহ আমাদের কবুল করুন।
লেখক : মুহাদ্দিস, জামিয়া মাদানিয়া, বিশ্বনাথ, সিলেট
বিসর্গ রদ-বদল হচ্ছে কি না? ইসলামের বিধিনিষেধ পালনে কোনোরূপ আলসেমি পেয়ে বসছে কি না? তিনি এসব বিষয় সর্বদাই ভাবেন, ঘুরে ফেরেন সতর্ক প্রহরির মতো।
এক রমজানুল মোবারকের ঘটনা। নীরব রাত। হজরত উমর (রা.) যথারীতি টহলে নেমেছেন। সঙ্গে আবদুর রহমান ইবনে আবদুল কাদির। হাঁটছেন উভয়ে। মসজিদে নববীতে গিয়ে দেখলেন কেউ খণ্ড জামায়াত কেউবা একাকী নামাজ পড়ছেন। উমর (রা.) বিষয়টি গভীরভাবে লক্ষ করলেন। বললেন, সবাই মিলে একটি জামায়াতে তারাবি পড়লে খুব ভালো হতো। দৃঢ় সংকল্পবদ্ধ হলেন। স্মরণ করলেন বিশিষ্ট সাহাবি উবাই ইবনে কাব (রা.)-কে। পরের দিন থেকে এক জামায়াতে তারাবি পড়ার কথা জানালেন। জানালেন, এই জামায়াতের ইমাম হবেন হজরত উবাই। তাঁর সুললিত কণ্ঠ, অকৃত্রিম মাধুরিমাধৌত তেলাওয়াত সবার হৃদয় ছুঁয়ে যেত। সাহাবায়ে কেরামের যথেষ্ট অনুরাগ ছিল তাঁর তেলাওয়াতের প্রতি। পরের রাতে উমর (রা.) মসজিদে গিয়ে দেখলেন, তারাবির জামায়াত হচ্ছে। বিশাল জামায়াত। একই ইমামের পেছনে নামাজের সৌম্য শান্ত-সুনিবিড় এ দৃশ্য প্লাবিত করে উমরের আত্মা, শান্তির আলতো পরশ মেখে দেয় তাঁর চেতনা-অনুভূতি। তিনি বলে ওঠেন, 'কত সুন্দর নতুন সংস্কৃতি এটি!' জামায়াতের সঙ্গে বিশ রাকাত তারাবির প্রচলন এখান থেকেই শুরু। এর অর্থ এই নয়, তারাবি হজরত উমর (রা.)-এর আবিষ্কার কিংবা জামায়াতে তারাবির প্রচলন ঘটেছে তাঁর আমলে। তারাবি প্রিয় নবীজী (সা.)-এর সুন্নত। হজরত আবু হোরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুল (সা.) বলেছেন, 'যে ব্যক্তি আল্লাহর প্রতি ইমান ও পরকালীন প্রতিদান প্রত্যাশায় রমজানের রোজা রাখে, তার অতীতকালের সব অপরাধ ক্ষমা করে দেওয়া হবে। যে ব্যক্তি আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস ও পরকালীন পুরস্কার লাভের আশায় নির্ঘুম রাত কাটাবে, রমজানের রাতগুলোর কারণে তার অতীতকালের সব গোনাহ ক্ষমা করে দেওয়া হবে।' (বুখারি শরিফ)। এ হাদিসে নির্ঘুম রাত যাপন বলতে তারাবি বোঝানো হয়েছে। এর মর্যাদা বর্ণনায় বলা হয়েছে, কেউ ইমানের তাড়নায় ও পরকালীন প্রতিদানের প্রত্যাশায় তারাবি পড়লে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির অতীতকালের সব অপরাধ ক্ষমা করে দেওয়া হবে। সব ধরনের সুন্দর, শুভ ও কল্যাণের কাজে প্রতিযোগিতা হয়েছে সাহাবায়ে কেরামের মধ্যে। ইবাদত-বন্দেগিতে নির্ঘুম রাত যাপন ছিল তাঁদের অনন্য বৈশিষ্ট্য। 'রাতে সাধক-পুরুষ, দিনে অশ্বারোহী মুজাহিদ' ছিল তাঁদের পরিচয়। তাই তাঁরা রমজানের রাত যাপনের এই অপার ফজিলতের কথা শুনেই এতে যুক্ত হয়েছেন প্রাণের তাগিদে। নবীজী (সা.) নিজেও তারাবি পড়েছেন। তবে নিয়মিত বিশ রাকাত পড়তেন না। কারণ ছিল, নবীজী (সা.) কোনো কাজ নিয়মিত করলে তা উম্মতের জন্য ওয়াজিব হয়ে যায়। নবীজী (সা.) উম্মতের প্রতি এই করুণাদৃষ্টিতেই রোজ বিশ রাকাত পূর্ণ তারাবির জামায়াত হতে দেননি। রহমতের সেই পরশেই তারাবি সুন্নতে মুয়াক্কাদা; ওয়াজিব নয়। দুর্বল উম্মতের প্রতি এতটুকু করুণা দেখাতে গিয়েই নবীজী (সা.) কখনো তারাবি একা পড়েছেন, কখনো কম পড়েছেন, কখনো বেশি।
হজরত উমর (রা.) জামায়াতের সঙ্গে বিশ রাকাত তারাবি পড়ার ঘোষণা দেওয়ার সময় সাহাবায়ে কেরামের বিরাট কাফেলা মদিনায় উপস্থিত ছিলেন। তাঁদের কেউ এর প্রতিবাদ করেননি। প্রশংসা করেছেন অনেকেই। হজরত উমরের ইন্তেকালের পর আলোকময় তারাবির জামায়াত লক্ষ করে হজরত আলী (রা.) বলেছিলেন, 'উমর আমাদের মসজিদগুলোকে উদ্ভাসিত করেছেন, আল্লাহ তাঁর কবরকেও আলোকোজ্জ্বল করুন।' সাহাবায়ে কেরামের এই ঐকমত্যও 'শরিয়তের স্বতন্ত্র দলিল।' রাসুল (সা.) বলেছেন, 'তোমাদের জন্য আমার এবং খোলাফায়ে রাশেদার আদর্শ অনুসরণ অবশ্য কর্তব্য।' তারাবি জামায়াতসহ নিয়মিত বিশ রাকাতের প্রচলন হজরত উমর করলেও তা বহালতবিয়তে বজায় ছিল পরবর্তী হজরত ওসমান, হজরত আলী (রা.)-সহ সব খলিফার আমলে। তা ছাড়া রাসুল (সা.) কর্তৃক বিশ রাকাত তারাবি পড়ার প্রমাণ তো আছেই। জামায়াতসহ বিশ রাকাত তারাবি সাহাবায়ে কেরামের ইজমা, খোলাফায়ে রাশেদার সুন্নত, নবীজীর হাদিসসহ পরবর্তীকালের ইমামদের বক্তব্যের দ্বারাও সত্য প্রমাণিত। পবিত্র এ রমজান মাসেই নাজিল হয়েছে কোরআন শরিফ। এ মাসে কোরআন তেলাওয়াতের স্বতন্ত্র গুরুত্ব রয়েছে। তারাবিতে পুরো কোরআন শরিফ পড়াও একটি স্বতন্ত্র সুন্নত। এর ফজিলতও অপরিসীম। রাসুল (সা.) বলেছেন, 'রোজা এবং কোরআন বান্দার জন্য সুপারিশ করবে। রোজা বলবে, হে আমার প্রভু, আমি তাকে দিনের বেলা পানাহার ও জৈবিক চাহিদা থেকে বিরত রেখেছি। তার জন্য আমার সুপারিশ কবুল করুন। কোরআন বলবে, আমি তাকে রাতের বেলা ঘুমাতে দেইনি। তার জন্য আমার সুপারিশ কবুল করুন।' (বায়হাকি শরিফ)
রমজানুল মোবারকে দিনে রোজা রাখা এবং রাতে তারাবি নামাজের পাশাপাশি কোরআন তেলাওয়াত, জিকির-আজকার, ইবাদত-বন্দেগিতে কাটিয়ে দেওয়া ইমানের দাবি। এতে করে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির দুনিয়া ও আখেরাত- দোজাহানের কল্যাণ নিশ্চিত হয়। আল্লাহ আমাদের কবুল করুন।
লেখক : মুহাদ্দিস, জামিয়া মাদানিয়া, বিশ্বনাথ, সিলেট
No comments