সাদাকালো-রায়, সহিংসতা ও গোলাম আযম সমাচার by আহমদ রফিক
জামায়াতে ইসলামীর সাবেক আমির গোলাম আযম
বাংলাদেশের গরিষ্ঠসংখ্যক মানুষের কাছে একাত্তরের 'ঘাতক শিরোমণি' হিসেবে
কুখ্যাতি অর্জন করেছে। বলতে গেলে জামায়াতের শীর্ষ নেতাদের সবাই একাত্তরে
নরনারী-শিশুহত্যাসহ নারী
নির্যাতন ও অগ্নিসংযোগের মতো
সুনির্দিষ্ট মানবতাবিরোধী কর্মকাণ্ডের সঙ্গে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জড়িত।
যেমন গোলাম আযম, নিজামী, মুজাহিদ, সাঈদী, কাদের মোল্লা প্রমুখ। একই কাতারে
মুসলিম লীগ ও নেজামে ইসলামের শীর্ষ নেতারা। তবে একাত্তরের পাকিস্তানি
বাহিনীর বর্বরতার প্রধান ও ঘনিষ্ঠ সহযোগী জামায়াত ও তার অঙ্গসংগঠন আল বদর,
আল শামসের তরুণ জঙ্গি সদস্য এবং মুসলিম লীগের নেতা-কর্মীরা।
যুদ্ধাপরাধের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট মানবতাবিরোধী এসব অপরাধ আন্তর্জাতিক মানদণ্ডে শাস্তিযোগ্য। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধে ইহুদি গণহত্যা, পরবর্তীকালে সার্বিয়া-ক্রোয়েশিয়া থেকে আফ্রিকার একাধিক দেশের গণহত্যায় অপরাধীদের বিচারের আওতায় আনা হয়েছে। ইসরায়েল তো দীর্ঘকাল পর ইহুদি-ঘাতক আইখম্যানকে সুদূর দক্ষিণ আমেরিকা থেকে ধরে এনে বিচার শেষে তার মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করে। বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক বাধা-বিপত্তির মুখে অপরাধী পাকিস্তানি সেনাদের বিচার করতে পারেনি। সে অবকাশে স্থানীয় ঘাতকদেরও বিচার ও শাস্তি হয়নি।
দেরিতে হলেও বর্তমান সরকার কর্তৃক গঠিত আন্তর্জাতিক বিচার ট্রাইব্যুনাল নানা অসুবিধার মধ্যে বিচারকাজ শুরু করে। ৪২ বছরের অতীত খুঁড়ে সাক্ষ্য-প্রমাণ সংগ্রহের দুরূহ কাজ সম্পন্ন করতে হচ্ছে। স্বভাবতই এ প্রক্রিয়ায় থাকছে ফাঁকফোকর, সীমাবদ্ধতা। থাকছে অভিযোগ প্রমাণে দুর্বলতা। যে জন্য কিছুসংখ্যক হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত কাদের মোল্লার সর্বোচ্চ শাস্তিদান সম্ভব হয়নি বলে কেউ কেউ মনে করেন। তা সত্ত্বেও ঘাতকের সর্বোচ্চ শাস্তির দাবিতে মানুষের ক্ষোভ প্রকাশ পেয়েছে। শাহবাগ গণজাগরণ মঞ্চের তারুণ্য বিষয়টিকে প্রতিবাদের ভাষায় তুলে ধরেছে ফাঁসির দাবিতে।
এর পর দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর অনুরূপ অপরাধে সর্বোচ্চ শাস্তির রায় ঘোষণার পরিপ্রেক্ষিতে জামায়াত-শিবির হরতাল ঘোষণার মাধ্যমে যে সহিংস তাণ্ডব চালায়, তা শুধু পুলিশ বাহিনী নয়, রাজনীতিক ও রাজনীতিসচেতন মানুষের জন্যও শিক্ষণীয় বিষয় হয়ে দাঁড়ায়। সে শিক্ষার মূল কথা হচ্ছে, একাত্তরের জামায়াতের হিংস্র, ঘাতক চরিত্র, সাম্প্রদায়িক চরিত্রের সামান্যতম পরিবর্তন ঘটেনি। তাই সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ওপর এ উপলক্ষে চলেছে অকারণ হামলা। হরতালের সূত্রে সন্ত্রাসী তাণ্ডব স্বধর্মের প্রতি সব শ্রদ্ধা বিকিয়ে দিয়ে।
লক্ষ করার বিষয় যে দুর্বোধ্য কারণে, যুক্তিহীন কারণে পশ্চিমা রাজনৈতিক মহলে এ বিচার নিয়ে দ্বিধা-সংশয় পাশ্চাত্য গণতন্ত্রের প্রতি আস্থার জায়গাটিকে প্রশ্নবিদ্ধ করে তোলে। আমাদেরও মনে তখন প্রশ্ন পশ্চিমা দেশগুলো কি তাদের মধ্যপ্রাচ্য স্বার্থ রক্ষার কারণে এ নীতিবিগর্হিত ভূমিকা গ্রহণ করছে! এর নেতিবাচক প্রভাব সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি করতে পারে। তাই এমন সন্দেহ হাওয়ায় ভেসেছে যে এসব কারণে একাত্তরের গণহত্যার প্রধান স্থানীয় কারিগর গোলাম আযমের রায় প্রকাশ বিলম্বিত হচ্ছে কি না।
সে সন্দেহ অমূলক প্রমাণ করে গোলাম আযমের বিচারের রায় প্রকাশ পেয়েছে। এ 'কেস' অর্থাৎ গোলাম আযমের বিচারের গুরুত্ব জামায়াতই প্রমাণ করেছে রায় ঘোষণার আগেই হরতাল আহ্বান করে (সোমবার)। এমনকি হরতালের আগের দিন দুপুর থেকে ঢাকার রাজপথে তারা সহিংসতার প্রকাশ ঘটায় গাড়ি ভাঙচুর, অটোরিকশা ও বাসে আগুন দেওয়ার মতো সীমাহীন হিংস্রতার মাধ্যমে। এসব কর্মকাণ্ড তাদের রাজনৈতিক স্বভাব ও সংস্কৃতিতে পরিণত হয়েছে।
সমাজবিরোধী নিয়ম-নীতিবিরোধী এ জাতীয় কর্মকাণ্ড চলেছে দেশজুড়ে এবং তা রমজান মাসে মানুষের কেনাবেচার-পথচলার প্রতি চরম অসম্মান ও ঔদ্ধত্য প্রকাশ করে। ধর্ম ও ধর্মাচরণের প্রতি তাদের আস্থা ও শ্রদ্ধার অভাবই এতে স্পষ্ট হয়ে ওঠে। ধর্মকে রাজনৈতিক স্বার্থে ব্যবহার করে ধর্মের শুদ্ধতা নষ্ট করতে তাদের ন্যায়নীতিতে বাধে না। ঢাকায় হেফাজতি তাণ্ডবের সময় এসব ভণ্ড ধর্মবাজের হাতে কোরআন-হাদিস গ্রন্থ পুড়েছে, প্রকৃত ধর্ম লাঞ্ছিত হয়েছে।
শুধু ধর্মবিরোধী নয়, মানবতাবিরোধী কর্মকাণ্ড অতীতের মতো এখনো চালিয়ে যাচ্ছে জামায়াত। তাই হরতাল আহ্বান করেও সন্তুষ্ট নয় তারা। দেশজুড়ে যে সহিংসতা চালিয়েছে তারা, তাতে শত শত কোটি টাকার জাতীয় সম্পদ নষ্ট হয়েছে, মানুষ মরেছে, অনেকে আহত হয়েছে এবং ব্যক্তিগত সম্পদ নষ্ট হয়েছে অনেক। একটি দৈনিকে মোটা শিরোনাম- 'দুদিনের সহিংসতায় নিহত ৯।' আবারও হরতাল। রোজার মাসে মানুষের সীমাহীন দুর্ভোগ। ভাবা যায়, এক সপ্তাহে চার দিন হরতাল! অর্থাৎ একটি কর্মদিবস নিয়ে সপ্তাহ শেষে। তাও আবার রমজান মাসে?
বিচারে গোলাম আযমের ৯০ বছরের অর্থাৎ আমৃত্যু কারাদণ্ড। রায় ঘোষণার পর মিশ্র প্রতিক্রিয়া। সরকারপ্রধান এ রায়ে সন্তুষ্ট। কিন্তু মনে হয় না সন্তুষ্ট দলের সাধারণ নেতা-কর্মী। ব্যাপক জনমত অসন্তুষ্ট। প্রতিবাদ গণজাগরণ মঞ্চের তরুণদের। তারা একাত্তরে সংঘটিত অপরাধের পেছনে মূল ব্যক্তিটির সর্বোচ্চ শাস্তি চায়। তাদের প্রতিবাদী সমাবেশ ও মিছিলে বাধা দিয়েছে সরকার। কারণ তারা আদালতের প্রতি শ্রদ্ধা দেখিয়ে নিয়মতান্ত্রিক পথে চলতে ইচ্ছুক। এ মনোভাব সম্পর্কে মন্তব্য শোনা যাচ্ছে : 'ডাল্মে কুছ কালা হ্যায়!'
রায় প্রদানকারী বিচারকদের বক্তব্য হচ্ছে, গোলাম আযমের বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধ সুস্পষ্টভাবে প্রমাণিত। কিন্তু অপরাধীর বয়স (৯১ বছর) ও অসুস্থতা বিবেচনায় সর্বোচ্চ শাস্তির বদলের ৯০ বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে। এখন এ রায় নিয়ে চলছে পোস্টমর্টেম, নানা দৃষ্টান্ত, উদাহরণ তুলে, রায়ের পক্ষে-বিপক্ষে। প্রতিবাদীদের বক্তব্য হচ্ছে- সাঈদীর যদি সর্বোচ্চ সাজা হতে পারে, তাহলে ঘাতক জামায়াতের আমির গোলাম আযমের সর্বোচ্চ শাস্তিই প্রাপ্য। করুণা বা নমনীয়তার যোগ্য নয় এসব অপরাধী।
একাত্তরের গণহত্যায় তারা কি কারো বয়স বিচার করেছে, নারী-শিশু-বৃদ্ধ বিচার করেছে? করেনি। বরং হত্যার সঙ্গে বাড়তি যোগ করেছে অমানুষিক নির্যাতন- চোখ উপড়ে ফেলা, হাত ছিঁড়ে নেওয়া থেকে জান্তব অত্যাচার- তরুণ মুক্তিযোদ্ধা রুমী থেকে মধ্যবয়সী শিল্পী আলতাফ মাহমুদ, চিকিৎসক ফজলে রাব্বী থেকে আলিম চৌধুরী- কয়েকটি প্রতীকী নাম। ঘাতক চৌধুরী মঈনুদ্দীনের স্বীকারোক্তিতে (যদি সম্ভব হয়) প্রমাণ মিলবে, 'মানুষ' এই শব্দটির প্রতি কী অপরিসীম অশ্রদ্ধা দেখিয়েছে তারা। তাদের প্রতি নমনীয়তা? ভিন্ন মতবাদীরা বলছেন, 'বাংলার মানুষ ক্ষমা করতে জানে।' এ ক্ষেত্রে ক্ষমা নয়, কিছু মাত্রায় মানবিক নমনীয়তা দেখানো হয়েছে, এই যা। এটা উদাহরণ হয়ে থাকুক। কিন্তু তারুণ্য এ নমনীয়তা মানতে নারাজ।
হয়তো এর কারণ জামায়াত সংশোধনের পথ ধরেনি, একাত্তরের অন্যায় স্বীকার করে নেয়নি। এখনো তারা ক্ষমতা দখলের চিন্তা মাথায় রেখে যে হিংস্রতা, বর্বরতার প্রকাশ ঘটাচ্ছে, তাতে যোগ্য শাস্তি তাদের অপরাধী শীর্ষ নেতাদের প্রাপ্য। সুযোগ পেলে অর্থাৎ এককভাবে ক্ষমতায় আসতে পারলে তারা পুরনো কায়দা ভিন্নমতের মোকাবিলা করবে। করবে মনুষ্যত্বের প্রতি চরম অবমাননার প্রকাশ ঘটিয়ে। যে অবমাননা প্রকৃত ধর্মীয় রীতিনীতি অগ্রাহ্য করার শামিল। ধর্মীয় বিচারে পবিত্র পরিগণিত মানবদেহের প্রতিও তাদের বিন্দুমাত্র শ্রদ্ধাবোধ নেই। পর ধর্ম-সহিষ্ণুতাও নেই। শুধু একাত্তরে নয়, ২০১৩ সালে পৌঁছেও তাদের কর্মকাণ্ড তেমন প্রমাণই দিচ্ছে।
এ জাতীয় ঘাতকদের কথা ভেবেই কি শান্তিবাদী, মানবতাবাদী করি রবীন্দ্রনাথ তাঁর স্বভাবসুলভ নমনীয়তায় 'প্রশ্ন' রেখেছিলেন সবার সামনে ক্ষমার যৌক্তিকতা নিয়ে, অন্যত্র 'ক্ষমার ক্ষীণ দুর্বলতা'র বিরুদ্ধে প্রতিবাদী হওয়ার আহ্বান জানিয়ে। যুদ্ধাপরাধ ও বীভৎস অমানবিক অপরাধে ক্ষমার নৈতিকতা নিয়ে কি তাঁর মনে প্রশ্ন জেগেছিল? তাই কিছু প্রতিবাদী কবিতা, প্রশ্নবোধক কবিতা রচনা?
যুদ্ধাপরাধ নিয়ে একাত্তরে আমরা ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি দেখেছি। তার জের মিটে যায়নি। তাই গোলাম আযমের শাস্তি নিয়ে মানুষের মনে ক্ষোভ। তবে এ রায়ের আরো একটি ইতিবাচক দিক হলো, একাত্তরে জামায়াতের দলগতভাবে সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধে দোষী সাব্যস্ত হওয়া। ফলে রাজনৈতিক অঙ্গনে তাদের অবস্থান প্রশ্নবিদ্ধ হবে। তাই জামায়াত নীতিগতভাবে বিএনপি জোটের কাঁধে বোঝা হয়ে ওঠার কথা। সে ক্ষেত্রে 'বোঝা নামানোর' প্রশ্ন নিয়ে বিএনপি কি পর্যালোচনার কথা ভাববে না?
বুধবার আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ মামলার রায় প্রকাশ পেয়েছে। জামায়াতের মহাসচিব আলী আহসান মুহাম্মদ মুজাহিদের মামলায় বিজ্ঞ আদালত যথেষ্ট সাক্ষ্য-প্রমাণ সাপেক্ষে অপরাধীর মৃত্যুদণ্ড রায় ঘোষণা করেছেন। তার বিরুদ্ধে গণহত্যা, বুদ্ধিজীবী হত্যা, অপহরণ, অগ্নিসংযোগ ও লুটপাটসহ একাধিক অভিযোগ ছিল। তাই এ রায়। গোলাম আযমের মামলার রায় শুনে যাঁরা ক্ষুব্ধ ও ব্যথিত হয়েছিলেন, এ রায়ে তাঁদের ক্ষোভ-ব্যথা লাঘব হওয়ার কথা।
এ রায়ের প্রতিক্রিয়ায় সবাই খুশি- সরকার, বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, তারুণ্য ও সাধারণ মানুষ। বিএনপি আগের মতোই এ রায়ের ক্ষেত্রে নীরব, প্রতিক্রিয়াহীন। তারা কি জোট ও ভোটের হিসাব মেলাচ্ছে? তবে স্বাধীনতার ঘোষকের প্রতিষ্ঠিত দলটির অন্তত এ বিষয়ে সুস্পষ্ট অবস্থান নেওয়া উচিত, একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধ বলে কথা আর জনমত যেখানে বিচারের পক্ষে, রায়ের পক্ষে।
তবে এ উপলক্ষেও যথারীতি জামায়াতের হরতাল ঘোষণা- পবিত্র রমজান মাসে যে হরতাল নিয়ে সাধারণ মানুষের মুখেও সমালোচনা প্রকাশ পাচ্ছে। রোজায় দিনমজুর, ছোট দোকানদারদের কথা ভাবেনি জামায়াত। তাদের রাজনৈতিক সহিংসতা বন্ধ হওয়ার নয়। যা-ই হোক, পূর্বোক্ত রায়ের পর্যবেক্ষণ বিবেচনায় এখন অনেকের দাবি, জামায়াত নিষিদ্ধ করা হোক। এখনই সময়। অন্যদের চিন্তা, তাদের রাজনৈতিকভাবে মোকাবিলা ও সামাজিকভাবে সব কিছুতে বয়কট করা হোক। দ্বিতীয় ব্যবস্থাটি নখদন্তহীন হলেও এর কার্যকারিতা কম হবে না বলে তাঁরা মনে করেন।
সবশেষে এসব বিচার ও রায়ের পরিপ্রেক্ষিতে যে দাবি বড় হয়ে উঠছে তা হলো, নিয়মনীতি মাফিক রায় দ্রুত কার্যকর করা, বিশেষত সর্বোচ্চ শাস্তির ক্ষেত্রে। কারণ তা না হলে কোনো কারণে রাজনৈতিক পটপরিবর্তন ঘটলে বিচারের যা কিছু অর্জন, সব ব্যর্থ হয়ে যেতে পারে। জাতির জন্য তা হবে দুঃখজনক। তাই কারো কারো পরামর্শ, এমন আইনের বিধান রাখা হোক, যাতে মানবতাবিরোধী অপরাধের শাস্তির বিষয়টি সর্বোচ্চ ক্ষেত্রেও ক্ষমার অযোগ্য বিবেচিত হয়। জানি না, এ পরামর্শ সরকার আমলে নেবে কি না।
লেখক : কবি, গবেষক ও ভাষাসংগ্রামী
যুদ্ধাপরাধের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট মানবতাবিরোধী এসব অপরাধ আন্তর্জাতিক মানদণ্ডে শাস্তিযোগ্য। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধে ইহুদি গণহত্যা, পরবর্তীকালে সার্বিয়া-ক্রোয়েশিয়া থেকে আফ্রিকার একাধিক দেশের গণহত্যায় অপরাধীদের বিচারের আওতায় আনা হয়েছে। ইসরায়েল তো দীর্ঘকাল পর ইহুদি-ঘাতক আইখম্যানকে সুদূর দক্ষিণ আমেরিকা থেকে ধরে এনে বিচার শেষে তার মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করে। বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক বাধা-বিপত্তির মুখে অপরাধী পাকিস্তানি সেনাদের বিচার করতে পারেনি। সে অবকাশে স্থানীয় ঘাতকদেরও বিচার ও শাস্তি হয়নি।
দেরিতে হলেও বর্তমান সরকার কর্তৃক গঠিত আন্তর্জাতিক বিচার ট্রাইব্যুনাল নানা অসুবিধার মধ্যে বিচারকাজ শুরু করে। ৪২ বছরের অতীত খুঁড়ে সাক্ষ্য-প্রমাণ সংগ্রহের দুরূহ কাজ সম্পন্ন করতে হচ্ছে। স্বভাবতই এ প্রক্রিয়ায় থাকছে ফাঁকফোকর, সীমাবদ্ধতা। থাকছে অভিযোগ প্রমাণে দুর্বলতা। যে জন্য কিছুসংখ্যক হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত কাদের মোল্লার সর্বোচ্চ শাস্তিদান সম্ভব হয়নি বলে কেউ কেউ মনে করেন। তা সত্ত্বেও ঘাতকের সর্বোচ্চ শাস্তির দাবিতে মানুষের ক্ষোভ প্রকাশ পেয়েছে। শাহবাগ গণজাগরণ মঞ্চের তারুণ্য বিষয়টিকে প্রতিবাদের ভাষায় তুলে ধরেছে ফাঁসির দাবিতে।
এর পর দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর অনুরূপ অপরাধে সর্বোচ্চ শাস্তির রায় ঘোষণার পরিপ্রেক্ষিতে জামায়াত-শিবির হরতাল ঘোষণার মাধ্যমে যে সহিংস তাণ্ডব চালায়, তা শুধু পুলিশ বাহিনী নয়, রাজনীতিক ও রাজনীতিসচেতন মানুষের জন্যও শিক্ষণীয় বিষয় হয়ে দাঁড়ায়। সে শিক্ষার মূল কথা হচ্ছে, একাত্তরের জামায়াতের হিংস্র, ঘাতক চরিত্র, সাম্প্রদায়িক চরিত্রের সামান্যতম পরিবর্তন ঘটেনি। তাই সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ওপর এ উপলক্ষে চলেছে অকারণ হামলা। হরতালের সূত্রে সন্ত্রাসী তাণ্ডব স্বধর্মের প্রতি সব শ্রদ্ধা বিকিয়ে দিয়ে।
লক্ষ করার বিষয় যে দুর্বোধ্য কারণে, যুক্তিহীন কারণে পশ্চিমা রাজনৈতিক মহলে এ বিচার নিয়ে দ্বিধা-সংশয় পাশ্চাত্য গণতন্ত্রের প্রতি আস্থার জায়গাটিকে প্রশ্নবিদ্ধ করে তোলে। আমাদেরও মনে তখন প্রশ্ন পশ্চিমা দেশগুলো কি তাদের মধ্যপ্রাচ্য স্বার্থ রক্ষার কারণে এ নীতিবিগর্হিত ভূমিকা গ্রহণ করছে! এর নেতিবাচক প্রভাব সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি করতে পারে। তাই এমন সন্দেহ হাওয়ায় ভেসেছে যে এসব কারণে একাত্তরের গণহত্যার প্রধান স্থানীয় কারিগর গোলাম আযমের রায় প্রকাশ বিলম্বিত হচ্ছে কি না।
সে সন্দেহ অমূলক প্রমাণ করে গোলাম আযমের বিচারের রায় প্রকাশ পেয়েছে। এ 'কেস' অর্থাৎ গোলাম আযমের বিচারের গুরুত্ব জামায়াতই প্রমাণ করেছে রায় ঘোষণার আগেই হরতাল আহ্বান করে (সোমবার)। এমনকি হরতালের আগের দিন দুপুর থেকে ঢাকার রাজপথে তারা সহিংসতার প্রকাশ ঘটায় গাড়ি ভাঙচুর, অটোরিকশা ও বাসে আগুন দেওয়ার মতো সীমাহীন হিংস্রতার মাধ্যমে। এসব কর্মকাণ্ড তাদের রাজনৈতিক স্বভাব ও সংস্কৃতিতে পরিণত হয়েছে।
সমাজবিরোধী নিয়ম-নীতিবিরোধী এ জাতীয় কর্মকাণ্ড চলেছে দেশজুড়ে এবং তা রমজান মাসে মানুষের কেনাবেচার-পথচলার প্রতি চরম অসম্মান ও ঔদ্ধত্য প্রকাশ করে। ধর্ম ও ধর্মাচরণের প্রতি তাদের আস্থা ও শ্রদ্ধার অভাবই এতে স্পষ্ট হয়ে ওঠে। ধর্মকে রাজনৈতিক স্বার্থে ব্যবহার করে ধর্মের শুদ্ধতা নষ্ট করতে তাদের ন্যায়নীতিতে বাধে না। ঢাকায় হেফাজতি তাণ্ডবের সময় এসব ভণ্ড ধর্মবাজের হাতে কোরআন-হাদিস গ্রন্থ পুড়েছে, প্রকৃত ধর্ম লাঞ্ছিত হয়েছে।
শুধু ধর্মবিরোধী নয়, মানবতাবিরোধী কর্মকাণ্ড অতীতের মতো এখনো চালিয়ে যাচ্ছে জামায়াত। তাই হরতাল আহ্বান করেও সন্তুষ্ট নয় তারা। দেশজুড়ে যে সহিংসতা চালিয়েছে তারা, তাতে শত শত কোটি টাকার জাতীয় সম্পদ নষ্ট হয়েছে, মানুষ মরেছে, অনেকে আহত হয়েছে এবং ব্যক্তিগত সম্পদ নষ্ট হয়েছে অনেক। একটি দৈনিকে মোটা শিরোনাম- 'দুদিনের সহিংসতায় নিহত ৯।' আবারও হরতাল। রোজার মাসে মানুষের সীমাহীন দুর্ভোগ। ভাবা যায়, এক সপ্তাহে চার দিন হরতাল! অর্থাৎ একটি কর্মদিবস নিয়ে সপ্তাহ শেষে। তাও আবার রমজান মাসে?
বিচারে গোলাম আযমের ৯০ বছরের অর্থাৎ আমৃত্যু কারাদণ্ড। রায় ঘোষণার পর মিশ্র প্রতিক্রিয়া। সরকারপ্রধান এ রায়ে সন্তুষ্ট। কিন্তু মনে হয় না সন্তুষ্ট দলের সাধারণ নেতা-কর্মী। ব্যাপক জনমত অসন্তুষ্ট। প্রতিবাদ গণজাগরণ মঞ্চের তরুণদের। তারা একাত্তরে সংঘটিত অপরাধের পেছনে মূল ব্যক্তিটির সর্বোচ্চ শাস্তি চায়। তাদের প্রতিবাদী সমাবেশ ও মিছিলে বাধা দিয়েছে সরকার। কারণ তারা আদালতের প্রতি শ্রদ্ধা দেখিয়ে নিয়মতান্ত্রিক পথে চলতে ইচ্ছুক। এ মনোভাব সম্পর্কে মন্তব্য শোনা যাচ্ছে : 'ডাল্মে কুছ কালা হ্যায়!'
রায় প্রদানকারী বিচারকদের বক্তব্য হচ্ছে, গোলাম আযমের বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধ সুস্পষ্টভাবে প্রমাণিত। কিন্তু অপরাধীর বয়স (৯১ বছর) ও অসুস্থতা বিবেচনায় সর্বোচ্চ শাস্তির বদলের ৯০ বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে। এখন এ রায় নিয়ে চলছে পোস্টমর্টেম, নানা দৃষ্টান্ত, উদাহরণ তুলে, রায়ের পক্ষে-বিপক্ষে। প্রতিবাদীদের বক্তব্য হচ্ছে- সাঈদীর যদি সর্বোচ্চ সাজা হতে পারে, তাহলে ঘাতক জামায়াতের আমির গোলাম আযমের সর্বোচ্চ শাস্তিই প্রাপ্য। করুণা বা নমনীয়তার যোগ্য নয় এসব অপরাধী।
একাত্তরের গণহত্যায় তারা কি কারো বয়স বিচার করেছে, নারী-শিশু-বৃদ্ধ বিচার করেছে? করেনি। বরং হত্যার সঙ্গে বাড়তি যোগ করেছে অমানুষিক নির্যাতন- চোখ উপড়ে ফেলা, হাত ছিঁড়ে নেওয়া থেকে জান্তব অত্যাচার- তরুণ মুক্তিযোদ্ধা রুমী থেকে মধ্যবয়সী শিল্পী আলতাফ মাহমুদ, চিকিৎসক ফজলে রাব্বী থেকে আলিম চৌধুরী- কয়েকটি প্রতীকী নাম। ঘাতক চৌধুরী মঈনুদ্দীনের স্বীকারোক্তিতে (যদি সম্ভব হয়) প্রমাণ মিলবে, 'মানুষ' এই শব্দটির প্রতি কী অপরিসীম অশ্রদ্ধা দেখিয়েছে তারা। তাদের প্রতি নমনীয়তা? ভিন্ন মতবাদীরা বলছেন, 'বাংলার মানুষ ক্ষমা করতে জানে।' এ ক্ষেত্রে ক্ষমা নয়, কিছু মাত্রায় মানবিক নমনীয়তা দেখানো হয়েছে, এই যা। এটা উদাহরণ হয়ে থাকুক। কিন্তু তারুণ্য এ নমনীয়তা মানতে নারাজ।
হয়তো এর কারণ জামায়াত সংশোধনের পথ ধরেনি, একাত্তরের অন্যায় স্বীকার করে নেয়নি। এখনো তারা ক্ষমতা দখলের চিন্তা মাথায় রেখে যে হিংস্রতা, বর্বরতার প্রকাশ ঘটাচ্ছে, তাতে যোগ্য শাস্তি তাদের অপরাধী শীর্ষ নেতাদের প্রাপ্য। সুযোগ পেলে অর্থাৎ এককভাবে ক্ষমতায় আসতে পারলে তারা পুরনো কায়দা ভিন্নমতের মোকাবিলা করবে। করবে মনুষ্যত্বের প্রতি চরম অবমাননার প্রকাশ ঘটিয়ে। যে অবমাননা প্রকৃত ধর্মীয় রীতিনীতি অগ্রাহ্য করার শামিল। ধর্মীয় বিচারে পবিত্র পরিগণিত মানবদেহের প্রতিও তাদের বিন্দুমাত্র শ্রদ্ধাবোধ নেই। পর ধর্ম-সহিষ্ণুতাও নেই। শুধু একাত্তরে নয়, ২০১৩ সালে পৌঁছেও তাদের কর্মকাণ্ড তেমন প্রমাণই দিচ্ছে।
এ জাতীয় ঘাতকদের কথা ভেবেই কি শান্তিবাদী, মানবতাবাদী করি রবীন্দ্রনাথ তাঁর স্বভাবসুলভ নমনীয়তায় 'প্রশ্ন' রেখেছিলেন সবার সামনে ক্ষমার যৌক্তিকতা নিয়ে, অন্যত্র 'ক্ষমার ক্ষীণ দুর্বলতা'র বিরুদ্ধে প্রতিবাদী হওয়ার আহ্বান জানিয়ে। যুদ্ধাপরাধ ও বীভৎস অমানবিক অপরাধে ক্ষমার নৈতিকতা নিয়ে কি তাঁর মনে প্রশ্ন জেগেছিল? তাই কিছু প্রতিবাদী কবিতা, প্রশ্নবোধক কবিতা রচনা?
যুদ্ধাপরাধ নিয়ে একাত্তরে আমরা ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি দেখেছি। তার জের মিটে যায়নি। তাই গোলাম আযমের শাস্তি নিয়ে মানুষের মনে ক্ষোভ। তবে এ রায়ের আরো একটি ইতিবাচক দিক হলো, একাত্তরে জামায়াতের দলগতভাবে সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধে দোষী সাব্যস্ত হওয়া। ফলে রাজনৈতিক অঙ্গনে তাদের অবস্থান প্রশ্নবিদ্ধ হবে। তাই জামায়াত নীতিগতভাবে বিএনপি জোটের কাঁধে বোঝা হয়ে ওঠার কথা। সে ক্ষেত্রে 'বোঝা নামানোর' প্রশ্ন নিয়ে বিএনপি কি পর্যালোচনার কথা ভাববে না?
বুধবার আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ মামলার রায় প্রকাশ পেয়েছে। জামায়াতের মহাসচিব আলী আহসান মুহাম্মদ মুজাহিদের মামলায় বিজ্ঞ আদালত যথেষ্ট সাক্ষ্য-প্রমাণ সাপেক্ষে অপরাধীর মৃত্যুদণ্ড রায় ঘোষণা করেছেন। তার বিরুদ্ধে গণহত্যা, বুদ্ধিজীবী হত্যা, অপহরণ, অগ্নিসংযোগ ও লুটপাটসহ একাধিক অভিযোগ ছিল। তাই এ রায়। গোলাম আযমের মামলার রায় শুনে যাঁরা ক্ষুব্ধ ও ব্যথিত হয়েছিলেন, এ রায়ে তাঁদের ক্ষোভ-ব্যথা লাঘব হওয়ার কথা।
এ রায়ের প্রতিক্রিয়ায় সবাই খুশি- সরকার, বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, তারুণ্য ও সাধারণ মানুষ। বিএনপি আগের মতোই এ রায়ের ক্ষেত্রে নীরব, প্রতিক্রিয়াহীন। তারা কি জোট ও ভোটের হিসাব মেলাচ্ছে? তবে স্বাধীনতার ঘোষকের প্রতিষ্ঠিত দলটির অন্তত এ বিষয়ে সুস্পষ্ট অবস্থান নেওয়া উচিত, একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধ বলে কথা আর জনমত যেখানে বিচারের পক্ষে, রায়ের পক্ষে।
তবে এ উপলক্ষেও যথারীতি জামায়াতের হরতাল ঘোষণা- পবিত্র রমজান মাসে যে হরতাল নিয়ে সাধারণ মানুষের মুখেও সমালোচনা প্রকাশ পাচ্ছে। রোজায় দিনমজুর, ছোট দোকানদারদের কথা ভাবেনি জামায়াত। তাদের রাজনৈতিক সহিংসতা বন্ধ হওয়ার নয়। যা-ই হোক, পূর্বোক্ত রায়ের পর্যবেক্ষণ বিবেচনায় এখন অনেকের দাবি, জামায়াত নিষিদ্ধ করা হোক। এখনই সময়। অন্যদের চিন্তা, তাদের রাজনৈতিকভাবে মোকাবিলা ও সামাজিকভাবে সব কিছুতে বয়কট করা হোক। দ্বিতীয় ব্যবস্থাটি নখদন্তহীন হলেও এর কার্যকারিতা কম হবে না বলে তাঁরা মনে করেন।
সবশেষে এসব বিচার ও রায়ের পরিপ্রেক্ষিতে যে দাবি বড় হয়ে উঠছে তা হলো, নিয়মনীতি মাফিক রায় দ্রুত কার্যকর করা, বিশেষত সর্বোচ্চ শাস্তির ক্ষেত্রে। কারণ তা না হলে কোনো কারণে রাজনৈতিক পটপরিবর্তন ঘটলে বিচারের যা কিছু অর্জন, সব ব্যর্থ হয়ে যেতে পারে। জাতির জন্য তা হবে দুঃখজনক। তাই কারো কারো পরামর্শ, এমন আইনের বিধান রাখা হোক, যাতে মানবতাবিরোধী অপরাধের শাস্তির বিষয়টি সর্বোচ্চ ক্ষেত্রেও ক্ষমার অযোগ্য বিবেচিত হয়। জানি না, এ পরামর্শ সরকার আমলে নেবে কি না।
লেখক : কবি, গবেষক ও ভাষাসংগ্রামী
No comments