সময়চিত্র কোটা এবং মুক্তিযুদ্ধের চেতনা by আসিফ নজরুল
কোটা নিয়ে প্রথম আলোয় আমি লিখি ২০১০ সালে।
লেখার শিরোনাম ছিল কোটা (৫৫) বনাম মেধা (৪৫)। এই লেখার আগে আমার শ্রদ্ধেয়
একজন আইনজীবীর সঙ্গে এ বিষয়ে ছোটখাটো একটা মতৈক্য হয়।
কোটা নিয়ে আমি লিখব, এরপর বিদ্যমান কোটাব্যবস্থার কিছু অংশ
সংবিধানবিরোধী—এই যুক্তিতে তিনি তা বাতিলের জন্য হাইকোর্টে মামলা করবেন,
মোটামুটি এই স্থির করি আমরা।
আমার লেখা ছাপা হলো, প্রথম আলোর অনলাইনে বিপুলসংখ্যক পাঠকের সমর্থনও পাওয়া গেল। কিন্তু এরপর আর আমার শ্রদ্ধেয় আইনজীবী মামলা করতে রাজি না। তিনি সমাজে খুবই প্রগতিশীল হিসেবে পরিচিত। তার পরও মুক্তিযোদ্ধা কোটা সংবিধানবিরোধী, এটি বললে তাঁকে জামায়াত-শিবির ভাবা হতে পারে, এই ভয় গ্রাস করে তাঁকে। তখন ততটা বুঝিনি। এখন মনে হচ্ছে, তাঁর ভয় ভুল ছিল না। কোটা বাতিলের সাম্প্রতিক আন্দোলনকারীদের আসলেও ব্র্যান্ডিং করা হচ্ছে জামায়াত-শিবির হিসেবে।
কোটার বিরুদ্ধে আন্দোলন তাই বলে অযৌক্তিক হয়ে যায়নি। কোটাধারীদের সুবিধার জন্য এবার চরম বৈষম্যমূলকভাবে দেশের মেধাবী ছাত্রছাত্রীদের বিসিএস প্রিলিমিনারি পরীক্ষাতেই গণহারে বাতিল করা হয়েছে। এর বিরুদ্ধে সংগত কারণে ফুঁসে উঠেছে সাধারণ ছাত্ররা। শাহবাগে তাদের জমায়েত দেশের বহু মানুষের সহানুভূতি অর্জন করেছে। এই আন্দোলন স্বতঃস্ফূর্তভাবে চলতে থাকলে সারা দেশে তা ছড়িয়ে পড়ত, পড়তে শুরুও করেছিল। সিটি করপোরেশনগুলোতে শোচনীয় পরাজয়ের পর সরকারের জন্য তাতে নতুন বিব্রতকর পরিস্থিতির সৃষ্টি হতে পারত। আন্দোলনের দ্বিতীয় দিনেই পুলিশ আর ছাত্রলীগ একসঙ্গে লাঠিপেটা করে আন্দোলনকারীদের শায়েস্তা করেছে। আগের রাতে হলে হলে গিয়ে সাধারণ ছাত্রদের আন্দোলনে অংশ নিলে পিটিয়ে হলছাড়া করার হুমকি দেওয়া হয়েছে। সরকারের দমননীতির অনিবার্য হাতিয়ার হিসেবে অবশেষে এই আন্দোলনের নেতৃত্বস্থানীয় ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে মামলাও হয়েছে, গ্রেপ্তার হয়েছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন মেধাবী ছাত্র।
সরকারের দমননীতি ও কোটাকেন্দ্রিক বৈষম্যকে যৌক্তিকতা প্রদানের জন্য কোটা বাতিলের আন্দোলনকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরোধী বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে। ইতিপূর্বে শেয়ারবাজারের লুটপাট, পদ্মা সেতুর দুর্নীতি কিংবা ভারতের প্রতি নতজানুমূলক আচরণসহ সরকারের বিভিন্ন অনাচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদকারীদেরও একইভাবে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরোধী হিসেবে ব্র্যান্ডিং করার অপচেষ্টা হয়েছে।
মুক্তিযুদ্ধের চেতনার এমন সুবিধাবাদী ব্যাখ্যা বহু বছর ধরে চলছে সমাজে। অথচ নির্মোহ বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে, দুর্নীতি ও অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদই বরং মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত চেতনা। ঢালাও কোটার নামে অনাচারের বিরুদ্ধে দাঁড়ানো একইভাবে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার সঙ্গে সম্পূর্ণ সংগতিপূর্ণ।
দুই
আমাদের মুক্তিযুদ্ধের প্রধান চেতনা ছিল পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর বৈষম্য ও অবিচার মেনে না নেওয়া। ভাষা ও সংস্কৃতি নিয়ে বৈষম্যের অনেকটা ফয়সালা আমরা অর্জন করতে পেরেছিলাম পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পাঁচ বছরের মধ্যে। কিন্তু অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক বৈষম্য এর পরও বেড়েছে দিন দিন। এই বৈষম্যের সবচেয়ে উৎকট প্রকাশ ঘটত উন্নয়ন বাজেট ও সরকারি চাকরিতে তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তানিদের প্রায় একচ্ছত্র আধিপত্যে। বাঙালিদের মেধা থাকা সত্ত্বেও সরকারি চাকরিতে অধিকাংশ নিয়োগ দেওয়া হতো পশ্চিম পাকিস্তান থেকে। ছয় দফার আন্দোলন থেকে শুরু করে স্বাধীনতা আন্দোলনের প্রতিটি স্তরে এসব তথ্য-উপাত্ত তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের মানুষের ক্ষোভকে সংগঠিত করতে বিরাট ভূমিকা রেখেছে।
বঙ্গবন্ধু সরকারের আমলে প্রণীত স্বাধীন বাংলাদেশের সংবিধানে আমরা তাই বৈষম্যের বিরুদ্ধে দৃঢ় অবস্থান লক্ষ করি। ১৯৭২ সালের সংবিধানে অন্তত ছয়টি বিধানে সমতা ও বৈষম্যহীনতা প্রতিষ্ঠা করার কথা বলা আছে। সংবিধানের ১৯ অনুচ্ছেদে সকল নাগরিকের জন্য সুযোগের সমতা, ২৮ অনুচ্ছেদে বৈষম্যহীনতা এবং ২৯ অনুচ্ছেদে সরকারি চাকরিতে সব নাগরিকের সুযোগের সমতার কথা বলা আছে। অবশ্য ২৮ অনুচ্ছেদে নারী, শিশু ও ‘নাগরিকদের যেকোনো অনগ্রসর অংশের অগ্রগতির’ জন্য এবং ২৯ অনুচ্ছেদে সরকারি চাকরিতে ‘নাগরিকদের যেকোনো অনগ্রসর’ অংশের উপযুক্ত প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করার জন্য বিশেষ বিধান প্রণয়ন করার কথা বলা হয়েছে।
১৯৭২ সালের সংবিধান বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের চেতনার সবচেয়ে অকাট্য দলিল। এই দলিল অনুসারে নারী কিংবা সমাজের অনগ্রসর শ্রেণী হিসেবে ‘উপজাতিদের’ জন্য একটি নির্দিষ্ট মাত্রায় কোটা থাকতে পারে। কিন্তু সেটি তত দিনই থাকা সংগত, যত দিন সরকারি চাকরিতে তাঁদের ‘উপযুক্ত প্রতিনিধিত্ব’ নিশ্চিত না হয়। আবার সংবিধানের ২৯(৩) অনুচ্ছেদ নাগরিকদের ‘অনগ্রসর অংশের’ জন্য চাকরিতে বিশেষ কোটা প্রদান অনুমোদন করেছে, ‘অনগ্রসর অঞ্চলের’ জন্য নয়। ফলে জেলা কোটার সাংবিধানিক ভিত্তি সন্দেহজনক।
১৯৭২ সালের সংবিধানে মুক্তিযোদ্ধাদের কোটা সম্পর্কে সরাসরি বা পরোক্ষভাবে কিছু বলা নেই। ১৯৭২ সালের সংবিধান প্রণীত হয়েছিল যে গণপরিষদে, তার বিতর্কের দলিল অনুসারে ২৮ বা ২৯ অনুচ্ছেদ প্রণয়নের আলোচনকালে মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য কোনো বিশেষ সুবিধা (যেমন কোটা) প্রদানের কথা উত্থাপিত হয়নি। কেবল সংবিধানের ১৫ অনুচ্ছেদের অধীনে নাগরিকদের সামাজিক নিরাপত্তা প্রদান প্রসঙ্গে পঙ্গু মুক্তিযোদ্ধা ও নিহত মুক্তিযোদ্ধা পরিবারের কথা বিশেষভাবে উল্লেখ করা হয় (বাংলাদেশ গণপরিষদের বিতর্ক, সরকারি বিবরণী, দ্বিতীয় খণ্ড, ১৯৭২, পৃষ্ঠা ৪৭০-১)। সামাজিক নিরাপত্তার উদার ব্যাখ্যা করলে পঙ্গু বা নিহত মুক্তিযোদ্ধার পরিবারের জন্য চাকরিতে কোটা সংরক্ষণ বৈধ হতে পারে। কিন্তু ঢালাওভাবে মুক্তিযোদ্ধারা ‘অনগ্রসর শ্রেণী’ বলে বিবেচিত হতে পারেন না বলে তাঁদের জন্য ঢালাও কোটা সংরক্ষণ ১৯৭২ সালের সংবিধানের প্রত্যাশা হতে পারে না। ঢালাও কোটার বিরুদ্ধে আন্দোলন তাই কোনোভাবেই মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বিরোধী হতে পারে না।
বঙ্গবন্ধুর সময়ে সরকারি চাকরিতে মুক্তিযোদ্ধা কোটা প্রবর্তনের সময় মুক্তিযুদ্ধের চেতনার সঙ্গে একে সম্পর্কিত করা হয়নি। সে সময়ে ১৯৭২ সালে প্রণীত ইন্টেরিম (বা অন্তর্বর্তীকালীন) রিক্রুটমেন্ট পলিসিতে মুক্তিযোদ্ধাদের ৩০ শতাংশ কোটার কথা বলা হয়। এটি ইন্টেরিম বলার মানেই হচ্ছে কোটা স্বল্প সময়ের জন্য প্রযোজ্য রাখার চিন্তা ছিল তখন। ১৯৭৩ সালে পাবলিক সার্ভিস কমিশনের মাধ্যমে মেধার ভিত্তিতে ৩৫০টি পদে মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়োগের পর এই সুযোগ আর সম্প্রসারণের কোনো যুক্তি ছিল না। ১৯৭৭ সালে তৎকালীন পে ও সার্ভিস কমিশনের একজন বাদে বাকি সব সদস্য তাই সরকারি নিয়োগে কোটাব্যবস্থার বিরোধিতা করেন। কমিশনের সদস্যদের মধ্যে মাত্র একজন প্রচলিত কোটাসমূহ বহাল রেখে ১৯৮৭ থেকে পরবর্তী ১০ বছরে ধীরে ধীরে কমিয়ে তা বিলুপ্ত করার পক্ষে মত দেন। অথচ ১৯৯৭ সালেই এই কোটাব্যবস্থার আরও সম্প্রসারণ করে মুক্তিযোদ্ধার সন্তানদের এর আওতাভুক্ত করা হয়, পরে তাঁদের পাওয়া না গেলে তাঁদের জন্য নির্ধারিত পদগুলো শূন্য রাখার নীতি গৃহীত হয়। সর্বশেষে পিএসসির তুঘলকি সিদ্ধান্তের মাধ্যমে লিখিত ও মৌখিক পরীক্ষায় মেধার ভিত্তিতে প্রতিযোগিতার সুযোগ ব্যাপকভাবে সংকুচিত করা হয় কোটাধারীদের স্বার্থে।
তিন
বর্তমানে বাংলাদেশে বেসামরিক সরকারি চাকরিতে (সামরিক চাকরিতে কোনো কোটা নেই) নিয়োগের ক্ষেত্রে শতকরা ৫৫ ভাগ কোটা প্রধানত চার ধরনের সুবিধাভোগীদের জন্য সংরক্ষিত। প্রথমে এই ৫৫ ভাগকে জেলা/বিভাগ অনুযায়ী বণ্টন করা হয়। জেলা/বিভাগওয়ারি বণ্টন শেষে সংশ্লিষ্ট জেলার অধীনে মুক্তিযোদ্ধা সন্তান কোটায় ৩০ ভাগ, শুধু জেলা কোটায় ১০ ভাগ, নারী কোটায় ১০ ভাগ এবং উপজাতি কোটায় ৫ ভাগ লোক নিয়োগ করা হয়। কোটার জন্য বিবেচিত ব্যক্তিরা আবার মেধার ৪৫ জনের ক্ষেত্রেও বিবেচিত হবেন।
বিশিষ্ট মুক্তিযোদ্ধা ড. আকবর আলি খান রেগুলেটরি কমিশনের প্রধান হিসেবে ২০০৮ সালের মার্চ মাসে কোটাব্যবস্থা নিয়ে একটি গবেষণাকর্ম সম্পাদন করেছেন। এই গবেষণার সিদ্ধান্তে বলা হয়েছে, মেধার ভিত্তিতে মাত্র শতকরা ৪৫ জনকে নিয়োগ সংবিধানসম্মত নয়। সংবিধান বৈষম্যহীনতার কথা বলেছে এবং ক্ষেত্রবিশেষে ব্যতিক্রম হিসেবে (যেমন সমাজের অনগ্রসর শ্রেণীর জন্য) কোটাকে অনুমোদন করেছে। ব্যতিক্রমী নিয়োগ (শতকরা ৫৫ ভাগ) কখনো সাধারণ নিয়োগের (শতকরা ৪৫ লাভ) চেয়ে বেশি হতে পারে না।
আকবর আলি খানের গবেষণা অনুসারে, মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য কোটার কোনো আইনগত ভিত্তি নেই। এই কোটা কেবল তখনই যৌক্তিক হবে, যদি প্রমাণ করা যায় যে মুক্তিযোদ্ধারা নাগরিকদের মধ্যে অনগ্রসর অংশ। মুক্তিযোদ্ধাদের সন্তানদের জন্য এই কোটার ভিত্তি আইনগতভাবে আরও দুর্বল।
চার
মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য কোটা বর্তমানে একটি দুর্নীতিবান্ধব প্রক্রিয়ায়ও পরিণত হয়েছে। এই কোটার সুযোগে দিনে দিনে মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা বেড়েছে, তাঁদের একটি অংশ যে ভুয়া, তা নিয়ে সন্দেহ করার কারণ রয়েছে। ২০১১ সালে নিউ এজ-এ মহীউদ্দীন আলমগীরের একটি রিপোর্টে জানা যায়, ১৯৮৬ সালে মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্টের তালিকা অনুসারে মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা ছিল ৬৯ হাজার ৮৩৩ জন, একই বছরে আরেকটি তালিকায় এক লাখ দুই হাজার ৪৫৮ জন মুক্তিযোদ্ধার কথা বলা হয়। পরে শেখ হাসিনার সরকারের আমলে একটি তালিকায় দুই লাখ দুই হাজার ৩০০ জন মুক্তিযোদ্ধার নাম প্রকাশিত হয়। তাঁদের মধ্যে ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা রয়েছেন এই মর্মে আপত্তি দাখিল হয় ৬২ হাজারটি। এসব আপত্তি নিষ্পত্তি হয়েছে কি না বা পরবর্তী সময়ে আরও যাঁদের মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে সার্টিফিকেট দেওয়া হয়েছে, তাঁরা আদৌ মুক্তিযোদ্ধা কি না, এই সংশয় কখনো দূর হয়নি। বাংলাদেশে বিভিন্ন সেক্টরে দুর্নীতি আর দলীয়করণের মহোৎসবের মধ্যে মুক্তিযোদ্ধা কোটা নিষ্কলুষ রয়েছে—এটি ভাবারও কোনো কারণ নেই।
ন্যায়পরায়ণতা ও বাস্তবতার স্বার্থে তাই কোটাব্যবস্থার সংস্কার জরুরি। বিদ্যমান কোটাব্যবস্থায় শুধু যে বেসামরিক প্রশাসনের মান খর্ব হচ্ছে, তা-ই নয়। এতে সমাজে চরম বৈষম্য ও অবিচার সৃষ্টি হচ্ছে, যা মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরোধী। এটি পরিবর্তন করে, যুদ্ধাহত ও নিহত মুক্তিযোদ্ধাদের সঠিকভাবে চিহ্নিত করে শুধু তাঁদের সন্তানদের জন্য সমানুপাতিক কোটা রাখলে তা যৌক্তিক ও গ্রহণযোগ্য হবে। জেলা কোটা বাতিল করে নারী, ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠী ও প্রতিবন্ধীদের জন্য সীমিত কোটার ব্যবস্থাও সরকার করতে পারে। তবে কোনো বিচারেই কোটাধারীদের সংখ্যা মোট নিয়োগের এক-তৃতীয়াংশের বেশি হওয়া উচিত হবে না।
আসিফ নজরুল: অধ্যাপক, আইন বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
আমার লেখা ছাপা হলো, প্রথম আলোর অনলাইনে বিপুলসংখ্যক পাঠকের সমর্থনও পাওয়া গেল। কিন্তু এরপর আর আমার শ্রদ্ধেয় আইনজীবী মামলা করতে রাজি না। তিনি সমাজে খুবই প্রগতিশীল হিসেবে পরিচিত। তার পরও মুক্তিযোদ্ধা কোটা সংবিধানবিরোধী, এটি বললে তাঁকে জামায়াত-শিবির ভাবা হতে পারে, এই ভয় গ্রাস করে তাঁকে। তখন ততটা বুঝিনি। এখন মনে হচ্ছে, তাঁর ভয় ভুল ছিল না। কোটা বাতিলের সাম্প্রতিক আন্দোলনকারীদের আসলেও ব্র্যান্ডিং করা হচ্ছে জামায়াত-শিবির হিসেবে।
কোটার বিরুদ্ধে আন্দোলন তাই বলে অযৌক্তিক হয়ে যায়নি। কোটাধারীদের সুবিধার জন্য এবার চরম বৈষম্যমূলকভাবে দেশের মেধাবী ছাত্রছাত্রীদের বিসিএস প্রিলিমিনারি পরীক্ষাতেই গণহারে বাতিল করা হয়েছে। এর বিরুদ্ধে সংগত কারণে ফুঁসে উঠেছে সাধারণ ছাত্ররা। শাহবাগে তাদের জমায়েত দেশের বহু মানুষের সহানুভূতি অর্জন করেছে। এই আন্দোলন স্বতঃস্ফূর্তভাবে চলতে থাকলে সারা দেশে তা ছড়িয়ে পড়ত, পড়তে শুরুও করেছিল। সিটি করপোরেশনগুলোতে শোচনীয় পরাজয়ের পর সরকারের জন্য তাতে নতুন বিব্রতকর পরিস্থিতির সৃষ্টি হতে পারত। আন্দোলনের দ্বিতীয় দিনেই পুলিশ আর ছাত্রলীগ একসঙ্গে লাঠিপেটা করে আন্দোলনকারীদের শায়েস্তা করেছে। আগের রাতে হলে হলে গিয়ে সাধারণ ছাত্রদের আন্দোলনে অংশ নিলে পিটিয়ে হলছাড়া করার হুমকি দেওয়া হয়েছে। সরকারের দমননীতির অনিবার্য হাতিয়ার হিসেবে অবশেষে এই আন্দোলনের নেতৃত্বস্থানীয় ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে মামলাও হয়েছে, গ্রেপ্তার হয়েছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন মেধাবী ছাত্র।
সরকারের দমননীতি ও কোটাকেন্দ্রিক বৈষম্যকে যৌক্তিকতা প্রদানের জন্য কোটা বাতিলের আন্দোলনকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরোধী বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে। ইতিপূর্বে শেয়ারবাজারের লুটপাট, পদ্মা সেতুর দুর্নীতি কিংবা ভারতের প্রতি নতজানুমূলক আচরণসহ সরকারের বিভিন্ন অনাচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদকারীদেরও একইভাবে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরোধী হিসেবে ব্র্যান্ডিং করার অপচেষ্টা হয়েছে।
মুক্তিযুদ্ধের চেতনার এমন সুবিধাবাদী ব্যাখ্যা বহু বছর ধরে চলছে সমাজে। অথচ নির্মোহ বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে, দুর্নীতি ও অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদই বরং মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত চেতনা। ঢালাও কোটার নামে অনাচারের বিরুদ্ধে দাঁড়ানো একইভাবে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার সঙ্গে সম্পূর্ণ সংগতিপূর্ণ।
দুই
আমাদের মুক্তিযুদ্ধের প্রধান চেতনা ছিল পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর বৈষম্য ও অবিচার মেনে না নেওয়া। ভাষা ও সংস্কৃতি নিয়ে বৈষম্যের অনেকটা ফয়সালা আমরা অর্জন করতে পেরেছিলাম পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পাঁচ বছরের মধ্যে। কিন্তু অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক বৈষম্য এর পরও বেড়েছে দিন দিন। এই বৈষম্যের সবচেয়ে উৎকট প্রকাশ ঘটত উন্নয়ন বাজেট ও সরকারি চাকরিতে তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তানিদের প্রায় একচ্ছত্র আধিপত্যে। বাঙালিদের মেধা থাকা সত্ত্বেও সরকারি চাকরিতে অধিকাংশ নিয়োগ দেওয়া হতো পশ্চিম পাকিস্তান থেকে। ছয় দফার আন্দোলন থেকে শুরু করে স্বাধীনতা আন্দোলনের প্রতিটি স্তরে এসব তথ্য-উপাত্ত তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের মানুষের ক্ষোভকে সংগঠিত করতে বিরাট ভূমিকা রেখেছে।
বঙ্গবন্ধু সরকারের আমলে প্রণীত স্বাধীন বাংলাদেশের সংবিধানে আমরা তাই বৈষম্যের বিরুদ্ধে দৃঢ় অবস্থান লক্ষ করি। ১৯৭২ সালের সংবিধানে অন্তত ছয়টি বিধানে সমতা ও বৈষম্যহীনতা প্রতিষ্ঠা করার কথা বলা আছে। সংবিধানের ১৯ অনুচ্ছেদে সকল নাগরিকের জন্য সুযোগের সমতা, ২৮ অনুচ্ছেদে বৈষম্যহীনতা এবং ২৯ অনুচ্ছেদে সরকারি চাকরিতে সব নাগরিকের সুযোগের সমতার কথা বলা আছে। অবশ্য ২৮ অনুচ্ছেদে নারী, শিশু ও ‘নাগরিকদের যেকোনো অনগ্রসর অংশের অগ্রগতির’ জন্য এবং ২৯ অনুচ্ছেদে সরকারি চাকরিতে ‘নাগরিকদের যেকোনো অনগ্রসর’ অংশের উপযুক্ত প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করার জন্য বিশেষ বিধান প্রণয়ন করার কথা বলা হয়েছে।
১৯৭২ সালের সংবিধান বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের চেতনার সবচেয়ে অকাট্য দলিল। এই দলিল অনুসারে নারী কিংবা সমাজের অনগ্রসর শ্রেণী হিসেবে ‘উপজাতিদের’ জন্য একটি নির্দিষ্ট মাত্রায় কোটা থাকতে পারে। কিন্তু সেটি তত দিনই থাকা সংগত, যত দিন সরকারি চাকরিতে তাঁদের ‘উপযুক্ত প্রতিনিধিত্ব’ নিশ্চিত না হয়। আবার সংবিধানের ২৯(৩) অনুচ্ছেদ নাগরিকদের ‘অনগ্রসর অংশের’ জন্য চাকরিতে বিশেষ কোটা প্রদান অনুমোদন করেছে, ‘অনগ্রসর অঞ্চলের’ জন্য নয়। ফলে জেলা কোটার সাংবিধানিক ভিত্তি সন্দেহজনক।
১৯৭২ সালের সংবিধানে মুক্তিযোদ্ধাদের কোটা সম্পর্কে সরাসরি বা পরোক্ষভাবে কিছু বলা নেই। ১৯৭২ সালের সংবিধান প্রণীত হয়েছিল যে গণপরিষদে, তার বিতর্কের দলিল অনুসারে ২৮ বা ২৯ অনুচ্ছেদ প্রণয়নের আলোচনকালে মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য কোনো বিশেষ সুবিধা (যেমন কোটা) প্রদানের কথা উত্থাপিত হয়নি। কেবল সংবিধানের ১৫ অনুচ্ছেদের অধীনে নাগরিকদের সামাজিক নিরাপত্তা প্রদান প্রসঙ্গে পঙ্গু মুক্তিযোদ্ধা ও নিহত মুক্তিযোদ্ধা পরিবারের কথা বিশেষভাবে উল্লেখ করা হয় (বাংলাদেশ গণপরিষদের বিতর্ক, সরকারি বিবরণী, দ্বিতীয় খণ্ড, ১৯৭২, পৃষ্ঠা ৪৭০-১)। সামাজিক নিরাপত্তার উদার ব্যাখ্যা করলে পঙ্গু বা নিহত মুক্তিযোদ্ধার পরিবারের জন্য চাকরিতে কোটা সংরক্ষণ বৈধ হতে পারে। কিন্তু ঢালাওভাবে মুক্তিযোদ্ধারা ‘অনগ্রসর শ্রেণী’ বলে বিবেচিত হতে পারেন না বলে তাঁদের জন্য ঢালাও কোটা সংরক্ষণ ১৯৭২ সালের সংবিধানের প্রত্যাশা হতে পারে না। ঢালাও কোটার বিরুদ্ধে আন্দোলন তাই কোনোভাবেই মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বিরোধী হতে পারে না।
বঙ্গবন্ধুর সময়ে সরকারি চাকরিতে মুক্তিযোদ্ধা কোটা প্রবর্তনের সময় মুক্তিযুদ্ধের চেতনার সঙ্গে একে সম্পর্কিত করা হয়নি। সে সময়ে ১৯৭২ সালে প্রণীত ইন্টেরিম (বা অন্তর্বর্তীকালীন) রিক্রুটমেন্ট পলিসিতে মুক্তিযোদ্ধাদের ৩০ শতাংশ কোটার কথা বলা হয়। এটি ইন্টেরিম বলার মানেই হচ্ছে কোটা স্বল্প সময়ের জন্য প্রযোজ্য রাখার চিন্তা ছিল তখন। ১৯৭৩ সালে পাবলিক সার্ভিস কমিশনের মাধ্যমে মেধার ভিত্তিতে ৩৫০টি পদে মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়োগের পর এই সুযোগ আর সম্প্রসারণের কোনো যুক্তি ছিল না। ১৯৭৭ সালে তৎকালীন পে ও সার্ভিস কমিশনের একজন বাদে বাকি সব সদস্য তাই সরকারি নিয়োগে কোটাব্যবস্থার বিরোধিতা করেন। কমিশনের সদস্যদের মধ্যে মাত্র একজন প্রচলিত কোটাসমূহ বহাল রেখে ১৯৮৭ থেকে পরবর্তী ১০ বছরে ধীরে ধীরে কমিয়ে তা বিলুপ্ত করার পক্ষে মত দেন। অথচ ১৯৯৭ সালেই এই কোটাব্যবস্থার আরও সম্প্রসারণ করে মুক্তিযোদ্ধার সন্তানদের এর আওতাভুক্ত করা হয়, পরে তাঁদের পাওয়া না গেলে তাঁদের জন্য নির্ধারিত পদগুলো শূন্য রাখার নীতি গৃহীত হয়। সর্বশেষে পিএসসির তুঘলকি সিদ্ধান্তের মাধ্যমে লিখিত ও মৌখিক পরীক্ষায় মেধার ভিত্তিতে প্রতিযোগিতার সুযোগ ব্যাপকভাবে সংকুচিত করা হয় কোটাধারীদের স্বার্থে।
তিন
বর্তমানে বাংলাদেশে বেসামরিক সরকারি চাকরিতে (সামরিক চাকরিতে কোনো কোটা নেই) নিয়োগের ক্ষেত্রে শতকরা ৫৫ ভাগ কোটা প্রধানত চার ধরনের সুবিধাভোগীদের জন্য সংরক্ষিত। প্রথমে এই ৫৫ ভাগকে জেলা/বিভাগ অনুযায়ী বণ্টন করা হয়। জেলা/বিভাগওয়ারি বণ্টন শেষে সংশ্লিষ্ট জেলার অধীনে মুক্তিযোদ্ধা সন্তান কোটায় ৩০ ভাগ, শুধু জেলা কোটায় ১০ ভাগ, নারী কোটায় ১০ ভাগ এবং উপজাতি কোটায় ৫ ভাগ লোক নিয়োগ করা হয়। কোটার জন্য বিবেচিত ব্যক্তিরা আবার মেধার ৪৫ জনের ক্ষেত্রেও বিবেচিত হবেন।
বিশিষ্ট মুক্তিযোদ্ধা ড. আকবর আলি খান রেগুলেটরি কমিশনের প্রধান হিসেবে ২০০৮ সালের মার্চ মাসে কোটাব্যবস্থা নিয়ে একটি গবেষণাকর্ম সম্পাদন করেছেন। এই গবেষণার সিদ্ধান্তে বলা হয়েছে, মেধার ভিত্তিতে মাত্র শতকরা ৪৫ জনকে নিয়োগ সংবিধানসম্মত নয়। সংবিধান বৈষম্যহীনতার কথা বলেছে এবং ক্ষেত্রবিশেষে ব্যতিক্রম হিসেবে (যেমন সমাজের অনগ্রসর শ্রেণীর জন্য) কোটাকে অনুমোদন করেছে। ব্যতিক্রমী নিয়োগ (শতকরা ৫৫ ভাগ) কখনো সাধারণ নিয়োগের (শতকরা ৪৫ লাভ) চেয়ে বেশি হতে পারে না।
আকবর আলি খানের গবেষণা অনুসারে, মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য কোটার কোনো আইনগত ভিত্তি নেই। এই কোটা কেবল তখনই যৌক্তিক হবে, যদি প্রমাণ করা যায় যে মুক্তিযোদ্ধারা নাগরিকদের মধ্যে অনগ্রসর অংশ। মুক্তিযোদ্ধাদের সন্তানদের জন্য এই কোটার ভিত্তি আইনগতভাবে আরও দুর্বল।
চার
মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য কোটা বর্তমানে একটি দুর্নীতিবান্ধব প্রক্রিয়ায়ও পরিণত হয়েছে। এই কোটার সুযোগে দিনে দিনে মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা বেড়েছে, তাঁদের একটি অংশ যে ভুয়া, তা নিয়ে সন্দেহ করার কারণ রয়েছে। ২০১১ সালে নিউ এজ-এ মহীউদ্দীন আলমগীরের একটি রিপোর্টে জানা যায়, ১৯৮৬ সালে মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্টের তালিকা অনুসারে মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা ছিল ৬৯ হাজার ৮৩৩ জন, একই বছরে আরেকটি তালিকায় এক লাখ দুই হাজার ৪৫৮ জন মুক্তিযোদ্ধার কথা বলা হয়। পরে শেখ হাসিনার সরকারের আমলে একটি তালিকায় দুই লাখ দুই হাজার ৩০০ জন মুক্তিযোদ্ধার নাম প্রকাশিত হয়। তাঁদের মধ্যে ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা রয়েছেন এই মর্মে আপত্তি দাখিল হয় ৬২ হাজারটি। এসব আপত্তি নিষ্পত্তি হয়েছে কি না বা পরবর্তী সময়ে আরও যাঁদের মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে সার্টিফিকেট দেওয়া হয়েছে, তাঁরা আদৌ মুক্তিযোদ্ধা কি না, এই সংশয় কখনো দূর হয়নি। বাংলাদেশে বিভিন্ন সেক্টরে দুর্নীতি আর দলীয়করণের মহোৎসবের মধ্যে মুক্তিযোদ্ধা কোটা নিষ্কলুষ রয়েছে—এটি ভাবারও কোনো কারণ নেই।
ন্যায়পরায়ণতা ও বাস্তবতার স্বার্থে তাই কোটাব্যবস্থার সংস্কার জরুরি। বিদ্যমান কোটাব্যবস্থায় শুধু যে বেসামরিক প্রশাসনের মান খর্ব হচ্ছে, তা-ই নয়। এতে সমাজে চরম বৈষম্য ও অবিচার সৃষ্টি হচ্ছে, যা মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরোধী। এটি পরিবর্তন করে, যুদ্ধাহত ও নিহত মুক্তিযোদ্ধাদের সঠিকভাবে চিহ্নিত করে শুধু তাঁদের সন্তানদের জন্য সমানুপাতিক কোটা রাখলে তা যৌক্তিক ও গ্রহণযোগ্য হবে। জেলা কোটা বাতিল করে নারী, ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠী ও প্রতিবন্ধীদের জন্য সীমিত কোটার ব্যবস্থাও সরকার করতে পারে। তবে কোনো বিচারেই কোটাধারীদের সংখ্যা মোট নিয়োগের এক-তৃতীয়াংশের বেশি হওয়া উচিত হবে না।
আসিফ নজরুল: অধ্যাপক, আইন বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
No comments