বিআরটিসি বাসে দুর্নীতি শর্ষের ভূত তাড়াতেই হবে
সরকারি বাস সার্ভিস বিআরটিসিকে এমন ভূতেই
পেয়েছে যে, এই ভূত তাড়ানো যেন প্রায় অসম্ভব! স্বাধীনতা-পূর্ববর্তী এবং
পরবর্তীকালেও বিআরটিসি বাসে চালক-কন্ডাক্টরের যোগসাজশে দুর্নীতি হতো,
সরকারি বেতনে চাকরি করে তারা সরকারি পরিবহনে যে ভাড়া উঠত, দৈনিক তার
এক-চতুর্থাংশও বিআরটিসির তহবিলে জমা দিত না। ফলে যোগাযোগ মন্ত্রণালয় একসময়
প্রায় নিরুপায় হয়েই বিআরটিসির বাসচালকদের কাছেই দৈনিক চুক্তিভিত্তিতে ভাড়া
দিয়ে দেয়। তা-ও ছিল মন্দের ভালো। কিন্তু এখন বিআরটিসি আবার সেই পুরনো
লুটপাটের অবস্থায় ফিরে গেছে। শনিবার সমকালের প্রথম পৃষ্ঠায় প্রকাশিত
বিআরটিসি সিটি সার্ভিস নিয়ে প্রকাশিত প্রতিবেদন 'গলাকাটা ভাড়া আদায়,
সীমাহীন অনিয়ম' পড়ে যে কেউ আঁতকে উঠবেন। রীতিমতো পুকুরচুরি! জনসংখ্যার চাপে
নুয়েপড়া রাজধানীতে বর্তমান সরকার আমলে কয়েকশ' নতুন বাস সংযোজন শুধু
নগরবাসীর জন্যই আনন্দ সংবাদ ছিল না, বিআরটিসির জন্যও ছিল ঘুরে দাঁড়ানোর এক
বিপুল সম্ভাবনা; কিন্তু সেই সম্ভাবনা কাজে লাগায়নি বিআরটিসি। উল্টো
দুর্নীতির আশ্রয়ে গলাকাটা ভাড়া আদায়ের উৎস বানিয়েছে এ সুযোগ। যাত্রীরা শুধু
অতিরিক্ত ভাড়াই দিতে বাধ্য হচ্ছেন না, কাউন্টার থেকে টিকিট কেটেও তারা
বাসে উঠতে পারছেন না। প্রতিবেদক রাজধানীর বিভিন্ন রুটে ঘুরে দেখেছেন,
বিআরটিসি সিটি সার্ভিসে অনিয়মের কারণে যাত্রীদের দেওয়া ভাড়ার বড় অংশই জমা
হচ্ছে না সরকারের কোষাগারে। প্রতিদিন প্রায় ১০ লাখ টাকা যাত্রীভাড়া চলে যায়
বিআরটিসির কতিপয় অসাধু কর্মকর্তার পকেটে। দুর্নীতির হোতা সিটি সার্ভিসের
চালক ও কন্ডাক্টররা পায় এর একটি অংশ। উত্তরা-গুলিস্তান রুটের একমাত্র এসি
সার্ভিসে আদায় করা হচ্ছে গলাকাটা ভাড়া_ মাথাপিছু ৫০ টাকা। লুটপাটের উৎস
হচ্ছে কাউন্টারের বাইরে থেকে বিপুলসংখ্যক যাত্রী তোলা। কাউন্টার থেকে
যেহেতু ইলেকট্রনিক টিকিটিং সিস্টেমে যাত্রীদের ভাড়া নিতে হয়, সুতরাং টিকিট
কাটা যাত্রীদের টাকা লোপাট করা সম্ভব নয়। সে জন্য চালক ও কন্ডাক্টর,
হেলপারদের মূল লক্ষ্য থাকে কাউন্টারের বাইরে থেকে বিনা টিকিটের যাত্রী
তোলা। বিনা টিকিটের যাত্রীদের কাছ থেকেও সমপরিমাণ ভাড়া আদায় করা হয়। সবচেয়ে
বিস্ময়কর ব্যাপার হলো, বিপুলসংখ্যক যাত্রী স্টপেজে ফেলে রেখেই তারা অল্প
কিছু যাত্রী নিয়ে বিনা টিকিটের যাত্রী তোলার জন্য স্টপেজ ছেড়ে যায়। সিটিং
সার্ভিস বাস পথে পথে গাড়ি দাঁড় করিয়ে লোকাল বাসের চেয়েও বিড়ম্বনাপূর্ণ
পরিস্থিতিতে ফেলে যাত্রীদের। শুধু তা-ই নয়, বর্তমানে রাজধানী ও এর আশপাশে
চলমান ৩৫২টি বিআরটিসি বাস ব্যক্তিমালিকানাধীন বাসের চেয়ে অধিক যাত্রী বহন
করেও ভাড়া আদায় দেখাচ্ছে বাসপ্রতি দৈনিক গড়ে পাঁচ থেকে সাত হাজার টাকা। ৩৫২
বাসে আয় দৈনিক ২০ লাখ টাকার ওপরে যায় না। অথচ প্রতি বাসে যে যাত্রী তোলা
হয়, তাতে বেসরকারি বাসের সঙ্গে তুলনা করলে বিআরটিসির বাসপ্রতি দৈনিক গড়ে ১৫
থেকে ২০ হাজার টাকা আয় হওয়ার কথা। গড়ে ১০ হাজার দেখালেও ৩৫ লাখ টাকা হবে
দৈনিক আয়। কিন্তু পরিদর্শকসহ বিআরটিসির সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা মোট আয়ের
সিংহভাগই লোপাট করে দিচ্ছে। একটি অর্থনৈতিক সমীক্ষা অনুযায়ী, শুধু ঢাকা
সিটিতে ৩৫২টি বাস থেকে কমপক্ষে আড়াইশ' কোটি টাকা আয় করা সম্ভব। অথচ গত বছর
বিআরটিসির ৯৭০টি বাস থেকে আয় দেখানো হয়েছে মাত্র ২২০ কোটি টাকা। এর মধ্যে
পরিচালনা ব্যয় ২০৩ কোটি টাকা। এই লুটপাট বন্ধ করতে হলে পরিচালনার নামে টাকা
লোপাট না করে বাসগুলো অনতিবিলম্বে দৈনিক চুক্তিতে ভাড়া দেওয়া উচিত। তা হলে
অন্তত বর্তমান আয়ের দ্বিগুণ অর্জন সম্ভব। একই সঙ্গে জরুরি ভিত্তিতে
দুর্নীতি তদন্তে উচ্চ পর্যায়ের কার্যকর তদন্ত কমিটি গঠন করে অবিলম্বে
শর্ষের ভূত তাড়ানোর পদক্ষেপ নিতে হবে।
No comments