ওস্তাদের মার শেষ রাতে by সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিম বীরপ্রতীক
কয়েক
দিন আগে অনুষ্ঠিত গাজীপুর সিটি কর্পোরেশন নির্বাচন নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা
চলছে। এর চার সপ্তাহ আগে দেশের চারটি সিটি কর্পোরেশন নির্বাচন অনুষ্ঠিত
হয়। গাজীপুরসহ পাঁচটি সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে সরকারদলীয় বা সরকার
সমর্থিত প্রার্থীরা কেউই নির্বাচনে জয়লাভ করতে পারেননি। কেন এই বিপর্যয়?
আওয়ামী ঘরানার ব্যক্তিবর্গ ও বুদ্ধিজীবীরা পত্রিকার কলামে, টেলিভিশনের
টকশোগুলোতে আওয়ামী লীগ সমর্থিত প্রার্থীর বিশাল পরাজয়ের বিভিন্ন কারণ
বিশ্লেষণ করেছেন। কিন্তু তারা একটি বিষয় এড়িয়ে গেছেন, যেটি পত্রিকার কলামেও
আসেনি এবং টকশোগুলোতেও কেউ বলেননি। সেটি হচ্ছে- বর্তমান সরকারের প্রতি
মানুষের আস্থা হারিয়ে গেছে। জনগণ এ সরকার থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে। আওয়ামী
লীগের বিশাল পরাজয়ই তা প্রমাণ করে। এ কথাগুলো বলার পেছনে কারণ হল- চারটি
সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে ভরাডুবির পর সরকারের সামনে গাজীপুর সিটি
কর্পোরেশন নির্বাচন একটি চ্যালেঞ্জ ছিল। এ নির্বাচনে জয়লাভের মাধ্যমে
সরকার তার জনপ্রিয়তার বিষয়টি প্রমাণ করতে চেয়েছিল। কারণ গোপালগঞ্জের পরেই
গাজীপুরকে দ্বিতীয় আওয়ামী ঘাঁটি মনে করা হতো। আর এ কারণে গাজীপুর সিটি
কর্পোরেশন নির্বাচনে সরকারি দল সর্বশক্তি নিয়োগ করে। বর্তমান সরকারের সংসদ
সদস্যরা সপরিবারে নির্বাচনী এলাকায় দলীয় প্রার্থীর পক্ষে জনসমর্থন
জুগিয়েছেন। ঢাকা থেকে উচ্চপদস্থ নেতাকর্মীরাও সেখানে গিয়ে অনেক পরিশ্রম
করেছেন। বিরোধী শিবিরের নেতাকর্মীরাও জনসমর্থন জুগিয়েছেন। আমি নিজেও ১৮
দলীয় জোটের প্রার্থীর পক্ষে সশরীরে বিভিন্ন এলাকায় জনসংযোগ করেছি। ভোট
চেয়েছি। অর্থাৎ উভয় পক্ষই সর্বাত্মক শক্তি নিয়োগ করেছে। সরকার জয় চেয়েছে
তাদের জনপ্রিয়তা প্রমাণ করার জন্য। বিরোধী দলও জয় চেয়েছে তাদের জনপ্রিয়তা
প্রমাণ করার জন্য। জনগণ বিরোধী শিবিরেই তাদের রায় দিয়েছেন। সুতরাং বর্তমান
সরকারের জনপ্রিয়তা কোন অবস্থানে আছে, সেটা আর বলার অপেক্ষা রাখে না।
চার সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনের পর অনেক পত্রিকার শিরোনাম ছিল- ‘প্রার্থীর পরাজয় হয়নি, আওয়ামী লীগের পরাজয় হয়েছে’। গাজীপুরের ক্ষেত্রেও অনেককেই বলতে শুনেছি যে, আজমত উল্লাহর পরাজয় হয়নি, আওয়ামী লীগেরই পরাজয় হয়েছে। যাই হোক, গাজীপুর সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে ভোটের দিন কোনো সহিংসতা হয়নি, এ কথা সত্য। কিন্তু হতে হতে থেমে গেছে এ রকম অনেক ঘটনা রয়েছে। এ নির্বাচনে প্রায় সাড়ে সাতশ’ র্যাব সদস্য নিয়োগ করা হয়েছিল। গাজীপুর জেলার পুলিশ সদস্যদের সঙ্গে বাইরে থেকে আরও পুলিশ সদস্য এনে সংখ্যা বৃদ্ধি করা হয়েছে। গাজীপুর সিটি কর্পোরেশন এলাকাটি যদি ১৩০ বর্গকিলোমিটার হয়, তাহলে ওই সংখ্যাকে পুলিশ সদস্যদের সংখ্যা দিয়ে ভাগ করা হলে দেখা যাবে প্রতি বর্গকিলোমিটারে কতজন পুলিশ সদস্য রয়েছে। প্রশ্ন হচ্ছে- গাজীপুর সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে যে সংখ্যক আইন-শৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনী নিয়োগ করা হয়েছে, জাতীয় নির্বাচনে সে সংখ্যক আইন-শৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনী নিয়োগ করা যাবে কি-না? উত্তর হল, যাবে না।
নির্বাচন কমিশনের কাছে বিরোধী শিবির থেকে অনেক অভিযোগ এসেছে। কিন্তু এ অভিযোগের নির্ভরযোগ্য কোনো জবাব নির্বাচন কমিশন দিতে পারেনি। পাঁচটি সিটি কর্পোরেশন নির্বাচন অনুষ্ঠান করা নির্বাচন কমিশনের জন্য ছিল একটি অভিজ্ঞতা অর্জনের বিষয়। এ অভিজ্ঞতা দিয়ে জাতীয় নির্বাচনের আয়োজন করার মতো ভৌত অবকাঠামো কি নির্বাচন কমিশনের আছে? আমার মূল্যায়নে, নেই। বাংলাদেশের সব মিডিয়া গাজীপুর সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে উপস্থিত থেকে সার্বক্ষণিক তথ্য জনসমক্ষে তুলে ধরেছে। প্রশ্ন হচ্ছে, ঠিক অনুরূপভাবে এ মিডিয়াগুলো কি জাতীয় নির্বাচনে দেশের প্রতিটি নির্বাচনী এলাকায় নিবিড় পর্যবেক্ষণ করতে পারবে? পারবে না। সুতরাং জাতীয় নির্বাচন যদি দলীয় সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত হয়, তাহলে আইন-শৃংখলার বিষয়টি অবহেলিত হবে। পর্যবেক্ষণ অবহেলিত হবে। মিডিয়ার পক্ষ থেকে মনোযোগ সীমিত হয়ে যাবে। আর এ অবস্থায় ওস্তাদ তার শেষ খেলাটি খেলবেন। অর্থাৎ ওস্তাদের মার শেষ রাতে। কারণ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ফলাফলের ওপর সরকার গঠন নির্ভর করবে। জাতীয় সংসদ নির্বাচনে পড়ি কী মরি যেভাবেই হোক না কেন, ফলাফল সরকারের পক্ষে নিতে চেষ্টা করবেই। কারণ সরকারি দলের মধ্যে একটি আতংক ঢুকে গেছে। তারা মনে করছে, ‘আমরা যদি ক্ষমতাচ্যুত হই তাহলে আমাদের কৃতকর্ম ও ভুল কর্মকাণ্ডের জন্য আদালতের কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হবে। এর থেকে পরিত্রাণের একমাত্র উপায় হচ্ছে ক্ষমতায় বহাল থাকা।’ অতএব সরকার যে কোনো উপায়ে ক্ষমতায় বহাল থাকার চেষ্টা করবে। সিটি কর্পোরেশন নির্বাচন দিয়ে কোনোভাবেই সরকার গঠন করা যায় না। কিন্তু জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মধ্য দিয়ে সরকার গঠিত হয়। সুতরাং সিটি কর্পোরেশন নির্বাচন জাতীয় নির্বাচনে তেমন কোনো প্রভাব ফেলবে না। অতএব জাতীয় নির্বাচনের জন্য অবশ্যই একটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার বা তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রয়োজন। যে যত কথাই বলুন না কেন, অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিকল্প নেই।
সরকার যদি ঢাকা মহানগরীকে অনির্বাচিত ব্যক্তি দিয়ে পরিচালনা করতে পারে, অনির্বাচিত ব্যক্তি দিয়ে সরকার যদি পার্বত্য চট্টগ্রামকে চালাতে পারে, ৬৪ জেলায় প্রশাসন চালাতে পারে অনির্বাচিত ব্যক্তি দিয়ে, তাহলে সরকার তথা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী কেন বলছেন, বাংলাদেশকে এক ঘণ্টার জন্যও কোনো অনির্বাচিত ব্যক্তির হাতে দেবেন না? এটা তাহলে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর গোয়ার্তুমি। অবস্থাদৃষ্টে প্রশ্ন এসে যায়- তাহলে কি প্রধানমন্ত্রী দেশের জনগণের প্রতি প্রতিহিংসাপরায়ণ? তিনি কি কোনো কারণে প্রতিশোধ নেয়ার জন্য সংকল্পবদ্ধ? এ প্রশ্নের উত্তর আমাদের জানা নেই। তিনি যদি উদার হতেন, বাস্তবমুখী হতেন তাহলে অবশ্যই তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিষয়টি বিবেচনায় আনতেন। খোদ মহাজোটের শরিক দল জাতীয় পার্টিও তত্ত্বাবধায়ক সরকার চায়। সুতরাং তত্ত্বাবধায়ক বা অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে কোনোভাবেই বাদ দেয়া যাবে না।
১৯৮৬ সালে লালদীঘি ময়দান থেকে উচ্চারণ এসেছিল, এরশাদের পাতানো নির্বাচনে কেউ অংশগ্রহণ করবে না। কিন্তু এর ২৪ ঘণ্টা পরেই দেশের একটি বৃহৎ রাজনৈতিক দল ওয়াদার বরখেলাপ করে ওই পাতানো নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে। এতে এরশাদ উপকৃত হন। কিন্তু বিএনপি আপস করেনি। নীতিতে অটল থেকেছে। তার পুরস্কার পেয়েছে। তবে এরশাদের অনেক নীতির সঙ্গে আমি একমত। তার অনেক ভালো কর্মকাণ্ডকে সাধুবাদ জানাই। তার প্রশাসনিক অনেক প্রস্তাবের সঙ্গেও আমি একমত। এরপরও বলতে হয়, ১৯৮৬ সালের রাজনৈতিক নির্বাচনটি অনুষ্ঠান করা তার জন্য ছিল অত্যন্ত ক্রিটিক্যাল। সেই নির্বাচনটি করার ক্ষেত্রে সহযোগিতার হাত বাড়িয়েছিলেন জননেত্রী শেখ হাসিনা। আমার মনে হচ্ছে, আগামী জাতীয় নির্বাচনে এরশাদ সেই উপকারের বদলা দেবেন। রাজনৈতিক টানাপোড়েনে দেশ একটি গভীর সংকটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। গার্মেন্ট, ব্যাংক, ব্যবসা-বাণিজ্য, বিদেশে কর্মসংস্থান, নির্মাণ শিল্প, আবাসন খাত ইত্যাদি ছাড়াও আরও অনেক বিষয় সংকটের মুখে রয়েছে। এ সংকটে দেশ পিছিয়ে যাচ্ছে। অর্থনীতি মুখ থুবড়ে পড়ছে। আমাদের এই গণ্ডি থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। আর সে জন্য দরকার সুস্থ রাজনৈতিক পরিবেশ। সুস্থ রাজনৈতিক পরিবেশ যাতে বজায় থাকে সে জন্য সরকারকেও অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে হবে। যদি তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতি না আসে, তাহলে ১৮ দলীয় জোট নির্বাচনে অংশগ্রহণ করবে না। ১৮ দলীয় জোট যদি নির্বাচনে অংশগ্রহণ না করে, তাহলে বর্তমান সরকার কাদের নিয়ে নির্বাচন সম্পন্ন করবে তারও একটি খসড়া হয়তো এরই মধ্যে করে রেখেছে। সুতরাং সরকারি পৃষ্ঠপোষকতাপ্রাপ্ত দল নিয়ে সরকার সংসদে থাকবে।
দেশের বহু বুদ্ধিজীবী বিভিন্ন টকশোতে বলছেন, সরকারের একগুঁয়েমির কারণে দেশ এক অনিশ্চিত গন্তব্যের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। আমার ভয় হচ্ছে, বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনের অবস্থা মিসরের মতো না হয়ে যায়। মিসরে ক্ষমতার দ্বন্দ্বকে কেন্দ্র করে অভ্যুত্থান হয়েছে। দুটি পক্ষের মধ্যে এক পক্ষে আছে সেনাবাহিনী সমর্থিত নাস্তিকতাবাদী ও ধর্মনিরপেক্ষতাবাদীরা। অপর পক্ষে রয়েছে আস্তিকতাবাদী ও গণতন্ত্রকামীরা, যারা ভোটের মাধ্যমে নির্বাচিত হয়েছিল। প্রেসিডেন্ট মুরসি ব্যর্থ হলে এবং তিনি সুযোগ্য প্রেসিডেন্ট না হলে সেক্ষেত্রে প্রেসিডেন্ট বদলানোর প্রস্তাব দেয়া যেতে পারে। কিন্তু ভোটের রায় বাতিল করা, সংবিধানকে লংঘন করা কখনোই গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। আমি বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর একজন সাবেক সদস্য হিসেবে বলতে চাই, আমাদের সেনাবাহিনী বাংলাদেশের ৪২ বছরের ইতিহাসে যে গৌরব অর্জন করেছে, তার জন্য সশ্রদ্ধ অভিনন্দন। কিন্তু মিসরের সেনাবাহিনী এবং বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর মধ্যে আকাশ-পাতাল তফাত। বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর জন্ম মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে। তাই বাংলাদেশ সেনাবাহিনী দেশের জনগণের পালসস্বরূপ। আমাদের সেনাবাহিনী কোনো দুর্নীতিবাজ রাজনীতিকদের পৃষ্ঠপোষকতা করেনি। দেশের আপদে-বিপদে মহাদুর্যোগে এ সেনাবাহিনী জনগণের পাশে থেকেছে। সুতরাং এই সেনাবাহিনী সব বিতর্কের ঊর্ধ্বে বলে আমি মনে করি। কাজেই মিসরের মতো কোনো পরিস্থিতি আমাদের দেশে ঘটবে না এবং অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনে আমাদের সেনাবাহিনী গণতন্ত্রের পাশে থাকবে বলে আমার বিশ্বাস।
মেজর জেনারেল (অব.) সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিম বীরপ্রতীক : কলাম লেখক; সভাপতি, বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টি
চার সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনের পর অনেক পত্রিকার শিরোনাম ছিল- ‘প্রার্থীর পরাজয় হয়নি, আওয়ামী লীগের পরাজয় হয়েছে’। গাজীপুরের ক্ষেত্রেও অনেককেই বলতে শুনেছি যে, আজমত উল্লাহর পরাজয় হয়নি, আওয়ামী লীগেরই পরাজয় হয়েছে। যাই হোক, গাজীপুর সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে ভোটের দিন কোনো সহিংসতা হয়নি, এ কথা সত্য। কিন্তু হতে হতে থেমে গেছে এ রকম অনেক ঘটনা রয়েছে। এ নির্বাচনে প্রায় সাড়ে সাতশ’ র্যাব সদস্য নিয়োগ করা হয়েছিল। গাজীপুর জেলার পুলিশ সদস্যদের সঙ্গে বাইরে থেকে আরও পুলিশ সদস্য এনে সংখ্যা বৃদ্ধি করা হয়েছে। গাজীপুর সিটি কর্পোরেশন এলাকাটি যদি ১৩০ বর্গকিলোমিটার হয়, তাহলে ওই সংখ্যাকে পুলিশ সদস্যদের সংখ্যা দিয়ে ভাগ করা হলে দেখা যাবে প্রতি বর্গকিলোমিটারে কতজন পুলিশ সদস্য রয়েছে। প্রশ্ন হচ্ছে- গাজীপুর সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে যে সংখ্যক আইন-শৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনী নিয়োগ করা হয়েছে, জাতীয় নির্বাচনে সে সংখ্যক আইন-শৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনী নিয়োগ করা যাবে কি-না? উত্তর হল, যাবে না।
নির্বাচন কমিশনের কাছে বিরোধী শিবির থেকে অনেক অভিযোগ এসেছে। কিন্তু এ অভিযোগের নির্ভরযোগ্য কোনো জবাব নির্বাচন কমিশন দিতে পারেনি। পাঁচটি সিটি কর্পোরেশন নির্বাচন অনুষ্ঠান করা নির্বাচন কমিশনের জন্য ছিল একটি অভিজ্ঞতা অর্জনের বিষয়। এ অভিজ্ঞতা দিয়ে জাতীয় নির্বাচনের আয়োজন করার মতো ভৌত অবকাঠামো কি নির্বাচন কমিশনের আছে? আমার মূল্যায়নে, নেই। বাংলাদেশের সব মিডিয়া গাজীপুর সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে উপস্থিত থেকে সার্বক্ষণিক তথ্য জনসমক্ষে তুলে ধরেছে। প্রশ্ন হচ্ছে, ঠিক অনুরূপভাবে এ মিডিয়াগুলো কি জাতীয় নির্বাচনে দেশের প্রতিটি নির্বাচনী এলাকায় নিবিড় পর্যবেক্ষণ করতে পারবে? পারবে না। সুতরাং জাতীয় নির্বাচন যদি দলীয় সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত হয়, তাহলে আইন-শৃংখলার বিষয়টি অবহেলিত হবে। পর্যবেক্ষণ অবহেলিত হবে। মিডিয়ার পক্ষ থেকে মনোযোগ সীমিত হয়ে যাবে। আর এ অবস্থায় ওস্তাদ তার শেষ খেলাটি খেলবেন। অর্থাৎ ওস্তাদের মার শেষ রাতে। কারণ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ফলাফলের ওপর সরকার গঠন নির্ভর করবে। জাতীয় সংসদ নির্বাচনে পড়ি কী মরি যেভাবেই হোক না কেন, ফলাফল সরকারের পক্ষে নিতে চেষ্টা করবেই। কারণ সরকারি দলের মধ্যে একটি আতংক ঢুকে গেছে। তারা মনে করছে, ‘আমরা যদি ক্ষমতাচ্যুত হই তাহলে আমাদের কৃতকর্ম ও ভুল কর্মকাণ্ডের জন্য আদালতের কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হবে। এর থেকে পরিত্রাণের একমাত্র উপায় হচ্ছে ক্ষমতায় বহাল থাকা।’ অতএব সরকার যে কোনো উপায়ে ক্ষমতায় বহাল থাকার চেষ্টা করবে। সিটি কর্পোরেশন নির্বাচন দিয়ে কোনোভাবেই সরকার গঠন করা যায় না। কিন্তু জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মধ্য দিয়ে সরকার গঠিত হয়। সুতরাং সিটি কর্পোরেশন নির্বাচন জাতীয় নির্বাচনে তেমন কোনো প্রভাব ফেলবে না। অতএব জাতীয় নির্বাচনের জন্য অবশ্যই একটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার বা তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রয়োজন। যে যত কথাই বলুন না কেন, অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিকল্প নেই।
সরকার যদি ঢাকা মহানগরীকে অনির্বাচিত ব্যক্তি দিয়ে পরিচালনা করতে পারে, অনির্বাচিত ব্যক্তি দিয়ে সরকার যদি পার্বত্য চট্টগ্রামকে চালাতে পারে, ৬৪ জেলায় প্রশাসন চালাতে পারে অনির্বাচিত ব্যক্তি দিয়ে, তাহলে সরকার তথা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী কেন বলছেন, বাংলাদেশকে এক ঘণ্টার জন্যও কোনো অনির্বাচিত ব্যক্তির হাতে দেবেন না? এটা তাহলে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর গোয়ার্তুমি। অবস্থাদৃষ্টে প্রশ্ন এসে যায়- তাহলে কি প্রধানমন্ত্রী দেশের জনগণের প্রতি প্রতিহিংসাপরায়ণ? তিনি কি কোনো কারণে প্রতিশোধ নেয়ার জন্য সংকল্পবদ্ধ? এ প্রশ্নের উত্তর আমাদের জানা নেই। তিনি যদি উদার হতেন, বাস্তবমুখী হতেন তাহলে অবশ্যই তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিষয়টি বিবেচনায় আনতেন। খোদ মহাজোটের শরিক দল জাতীয় পার্টিও তত্ত্বাবধায়ক সরকার চায়। সুতরাং তত্ত্বাবধায়ক বা অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে কোনোভাবেই বাদ দেয়া যাবে না।
১৯৮৬ সালে লালদীঘি ময়দান থেকে উচ্চারণ এসেছিল, এরশাদের পাতানো নির্বাচনে কেউ অংশগ্রহণ করবে না। কিন্তু এর ২৪ ঘণ্টা পরেই দেশের একটি বৃহৎ রাজনৈতিক দল ওয়াদার বরখেলাপ করে ওই পাতানো নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে। এতে এরশাদ উপকৃত হন। কিন্তু বিএনপি আপস করেনি। নীতিতে অটল থেকেছে। তার পুরস্কার পেয়েছে। তবে এরশাদের অনেক নীতির সঙ্গে আমি একমত। তার অনেক ভালো কর্মকাণ্ডকে সাধুবাদ জানাই। তার প্রশাসনিক অনেক প্রস্তাবের সঙ্গেও আমি একমত। এরপরও বলতে হয়, ১৯৮৬ সালের রাজনৈতিক নির্বাচনটি অনুষ্ঠান করা তার জন্য ছিল অত্যন্ত ক্রিটিক্যাল। সেই নির্বাচনটি করার ক্ষেত্রে সহযোগিতার হাত বাড়িয়েছিলেন জননেত্রী শেখ হাসিনা। আমার মনে হচ্ছে, আগামী জাতীয় নির্বাচনে এরশাদ সেই উপকারের বদলা দেবেন। রাজনৈতিক টানাপোড়েনে দেশ একটি গভীর সংকটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। গার্মেন্ট, ব্যাংক, ব্যবসা-বাণিজ্য, বিদেশে কর্মসংস্থান, নির্মাণ শিল্প, আবাসন খাত ইত্যাদি ছাড়াও আরও অনেক বিষয় সংকটের মুখে রয়েছে। এ সংকটে দেশ পিছিয়ে যাচ্ছে। অর্থনীতি মুখ থুবড়ে পড়ছে। আমাদের এই গণ্ডি থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। আর সে জন্য দরকার সুস্থ রাজনৈতিক পরিবেশ। সুস্থ রাজনৈতিক পরিবেশ যাতে বজায় থাকে সে জন্য সরকারকেও অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে হবে। যদি তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতি না আসে, তাহলে ১৮ দলীয় জোট নির্বাচনে অংশগ্রহণ করবে না। ১৮ দলীয় জোট যদি নির্বাচনে অংশগ্রহণ না করে, তাহলে বর্তমান সরকার কাদের নিয়ে নির্বাচন সম্পন্ন করবে তারও একটি খসড়া হয়তো এরই মধ্যে করে রেখেছে। সুতরাং সরকারি পৃষ্ঠপোষকতাপ্রাপ্ত দল নিয়ে সরকার সংসদে থাকবে।
দেশের বহু বুদ্ধিজীবী বিভিন্ন টকশোতে বলছেন, সরকারের একগুঁয়েমির কারণে দেশ এক অনিশ্চিত গন্তব্যের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। আমার ভয় হচ্ছে, বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনের অবস্থা মিসরের মতো না হয়ে যায়। মিসরে ক্ষমতার দ্বন্দ্বকে কেন্দ্র করে অভ্যুত্থান হয়েছে। দুটি পক্ষের মধ্যে এক পক্ষে আছে সেনাবাহিনী সমর্থিত নাস্তিকতাবাদী ও ধর্মনিরপেক্ষতাবাদীরা। অপর পক্ষে রয়েছে আস্তিকতাবাদী ও গণতন্ত্রকামীরা, যারা ভোটের মাধ্যমে নির্বাচিত হয়েছিল। প্রেসিডেন্ট মুরসি ব্যর্থ হলে এবং তিনি সুযোগ্য প্রেসিডেন্ট না হলে সেক্ষেত্রে প্রেসিডেন্ট বদলানোর প্রস্তাব দেয়া যেতে পারে। কিন্তু ভোটের রায় বাতিল করা, সংবিধানকে লংঘন করা কখনোই গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। আমি বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর একজন সাবেক সদস্য হিসেবে বলতে চাই, আমাদের সেনাবাহিনী বাংলাদেশের ৪২ বছরের ইতিহাসে যে গৌরব অর্জন করেছে, তার জন্য সশ্রদ্ধ অভিনন্দন। কিন্তু মিসরের সেনাবাহিনী এবং বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর মধ্যে আকাশ-পাতাল তফাত। বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর জন্ম মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে। তাই বাংলাদেশ সেনাবাহিনী দেশের জনগণের পালসস্বরূপ। আমাদের সেনাবাহিনী কোনো দুর্নীতিবাজ রাজনীতিকদের পৃষ্ঠপোষকতা করেনি। দেশের আপদে-বিপদে মহাদুর্যোগে এ সেনাবাহিনী জনগণের পাশে থেকেছে। সুতরাং এই সেনাবাহিনী সব বিতর্কের ঊর্ধ্বে বলে আমি মনে করি। কাজেই মিসরের মতো কোনো পরিস্থিতি আমাদের দেশে ঘটবে না এবং অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনে আমাদের সেনাবাহিনী গণতন্ত্রের পাশে থাকবে বলে আমার বিশ্বাস।
মেজর জেনারেল (অব.) সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিম বীরপ্রতীক : কলাম লেখক; সভাপতি, বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টি
No comments