জাতীয় ও সিটি নির্বাচন by এ এম এম শওকত আলী
বহু বছর ধরেই জাতীয় বা সংসদ নির্বাচনই ছিল
অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কয়েক বছর ধরে সিটি করপোরেশন নির্বাচনও মনে হয় হয়ে
যাচ্ছে গুরুত্বপূর্ণ। আগে সিটি করপোরেশন নির্বাচন নিয়ে সবাই মনে করত যে
ক্ষমতাসীন দল সমর্থিত প্রার্থীই জয়লাভ করবে।
কিছু
ক্ষেত্রে এটা যে অতীতে হয়নি তা নয়। হয়তো অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তা হয়েছে। এর
অবশ্য কোনো নির্ভরযোগ্য তথ্য বা পরিসংখ্যান কোনো গবেষণায় দেখা যায়নি। তবে
বিক্ষিপ্তভাবে পাওয়া যেতে পারে। এ বিষয়টি জানা প্রয়োজন। জানতে পারলে জাতীয় ও
স্থানীয় সরকার নির্বাচনের পারস্পরিক সম্পর্কের বিষয়টি সম্পর্কে একটা
স্বচ্ছ ধারণা পাওয়া সম্ভব ছিল। এ বিষয়ে অবশ্য একটি বিষয় সত্য। তা হলো,
উপজেলা প্রথার প্রবর্তনের পর স্থানীয় সরকার নির্বাচন ক্রমেই অত্যন্ত
গুরুত্বপূর্ণ হয়। জাতীয় পর্যায়ের রাজনৈতিক দলগুলো এর মধ্যে জড়িয়ে পড়ে। এর
একটি প্রত্যক্ষ কারণ চিহ্নিত করা সম্ভব। স্থানীয় পর্যায়ে দলীয় ক্ষমতা
স্থায়ী করার জন্যই জাতীয় পর্যায়ের দলগুলো এ রাজনীতিতে আগ্রহ প্রকাশ করে।
সিটি করপোরেশন প্রথা চালু হওয়ার পর মেয়রের পদটি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। কারণ বিশাল নগর এলাকার প্রতিভূ ছাড়াও এ পদকে সরকার একটি সম্মানিত পদে রূপান্তরিত করে। মেয়রের পদমর্যাদা মন্ত্রীর সমতুল্য। তবে আক্ষরিক অর্থে নয়। ২০০৭-০৯ সালের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে প্রণীত স্থানীয় সরকার গতিশীল সম্পর্কিত প্রতিবেদনে অবশ্য মেয়র উপাধিটি সিটি করপোরেশন পর্যায়ে সীমিত না রেখে শহরভিত্তিক সব ধরনের স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানের প্রধানদের দেওয়া হয়েছিল। অর্থাৎ তিন শ্রেণীর পৌরপ্রধানদেরও এ উপাধি দেওয়া হয়। এর কারণ ছিল পৌরসভার তদানীন্তন চেয়ারম্যান সমিতি এ দাবি সরকারকে বারংবার জানিয়েছিল।
রাজনৈতিক দলের সাংগঠনিক পর্যায়ে সিটি ও পৌর মেয়রদের সম্পর্কও স্থায়ী করা হয়। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এসব মেয়র ক্ষেত্র মতে ক্ষমতাসীন বা বিরোধী দলের ওই পর্যায়ের স্বীকৃত নেতা। অর্থাৎ সাধারণ সম্পাদক বা সভাপতি। ২০০৮ সালে প্রণীত স্থানীয় সরকার শক্তিশালী ও গতিশীল বিষয়ক কমিটি ওই সময় জাতীয় রাজনীতি থেকে স্থানীয় সরকারের রাজনীতি পৃথক করার চিন্তাভাবনা করেছিল। কারণ সুশীল সমাজের অনেকেই এ ধরনের প্রস্তাব কমিটিকে দিয়েছিলেন। ওই কমিটিতে দুইজন স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধি সদস্য ছিলেন। তাঁদের একজন এ বিষয়ে ভিন্নমত প্রকাশ করেন। তবে শেষ পর্যন্ত স্থানীয় সরকার আইনে রাজনৈতিক দলের কোনো উল্লেখ করা হয়নি। বাস্তবতা হলো, রাজনৈতিক দল থেকে এ পর্যায়ের নির্বাচন বিচ্ছিন্ন করা সম্ভব হয়নি। ভবিষ্যতে যে হবে না তা নিশ্চিত করে বলা যায়। বর্তমান বছরের সিটি নির্বাচনগুলো এটাই প্রমাণ করেছে। চারটি সিটি নির্বাচন এটাও প্রমাণ করেছে যে ক্ষমতাসীন দলের জনপ্রিয়তা হ্রাসের জন্যই হবে, তা সঠিক নয়।
স্থানীয় পর্যায়ে অনেক ক্ষেত্রেই প্রার্থীকে মনোনয়ন দেওয়া নিয়ে সমস্যা থাকে। ক্ষমতাসীন বা বিরোধী দল পরোক্ষভাবে এ কাজ করে। এ নিয়ে জটিলতাও হয়। বিদ্রোহী প্রার্থীর আবির্ভাব হয়। অতীতে কিছু ক্ষেত্রে এটা জাতীয় ও স্থানীয় নির্বাচনে লক্ষ করা গেছে। বিদ্রোহী প্রার্থীকে বহিষ্কারও করা হয়। স্বল্প কিছু ক্ষেত্রে জাতীয় বা স্থানীয় নির্বাচনে বিদ্রোহী প্রার্থী জয়ী হয়ে আবার নিজ দলের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করেন। দল তাঁকে গ্রহণও করে। এ ধরনের ঘটনা স্থানীয় নির্বাচনেই অধিক মাত্রায় লক্ষ করা গেছে। এর ফলে দলীয় সমর্থিত প্রার্থীর জন্য জয়ের আশা ক্ষীণ হয়। এর সঙ্গে রয়েছে স্থানীয় পর্যায়ের দলীয় কোন্দল। এ কোন্দল যেখানে বেশি, সেখানে জয়ী হওয়ার সম্ভাবনাও কম।
এবারে বিভিন্ন সিটি নির্বাচনে কমবেশি স্থানীয় কোন্দলের সংবাদ সময় সময় মিডিয়ায় প্রকাশ করা হয়েছে। তবে এ বিষয়টি বহুল প্রচারিত ছিল বরিশাল সিটি নির্বাচনে। এসব প্রকাশিত সংবাদে দেখা গেছে, ক্ষমতাসীন দলের একসময়ের প্রভাবশালী নেতার বিরোধীদলীয় জয়ী মেয়রের পক্ষে সমর্থন ছিল। কারণ স্থানীয় কোন্দল। তবে এ কথা নিশ্চিতভাবে প্রমাণ করা সম্ভব নয়। কারণ দুই মেয়র প্রার্থীর মধ্যে ভোটের ব্যবধান কম ছিল না। চার সিটি নির্বাচনে ক্ষমতাসীন দলের মেয়র প্রার্থীদের ভরাডুবির পর ক্ষমতাসীন দলের নজর এখন গাজীপুর সিটি নির্বাচনে। গত প্রায় এক মাস ধরে মিডিয়ায় এটাই ছিল সর্বাধিক প্রচারিত বিষয়। কোন দলের সমর্থিত প্রার্থী জয়ী হবে, এ নিয়ে অনেক ধরনের জল্পনা-কল্পনা হয়। জাতীয় দুই দলের শীর্ষ পর্যায়ের নেতাদের মধ্যে পাল্টাপাল্টি বক্তব্যের সূচনাও হয়। সিটি নির্বাচনের ইতিহাসে নব্যসৃষ্ট করপোরেশনের জন্য ক্ষমতাসীন ও বিরোধী দলের উপস্থিতি ছিল দেখার মতো।
সূত্র মতে, দুই দলের জাতীয় পর্যায়ের অনেক নেতাই গাজীপুরে গিয়ে স্বীয় দল মনোনীত প্রার্থীর জন্য প্রচারকাজে লিপ্ত হন, যা জুন ৩০ পর্যন্ত শেষ হয়নি। নির্বাচন আইন অনুযায়ী নির্বাচনের দিনের ৪৮ ঘণ্টা আগে এ ধরনের প্রচারণা বন্ধ করতে হবে। অন্যান্য সিটির তুলনায় গাজীপুরের সিটি নির্বাচনের বিষয়টি অনেকাংশে জটিল। গাজীপুর ও টঙ্গী নিয়ে গঠিত এই সিটি এলাকায় দেশের অন্যান্য জেলার অধিবাসীরা স্থায়ীভাবে বসবাস করছে। এ দুই উপজেলায় শ্রমিকদের আধিক্য বেশি, কারণ দুটি এলাকাই শিল্পাঞ্চল। টঙ্গী অবশ্য বহু বছর আগেই শিল্পনগরী হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। একটি দৈনিকের প্রকাশিত বিশ্লেষণ অনুযায়ী দুই দলের নেতারাই আঞ্চলিকতার ওপর নির্ভর করে স্ব-স্ব দলের প্রার্থীদের জন্য সমর্থন আনার চেষ্টা করবেন। এ কারণেই ক্ষমতাসীন দলের প্রায় ৪২ জন সংসদ সদস্য গাজীপুরে প্রচারের কাজ করছেন। অতীতে কোনো স্থানীয় সরকার নির্বাচনে এমনটি দেখা যায়নি। অন্যদিকে টঙ্গী ও গাজীপুর ভিন্ন ভিন্ন এলাকা। দুটিই একসময় থানা হিসেবে ঢাকা উত্তর মহকুমার অংশ ছিল। ১৯৭৮ সালে গাজীপুরকে পৃথক মহকুমা হিসেবে প্রতিষ্ঠা করা হয়। প্রশাসনিক ইউনিট হিসেবে গাজীপুরের গুরুত্ব বৃদ্ধি পায়। উপজেলা প্রথা প্রবর্তনের সময় গাজীপুর জেলা সদর হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করে। ফলে এর গুরত্ব আরো বেড়ে যায়। জেলা সদর হওয়ার কারণেই নব্যসৃষ্ট সিটি হিসেবে গাজীপুরই পরিচিতি লাভ করেছে। এর আগে গাজীপুর ও টঙ্গী পৌরসভা ছিল। তবে পৌরসভা হিসেবে গাজীপুরের তুলনায় টঙ্গী পৌরসভার গুরুত্বই ছিল অধিকতর। এটি একটি প্রথম শ্রেণীর পৌরসভা হিসেবে স্বীকৃত ছিল। মূল কারণ বার্ষিক আয় ও জনসংখ্যার আধিক্য। টঙ্গী পৌরসভার বর্তমান মেয়রকেই ক্ষমতাসীন দল সিটি নির্বাচনে মনোনীত করেছে। তিনি প্রায় ১৫ বছর ধরে এ পৌরসভার মেয়র হিসেবে কাজ করেছেন। এর বিপরীতে রয়েছে বিরোধীদলীয় মেয়র প্রার্থী। এ প্রার্থী ১৯৯১ সালে ওই দলের নির্বাচিত সংসদ সদস্য ও প্রতিমন্ত্রী ছিলেন। ক্ষমতাসীন দলের ঝুঁকি ছিল ওই দলের বিদ্রোহী প্রার্থীর আবির্ভাব। এ নিয়ে নাটকীয়তারও সৃষ্টি হয়। কারণ তিনি গাজীপুরের অধিবাসী হিসেবে ওই অঞ্চলের অনেক ভোটের ভাগাভাগি হওয়ার সম্ভাবনা ছিল। প্রার্থিতা প্রত্যাহার করার জন্য ক্ষমতাসীন দলের চেষ্টারও অভাব ছিল না মর্মে অনেক সংবাদ মিডিয়ায় প্রকাশ করা হয়। তিনি কিছুদিন নিখোঁজ ছিলেন। এ জন্য বিরোধী দলের শীর্ষ পর্যায়ের নেতারা এ প্রার্থী কোথায় তা স্পষ্টীকরণের জন্য সরকারের কাছে দাবি জানায়। শেষ পর্যন্ত তাঁকে ঢাকার একটি হাসপাতালে রোগী হিসেবে পাওয়া যায়। এ নিয়েও দুই দলের মধ্যে বিতর্কের সৃষ্টি হয়। শেষ পর্যন্ত তিনি প্রার্থিতা প্রত্যাহার করেন। সমর্থন জানান দল কর্তৃক মনোনীত প্রার্থীকে। ৬ জুলাই সিটি নির্বাচন হবে। ফলাফল নিয়ে এখনো জল্পনা-কল্পনার অবসান হয়নি। ক্ষমতাসীন দলের প্রার্থী টঙ্গীর অধিবাসী। ওই এলাকায় তিনি সুপরিচিত। তবে গাজীপুরে ওই মাত্রায় নন। এ নিয়েও কিছু আশঙ্কা। গাজীপুরের কালীগঞ্জ পৌরসভায় সম্প্রতি নির্বাচন সম্পন্ন হয়েছে। এতে বিরোধী দল সমর্থিত প্রার্থী জয়লাভ করেছেন। চাটখিল পৌরসভায়ও একই ফল। অনেকে মনে করেন যে শুধু সিটিতেই নয়, পৌরসভায়ও বিরোধী দলের প্রভাব দৃশ্যমান।
সাম্প্রতিক সময়ে সিটি নির্বাচনে বিপর্যয়ের পর ক্ষমতাসীন দল আগামী সংসদ নির্বাচন নিয়েও চিন্তাভাবনা শুরু করেছে। ২৬ জুন একটি ইংরেজি দৈনিকের সংবাদ অনুযায়ী আগামী সংসদ নির্বাচনে নতুন প্রার্থী দিতে আগ্রহী। এতে আরো বলা হয়েছে, দলের নীতিনির্ধারকরা বর্তমানের দলীয় সংসদ সদস্যদের ওপর খুব একটা খুশি নন। জানা গেছে, আগামী সংসদ নির্বাচনে ১৫০ আসনে নতুন প্রার্থীর মনোনয়ন দেওয়া হবে। স্মরণ করা যেতে পারে, ইতিপূর্বে অনুষ্ঠিত চারটি সিটি নির্বাচনে ক্ষমতাসীন দলের পুরনো মেয়র প্রার্থীদের সবাই পরাজিত হয়েছেন। এর সঙ্গে আগামী সংসদ নির্বাচনের কৌশলগত কোনো প্রভাব আছে কি না তা নিশ্চিতভাবে জানা যায়নি।
গাজীপুর সিটি নির্বাচনে ক্ষমতাসীন দল ও প্রধান বিরোধী দল গভীরভাবে জড়িয়ে পড়েছে। তাই সার্বিক দৃষ্টিকোণে মনে হয়, এ ধারাই বজায় থাকবে ভবিষ্যতে। অন্যদিকে দুই দলের জাতীয় পর্যায়ের নেতারা সিটি-বহির্ভূত পৌরসভায় প্রচার চালাতে আগ্রহী নয়। কারণ ওই সব পৌরসভার অধিবাসীরা হয়তো তাঁদের সম্পর্কে খুব একটা জানেন না। এ যুক্তি কমবেশি গাজীপুরের জন্য প্রযোজ্য হলেও কয়েকটি কারণে গাজীপুর সিটি নির্বাচন জাতীয় রাজনীতিতে অধিকতর গুরুত্ব বহন করে। গাজীপুরে বহু বছর ধরেই ক্ষমতাসীন দলের প্রভাব অক্ষুণ্ন ছিল। এ সিটি নির্বাচনে জয়ী থাকার বিষয়টি দলের জন্য ইজ্জত রক্ষার প্রশ্ন ছিল। বিশেষ করে পূর্ববর্তী চারটি নির্বাচনে বিরোধী দল জয়ী হওয়ার পর। এর অন্যতম প্রমাণ হলো চার সিটি নির্বাচনে পরাজিত হওয়ার পর একজন মন্ত্রী ও প্রতিমন্ত্রীকে গাজীপুর সিটি নির্বাচনের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু তাঁরা শেষ রক্ষা করতে পারেননি। দুই মেয়র প্রার্থীর মধ্যে একজন (ক্ষমতাসীন দলের) টঙ্গী পৌরসভায় ১৫ বছর একটানা মেয়র ছিলেন। তিনি জাতীয় রাজনীতির সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে যুক্ত না হলেও স্থানীয় পর্যায়ে দলের গুরুত্বপূর্ণ সাংগঠনিক পদে ছিলেন। অন্যদিকে বিজয়ী মেয়র একসময় বিরোধী দল যখন ক্ষমতায় ছিল তখন প্রতিমন্ত্রী ছিলেন। এরপর রাজনীতিতে তিনি অতটা সক্রিয় ছিলেন না। এ সত্ত্বেও তিনি এক লাখের বেশি ভোটে জয়ী হয়েছেন। এ থেকে যে বার্তাটি স্পষ্ট তা হলো জাতীয় ও সিটি নির্বাচন ওতপ্রোতভাবে জড়িত।
লেখক : তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা
সিটি করপোরেশন প্রথা চালু হওয়ার পর মেয়রের পদটি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। কারণ বিশাল নগর এলাকার প্রতিভূ ছাড়াও এ পদকে সরকার একটি সম্মানিত পদে রূপান্তরিত করে। মেয়রের পদমর্যাদা মন্ত্রীর সমতুল্য। তবে আক্ষরিক অর্থে নয়। ২০০৭-০৯ সালের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে প্রণীত স্থানীয় সরকার গতিশীল সম্পর্কিত প্রতিবেদনে অবশ্য মেয়র উপাধিটি সিটি করপোরেশন পর্যায়ে সীমিত না রেখে শহরভিত্তিক সব ধরনের স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানের প্রধানদের দেওয়া হয়েছিল। অর্থাৎ তিন শ্রেণীর পৌরপ্রধানদেরও এ উপাধি দেওয়া হয়। এর কারণ ছিল পৌরসভার তদানীন্তন চেয়ারম্যান সমিতি এ দাবি সরকারকে বারংবার জানিয়েছিল।
রাজনৈতিক দলের সাংগঠনিক পর্যায়ে সিটি ও পৌর মেয়রদের সম্পর্কও স্থায়ী করা হয়। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এসব মেয়র ক্ষেত্র মতে ক্ষমতাসীন বা বিরোধী দলের ওই পর্যায়ের স্বীকৃত নেতা। অর্থাৎ সাধারণ সম্পাদক বা সভাপতি। ২০০৮ সালে প্রণীত স্থানীয় সরকার শক্তিশালী ও গতিশীল বিষয়ক কমিটি ওই সময় জাতীয় রাজনীতি থেকে স্থানীয় সরকারের রাজনীতি পৃথক করার চিন্তাভাবনা করেছিল। কারণ সুশীল সমাজের অনেকেই এ ধরনের প্রস্তাব কমিটিকে দিয়েছিলেন। ওই কমিটিতে দুইজন স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধি সদস্য ছিলেন। তাঁদের একজন এ বিষয়ে ভিন্নমত প্রকাশ করেন। তবে শেষ পর্যন্ত স্থানীয় সরকার আইনে রাজনৈতিক দলের কোনো উল্লেখ করা হয়নি। বাস্তবতা হলো, রাজনৈতিক দল থেকে এ পর্যায়ের নির্বাচন বিচ্ছিন্ন করা সম্ভব হয়নি। ভবিষ্যতে যে হবে না তা নিশ্চিত করে বলা যায়। বর্তমান বছরের সিটি নির্বাচনগুলো এটাই প্রমাণ করেছে। চারটি সিটি নির্বাচন এটাও প্রমাণ করেছে যে ক্ষমতাসীন দলের জনপ্রিয়তা হ্রাসের জন্যই হবে, তা সঠিক নয়।
স্থানীয় পর্যায়ে অনেক ক্ষেত্রেই প্রার্থীকে মনোনয়ন দেওয়া নিয়ে সমস্যা থাকে। ক্ষমতাসীন বা বিরোধী দল পরোক্ষভাবে এ কাজ করে। এ নিয়ে জটিলতাও হয়। বিদ্রোহী প্রার্থীর আবির্ভাব হয়। অতীতে কিছু ক্ষেত্রে এটা জাতীয় ও স্থানীয় নির্বাচনে লক্ষ করা গেছে। বিদ্রোহী প্রার্থীকে বহিষ্কারও করা হয়। স্বল্প কিছু ক্ষেত্রে জাতীয় বা স্থানীয় নির্বাচনে বিদ্রোহী প্রার্থী জয়ী হয়ে আবার নিজ দলের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করেন। দল তাঁকে গ্রহণও করে। এ ধরনের ঘটনা স্থানীয় নির্বাচনেই অধিক মাত্রায় লক্ষ করা গেছে। এর ফলে দলীয় সমর্থিত প্রার্থীর জন্য জয়ের আশা ক্ষীণ হয়। এর সঙ্গে রয়েছে স্থানীয় পর্যায়ের দলীয় কোন্দল। এ কোন্দল যেখানে বেশি, সেখানে জয়ী হওয়ার সম্ভাবনাও কম।
এবারে বিভিন্ন সিটি নির্বাচনে কমবেশি স্থানীয় কোন্দলের সংবাদ সময় সময় মিডিয়ায় প্রকাশ করা হয়েছে। তবে এ বিষয়টি বহুল প্রচারিত ছিল বরিশাল সিটি নির্বাচনে। এসব প্রকাশিত সংবাদে দেখা গেছে, ক্ষমতাসীন দলের একসময়ের প্রভাবশালী নেতার বিরোধীদলীয় জয়ী মেয়রের পক্ষে সমর্থন ছিল। কারণ স্থানীয় কোন্দল। তবে এ কথা নিশ্চিতভাবে প্রমাণ করা সম্ভব নয়। কারণ দুই মেয়র প্রার্থীর মধ্যে ভোটের ব্যবধান কম ছিল না। চার সিটি নির্বাচনে ক্ষমতাসীন দলের মেয়র প্রার্থীদের ভরাডুবির পর ক্ষমতাসীন দলের নজর এখন গাজীপুর সিটি নির্বাচনে। গত প্রায় এক মাস ধরে মিডিয়ায় এটাই ছিল সর্বাধিক প্রচারিত বিষয়। কোন দলের সমর্থিত প্রার্থী জয়ী হবে, এ নিয়ে অনেক ধরনের জল্পনা-কল্পনা হয়। জাতীয় দুই দলের শীর্ষ পর্যায়ের নেতাদের মধ্যে পাল্টাপাল্টি বক্তব্যের সূচনাও হয়। সিটি নির্বাচনের ইতিহাসে নব্যসৃষ্ট করপোরেশনের জন্য ক্ষমতাসীন ও বিরোধী দলের উপস্থিতি ছিল দেখার মতো।
সূত্র মতে, দুই দলের জাতীয় পর্যায়ের অনেক নেতাই গাজীপুরে গিয়ে স্বীয় দল মনোনীত প্রার্থীর জন্য প্রচারকাজে লিপ্ত হন, যা জুন ৩০ পর্যন্ত শেষ হয়নি। নির্বাচন আইন অনুযায়ী নির্বাচনের দিনের ৪৮ ঘণ্টা আগে এ ধরনের প্রচারণা বন্ধ করতে হবে। অন্যান্য সিটির তুলনায় গাজীপুরের সিটি নির্বাচনের বিষয়টি অনেকাংশে জটিল। গাজীপুর ও টঙ্গী নিয়ে গঠিত এই সিটি এলাকায় দেশের অন্যান্য জেলার অধিবাসীরা স্থায়ীভাবে বসবাস করছে। এ দুই উপজেলায় শ্রমিকদের আধিক্য বেশি, কারণ দুটি এলাকাই শিল্পাঞ্চল। টঙ্গী অবশ্য বহু বছর আগেই শিল্পনগরী হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। একটি দৈনিকের প্রকাশিত বিশ্লেষণ অনুযায়ী দুই দলের নেতারাই আঞ্চলিকতার ওপর নির্ভর করে স্ব-স্ব দলের প্রার্থীদের জন্য সমর্থন আনার চেষ্টা করবেন। এ কারণেই ক্ষমতাসীন দলের প্রায় ৪২ জন সংসদ সদস্য গাজীপুরে প্রচারের কাজ করছেন। অতীতে কোনো স্থানীয় সরকার নির্বাচনে এমনটি দেখা যায়নি। অন্যদিকে টঙ্গী ও গাজীপুর ভিন্ন ভিন্ন এলাকা। দুটিই একসময় থানা হিসেবে ঢাকা উত্তর মহকুমার অংশ ছিল। ১৯৭৮ সালে গাজীপুরকে পৃথক মহকুমা হিসেবে প্রতিষ্ঠা করা হয়। প্রশাসনিক ইউনিট হিসেবে গাজীপুরের গুরুত্ব বৃদ্ধি পায়। উপজেলা প্রথা প্রবর্তনের সময় গাজীপুর জেলা সদর হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করে। ফলে এর গুরত্ব আরো বেড়ে যায়। জেলা সদর হওয়ার কারণেই নব্যসৃষ্ট সিটি হিসেবে গাজীপুরই পরিচিতি লাভ করেছে। এর আগে গাজীপুর ও টঙ্গী পৌরসভা ছিল। তবে পৌরসভা হিসেবে গাজীপুরের তুলনায় টঙ্গী পৌরসভার গুরুত্বই ছিল অধিকতর। এটি একটি প্রথম শ্রেণীর পৌরসভা হিসেবে স্বীকৃত ছিল। মূল কারণ বার্ষিক আয় ও জনসংখ্যার আধিক্য। টঙ্গী পৌরসভার বর্তমান মেয়রকেই ক্ষমতাসীন দল সিটি নির্বাচনে মনোনীত করেছে। তিনি প্রায় ১৫ বছর ধরে এ পৌরসভার মেয়র হিসেবে কাজ করেছেন। এর বিপরীতে রয়েছে বিরোধীদলীয় মেয়র প্রার্থী। এ প্রার্থী ১৯৯১ সালে ওই দলের নির্বাচিত সংসদ সদস্য ও প্রতিমন্ত্রী ছিলেন। ক্ষমতাসীন দলের ঝুঁকি ছিল ওই দলের বিদ্রোহী প্রার্থীর আবির্ভাব। এ নিয়ে নাটকীয়তারও সৃষ্টি হয়। কারণ তিনি গাজীপুরের অধিবাসী হিসেবে ওই অঞ্চলের অনেক ভোটের ভাগাভাগি হওয়ার সম্ভাবনা ছিল। প্রার্থিতা প্রত্যাহার করার জন্য ক্ষমতাসীন দলের চেষ্টারও অভাব ছিল না মর্মে অনেক সংবাদ মিডিয়ায় প্রকাশ করা হয়। তিনি কিছুদিন নিখোঁজ ছিলেন। এ জন্য বিরোধী দলের শীর্ষ পর্যায়ের নেতারা এ প্রার্থী কোথায় তা স্পষ্টীকরণের জন্য সরকারের কাছে দাবি জানায়। শেষ পর্যন্ত তাঁকে ঢাকার একটি হাসপাতালে রোগী হিসেবে পাওয়া যায়। এ নিয়েও দুই দলের মধ্যে বিতর্কের সৃষ্টি হয়। শেষ পর্যন্ত তিনি প্রার্থিতা প্রত্যাহার করেন। সমর্থন জানান দল কর্তৃক মনোনীত প্রার্থীকে। ৬ জুলাই সিটি নির্বাচন হবে। ফলাফল নিয়ে এখনো জল্পনা-কল্পনার অবসান হয়নি। ক্ষমতাসীন দলের প্রার্থী টঙ্গীর অধিবাসী। ওই এলাকায় তিনি সুপরিচিত। তবে গাজীপুরে ওই মাত্রায় নন। এ নিয়েও কিছু আশঙ্কা। গাজীপুরের কালীগঞ্জ পৌরসভায় সম্প্রতি নির্বাচন সম্পন্ন হয়েছে। এতে বিরোধী দল সমর্থিত প্রার্থী জয়লাভ করেছেন। চাটখিল পৌরসভায়ও একই ফল। অনেকে মনে করেন যে শুধু সিটিতেই নয়, পৌরসভায়ও বিরোধী দলের প্রভাব দৃশ্যমান।
সাম্প্রতিক সময়ে সিটি নির্বাচনে বিপর্যয়ের পর ক্ষমতাসীন দল আগামী সংসদ নির্বাচন নিয়েও চিন্তাভাবনা শুরু করেছে। ২৬ জুন একটি ইংরেজি দৈনিকের সংবাদ অনুযায়ী আগামী সংসদ নির্বাচনে নতুন প্রার্থী দিতে আগ্রহী। এতে আরো বলা হয়েছে, দলের নীতিনির্ধারকরা বর্তমানের দলীয় সংসদ সদস্যদের ওপর খুব একটা খুশি নন। জানা গেছে, আগামী সংসদ নির্বাচনে ১৫০ আসনে নতুন প্রার্থীর মনোনয়ন দেওয়া হবে। স্মরণ করা যেতে পারে, ইতিপূর্বে অনুষ্ঠিত চারটি সিটি নির্বাচনে ক্ষমতাসীন দলের পুরনো মেয়র প্রার্থীদের সবাই পরাজিত হয়েছেন। এর সঙ্গে আগামী সংসদ নির্বাচনের কৌশলগত কোনো প্রভাব আছে কি না তা নিশ্চিতভাবে জানা যায়নি।
গাজীপুর সিটি নির্বাচনে ক্ষমতাসীন দল ও প্রধান বিরোধী দল গভীরভাবে জড়িয়ে পড়েছে। তাই সার্বিক দৃষ্টিকোণে মনে হয়, এ ধারাই বজায় থাকবে ভবিষ্যতে। অন্যদিকে দুই দলের জাতীয় পর্যায়ের নেতারা সিটি-বহির্ভূত পৌরসভায় প্রচার চালাতে আগ্রহী নয়। কারণ ওই সব পৌরসভার অধিবাসীরা হয়তো তাঁদের সম্পর্কে খুব একটা জানেন না। এ যুক্তি কমবেশি গাজীপুরের জন্য প্রযোজ্য হলেও কয়েকটি কারণে গাজীপুর সিটি নির্বাচন জাতীয় রাজনীতিতে অধিকতর গুরুত্ব বহন করে। গাজীপুরে বহু বছর ধরেই ক্ষমতাসীন দলের প্রভাব অক্ষুণ্ন ছিল। এ সিটি নির্বাচনে জয়ী থাকার বিষয়টি দলের জন্য ইজ্জত রক্ষার প্রশ্ন ছিল। বিশেষ করে পূর্ববর্তী চারটি নির্বাচনে বিরোধী দল জয়ী হওয়ার পর। এর অন্যতম প্রমাণ হলো চার সিটি নির্বাচনে পরাজিত হওয়ার পর একজন মন্ত্রী ও প্রতিমন্ত্রীকে গাজীপুর সিটি নির্বাচনের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু তাঁরা শেষ রক্ষা করতে পারেননি। দুই মেয়র প্রার্থীর মধ্যে একজন (ক্ষমতাসীন দলের) টঙ্গী পৌরসভায় ১৫ বছর একটানা মেয়র ছিলেন। তিনি জাতীয় রাজনীতির সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে যুক্ত না হলেও স্থানীয় পর্যায়ে দলের গুরুত্বপূর্ণ সাংগঠনিক পদে ছিলেন। অন্যদিকে বিজয়ী মেয়র একসময় বিরোধী দল যখন ক্ষমতায় ছিল তখন প্রতিমন্ত্রী ছিলেন। এরপর রাজনীতিতে তিনি অতটা সক্রিয় ছিলেন না। এ সত্ত্বেও তিনি এক লাখের বেশি ভোটে জয়ী হয়েছেন। এ থেকে যে বার্তাটি স্পষ্ট তা হলো জাতীয় ও সিটি নির্বাচন ওতপ্রোতভাবে জড়িত।
লেখক : তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা
No comments