যার ঘরে থাকবে তার মনে পড়বে by মোকাম্মেল হোসেন
বাসায়
ফিরে দেখি সবাই গোল হয়ে বসে আছে। মাঝখানে জাহিন মিয়া। চুপচাপ। গম্ভীর। তবে
তার চোখ দুটো কথা বলছে। আমি কৌতূহলী হয়ে জানতে চাইলাম,
: বিষয় কী!
মনে হল, এই মুহূর্তটির জন্য লবণ বেগম উন্মুখ হয়ে অপেক্ষা করছিল। সে জাহিন মিয়ার দিকে আড়চোখে তাকিয়ে বলল,
: তোমার ছোট ছেলের কথা শোন!
- কী কথা?
: জাহিন, আব্বুকে শোনাও তো!
জাহিন মিয়ার বসার ভঙ্গি ও হাবভাব দেখে তাকে শিষ্য পরিবেষ্টিত কোনো পীর সাহেব বলে মনে হচ্ছে। প্রায় চার বছর বয়সী এই শিশুপীর একবার ব্যাঙ খাওয়ার কথা বলে আমাদের মধ্যে হইচই ফেলে দিয়েছিল। এবার তার মনে কী উদয় হয়েছে কে জানে! আমি জাহিন মিয়ার সামনে হাঁটু গেড়ে বসলাম। তারপর চোখে-মুখে গভীর আগ্রহ ফুটিয়ে তুলে বললাম,
: আব্বা হুজুর, আপনের মা’রেফতের মাইকোষ থেইক্যা কী কথা বাইর হইছে বলেন- শুইন্যা ধন্য হই!
আমার কথা শুনে জাহিন মিয়ার মুখে রহস্যময় হাসি ফুটে উঠল। সে চোখ ঘুরিয়ে সবার দিকে একবার তাকিয়ে আবৃত্তির ঢঙ্গে বলে উঠল,
: যার ঘরে থাকবে তার মনে পড়বে।
এটা কোনো ধাঁধা, না ছড়া বুঝতে পারছি না। লবণ বেগমকে জিজ্ঞেস করলাম,
: এই এলেম সে কার কাছ থেইক্যা পাইছে?
- কারও কাছ থেইক্যা পায় নাই!
: তাইলে?
-আরে, ঘটনা তো এইখানেই!
আমি লবণ বেগমের দিকে প্রশ্নবোধক দৃষ্টিতে তাকালাম। দেখে মনে হচ্ছে, ছেলের প্রতিভায় সে মুগ্ধ। কোনো শিশু ‘আ’ বলার সঙ্গে সঙ্গে সেটাকে আকাশ ভেবে আহ্লাদে আটখানা হয় না- এমন মায়ের সংখ্যা পৃথিবীতে বিরল। লবণ বেগমের মুগ্ধতা পরিমাপ করতে করতে বললাম,
: কী রকম!
- আইজ বিকাল থেইক্যা তার মুখে এই কথাগুলা শুনতেছি!
: এর শানে-নজুল কী?
- সেইটাই তো রহস্য! আমি কোনো কূল-কিনারা পাইতেছি না! তুমি চেষ্টা কইরা দেখ তো, এর মানে বাইর করতে পার কিনা...
শিশুদের মনে ১২ পদের খেয়াল রাজত্ব করে। খেয়াল রাজারা খেয়ালের বশবর্তী হয়ে ১২ রকম কথা বলতেই পারে। এতে অবাক হওয়ার কিছু নেই। আমি জাহিন মিয়ার কথায় তেমন গুরুত্ব দেয়ার প্রয়োজন মনে করলাম না। আবার ভুলেও গেলাম না।
পরদিন অফিসে চায়ের আড্ডায় কী মনে করে বিষয়টির অবতারণা করলাম। উত্তর দিতে গিয়ে এক সহকর্মী দু’গালে বাতাস জমিয়ে বেলুনের রূপ দিলেন। দম যখন ফুরিয়ে গেল, তখন তিনি ফুছফুছ করে মুখের হাওয়া ত্যাগ করে দুই আঙুলে তুড়ি বাজালেন। আমার এই সহকর্মী বোবা নন। অথচ তিনি যে আচরণ করলেন, তা একজন বাকপ্রতিবন্ধীর অনুরূপ। আমি আশ্চর্য হয়ে তাকে জিজ্ঞেস করলাম,
: ভাই সাহেব, আপনি এইরকম ফুছফাছ ও টুসটাসের মাধ্যমে কী বুঝাইতে চাইলেন?
তিনি হেসে বললেন,
: আপনের এই ধাঁধা খুবই সোজা। এর উত্তর হইল সুন্দরী বৌ। যার ঘরে সুন্দরী বৌ আছে, সেই বৌয়ের কথা তার সেকেন্ডে সেকেন্ডে মনে পড়বে- এই ব্যাপারে আমি শতভাগ নিশ্চিত।
সুন্দর বা সুন্দরী হচ্ছে সামগ্রিক একটা বিষয়, যেখানে রূপের সঙ্গে গুণসহ অন্যান্য ইতিবাচক দিকের সমন্বয় ঘটে। সহকর্মী সুন্দরী বলতে সম্ভবত রূপবতী নারী বোঝাতে চাচ্ছেন। তার কথার সঙ্গে একমত হতে পারলাম না। রূপের চমক কয়দিন? স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক হচ্ছে আত্মার সঙ্গে আত্মার বন্ধন। স্নেহ-ভালোবাসায়, সম্মান-শ্রদ্ধায় আর বিশ্বাসের মধ্য দিয়ে এ বন্ধন দৃঢ় না হলে কেবল রূপ দিয়ে সম্পর্ক টিকিয়ে রাখা যায় না। আমাকে মাথা নাড়তে দেখে পাশ থেকে আরেকজন বললেন,
: ভাই, এইটা হবে বিবাহযোগ্যা কন্যা। ঘরে অবিবাহিতা বয়স্ক কন্যা থাকলে কোনো বাপের পক্ষে তার কথা এক মুহূর্তের জন্যও ভুইল্যা থাকার উপায় নাই। টেনশনের বাতি জ্বলে দিবারাত্রি কন্যাদায়গ্রস্ত পিতার মনে...
আরেকজন টেবিলে থাপ্পড় মেরে উত্তেজিত গলায় বলে উঠলেন,
: আরে রাখেন মিয়া বৌ-কন্যা-পোলাপান! মানুষের আসল চিন্তা থাকে ধন-দৌলত লইয়া। কারও ঘরে যদি সোনাদানা, টাকা-পয়সা কিংবা অন্য কোনো মূলবান সামগ্রী থাকে, তবে ঘুমের ইঞ্জেকশন দিয়া ঘুম পাড়াইয়া দিলেও চোর-ডাকাতের কথা তার মনের মধ্যে ঘুরপাক খাবে।
আরেক সহকর্মী বললেন,
: মেহমানের কথাও বিবেচনায় রাইখ্যেন! ঘরে মেহমান থাকলে আপনে যতবড় ভোলানাথই হন, তার কথা মনে রাখতে সে আপনেরে বাধ্য করবে। আমার দৃঢ় বিশ্বাস, মেহমানদের লইয়াই এই ধাঁধাটা রচিত হইছে...
অফিসে চা পান ছাড়া আরও অনেক কাজকর্ম আছে। ফলে বিষয়টা অমীমাংসিতই রয়ে গেল। ফেরার পথে বাসে যেতে যেতে জাহিন মিয়ার কথাগুলো নিয়ে ভাবতে বসলাম। ভাবতে গিয়ে মনের পর্দায় জাহিন মিয়ার মুখটা উঁকি দিতেই আমি আবিষ্কার করলাম, তার কচি-কোমল মুখেই লেখা রয়েছে এ ধাঁধার উত্তর। সন্তান- সে পুত্র হোক বা কন্যা হোক, ছোট হোক বা বড় হোক, তাদের নিয়ে মা-বাবার ভাবনা কখনোই শেষ না। ছোটবেলায় আমাকে নিয়ে আব্বা-আম্মার মধ্যে যে আকুলতা দেখেছি, এখন আমি নিজে একাধিক সন্তানের পিতা হওয়ার পরও তাদের মধ্যে একই আকুলতা লক্ষ্য করি। সন্তান ও মা-বাবার মধ্যকার বাৎসল্যের এই যে রূপ- বিশ্ব সংসারে তার তুলনা মেলা ভার। এই রূপের কথা বলতে গিয়ে এ মুহূর্তে আমার চোখের সামনে এক বৃদ্ধা মায়ের মুখ ভেসে উঠছে। পাশের গ্রামে বসবাসকারী এই বৃদ্ধা মা তার একমাত্র পুত্রের সংসারে ঠাঁই না পেয়ে আমাদের বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছিলেন। একদিন স্কুল থেকে ফেরার পর দেখি, তিনি এক বাটি তরকারি উনার ছেলের হাতে পৌঁছে দেয়ার জন্য একজনকে অনুরোধ করছেন! এ দৃশ্য দেখার পর আম্মাকে বললাম,
: আম্মা, এই মহিলার জ্ঞানের নাড়ি তো দেখতেছি খুবই টনটনা!
- কেন, কী হইছে!
ঘটনা শোনার পর আম্মা বললেন,
: বাবা রে! এই বেটি মা হইয়া ঠেকছে! মায়ের মন তো, ভালা-বুড়া কিছু খাইতে গেলেই ছেলের কথা মনে পড়ে। মায়ের মন যে কী জিনিস, তার একটা ঘটনা বলতেছি, শোন-
এক লোক মায়ের সঙ্গে ঝগড়াঝাটি কইরা তারে বনের মধ্যে রাইখ্যা রওনা হইতেই আকাশে মেঘের গর্জন শোনা গেল। মা তখন মেঘের উদ্দেশে বইল্যা উঠল,
: দেওয়া রে! ডাইক্যা-ডুইক্যা ঘর ল। আমার পুত বাড়িতে যাওয়ার পরে নামিস।
বুঝলা, ওইরকম একটা অবস্থার মধ্যেও মা ছেলের চিন্তায় আকুল হইতেছে। অথচ নিজে যে জঙ্গলের মধ্যে পইড়া বৃষ্টিতে ভিজবে- তারে বাঘে খাবে, না সাপে কাটবে- সেই চিন্তা তার নাই!
এ যুগের আধুনিক মানুষ মা-বাবাকে বনে-জঙ্গলে ফেলে আসে না। কাউকে যাতে বনে-জঙ্গলে দৌড়াতে না হয়, সেজন্য বৃদ্ধাশ্রম, বৃদ্ধনিবাস ইত্যাদির পত্তন হয়েছে। আজকাল অনেক বয়স্ক বাবা-মা’ই এসব স্থানে আশ্রয় নিতে বাধ্য হন। মায়ের রক্তে পরিপুষ্ট হয়েছে যে সন্তানের দেহ, বাবার স্নেহের ছায়ায় যার শৈশব-কৈশোরের সুরক্ষা নিশ্চিত হয়েছে- সেই সন্তান তার মা-বাবাকে কিভাবে কোনো আশ্রমে নির্বাসনে পাঠায়- ভাবতে গেলেই আমার দম বন্ধ হয়ে আসে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র থাকার সময় মাঝেমধ্যে পুরান ঢাকার নীরব হোটেলে খেতে যেতাম। একবার খাওয়া শেষ করে রিকশায় ফিরছি- রিকশাওয়ালা একটা ঘটনার কথা বললেন। ঘটনাটা ঘটেছিল নবাব সলিমুল্লাহর আমলে। একদিন নবাব সাহেবের কানে এলো- মহল্লার এক লোক তার মায়ের সঙ্গে দুর্ব্যবহার করেছে। তিনি ওই লোকটিকে ডাকালেন। তখন ছিল কাঁঠালের মৌসুম। নবাব সাহেবের হুকুমে বড় সাইজের একটি কাঁঠাল এনে অভিযুক্ত লোকটির তলপেটের সঙ্গে বেঁধে দেয়া হল। এরপর নবাব সাহেব লোকটিকে বললেন, তোমারে পেটে লইয়া তোমার মায়ের চলাফেরা করতে কতটা কষ্ট হইছে- আমি চাই সেইটা তুমি উপলব্ধি কর। এই জন্য তোমার শাস্তি হইল- পেটে কাঁঠাল বান্ধা অবস্থায় আমার ঘরের এই সিঁড়ি দিয়া একতলা থেইক্যা দোতলায় উঠানামা করবা। খবরদার! আমি না বলা পর্যন্ত থামার চেষ্টা করবা না। থামলে বিপদ হবে। কঠিন বিপদ...
বাসায় ফিরে জাহিন মিয়াকে কোলে টেনে নিলাম। বললাম,
: আব্বাজান, আপনের ধাঁধার উত্তর তো আমি পাইয়া গেছি। এইটা হইলেন স্বয়ং আপনে। যেসব মা-বাবার ঘরে আপনের মতো সন্তান আছে, তারা কি সেই সন্তানের কথা ভুইল্যা থাকতে পারবে?
জাহিন মিয়া তার বড় বড় চোখ তুলে আমার দিকে তাকাল। তার সেই চোখ ও ফুলের পাঁপড়িসম মুখের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে আমি বললাম,
: তবে একটা কথা। এখন যেমন আপনের কথা আমাদের আহারে-বিহারে, শয়নে-স্বপনে ও নিশি-জাগরণে মনে পড়ে, তেমনি আপনের আম্মা ও আমি যখন আপনের মতো ছোট্ট শিশু হইয়া যাব, তখন আপনেও কিন্তু আমাদের কথা মনে রাখার চেষ্টা করবেন।
জাহিন মিয়া অবাক চোখে কিছুক্ষণ আমার দিকে তাকিয়ে থাকার পর ভাঙা ভাঙা অক্ষরে বলল,
: আরে! তুমি আর আম্মু তো অনেক বড়! তোমরা আমার মতো ছোট হবা কেমনে?
আমি হেসে বললাম,
: আব্বাজান, ছোট হওয়া কোনো সমস্যা না। আব্বু-আম্মুরা যখন বুড়া হয়, তখন তোমার মতন শিশু হইয়া যায়...
মোকাম্মেল হোসেন : সাংবাদিক
: বিষয় কী!
মনে হল, এই মুহূর্তটির জন্য লবণ বেগম উন্মুখ হয়ে অপেক্ষা করছিল। সে জাহিন মিয়ার দিকে আড়চোখে তাকিয়ে বলল,
: তোমার ছোট ছেলের কথা শোন!
- কী কথা?
: জাহিন, আব্বুকে শোনাও তো!
জাহিন মিয়ার বসার ভঙ্গি ও হাবভাব দেখে তাকে শিষ্য পরিবেষ্টিত কোনো পীর সাহেব বলে মনে হচ্ছে। প্রায় চার বছর বয়সী এই শিশুপীর একবার ব্যাঙ খাওয়ার কথা বলে আমাদের মধ্যে হইচই ফেলে দিয়েছিল। এবার তার মনে কী উদয় হয়েছে কে জানে! আমি জাহিন মিয়ার সামনে হাঁটু গেড়ে বসলাম। তারপর চোখে-মুখে গভীর আগ্রহ ফুটিয়ে তুলে বললাম,
: আব্বা হুজুর, আপনের মা’রেফতের মাইকোষ থেইক্যা কী কথা বাইর হইছে বলেন- শুইন্যা ধন্য হই!
আমার কথা শুনে জাহিন মিয়ার মুখে রহস্যময় হাসি ফুটে উঠল। সে চোখ ঘুরিয়ে সবার দিকে একবার তাকিয়ে আবৃত্তির ঢঙ্গে বলে উঠল,
: যার ঘরে থাকবে তার মনে পড়বে।
এটা কোনো ধাঁধা, না ছড়া বুঝতে পারছি না। লবণ বেগমকে জিজ্ঞেস করলাম,
: এই এলেম সে কার কাছ থেইক্যা পাইছে?
- কারও কাছ থেইক্যা পায় নাই!
: তাইলে?
-আরে, ঘটনা তো এইখানেই!
আমি লবণ বেগমের দিকে প্রশ্নবোধক দৃষ্টিতে তাকালাম। দেখে মনে হচ্ছে, ছেলের প্রতিভায় সে মুগ্ধ। কোনো শিশু ‘আ’ বলার সঙ্গে সঙ্গে সেটাকে আকাশ ভেবে আহ্লাদে আটখানা হয় না- এমন মায়ের সংখ্যা পৃথিবীতে বিরল। লবণ বেগমের মুগ্ধতা পরিমাপ করতে করতে বললাম,
: কী রকম!
- আইজ বিকাল থেইক্যা তার মুখে এই কথাগুলা শুনতেছি!
: এর শানে-নজুল কী?
- সেইটাই তো রহস্য! আমি কোনো কূল-কিনারা পাইতেছি না! তুমি চেষ্টা কইরা দেখ তো, এর মানে বাইর করতে পার কিনা...
শিশুদের মনে ১২ পদের খেয়াল রাজত্ব করে। খেয়াল রাজারা খেয়ালের বশবর্তী হয়ে ১২ রকম কথা বলতেই পারে। এতে অবাক হওয়ার কিছু নেই। আমি জাহিন মিয়ার কথায় তেমন গুরুত্ব দেয়ার প্রয়োজন মনে করলাম না। আবার ভুলেও গেলাম না।
পরদিন অফিসে চায়ের আড্ডায় কী মনে করে বিষয়টির অবতারণা করলাম। উত্তর দিতে গিয়ে এক সহকর্মী দু’গালে বাতাস জমিয়ে বেলুনের রূপ দিলেন। দম যখন ফুরিয়ে গেল, তখন তিনি ফুছফুছ করে মুখের হাওয়া ত্যাগ করে দুই আঙুলে তুড়ি বাজালেন। আমার এই সহকর্মী বোবা নন। অথচ তিনি যে আচরণ করলেন, তা একজন বাকপ্রতিবন্ধীর অনুরূপ। আমি আশ্চর্য হয়ে তাকে জিজ্ঞেস করলাম,
: ভাই সাহেব, আপনি এইরকম ফুছফাছ ও টুসটাসের মাধ্যমে কী বুঝাইতে চাইলেন?
তিনি হেসে বললেন,
: আপনের এই ধাঁধা খুবই সোজা। এর উত্তর হইল সুন্দরী বৌ। যার ঘরে সুন্দরী বৌ আছে, সেই বৌয়ের কথা তার সেকেন্ডে সেকেন্ডে মনে পড়বে- এই ব্যাপারে আমি শতভাগ নিশ্চিত।
সুন্দর বা সুন্দরী হচ্ছে সামগ্রিক একটা বিষয়, যেখানে রূপের সঙ্গে গুণসহ অন্যান্য ইতিবাচক দিকের সমন্বয় ঘটে। সহকর্মী সুন্দরী বলতে সম্ভবত রূপবতী নারী বোঝাতে চাচ্ছেন। তার কথার সঙ্গে একমত হতে পারলাম না। রূপের চমক কয়দিন? স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক হচ্ছে আত্মার সঙ্গে আত্মার বন্ধন। স্নেহ-ভালোবাসায়, সম্মান-শ্রদ্ধায় আর বিশ্বাসের মধ্য দিয়ে এ বন্ধন দৃঢ় না হলে কেবল রূপ দিয়ে সম্পর্ক টিকিয়ে রাখা যায় না। আমাকে মাথা নাড়তে দেখে পাশ থেকে আরেকজন বললেন,
: ভাই, এইটা হবে বিবাহযোগ্যা কন্যা। ঘরে অবিবাহিতা বয়স্ক কন্যা থাকলে কোনো বাপের পক্ষে তার কথা এক মুহূর্তের জন্যও ভুইল্যা থাকার উপায় নাই। টেনশনের বাতি জ্বলে দিবারাত্রি কন্যাদায়গ্রস্ত পিতার মনে...
আরেকজন টেবিলে থাপ্পড় মেরে উত্তেজিত গলায় বলে উঠলেন,
: আরে রাখেন মিয়া বৌ-কন্যা-পোলাপান! মানুষের আসল চিন্তা থাকে ধন-দৌলত লইয়া। কারও ঘরে যদি সোনাদানা, টাকা-পয়সা কিংবা অন্য কোনো মূলবান সামগ্রী থাকে, তবে ঘুমের ইঞ্জেকশন দিয়া ঘুম পাড়াইয়া দিলেও চোর-ডাকাতের কথা তার মনের মধ্যে ঘুরপাক খাবে।
আরেক সহকর্মী বললেন,
: মেহমানের কথাও বিবেচনায় রাইখ্যেন! ঘরে মেহমান থাকলে আপনে যতবড় ভোলানাথই হন, তার কথা মনে রাখতে সে আপনেরে বাধ্য করবে। আমার দৃঢ় বিশ্বাস, মেহমানদের লইয়াই এই ধাঁধাটা রচিত হইছে...
অফিসে চা পান ছাড়া আরও অনেক কাজকর্ম আছে। ফলে বিষয়টা অমীমাংসিতই রয়ে গেল। ফেরার পথে বাসে যেতে যেতে জাহিন মিয়ার কথাগুলো নিয়ে ভাবতে বসলাম। ভাবতে গিয়ে মনের পর্দায় জাহিন মিয়ার মুখটা উঁকি দিতেই আমি আবিষ্কার করলাম, তার কচি-কোমল মুখেই লেখা রয়েছে এ ধাঁধার উত্তর। সন্তান- সে পুত্র হোক বা কন্যা হোক, ছোট হোক বা বড় হোক, তাদের নিয়ে মা-বাবার ভাবনা কখনোই শেষ না। ছোটবেলায় আমাকে নিয়ে আব্বা-আম্মার মধ্যে যে আকুলতা দেখেছি, এখন আমি নিজে একাধিক সন্তানের পিতা হওয়ার পরও তাদের মধ্যে একই আকুলতা লক্ষ্য করি। সন্তান ও মা-বাবার মধ্যকার বাৎসল্যের এই যে রূপ- বিশ্ব সংসারে তার তুলনা মেলা ভার। এই রূপের কথা বলতে গিয়ে এ মুহূর্তে আমার চোখের সামনে এক বৃদ্ধা মায়ের মুখ ভেসে উঠছে। পাশের গ্রামে বসবাসকারী এই বৃদ্ধা মা তার একমাত্র পুত্রের সংসারে ঠাঁই না পেয়ে আমাদের বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছিলেন। একদিন স্কুল থেকে ফেরার পর দেখি, তিনি এক বাটি তরকারি উনার ছেলের হাতে পৌঁছে দেয়ার জন্য একজনকে অনুরোধ করছেন! এ দৃশ্য দেখার পর আম্মাকে বললাম,
: আম্মা, এই মহিলার জ্ঞানের নাড়ি তো দেখতেছি খুবই টনটনা!
- কেন, কী হইছে!
ঘটনা শোনার পর আম্মা বললেন,
: বাবা রে! এই বেটি মা হইয়া ঠেকছে! মায়ের মন তো, ভালা-বুড়া কিছু খাইতে গেলেই ছেলের কথা মনে পড়ে। মায়ের মন যে কী জিনিস, তার একটা ঘটনা বলতেছি, শোন-
এক লোক মায়ের সঙ্গে ঝগড়াঝাটি কইরা তারে বনের মধ্যে রাইখ্যা রওনা হইতেই আকাশে মেঘের গর্জন শোনা গেল। মা তখন মেঘের উদ্দেশে বইল্যা উঠল,
: দেওয়া রে! ডাইক্যা-ডুইক্যা ঘর ল। আমার পুত বাড়িতে যাওয়ার পরে নামিস।
বুঝলা, ওইরকম একটা অবস্থার মধ্যেও মা ছেলের চিন্তায় আকুল হইতেছে। অথচ নিজে যে জঙ্গলের মধ্যে পইড়া বৃষ্টিতে ভিজবে- তারে বাঘে খাবে, না সাপে কাটবে- সেই চিন্তা তার নাই!
এ যুগের আধুনিক মানুষ মা-বাবাকে বনে-জঙ্গলে ফেলে আসে না। কাউকে যাতে বনে-জঙ্গলে দৌড়াতে না হয়, সেজন্য বৃদ্ধাশ্রম, বৃদ্ধনিবাস ইত্যাদির পত্তন হয়েছে। আজকাল অনেক বয়স্ক বাবা-মা’ই এসব স্থানে আশ্রয় নিতে বাধ্য হন। মায়ের রক্তে পরিপুষ্ট হয়েছে যে সন্তানের দেহ, বাবার স্নেহের ছায়ায় যার শৈশব-কৈশোরের সুরক্ষা নিশ্চিত হয়েছে- সেই সন্তান তার মা-বাবাকে কিভাবে কোনো আশ্রমে নির্বাসনে পাঠায়- ভাবতে গেলেই আমার দম বন্ধ হয়ে আসে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র থাকার সময় মাঝেমধ্যে পুরান ঢাকার নীরব হোটেলে খেতে যেতাম। একবার খাওয়া শেষ করে রিকশায় ফিরছি- রিকশাওয়ালা একটা ঘটনার কথা বললেন। ঘটনাটা ঘটেছিল নবাব সলিমুল্লাহর আমলে। একদিন নবাব সাহেবের কানে এলো- মহল্লার এক লোক তার মায়ের সঙ্গে দুর্ব্যবহার করেছে। তিনি ওই লোকটিকে ডাকালেন। তখন ছিল কাঁঠালের মৌসুম। নবাব সাহেবের হুকুমে বড় সাইজের একটি কাঁঠাল এনে অভিযুক্ত লোকটির তলপেটের সঙ্গে বেঁধে দেয়া হল। এরপর নবাব সাহেব লোকটিকে বললেন, তোমারে পেটে লইয়া তোমার মায়ের চলাফেরা করতে কতটা কষ্ট হইছে- আমি চাই সেইটা তুমি উপলব্ধি কর। এই জন্য তোমার শাস্তি হইল- পেটে কাঁঠাল বান্ধা অবস্থায় আমার ঘরের এই সিঁড়ি দিয়া একতলা থেইক্যা দোতলায় উঠানামা করবা। খবরদার! আমি না বলা পর্যন্ত থামার চেষ্টা করবা না। থামলে বিপদ হবে। কঠিন বিপদ...
বাসায় ফিরে জাহিন মিয়াকে কোলে টেনে নিলাম। বললাম,
: আব্বাজান, আপনের ধাঁধার উত্তর তো আমি পাইয়া গেছি। এইটা হইলেন স্বয়ং আপনে। যেসব মা-বাবার ঘরে আপনের মতো সন্তান আছে, তারা কি সেই সন্তানের কথা ভুইল্যা থাকতে পারবে?
জাহিন মিয়া তার বড় বড় চোখ তুলে আমার দিকে তাকাল। তার সেই চোখ ও ফুলের পাঁপড়িসম মুখের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে আমি বললাম,
: তবে একটা কথা। এখন যেমন আপনের কথা আমাদের আহারে-বিহারে, শয়নে-স্বপনে ও নিশি-জাগরণে মনে পড়ে, তেমনি আপনের আম্মা ও আমি যখন আপনের মতো ছোট্ট শিশু হইয়া যাব, তখন আপনেও কিন্তু আমাদের কথা মনে রাখার চেষ্টা করবেন।
জাহিন মিয়া অবাক চোখে কিছুক্ষণ আমার দিকে তাকিয়ে থাকার পর ভাঙা ভাঙা অক্ষরে বলল,
: আরে! তুমি আর আম্মু তো অনেক বড়! তোমরা আমার মতো ছোট হবা কেমনে?
আমি হেসে বললাম,
: আব্বাজান, ছোট হওয়া কোনো সমস্যা না। আব্বু-আম্মুরা যখন বুড়া হয়, তখন তোমার মতন শিশু হইয়া যায়...
মোকাম্মেল হোসেন : সাংবাদিক
No comments