সুস্থ বিবেকই শ্রেষ্ঠ আদালত by ডা. মো. ফজলুল হক
একটি বিদেশি চ্যানেলের এক প্রতিবেদনে বলা
হয়েছে, বাংলাদেশের কৃষকদের সর্বস্বান্ত করেছে ধ্বংসাত্মক হরতাল। কারণ কৃষক
তাঁর উৎপাদিত পণ্য বাজারজাত না করতে পেরে প্রতিদিন গড়ে প্রায় ২৫০ মিলিয়ন
ডলার ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে, যার পরিমাণ দুই হাজার কোটি টাকা।
গণতন্ত্র, অর্থনীতি ও আইনশৃঙ্খলা উন্নয়নের ক্ষেত্রে সহিংসতাই প্রধান
অন্তরায়। এটিই সর্বজনস্বীকৃত ও যথার্থ মন্তব্য। সহিংসতায় জড়িতদের মানবতা ও
বিবেক বলতে কিছুই থাকে না। অনেক সময় নিজের জীবনেও নেমে আসে বিপর্যয়, এমনকি
নিজের সংসারেও নেমে আসে ধূমায়িত অন্ধকার। বিশ্ব মানচিত্রে বাংলাদেশ একটি
ছোট ও ঘন জনবহুল দেশ। অনুকূল জলবায়ুর দেশ। উন্নয়নশীল দেশ। কিন্তু দঃখের
বিষয় উন্নয়নের গতি মন্থর কেন? বাস, ট্রেন, রিকশায় ভ্রমণ নিরাপদ নয় কেন? তা
হলো সহিংস হরতাল। এ দেশে শান্তিপ্রিয় মানুষের কত শতাংশ হরতাল চায়? উত্তর
হলো বেশির ভাগই চায় না। সহিংস হরতাল কোনো বিবেকবান মানুষই সমর্থন করে না,
করতে পারে না। শান্তিপূর্ণ হরতাল বলতে যা বোঝায় স্বাধীনতার পর এ পর্যন্ত
একটি মাত্র হয়েছে ২০১৩ সালে। সহিংস হরতাল দেশ ও জনগণের জন্য মারাত্মক
ক্ষতিকারক তা সরকার ও বিরোধী দল মনেপ্রাণে বিশ্বাস করে; কিন্তু বাস্তবে তা
আমলে আনা হচ্ছে না। যেমন- মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও বিরোধীদলীয়
নেতা খালেদা জিয়া যথাক্রমে ১৯৯৯ সালের ২ মার্চ কক্সবাজার জনসভায় ও ২০০৪
সালের ২৯ ফ্রেরুয়ারিতে সাভার জনসভায় (উভয়েই) বলেছিলেন জনগণ হরতাল চায় না।
খালেদা জিয়া আরো বলেছিলেন, হরতাল দিয়ে মানুষের সমর্থন আদায় করা যায় না।
সমর্থন আদায় করতে হলে সংসদের বিকল্প নেই (দৈনিকের তথ্যমতে)। উভয়ের মন্তব্যই
সঠিক ও যথাযথ নিঃসন্দেহে। বাস্তবে কী ঘটছে? দেশের উন্নয়নে প্রয়োজনে
গঠনমূলক সমালোচনার পাশাপাশি গঠনমূলক উপদেশও দিতে হবে সরকারকে। সরকারি দল সব
সময়ই হরতালের বিপক্ষে। কারণ রাষ্ট্র ও জনগণের জানমালের নিরাপত্তা বিধানের
দায়িত্ব সরকারের। বিশ্বের অন্যান্য উন্নয়নশীল দেশ হরতালকে ক্যান্সার মনে
করে। বেশ কয়েক বছর ধরে বিশ্ব অর্থনীতিতে ধস নামলেও বাংলাদেশের প্রায় সব
সেক্টরেই অভাবনীয় উন্নতি হয়েছে, যার দাবিদার এ দেশের কৃষক, গার্মেন্ট
সেক্টর, বিদেশে কর্মরত শ্রমিক ও বর্তমান সরকারের সঠিক সিদ্ধান্তও এর
বাস্তবায়ন। উল্লেখ্য, জাতিসংঘের মহাসচিব বান কি মুন বাংলাদেশকে উন্নয়নশীল
বিশ্বের জন্য মডেল দেশ হিসেবে চিহ্নিত করেন। মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক
ওবামা গত কয়েক দিন আগে এক সভায় বাংলাদেশের উন্নয়নে সন্তোষ প্রকাশ করে বলেন,
উন্নয়নের দিক থেকে বিশ্বে বাংলাদেশের অবস্থান প্রথম পর্যায়ে। অনেকে
মন্তব্য করেছেন, বাংলাদেশ এখন আর তলাবিহীন ঝুড়ি নয়। যৌথ সংবাদ সম্মেলনে
মার্কিন আন্ডারসেক্রেটারি শ্যারমেন বলেন, বিশ্বজুড়ে বাংলাদেশকে গণতন্ত্র ও
অর্থনৈতিক উন্নয়নের উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হিসেবে দেখা হচ্ছে। তাই সংকট নিরসনের
পথটাও অন্যান্য গণতান্ত্রিক দেশের মতোই বাংলাদেশের মানুষকেই খুঁজে বের
করতে হবে। ফিলিস্তিনের রাষ্ট্রদূত শাহের মোহাম্মদ বলেন, একজন বিদেশি হিসেবে
বলব, 'হরতাল বাংলাদেশিদের সম্পর্কে নেতিবাচক ধারণা দেয়। খারাপ ধারণা
দিচ্ছে বহির্বিশ্বের কাছে। ওআইসি বর্তমান সরকারের উদ্যোগকে স্বাগত জানায়
(পত্রিকায় প্রকাশিত)। অন্যদিকে বর্তমান সরকারকে বিগত ৩৫ বছরের পুঞ্জীভূত
সমস্যা দূরীকরণে আইনের সংশোধন ও নতুন আইন তৈরি, এর বাস্তবায়নে কঠিন পদক্ষেপ
নিতে হচ্ছে। পদক্ষেপগুলো দেশ ও জাতি গঠনে যথেষ্ট সহায়ক হলেও সমালোচনা থেকে
বাদ পড়ছে না সরকার। তবে কিছু দুর্নীতির কারণে দেশের ভাবমূর্তি নষ্ট হচ্ছে,
তা অস্বীকার করার উপায় নেই প্রকৃত বিশ্লেষণে। কৃষি, গার্মেন্ট, শিক্ষা ও
জনশক্তি রপ্তানিতে অসাধারণ উন্নয়ন ঘটেছে। তা ছাড়া বিদ্যুৎ, গ্যাস ও
যোগাযোগের ক্ষেত্রেও উন্নয়ন ঘটেছে। বিদেশিদের দৃষ্টিতে এ ধরনের হরতাল
ক্যান্সারের চেয়েও মারাত্মক। গরিব মানুষ বলে, পেটে লাথি মারার হরতাল।
রাজনৈতিক অস্থিরতাই বর্তমানে বড় সমস্যা, যার সমাধান রাজনৈতিক দলগুলোর
মতানৈক্যের মাধ্যমেই সম্ভব। এ দেশের কৃষকসহ সাধারণ জনগণ এখন নির্বিকার। টক
শোতে নিরপেক্ষ আলোচনার পাশাপাশি অনেকে দলের পক্ষে-বিপক্ষেও বলছেন। দল ও
ব্যক্তিস্বার্থে কেউই এক বিন্দু ছাড় দিতে নারাজ। আজ যাঁদের বয়স সর্বনিম্ন
৫০ বছর তিনি মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করার যোগ্য ছিলেন না বটে। কিন্তু
যুদ্ধাপরাধীদের দ্বারা ঘরবাড়িতে অগি্নসংযোগ, লুটপাট ও মানুষ হত্যার দৃশ্য
কমবেশি দেখেছেন। আজকের অগি্নসংযোগের ধরন, মানুষ হত্যা, লুটপাট- সবই সেই
১৯৭১ সালের অনুরূপ। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর থেকেই দেখা যাচ্ছে, কয়েকটি
নির্বাচন ছাড়া প্রায় সব নির্বাচনই ভেজালমুক্ত হয়েছে। বর্তমান সরকারের সময়ে
বিগত সাড়ে চার বছরে সদ্য সমাপ্ত চারটি সিটি করপোরেশন নির্বাচনসহ প্রায় পাঁচ
হাজার ৬৪৯টি বিভিন্ন পর্যায়ের নির্বাচন হয়েছে, যার বেশির ভাগই সুষ্ঠু ও
নিরপেক্ষ। গণতন্ত্রের মূল মন্ত্রও এটাই- জনগণ স্বাধীনভাবে ভোট দেবে, যাকে
ইচ্ছা তাকে দেবে। বিস্ময়কর ঘটনা হলো পরাজিত প্রতিপক্ষও নির্বাচনকে সুষ্ঠু
বলেছেন, মেনে নিয়েছেন, এমনকি ঘাড়ে হাত রেখে মিষ্টিও খেয়েছেন, যা বিগত ৪২
বছরের সব ঘটনাকে হার মানিয়েছে। মানুষ আজ আশার আলো দেখছে, অবাকও হচ্ছে। এ
কালচার ধরে রাখতে হবে ভবিষ্যতের জন্য। আমরা আশা করছি, আগামী সংসদ নির্বাচনও
সুষ্ঠু হবে। আমি নিজেও ১৯৮৩ সাল থেকে প্রায় সব নির্বাচনে প্রিসাইডিং
অফিসারের দায়িত্ব পালন করেছি। ২০০৮ সালের নির্বাচনেও ছিলাম। আমার
কেন্দ্রটির ভোটগ্রহণ শতভাগ নির্ভেজাল হলেও জামায়াতের একজন নেতা আমাকে চার্জ
করে বললেন, নির্বাচনে কারচুপি হয়েছে, ভোটগ্রহণ বন্ধ করুন। আমি বললাম, ভাই,
নির্বাচন শতভাগ সঠিক হয়েছে। পরাজয়ের আভাস পেয়েই তারা ভোট বাক্স ছিনিয়ে
নেওয়ার জন্য প্রায় ৫০ জন জড়ো হতে না হতেই আর্মি এসে পরিস্থিতি স্বাভাবিক
করে। ছেলেমেয়েদের তথা নতুন প্রজন্মের জন্য স্বচ্ছ ও ভেজালমুক্ত বাংলাদেশ
গড়তে চাই, যেখানে থাকবে না মারামারি, হানাহানি। সুস্থ মন নিয়ে সুস্থ
চিন্তার প্রতিফলন ঘটুক। এটিই হোক দলমত নির্বিশেষে সবার চিন্তাচেতনা। সবার
বিবেকই হোক সব ক্ষেত্রে শ্রেষ্ঠ আদালত।
লেখক : অধ্যাপক, হাজী মোহাম্মদ দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, দিনাজপুর।
fhoque.hstu@gmail.com
লেখক : অধ্যাপক, হাজী মোহাম্মদ দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, দিনাজপুর।
fhoque.hstu@gmail.com
No comments