বিশেষ সাক্ষাৎকার : ইফতেখারুজ্জামান-মানুষ চায় একটি দুর্নীতিমুক্ত সমাজব্যবস্থা ও শাসন
সম্প্রতি রাজনীতিবিদরা দুর্নীতির শীর্ষে
বলে টিআই জরিপ প্রকাশ পেলে তা নিয়ে দেশব্যাপী তোলপাড় সৃষ্টি হয়। বিশেষ করে
সরকারে থাকা রাজনীতিবিদরা এটিকে ষড়যন্ত্র বলে আখ্যায়িত করেছেন।
এ নিয়ে কালের কণ্ঠের মুখোমুখি হয়েছেন টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড.
ইফতেখারুজ্জামান। তাঁদের দৃষ্টিভঙ্গি ব্যাখ্যা করেছেন। সাক্ষাৎকার গ্রহণ
করেছেন মহসীন হাবিব
কালের কণ্ঠ : টিআই জরিপে রাজনৈতিক দলের নেতাদের দুর্নীতি এবারই বাংলাদেশে প্রথম শীর্ষে অবস্থান নিল। এ নিয়ে রাজনৈতিক বিশেষ করে সরকারের মধ্যে হতাশা লক্ষ করা গেছে। একাধিক দায়িত্বশীল ব্যক্তি বলেছেন, এটি ষড়যন্ত্র। তৃতীয় কোনো শক্তিকে ক্ষমতায় বসানোর পাঁয়তারা।
ইফতেখারুজ্জামান : প্রথম কথা হলো বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে এবারই রাজনৈতিক দলগুলো শীর্ষে এসেছে। তবে এ জরিপটি যতবার হয়েছে, বাংলাদেশ নিয়ে জরিপে ২০১০ সালে কিন্তু রাজনীতিকদের কথা এসেছিল। কিন্তু আলোচনা বা আলোড়ন সৃষ্টি হয়নি, যেহেতু অবস্থানটি শীর্ষে ছিল না। আরেকটি কথা আমি প্রথমেই বলে রাখি, বিশ্বব্যাপী এই জরিপ যখন থেকে শুরু হয়েছে, বিভিন্ন দেশে দেখা গেছে জনগণের দৃষ্টিতে রাজনৈতিক ব্যক্তিরা হয় দুর্নীতির শীর্ষে অথবা কাছাকাছি রয়েছে। বাংলাদেশে এটা প্রথম হলো। তবে উদ্দেশ্যমূলক বা ষড়যন্ত্র- এমন কথা বলার সুযোগ নেই। আমি এসব কথা কোনো অবস্থাতে মানতে রাজি নই। এর কারণ হলো, এটি একটি গবেষণা এবং এ গবেষণা একটি আন্তর্জাতিক গবেষণা। এখানে জনগণের কাছ থেকে প্রাপ্ত তথ্যই উত্থাপন করা হয়েছে। এটি এমন নয় যে টিআই বা টিআইবি তথ্যগুলো তৈরি করেছে। একটি নির্ধারিত জরিপ পদ্ধতি অনুসরণ করে জনগণের কাছ থেকে একটি প্রশ্নমালার মাধ্যমে তাদের মন্তব্য তুলে ধরা হয়েছে। আমার ধারণা এই যে ষড়যন্ত্রমূলক ও তৃতীয় শক্তির উত্থান সম্পর্কে যা বলা হচ্ছে এর দুটি উত্তর দেব। প্রথমত, আমাদের দেশে সামনে নির্বাচন, রাজনৈতিক অঙ্গন খুবই উত্তপ্ত। সেখানে সংঘাত ও অনিশ্চয়তা, সেখানে নির্বাচন কেমন করে হবে, কিভাবে হবে তা নিয়ে বিতর্ক। এ ছাড়া এমনিতে উভয় জোটের মধ্যে একটি সাংঘর্ষিক অবস্থা। সব মিলে এর পরিপ্রেক্ষিতে অনেকে মনে করতে পারেন যে এটি বিশেষ উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। কিন্তু আমাদের ব্যাখ্যা হলো, এটি তো আর বাংলাদেশের সময়ের দিকে তাকিয়ে করা হয়নি। কোন দেশে কখন নির্বাচন সেটা যদি বিবেচনায় রাখা হয়, তাহলে তো এ ধরনের জরিপ প্রকাশই করা যাবে না। কারণ সব দেশে তো একসঙ্গে নির্বাচন হচ্ছে না। সুতরাং বলতে পারি যে টাইমিংয়ের বিষয়টি কাকতালীয়। আর তৃতীয় শক্তির ব্যাপারে এর আগেও আমাদের বিরুদ্ধে বলা হয়েছে। আমি কালের কণ্ঠকে আগেও বলেছি এবং আবারও বলতে চাই যে আমাদের কাজের মধ্যে মূল জায়গাটি হলো আমরা জবাবদিহিমূলক গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা ও সুশাসন প্রতিষ্ঠা হোক সেটিই চাই। সেদিকে লক্ষ রেখে আমরা কাজ করি। যেমন উদাহরণস্বরূপ বলা যায় সংসদ নিয়ে আমাদের যে কাজ বা সুশাসনের সঙ্গে সম্পৃক্ত যেসব প্রতিষ্ঠান রয়েছে, যেমন- বিচার ব্যবস্থা, আইন প্রয়োগকারী সংস্থা, দুর্নীতি দমন সংস্থা, এগুলোকে আমরা শক্তিশালী দেখতে চাই। একটি প্রত্যাশিত ভূমিকা তারা পালন করছে সেটি দেখতে চাই। আমরা মনে করি গণতন্ত্রের কোনো বিকল্প নেই। গণতন্ত্রের বিকল্প উন্নততর গণতন্ত্র। আর সেখানে পৌঁছতেই আমাদের রাজনৈতিক অঙ্গন নিয়েই কাজ বা গবেষণা। এবং এরই পরিপ্রেক্ষিতে আমরা ফল দেখতে চাই। আমি আশা করব যে আমাদের রাজনীতিবিদরা জনগণের এই মতামতকে ইতিবাচকভাবে বিবেচনা করে গণতন্ত্রকে আরো শক্তিশালী করার উপায় হিসেবে দেখবেন।
কালের কণ্ঠ : বিরোধী দলের পক্ষে বলা হয়েছে যে এটি সরকারে থাকা দলকে নির্দেশ করে করা হয়েছে। আমরা নই। আসলে কী?
ইফতেখারুজ্জামান : এটি তথ্যের সঙ্গেও সাংঘর্ষিক এবং বিশ্লেষণের দিক দিয়েও সঠিক কথা নয়। কারণ আমাদের উত্তরদাতারা যে তথ্য দিয়েছেন, সেটি কিন্তু কোন দল দুর্নীতিগ্রস্ত এবং কোন দল নয়, তার ওপর ভিত্তি করে বলেননি। তাঁরা রাজনৈতিক দলগুলোকেই সার্বিকভাবে একটি প্রতিষ্ঠান হিসেবে দেখেছেন।
কালের কণ্ঠ : কিন্তু এখন তো সরকার ক্ষমতায়। বিরোধী দলের দুর্নীতি করার এখন সুযোগটি কোথায়?
ইফতেখারুজ্জামান : যে প্রতিষ্ঠানগুলো সম্পর্কে বলা হয়েছে, সেখানে কিন্তু উত্তরদাতাদের বলা হয়নি যে বর্তমান সরকারের ব্যাপারে ধারণা দিন। কথাটি হলো সার্বিকভাবে আপনি বাংলাদেশের কোন প্রতিষ্ঠানগুলোকে দুর্নীতিগ্রস্ত বলে মনে করেন। উত্তরদাতারা শুধু আজকের পরিস্থিতিকেই বিচার করেননি। আমরা মনে করি রাজনৈতিক দলগুলোকে তাঁরা প্রতিষ্ঠান হিসেবে প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন। দ্বিতীয়ত, শুধু বাংলাদেশেই নয়, সব দেশেই সরকারি দলের অনিয়ম করার সুযোগ থাকে- বিরোধী দলের থাকে না তা কিন্তু নয়। বিরোধী দলও অনিয়ম করতে পারে। তবে স্বীকার করি যে সরকারের হাতে সুযোগ বেশি থাকে। তবে উত্তরদাতারা সেটি মাথায় রাখেননি। এখন বিরোধী দল উচ্ছ্বাস প্রকাশ করছে এবং আমাদের স্বাগত জানাচ্ছে। কিন্তু তারা যখন সরকারে ছিল তখন তাদের এমন ভূমিকা ছিল না।
কালের কণ্ঠ : ওয়েবসাইটের তথ্য অনুসারে টিআই এবং টিআইবির হিসাবের মধ্যে পার্থক্যের কথাই বলা হয়েছে। বিষয়টি একটু ব্যাখ্যা করবেন?
ইফতেখারুজ্জামান : এটি এক ধরনের বোঝাপড়ার ভুল, কমিউনিকেশনের ভুল। আমি বলি রাজনৈতিক দলসহ বিভিন্ন সংস্থার ব্যাপারে যে প্রশ্নগুলো আনা হয়েছে, সেখানে পাঁচটি ক্যাটাগরি ছিল। একটি হলো, এই প্রতিষ্ঠানগুলোকে আপনি কিভাবে মূল্যায়ন করেন? প্রথম অপশন ছিল মোটেই দুর্নীতিগ্রস্ত নয়, দ্বিতীয়টি হলো কম দুর্নীতিগ্রস্ত। তৃতীয় দুর্নীতিগ্রস্ত। চতুর্থ হলো বেশি দুর্নীতিগ্রস্ত এবং পঞ্চম হলো খুব বেশি দুর্নীতিগ্রস্ত। আমরা যেটা করেছি, তথ্য অনুযায়ী মোটেই দুর্নীতিগ্রস্ত নয় ক্যাটাগরির বাইরে বাকি যে চারটি। এই চারটিকে যোগ করে আমরা বলেছি যে ৯৩ শতাংশ মানুষের হিসাবে রাজনৈতিক দল দুর্নীতিগ্রস্ত। এখানে আমরা বেশি দুর্নীতিগ্রস্ত, দুর্নীতিগ্রস্ত এটি বলিনি। যাঁরা বলেছেন মোটেই দুর্নীতিগ্রস্ত নয়, তাঁদের আমরা এটির মধ্যে আনিনি। যারা বলেছেন কম দুর্নীতিগ্রস্ত, খুব দুর্নীতিগ্রস্ত তাঁদের আমরা এই ক্যাটাগরিতে এনেছি। টিআই যেটি করেছে, অবশ্য তারা বলেছে যে সেটি সংশোধন করবে, সেটি হলো শেষের দুটো ক্যাটাগরি যোগ করে তারা বলেছে উত্তরদাতার মধ্যে ৪৫ শতাংশ দুর্নীতিগ্রস্ত। কিন্তু সেখানে প্রকৃতপক্ষে বলা হবে, উদ্বেগজনকভাবে দুর্নীতিগ্রস্ত। কিন্তু লক্ষ করবেন, ডাটা কিন্তু একই। একই তথ্য, এর মধ্যে কোনো অসংগতি নেই।
কালের কণ্ঠ : অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ বলেছেন, ঢালাওভাবে টিআইয়ের রিপোর্টে রাজনৈতিক দলগুলোর কথা বলা হয়েছে। টিআইয়ের উচিত ছিল রাজনৈতিক নেতাদের ব্যাপারে নির্দিষ্ট করে বলা। সেই নির্দিষ্ট করা কি যায়নি বা নির্দিষ্ট করা কি সম্ভব?
ইফতেখারুজ্জামান : প্রথম কথা হলো আমাদের জরিপে এই সুযোগ ছিল না। কোন রাজনৈতিক দল বা কোন নেতা- সেটি করার সুযোগ আমাদের ছিল না। আমরা প্রতিষ্ঠান হিসেবে দেখেছি। আপনি দেখবেন যেসব তথ্য এসেছে, তা অভিজ্ঞতার ভিত্তিতেই হোক বা ধারণার ভিত্তিতেই হোক, সব তথ্য প্রতিষ্ঠানকে কেন্দ্র করে। আর করা সম্ভব কি না? সম্ভব। তবে টিআই বা টিআইবি কিন্তু ব্যক্তির দুর্নীতি নিয়ে কাজ করে না। সেটি একটি তদন্তের পর্যায়ে চলে যায়। এ ব্যাপারে আমাদের কোনো ম্যানডেট নেই। আমরা প্রাতিষ্ঠানিকভাবে দেখি। সেই হিসেবে রাজনৈতিক দল বা দলগুলো একটা প্রতিষ্ঠান। আমাদের প্রতিবেদনে সংখ্যার প্রতিফলন ঘটে। আমরা করতে পারলে ভালো হতো, কিন্তু তা আমাদের নীতিমালার মধ্যে নেই।
কালের কণ্ঠ : আইনগত বাধ্যবাধকতা রয়েছে।
ইফতেখারুজ্জামান : হ্যাঁ, তদন্তকাজ করার দায়িত্ব কিন্তু আইন প্রয়োগকারী সংস্থাসহ বিভিন্ন সংশ্লিষ্ট সংস্থার। যেমন- দুর্নীতি দমন সংস্থা, পুলিশ, এনবিআর, সিআইডিরাও হতে পারে।
কালের কণ্ঠ : এই যে রাজনৈতিক দলগুলো বিভিন্ন সময় টিআই বা টিআইবির রিপোর্টে নাখোশ হচ্ছে, তারা ক্ষমতায় থাকতে আপনারা কি কাজ করতে বিব্রত হচ্ছেন বা কোনো বিপত্তির সম্মুখীন হচ্ছেন? ভবিষ্যতে বিঘ্ন ঘটতে পারে কি না?
ইফতেখারুজ্জামান : আমরা তা মনে করি না। আমাদের রিপোর্ট প্রথম নয় এবং রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতিক্রিয়াও প্রথম নয়। আমাদের একজন বর্ষীয়ান নেতা কিছুদিন আগে এক জনসভায় বলেছিলেন যে টিআইবি তো সব সময় প্রতিবেদন প্রকাশ করে। আমরা যখন সরকারে থাকি তখন বলি নাউজুবিল্লাহ আর বিরোধী দলে থাকলে বলি আল হামদুলিল্লাহ। এটি আসলে আমাদের সংস্কৃতির মধ্যে চলে এসেছে। এটি আমরা প্রতিবারই দেখতে পাই। আমি মনে করি এটি আমাদের পেশাগত বিড়ম্বনার মতোই। এটি কোনো বিঘ্ন ঘটাবে না। আমরা মানুষের প্রতিক্রিয়া দেখতে পাই। গণমাধ্যমের সহায়তা পেয়ে থাকি। এত কিছুর পরও কিন্তু আমরা প্রতিটি সরকারের সঙ্গে বিভিন্ন সেক্টরে কাজ করি, সহযোগিতা করি এবং তাদের সহযোগিতা পাই।
কালের কণ্ঠ : আপনারা দীর্ঘদিন ধরে এ কাজ করে আসছেন এবং প্রতিবছরই রিপোর্ট প্রকাশের পর এক ধরনের জাগরণ লক্ষ করা যায়। ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়। মানুষও চায় একটি দুর্নীতিমুক্ত সমাজব্যবস্থা ও শাসন। কিন্তু আমরা উত্তরোত্তর দুর্নীতি বাড়ছে দেখে স্তম্ভিত। এর কারণ কী? আপনাদের অবজারভেশন কী?
ইফতেখারুজ্জামান : খুব ভালো প্রশ্ন করেছেন। এটির ব্যাখ্যা খুব গুরুত্বপূর্ণ। এবারের জরিপেও কিন্তু একটি জিনিস পরিষ্কার। বিশ্বব্যাপী ৬০ শতাংশের বেশি মানুষ বলেছে তারা দুর্নীতির বিরুদ্ধে অবস্থান নিতে আগ্রহী। আমাদের দেশে প্রায় ৯৪ শতাংশ মানুষ বলেছে তারা দুর্নীতির বিরুদ্ধে অবস্থান নিতে আগ্রহী এবং শতভাগ মানুষ বলেছে তারা কোনো না কোনোভাবে দুর্নীতির বিরুদ্ধে অংশ নিতে চায়। কাজেই মানুষ কিন্তু প্রস্তুত দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণের ব্যাপারে। সেটির প্রতিফলন কিন্তু আমরা দেখতে পাই। নির্বাচনের মধ্য দিয়েও দেখতে পাই। ২০০৮ সালের নির্বাচনী ইশতেহারে সব দলের দুর্নীতির বিরুদ্ধে অবস্থানের কথা উল্লেখ ছিল। তার ধারাবাহিকতায় সরকার কিছু কিছু উদ্যোগ নিয়েছেও। অনেক ভালো উদ্যোগের সঙ্গে আমরাও জড়িত ছিলাম। কিন্তু যে কারণে তা হয় না, সেটি নিয়ে আরো গভীর বিশ্লেষণ দরকার। আমরা মনে করি যাদের হাতে দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণের দায়িত্ব, সে প্রতিষ্ঠানগুলো যথাযথ ভূমিকা পালন করতে পারে না বলেই মূলত দুর্নীতি হয়। যেমন আমাদের জাতীয় সংসদের একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে দুর্নীতি প্রতিরোধে। সেই সংসদ কিন্তু বিরোধী দলের দীর্ঘদিন অনুপস্থিতির কারণে অকার্যকর হয়ে থেকেছে। কমিটিগুলো মিটিং করে কিন্তু কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে না। সংসদীয় কমিটিগুলোর কাজ হলো জবাবদিহিমূলক সরকারব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করা। যেসব মন্ত্রণালয়ে দুর্নীতি হয়, তাদের জবাবদিহিতায় নিয়ে আসা। দুর্নীতি দমন কমিশন একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান। সেই কমিশন এখন পর্যন্ত স্বাধীন ও নিরপেক্ষভাবে কাজ করার মতো করে তৈরি করা হয়নি। খোদ সাবেক চেয়ারম্যানই বলেছেন, এটি নখদন্তহীন বাঘ। আমাদের আইন প্রয়োগকারী সংস্থা, আমাদের বিচার বিভাগের মধ্যে রাজনৈতিক প্রভাব অত্যন্ত প্রকট। এমন এক অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে দুই-আড়াই দশকে যে সরকার পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে প্রতিষ্ঠানগুলো পরিবর্তন হয়ে যায়। তারা দক্ষতা প্রদর্শন করতে পারেন না বরং দলীয় এজেন্ডা বাস্তবায়ন করতে হয়। তাদের ব্যবহার করা হয়। নির্বাচনে জিততেই হবে- এমন প্রাধান্যের কারণে তাদের ব্যবহার করা হয়। নির্বাচনে হারার একটা ভীতি কাজ করে। কারণ নির্বাচনে হারলে এসব প্রতিষ্ঠানকে ব্যবহার করা হয় নাজেহাল করতে। দুর্নীতি করে পার পেয়ে যাওয়ার সংস্কৃতি প্রতিষ্ঠা পেয়ে গেছে। দুর্নীতি করলে শাস্তি পেতে হবে তা প্রতিষ্ঠা করা যাচ্ছে না এসব কারণে। তাই দুর্নীতির বিস্তার ঘটছে। আরেকটি বিষয় হলো বিশেষ গোষ্ঠীর স্বার্থ প্রমোট করার জন্য সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। যা টিআই জরিপে এসেছে। দরপত্রের বিভিন্ন সিদ্ধান্ত কালো টাকা সাদা করা, এসব সিদ্ধান্তে সাধারণ মানুষ উপকৃত হয় না। যারা দুর্নীতির মাধ্যমে অর্থ উপার্জন করেন, তাঁদের জন্য এ ধরনের সুযোগ সৃষ্টি করা হয়। এগুলোর কারণেই প্রত্যাশিত পর্যায়ে আমরা নিয়ন্ত্রণ করতে পারছি না। তবে আশার বিষয়, এবারের জরিপ এবং ২০১২ এর খানাজরিপে দেখা গেছে সেবামূলক কিছু কিছু খাতে দুর্নীতির মাত্রা কিছু কমেছে। কাজেই দুর্নীতি রোধের সম্ভাবনা আছে।
কালের কণ্ঠ : আমাদেরকে সময় দেওয়ার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।
ইফতেখারুজ্জামান : কালের কণ্ঠকেও ধন্যবাদ।
কালের কণ্ঠ : টিআই জরিপে রাজনৈতিক দলের নেতাদের দুর্নীতি এবারই বাংলাদেশে প্রথম শীর্ষে অবস্থান নিল। এ নিয়ে রাজনৈতিক বিশেষ করে সরকারের মধ্যে হতাশা লক্ষ করা গেছে। একাধিক দায়িত্বশীল ব্যক্তি বলেছেন, এটি ষড়যন্ত্র। তৃতীয় কোনো শক্তিকে ক্ষমতায় বসানোর পাঁয়তারা।
ইফতেখারুজ্জামান : প্রথম কথা হলো বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে এবারই রাজনৈতিক দলগুলো শীর্ষে এসেছে। তবে এ জরিপটি যতবার হয়েছে, বাংলাদেশ নিয়ে জরিপে ২০১০ সালে কিন্তু রাজনীতিকদের কথা এসেছিল। কিন্তু আলোচনা বা আলোড়ন সৃষ্টি হয়নি, যেহেতু অবস্থানটি শীর্ষে ছিল না। আরেকটি কথা আমি প্রথমেই বলে রাখি, বিশ্বব্যাপী এই জরিপ যখন থেকে শুরু হয়েছে, বিভিন্ন দেশে দেখা গেছে জনগণের দৃষ্টিতে রাজনৈতিক ব্যক্তিরা হয় দুর্নীতির শীর্ষে অথবা কাছাকাছি রয়েছে। বাংলাদেশে এটা প্রথম হলো। তবে উদ্দেশ্যমূলক বা ষড়যন্ত্র- এমন কথা বলার সুযোগ নেই। আমি এসব কথা কোনো অবস্থাতে মানতে রাজি নই। এর কারণ হলো, এটি একটি গবেষণা এবং এ গবেষণা একটি আন্তর্জাতিক গবেষণা। এখানে জনগণের কাছ থেকে প্রাপ্ত তথ্যই উত্থাপন করা হয়েছে। এটি এমন নয় যে টিআই বা টিআইবি তথ্যগুলো তৈরি করেছে। একটি নির্ধারিত জরিপ পদ্ধতি অনুসরণ করে জনগণের কাছ থেকে একটি প্রশ্নমালার মাধ্যমে তাদের মন্তব্য তুলে ধরা হয়েছে। আমার ধারণা এই যে ষড়যন্ত্রমূলক ও তৃতীয় শক্তির উত্থান সম্পর্কে যা বলা হচ্ছে এর দুটি উত্তর দেব। প্রথমত, আমাদের দেশে সামনে নির্বাচন, রাজনৈতিক অঙ্গন খুবই উত্তপ্ত। সেখানে সংঘাত ও অনিশ্চয়তা, সেখানে নির্বাচন কেমন করে হবে, কিভাবে হবে তা নিয়ে বিতর্ক। এ ছাড়া এমনিতে উভয় জোটের মধ্যে একটি সাংঘর্ষিক অবস্থা। সব মিলে এর পরিপ্রেক্ষিতে অনেকে মনে করতে পারেন যে এটি বিশেষ উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। কিন্তু আমাদের ব্যাখ্যা হলো, এটি তো আর বাংলাদেশের সময়ের দিকে তাকিয়ে করা হয়নি। কোন দেশে কখন নির্বাচন সেটা যদি বিবেচনায় রাখা হয়, তাহলে তো এ ধরনের জরিপ প্রকাশই করা যাবে না। কারণ সব দেশে তো একসঙ্গে নির্বাচন হচ্ছে না। সুতরাং বলতে পারি যে টাইমিংয়ের বিষয়টি কাকতালীয়। আর তৃতীয় শক্তির ব্যাপারে এর আগেও আমাদের বিরুদ্ধে বলা হয়েছে। আমি কালের কণ্ঠকে আগেও বলেছি এবং আবারও বলতে চাই যে আমাদের কাজের মধ্যে মূল জায়গাটি হলো আমরা জবাবদিহিমূলক গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা ও সুশাসন প্রতিষ্ঠা হোক সেটিই চাই। সেদিকে লক্ষ রেখে আমরা কাজ করি। যেমন উদাহরণস্বরূপ বলা যায় সংসদ নিয়ে আমাদের যে কাজ বা সুশাসনের সঙ্গে সম্পৃক্ত যেসব প্রতিষ্ঠান রয়েছে, যেমন- বিচার ব্যবস্থা, আইন প্রয়োগকারী সংস্থা, দুর্নীতি দমন সংস্থা, এগুলোকে আমরা শক্তিশালী দেখতে চাই। একটি প্রত্যাশিত ভূমিকা তারা পালন করছে সেটি দেখতে চাই। আমরা মনে করি গণতন্ত্রের কোনো বিকল্প নেই। গণতন্ত্রের বিকল্প উন্নততর গণতন্ত্র। আর সেখানে পৌঁছতেই আমাদের রাজনৈতিক অঙ্গন নিয়েই কাজ বা গবেষণা। এবং এরই পরিপ্রেক্ষিতে আমরা ফল দেখতে চাই। আমি আশা করব যে আমাদের রাজনীতিবিদরা জনগণের এই মতামতকে ইতিবাচকভাবে বিবেচনা করে গণতন্ত্রকে আরো শক্তিশালী করার উপায় হিসেবে দেখবেন।
কালের কণ্ঠ : বিরোধী দলের পক্ষে বলা হয়েছে যে এটি সরকারে থাকা দলকে নির্দেশ করে করা হয়েছে। আমরা নই। আসলে কী?
ইফতেখারুজ্জামান : এটি তথ্যের সঙ্গেও সাংঘর্ষিক এবং বিশ্লেষণের দিক দিয়েও সঠিক কথা নয়। কারণ আমাদের উত্তরদাতারা যে তথ্য দিয়েছেন, সেটি কিন্তু কোন দল দুর্নীতিগ্রস্ত এবং কোন দল নয়, তার ওপর ভিত্তি করে বলেননি। তাঁরা রাজনৈতিক দলগুলোকেই সার্বিকভাবে একটি প্রতিষ্ঠান হিসেবে দেখেছেন।
কালের কণ্ঠ : কিন্তু এখন তো সরকার ক্ষমতায়। বিরোধী দলের দুর্নীতি করার এখন সুযোগটি কোথায়?
ইফতেখারুজ্জামান : যে প্রতিষ্ঠানগুলো সম্পর্কে বলা হয়েছে, সেখানে কিন্তু উত্তরদাতাদের বলা হয়নি যে বর্তমান সরকারের ব্যাপারে ধারণা দিন। কথাটি হলো সার্বিকভাবে আপনি বাংলাদেশের কোন প্রতিষ্ঠানগুলোকে দুর্নীতিগ্রস্ত বলে মনে করেন। উত্তরদাতারা শুধু আজকের পরিস্থিতিকেই বিচার করেননি। আমরা মনে করি রাজনৈতিক দলগুলোকে তাঁরা প্রতিষ্ঠান হিসেবে প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন। দ্বিতীয়ত, শুধু বাংলাদেশেই নয়, সব দেশেই সরকারি দলের অনিয়ম করার সুযোগ থাকে- বিরোধী দলের থাকে না তা কিন্তু নয়। বিরোধী দলও অনিয়ম করতে পারে। তবে স্বীকার করি যে সরকারের হাতে সুযোগ বেশি থাকে। তবে উত্তরদাতারা সেটি মাথায় রাখেননি। এখন বিরোধী দল উচ্ছ্বাস প্রকাশ করছে এবং আমাদের স্বাগত জানাচ্ছে। কিন্তু তারা যখন সরকারে ছিল তখন তাদের এমন ভূমিকা ছিল না।
কালের কণ্ঠ : ওয়েবসাইটের তথ্য অনুসারে টিআই এবং টিআইবির হিসাবের মধ্যে পার্থক্যের কথাই বলা হয়েছে। বিষয়টি একটু ব্যাখ্যা করবেন?
ইফতেখারুজ্জামান : এটি এক ধরনের বোঝাপড়ার ভুল, কমিউনিকেশনের ভুল। আমি বলি রাজনৈতিক দলসহ বিভিন্ন সংস্থার ব্যাপারে যে প্রশ্নগুলো আনা হয়েছে, সেখানে পাঁচটি ক্যাটাগরি ছিল। একটি হলো, এই প্রতিষ্ঠানগুলোকে আপনি কিভাবে মূল্যায়ন করেন? প্রথম অপশন ছিল মোটেই দুর্নীতিগ্রস্ত নয়, দ্বিতীয়টি হলো কম দুর্নীতিগ্রস্ত। তৃতীয় দুর্নীতিগ্রস্ত। চতুর্থ হলো বেশি দুর্নীতিগ্রস্ত এবং পঞ্চম হলো খুব বেশি দুর্নীতিগ্রস্ত। আমরা যেটা করেছি, তথ্য অনুযায়ী মোটেই দুর্নীতিগ্রস্ত নয় ক্যাটাগরির বাইরে বাকি যে চারটি। এই চারটিকে যোগ করে আমরা বলেছি যে ৯৩ শতাংশ মানুষের হিসাবে রাজনৈতিক দল দুর্নীতিগ্রস্ত। এখানে আমরা বেশি দুর্নীতিগ্রস্ত, দুর্নীতিগ্রস্ত এটি বলিনি। যাঁরা বলেছেন মোটেই দুর্নীতিগ্রস্ত নয়, তাঁদের আমরা এটির মধ্যে আনিনি। যারা বলেছেন কম দুর্নীতিগ্রস্ত, খুব দুর্নীতিগ্রস্ত তাঁদের আমরা এই ক্যাটাগরিতে এনেছি। টিআই যেটি করেছে, অবশ্য তারা বলেছে যে সেটি সংশোধন করবে, সেটি হলো শেষের দুটো ক্যাটাগরি যোগ করে তারা বলেছে উত্তরদাতার মধ্যে ৪৫ শতাংশ দুর্নীতিগ্রস্ত। কিন্তু সেখানে প্রকৃতপক্ষে বলা হবে, উদ্বেগজনকভাবে দুর্নীতিগ্রস্ত। কিন্তু লক্ষ করবেন, ডাটা কিন্তু একই। একই তথ্য, এর মধ্যে কোনো অসংগতি নেই।
কালের কণ্ঠ : অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ বলেছেন, ঢালাওভাবে টিআইয়ের রিপোর্টে রাজনৈতিক দলগুলোর কথা বলা হয়েছে। টিআইয়ের উচিত ছিল রাজনৈতিক নেতাদের ব্যাপারে নির্দিষ্ট করে বলা। সেই নির্দিষ্ট করা কি যায়নি বা নির্দিষ্ট করা কি সম্ভব?
ইফতেখারুজ্জামান : প্রথম কথা হলো আমাদের জরিপে এই সুযোগ ছিল না। কোন রাজনৈতিক দল বা কোন নেতা- সেটি করার সুযোগ আমাদের ছিল না। আমরা প্রতিষ্ঠান হিসেবে দেখেছি। আপনি দেখবেন যেসব তথ্য এসেছে, তা অভিজ্ঞতার ভিত্তিতেই হোক বা ধারণার ভিত্তিতেই হোক, সব তথ্য প্রতিষ্ঠানকে কেন্দ্র করে। আর করা সম্ভব কি না? সম্ভব। তবে টিআই বা টিআইবি কিন্তু ব্যক্তির দুর্নীতি নিয়ে কাজ করে না। সেটি একটি তদন্তের পর্যায়ে চলে যায়। এ ব্যাপারে আমাদের কোনো ম্যানডেট নেই। আমরা প্রাতিষ্ঠানিকভাবে দেখি। সেই হিসেবে রাজনৈতিক দল বা দলগুলো একটা প্রতিষ্ঠান। আমাদের প্রতিবেদনে সংখ্যার প্রতিফলন ঘটে। আমরা করতে পারলে ভালো হতো, কিন্তু তা আমাদের নীতিমালার মধ্যে নেই।
কালের কণ্ঠ : আইনগত বাধ্যবাধকতা রয়েছে।
ইফতেখারুজ্জামান : হ্যাঁ, তদন্তকাজ করার দায়িত্ব কিন্তু আইন প্রয়োগকারী সংস্থাসহ বিভিন্ন সংশ্লিষ্ট সংস্থার। যেমন- দুর্নীতি দমন সংস্থা, পুলিশ, এনবিআর, সিআইডিরাও হতে পারে।
কালের কণ্ঠ : এই যে রাজনৈতিক দলগুলো বিভিন্ন সময় টিআই বা টিআইবির রিপোর্টে নাখোশ হচ্ছে, তারা ক্ষমতায় থাকতে আপনারা কি কাজ করতে বিব্রত হচ্ছেন বা কোনো বিপত্তির সম্মুখীন হচ্ছেন? ভবিষ্যতে বিঘ্ন ঘটতে পারে কি না?
ইফতেখারুজ্জামান : আমরা তা মনে করি না। আমাদের রিপোর্ট প্রথম নয় এবং রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতিক্রিয়াও প্রথম নয়। আমাদের একজন বর্ষীয়ান নেতা কিছুদিন আগে এক জনসভায় বলেছিলেন যে টিআইবি তো সব সময় প্রতিবেদন প্রকাশ করে। আমরা যখন সরকারে থাকি তখন বলি নাউজুবিল্লাহ আর বিরোধী দলে থাকলে বলি আল হামদুলিল্লাহ। এটি আসলে আমাদের সংস্কৃতির মধ্যে চলে এসেছে। এটি আমরা প্রতিবারই দেখতে পাই। আমি মনে করি এটি আমাদের পেশাগত বিড়ম্বনার মতোই। এটি কোনো বিঘ্ন ঘটাবে না। আমরা মানুষের প্রতিক্রিয়া দেখতে পাই। গণমাধ্যমের সহায়তা পেয়ে থাকি। এত কিছুর পরও কিন্তু আমরা প্রতিটি সরকারের সঙ্গে বিভিন্ন সেক্টরে কাজ করি, সহযোগিতা করি এবং তাদের সহযোগিতা পাই।
কালের কণ্ঠ : আপনারা দীর্ঘদিন ধরে এ কাজ করে আসছেন এবং প্রতিবছরই রিপোর্ট প্রকাশের পর এক ধরনের জাগরণ লক্ষ করা যায়। ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়। মানুষও চায় একটি দুর্নীতিমুক্ত সমাজব্যবস্থা ও শাসন। কিন্তু আমরা উত্তরোত্তর দুর্নীতি বাড়ছে দেখে স্তম্ভিত। এর কারণ কী? আপনাদের অবজারভেশন কী?
ইফতেখারুজ্জামান : খুব ভালো প্রশ্ন করেছেন। এটির ব্যাখ্যা খুব গুরুত্বপূর্ণ। এবারের জরিপেও কিন্তু একটি জিনিস পরিষ্কার। বিশ্বব্যাপী ৬০ শতাংশের বেশি মানুষ বলেছে তারা দুর্নীতির বিরুদ্ধে অবস্থান নিতে আগ্রহী। আমাদের দেশে প্রায় ৯৪ শতাংশ মানুষ বলেছে তারা দুর্নীতির বিরুদ্ধে অবস্থান নিতে আগ্রহী এবং শতভাগ মানুষ বলেছে তারা কোনো না কোনোভাবে দুর্নীতির বিরুদ্ধে অংশ নিতে চায়। কাজেই মানুষ কিন্তু প্রস্তুত দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণের ব্যাপারে। সেটির প্রতিফলন কিন্তু আমরা দেখতে পাই। নির্বাচনের মধ্য দিয়েও দেখতে পাই। ২০০৮ সালের নির্বাচনী ইশতেহারে সব দলের দুর্নীতির বিরুদ্ধে অবস্থানের কথা উল্লেখ ছিল। তার ধারাবাহিকতায় সরকার কিছু কিছু উদ্যোগ নিয়েছেও। অনেক ভালো উদ্যোগের সঙ্গে আমরাও জড়িত ছিলাম। কিন্তু যে কারণে তা হয় না, সেটি নিয়ে আরো গভীর বিশ্লেষণ দরকার। আমরা মনে করি যাদের হাতে দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণের দায়িত্ব, সে প্রতিষ্ঠানগুলো যথাযথ ভূমিকা পালন করতে পারে না বলেই মূলত দুর্নীতি হয়। যেমন আমাদের জাতীয় সংসদের একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে দুর্নীতি প্রতিরোধে। সেই সংসদ কিন্তু বিরোধী দলের দীর্ঘদিন অনুপস্থিতির কারণে অকার্যকর হয়ে থেকেছে। কমিটিগুলো মিটিং করে কিন্তু কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে না। সংসদীয় কমিটিগুলোর কাজ হলো জবাবদিহিমূলক সরকারব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করা। যেসব মন্ত্রণালয়ে দুর্নীতি হয়, তাদের জবাবদিহিতায় নিয়ে আসা। দুর্নীতি দমন কমিশন একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান। সেই কমিশন এখন পর্যন্ত স্বাধীন ও নিরপেক্ষভাবে কাজ করার মতো করে তৈরি করা হয়নি। খোদ সাবেক চেয়ারম্যানই বলেছেন, এটি নখদন্তহীন বাঘ। আমাদের আইন প্রয়োগকারী সংস্থা, আমাদের বিচার বিভাগের মধ্যে রাজনৈতিক প্রভাব অত্যন্ত প্রকট। এমন এক অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে দুই-আড়াই দশকে যে সরকার পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে প্রতিষ্ঠানগুলো পরিবর্তন হয়ে যায়। তারা দক্ষতা প্রদর্শন করতে পারেন না বরং দলীয় এজেন্ডা বাস্তবায়ন করতে হয়। তাদের ব্যবহার করা হয়। নির্বাচনে জিততেই হবে- এমন প্রাধান্যের কারণে তাদের ব্যবহার করা হয়। নির্বাচনে হারার একটা ভীতি কাজ করে। কারণ নির্বাচনে হারলে এসব প্রতিষ্ঠানকে ব্যবহার করা হয় নাজেহাল করতে। দুর্নীতি করে পার পেয়ে যাওয়ার সংস্কৃতি প্রতিষ্ঠা পেয়ে গেছে। দুর্নীতি করলে শাস্তি পেতে হবে তা প্রতিষ্ঠা করা যাচ্ছে না এসব কারণে। তাই দুর্নীতির বিস্তার ঘটছে। আরেকটি বিষয় হলো বিশেষ গোষ্ঠীর স্বার্থ প্রমোট করার জন্য সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। যা টিআই জরিপে এসেছে। দরপত্রের বিভিন্ন সিদ্ধান্ত কালো টাকা সাদা করা, এসব সিদ্ধান্তে সাধারণ মানুষ উপকৃত হয় না। যারা দুর্নীতির মাধ্যমে অর্থ উপার্জন করেন, তাঁদের জন্য এ ধরনের সুযোগ সৃষ্টি করা হয়। এগুলোর কারণেই প্রত্যাশিত পর্যায়ে আমরা নিয়ন্ত্রণ করতে পারছি না। তবে আশার বিষয়, এবারের জরিপ এবং ২০১২ এর খানাজরিপে দেখা গেছে সেবামূলক কিছু কিছু খাতে দুর্নীতির মাত্রা কিছু কমেছে। কাজেই দুর্নীতি রোধের সম্ভাবনা আছে।
কালের কণ্ঠ : আমাদেরকে সময় দেওয়ার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।
ইফতেখারুজ্জামান : কালের কণ্ঠকেও ধন্যবাদ।
No comments