কোটাব্যবস্থা ও সাংবিধানিক নায্যতা by সুলতান মাহমুদ রানা
বিসিএসসহ সরকারি চাকরিতে কোটা পদ্ধতি
বাতিল ও রক্ষার দাবিতে পাল্টাপাল্টি আন্দোলন কর্মসূচিতে সারা দেশে
কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় উত্তাল। এরই মধ্যে শাহবাগের 'মেধা চত্বরের'
আন্দোলনকারীরা নানা কর্মসূচি ঘোষণা করেছে এবং পালন করতে শুরু করেছে।
একদিকে মেধাবীরা কোটাব্যবস্থা বাতিলের দাবিতে অন্যদিকে মুত্তিযোদ্ধা সংসদ
সন্তান কমান্ড ও আমরা মুক্তিযোদ্ধার সন্তান ব্যানারে কোটা রক্ষার দাবিতে
কর্মসূচি অব্যাহত রেখেছে। ৩৪তম বিসিএস প্রিলিমিনারি ফলপরবর্তী মেধাবীদের
দীর্ঘদিনের চাপা ক্ষোভের বিস্ফোরণ ঘটেছে। বিক্ষোভ, অবস্থান ধর্মঘট,
মানববন্ধন ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ধর্মঘটের মধ্য দিয়ে কোটা পদ্ধতি বাতিলের
দাবিতে মেধাবী-বঞ্চিত প্রার্থীরা যে রাস্তায় নেমেছে, তা কতটুকু ন্যায্য ও
এর সাংবিধানিক ব্যাখ্যা তুলে ধরার মাধ্যমে সংক্ষিপ্ত বিশ্লেষণের নিমিত্তেই
আমার এই ক্ষুদ্র প্রয়াস।
চাকরিপ্রার্থীদের অনেকেরই এই পদ্ধতি নিয়ে আপত্তি রয়েছে। সম্প্রতি প্রকাশিত ৩৪তম বিসিএস প্রিলিমিনারি পরীক্ষার ফলাফলে কোটা অনুসরণে মেধাবীরা বঞ্চিত হওয়ায় অনেক প্রার্থী বিক্ষোভ কর্মসূচির মাধ্যমে দাবি করে যে ওই ফলাফলে প্রকৃত মেধাবীরা ব্যাপকভাবে বঞ্চিত হয়েছে। আন্দোলনের মুখে পিএসসি কর্তৃপক্ষ এরই মধ্যে ফলাফল পুনর্বিবেচনার শর্তে স্থগিত করে। শিক্ষার্থীরা কোটা পদ্ধতি সংস্কার কিংবা বাতিলের দাবিতে আন্দোলন অব্যাহত রাখারও অঙ্গীকার ব্যক্ত করে।
বাংলাদেশে ১৯৭২ সালে এক নির্বাহী আদেশে কোটা পদ্ধতি চালু হয়। স্বাধীনতাপরবর্তী সময় থেকে ১৯৭৬ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশে ২০ শতাংশ সরকারি কর্মকর্তাকে মেধাভিত্তিক নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। ১৯৭৬ সালেই মেধার ভিত্তিতে নিয়োগে ২০ শতাংশ থেকে ৪০ শতাংশে উন্নীত করা হয়। ১৯৮৫ সালে এই সংখ্যা ৪৫ শতাংশে উন্নীত করা হয়, যা বর্তমানেও প্রচলিত রয়েছে। বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর অনগ্রসর এলাকাগুলো নিয়ে জেলা-কোটা চালু হয়। কোটার সারিতে পরবর্তীকালে মুক্তিযোদ্ধা, নারী, আদিবাসী, প্রতিবন্ধী প্রভৃতি যুক্ত হয়। এ ছাড়া বিশেষ ক্ষেত্রে পোষ্য কোটা, আনসার কোটাসহ সংশ্লিষ্ট প্রাতিষ্ঠানিক নানা কোটা বিভিন্ন চাকরিতে অনুসরণ করা হয়, যা অনেক ক্ষেত্রেই মেধাবীদের বঞ্চিত করে। বর্তমানে সরকারি কর্মকমিশনের অধীনে পরিচালিত বিশেষ বিসিএস ছাড়া সব বিসিএসে মুক্তিযোদ্ধার সন্তান/নাতি-নাতনি কোটায় ৩০ শতাংশ, নারী কোটায় ১০ শতাংশ, আদিবাসী কোটায় ৫ শতাংশ, প্রতিবন্ধী কোটায় ১ শতাংশ ও জেলা কোটায় ১০ শতাংশ নিয়োগের বাধ্যবাধকতা রয়েছে। এভাবে মোট ৫৬ শতাংশ পদ কোটার মাধ্যমে পূরণের চিত্রটি মেধাবীদের জন্য নিশ্চয়ই হতাশার সুযোগ সৃষ্টি করে। কোটা পদ্ধতি নিয়ে সরকারি কর্মকমিশনসহ অনেক বিশেষজ্ঞ মহল সরকারের কাছে সংস্কারের সুপারিশ জানালেও এখন পর্যন্ত কোনো কার্যকর উদ্যোগ লক্ষ করা যায়নি। পিএসসি এ পদ্ধতিকে সহজীকরণের জন্য তাগাদা দিয়ে বিভিন্ন সময় উল্লেখ করেছে যে এটি অত্যন্ত জটিল, দুরূহ ও সময়সাপেক্ষ প্রক্রিয়া। শতভাগ নিখুঁতভাবে উপযুক্ত প্রার্থী নির্বাচন এর মাধ্যমে প্রায় অসম্ভব।
৫৬ শতাংশ কোটা অনুসরণের ক্ষেত্রে সাংবিধানিক ন্যায্যতা যাচাই করার লক্ষ্যে ও কোটা পদ্ধতির যৌক্তিকতা নিয়ে বাংলাদেশের সংবিধানে বর্ণিত কতিপয় অনুচ্ছেদ উল্লেখ করতে চাই। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানে ১৯(১) নম্বর ধারায় উল্লেখ আছে, 'সকল নাগরিকের জন্য সুযোগের সমতা নিশ্চিত করিতে রাষ্ট্র সচেষ্ট হইবেন।' ২৮(১) অনুচ্ছেদে বর্ণিত আছে, 'কেবল ধর্ম, গোষ্ঠী, বর্ণ, নারীপুরুষভেদ বা জন্মস্থানের কারণে নাগরিকের প্রতি রাষ্ট্র বৈষম্য প্রদর্শন করিবেন না।' ২৮(২)-এ আছে, 'রাষ্ট্র ও গণজীবনের সর্বস্তরে নারী পুরুষের সমান অধিকার লাভ করিবেন।'
অন্যদিকে সংবিধানের ২৯(১) নম্বর অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, 'প্রজাতন্ত্রের কর্মে নিয়োগ বা পদ-লাভের ক্ষেত্রে সকল নাগরিকের জন্য সুযোগের সমতা থাকিবে।' ২৯(২) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, 'কেবল ধর্ম, গোষ্ঠী, বর্ণ, নারীপুরুষভেদ বা জন্মস্থানের কারণে কোন নাগরিক প্রজাতন্ত্রের কর্মে নিয়োগ বা পদ-লাভের অযোগ্য হইবেন না কিংবা সেই ক্ষেত্রে তাঁহার প্রদর্শন করা যাইবে না।' অবশ্য সংবিধানের ২৯(৩)(ক)তে বলা আছে, 'নাগরিকদের যে কোন অনগ্রসর অংশ যাহাতে প্রজাতন্ত্রের কর্মে উপযুক্ত প্রতিনিধিত্ব লাভ করতে পারেন, সেই উদ্দেশ্যে তাঁহাদের অনুকূলে বিশেষ বিধান-প্রণয়ন করা হইতে রাষ্ট্রকে নিবৃত্ত করিবে না।' একই অনুচ্ছেদের প্রথম ধারায় এক ধরনের বিধান ও অন্য ধারায় ভিন্ন এবং অনেকটাই সাংঘর্ষিক বিধান লিপিবদ্ধ আছে।
সংবিধানের ৪০ নম্বর অনুচ্ছেদে বর্ণিত আছে, 'আইনের দ্বারা আরোপিত বাধানিষেধ সাপেক্ষে কোন পেশা বা বৃত্তি গ্রহণের কিংবা কারবার বা ব্যবসায়-পরিচালনার জন্য আইনের দ্বারা কোন যোগ্যতা নির্ধারিত হইয়া থাকিলে অনুরূপ যোগ্যতা সম্পন্ন প্রত্যেক নাগরিকের যে কোন অইনসঙ্গত পেশা বা বৃত্তি-গ্রহণের এবং যে কোন আইনসঙ্গত কারবার বা ব্যবসায়-পরিচালনার অধিকার থাকিবে।'
সংবিধানের উল্লিখিত ধারাগুলো বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, নাগরিকদের সুযোগের সমতা নিশ্চিত করার বিষয়ে সংবিধানে স্পষ্টভাবে উল্লেখ থাকলেও চাকরি ক্ষেত্রে বিদ্যমান কোটা সে ক্ষেত্রে প্রশ্নের সম্মুখীন করে। বাংলাদেশে সরকারি চাকরিতে যে কোটা অনুসরণ করা হয়, তা অনেক ক্ষেত্রেই সংবিধানের এ ধারণাগুলোর সঙ্গে সাংঘর্ষিক। কোটা পদ্ধতি কতটুকু যুক্তিযুক্ত, সে প্রসঙ্গে আমি আরো দু-একটি কথা পরিষ্কারভাবে বলতে চাই। প্রথমত. বাংলাদেশের সংবিধানে নাগরিকদের জন্য কর্মসংস্থানের সমান সুযোগের নিশ্চয়তার বিধান রয়েছে; কিন্তু তা সত্ত্বেও কোটা পদ্ধতির ফলে সেটা যথাযথ অনুসরণ সম্ভব হচ্ছে না। দ্বিতীয়ত. সংবিধানে অনগ্রসর সমাজের জন্য একটি ব্যতিক্রমী ব্যবস্থা হিসেবে কোটা পদ্ধতি সংরক্ষণের বিধান থাকলেও দেশের সমগ্র নাগরিকের সমান সুযোগের নিশ্চয়তাকে বাধাগ্রস্ত করে নয়। তৃতীয়ত. কোটা পদ্ধতির সুনির্দিষ্ট নীতিমালা না থাকায় অর্থাৎ চাকরিভেদে ভিন্ন ভিন্ন কোটা অনুসরণ করাতে এর স্বচ্ছতা অনেকটাই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। চতুর্থত. কোটা পদ্ধতির মাধ্যমে নিয়োগ কখনোই সরকারি কর্মকমিশনের মাধ্যমে অথবা সরকারের মাধ্যমে সুস্পষ্ট গেজেট জনসমক্ষে প্রকাশ করা হয়নি। পঞ্চমত. কোটার ফলে অপেক্ষাকৃত কম মেধাবীরা সরকারের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা হিসেবে নিয়োগ পাচ্ছে, যেখানে কোটার আওতায় না পরে তার চেয়ে অনেক বেশি মেধাবী প্রার্থী বঞ্চিত হচ্ছে। ফলে এর একটি নেতিবাচক প্রভাব সমাজের ওপর পড়ছে, যা জাতিকে যথাযথ অগ্রসর করতে বাধাগ্রস্ত করছে। ষষ্ঠত. কোটাব্যবস্থা সংবিধানে বর্ণিত মৌলিক অধিকারের পরিপন্থী।
সরকারি পদসমূহে জনবল নিয়োগ রাষ্ট্রের খুব গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়। উচ্চশিক্ষায় অধ্যয়নরত বেশির ভাগ শিক্ষার্থীর জীবনের অন্যতম লক্ষ্য থাকে বিসিএস পরীক্ষা দিয়ে প্রথম শ্রেণীর সরকারি পদে অধিষ্ঠিত হওয়া। সরকারও তার রাষ্ট্রযন্ত্র পরিচালনা করার জন্য প্রয়োজনীয় শ্রেষ্ঠ মানবসম্পদ এ-সংক্রান্ত প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার মধ্য দিয়ে নির্বাচন করে থাকে। তাই সরকারকে নিয়োগ প্রক্রিয়ার কোটাসংক্রান্ত জটিলতা নিরসন করে নাগরিকদের সুযোগের সমতার নিশ্চয়তা প্রদানসহ স্বচ্ছতা আনয়ন জরুরি। পাশাপাশি কোটা প্রয়োগের ব্যাপকতা কমিয়ে আনা যায় কি না সেটাও পুনর্বিবেচনা সাপেক্ষে যথাযথ ইতিবাচক সিদ্ধান্ত দ্রুত নেওয়া জরুরি। জাতি-লিঙ্গ-অঞ্চল নির্বিশেষে অনগ্রসর জনগোষ্ঠীর পৃষ্ঠপোষকতার প্রয়োজন রয়েছে, কিন্তু সময়ের পরিক্রমায় পৃষ্ঠপোষকতার পরিস্থিতি পর্যালোচনার মাধ্যমে কোটা পদ্ধতি সংস্কারের কোনো বিকল্প নেই।
লেখক : শিক্ষক, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়
sultanmahmud.rana@gmail.com
চাকরিপ্রার্থীদের অনেকেরই এই পদ্ধতি নিয়ে আপত্তি রয়েছে। সম্প্রতি প্রকাশিত ৩৪তম বিসিএস প্রিলিমিনারি পরীক্ষার ফলাফলে কোটা অনুসরণে মেধাবীরা বঞ্চিত হওয়ায় অনেক প্রার্থী বিক্ষোভ কর্মসূচির মাধ্যমে দাবি করে যে ওই ফলাফলে প্রকৃত মেধাবীরা ব্যাপকভাবে বঞ্চিত হয়েছে। আন্দোলনের মুখে পিএসসি কর্তৃপক্ষ এরই মধ্যে ফলাফল পুনর্বিবেচনার শর্তে স্থগিত করে। শিক্ষার্থীরা কোটা পদ্ধতি সংস্কার কিংবা বাতিলের দাবিতে আন্দোলন অব্যাহত রাখারও অঙ্গীকার ব্যক্ত করে।
বাংলাদেশে ১৯৭২ সালে এক নির্বাহী আদেশে কোটা পদ্ধতি চালু হয়। স্বাধীনতাপরবর্তী সময় থেকে ১৯৭৬ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশে ২০ শতাংশ সরকারি কর্মকর্তাকে মেধাভিত্তিক নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। ১৯৭৬ সালেই মেধার ভিত্তিতে নিয়োগে ২০ শতাংশ থেকে ৪০ শতাংশে উন্নীত করা হয়। ১৯৮৫ সালে এই সংখ্যা ৪৫ শতাংশে উন্নীত করা হয়, যা বর্তমানেও প্রচলিত রয়েছে। বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর অনগ্রসর এলাকাগুলো নিয়ে জেলা-কোটা চালু হয়। কোটার সারিতে পরবর্তীকালে মুক্তিযোদ্ধা, নারী, আদিবাসী, প্রতিবন্ধী প্রভৃতি যুক্ত হয়। এ ছাড়া বিশেষ ক্ষেত্রে পোষ্য কোটা, আনসার কোটাসহ সংশ্লিষ্ট প্রাতিষ্ঠানিক নানা কোটা বিভিন্ন চাকরিতে অনুসরণ করা হয়, যা অনেক ক্ষেত্রেই মেধাবীদের বঞ্চিত করে। বর্তমানে সরকারি কর্মকমিশনের অধীনে পরিচালিত বিশেষ বিসিএস ছাড়া সব বিসিএসে মুক্তিযোদ্ধার সন্তান/নাতি-নাতনি কোটায় ৩০ শতাংশ, নারী কোটায় ১০ শতাংশ, আদিবাসী কোটায় ৫ শতাংশ, প্রতিবন্ধী কোটায় ১ শতাংশ ও জেলা কোটায় ১০ শতাংশ নিয়োগের বাধ্যবাধকতা রয়েছে। এভাবে মোট ৫৬ শতাংশ পদ কোটার মাধ্যমে পূরণের চিত্রটি মেধাবীদের জন্য নিশ্চয়ই হতাশার সুযোগ সৃষ্টি করে। কোটা পদ্ধতি নিয়ে সরকারি কর্মকমিশনসহ অনেক বিশেষজ্ঞ মহল সরকারের কাছে সংস্কারের সুপারিশ জানালেও এখন পর্যন্ত কোনো কার্যকর উদ্যোগ লক্ষ করা যায়নি। পিএসসি এ পদ্ধতিকে সহজীকরণের জন্য তাগাদা দিয়ে বিভিন্ন সময় উল্লেখ করেছে যে এটি অত্যন্ত জটিল, দুরূহ ও সময়সাপেক্ষ প্রক্রিয়া। শতভাগ নিখুঁতভাবে উপযুক্ত প্রার্থী নির্বাচন এর মাধ্যমে প্রায় অসম্ভব।
৫৬ শতাংশ কোটা অনুসরণের ক্ষেত্রে সাংবিধানিক ন্যায্যতা যাচাই করার লক্ষ্যে ও কোটা পদ্ধতির যৌক্তিকতা নিয়ে বাংলাদেশের সংবিধানে বর্ণিত কতিপয় অনুচ্ছেদ উল্লেখ করতে চাই। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানে ১৯(১) নম্বর ধারায় উল্লেখ আছে, 'সকল নাগরিকের জন্য সুযোগের সমতা নিশ্চিত করিতে রাষ্ট্র সচেষ্ট হইবেন।' ২৮(১) অনুচ্ছেদে বর্ণিত আছে, 'কেবল ধর্ম, গোষ্ঠী, বর্ণ, নারীপুরুষভেদ বা জন্মস্থানের কারণে নাগরিকের প্রতি রাষ্ট্র বৈষম্য প্রদর্শন করিবেন না।' ২৮(২)-এ আছে, 'রাষ্ট্র ও গণজীবনের সর্বস্তরে নারী পুরুষের সমান অধিকার লাভ করিবেন।'
অন্যদিকে সংবিধানের ২৯(১) নম্বর অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, 'প্রজাতন্ত্রের কর্মে নিয়োগ বা পদ-লাভের ক্ষেত্রে সকল নাগরিকের জন্য সুযোগের সমতা থাকিবে।' ২৯(২) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, 'কেবল ধর্ম, গোষ্ঠী, বর্ণ, নারীপুরুষভেদ বা জন্মস্থানের কারণে কোন নাগরিক প্রজাতন্ত্রের কর্মে নিয়োগ বা পদ-লাভের অযোগ্য হইবেন না কিংবা সেই ক্ষেত্রে তাঁহার প্রদর্শন করা যাইবে না।' অবশ্য সংবিধানের ২৯(৩)(ক)তে বলা আছে, 'নাগরিকদের যে কোন অনগ্রসর অংশ যাহাতে প্রজাতন্ত্রের কর্মে উপযুক্ত প্রতিনিধিত্ব লাভ করতে পারেন, সেই উদ্দেশ্যে তাঁহাদের অনুকূলে বিশেষ বিধান-প্রণয়ন করা হইতে রাষ্ট্রকে নিবৃত্ত করিবে না।' একই অনুচ্ছেদের প্রথম ধারায় এক ধরনের বিধান ও অন্য ধারায় ভিন্ন এবং অনেকটাই সাংঘর্ষিক বিধান লিপিবদ্ধ আছে।
সংবিধানের ৪০ নম্বর অনুচ্ছেদে বর্ণিত আছে, 'আইনের দ্বারা আরোপিত বাধানিষেধ সাপেক্ষে কোন পেশা বা বৃত্তি গ্রহণের কিংবা কারবার বা ব্যবসায়-পরিচালনার জন্য আইনের দ্বারা কোন যোগ্যতা নির্ধারিত হইয়া থাকিলে অনুরূপ যোগ্যতা সম্পন্ন প্রত্যেক নাগরিকের যে কোন অইনসঙ্গত পেশা বা বৃত্তি-গ্রহণের এবং যে কোন আইনসঙ্গত কারবার বা ব্যবসায়-পরিচালনার অধিকার থাকিবে।'
সংবিধানের উল্লিখিত ধারাগুলো বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, নাগরিকদের সুযোগের সমতা নিশ্চিত করার বিষয়ে সংবিধানে স্পষ্টভাবে উল্লেখ থাকলেও চাকরি ক্ষেত্রে বিদ্যমান কোটা সে ক্ষেত্রে প্রশ্নের সম্মুখীন করে। বাংলাদেশে সরকারি চাকরিতে যে কোটা অনুসরণ করা হয়, তা অনেক ক্ষেত্রেই সংবিধানের এ ধারণাগুলোর সঙ্গে সাংঘর্ষিক। কোটা পদ্ধতি কতটুকু যুক্তিযুক্ত, সে প্রসঙ্গে আমি আরো দু-একটি কথা পরিষ্কারভাবে বলতে চাই। প্রথমত. বাংলাদেশের সংবিধানে নাগরিকদের জন্য কর্মসংস্থানের সমান সুযোগের নিশ্চয়তার বিধান রয়েছে; কিন্তু তা সত্ত্বেও কোটা পদ্ধতির ফলে সেটা যথাযথ অনুসরণ সম্ভব হচ্ছে না। দ্বিতীয়ত. সংবিধানে অনগ্রসর সমাজের জন্য একটি ব্যতিক্রমী ব্যবস্থা হিসেবে কোটা পদ্ধতি সংরক্ষণের বিধান থাকলেও দেশের সমগ্র নাগরিকের সমান সুযোগের নিশ্চয়তাকে বাধাগ্রস্ত করে নয়। তৃতীয়ত. কোটা পদ্ধতির সুনির্দিষ্ট নীতিমালা না থাকায় অর্থাৎ চাকরিভেদে ভিন্ন ভিন্ন কোটা অনুসরণ করাতে এর স্বচ্ছতা অনেকটাই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। চতুর্থত. কোটা পদ্ধতির মাধ্যমে নিয়োগ কখনোই সরকারি কর্মকমিশনের মাধ্যমে অথবা সরকারের মাধ্যমে সুস্পষ্ট গেজেট জনসমক্ষে প্রকাশ করা হয়নি। পঞ্চমত. কোটার ফলে অপেক্ষাকৃত কম মেধাবীরা সরকারের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা হিসেবে নিয়োগ পাচ্ছে, যেখানে কোটার আওতায় না পরে তার চেয়ে অনেক বেশি মেধাবী প্রার্থী বঞ্চিত হচ্ছে। ফলে এর একটি নেতিবাচক প্রভাব সমাজের ওপর পড়ছে, যা জাতিকে যথাযথ অগ্রসর করতে বাধাগ্রস্ত করছে। ষষ্ঠত. কোটাব্যবস্থা সংবিধানে বর্ণিত মৌলিক অধিকারের পরিপন্থী।
সরকারি পদসমূহে জনবল নিয়োগ রাষ্ট্রের খুব গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়। উচ্চশিক্ষায় অধ্যয়নরত বেশির ভাগ শিক্ষার্থীর জীবনের অন্যতম লক্ষ্য থাকে বিসিএস পরীক্ষা দিয়ে প্রথম শ্রেণীর সরকারি পদে অধিষ্ঠিত হওয়া। সরকারও তার রাষ্ট্রযন্ত্র পরিচালনা করার জন্য প্রয়োজনীয় শ্রেষ্ঠ মানবসম্পদ এ-সংক্রান্ত প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার মধ্য দিয়ে নির্বাচন করে থাকে। তাই সরকারকে নিয়োগ প্রক্রিয়ার কোটাসংক্রান্ত জটিলতা নিরসন করে নাগরিকদের সুযোগের সমতার নিশ্চয়তা প্রদানসহ স্বচ্ছতা আনয়ন জরুরি। পাশাপাশি কোটা প্রয়োগের ব্যাপকতা কমিয়ে আনা যায় কি না সেটাও পুনর্বিবেচনা সাপেক্ষে যথাযথ ইতিবাচক সিদ্ধান্ত দ্রুত নেওয়া জরুরি। জাতি-লিঙ্গ-অঞ্চল নির্বিশেষে অনগ্রসর জনগোষ্ঠীর পৃষ্ঠপোষকতার প্রয়োজন রয়েছে, কিন্তু সময়ের পরিক্রমায় পৃষ্ঠপোষকতার পরিস্থিতি পর্যালোচনার মাধ্যমে কোটা পদ্ধতি সংস্কারের কোনো বিকল্প নেই।
লেখক : শিক্ষক, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়
sultanmahmud.rana@gmail.com
No comments