শাহবাগ আন্দোলন জনআকাঙ্ক্ষার সঙ্গে কতটা সঙ্গতিপূর্ণ?
জামায়াত
নেতা কাদের মোল্লাকে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২ গত ৫ ফেব্র“য়ারি
যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের সাজা দিলে পরদিন কয়েকজন ব্লগার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের
চারুকলা ইন্সটিটিউটের সামনে মানববন্ধনের মাধ্যমে এর প্রতিবাদ করেন। এ
প্রতিবাদ কর্মসূচিকে সূচনালগ্ন থেকে যারা পৃষ্ঠপোষকতা করে আসছিলেন, তারা
অচিরেই এটিকে গণজাগরণ নামে অভিহিত করতে থাকেন। স্বভাবতই প্রশ্ন উঠে,
গণজাগরণ কী? অন্যায়ের প্রতিবিধানে যখন দেশের সব শ্রেণী-পেশার মানুষ
স্বতঃস্ফূর্তভাবে প্রতিবাদী কণ্ঠে রাস্তায় নেমে এসে আন্দোলনের মাধ্যমে
সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য পূরণকল্পে দাবি আদায়ে সোচ্চার হয়, সেটিকে বলা হয়
গণজাগরণ। গণজাগরণ সব সময় শাসক শ্রেণীর প্রতিকূলে হয়ে থাকে। প্রাথমিক
পর্যায়ে গণজাগরণ মঞ্চের কার্যক্রম বিষয়ে ভারতের গণমাধ্যমে সে দেশের
পৃষ্ঠপোষকতার কথা উল্লেখ করা হয়েছে। এ সময় দেশের কতিপয় গণমাধ্যমের বৈরী ও
পক্ষপাতদুষ্ট আচরণ দেশের এক বৃহৎ জনগোষ্ঠীকে হতাশ করেছে। প্রাথমিক পর্যায়ে
দেখা গেছে, গণজাগরণ মঞ্চের অবকাঠামো, নিরাপত্তা, খাদ্য, পানীয়, প্রাথমিক
চিকিৎসা, পয়ঃনিষ্কাশন সেবা প্রভৃতি সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায় নিশ্চিত হয়ে
আসছিল।
দেশের সচেতন সাধারণ মানুষের উপলব্ধি- শেয়ারবাজার, বিদ্যুৎ, জ্বালানি, টেলিযোগাযোগ, পদ্মা সেতু, হলমার্ক, ডেসটিনি প্রভৃতি দুর্নীতি নিয়ে যখন সরকারের জনসমর্থনে ধস নেমেছে, ঠিক তখন মানুষের দৃষ্টি অন্যদিকে ফেরানোর এটি একটি অপপ্রয়াস। তাছাড়া জাতীয় নির্বাচন পূর্ববর্তী তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার দাবিকে অবদমিত করার ক্ষেত্রে এটি একটি অপকৌশল।
গণজাগরণ মঞ্চের আন্দোলনকারীদের পক্ষ থেকে দাবি করা হয়ে আসছিল, মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উজ্জীবিত নতুন প্রজন্মর এটি দ্বিতীয় মুক্তিযুদ্ধ। তাদের দাবিটিকে সঠিক ধরে নিলে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা কী ছিল তা জানা প্রয়োজন। আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধ সংগঠিত হয়েছিল শোষণ ও দুর্নীতিমুক্ত সমাজ বিনির্মাণে কৃষক-শ্রমিক ও মেহনতি মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠা, আইনের শাসনের বাস্তবায়ন, সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা, রাষ্ট্রের সর্বক্ষেত্রে বাংলা ভাষার প্রচলন, দেশের সমন্বিত ও সুষম উন্নয়ন এবং সব নাগরিকের জীবনধারণের মৌলিক উপকরণের ব্যবস্থার জন্য। প্রতিটি আন্দোলনের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য থাকে। শুধু ফাঁসির রায় প্রদান ও কার্যকর করার দাবি নিয়ে আন্দোলন কতটুকু যৌক্তিক? এ ধরনের আন্দোলন সংবিধান স্বীকৃত স্বাধীন বিচার ব্যবস্থার অন্তরায় নয় কি? এ আন্দোলন দেশের শ্রমিক কৃষক মেহনতি মানুষের মুক্তি ও দুর্নীতি এবং শোষণমুক্ত সমাজ প্রতিষ্ঠায় কী অবদান ও আবেদন রেখেছে? গণজাগরণ মঞ্চ হতে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বিষয়ক কোনো বক্তব্য দেয়া হয়েছে কি?
গণজাগরণ মঞ্চের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কতিপয় ব্লগারের মহান আল্লাহ ও হজরত মুহাম্মদকে (স.) নিয়ে অশ্লীল ও কুরুচিপূর্ণ মন্তব্য সম্পর্কে দেশবাসী অবহিত হওয়ার পর দ্রুত গণজাগরণ মঞ্চের নেপথ্য উদ্দেশ্য সম্পর্কে দেশবাসীর ধারণা পাল্টাতে থাকে। এসব ব্লগারের মন্তব্য দেশের ধর্মপ্রাণ মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের ধর্মবিশ্বাসের ভিত্তিমূলে আঘাত হেনেছে। সরকার কেন জনবিচ্ছিন্ন এ ব্লগারদের পক্ষ অবলম্বন করে নিজের অবস্থানকে বিতর্কিত করেছে? একজন ঈমানদার মুসলমানের কর্তব্য সম্পর্কে ধর্মীয় অনুশাসন হল - যে কোনো অন্যায় দেখলে তিনি তা শক্তি দিয়ে প্রতিহত করার চেষ্টা করবেন, যদি শক্তি দিয়ে প্রতিহত করার সুযোগ না থাকে তাহলে মৌখিকভাবে প্রতিবাদ করবেন, আর মৌখিকভাবে প্রতিবাদে অক্ষম হলে মনে মনে অন্যায়কে ঘৃণা করবেন। একজন ঈমানদার মুসলমান মহান আল্লাহ ও হজরত মুহাম্মদকে (স.) নিয়ে অবমাননা ও কটাক্ষ সহ্য করেন না। মাওলানা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর মৃত্যুদণ্ডের রায় ঘোষণার আগের দিন মতিঝিলের সমাবেশ থেকে গণজাগরণ মঞ্চের মুখপাত্র বলেছিলেন, ‘আমরা আগামীকাল ফাঁসির রায় নিয়ে উল্লাস করে বাড়ি ফিরব।’ এ ধরনের বক্তব্য অনাকাক্সিক্ষত, অনভিপ্রেত এবং স্বাধীন বিচার ব্যবস্থাকে বাধাগ্রস্ত করে। তাই সবার প্রত্যাশা ছিল, বক্তব্য প্রদান-পরবর্তী আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের পক্ষ থেকে আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়া হবে। কিন্তু কার্যক্ষেত্রে কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ না করায় দেশবাসী হতাশ হয়েছে।
ব্লগার রাজীব এবং নারায়ণগঞ্জের সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্বের পুত্র ত্বকী হত্যার পর কোনো ধরনের অনুসন্ধান ছাড়াই বলা হল, এগুলো জামায়াত-শিবিরের কাজ। পরবর্তীকালে দেখা গেল, প্রথমোক্ত হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে হিজবুত তাহরীর নামক একটি সংগঠন এবং শেষোক্তটির সঙ্গে নারায়ণগঞ্জের একটি বিশেষ পরিবারের সম্পৃক্ততার চাঞ্চল্যকর তথ্যের উদয় হয়েছে। বিভিন্ন স্থানে মন্দির ভাঙা, আগুন দেয়া ও সংখ্যালঘুদের বাড়িঘরে হামলার সঙ্গে জামায়াত-শিবির সম্পৃক্ত বলে আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে। কিন্তু এ ব্যাপারে বিরোধী দল ও সাধারণ মানুষের বক্তব্য এর বিপরীত। এমনকি সংখ্যালঘু হিন্দুদের পক্ষ থেকেও বলা হচ্ছে ভিন্ন কথা। দেশের সচেতন জনগোষ্ঠী মনে করে, নিরপেক্ষ ব্যক্তির সমন্বয়ে তদন্ত কমিটি করা হলে প্রকৃত সত্য বেরিয়ে আসবে। অতীতে বহুবার বিভিন্ন ক্ষমতাসীন দল হিন্দু সংখ্যালঘুদের ওপর অত্যাচার-নিপীড়ন করে দোষ বিরোধীদের ঘাড়ে চাপিয়ে ভারতের সমর্থন ও সহানুভূূতি লাভের চেষ্টা করেছে। ভারত সরকারও অবহিত অতীত ও বর্তমানে কারা সংখ্যালঘুদের ওপর অত্যাচার করেছে এবং অন্যের ওপর দোষ চাপিয়ে কারা ফায়দা লোটার চেষ্টা করছে। রামুর ঘটনার প্রতি দৃষ্টি নিবদ্ধ করলে দেখা যায়, সেখানেও একটি বিশেষ মহল নেপথ্যে থেকে ঘটনা সংগঠনে ইন্ধন যুগিয়েছে এবং এক্ষেত্রেও রাজনৈতিক ফায়দা ছিল মুখ্য। দেশের প্রধান বিরোধী দল বিএনপি নেত্রী খালেদা জিয়া শাহবাগের আন্দোলনকারীদের নাস্তিক, নষ্ট ও আওয়ামী ঘরানার আখ্যা দিয়ে বক্তব্য প্রদান করেছেন। দ্বিতীয় বৃহত্তম বিরোধী দল জাতীয় পার্টির নেতা এরশাদও শাহবাগের আন্দোলনকে সমর্থন করেননি এবং স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছেন, তিনি সেখানে যাবেন না। অপরদিকে শাহবাগ আন্দোলনের পৃষ্ঠপোষকতা ও সমর্থনে দেখা যায়, আওয়ামী লীগের পাশে রয়েছে জনসমর্থহীন কতিপয় নেতাসর্বস্ব বাম ঘরানার দল এবং এসব দলের ছাত্র ও যুব সংগঠন।
শাহবাগ আন্দোলনের মুখপাত্রকে দেখা গেছে জাতীয় পতাকা উত্তোলন, নীরবতা পালন এবং স্কুল-কলেজে কর্মসূচি পালন বিষয়ে মঞ্চ থেকে তিনি যখন যে ঘোষণা দিয়েছেন, সে ঘোষণা বাস্তবায়নে সরকার সচেষ্ট ছিল। দেশবাসী নিশ্চয়ই অবহিত পতাকা উড়ানো বিষয়ে সংবিধান ও আইনে সুনির্দিষ্টভাবে বিধানাবলী দেয়া আছে। এর ব্যত্যয়ে সরকারিভাবে দায়িত্বপ্রাপ্ত নন এমন কোনো ব্যক্তির পক্ষ থেকে পতাকা উড়ানো বিষয়ে কোনো নির্দেশনা এলে সেটি সংবিধান ও প্রচলিত আইনের লংঘন ও অবমাননা নয় কি? তাছাড়া এ মুখপাত্রের নির্দেশনায় সরকারের মন্ত্রী, সচিবসহ ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের রাস্তায় নেমে এসে তিন মিনিট নীরবতা পালন এবং বিভিন্ন স্কুল-কলেজে মঞ্চ থেকে ঘোাষিত কর্মসূচি পালন দেশের প্রচলিত আইন ও বিধি-বিধান দ্বারা সমর্থিত কি-না তা ভেবে দেখা প্রয়োজন। আর সমর্থিত না হয়ে থাকলে সরকারের পক্ষ থেকে এ মুখপাত্রের বিরুদ্ধে আইন নিজের হাতে তুলে নেয়ার জন্য কী ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে, তা দেশবাসীর জানা প্রয়োজন।
ভারতের বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় সংবাদ বেরিয়েছে, ভারত দ্বিতীয় মেয়াদে আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় দেখতে চায় এবং সে লক্ষ্যে কৌশলও নির্ধারণ করেছে। জনআকাক্সক্ষার বিপরীতে কোনো সরকারকে পৃথিবীর কোনো দেশে কোনো বহিঃশক্তি কি ক্ষমতায় রাখতে পেরেছে? তর্কের খাতিরে যদি ধরে নেই, ক্ষমতায় রাখতে পারবে তখন সেটির স্থায়িত্ব কতদিন হবে? অভিজ্ঞতা বলে, পৃথিবীর কোথাও এ ধরনের সরকার স্থায়িত্ব পায়নি। প্রশাসন নিরপেক্ষ না হলে বহিঃশক্তির সমর্থন যে নির্বাচনকে প্রভাবিত করতে পারে না, তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ ’৮৬র তৃতীয় জাতীয় সংসদ নির্বাচন। সে নির্বাচনে আওয়ামী লীগ অংশগ্রহণ করলেও এবং নির্বাচনী ফলাফলে জনমত পক্ষে থাকা সত্ত্বেও তাদের আকাক্সক্ষার প্রতিফলন ঘটাতে পারেনি।
শাহবাগ আন্দোলনের মূল লক্ষ্য যদি হয়ে থাকে যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসি ও এর কার্যকর, সেক্ষেত্রে রাজাকার, আলবদর ও আলশামসের তালিকা করে নিহত ও জীবিতদের সংখ্যা নিরূপণের কাজটি সমাধা করা অত্যন্ত জরুরি। বর্তমানে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার হচ্ছে। এ মানবতাবিরোধী অপরাধে চার ধরনের অপরাধ অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। যথা- গণহত্যা, লুণ্ঠন, অগ্নিসংযোগ ও ধর্ষণ। দেশের সব শ্রেণী-পেশা ও দলমত নির্বিশেষে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার চায়। কিন্তু সে বিচার হতে হবে আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন, স্বচ্ছ, প্রশ্নাতীত ও সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত। বঙ্গবন্ধুকে যখন আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় সম্পৃক্ত করা হয়েছিল, তখন ঔপনিবেশিক পাকিস্তানি শাসকরা বঙ্গবন্ধুর পক্ষে প্রখ্যাত ব্রিটিশ আইনজীবী টমাস উইলিয়ামকে নিয়োগের বিষয়ে কোনো বাধা সৃষ্টি করেনি। কিন্তু যুদ্ধাপরাধের মামলার ক্ষেত্রে দেখা যায় বিদেশী আইনজীবী নিয়োগে বিভিন্নভাবে অন্তরায় সৃষ্টি করা হচ্ছে। নিঃসন্দেহে বলা যায়, বিদেশী আইনজীবীদের আসামিদের পক্ষে নিয়োগের সুযোগ দেয়া হলে বিচারের আন্তর্জাতিক মান সম্পর্কে কোনো মহল থেকে কোনো ধরনের প্রশ্ন উত্থাপনের সুযোগ থাকত না। ঔপনিবেশিক পাকিস্তানি শাসকরা বঙ্গবন্ধুর ক্ষেত্রে যে সুযোগ দিয়েছে, স্বাধীন দেশে একই জাতিভুক্ত নাগরিকদের আমরা কেন সে সুযোগ দেব না? শাহবাগের আন্দোলন প্রশ্নে এবং আন্দোলনকারীদের দাবি বিষয়ে জাতি দ্বিধাবিভক্ত। দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের অবস্থান শাহবাগ আন্দোলনকারীদের পক্ষে না বিপক্ষে ছিল এবং আন্দোলনটি স্বতঃস্ফূর্ত ছিল কি-না, সেটা নিরূপণের জন্য আন্দোলনস্থল থেকে আইন-শৃংখলা বাহিনীর সদস্যদের প্রত্যাহার করে আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার কথা যদি বলা হতো, তাহলে পরিস্থিতি কী দাঁড়াত তা বলা মুশকিল।
ইকতেদার আহমেদ : সাবেক জেলা জজ ও সাবেক রেজিস্ট্রার, সুপ্রিমকোর্ট
দেশের সচেতন সাধারণ মানুষের উপলব্ধি- শেয়ারবাজার, বিদ্যুৎ, জ্বালানি, টেলিযোগাযোগ, পদ্মা সেতু, হলমার্ক, ডেসটিনি প্রভৃতি দুর্নীতি নিয়ে যখন সরকারের জনসমর্থনে ধস নেমেছে, ঠিক তখন মানুষের দৃষ্টি অন্যদিকে ফেরানোর এটি একটি অপপ্রয়াস। তাছাড়া জাতীয় নির্বাচন পূর্ববর্তী তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার দাবিকে অবদমিত করার ক্ষেত্রে এটি একটি অপকৌশল।
গণজাগরণ মঞ্চের আন্দোলনকারীদের পক্ষ থেকে দাবি করা হয়ে আসছিল, মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উজ্জীবিত নতুন প্রজন্মর এটি দ্বিতীয় মুক্তিযুদ্ধ। তাদের দাবিটিকে সঠিক ধরে নিলে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা কী ছিল তা জানা প্রয়োজন। আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধ সংগঠিত হয়েছিল শোষণ ও দুর্নীতিমুক্ত সমাজ বিনির্মাণে কৃষক-শ্রমিক ও মেহনতি মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠা, আইনের শাসনের বাস্তবায়ন, সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা, রাষ্ট্রের সর্বক্ষেত্রে বাংলা ভাষার প্রচলন, দেশের সমন্বিত ও সুষম উন্নয়ন এবং সব নাগরিকের জীবনধারণের মৌলিক উপকরণের ব্যবস্থার জন্য। প্রতিটি আন্দোলনের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য থাকে। শুধু ফাঁসির রায় প্রদান ও কার্যকর করার দাবি নিয়ে আন্দোলন কতটুকু যৌক্তিক? এ ধরনের আন্দোলন সংবিধান স্বীকৃত স্বাধীন বিচার ব্যবস্থার অন্তরায় নয় কি? এ আন্দোলন দেশের শ্রমিক কৃষক মেহনতি মানুষের মুক্তি ও দুর্নীতি এবং শোষণমুক্ত সমাজ প্রতিষ্ঠায় কী অবদান ও আবেদন রেখেছে? গণজাগরণ মঞ্চ হতে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বিষয়ক কোনো বক্তব্য দেয়া হয়েছে কি?
গণজাগরণ মঞ্চের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কতিপয় ব্লগারের মহান আল্লাহ ও হজরত মুহাম্মদকে (স.) নিয়ে অশ্লীল ও কুরুচিপূর্ণ মন্তব্য সম্পর্কে দেশবাসী অবহিত হওয়ার পর দ্রুত গণজাগরণ মঞ্চের নেপথ্য উদ্দেশ্য সম্পর্কে দেশবাসীর ধারণা পাল্টাতে থাকে। এসব ব্লগারের মন্তব্য দেশের ধর্মপ্রাণ মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের ধর্মবিশ্বাসের ভিত্তিমূলে আঘাত হেনেছে। সরকার কেন জনবিচ্ছিন্ন এ ব্লগারদের পক্ষ অবলম্বন করে নিজের অবস্থানকে বিতর্কিত করেছে? একজন ঈমানদার মুসলমানের কর্তব্য সম্পর্কে ধর্মীয় অনুশাসন হল - যে কোনো অন্যায় দেখলে তিনি তা শক্তি দিয়ে প্রতিহত করার চেষ্টা করবেন, যদি শক্তি দিয়ে প্রতিহত করার সুযোগ না থাকে তাহলে মৌখিকভাবে প্রতিবাদ করবেন, আর মৌখিকভাবে প্রতিবাদে অক্ষম হলে মনে মনে অন্যায়কে ঘৃণা করবেন। একজন ঈমানদার মুসলমান মহান আল্লাহ ও হজরত মুহাম্মদকে (স.) নিয়ে অবমাননা ও কটাক্ষ সহ্য করেন না। মাওলানা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর মৃত্যুদণ্ডের রায় ঘোষণার আগের দিন মতিঝিলের সমাবেশ থেকে গণজাগরণ মঞ্চের মুখপাত্র বলেছিলেন, ‘আমরা আগামীকাল ফাঁসির রায় নিয়ে উল্লাস করে বাড়ি ফিরব।’ এ ধরনের বক্তব্য অনাকাক্সিক্ষত, অনভিপ্রেত এবং স্বাধীন বিচার ব্যবস্থাকে বাধাগ্রস্ত করে। তাই সবার প্রত্যাশা ছিল, বক্তব্য প্রদান-পরবর্তী আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের পক্ষ থেকে আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়া হবে। কিন্তু কার্যক্ষেত্রে কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ না করায় দেশবাসী হতাশ হয়েছে।
ব্লগার রাজীব এবং নারায়ণগঞ্জের সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্বের পুত্র ত্বকী হত্যার পর কোনো ধরনের অনুসন্ধান ছাড়াই বলা হল, এগুলো জামায়াত-শিবিরের কাজ। পরবর্তীকালে দেখা গেল, প্রথমোক্ত হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে হিজবুত তাহরীর নামক একটি সংগঠন এবং শেষোক্তটির সঙ্গে নারায়ণগঞ্জের একটি বিশেষ পরিবারের সম্পৃক্ততার চাঞ্চল্যকর তথ্যের উদয় হয়েছে। বিভিন্ন স্থানে মন্দির ভাঙা, আগুন দেয়া ও সংখ্যালঘুদের বাড়িঘরে হামলার সঙ্গে জামায়াত-শিবির সম্পৃক্ত বলে আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে। কিন্তু এ ব্যাপারে বিরোধী দল ও সাধারণ মানুষের বক্তব্য এর বিপরীত। এমনকি সংখ্যালঘু হিন্দুদের পক্ষ থেকেও বলা হচ্ছে ভিন্ন কথা। দেশের সচেতন জনগোষ্ঠী মনে করে, নিরপেক্ষ ব্যক্তির সমন্বয়ে তদন্ত কমিটি করা হলে প্রকৃত সত্য বেরিয়ে আসবে। অতীতে বহুবার বিভিন্ন ক্ষমতাসীন দল হিন্দু সংখ্যালঘুদের ওপর অত্যাচার-নিপীড়ন করে দোষ বিরোধীদের ঘাড়ে চাপিয়ে ভারতের সমর্থন ও সহানুভূূতি লাভের চেষ্টা করেছে। ভারত সরকারও অবহিত অতীত ও বর্তমানে কারা সংখ্যালঘুদের ওপর অত্যাচার করেছে এবং অন্যের ওপর দোষ চাপিয়ে কারা ফায়দা লোটার চেষ্টা করছে। রামুর ঘটনার প্রতি দৃষ্টি নিবদ্ধ করলে দেখা যায়, সেখানেও একটি বিশেষ মহল নেপথ্যে থেকে ঘটনা সংগঠনে ইন্ধন যুগিয়েছে এবং এক্ষেত্রেও রাজনৈতিক ফায়দা ছিল মুখ্য। দেশের প্রধান বিরোধী দল বিএনপি নেত্রী খালেদা জিয়া শাহবাগের আন্দোলনকারীদের নাস্তিক, নষ্ট ও আওয়ামী ঘরানার আখ্যা দিয়ে বক্তব্য প্রদান করেছেন। দ্বিতীয় বৃহত্তম বিরোধী দল জাতীয় পার্টির নেতা এরশাদও শাহবাগের আন্দোলনকে সমর্থন করেননি এবং স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছেন, তিনি সেখানে যাবেন না। অপরদিকে শাহবাগ আন্দোলনের পৃষ্ঠপোষকতা ও সমর্থনে দেখা যায়, আওয়ামী লীগের পাশে রয়েছে জনসমর্থহীন কতিপয় নেতাসর্বস্ব বাম ঘরানার দল এবং এসব দলের ছাত্র ও যুব সংগঠন।
শাহবাগ আন্দোলনের মুখপাত্রকে দেখা গেছে জাতীয় পতাকা উত্তোলন, নীরবতা পালন এবং স্কুল-কলেজে কর্মসূচি পালন বিষয়ে মঞ্চ থেকে তিনি যখন যে ঘোষণা দিয়েছেন, সে ঘোষণা বাস্তবায়নে সরকার সচেষ্ট ছিল। দেশবাসী নিশ্চয়ই অবহিত পতাকা উড়ানো বিষয়ে সংবিধান ও আইনে সুনির্দিষ্টভাবে বিধানাবলী দেয়া আছে। এর ব্যত্যয়ে সরকারিভাবে দায়িত্বপ্রাপ্ত নন এমন কোনো ব্যক্তির পক্ষ থেকে পতাকা উড়ানো বিষয়ে কোনো নির্দেশনা এলে সেটি সংবিধান ও প্রচলিত আইনের লংঘন ও অবমাননা নয় কি? তাছাড়া এ মুখপাত্রের নির্দেশনায় সরকারের মন্ত্রী, সচিবসহ ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের রাস্তায় নেমে এসে তিন মিনিট নীরবতা পালন এবং বিভিন্ন স্কুল-কলেজে মঞ্চ থেকে ঘোাষিত কর্মসূচি পালন দেশের প্রচলিত আইন ও বিধি-বিধান দ্বারা সমর্থিত কি-না তা ভেবে দেখা প্রয়োজন। আর সমর্থিত না হয়ে থাকলে সরকারের পক্ষ থেকে এ মুখপাত্রের বিরুদ্ধে আইন নিজের হাতে তুলে নেয়ার জন্য কী ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে, তা দেশবাসীর জানা প্রয়োজন।
ভারতের বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় সংবাদ বেরিয়েছে, ভারত দ্বিতীয় মেয়াদে আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় দেখতে চায় এবং সে লক্ষ্যে কৌশলও নির্ধারণ করেছে। জনআকাক্সক্ষার বিপরীতে কোনো সরকারকে পৃথিবীর কোনো দেশে কোনো বহিঃশক্তি কি ক্ষমতায় রাখতে পেরেছে? তর্কের খাতিরে যদি ধরে নেই, ক্ষমতায় রাখতে পারবে তখন সেটির স্থায়িত্ব কতদিন হবে? অভিজ্ঞতা বলে, পৃথিবীর কোথাও এ ধরনের সরকার স্থায়িত্ব পায়নি। প্রশাসন নিরপেক্ষ না হলে বহিঃশক্তির সমর্থন যে নির্বাচনকে প্রভাবিত করতে পারে না, তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ ’৮৬র তৃতীয় জাতীয় সংসদ নির্বাচন। সে নির্বাচনে আওয়ামী লীগ অংশগ্রহণ করলেও এবং নির্বাচনী ফলাফলে জনমত পক্ষে থাকা সত্ত্বেও তাদের আকাক্সক্ষার প্রতিফলন ঘটাতে পারেনি।
শাহবাগ আন্দোলনের মূল লক্ষ্য যদি হয়ে থাকে যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসি ও এর কার্যকর, সেক্ষেত্রে রাজাকার, আলবদর ও আলশামসের তালিকা করে নিহত ও জীবিতদের সংখ্যা নিরূপণের কাজটি সমাধা করা অত্যন্ত জরুরি। বর্তমানে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার হচ্ছে। এ মানবতাবিরোধী অপরাধে চার ধরনের অপরাধ অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। যথা- গণহত্যা, লুণ্ঠন, অগ্নিসংযোগ ও ধর্ষণ। দেশের সব শ্রেণী-পেশা ও দলমত নির্বিশেষে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার চায়। কিন্তু সে বিচার হতে হবে আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন, স্বচ্ছ, প্রশ্নাতীত ও সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত। বঙ্গবন্ধুকে যখন আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় সম্পৃক্ত করা হয়েছিল, তখন ঔপনিবেশিক পাকিস্তানি শাসকরা বঙ্গবন্ধুর পক্ষে প্রখ্যাত ব্রিটিশ আইনজীবী টমাস উইলিয়ামকে নিয়োগের বিষয়ে কোনো বাধা সৃষ্টি করেনি। কিন্তু যুদ্ধাপরাধের মামলার ক্ষেত্রে দেখা যায় বিদেশী আইনজীবী নিয়োগে বিভিন্নভাবে অন্তরায় সৃষ্টি করা হচ্ছে। নিঃসন্দেহে বলা যায়, বিদেশী আইনজীবীদের আসামিদের পক্ষে নিয়োগের সুযোগ দেয়া হলে বিচারের আন্তর্জাতিক মান সম্পর্কে কোনো মহল থেকে কোনো ধরনের প্রশ্ন উত্থাপনের সুযোগ থাকত না। ঔপনিবেশিক পাকিস্তানি শাসকরা বঙ্গবন্ধুর ক্ষেত্রে যে সুযোগ দিয়েছে, স্বাধীন দেশে একই জাতিভুক্ত নাগরিকদের আমরা কেন সে সুযোগ দেব না? শাহবাগের আন্দোলন প্রশ্নে এবং আন্দোলনকারীদের দাবি বিষয়ে জাতি দ্বিধাবিভক্ত। দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের অবস্থান শাহবাগ আন্দোলনকারীদের পক্ষে না বিপক্ষে ছিল এবং আন্দোলনটি স্বতঃস্ফূর্ত ছিল কি-না, সেটা নিরূপণের জন্য আন্দোলনস্থল থেকে আইন-শৃংখলা বাহিনীর সদস্যদের প্রত্যাহার করে আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার কথা যদি বলা হতো, তাহলে পরিস্থিতি কী দাঁড়াত তা বলা মুশকিল।
ইকতেদার আহমেদ : সাবেক জেলা জজ ও সাবেক রেজিস্ট্রার, সুপ্রিমকোর্ট
No comments