সাম্প্রতিক প্রসঙ্গ-শাইনিং ইন্ডিয়ায় দামিনী হত্যা :জীবন আমার বোন by অদিতি ফাল্গুনী
'জীবন আমার বোন উছলে উঠেছে আজ, বসন্তের বৃষ্টি আছড়ে পড়ছে কাচের টুকরোর মতো (মাই সিস্টার-লাইফ ইজ ওভারফ্লোয়িং টুডে, স্প্রি্রং রেইন শ্যাটারিং ইটসেল্ফ লাইক গ্গ্নাস)!' লিখেছিলেন রুশ কবি বরিস পাস্তেরনাক।
বরিস পাস্তেরনাকের 'সিস্টার লাইফ' থেকেই অনুপ্রাণিত হয়ে কি-না জানি না, আমাদের বাংলাদেশের প্রয়াত কথাসাহিত্যিক মাহমুদুল হকের 'জীবন আমার বোন'-এ এক আশ্চর্য কাপুরুষ ও পলাতক নায়কের কাহিনী আমরা জানতে পেরেছিলাম, যে ১৯৭১-এ যুদ্ধে অংশগ্রহণ বা আত্মত্যাগ দূরে থাক, নিজের তরুণী বোনটিকেও রক্ষা করতে পারেনি।
দিলি্লর ২৩ বছরের চিকিৎসাবিদ্যার ছাত্রী দামিনী রোববারের রাত সাড়ে ৯টায় সিনেমা দেখে এক সুখী মুহূর্তেই হয়তো প্রিয় বন্ধুর সঙ্গে বাসে উঠেছিল বাড়ি ফেরার জন্য। জীবনপাত্র উছলে মাধুরীতে ভরে না উঠলেও মেয়েটির জীবন ভরাই ছিল নিশ্চিত। চিকিৎসাবিজ্ঞান পড়ছিল। বাবা-মা, দুই ভাই, প্রিয় বন্ধু আর পড়াশোনা নিয়ে সামনে উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ গড়ার সময়। কী হলো? কেন অকস্মাৎ নিজের দেশ ও নিজের শহরে বাসযাত্রীদের অশালীন মন্তব্যের প্রতিবাদে শুধু গণধর্ষিতই নয়, হতে হলো অসম্ভব নিপীড়নের শিকার? পাঁচ-ছ'জন বাসযাত্রী তাকে গণধর্ষণ করেই ক্ষান্ত হয়নি, গোপনাঙ্গে ঢুকিয়ে দিয়েছে লোহার রড। দু'সপ্তাহ মৃত্যুর সঙ্গে লড়াই করে, মস্তিষ্ক-ফুসফুস-তলপেটে গুরুতর জখম নিয়ে তাকে মরতে হলো! আচ্ছা, সব দেশের ধর্ষিতা মেয়েদের মেডিকেল রিপোর্ট কি একই রকম হয়? আমাদের দেশের ইয়াসমিনের মৃত্যুর পর মেডিকেল রিপোর্টে যেমন লেখা হয়েছিল :'আমাদের মতে, শ্বাসরোধ করে তাকে হত্যা করা হয়েছিল। মাথায় গুরুতর জখম এবং টুঁটি টিপে ধরায় অন্তর্গত রক্তক্ষরণ হয়ে সে মারা যায়। সে গণধর্ষণের শিকার হয়েছিল, যা স্বভাবের দিক থেকে হত্যাচেষ্টার স্বাক্ষরবাহী (ইন আওয়ার অপিনিয়ন, ডেথ ওয়াজ ডিউ টু অ্যাফিক্সিয়া ফলোড বাই ইন্টার্নাল হ্যামারেজ, অ্যাজ আ রেজাল্ট অব থ্রটলিং ফলোড বাই হেড ইনজুরি অ্যান্ড শি ওয়াজ রেপ্ড হুইচ ওয়াজ অ্যান্টি-মর্টেম অ্যান্ড হোমিসাইডাল ইন নেচার: ইয়াসমিন, দ্য ব্যালাড অব আ ফ্লাওয়ার নট অ্যালাউড টু বল্গুম, দ্য ডেইলি স্টার- ১৭ ফেব্রুয়ারি, ১৯৯৮)।'
ভারতীয় সরকার অবশ্য মেয়েটির নিরাপত্তা ও জীবন রক্ষা না করতে পারলেও তার শেষ ক'টি দিনের চিকিৎসাভার বহন করেছে। ক্ষমতাসীন কংগ্রেসের ভয়ার্ত নেতৃবৃন্দ মেয়েটির অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ায় অংশগ্রহণ করেছেন। পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত খবর অনুযায়ী ভারতীয় বিরোধী দলের নেতারা মেয়েটির পরিবারকে ২৫ লাখ ভারতীয় রুপি ক্ষতিপূরণ এবং তার দুই ভাইকে পড়াশোনা শেষে ভালো চাকরি দেওয়ার দাবি জানিয়েছেন। এদিকে দিলি্লতে সরকার গণঅসন্তোষের ভয়ে বিক্ষোভকারীদের সরিয়ে রাখতে নানা পন্থা অবলম্বন করছে বলেও জানা যাচ্ছে।
দামিনী ধর্ষিত, হাসপাতালে ভর্তি থেকে শুরু করে তার মৃত্যু ও মৃত্যুর পরেও ভারত ও ভারতের বাইরের সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে বিশেষজ্ঞ ও নীতিনির্ধারক মহল অবধি নানা ধরনের আলোচনা-বিশ্লেষণের ঝড় উঠেছে। মেয়েদের পোশাক, রাত ক'টা পর্যন্ত তাদের বাইরে থাকা উচিত বা অনুচিত_ সেসব নিয়েও কিছু কথা উঠছে। এই পুরুষতান্ত্রিক সমাজে যেখানে বোরকা পরা নারীও ধর্ষিত হয়, সেখানে পোশাকের জন্য মেয়েরা ধর্ষিত হয়, কি হয় না_ সে বিতর্কে না গেলেও দামিনী হত্যার ঘটনা থেকে একটি প্রশ্ন ঘুরেফিরে সামনে চলে এসেছে। আর সেটা হলো :'শাইনিং ইন্ডিয়া' কতটুকু 'শাইনিং'? এই ধর্ষণকে শুধুই কি একটি ধর্ষণ, একটি অপরাধমূলক ঘটনা হিসেবে দেখা হবে, নাকি আমরা অপরাধের সমাজতত্ত্বও আলোচনা করব? বিশ্বব্যাংকের অর্থনীতিবিদ মনমোহন সিংয়ের প্রেসক্রিপশন অনুযায়ী নব্বইয়ের দশক থেকে ভারত যে নিও-লিবারেল অর্থনীতির ধারার অনুসারী হয়েছে, অর্থনীতির যে নয়া উদারীকরণ ভারতে গত দুই দশকে একটি বিপুল মধ্যবিত্ত ক্রেতা ও ভোক্তা শ্রেণীর জন্ম দিয়েছে, যারা পোশাক ও ভাষায় ক্রমাগত পশ্চিমা হয়ে উঠেছে, সেই উদারীকরণের অভিঘাতে ভারতে ক্রমাগত দরিদ্ররা আরও দরিদ্র হচ্ছে কি-না? সমাজে বিভিন্ন শ্রেণীর ভেতর বস্তুগত, শিক্ষাগত ও সাংস্কৃতিক মানের বৈষম্য প্রকট থেকে প্রকটতর হচ্ছে কি-না? ভারতের মুম্বাই ও দক্ষিণী ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রি, পর্নো ছবি ও অশালীন বিজ্ঞাপন শিল্পের ঝাঁ-চকচক চোখ ধাঁধানো গল্গ্যামার দুনিয়ার পাদপ্রদীপের আলো থেকে ঠিক কতটা দূরে বাস করে গড় ভারতীয় দরিদ্র মানুষ? একটি ব্যাপার উল্লেখযোগ্য, দিলি্লর ধর্ষণ ঘটনায় জড়িত সবাই বস্তিবাসী যুবক তথা সমাজের নিম্নশ্রেণীর মানুষ।
ইউএনডিপির ২০০৯ সালে প্রদত্ত রিপোর্ট অনুযায়ী, ১৯৮০-২০০৫ নাগাদ ভারতের বার্ষিক প্রবৃদ্ধির হার ৩ দশমিক ৯৫ শতাংশ ছিল, যা ২০০৪ থেকে পরবর্তী বছরগুলোয় ৬ দশমিক ৪ থেকে ৯ দশমিক ৭ শতাংশ হারে উন্নীত হয়। কিন্তু পাশাপাশি মানব উন্নয়ন সূচকে ২০০০ সালে পৃথিবীর ১৭৭টি দেশের ভেতর ১২৪তম স্থান অধিকারী ভারত ২০০৯ সালে ১৮২টি দেশের ভেতর ১৩৪-এ অবনীত হয়েছে। আজও ৮৩৬ মিলিয়ন ভারতীয় বা মোট ভারতীয় জনগণের ৭৭ শতাংশ মানুষ দৈনিক ২০ রুপির চেয়েও কম টাকায় দিন চালায়। ভারতে আজও গ্রামীণ এলাকায় ৪১ দশমিক ৮ শতাংশ এবং শহর এলাকায় ২৫ দশমিক ৭ শতাংশ মানুষ দরিদ্র। ১৯৯৩-৯৪ সালে যেখানে গ্রামীণ দারিদ্র্যের হার ছিল ৭৪ দশমিক ৫ শতাংশ, আজ তা ৮৭ শতাংশ। বৈশ্বিক ক্ষুধা সূচকে (গ্গ্নোবাল হাঙ্গার ইনডেক্স-জিএইচআই) ভারতের অবস্থান পৃথিবীর ৮৪টি দেশের মধ্যে ৬৫। জাতিসংঘের ২০১০ সালের 'বৈশ্বিক সামাজিক অবস্থান' প্রতিবেদনে প্রতিবেশী মিয়ানমার, শ্রীলংকা বা পাকিস্তানের চেয়েও পিছিয়ে রয়েছে ভারত। প্রতি বছরই অসংখ্য কৃষক অভাবের কারণে আত্মহত্যা করছে। পাশাপাশি এই একই ভারতের ১০০ জন শীর্ষ ধনী ব্যক্তির ভেতরে ৫২ জন বিলিয়নেয়ার আছেন এবং এই সংখ্যা গত ২৭ বছরে দ্বিগুণ হয়েছে। এই শীর্ষ ১০০ জন ধনীর মোট সম্পদের পরিমাণ ১৭৬ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের সমপরিমাণ (১৩ লাখ কোটি ভারতীয় রুপি), যা ভারতের মোট জিডিপির এক-চতুর্থাংশ (জিডিপি গ্রোথ অ্যান্ড রাইজিং ইনইক্যুয়ালিটি :প্রয়াগ মিত্র, কাউন্টার কারেন্টস, ২৭ এপ্রিল ২০১০)। ভারতীয় সমাজের একটি অংশের হাতে যখন সঞ্চিত হচ্ছে বিপুল পরিমাণ ধন-সম্পদ, ঠিক তখনি তিন বছর বয়সের কম ৪৬ শতাংশ শিশু স্বল্প ওজন এবং ৫০ ভাগ শিশু অপুষ্টির শিকার। ওয়ার্ল্ড হেলথ অর্গানাইজেশনের ২০০৭-০৮ এর প্রতিবেদন অনুযায়ী পৃথিবীর ১৭৫টি দেশের ভেতর ভারতে জনস্বাস্থ্যে ব্যয় ১৭১তম। শিক্ষা খাতে ১২৮টি দেশের ভেতর ভারতের অবস্থান ১০৫। পঞ্চম শ্রেণী পড়ার আগেই এক-তৃতীয়াংশ শিশু দারিদ্র্যের কারণে ঝরে পড়ে। এই হলো আয়নার সামনে 'শাইনিং ইন্ডিয়া' বা 'উজ্জ্বল ভারত'-এর আসল চেহারা। আয়না- আয়না- বলো আমাকে কতটাই উজ্জ্বল, রূপো চকচকে আমি! যে ভারতীয় তারুণ্য ১৯৭১-এর নকশালবাড়ী আন্দোলনের মাধ্যমে গর্জে উঠতে চেয়েছিল সব সামাজিক বৈষম্য ও অন্যায়ের বিরুদ্ধে, সেই ভারতীয় তারুণ্যকে থামিয়ে দেওয়া হয়েছে। তাকে শেখানো হচ্ছে অর্থনীতি ও কর্মক্ষেত্রের কাঠামোগত অন্যায়কে নীতিনিষ্ঠ প্রতিবাদের বদলে 'ব্যক্তিগত সুবিধাবাদী' আচরণের মাধ্যমে নিজের অনুকূলে নিয়ে আসা। এই 'শাইনিং ইন্ডিয়া'য় তাই আজ শিল্পপতিদের প্রতি বছর ৪ দশমিক ৬ লাখ কোটি টাকা কর ফাঁকিসহ নানা ধরনের আর্থিক সুযোগ দেওয়া হয়। অথচ কৃষক ও দরিদ্ররা বার্ষিক ভর্তুকি পায় মাত্র ১ দশমিক ৫৪ লাখ কোটি টাকা। গোটা আফ্রিকা ও সাব-সাহারান আফ্রিকার চেয়ে এক ভারতেই ক্ষুধার্ত মানুষের সংখ্যা বেশি। শিশুদের রক্তাল্পতা বা অ্যানিমিয়া জিডিপির যে ঘাটতি সূচনা করে, তার হার বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের চেয়ে ভারতেই বেশি।
এখন সামাজিক এই বৈষম্য থেকে নারীর অবস্থান আলাদা করা যাবে কী করে? প্রথম আলো ডেস্ক প্রতিবেদন (৩১ ডিসেম্বর) বিবিসিকে উদৃব্দত করে বলছে, ২০১১ সালে ভারতে ধর্ষণের সংখ্যা আগের বছরের চেয়ে ৯ দশমিক ২ শতাংশ বেড়েছে। ২০১১ সালের পুলিশ রিপোর্ট অনুযায়ী, দেশটিতে আগের বছরের তুলনায় নারী অপহরণ বেড়েছে ১৯ দশমিক ৪ শতাংশ; যৌতুকের জন্য মৃত্যুহার বেড়েছে ২ দশমিক ৭ শতাংশ; প্রহার ৫ দশমিক ৪ শতাংশ; বিভিন্ন ধরনের যৌন নিপীড়ন বেড়েছে ৫ দশমিক ৮ শতাংশ এবং নারী পাচার বেড়েছে ১২২ শতাংশ। পড়ে শিহরিত হলাম যে, যৌতুকের জন্য প্রতি বছর কমপক্ষে এক লাখ নারী আগুনে পুড়ে মারা যান।
একটা ব্যাপার স্পষ্ট। ভারতের শহুরে মধ্যবিত্ত শ্রেণী যতই আগের তুলনায় সচ্ছল ক্রেতা হন বা ভারতীয় মধ্যবিত্ত আজ তার নারীকে শার্ট-প্যান্ট পরিয়ে বা মুখে ইংরেজি বুলি দিয়ে ছেড়ে দিয়ে যদি এই ভেবে আত্মতৃপ্ত হন যে, তারা 'পশ্চিমা' হয়ে উঠছেন; আজও সেই ভারতেই ৫ বছরের কন্যা সন্তানকে তার কাকা কাঁধে চড়িয়ে বিয়ের মণ্ডপে নিয়ে যান বিয়ে দিয়ে সংসারে খাওয়ার মুখ কমাতে। কোটি কোটি ক্ষুধার্ত, দরিদ্র, নিরক্ষর ভারতীয়র কাছে হনুমান আজও পূজনীয় দেবতা; সীতার মতো নারীই 'ভালো' ও 'পবিত্র' নারীর প্রতীক। কোটি কোটি ক্ষুধার্ত ও দরিদ্র যুবক যখন রাজধানী শহরে পাড়ি জমায় কাজের খোঁজে, একদিকে বস্তির বুভুক্ষু জীবন অপরদিকে ট্রামে-বাসে ঝাঁ-চকচকে পশ্চিমা পোশাক পরা ও বিদেশি ভাষা বলা মধ্যবিত্ত নারী সহযাত্রী তার ভেতর সৃষ্টি করতে পারে প্রবল শ্রেণী জুগুপ্সা। নিম্নবর্গের পুরুষ পুরুষ হিসেবেই তার জৈবিক আক্রমণ ক্ষমতার সুযোগ নিয়ে উচ্চতর শ্রেণীর নারীকে নিপীড়নের মাধ্যমে তার জীবনের সব ধরনের অপ্রাপ্তির একটি ফয়সালা খুঁজে নিতে পারে। সেই সঙ্গে ভারতীয় বিনোদন ইন্ডাস্ট্রি ও সিনেমায় ধর্ষণ দৃশ্য, ইভ টিজিংয়ের দৃশ্য, 'আইটেম সং' তথা নারীর নিছক যৌনবস্তুসুলভ উপস্থিতি সমাজে নারীর হীন অবস্থাকে ক্রমাগত জোরদার তো করেই!
দামিনীর ধর্ষক ও হত্যাকারীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি করেও বলা যায়, শুধু আইনের কঠোর প্রয়োগই এ সমস্যার চিরস্থায়ী সমাধান নয়। সমস্যার শিকড় সমাজের ক্রমবর্ধর্মান শ্রেণী দূরত্ব ও অসন্তোষ, সম্পদের বিতরণ ও বণ্টনের ঘোর অসাম্যে প্রোথিত।
অদিতি ফাল্গুনী :লেখক, উন্নয়ন কাজে জড়িত
দিলি্লর ২৩ বছরের চিকিৎসাবিদ্যার ছাত্রী দামিনী রোববারের রাত সাড়ে ৯টায় সিনেমা দেখে এক সুখী মুহূর্তেই হয়তো প্রিয় বন্ধুর সঙ্গে বাসে উঠেছিল বাড়ি ফেরার জন্য। জীবনপাত্র উছলে মাধুরীতে ভরে না উঠলেও মেয়েটির জীবন ভরাই ছিল নিশ্চিত। চিকিৎসাবিজ্ঞান পড়ছিল। বাবা-মা, দুই ভাই, প্রিয় বন্ধু আর পড়াশোনা নিয়ে সামনে উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ গড়ার সময়। কী হলো? কেন অকস্মাৎ নিজের দেশ ও নিজের শহরে বাসযাত্রীদের অশালীন মন্তব্যের প্রতিবাদে শুধু গণধর্ষিতই নয়, হতে হলো অসম্ভব নিপীড়নের শিকার? পাঁচ-ছ'জন বাসযাত্রী তাকে গণধর্ষণ করেই ক্ষান্ত হয়নি, গোপনাঙ্গে ঢুকিয়ে দিয়েছে লোহার রড। দু'সপ্তাহ মৃত্যুর সঙ্গে লড়াই করে, মস্তিষ্ক-ফুসফুস-তলপেটে গুরুতর জখম নিয়ে তাকে মরতে হলো! আচ্ছা, সব দেশের ধর্ষিতা মেয়েদের মেডিকেল রিপোর্ট কি একই রকম হয়? আমাদের দেশের ইয়াসমিনের মৃত্যুর পর মেডিকেল রিপোর্টে যেমন লেখা হয়েছিল :'আমাদের মতে, শ্বাসরোধ করে তাকে হত্যা করা হয়েছিল। মাথায় গুরুতর জখম এবং টুঁটি টিপে ধরায় অন্তর্গত রক্তক্ষরণ হয়ে সে মারা যায়। সে গণধর্ষণের শিকার হয়েছিল, যা স্বভাবের দিক থেকে হত্যাচেষ্টার স্বাক্ষরবাহী (ইন আওয়ার অপিনিয়ন, ডেথ ওয়াজ ডিউ টু অ্যাফিক্সিয়া ফলোড বাই ইন্টার্নাল হ্যামারেজ, অ্যাজ আ রেজাল্ট অব থ্রটলিং ফলোড বাই হেড ইনজুরি অ্যান্ড শি ওয়াজ রেপ্ড হুইচ ওয়াজ অ্যান্টি-মর্টেম অ্যান্ড হোমিসাইডাল ইন নেচার: ইয়াসমিন, দ্য ব্যালাড অব আ ফ্লাওয়ার নট অ্যালাউড টু বল্গুম, দ্য ডেইলি স্টার- ১৭ ফেব্রুয়ারি, ১৯৯৮)।'
ভারতীয় সরকার অবশ্য মেয়েটির নিরাপত্তা ও জীবন রক্ষা না করতে পারলেও তার শেষ ক'টি দিনের চিকিৎসাভার বহন করেছে। ক্ষমতাসীন কংগ্রেসের ভয়ার্ত নেতৃবৃন্দ মেয়েটির অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ায় অংশগ্রহণ করেছেন। পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত খবর অনুযায়ী ভারতীয় বিরোধী দলের নেতারা মেয়েটির পরিবারকে ২৫ লাখ ভারতীয় রুপি ক্ষতিপূরণ এবং তার দুই ভাইকে পড়াশোনা শেষে ভালো চাকরি দেওয়ার দাবি জানিয়েছেন। এদিকে দিলি্লতে সরকার গণঅসন্তোষের ভয়ে বিক্ষোভকারীদের সরিয়ে রাখতে নানা পন্থা অবলম্বন করছে বলেও জানা যাচ্ছে।
দামিনী ধর্ষিত, হাসপাতালে ভর্তি থেকে শুরু করে তার মৃত্যু ও মৃত্যুর পরেও ভারত ও ভারতের বাইরের সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে বিশেষজ্ঞ ও নীতিনির্ধারক মহল অবধি নানা ধরনের আলোচনা-বিশ্লেষণের ঝড় উঠেছে। মেয়েদের পোশাক, রাত ক'টা পর্যন্ত তাদের বাইরে থাকা উচিত বা অনুচিত_ সেসব নিয়েও কিছু কথা উঠছে। এই পুরুষতান্ত্রিক সমাজে যেখানে বোরকা পরা নারীও ধর্ষিত হয়, সেখানে পোশাকের জন্য মেয়েরা ধর্ষিত হয়, কি হয় না_ সে বিতর্কে না গেলেও দামিনী হত্যার ঘটনা থেকে একটি প্রশ্ন ঘুরেফিরে সামনে চলে এসেছে। আর সেটা হলো :'শাইনিং ইন্ডিয়া' কতটুকু 'শাইনিং'? এই ধর্ষণকে শুধুই কি একটি ধর্ষণ, একটি অপরাধমূলক ঘটনা হিসেবে দেখা হবে, নাকি আমরা অপরাধের সমাজতত্ত্বও আলোচনা করব? বিশ্বব্যাংকের অর্থনীতিবিদ মনমোহন সিংয়ের প্রেসক্রিপশন অনুযায়ী নব্বইয়ের দশক থেকে ভারত যে নিও-লিবারেল অর্থনীতির ধারার অনুসারী হয়েছে, অর্থনীতির যে নয়া উদারীকরণ ভারতে গত দুই দশকে একটি বিপুল মধ্যবিত্ত ক্রেতা ও ভোক্তা শ্রেণীর জন্ম দিয়েছে, যারা পোশাক ও ভাষায় ক্রমাগত পশ্চিমা হয়ে উঠেছে, সেই উদারীকরণের অভিঘাতে ভারতে ক্রমাগত দরিদ্ররা আরও দরিদ্র হচ্ছে কি-না? সমাজে বিভিন্ন শ্রেণীর ভেতর বস্তুগত, শিক্ষাগত ও সাংস্কৃতিক মানের বৈষম্য প্রকট থেকে প্রকটতর হচ্ছে কি-না? ভারতের মুম্বাই ও দক্ষিণী ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রি, পর্নো ছবি ও অশালীন বিজ্ঞাপন শিল্পের ঝাঁ-চকচক চোখ ধাঁধানো গল্গ্যামার দুনিয়ার পাদপ্রদীপের আলো থেকে ঠিক কতটা দূরে বাস করে গড় ভারতীয় দরিদ্র মানুষ? একটি ব্যাপার উল্লেখযোগ্য, দিলি্লর ধর্ষণ ঘটনায় জড়িত সবাই বস্তিবাসী যুবক তথা সমাজের নিম্নশ্রেণীর মানুষ।
ইউএনডিপির ২০০৯ সালে প্রদত্ত রিপোর্ট অনুযায়ী, ১৯৮০-২০০৫ নাগাদ ভারতের বার্ষিক প্রবৃদ্ধির হার ৩ দশমিক ৯৫ শতাংশ ছিল, যা ২০০৪ থেকে পরবর্তী বছরগুলোয় ৬ দশমিক ৪ থেকে ৯ দশমিক ৭ শতাংশ হারে উন্নীত হয়। কিন্তু পাশাপাশি মানব উন্নয়ন সূচকে ২০০০ সালে পৃথিবীর ১৭৭টি দেশের ভেতর ১২৪তম স্থান অধিকারী ভারত ২০০৯ সালে ১৮২টি দেশের ভেতর ১৩৪-এ অবনীত হয়েছে। আজও ৮৩৬ মিলিয়ন ভারতীয় বা মোট ভারতীয় জনগণের ৭৭ শতাংশ মানুষ দৈনিক ২০ রুপির চেয়েও কম টাকায় দিন চালায়। ভারতে আজও গ্রামীণ এলাকায় ৪১ দশমিক ৮ শতাংশ এবং শহর এলাকায় ২৫ দশমিক ৭ শতাংশ মানুষ দরিদ্র। ১৯৯৩-৯৪ সালে যেখানে গ্রামীণ দারিদ্র্যের হার ছিল ৭৪ দশমিক ৫ শতাংশ, আজ তা ৮৭ শতাংশ। বৈশ্বিক ক্ষুধা সূচকে (গ্গ্নোবাল হাঙ্গার ইনডেক্স-জিএইচআই) ভারতের অবস্থান পৃথিবীর ৮৪টি দেশের মধ্যে ৬৫। জাতিসংঘের ২০১০ সালের 'বৈশ্বিক সামাজিক অবস্থান' প্রতিবেদনে প্রতিবেশী মিয়ানমার, শ্রীলংকা বা পাকিস্তানের চেয়েও পিছিয়ে রয়েছে ভারত। প্রতি বছরই অসংখ্য কৃষক অভাবের কারণে আত্মহত্যা করছে। পাশাপাশি এই একই ভারতের ১০০ জন শীর্ষ ধনী ব্যক্তির ভেতরে ৫২ জন বিলিয়নেয়ার আছেন এবং এই সংখ্যা গত ২৭ বছরে দ্বিগুণ হয়েছে। এই শীর্ষ ১০০ জন ধনীর মোট সম্পদের পরিমাণ ১৭৬ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের সমপরিমাণ (১৩ লাখ কোটি ভারতীয় রুপি), যা ভারতের মোট জিডিপির এক-চতুর্থাংশ (জিডিপি গ্রোথ অ্যান্ড রাইজিং ইনইক্যুয়ালিটি :প্রয়াগ মিত্র, কাউন্টার কারেন্টস, ২৭ এপ্রিল ২০১০)। ভারতীয় সমাজের একটি অংশের হাতে যখন সঞ্চিত হচ্ছে বিপুল পরিমাণ ধন-সম্পদ, ঠিক তখনি তিন বছর বয়সের কম ৪৬ শতাংশ শিশু স্বল্প ওজন এবং ৫০ ভাগ শিশু অপুষ্টির শিকার। ওয়ার্ল্ড হেলথ অর্গানাইজেশনের ২০০৭-০৮ এর প্রতিবেদন অনুযায়ী পৃথিবীর ১৭৫টি দেশের ভেতর ভারতে জনস্বাস্থ্যে ব্যয় ১৭১তম। শিক্ষা খাতে ১২৮টি দেশের ভেতর ভারতের অবস্থান ১০৫। পঞ্চম শ্রেণী পড়ার আগেই এক-তৃতীয়াংশ শিশু দারিদ্র্যের কারণে ঝরে পড়ে। এই হলো আয়নার সামনে 'শাইনিং ইন্ডিয়া' বা 'উজ্জ্বল ভারত'-এর আসল চেহারা। আয়না- আয়না- বলো আমাকে কতটাই উজ্জ্বল, রূপো চকচকে আমি! যে ভারতীয় তারুণ্য ১৯৭১-এর নকশালবাড়ী আন্দোলনের মাধ্যমে গর্জে উঠতে চেয়েছিল সব সামাজিক বৈষম্য ও অন্যায়ের বিরুদ্ধে, সেই ভারতীয় তারুণ্যকে থামিয়ে দেওয়া হয়েছে। তাকে শেখানো হচ্ছে অর্থনীতি ও কর্মক্ষেত্রের কাঠামোগত অন্যায়কে নীতিনিষ্ঠ প্রতিবাদের বদলে 'ব্যক্তিগত সুবিধাবাদী' আচরণের মাধ্যমে নিজের অনুকূলে নিয়ে আসা। এই 'শাইনিং ইন্ডিয়া'য় তাই আজ শিল্পপতিদের প্রতি বছর ৪ দশমিক ৬ লাখ কোটি টাকা কর ফাঁকিসহ নানা ধরনের আর্থিক সুযোগ দেওয়া হয়। অথচ কৃষক ও দরিদ্ররা বার্ষিক ভর্তুকি পায় মাত্র ১ দশমিক ৫৪ লাখ কোটি টাকা। গোটা আফ্রিকা ও সাব-সাহারান আফ্রিকার চেয়ে এক ভারতেই ক্ষুধার্ত মানুষের সংখ্যা বেশি। শিশুদের রক্তাল্পতা বা অ্যানিমিয়া জিডিপির যে ঘাটতি সূচনা করে, তার হার বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের চেয়ে ভারতেই বেশি।
এখন সামাজিক এই বৈষম্য থেকে নারীর অবস্থান আলাদা করা যাবে কী করে? প্রথম আলো ডেস্ক প্রতিবেদন (৩১ ডিসেম্বর) বিবিসিকে উদৃব্দত করে বলছে, ২০১১ সালে ভারতে ধর্ষণের সংখ্যা আগের বছরের চেয়ে ৯ দশমিক ২ শতাংশ বেড়েছে। ২০১১ সালের পুলিশ রিপোর্ট অনুযায়ী, দেশটিতে আগের বছরের তুলনায় নারী অপহরণ বেড়েছে ১৯ দশমিক ৪ শতাংশ; যৌতুকের জন্য মৃত্যুহার বেড়েছে ২ দশমিক ৭ শতাংশ; প্রহার ৫ দশমিক ৪ শতাংশ; বিভিন্ন ধরনের যৌন নিপীড়ন বেড়েছে ৫ দশমিক ৮ শতাংশ এবং নারী পাচার বেড়েছে ১২২ শতাংশ। পড়ে শিহরিত হলাম যে, যৌতুকের জন্য প্রতি বছর কমপক্ষে এক লাখ নারী আগুনে পুড়ে মারা যান।
একটা ব্যাপার স্পষ্ট। ভারতের শহুরে মধ্যবিত্ত শ্রেণী যতই আগের তুলনায় সচ্ছল ক্রেতা হন বা ভারতীয় মধ্যবিত্ত আজ তার নারীকে শার্ট-প্যান্ট পরিয়ে বা মুখে ইংরেজি বুলি দিয়ে ছেড়ে দিয়ে যদি এই ভেবে আত্মতৃপ্ত হন যে, তারা 'পশ্চিমা' হয়ে উঠছেন; আজও সেই ভারতেই ৫ বছরের কন্যা সন্তানকে তার কাকা কাঁধে চড়িয়ে বিয়ের মণ্ডপে নিয়ে যান বিয়ে দিয়ে সংসারে খাওয়ার মুখ কমাতে। কোটি কোটি ক্ষুধার্ত, দরিদ্র, নিরক্ষর ভারতীয়র কাছে হনুমান আজও পূজনীয় দেবতা; সীতার মতো নারীই 'ভালো' ও 'পবিত্র' নারীর প্রতীক। কোটি কোটি ক্ষুধার্ত ও দরিদ্র যুবক যখন রাজধানী শহরে পাড়ি জমায় কাজের খোঁজে, একদিকে বস্তির বুভুক্ষু জীবন অপরদিকে ট্রামে-বাসে ঝাঁ-চকচকে পশ্চিমা পোশাক পরা ও বিদেশি ভাষা বলা মধ্যবিত্ত নারী সহযাত্রী তার ভেতর সৃষ্টি করতে পারে প্রবল শ্রেণী জুগুপ্সা। নিম্নবর্গের পুরুষ পুরুষ হিসেবেই তার জৈবিক আক্রমণ ক্ষমতার সুযোগ নিয়ে উচ্চতর শ্রেণীর নারীকে নিপীড়নের মাধ্যমে তার জীবনের সব ধরনের অপ্রাপ্তির একটি ফয়সালা খুঁজে নিতে পারে। সেই সঙ্গে ভারতীয় বিনোদন ইন্ডাস্ট্রি ও সিনেমায় ধর্ষণ দৃশ্য, ইভ টিজিংয়ের দৃশ্য, 'আইটেম সং' তথা নারীর নিছক যৌনবস্তুসুলভ উপস্থিতি সমাজে নারীর হীন অবস্থাকে ক্রমাগত জোরদার তো করেই!
দামিনীর ধর্ষক ও হত্যাকারীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি করেও বলা যায়, শুধু আইনের কঠোর প্রয়োগই এ সমস্যার চিরস্থায়ী সমাধান নয়। সমস্যার শিকড় সমাজের ক্রমবর্ধর্মান শ্রেণী দূরত্ব ও অসন্তোষ, সম্পদের বিতরণ ও বণ্টনের ঘোর অসাম্যে প্রোথিত।
অদিতি ফাল্গুনী :লেখক, উন্নয়ন কাজে জড়িত
No comments