বর্ষবরণ by এম আবদুল হাফিজ
মাত্র ক'দিন আগে চরম উন্মাদনার মধ্য দিয়ে জীর্ণ-পুরনোকে ঝেড়ে ফেলে ২০১৩ সালের বর্ষবরণ হলো। অন্তত গণমাধ্যমের প্রতিবেদন সেইভাবেই কালের এই পরিবর্তনকে উপস্থাপন করেছে।
আমার চেতনায় খটকা কিন্তু লেগেই আছে :তাও কি সম্ভব! সময় পরিমাপক যন্ত্রে সামান্য একটি ক্লিকে কি জীর্ণ-পুরনোকে বর্জন করে মানুষ সামনে এগোতে পারে? স্বজনদের কাছে কি বিশ্বজিৎ দাস এমনই শুধু একটি বর্জ্য আবর্জনা বা তাহসিনা রুশদির কাছে ইলিয়াস আলী অথবা স্বজন, বন্ধু ও সহকর্মীদের কাছে সাগর-রুনি? নাহ্, এরা কেউ কোনো জীর্ণ-পুরনো বর্জ্য নয়। সময়ের গণ্ডি পেরিয়ে এদের ধারাবাহিকতা থেকেই যায়। থেকে যায় নেতিবাচক ও ইতিবাচক উভয় প্রবণতারই রেশ এবং সেসব প্রভাব ফেলতে থাকে আগামীর ওপর। সময় একটি বহমান প্রক্রিয়া, যা প্রতিটি বছরের মাইলফলককে অতিক্রম করে সামনে এগোতেই থাকে।
কয়েক মাস আগে যখন নিশ্চিন্তপুরের তাজরীন ফ্যাশনের অগি্নকাণ্ডে শতাধিক নারী শ্রমিক দগ্ধ হয়ে অঙ্গারে পরিণত হয়, তাৎক্ষণিকভাবে এ নিয়ে দেশের অভ্যন্তরে এবং বহির্বিশ্বে প্রচুর বিতর্ক হয়েছে। যার জের এখনও চলছে। নিউইয়র্ক টাইমসে সর্বাধিক মর্মান্তিক ২০১২ সালের ঘটনাবলির অন্যতম আমাদের 'শুভ নববর্ষে' এবং তার পরও বিষাদের ছায়া বিস্তার করবে। চাইলেই অতীতের বর্জ্য বলে শ'খানেক আদম সন্তানের বাঁচার আকুতি, অসহায়ত্ব এবং দীর্ঘশ্বাসকে 'থার্টিফার্স্ট'-এর নর্তন-কুর্দন দিয়ে ঢেকে দেওয়া যায় না। তবু এসব অপসংস্কৃতির আমরা নির্বাক দর্শক।
পৃথিবীতে অবিমিশ্রতা বলে কিছু নেই। দেশের ২০১২ সালের বর্জিত এবং বহু নিন্দিত নেতিবাচকতার মধ্য দিয়ে কিন্তু সাফল্যের পাল্লাও প্রতিদ্বন্দিতা করে অনেক ব্যর্থতাকে ঢেকে দিতে পেরেছে। বলা হয়েছে যে, দেশ এখন খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ। আর কষ্টার্জিত বৈদেশিক মুদ্রা ব্যয়ে খাদ্য আমদানির প্রয়োজন পড়বে না। এ যে কী পরম স্বস্তি_ তা তারা না বুঝে পারবেন না, যারা মাত্র ক'বছর আগে ভারতসহ খাদ্য রফতানিকারক দেশগুলোতে খাদ্য ক্রয়ের জন্য আমাদের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের ধরনা দিতে দেখেছেন।
বেশ কিছু নান্দনিক বিষয় সংযোজিত হয়েছে আমাদের অবকাঠামোতে। শুধু আমাদের দুর্নীতিপরায়ণতার প্রবণতাকে শৃঙ্খলিত রাখতে পারলে আমাদের সম্ভাবনাময় মানবসম্পদের জন্য ইংরেজিতে যাকে বলে, 'ঞযব ংশু রং ঃযব ষরসরঃ'_ কে ভেবেছিল যে, আমাদের ভীতু বাঙালি কোনোদিন এভারেস্টের চূড়ায় আরোহণ করবে! তাও আবার একাধিক নারী অভিযাত্রী! এরা সবাই আমাদের গর্ব। কৃষিতে আমাদের অভূতপূর্ব সাফল্যের কথা ২০১২ সালের মধ্যে আবদ্ধ রাখতে অবশ্যই আমার মন চায় না। ছোটবেলা থেকেই খরা, বন্যা বা অতিবৃষ্টিতে শস্যহানি দেখতে অভ্যস্ত আমি। সেখানে এখন সারাবছর শষ্যভরা ক্ষেতে সবুজের হাতছানি। আমাদের কৃষিবিদদের অবদানে শুধু ফসলভরা ক্ষেতই নয়, ফসলেও বৈচিত্র্য আনা সম্ভব হয়েছে। কমলালেবু থেকে শুরু করে বিভিন্ন জাতের ফলমূল উৎপাদন করে তাক লাগিয়ে দিয়েছেন আমাদের কৃষকরা।
কিন্তু যতক্ষণ পর্যন্ত আমরা ২০১২ সালের কলঙ্ক যথা_ দুর্নীতি, বৈষম্য, হত্যা, গুম, অপহরণ ইত্যাদিকে আমাদের সমাজ ও রাষ্ট্রদেহ থেকে মুছে ফেলতে না পারি, ততদিন বহির্বিশ্বে আমাদের ভাবমূর্তি অপরিবর্তিতই থাকবে। সেক্ষেত্রে আমাদের অনেকের অর্জনকে আমরা বাধাগ্রস্তই করতে থাকব। পদ্মা সেতুর অনিশ্চিত ভাগ্য, শেয়ারবাজার, ব্যাংকিং খাত এবং হলমার্ক, ডেসটিনি বা ইউনিপেটুইউ জাতীয় প্রতারকচক্রের কেলেঙ্কারি জাতির সব অর্জনকেই ম্লান করবে। অতিরিক্ত মুনাফালোভী গার্মেন্ট শিল্প মালিকদের রাশ টেনে ধরারও সময় এটাই। সব রকম দুর্নাম কুড়িয়ে এবং আমদানিকারকদের হুমকি তুচ্ছ করে আমাদের পোশাক শিল্প এখনও পাশ্চাত্যে দ্বিতীয় স্থানে। চীনের পর বাংলাদেশের এই ঈর্ষণীয় অবস্থানটিকে ধরে রাখতে যে কোনো ত্রুটি অমার্জনীয়। অনেক ব্যর্থতার ভেতর দিয়েও বিস্ময়কর হলেও দেশ কিন্তু এগোচ্ছে। পাড়াগাঁয়েও আজকাল পাকা বাড়িঘর, স্যানিটারি পয়ঃব্যবস্থা ও পল্লী বিদ্যুতের বদৌলতে বিদ্যুৎনির্ভর সামগ্রী যেমন_ টেলিভিশন, রেফ্রিজারেটর বা ইলেকট্রিক ইস্ত্রির ছড়াছড়ি। জানি না, এসবই কি নগরায়নের প্রাথমিক পর্যায় বা পূর্বাভাস? পাড়াগাঁয়েই এখন নিরক্ষর মানুষের দেখা মেলা দুষ্কর। সবাই বুঝেছে যে, ব্যক্তি পর্যায়ে বা জাতীয় পর্যায়ে জ্ঞান বা শিক্ষাই শক্তি। গ্রামে গেলে পরিচিত অনেককে আর সেখানে দেখি না। শুনি, ছেলেমেয়েদের লেখাপড়ার সুবিধার্থে তারা শহরে পাড়ি জমিয়েছে। তখন বুঝি স্বাচ্ছন্দ্য, শিক্ষা, সচেতনতা একদিন এ দেশে তার অবধারিত পরিণতি হিসেবে প্রকৃত গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের উদ্ভব ঘটাবে। দেশ, গণতন্ত্র বা জাতি গঠন নিয়ে অনেক পরীক্ষা-নিরীক্ষার মধ্য দিয়ে আমাদের জীবনকাল অতিবাহিত হলো। তবু যে জনগণেরই উদ্যোগ ও প্রচেষ্টায় একটি সম্ভাবনাময় সময়ের আলোকচ্ছটা দেখে যেতে পারছি_ তাই বা কম কিসে!
ব্রিগেডিয়ার (অব.) এম আবদুল হাফিজ :সাবেক মহাপরিচালক বিআইআইএসএস ও কলাম লেখক
কয়েক মাস আগে যখন নিশ্চিন্তপুরের তাজরীন ফ্যাশনের অগি্নকাণ্ডে শতাধিক নারী শ্রমিক দগ্ধ হয়ে অঙ্গারে পরিণত হয়, তাৎক্ষণিকভাবে এ নিয়ে দেশের অভ্যন্তরে এবং বহির্বিশ্বে প্রচুর বিতর্ক হয়েছে। যার জের এখনও চলছে। নিউইয়র্ক টাইমসে সর্বাধিক মর্মান্তিক ২০১২ সালের ঘটনাবলির অন্যতম আমাদের 'শুভ নববর্ষে' এবং তার পরও বিষাদের ছায়া বিস্তার করবে। চাইলেই অতীতের বর্জ্য বলে শ'খানেক আদম সন্তানের বাঁচার আকুতি, অসহায়ত্ব এবং দীর্ঘশ্বাসকে 'থার্টিফার্স্ট'-এর নর্তন-কুর্দন দিয়ে ঢেকে দেওয়া যায় না। তবু এসব অপসংস্কৃতির আমরা নির্বাক দর্শক।
পৃথিবীতে অবিমিশ্রতা বলে কিছু নেই। দেশের ২০১২ সালের বর্জিত এবং বহু নিন্দিত নেতিবাচকতার মধ্য দিয়ে কিন্তু সাফল্যের পাল্লাও প্রতিদ্বন্দিতা করে অনেক ব্যর্থতাকে ঢেকে দিতে পেরেছে। বলা হয়েছে যে, দেশ এখন খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ। আর কষ্টার্জিত বৈদেশিক মুদ্রা ব্যয়ে খাদ্য আমদানির প্রয়োজন পড়বে না। এ যে কী পরম স্বস্তি_ তা তারা না বুঝে পারবেন না, যারা মাত্র ক'বছর আগে ভারতসহ খাদ্য রফতানিকারক দেশগুলোতে খাদ্য ক্রয়ের জন্য আমাদের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের ধরনা দিতে দেখেছেন।
বেশ কিছু নান্দনিক বিষয় সংযোজিত হয়েছে আমাদের অবকাঠামোতে। শুধু আমাদের দুর্নীতিপরায়ণতার প্রবণতাকে শৃঙ্খলিত রাখতে পারলে আমাদের সম্ভাবনাময় মানবসম্পদের জন্য ইংরেজিতে যাকে বলে, 'ঞযব ংশু রং ঃযব ষরসরঃ'_ কে ভেবেছিল যে, আমাদের ভীতু বাঙালি কোনোদিন এভারেস্টের চূড়ায় আরোহণ করবে! তাও আবার একাধিক নারী অভিযাত্রী! এরা সবাই আমাদের গর্ব। কৃষিতে আমাদের অভূতপূর্ব সাফল্যের কথা ২০১২ সালের মধ্যে আবদ্ধ রাখতে অবশ্যই আমার মন চায় না। ছোটবেলা থেকেই খরা, বন্যা বা অতিবৃষ্টিতে শস্যহানি দেখতে অভ্যস্ত আমি। সেখানে এখন সারাবছর শষ্যভরা ক্ষেতে সবুজের হাতছানি। আমাদের কৃষিবিদদের অবদানে শুধু ফসলভরা ক্ষেতই নয়, ফসলেও বৈচিত্র্য আনা সম্ভব হয়েছে। কমলালেবু থেকে শুরু করে বিভিন্ন জাতের ফলমূল উৎপাদন করে তাক লাগিয়ে দিয়েছেন আমাদের কৃষকরা।
কিন্তু যতক্ষণ পর্যন্ত আমরা ২০১২ সালের কলঙ্ক যথা_ দুর্নীতি, বৈষম্য, হত্যা, গুম, অপহরণ ইত্যাদিকে আমাদের সমাজ ও রাষ্ট্রদেহ থেকে মুছে ফেলতে না পারি, ততদিন বহির্বিশ্বে আমাদের ভাবমূর্তি অপরিবর্তিতই থাকবে। সেক্ষেত্রে আমাদের অনেকের অর্জনকে আমরা বাধাগ্রস্তই করতে থাকব। পদ্মা সেতুর অনিশ্চিত ভাগ্য, শেয়ারবাজার, ব্যাংকিং খাত এবং হলমার্ক, ডেসটিনি বা ইউনিপেটুইউ জাতীয় প্রতারকচক্রের কেলেঙ্কারি জাতির সব অর্জনকেই ম্লান করবে। অতিরিক্ত মুনাফালোভী গার্মেন্ট শিল্প মালিকদের রাশ টেনে ধরারও সময় এটাই। সব রকম দুর্নাম কুড়িয়ে এবং আমদানিকারকদের হুমকি তুচ্ছ করে আমাদের পোশাক শিল্প এখনও পাশ্চাত্যে দ্বিতীয় স্থানে। চীনের পর বাংলাদেশের এই ঈর্ষণীয় অবস্থানটিকে ধরে রাখতে যে কোনো ত্রুটি অমার্জনীয়। অনেক ব্যর্থতার ভেতর দিয়েও বিস্ময়কর হলেও দেশ কিন্তু এগোচ্ছে। পাড়াগাঁয়েও আজকাল পাকা বাড়িঘর, স্যানিটারি পয়ঃব্যবস্থা ও পল্লী বিদ্যুতের বদৌলতে বিদ্যুৎনির্ভর সামগ্রী যেমন_ টেলিভিশন, রেফ্রিজারেটর বা ইলেকট্রিক ইস্ত্রির ছড়াছড়ি। জানি না, এসবই কি নগরায়নের প্রাথমিক পর্যায় বা পূর্বাভাস? পাড়াগাঁয়েই এখন নিরক্ষর মানুষের দেখা মেলা দুষ্কর। সবাই বুঝেছে যে, ব্যক্তি পর্যায়ে বা জাতীয় পর্যায়ে জ্ঞান বা শিক্ষাই শক্তি। গ্রামে গেলে পরিচিত অনেককে আর সেখানে দেখি না। শুনি, ছেলেমেয়েদের লেখাপড়ার সুবিধার্থে তারা শহরে পাড়ি জমিয়েছে। তখন বুঝি স্বাচ্ছন্দ্য, শিক্ষা, সচেতনতা একদিন এ দেশে তার অবধারিত পরিণতি হিসেবে প্রকৃত গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের উদ্ভব ঘটাবে। দেশ, গণতন্ত্র বা জাতি গঠন নিয়ে অনেক পরীক্ষা-নিরীক্ষার মধ্য দিয়ে আমাদের জীবনকাল অতিবাহিত হলো। তবু যে জনগণেরই উদ্যোগ ও প্রচেষ্টায় একটি সম্ভাবনাময় সময়ের আলোকচ্ছটা দেখে যেতে পারছি_ তাই বা কম কিসে!
ব্রিগেডিয়ার (অব.) এম আবদুল হাফিজ :সাবেক মহাপরিচালক বিআইআইএসএস ও কলাম লেখক
No comments