সমকালীন প্রসঙ্গ-ছাত্রদের উচ্ছৃঙ্খল আচরণ প্রসঙ্গে by বদরুদ্দীন উমর

 ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ছাত্রের দুর্ঘটনাজনিত মৃত্যুকে কেন্দ্র করে ৬ মার্চ শাহবাগ মোড় ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্ররা ভাংচুরের এক মহাতাণ্ডব ঘটিয়েছে। নিহত ছাত্র রেদওয়ানের বন্ধুদের ভাষ্য থেকে জানা যায়, সোনারগাঁ থেকে ছাত্ররা হিমালয় পরিবহনের একটি বাসে ঢাকা ফিরছিল।
শনিবার ৫ মার্চ রাতে মতিঝিলে পেঁৗছানোর পর কয়েকজন ছাত্র ও বাস শ্রমিকদের মধ্যে কোনো বিষয় নিয়ে ঝগড়া সৃষ্টি হয়। ঝগড়া পরে মারামারিতে পরিণত হলে এলাকায় বাস শ্রমিকরা সংখ্যায় বেশি থাকায় ছাত্ররা অসুবিধায় পড়ে। এরপর ছাত্ররা বিশ্ববিদ্যালয়ে ফেরত গিয়ে রেদওয়ানসহ কিছু ছাত্রকে নিয়ে মতিঝিলে আসে। নতুন পর্যায়ে মারামারির সময় পুলিশ রেদওয়ান এবং অন্য দু'জনকে আটক করে। কিন্তু কিছুসংখ্যক শ্রমিক তাদের মধ্যে দু'জনকে ছিনিয়ে নেয়। এরপর তারা রেদওয়ান এবং অন্যজনকে মারধর করে রেদওয়ানকে এক চলন্ত গাড়ির নিচে ঠেলে দেয়। এতে রেদওয়ান মারাত্মক আহত হলে তাকে হাসপাতালে নেওয়ার পর সেখানে তার মৃত্যু হয়। (উধরষু ঝঃধৎ, ৭-৩-২০১১)। এই মৃত্যুর ঘটনার পর বহুসংখ্যক বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র ৬ মার্চ সকাল সাড়ে ১০টা থেকে দুই ঘণ্টা ধরে শাহবাগ এলাকায় প্রায় ১০০ গাড়ি ভাংচুর করে এবং একটি বাসে আগুন ধরিয়ে দেয়। পুলিশের সঙ্গে তাদের সংঘর্ষ শুরু হলে অন্তত ১৫ জন ছাত্র ও ৫ জন পুলিশ আহত হয়। গাড়ির ওপর আক্রমণ চলাকালে কিছু যাত্রীও আহত হন। শুধু তা-ই নয়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা প্রক্টরের অফিসসহ বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্য কিছু কামরায় ঢুকে ভাংচুর ও তছনছের ঘটনা ঘটায়। (ঐ)
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র, শাহবাগ মোড়ে উপস্থিত লোকজন ও পুলিশের ভাষ্য অনুযায়ী ছাত্ররা এভাবে ভাংচুরের কাজ করলেও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য দাবি করেন, কোনো ছাত্র এ ভাংচুরের কাজ করতে পারে এটা তিনি বিশ্বাস করেন না। তার মতে, এ কাজ করেছে বিশ্ববিদ্যালয়ের বাইরের কিছু লোকজন!! এ বক্তব্য যে খুবই বিস্ময়কর এতে সন্দেহ নেই। কারণ এর মধ্যে সত্যতার কোনো লেশমাত্র তো নেইই, উপরন্তু উপাচার্যের মতো এক ব্যক্তি নিজেদের প্রশাসনিক দায়িত্ব এড়িয়ে, নিজেদের ব্যর্থতা ধামাচাপা দেওয়ার উদ্দেশ্যে যেভাবে মিথ্যার আশ্রয় নিয়েছেন, সেটা নিতান্তই নিন্দনীয়।
বাংলাদেশে বিভিন্ন শ্রমিক অঞ্চলে ট্রেড ইউনিয়ন গঠন করতে না দেওয়া এবং যেখানে ট্রেড ইউনিয়ন আছে সেখানে সেগুলোকে ঠিকমতো কাজ করতে না দেওয়ার কারণে শ্রমিকরা স্বাভাবিক প্রতিবাদ ও প্রতিরোধের পথ না দেখে তাদের দাবি এবং অভিযোগ জানানোর জন্য এখন ভাংচুর করে থাকেন। তারা অনেক সময় ছাত্রসহ জনগণের বিভিন্ন অংশের যাত্রীদের সঙ্গেও খারাপ ব্যবহার করেন ও সংঘর্ষে লিপ্ত হন। এদিক দিয়ে ব্রিটিশ ও পাকিস্তান আমলের সঙ্গে বাংলাদেশ আমলের বড় তফাৎ। প্রতিবাদের স্বাভাবিক পথ বন্ধ করলে যে অভ্যাস প্রয়োজনের তাগিদে শ্রমিক অঞ্চলে তৈরি হয়, সেই অভ্যাস নিয়ে শ্রমিকরা অন্যদের প্রতিও অনেক সময় এমন আচরণ করেন, যা তাদের দিক থেকে স্বাভাবিক নয়। কাজেই শ্রমিকদের এ আচরণ বন্ধ করার জন্য তাদের গালাগালি না করে এর কারণ অনুসন্ধান করে কারণগুলো দূর করলেই তাদের এই অস্বাভাবিক আচরণ বন্ধ করা সম্ভব। কারণের প্রতি উদাসীন থেকে কার্য নিয়ে হৈচৈ করলে পরিস্থিতির কোনো পরিবর্তন হয় না। উপরন্তু পরিবর্তন যা হয় তার মাধ্যমে পরিস্থিতির আরও অবনতি ঘটে।
ছাত্রদের ক্ষেত্রেও একই কথা। ছাত্রদের মধ্যে বর্তমানে যেভাবে উচ্ছৃঙ্খলতা, দায়িত্বহীনতা, দুর্নীতি ইত্যাদি দেখা যায় সেটা অবশ্যই নিন্দাযোগ্য। কিন্তু শুধু নিন্দা দিয়ে এ পরিস্থিতির কোনো পরিবর্তন ঘটানো সম্ভব নয়। শ্রমিকদের মতো ছাত্রদের এ আচরণও স্বাভাবিক নয়। শ্রমিকদের মধ্যেও এ ধরনের আচরণ যেমন আগে দেখা যেত না, তেমনি ছাত্রদের মধ্যেও এটা অনুপস্থিত ছিল। পঞ্চাশ, ষাট ও সত্তরের দশকের শুরুতে যে শ্রমিক ও ছাত্ররা এ দেশে গণতান্ত্রিক ও প্রগতিশীল আন্দোলনের পুরোভাগে ছিলেন, তাদের অবস্থা আজ কেন এমন হলো_ এ প্রশ্ন বাদ দিয়ে শ্রমিক বা ছাত্রদের চিন্তাভাবনা, আচরণ ও কার্যকলাপের বিষয়ে কোনো সঠিক ধারণায় উপনীত হওয়া যেমন সম্ভব নয়, তেমনি সম্ভব নয় এই পরিস্থিতির কোনো ইতিবাচক পরিবর্তন ঘটানো।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য যখন বলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো ছাত্র ভাংচুরের এই ঘটনা ঘটাতে পারে বলে তিনি বিশ্বাস করেন না এবং এ কাজ বাইরের লোকদের, তখন তিনি যে সত্য কথা বলছেন না এ বিষয়ে কাউকে বুঝিয়ে বলার প্রয়োজন হয় না। এ ক্ষেত্রে তার পরিষ্কার উদ্দেশ্য হচ্ছে নিজেদের দায়িত্ব এড়িয়ে যাওয়া এবং এ কাজ করতে গিয়ে ছাত্রদের চরিত্রের এই পরিবর্তনের কারণের প্রতি চোখ বন্ধ করে থাকা, এ ব্যাপারে কোনো সুচিন্তিত পদক্ষেপ গ্রহণে অপারগ থাকা।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে দুই দশক ধরে ছাত্র ইউনিয়নগুলোর কোনো নির্বাচন হয় না। এককথায় বলা চলে, এটা হলো ছাত্রদের মধ্যে উচ্ছৃঙ্খলতা জিইয়ে রাখা ও বৃদ্ধির সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ একক কারণ। আগে হল ও বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ইউনিয়নের নিয়মিত নির্বাচন হতো। এ নির্বাচনে হার-জিতের মধ্য দিয়ে হল ও বিশ্ববিদ্যালয় ইউনিয়গুলোর নেতৃত্ব পরিবর্তিত হয়ে গঠিত হতো। নির্বাচন বন্ধ থাকায় হল ও বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র নেতৃত্বের পরিবর্তনের পরিবর্তে এখন যা দাঁড়িয়েছে তা হলো, বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র নির্বাচন নয়, দেশের সাধারণ নির্বাচনের পর যে সরকার ক্ষমতায় আসে তাদের অঙ্গ ছাত্র সংগঠন কর্তৃক হল দখল। এই দখল কাজ করার সময় আগের দখলদারদের মারধর করে বের করা হয় অথবা মারের ভয়ে তারা নিজেরাই হল ত্যাগ করে পলায়ন করে।
১৯৭২ সাল থেকেই সাধারণভাবে দেশে লুটপাট ও সন্ত্রাসের যে রাজত্ব এবং ঐতিহ্য সৃষ্টি হয়েছে, তার প্রভাব সমাজের সব অংশের ওপর পড়েছে। ছাত্ররাও এর বাইরে নয়। এর একটি দৃশ্যমান ফল হলো ক্রমাগতভাবে ছাত্রদের অরাজনীতিকরণ (ফব-ঢ়ড়ষরঃরপরুধঃরড়হ)। এ কারণেই এখন দেখা যায় আগের মতো গণতান্ত্রিক ও প্রগতিশীল ছাত্র সংগঠনে ছাত্ররা আর আসে না। আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মতো সংগঠনে যে ছাত্ররা আসে তারা কোনো আদর্শ বা উচ্চ চিন্তার প্রতি আকৃষ্ট হয়ে আসে না। তারা আসে ধান্ধাবাজির উদ্দেশ্যে। আর এই ধান্ধাবাজি প্রশ্রয় দেওয়ার জন্য এ ধরনের রাজনৈতিক দল হাত বাড়িয়ে থাকে। শুধু তা-ই নয়, তারা ছাত্রদের এ অবস্থায় রাখার জন্য নানা ফন্দি ও ফাঁদ ব্যবহার করে। এই ফন্দির একটি হলো বিশ্ববিদ্যালয়ে এবং অন্যান্য নিম্নতর শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ছাত্র ইউনিয়নগুলোর নির্বাচন ব্যবস্থা উচ্ছেদ করে দিয়ে সরাসরি বিশ্ববিদ্যালয়সহ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে তাদের প্রশাসন ও পুলিশের সাহায্যে নিজেদের ছাত্র সংগঠনকে ক্ষমতাসীন করা ও ইচ্ছামতো ব্যবহার করা। এই নিন্দনীয় কাজে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের, বিশেষত বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে ব্যবহারের উদ্দেশ্যে তারা নিজেরা সরকারি ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হওয়ার পরই উপাচার্য পরিবর্তন করে দলীয় লোকদের নিয়োগ প্রদান করেন। এই দলীয় উপাচার্যরা নিষ্ঠার সঙ্গে তাদের নিয়োগকারী দলের স্বার্থ রক্ষার জন্য যা কিছু করণীয় সেসব করে থাকেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় যে এদিক দিয়ে ব্যতিক্রম নয় এটা সবারই জানা। কাজেই এখানে যে ব্যক্তিই, যে সরকারের আমলেই উপাচার্য নির্বাচিত হন, তিনি একই আচরণ করেন। এ আচরণের মধ্যে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ হলো বিশ্ববিদ্যালয় হল ও কেন্দ্রীয় ইউনিয়নগুলোর নির্বাচনের ব্যবস্থা না করে সম্পূর্ণ অগণতান্ত্রিক উপায়ে, গায়ের জোরে নিজেদের দলের অঙ্গ ছাত্র সংগঠনকে হলগুলোর দখল প্রদান। এভাবে দখলপ্রাপ্ত ছাত্ররা একেবারে খেয়ালখুশি ও নির্লজ্জভাবে টেন্ডারবাজি, ভর্তি বাণিজ্য থেকে নিয়ে সব রকম দুর্নীতি এবং সন্ত্রাস করে থাকে। এসব প্রক্রিয়ার মাধ্যমে ছাত্রদের মধ্যে দল নির্বিশেষে গণতান্ত্রিক চিন্তাভাবনার ও কার্যকলাপের পরিবর্তে ফ্যাসিস্ট অভ্যাস-আচরণ এবং উচ্ছৃঙ্খলতার শর্তই সৃষ্টি হয়। ৬ মার্চ একজন ছাত্রের মৃত্যুকে কেন্দ্র করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা শাহবাগ মোড় ও বিশ্ববিদ্যালয়ে যে মারপিট, ভাংচুরের ঘটনা ঘটিয়েছে তাকে এই পরিপ্রেক্ষিতে বিচার করলেই একদিকে এর কারণ উপলব্ধি এবং অন্যদিকে এর প্রতিকারের পথ খুঁজে পাওয়া সম্ভব হতে পারে।
৭.৩.২০১১
 

No comments

Powered by Blogger.