নারী দিবস-নারী, কৃষি ও সভ্যতার দোলাচল by ফারহাত জাহান
হাজার হাজার বছরের শোষণ ও বঞ্চনার ধারাবাহিকতায় নারীর অধিকারহীনতা প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পেয়েছে। আর এর বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর আনুষ্ঠানিক ইতিহাস শতবর্ষের। নারী জাগরণের শতবর্ষকে সামনে রেখে আজ শ্রদ্ধা জানাতে চাই মানবসভ্যতাকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার সৈনিক কৃষি উদ্ভাবক নারীকে।
পুরুষতান্ত্রিক সমাজ কাঠামোর মধ্যে সম্পদের ওপর অধিকারহীনতা, ভূমির ওপর মালিকানাহীনতা, অর্থ ও পুঁজিপ্রবাহের বাইরে নারীর অবস্থান তার প্রান্তিকীকরণের ইতিহাসকে আরও করুণ করেছে। মানবসভ্যতা বিকাশের অভিযাত্রা শুরু হয়েছিল কৃষির মাধ্যমে আর এ কৃষির আবিষ্কারক মূলত নারী। কৃষি, উন্নয়ন ও অর্থনীতির সঙ্গে নারীর সম্পর্ক বহুমাত্রিক। জাতিসংঘের তথ্য অনুযায়ী পৃথিবীর ৭৫-৯০ শতাংশ খাদ্যশস্যের উৎপাদক নারী। আর পৃথিবীর প্রতি তিনজন প্রাপ্তবয়স্ক দরিদ্রের মধ্যে দু'জন হলো নারী। পৃথিবীর দুই-তৃতীয়াংশ কাজ নারীর দ্বারা সম্পাদিত হয়; কিন্তু বিশ্ব আয়ের ১০ শতাংশ গ্রহণ করে নারী আর মাত্র ১ শতাংশ উৎপাদন মাধ্যমের ওপর রয়েছে নারীর মালিকানা। অধিকারহীনতা ও প্রান্তিকীকরণের এ তথ্যচিত্র নারী জীবনের শোষণ ও বঞ্চনার ইতিহাসকে মূর্ত করে তোলে।
বিশেষত উন্নয়নশীল দেশগুলোতে নারী কৃষিকাজের এক নিবেদিত সৈনিক। কৃষিকাজের সব ধাপে নারীর ভূমিকা অগ্রগণ্য। বাংলাদেশে ৪৫% কৃষিকাজে নারীর উপস্থিতি দৃশ্যমান মূলত উৎপাদন প্রস্তুতি পর্ব ও উৎপাদন-পরবর্তী পর্বে। তাছাড়া ফসল ঘরে তোলার পর মাড়াই, বাছাইসহ আহারযোগ্য দানাশস্য তৈরিতে নারী একক কৃতিত্বের দাবিদার। আর মূল শস্যের বাইরে অন্যান্য খাদ্য যেমন_ শাকসবজি, ফলমূলের একক জোগানদাতা নারী। শুধু তাই নয়, গবাদিপশু পালনে নারীর ভূমিকাই মুখ্য। উৎপাদন ও অর্থনৈতিক উন্নয়নে নারীর রয়েছে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। নারীর লোকজ জ্ঞান ও দক্ষতা খাদ্য উৎপাদন এবং স্থায়িত্বশীল কৃষি সংরক্ষণ ও বিকাশের জন্য খুবই দরকার। কিন্তু মজার ব্যাপার হলো, এসব কর্মপ্রবাহে যেখানে অর্থপ্রবাহের সংযোগ রয়েছে, সেখানে নিয়ন্ত্রণের রশিটা নারীর আয়ত্তের বাইরে। আর তাই ভূমির ওপর নারীর নেই কোনো মালিকানা, নেই কোনো অধিকার। যদিও খাদ্য উৎপাদন ও খাদ্য নিরাপত্তায় নারীর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। কিন্তু সে সম্পদের মালিকানা থেকে বঞ্চিত, সম্পদে নেই নারীর অধিকার। পৃথিবীর অধিকাংশ সমাজ, প্রথা ও ধর্মীয় আইন সম্পদে বিশেষত ভূমিতে নারীর অধিকারকে সীমিত করেছে। খাদ্য ও কৃষি সংস্থার একটি গবেষণা বলছে, বিশ্বের মোট খাদ্যের অর্ধেক উৎপাদন করে নারী; কিন্তু মাত্র ২ শতাংশ জমিতে রয়েছে নারীর অধিকার। আর বাংলাদেশে এ অবস্থা আরও মারাত্মক; যদিও কৃষি ও খাদ্য নিরাপত্তায় নারীর অংশগ্রহণ খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু জাতীয় অর্থনীতিতে তাদের অংশগ্রহণের কোনো স্বীকৃতি নেই। শুধু জমি নয়, অন্যান্য সম্পদের ওপর নারীর অধিকার নেই বললেই চলে।
স্মরণাতীতকাল থেকে নারী কৃষির বিকাশ, কৃষিজ্ঞান উদ্ভাবন ও সংরক্ষণে অগ্রণী ভূমিকা রেখে এসেছে। কিন্তু নারীজীবনের করুণ বৈপরীত্য হলো পুরুষতান্ত্রিক মানবসভ্যতা নারীর সে অবদানকে স্বীকার করেনি। কেননা নারীর শ্রম কখনোই মুদ্রায় মূল্যায়িত হয়নি। তাই উন্নয়নের মূলধারা থেকে নারী ছিটকে পড়েছে। শুধু তাই নয়, বাণিজ্যিক বিশ্বায়ন ও জেন্ডারভিত্তিক শ্রমবিভাজন নারীর অবস্থানকে করেছে আরও নাজুক। শ্রমঘন খাতগুলোতে অধিকমাত্রায় নারীকর্মী নিয়োগে মালিকপক্ষের আগ্রহ থাকে বেশি। কারণ একদিকে নারীশ্রম সস্তা, অন্যদিকে তার প্রান্তিকীকরণ তাকে বাধ্য করে শোষণের শিকার হতে।
যদিও নারী কৃষিজজ্ঞানের পথপ্রদর্শক কিন্তু নারী কেবল প্রথাগত সমাজব্যবস্থা থেকে নয়, বরং উন্নয়নের তথাকথিত মূলধারার বাইরে থেকেছে। বাইরে থেকে বারবার, শতাব্দীর পর শতাব্দী উন্নয়নের সে দোলাচল পেরিয়ে আজকে পুরুষতন্ত্রের উপলব্ধি_ বিশাল এ জনগোষ্ঠীকে উন্নয়নের মূল স্রোতের বাইরে রেখে উন্নয়ন সম্ভব নয়। আজ তাই পুরুষতন্ত্রের স্বার্থে নারীর উন্নয়ন দরকার। আর নারী অধিকারের অভিযাত্রা শুরু হয়েছিল শ্রম অধিকারকে কেন্দ্র করে। বিংশ শতাব্দীতে উত্তর আমেরিকা ও ইউরোপে শুরু হওয়া এ অভিযাত্রা শতবর্ষ সম্পন্ন করেছে এবং এ অধিকারের বার্তা পৃথিবীর সব অংশের নারীদের কাছে পেঁৗছে গেছে। সংগ্রামের বিভিন্ন পর্যায় পেরিয়েছে নারী। নারীর অধিকার আদায়ের সংগ্রাম দিনে দিনে সংগঠিত হয়েছে। সাম্যতা, ন্যায্যতা, অংশগ্রহণ, সিদ্ধান্ত গ্রহণ, স্বাবলম্বন, স্বাধীনতা, ক্ষমতায়ন_ এসব ধাপ পেরিয়ে শতবর্ষে পদার্পণ করে নারী আজ দাবি তুলেছে 'শিক্ষা, বিজ্ঞান, প্রযুক্তি ও প্রশিক্ষণে সমান অংশগ্রহণ নারীর সম্মানজনক অংশগ্রহণ নিশ্চিত করবে। সভ্যতার প্রথম ধাপ কৃষি, যার বিকাশে নারী ছিল অগ্রভাগে। কিন্তু মানবসভ্যতা বিকাশের ধারায় পুরুষতন্ত্র নারীর অবস্থানকে প্রান্তিক করেছে। সম্পদ, ভূমি, পুঁজি, অর্থনীতি, শিক্ষা, প্রযুক্তি, বিজ্ঞান, বাজার সব ক্ষেত্রে নারীর প্রবেশাধিকার হয়েছে প্রান্তিক। তাই উদ্ভাবক নারী আজ নিজ ভূমিতে উদ্বাস্তু। আজ বিশ্ব নারী দিবসের দাবি শিক্ষা, বিজ্ঞান, প্রযুক্তি ও প্রশিক্ষণে নারীর সমান অংশগ্রহণ। বর্তমান বিশ্ব বাস্তবতায় ক্রমবর্ধমান দারিদ্র্য, খাদ্য নিরাপত্তাহীনতা, পরিবেশ বিপর্যয় মোকাবেলায় নারীর উন্নয়ন অংশীদারিত্বকে স্বীকৃতি দিয়ে তার ক্ষমতায়নের প্রশ্নটি উন্নয়ন ও সভ্যতার বিকাশের স্বার্থে জরুরি হয়ে পড়েছে। কারণ বিশ্ব মানবকল্যাণের জন্য নারীমুক্তি অনিবার্য সত্য।
ফারহাত জাহান : গবেষক
বিশেষত উন্নয়নশীল দেশগুলোতে নারী কৃষিকাজের এক নিবেদিত সৈনিক। কৃষিকাজের সব ধাপে নারীর ভূমিকা অগ্রগণ্য। বাংলাদেশে ৪৫% কৃষিকাজে নারীর উপস্থিতি দৃশ্যমান মূলত উৎপাদন প্রস্তুতি পর্ব ও উৎপাদন-পরবর্তী পর্বে। তাছাড়া ফসল ঘরে তোলার পর মাড়াই, বাছাইসহ আহারযোগ্য দানাশস্য তৈরিতে নারী একক কৃতিত্বের দাবিদার। আর মূল শস্যের বাইরে অন্যান্য খাদ্য যেমন_ শাকসবজি, ফলমূলের একক জোগানদাতা নারী। শুধু তাই নয়, গবাদিপশু পালনে নারীর ভূমিকাই মুখ্য। উৎপাদন ও অর্থনৈতিক উন্নয়নে নারীর রয়েছে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। নারীর লোকজ জ্ঞান ও দক্ষতা খাদ্য উৎপাদন এবং স্থায়িত্বশীল কৃষি সংরক্ষণ ও বিকাশের জন্য খুবই দরকার। কিন্তু মজার ব্যাপার হলো, এসব কর্মপ্রবাহে যেখানে অর্থপ্রবাহের সংযোগ রয়েছে, সেখানে নিয়ন্ত্রণের রশিটা নারীর আয়ত্তের বাইরে। আর তাই ভূমির ওপর নারীর নেই কোনো মালিকানা, নেই কোনো অধিকার। যদিও খাদ্য উৎপাদন ও খাদ্য নিরাপত্তায় নারীর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। কিন্তু সে সম্পদের মালিকানা থেকে বঞ্চিত, সম্পদে নেই নারীর অধিকার। পৃথিবীর অধিকাংশ সমাজ, প্রথা ও ধর্মীয় আইন সম্পদে বিশেষত ভূমিতে নারীর অধিকারকে সীমিত করেছে। খাদ্য ও কৃষি সংস্থার একটি গবেষণা বলছে, বিশ্বের মোট খাদ্যের অর্ধেক উৎপাদন করে নারী; কিন্তু মাত্র ২ শতাংশ জমিতে রয়েছে নারীর অধিকার। আর বাংলাদেশে এ অবস্থা আরও মারাত্মক; যদিও কৃষি ও খাদ্য নিরাপত্তায় নারীর অংশগ্রহণ খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু জাতীয় অর্থনীতিতে তাদের অংশগ্রহণের কোনো স্বীকৃতি নেই। শুধু জমি নয়, অন্যান্য সম্পদের ওপর নারীর অধিকার নেই বললেই চলে।
স্মরণাতীতকাল থেকে নারী কৃষির বিকাশ, কৃষিজ্ঞান উদ্ভাবন ও সংরক্ষণে অগ্রণী ভূমিকা রেখে এসেছে। কিন্তু নারীজীবনের করুণ বৈপরীত্য হলো পুরুষতান্ত্রিক মানবসভ্যতা নারীর সে অবদানকে স্বীকার করেনি। কেননা নারীর শ্রম কখনোই মুদ্রায় মূল্যায়িত হয়নি। তাই উন্নয়নের মূলধারা থেকে নারী ছিটকে পড়েছে। শুধু তাই নয়, বাণিজ্যিক বিশ্বায়ন ও জেন্ডারভিত্তিক শ্রমবিভাজন নারীর অবস্থানকে করেছে আরও নাজুক। শ্রমঘন খাতগুলোতে অধিকমাত্রায় নারীকর্মী নিয়োগে মালিকপক্ষের আগ্রহ থাকে বেশি। কারণ একদিকে নারীশ্রম সস্তা, অন্যদিকে তার প্রান্তিকীকরণ তাকে বাধ্য করে শোষণের শিকার হতে।
যদিও নারী কৃষিজজ্ঞানের পথপ্রদর্শক কিন্তু নারী কেবল প্রথাগত সমাজব্যবস্থা থেকে নয়, বরং উন্নয়নের তথাকথিত মূলধারার বাইরে থেকেছে। বাইরে থেকে বারবার, শতাব্দীর পর শতাব্দী উন্নয়নের সে দোলাচল পেরিয়ে আজকে পুরুষতন্ত্রের উপলব্ধি_ বিশাল এ জনগোষ্ঠীকে উন্নয়নের মূল স্রোতের বাইরে রেখে উন্নয়ন সম্ভব নয়। আজ তাই পুরুষতন্ত্রের স্বার্থে নারীর উন্নয়ন দরকার। আর নারী অধিকারের অভিযাত্রা শুরু হয়েছিল শ্রম অধিকারকে কেন্দ্র করে। বিংশ শতাব্দীতে উত্তর আমেরিকা ও ইউরোপে শুরু হওয়া এ অভিযাত্রা শতবর্ষ সম্পন্ন করেছে এবং এ অধিকারের বার্তা পৃথিবীর সব অংশের নারীদের কাছে পেঁৗছে গেছে। সংগ্রামের বিভিন্ন পর্যায় পেরিয়েছে নারী। নারীর অধিকার আদায়ের সংগ্রাম দিনে দিনে সংগঠিত হয়েছে। সাম্যতা, ন্যায্যতা, অংশগ্রহণ, সিদ্ধান্ত গ্রহণ, স্বাবলম্বন, স্বাধীনতা, ক্ষমতায়ন_ এসব ধাপ পেরিয়ে শতবর্ষে পদার্পণ করে নারী আজ দাবি তুলেছে 'শিক্ষা, বিজ্ঞান, প্রযুক্তি ও প্রশিক্ষণে সমান অংশগ্রহণ নারীর সম্মানজনক অংশগ্রহণ নিশ্চিত করবে। সভ্যতার প্রথম ধাপ কৃষি, যার বিকাশে নারী ছিল অগ্রভাগে। কিন্তু মানবসভ্যতা বিকাশের ধারায় পুরুষতন্ত্র নারীর অবস্থানকে প্রান্তিক করেছে। সম্পদ, ভূমি, পুঁজি, অর্থনীতি, শিক্ষা, প্রযুক্তি, বিজ্ঞান, বাজার সব ক্ষেত্রে নারীর প্রবেশাধিকার হয়েছে প্রান্তিক। তাই উদ্ভাবক নারী আজ নিজ ভূমিতে উদ্বাস্তু। আজ বিশ্ব নারী দিবসের দাবি শিক্ষা, বিজ্ঞান, প্রযুক্তি ও প্রশিক্ষণে নারীর সমান অংশগ্রহণ। বর্তমান বিশ্ব বাস্তবতায় ক্রমবর্ধমান দারিদ্র্য, খাদ্য নিরাপত্তাহীনতা, পরিবেশ বিপর্যয় মোকাবেলায় নারীর উন্নয়ন অংশীদারিত্বকে স্বীকৃতি দিয়ে তার ক্ষমতায়নের প্রশ্নটি উন্নয়ন ও সভ্যতার বিকাশের স্বার্থে জরুরি হয়ে পড়েছে। কারণ বিশ্ব মানবকল্যাণের জন্য নারীমুক্তি অনিবার্য সত্য।
ফারহাত জাহান : গবেষক
No comments