যুদ্ধাপরাধের বিচার- অভ্যন্তরীণ বিষয়ে তুরস্কের হস্তক্ষেপ by আবদুল মান্নান
চারজন ‘বিজ্ঞ’ আলোচক একত্র হয়েছিলেন একটি বিদেশি রেডিওর ‘জানালা’ শিরোনামের ঘণ্টাব্যাপী একটি টক শোতে অংশ নিতে, যেটি আবার গত সোমবার একটি বেসরকারি টিভিতে প্রচার করা হলো। সঞ্চালক এই প্রজন্মের যুবক, কথাবার্তায় বেশ সাবলীল।
সামনে বসা বাছাই করা কয়েকজন দর্শক-শ্রোতা। আলোচকদের একজন একটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক, যিনি জামায়াতের রাজনীতির ওপর পিএইচডি করেছেন; দ্বিতীয়জন পেশাদার প্রকৌশলী এবং পরিবেশ নিয়ে আন্দোলন করেন; তৃতীয়জন বিএনপি থেকে নির্বাচিত সাংসদ এবং শেষের জন ক্ষুদ্র দলের বড় নেতা, যিনি ভাগ্যবলে আবার সরকারের মন্ত্রীও। আলোচনার বিষয় মূলত দুটি—একাত্তরের যুদ্ধাপরাধ ও মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে অভিযুক্ত ব্যক্তিদের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে বিচার, সেই বিচারে তুরস্কের অযাচিত হস্তক্ষেপ এবং অভিযুক্তদের মধ্যে কয়েকজনের পুনর্বিচারের জামায়াত-বিএনপির দাবি আর দ্বিতীয় বিষয়টি ছিল বাংলাদেশের প্রস্তাবিত গভীর সমুদ্রবন্দর।
বলা বাহুল্য, অধ্যাপক মহোদয় ও সাংসদ জামায়াতের অবস্থানকে সমর্থন করলেন। দুজনই বললেন যে তুরস্কের প্রেসিডেন্ট আবদুল্লাহ গুল বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর কাছে চিঠি লিখে গোলাম আযমসহ জামায়াতের অন্য নেতাদের মৃত্যুদণ্ড না দেওয়ার জন্য অনুরোধ করেছেন, এটিকে গুরুত্ব দেওয়া উচিত। কারণ, ওআইসির বর্তমান মহাসচিব তুরস্কের। সাংসদ আরও জানালেন, ওআইসির দায়িত্ব হচ্ছে তাদের সদস্য দেশগুলোতে যাতে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠিত হয় এবং মানবাধিকার লঙ্ঘিত না হয়, সেদিকে নজর রাখা। বলা বাহুল্য, তিনি নিজে তাঁর দলের অবস্থানের বাইরে যেতে পারবেন না। অধ্যাপক মহোদয় বিচারের স্বচ্ছতা প্রত্যাশা করেন এবং বেশ জোরালোভাবে গোলাম আযমদের পুনর্বিচার সমর্থন করেন। প্রকৌশলী এ ব্যাপারে শুধু বিচার দ্রুত সম্পন্ন করার কথা বললেন আর মন্ত্রী মহোদয় চোখ বন্ধ করে সরকারের অবস্থানকে সমর্থন করেই তাঁর দায়িত্ব সারলেন। তিনি কোনো কোনো মধ্যরাতের টিভি টক শোতে বেশ সমাদৃত, যেহেতু বিরোধী দলের পক্ষে অংশগ্রহণকারীরা তাঁকে বেশ কোণঠাসা করতে পারেন। যাঁরা দর্শক-শ্রোতা ছিলেন, তাঁদের যুদ্ধাপরাধ বিষয়ে মন্তব্যের অনেকটা অধ্যাপক আর সাংসদ মহোদয়ের অবস্থানকে সমর্থন করল।
সব শেষে মনে হলো, বর্তমানে একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধের জন্য যাঁদের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে বিচার হচ্ছে, তাঁদের বাঁচানোর এবং এই বিচার বানচাল করার যে একটি দেশীয় ও আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্র চলছে, এসব অনুষ্ঠান তাকেই সহায়তা করছে। ইকোনমিস্ট-এর মতো একটি জগদ্বিখ্যাত সাময়িকী যদি এই ষড়যন্ত্রের খপ্পরে পড়তে পারে, রেডিও তো কোন ছার। জামায়াত এই বিচারকে বানচাল করার জন্য দেশে ও বিদেশে যে কোটি কোটি ডলার খরচ করছে এবং খ্যাতিমানদের লবিস্ট নিয়োগ করেছে, তাঁরা তো আর বসে নেই। ধরুন, বিলেতের খ্যাতিমান ব্যারিস্টার টোবি ক্যাডমেন পেশায় আইনজীবী। তাঁর কাজ হচ্ছে নিজ মক্কেলের হয়ে মামলা লড়া অথবা সংশ্লিষ্ট আইনজীবীদের পরামর্শ দেওয়া। তিনি তাঁর সেই কাজ বাদ দিয়ে এখন নিজামীর ছেলে নাকিবুর রহমান নিজামীকে নিয়ে দেশে দেশে ঘুরে বেড়িয়ে এই বিচারের বিরুদ্ধে জনমত সৃষ্টি করে চলেছেন। ইতিমধ্যে তিনি তাঁর ওপর অর্পিত দায়িত্ব পালনে কিছুটা সফলও হয়েছেন। এ বিষয়ে আরব নিউজ-এ তাঁর একটি বেশ বড় সাক্ষাৎকার সস্প্রতি প্রকাশিত হয়েছে। গালফ নিউজ খবর দিয়েছে যে মাস খানেকের মধ্যে বিদেশের বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি, যেমন: রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, সাংসদ বা সিনেটর আবদুল্লাহ গুলের ভাষায় বাংলাদেশ সরকারকে আরও একটা চিঠি লিখবেন। ১৯৫৩ সালে জামায়াতের প্রতিষ্ঠাতা পিতৃপুরুষ আবুল আলা মওদুদী কাদিয়ানিদের অমুসলিম ঘোষণার দাবি তুলে লাহোরে ভয়াবহ দাঙ্গা বাধিয়ে প্রায় দুই হাজার নিরীহ মানুষ হত্যায় ইন্ধন জুগিয়েছিলেন। পাকিস্তান সরকার সে সময় লাহোরে সামরিক আইন জারি করতে বাধ্য হয় এবং মওদুুদী গ্রেপ্তার হন। সামরিক আইনে মওদুদীকে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত করা হয়। তখন জামায়াতের প্রধান পৃষ্ঠপোষক ছিলেন সৌদি আরবের বাদশা ইবনে সউদ। সেবার মওদুদী অনেকটা সৌদি বাদশার চাপের কারণে পার পেয়ে গিয়েছিলেন। আর সেটি ছিল পাকিস্তান রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার প্রাথমিক পর্যায়ে। কিন্তু পরবর্তীকালে যখন পাকিস্তানের সাবেক প্রধানমন্ত্রী ভুট্টোর ফাঁসির হুকুম হয়, তখন প্রেসিডেন্ট জিয়াউল হকের কাছে অনেক রাষ্ট্রই তাঁর সাজা মওকুফের জন্য চাপ দিয়েছিল। কিন্তু শেষ রক্ষা হয়নি। কারণ, তত দিনে পাকিস্তান কিছুটা হলেও সাবালক হয়েছে। মওদুদীকে যেভাবে বাঁচানো গিয়েছিল, ঠিক একই কায়দায় বর্তমানে জামায়াতের যেসব নেতা বাংলাদেশে যুদ্ধাপরাধ ও মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে অভিযুক্ত হয়ে আসামির কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে, তাঁদের বাঁচানোর জন্য জামায়াত একই ফন্দি এঁটেছে।
তুরস্কের প্রেসিডেন্টের আবেদনের ব্যাপারে ইতিমধ্যে বাংলাদেশ তার প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে। একটা কথা মনে রাখা ভালো, গোলাম আযমদের বিচারের ব্যাপারে বাংলাদেশ যদি একটি ইস্পাত কঠিন দৃঢ় অবস্থান নিতে না পারে, পরবর্তীকালে দেখা যাবে যে জামায়াতের হয়ে আরও অনেক দেশ ও ব্যক্তি অথবা গোষ্ঠী তুরস্কের প্রেসিডেন্টের মতো বাংলাদেশকে অযাচিত চাপ দিচ্ছে। সরকারের পক্ষে একা এমন শক্ত অবস্থান নেওয়া সহজ হবে না, যদি না তারা মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের সব শক্তিকে অন্তত এই একটি কাজে ঐক্যবদ্ধ করতে পারে।
তুরস্কের এমন একটি আবদারের পেছনে আরও একটি বড় কারণ আছে। সেটি হচ্ছে ১৯১৫ থেকে ১৯২৩ সাল পর্যন্ত তুরস্ক কর্তৃক তাদের অটোমান সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত আর্মেনীয় জনগণের ওপর পরিচালিত গণহত্যা, যে গণহত্যায় ধারণা করা হয় যে ১৫ থেকে ১৮ লাখ পর্যন্ত নিরীহ আর্মেনীয় খ্রিষ্টান ও মুসলমানকে হত্যা করা হয়েছিল। হত্যা ছাড়াও এই মানবতাবিরোধী অপরাধের অন্তর্ভুক্ত ছিল ধর্ষণ, বিপুলসংখ্যক আর্মেনীয়কে নিজ ভূমি থেকে উচ্ছেদ, খাদ্য থেকে বঞ্চিত করে হত্যা, ব্যাপক হারে শিশু হত্যা ইত্যাদি। ‘মানবতাবিরোধী অপরাধ’ শব্দ দুটি প্রথমে বিশ্বনেতারা আর্মেনীয় গণহত্যাকে কেন্দ্র করে ১৯১৫ সালে ব্যবহার করেন। এই গণহত্যার প্রধান নায়ক ছিলেন অটোমান খলিফার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মেহেদী তালাত পাশা, যিনি পরবর্তী সময়ে হিটলারের গণহত্যার নায়ক এডলফ আইখম্যানের গুরু হিসেবে স্বীকৃত হয়েছিলেন। আইখম্যান ৬০ লাখ ইহুদি ও অন্যদের হত্যার জন্য অভিযুক্ত হয়ে পরবর্তী সময়ে বিচারের রায়ে ইসরায়েলে ফাঁসিতে ঝুলেছিলেন। অটোমান সাম্রাজ্য ছিল বিশ্বের বৃহত্তম ও সবচেয়ে দীর্ঘস্থায়ী সাম্রাজ্য (প্রায় ৬০০ বছর)। উত্তর আফ্রিকা থেকে তা সুদূর পোল্যান্ড-যুগোস্লাভিয়া (বলকান অঞ্চল) পর্যন্ত এর বিস্তৃতি ছিল।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধে অটোমান খলিফা জার্মানির পক্ষ অবলম্বন করে এবং ব্রিটেন, ফ্রান্স ও রাশিয়ার যৌথ শক্তির কাছে পরাজিত হয়। পরাজয়ের পর বস্তুতপক্ষে যৌথ শক্তি পুরো অটোমান সাম্রাজ্য ছাড়াও তুরস্কও দখল করে নেয়, যা পরবর্তী সময়ে মুস্তাফা কামাল আতাতুর্কের নেতৃত্বে স্বাধীন হয়ে প্রজাতন্ত্র হিসেব আভির্ভূত হয়। বহু দিন ধরে তুরস্ক-ইরাক সীমান্তে স্বাধীনতাকামী কুর্দিদের ওপর তুরস্ক নির্বিচারে হত্যাযজ্ঞ চালিয়ে আসছে। ১৯৯৯ সাল থেকে কুর্দি নেতা আবদুল্লাহ ওসলানেকে বিনা বিচারে তুরস্ক আটকে রেখেছে। এ ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্রের ক্লার্ক বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসবিদ অধ্যাপক ওরচেস্টার এককাম তাঁর এক গবেষণাপত্রের অংশবিশেষ নিউইয়র্ক টাইমস পত্রিকায় (জুলাই ১৯, ২০১২) বলেছেন, তুরস্ক মানবাধিকারের নামে যা বলে অথবা করে, তা হচ্ছে একধরনের ভণ্ডামি। বাংলাদেশ এখন ওসলানের মুক্তি দাবি করতে পারে।
তুরস্ক কখনো আর্মেনীয় গণহত্যার কথা স্বীকার করেনি এবং বর্তমানে তুরস্কে তালাত পাশার নামে সড়কেরও নামকরণ করা হয়েছে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শেষ হলে তালাত পাশা পালিয়ে জার্মানিতে গোপনে আশ্রয় নেন এবং ১৯২১ সালে আর্মেনীয় বিপ্লবীরা বার্লিনে তাঁকে হত্যা করে। বহু দিন ধরে তুরস্ক ইউরোপীয় ইউনিয়নের সদস্য হওয়ার চেষ্টা করছে, কিন্তু যে কটি বিষয় তাদের এখনো ইইউর বাইরে থাকতে বাধ্য করছে, তার একটি হচ্ছে আর্মেনীয় গণহত্যার বিষয়টি স্বীকার করে ক্ষমা না চাওয়া। বাংলাদেশে বতর্মানে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে যাঁদের বিচার হচ্ছে, তা যদি বাংলাদেশ সফলভাবে শেষ করতে পারে, তাহলে তুরস্কের ওপর আর্মেনীয় গণহত্যার জন্য ক্ষমা চাওয়ার বিষয়টা আবারও জোরালো হবে। আসলে বাংলাদেশ একাত্তরের ঘাতকদের ব্যাপারে দীর্ঘ ৪০ বছর অনেক বেশি নমনীয়তা প্রদর্শন করেছে। বর্তমানে যেভাবে বিচার চলছে, তা-ও নজিরবিহীন। বিশ্বের কোনো গণহত্যা অথবা মানবতাবিরোধী বিচারের আসামিরা বাংলাদেশের আসামিদের মতো এত সুবিধা পাননি। এই বিচার ২০ কার্যদিবসের মধ্যে শেষ হওয়া সম্ভব ছিল বলে অনেক আইনজ্ঞ মনে করেন। অথচ এখানে আসামিরা শুধু যে সুযোগ-সুবিধা পাচ্ছেন তা-ই নয়, রায় তাঁদের বিপক্ষে গেলে আবার উচ্চ আদালতে আপিল করারও সুযোগ পাবেন।
দীর্ঘ ৪০ বছর একাত্তরের অভিযুক্ত ঘাতকদের বিচার না হওয়ার কারণে বর্তমানে বেশ কিছু মুক্তিযোদ্ধাও তাঁদের প্রতি সহানুভূতিশীল হয়ে পড়েছেন। গত ২৮ ডিসেম্বর বিএনপির নেতা এবং একাত্তরের রণাঙ্গনে আহত মুক্তিযোদ্ধা শমসের মুবিন চৌধুরী একটি টিভি চ্যানেলের টক শোতে বেশ জোরালোভাবে বললেন, যুদ্ধাপরাধের বিচার দুই বছরের জন্য স্থগিত করা হোক আর একই অনুষ্ঠানে বিএনপির নেতা ব্যারিস্টার মওদুদ, যিনি একাত্তরে মুজিবনগর সরকারের একজন গুরুত্বপূর্ণ কর্মকর্তা ছিলেন, তিনি তো এই বিচারকার্য সরাসরি বাতিলের জন্য জোর দাবি তুললেন। সুতরাং সরকারের উচিত হবে, দ্রুত এই বিচারকাজ শেষ করে রায় যাতে বাস্তবায়িত হয়, তার জন্য সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালানো। প্রয়োজনে আরও একটি ট্রাইব্যুনাল গঠন করা যেতে পারে। আর এসব করতে ব্যর্থ হলে হয়তো ভবিষ্যতে বাংলাদেশেও গোলাম আযমের নামে সড়কের নামকরণ করতে হবে। সময় দ্রুত ফুরিয়ে আসছে।
আবদুল মান্নান: সাবেক উপাচার্য, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।
বলা বাহুল্য, অধ্যাপক মহোদয় ও সাংসদ জামায়াতের অবস্থানকে সমর্থন করলেন। দুজনই বললেন যে তুরস্কের প্রেসিডেন্ট আবদুল্লাহ গুল বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর কাছে চিঠি লিখে গোলাম আযমসহ জামায়াতের অন্য নেতাদের মৃত্যুদণ্ড না দেওয়ার জন্য অনুরোধ করেছেন, এটিকে গুরুত্ব দেওয়া উচিত। কারণ, ওআইসির বর্তমান মহাসচিব তুরস্কের। সাংসদ আরও জানালেন, ওআইসির দায়িত্ব হচ্ছে তাদের সদস্য দেশগুলোতে যাতে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠিত হয় এবং মানবাধিকার লঙ্ঘিত না হয়, সেদিকে নজর রাখা। বলা বাহুল্য, তিনি নিজে তাঁর দলের অবস্থানের বাইরে যেতে পারবেন না। অধ্যাপক মহোদয় বিচারের স্বচ্ছতা প্রত্যাশা করেন এবং বেশ জোরালোভাবে গোলাম আযমদের পুনর্বিচার সমর্থন করেন। প্রকৌশলী এ ব্যাপারে শুধু বিচার দ্রুত সম্পন্ন করার কথা বললেন আর মন্ত্রী মহোদয় চোখ বন্ধ করে সরকারের অবস্থানকে সমর্থন করেই তাঁর দায়িত্ব সারলেন। তিনি কোনো কোনো মধ্যরাতের টিভি টক শোতে বেশ সমাদৃত, যেহেতু বিরোধী দলের পক্ষে অংশগ্রহণকারীরা তাঁকে বেশ কোণঠাসা করতে পারেন। যাঁরা দর্শক-শ্রোতা ছিলেন, তাঁদের যুদ্ধাপরাধ বিষয়ে মন্তব্যের অনেকটা অধ্যাপক আর সাংসদ মহোদয়ের অবস্থানকে সমর্থন করল।
সব শেষে মনে হলো, বর্তমানে একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধের জন্য যাঁদের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে বিচার হচ্ছে, তাঁদের বাঁচানোর এবং এই বিচার বানচাল করার যে একটি দেশীয় ও আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্র চলছে, এসব অনুষ্ঠান তাকেই সহায়তা করছে। ইকোনমিস্ট-এর মতো একটি জগদ্বিখ্যাত সাময়িকী যদি এই ষড়যন্ত্রের খপ্পরে পড়তে পারে, রেডিও তো কোন ছার। জামায়াত এই বিচারকে বানচাল করার জন্য দেশে ও বিদেশে যে কোটি কোটি ডলার খরচ করছে এবং খ্যাতিমানদের লবিস্ট নিয়োগ করেছে, তাঁরা তো আর বসে নেই। ধরুন, বিলেতের খ্যাতিমান ব্যারিস্টার টোবি ক্যাডমেন পেশায় আইনজীবী। তাঁর কাজ হচ্ছে নিজ মক্কেলের হয়ে মামলা লড়া অথবা সংশ্লিষ্ট আইনজীবীদের পরামর্শ দেওয়া। তিনি তাঁর সেই কাজ বাদ দিয়ে এখন নিজামীর ছেলে নাকিবুর রহমান নিজামীকে নিয়ে দেশে দেশে ঘুরে বেড়িয়ে এই বিচারের বিরুদ্ধে জনমত সৃষ্টি করে চলেছেন। ইতিমধ্যে তিনি তাঁর ওপর অর্পিত দায়িত্ব পালনে কিছুটা সফলও হয়েছেন। এ বিষয়ে আরব নিউজ-এ তাঁর একটি বেশ বড় সাক্ষাৎকার সস্প্রতি প্রকাশিত হয়েছে। গালফ নিউজ খবর দিয়েছে যে মাস খানেকের মধ্যে বিদেশের বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি, যেমন: রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, সাংসদ বা সিনেটর আবদুল্লাহ গুলের ভাষায় বাংলাদেশ সরকারকে আরও একটা চিঠি লিখবেন। ১৯৫৩ সালে জামায়াতের প্রতিষ্ঠাতা পিতৃপুরুষ আবুল আলা মওদুদী কাদিয়ানিদের অমুসলিম ঘোষণার দাবি তুলে লাহোরে ভয়াবহ দাঙ্গা বাধিয়ে প্রায় দুই হাজার নিরীহ মানুষ হত্যায় ইন্ধন জুগিয়েছিলেন। পাকিস্তান সরকার সে সময় লাহোরে সামরিক আইন জারি করতে বাধ্য হয় এবং মওদুুদী গ্রেপ্তার হন। সামরিক আইনে মওদুদীকে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত করা হয়। তখন জামায়াতের প্রধান পৃষ্ঠপোষক ছিলেন সৌদি আরবের বাদশা ইবনে সউদ। সেবার মওদুদী অনেকটা সৌদি বাদশার চাপের কারণে পার পেয়ে গিয়েছিলেন। আর সেটি ছিল পাকিস্তান রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার প্রাথমিক পর্যায়ে। কিন্তু পরবর্তীকালে যখন পাকিস্তানের সাবেক প্রধানমন্ত্রী ভুট্টোর ফাঁসির হুকুম হয়, তখন প্রেসিডেন্ট জিয়াউল হকের কাছে অনেক রাষ্ট্রই তাঁর সাজা মওকুফের জন্য চাপ দিয়েছিল। কিন্তু শেষ রক্ষা হয়নি। কারণ, তত দিনে পাকিস্তান কিছুটা হলেও সাবালক হয়েছে। মওদুদীকে যেভাবে বাঁচানো গিয়েছিল, ঠিক একই কায়দায় বর্তমানে জামায়াতের যেসব নেতা বাংলাদেশে যুদ্ধাপরাধ ও মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে অভিযুক্ত হয়ে আসামির কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে, তাঁদের বাঁচানোর জন্য জামায়াত একই ফন্দি এঁটেছে।
তুরস্কের প্রেসিডেন্টের আবেদনের ব্যাপারে ইতিমধ্যে বাংলাদেশ তার প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে। একটা কথা মনে রাখা ভালো, গোলাম আযমদের বিচারের ব্যাপারে বাংলাদেশ যদি একটি ইস্পাত কঠিন দৃঢ় অবস্থান নিতে না পারে, পরবর্তীকালে দেখা যাবে যে জামায়াতের হয়ে আরও অনেক দেশ ও ব্যক্তি অথবা গোষ্ঠী তুরস্কের প্রেসিডেন্টের মতো বাংলাদেশকে অযাচিত চাপ দিচ্ছে। সরকারের পক্ষে একা এমন শক্ত অবস্থান নেওয়া সহজ হবে না, যদি না তারা মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের সব শক্তিকে অন্তত এই একটি কাজে ঐক্যবদ্ধ করতে পারে।
তুরস্কের এমন একটি আবদারের পেছনে আরও একটি বড় কারণ আছে। সেটি হচ্ছে ১৯১৫ থেকে ১৯২৩ সাল পর্যন্ত তুরস্ক কর্তৃক তাদের অটোমান সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত আর্মেনীয় জনগণের ওপর পরিচালিত গণহত্যা, যে গণহত্যায় ধারণা করা হয় যে ১৫ থেকে ১৮ লাখ পর্যন্ত নিরীহ আর্মেনীয় খ্রিষ্টান ও মুসলমানকে হত্যা করা হয়েছিল। হত্যা ছাড়াও এই মানবতাবিরোধী অপরাধের অন্তর্ভুক্ত ছিল ধর্ষণ, বিপুলসংখ্যক আর্মেনীয়কে নিজ ভূমি থেকে উচ্ছেদ, খাদ্য থেকে বঞ্চিত করে হত্যা, ব্যাপক হারে শিশু হত্যা ইত্যাদি। ‘মানবতাবিরোধী অপরাধ’ শব্দ দুটি প্রথমে বিশ্বনেতারা আর্মেনীয় গণহত্যাকে কেন্দ্র করে ১৯১৫ সালে ব্যবহার করেন। এই গণহত্যার প্রধান নায়ক ছিলেন অটোমান খলিফার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মেহেদী তালাত পাশা, যিনি পরবর্তী সময়ে হিটলারের গণহত্যার নায়ক এডলফ আইখম্যানের গুরু হিসেবে স্বীকৃত হয়েছিলেন। আইখম্যান ৬০ লাখ ইহুদি ও অন্যদের হত্যার জন্য অভিযুক্ত হয়ে পরবর্তী সময়ে বিচারের রায়ে ইসরায়েলে ফাঁসিতে ঝুলেছিলেন। অটোমান সাম্রাজ্য ছিল বিশ্বের বৃহত্তম ও সবচেয়ে দীর্ঘস্থায়ী সাম্রাজ্য (প্রায় ৬০০ বছর)। উত্তর আফ্রিকা থেকে তা সুদূর পোল্যান্ড-যুগোস্লাভিয়া (বলকান অঞ্চল) পর্যন্ত এর বিস্তৃতি ছিল।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধে অটোমান খলিফা জার্মানির পক্ষ অবলম্বন করে এবং ব্রিটেন, ফ্রান্স ও রাশিয়ার যৌথ শক্তির কাছে পরাজিত হয়। পরাজয়ের পর বস্তুতপক্ষে যৌথ শক্তি পুরো অটোমান সাম্রাজ্য ছাড়াও তুরস্কও দখল করে নেয়, যা পরবর্তী সময়ে মুস্তাফা কামাল আতাতুর্কের নেতৃত্বে স্বাধীন হয়ে প্রজাতন্ত্র হিসেব আভির্ভূত হয়। বহু দিন ধরে তুরস্ক-ইরাক সীমান্তে স্বাধীনতাকামী কুর্দিদের ওপর তুরস্ক নির্বিচারে হত্যাযজ্ঞ চালিয়ে আসছে। ১৯৯৯ সাল থেকে কুর্দি নেতা আবদুল্লাহ ওসলানেকে বিনা বিচারে তুরস্ক আটকে রেখেছে। এ ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্রের ক্লার্ক বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসবিদ অধ্যাপক ওরচেস্টার এককাম তাঁর এক গবেষণাপত্রের অংশবিশেষ নিউইয়র্ক টাইমস পত্রিকায় (জুলাই ১৯, ২০১২) বলেছেন, তুরস্ক মানবাধিকারের নামে যা বলে অথবা করে, তা হচ্ছে একধরনের ভণ্ডামি। বাংলাদেশ এখন ওসলানের মুক্তি দাবি করতে পারে।
তুরস্ক কখনো আর্মেনীয় গণহত্যার কথা স্বীকার করেনি এবং বর্তমানে তুরস্কে তালাত পাশার নামে সড়কেরও নামকরণ করা হয়েছে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শেষ হলে তালাত পাশা পালিয়ে জার্মানিতে গোপনে আশ্রয় নেন এবং ১৯২১ সালে আর্মেনীয় বিপ্লবীরা বার্লিনে তাঁকে হত্যা করে। বহু দিন ধরে তুরস্ক ইউরোপীয় ইউনিয়নের সদস্য হওয়ার চেষ্টা করছে, কিন্তু যে কটি বিষয় তাদের এখনো ইইউর বাইরে থাকতে বাধ্য করছে, তার একটি হচ্ছে আর্মেনীয় গণহত্যার বিষয়টি স্বীকার করে ক্ষমা না চাওয়া। বাংলাদেশে বতর্মানে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে যাঁদের বিচার হচ্ছে, তা যদি বাংলাদেশ সফলভাবে শেষ করতে পারে, তাহলে তুরস্কের ওপর আর্মেনীয় গণহত্যার জন্য ক্ষমা চাওয়ার বিষয়টা আবারও জোরালো হবে। আসলে বাংলাদেশ একাত্তরের ঘাতকদের ব্যাপারে দীর্ঘ ৪০ বছর অনেক বেশি নমনীয়তা প্রদর্শন করেছে। বর্তমানে যেভাবে বিচার চলছে, তা-ও নজিরবিহীন। বিশ্বের কোনো গণহত্যা অথবা মানবতাবিরোধী বিচারের আসামিরা বাংলাদেশের আসামিদের মতো এত সুবিধা পাননি। এই বিচার ২০ কার্যদিবসের মধ্যে শেষ হওয়া সম্ভব ছিল বলে অনেক আইনজ্ঞ মনে করেন। অথচ এখানে আসামিরা শুধু যে সুযোগ-সুবিধা পাচ্ছেন তা-ই নয়, রায় তাঁদের বিপক্ষে গেলে আবার উচ্চ আদালতে আপিল করারও সুযোগ পাবেন।
দীর্ঘ ৪০ বছর একাত্তরের অভিযুক্ত ঘাতকদের বিচার না হওয়ার কারণে বর্তমানে বেশ কিছু মুক্তিযোদ্ধাও তাঁদের প্রতি সহানুভূতিশীল হয়ে পড়েছেন। গত ২৮ ডিসেম্বর বিএনপির নেতা এবং একাত্তরের রণাঙ্গনে আহত মুক্তিযোদ্ধা শমসের মুবিন চৌধুরী একটি টিভি চ্যানেলের টক শোতে বেশ জোরালোভাবে বললেন, যুদ্ধাপরাধের বিচার দুই বছরের জন্য স্থগিত করা হোক আর একই অনুষ্ঠানে বিএনপির নেতা ব্যারিস্টার মওদুদ, যিনি একাত্তরে মুজিবনগর সরকারের একজন গুরুত্বপূর্ণ কর্মকর্তা ছিলেন, তিনি তো এই বিচারকার্য সরাসরি বাতিলের জন্য জোর দাবি তুললেন। সুতরাং সরকারের উচিত হবে, দ্রুত এই বিচারকাজ শেষ করে রায় যাতে বাস্তবায়িত হয়, তার জন্য সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালানো। প্রয়োজনে আরও একটি ট্রাইব্যুনাল গঠন করা যেতে পারে। আর এসব করতে ব্যর্থ হলে হয়তো ভবিষ্যতে বাংলাদেশেও গোলাম আযমের নামে সড়কের নামকরণ করতে হবে। সময় দ্রুত ফুরিয়ে আসছে।
আবদুল মান্নান: সাবেক উপাচার্য, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।
No comments