জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধি-জনজীবনে দুর্ভোগ বাড়বে
সিদ্ধান্তটি অজনপ্রিয়, কিন্তু ভর্তুকি ব্যয় হ্রাসের জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ বলেই গণ্য। বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশনের হিসাবে, দাম বাড়ানোর আগে জ্বালানি তেলে প্রায় সাড়ে আট হাজার কোটি টাকা ভর্তুকি দিতে হতো। মূল্যবৃদ্ধির ফলে ভর্তুকির পরিমাণ আড়াই হাজার কোটি টাকা কমবে।
অর্থাৎ মূল্যবৃদ্ধির পরও বিপুল অঙ্কের অর্থ ভর্তুকি দিয়ে যেতে হবে। বিপুল পরিমাণ ভর্তুকির বোঝা সত্ত্বেও অধিকাংশ দেশে জ্বালানি তেলে ভর্তুকি দেওয়াই রেওয়াজ। কেননা, জ্বালানি তেলই প্রকারান্তরে জীবনযাত্রার ব্যয়ের সূচক নির্ধারণ করে দেয়। তেলের মূল্যবৃদ্ধির অর্থ বাজারের সকল পণ্যের মূল্যবৃদ্ধি। কেননা, মূল্যবৃদ্ধির সঙ্গে উৎপাদন ও পরিবহন ব্যয়ও বেড়ে যায়। প্রতিবেশী দেশ ভারতে তেলের মূল্যবৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে প্রতিবাদে মুখর হয়ে ওঠে রাজপথ। সরকারগুলোও মূল্যবৃদ্ধির আগে পূর্বাপর বিচার করতে বাধ্য হয়। বিপুল ভর্তুকির বোঝা বয়ে নিয়ে চলা ছাড়া গত্যন্তর থাকে না। তুলনায় বাংলাদেশে এ নিয়ে প্রতিবাদ-প্রতিরোধ কম। বর্তমান সরকারই চার বছরের মেয়াদে পাঁচ দফা মূল্যবৃদ্ধি করল। এ নিয়ে জনমনে অস্বস্তি তৈরি হয়েছে; কিন্তু প্রতিবাদ-প্রতিরোধের দেখা মেলেনি। এবার বিরোধীদলীয় জোট জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধির প্রতিবাদে হরতাল ডেকেছে। হরতালের মতো কর্মসূচি উন্নয়ন ও অগ্রগতির পথে বাধা। স্বাভাবিক জীবনযাত্রার ওপর বিরূপ প্রভাব ফেলে এমন কর্মসূচি। বাজারেও এর নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। এ পরিস্থিতিতে হরতালের বিকল্প কোনো শান্তিপূর্ণ কর্মসূচিই শ্রেয় ছিল। প্রতিবাদ হোক না হোক, জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধির আগে সার্বিক পরিস্থিতি বিচার করা সরকারের কর্তব্য। কেননা, বাজার স্থিতিশীল রাখতে হলে এ ক্ষেত্রে স্থিতিশীলতা দরকার। এমনিতেই নির্দিষ্ট আয়ের মধ্যশ্রেণীর ক্রেতারা বাজারে গিয়ে সুবিধা করতে পারছেন না। জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধি তাদের আবার আক্রান্ত করবে। যানবাহন থেকে শুরু করে কাঁচাবাজার সর্বত্র বাড়তি মূল্য গুনতে হবে। সরকারের মেয়াদের চার বছর পূর্ণ হচ্ছে। অন্যদিকে এ বছরটিকেই নির্বাচনের বছর বলে গণ্য করা হচ্ছে। এ অবস্থায় জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধি ও এর প্রভাব সরকারের জনপ্রিয়তায়ও নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে। শুধু তাই নয়, বোরো ধান চাষের মৌসুমে ডিজেলের মূল্যবৃদ্ধি কৃষককেও ক্ষতিগ্রস্ত করবে। পাশাপাশি, বর্তমান মূল্যে অকটেন ও পেট্রোলের ক্ষেত্রে ভর্তুকি দিতে হয় না। এ অবস্থায় জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধি সমর্থনযোগ্য নয়। বাজারের স্থিতিশীলতার স্বার্থে একযোগে সকল জ্বালানি তেলের দাম না বাড়িয়ে কিছু পুনর্বিবেচনা ও দূরদর্শিতার পরিচয় দেওয়া আবশ্যক। বারবার জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধির পেছনে রেন্টাল ও কুইক রেন্টালে জ্বালানি তেলের ব্যবহারকেই দায়ী করা হয়। বিদ্যুৎ উৎপাদনে হ্রাসকৃত মূল্যে তেল সরবরাহ করার কারণে ভর্তুকির বোঝা যে বেড়ে যাচ্ছে, তাতে সন্দেহ নেই। উৎপাদন ব্যয় বৃদ্ধির কারণে বিদ্যুতের দামও কয়েক দফা বাড়ানো হয়েছে। বিদ্যুতের ব্যয় যাতে না বাড়ে, সে জন্য এবার ফার্নেস অয়েলের দাম বাড়ানো হয়নি। এ অবস্থায় বিকল্প বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যবস্থা তৈরির দিকেই মনোযোগ দিতে হবে। জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধির পর বাজারে যে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে, সে বিষয়ে মনোযোগ দেওয়া সরকারের অবশ্য কর্তব্য। অভিজ্ঞতায় দেখা যায়, তেলের মূল্য বাড়লে সিএনজিচালিত যানগুলোও ভাড়া বাড়িয়ে দেয়। তেলের দাম প্রতি লিটারে ৫ টাকা বাড়লে যানবাহনের মালিকরা তার চেয়েও অনেক বেশি হারে ভাড়া আদায়ের চেষ্টা করেন। এ প্রবণতা যে কোনো মূল্যে রুখতে হবে। সে জন্য সরকারের কঠোর নজরদারি ও নির্দেশনার বিকল্প নেই।
No comments