সদরে অন্দরে-ঐ নূতনের কেতন ওড়ে by মোস্তফা হোসেইন

খ্রিস্টীয় বছরের প্রথম দিন ভোরবেলা। উঠোনে ২০ জোড়া কবুতর বাকুম বাকুম করছে। কিছু খাবার খাচ্ছে আবার বকর বকর করছে কিছু। ওদের ভাষা নিয়ে ভাবতে গেলে যে কারো হাসি পেতে পারে। কিন্তু এক সময় কবুতরের কথা বোঝার জন্য খোপের দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকার অভ্যাস ছিল।
তাও নিজের কবুতর নয়, প্রতিবেশী সহপাঠীর বাড়িতে গিয়ে তাকিয়ে থাকতাম। এই চেষ্টা ছিল কবুতরের মালিক সহপাঠীরও। দারুণ নেশা। অথচ এক সময় সেই নেশায়ও ভাটা পড়ত। সহপাঠীর দুঃখ ছিল, তিন জোড়া কবুতর পুষছি; কিন্তু একটা বাচ্চাও খাওয়ার ভাগ্য হয় না। হবে কী করে? কবুতরের বাচ্চাগুলো জবাই করার বয়স হলে যে বাজারে নিয়ে যেতে হতো বিক্রির জন্য। ছয় আনা থেকে আট আনা জোড়া বিক্রি করে তাকে কিনতে হতো বই-খাতা, কালি কিংবা কলম।
একই সময় মধ্যবিত্ত গৃহস্থসন্তানদের অনেককেই বাবার কাছ থেকে টাকা নিয়ে যেতে হতো গ্রামের বাড়ি কুমিল্লার চান্দলা থেকে ছয় মাইল দূরে কুটিবাজারে। হেঁটেই যাওয়া লাগত। কারণ অর্ধশত বছর আগে পাকা রাস্তা ছিল না ওই এলাকায়। কুটিবাজারে বইপট্টি ছিল একটি। চট বিছিয়ে বই সাজিয়ে বসত দোকানি। স্তরে স্তরে সাজানো পুরনো বই। বই কিনে বাড়ি ফিরতে ফিরতে বেলা শেষ হয়ে যেত। তবে একবার বাজারে গিয়ে সব বই কেনা সম্ভব হতো না। ধাপে ধাপে বই কিনে পুরোদমে ক্লাস শুরু হতে চলে যেত বছরের তিন মাস। তারপর শুরু হতো স্কুলের নিয়মিত ক্লাস। মানুষের অর্থনৈতিক অবস্থার পরিবর্তনের পর পুরনো বই কিনে হয়তো লেখাপড়া করতে হয় না অনেক দিন ধরেই, কিন্তু নতুন বই কিনতে কিনতে ঠিকই চলে যেত বছরের তিন-চার মাস। এই চিত্র তো মাত্র বছর পাঁচেক আগেও দেখা গেছে।
হালে ব্যাপক পরিবর্তন এসেছে শিক্ষার্থীদের বই পাওয়ার ক্ষেত্রে। এবার বছরের প্রথম দিনে বই উৎসবের টেলিভিশন সংবাদচিত্র দেখতে দেখতে মনে হচ্ছিল, এই যুগের শিশুরা কত ভাগ্যবান। কী উৎসবমুখর পরিবেশ দেখা গেছে সারা দেশের স্কুলগুলোতে। নতুন বই নাকের কাছে এনে গন্ধ নিচ্ছে কচি শিশুরা। গন্ধ নিতে নিতে দ্রুত বাড়ি ফেরার প্রতিযোগিতায় মেতে উঠেছিল শিক্ষার্থীরা। এ এক অপূর্ব দৃশ্য। মন কেড়ে নেওয়ার মতো অবশ্যই। মন কেড়ে নিতে পেরেছে অভিভাবকদেরও। কারণ মাত্র কয়েক দিন আগেই জেএসসি আর পিএসসি পরীক্ষায় স্মরণাতীতকালের রেকর্ড ভঙ্গ করা পাসের হার দেখেছেন তাঁরা। ফল শুধু সংখ্যার দিকেই নয়, রেকর্ড হয়েছে ভালো ফলেরও। নিজেদের সন্তানদের এই সুখের দিনে কোনো অভিভাবকেরই মনস্তুষ্টি না হয়ে পারে না। তার সঙ্গে যোগ হয়েছে বছরের প্রথম দিনে শিক্ষার্থীদের হাতে বই চলে যাওয়া, সময়মতো ক্লাস শুরু হওয়া আর শিক্ষার্থীদের যথোচিত পরিচালনা।
সন্দেহাতীতভাবে বলতে হবে, এই সাফল্য সবাইকে তৃপ্তি দিতে পারে। অন্তত দুর্নীতি, দুঃশাসন আর অন্য ব্যর্থতাগুলোর পাশে এই সাফল্য নিশ্চিত করে বলে দিতে পারে, ইচ্ছা থাকলে আমাদের এখানেও সম্ভব। রীতিমতো এটা একটা যজ্ঞ। সারা দেশের ৮২ হাজার ২১৮টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ডিসেম্বরের মধ্যে বই পৌঁছে যাওয়ার ঘটনা অবশ্যই শিক্ষাক্ষেত্রে বিশাল অর্জনের প্রমাণই বহন করে। আর এসব স্কুল ও মাদ্রাসার প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষার্থীর সংখ্যা তিন কোটি ৬৮ লাখ ৮৬ হাজার ১৭২ জন। বিপুলসংখ্যক এই শিক্ষার্থীর বইপ্রাপ্তি নিশ্চিত করতে সরকারকে ওই যজ্ঞে মেতে থাকতে হয়েছে। এসব শিক্ষার্থীর প্রত্যেকের হাতে বই পৌঁছে দিতে গিয়ে কোনো রকম উচ্ছৃঙ্খল পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়নি- এটাও কম কথা নয়। বই বিতরণ হয়েছে ২৬ কোটি ১৮ লাখ ৯ হাজার ১০৬টি।
বাংলাদেশের উন্নয়ন বাধাগ্রস্ত করার মানুষেরও অভাব নেই। বিশেষ করে নোট বই ছেপে যারা শিক্ষার্থীদের মধ্যে ক্ষতিকর প্রভাব ফেলছিল, তাদের প্রচেষ্টা থেমে থাকার কথা নয়। এর প্রমাণও আমরা পেয়েছি বার কয়েক। সরকারের বিনা মূল্যে বই দেওয়ার এই পরিকল্পনা যাতে বাস্তবায়ন না হয়, সে জন্য বছর দুয়েক আগে কাগজ ও বইয়ের গুদাম আগুনে পুড়ে ছাই হওয়ার ঘটনা আমাদের ভুলে যাওয়ার কথা নয়। এবারও একটি বইয়ের গুদামে আগুন লাগার ঘটনা ঘটেছে। কিন্তু এ ধরনের আপদ মোকাবিলা করার আগাম প্রস্তুতি থাকার কারণে বই বিতরণে কোনো অসুবিধা হয়নি।
সরকারের বাধ্যতামূলক প্রাথমিক শিক্ষা লাভের কর্মসূচি বাস্তবায়ন করতে হলে বইপ্রাপ্তি নিশ্চিত করা একটি পদক্ষেপ মাত্র। মূল লক্ষ্য অর্জন করতে হলে বই বিতরণের পাশাপাশি আরো কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করা অপরিহার্য বলে মনে করি। দেশের বিপুলসংখ্যক শিশু এখনো শিক্ষায়তনের বাইরে রয়ে গেছে। তাদের শিক্ষার আলোয় আলোকিত করা ব্যতিরেকে দেশকে নিরক্ষরমুক্ত করার কোনো উপায় নেই। ইউনিসেফের হিসাব অনুযায়ী এখনো ৩ দশমিক ৩ মিলিয়ন বা ৩৩ লাখ শিশু শিক্ষার আলো থেকে বঞ্চিত রয়ে গেছে। বিপুলসংখ্যক শিশুকে শিক্ষার আওতায় আনতে গেলে আর্থসামাজিক পরিবর্তন প্রয়োজন। দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা ছাড়া এটা আদৌ সম্ভব হবে বলে মনে হয় না। তদুপরি শিক্ষার মান নিয়ে প্রশ্ন কিন্তু এখনো রয়ে গেছে। সৃজনশীল পদ্ধতিতে শিক্ষাব্যবস্থা চালু হওয়ার কারণে পাসের হার বেড়ে গেছে বলে মনে করা হয়। কিন্তু শিক্ষার মান নিশ্চিত করার জন্য যতটা গুরুত্ব দেওয়া প্রয়োজন, ততটা দেওয়া হচ্ছে না।
বছরের প্রথম দিন শিক্ষার্থীদের হাতে বই তুলে দেওয়ার পাশাপাশি শিক্ষাক্রমেও কিছু পরিবর্তন আনা হয়েছে, যা নিয়ে আলোচনার সুযোগ আছে। শিক্ষার্থীদের ওপর নোট বইয়ের চাপ কমানোর সরকারি পরিকল্পনা বাস্তবায়নের লক্ষ্যে এই পরিবর্তন আনা হলেও শিক্ষার্থীদের ওপর বাড়তি চাপ কিন্তু ঠিকই থেকে যাচ্ছে। বিষয়সংখ্যা ও নম্বর বাড়িয়ে দিয়ে সেই কাজটিই করা হয়েছে। যেমন ২০১২ সাল পর্যন্ত ষষ্ঠ শ্রেণী থেকে অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত শিক্ষার্থীদের পরীক্ষা দিতে হতো ৮০০ নম্বরের। এখন বাড়িয়ে ১০০০ নম্বর করা হয়েছে। বই যোগ হয়েছে তিনটি। নবম ও দশম শ্রেণীতে আগে শিক্ষার্থীরা ১১০০ নম্বরের পরীক্ষা দিত, এখন তাদের দিতে হবে ১৩০০ নম্বরের। বই যোগ হয়েছে শারীরিক শিক্ষা, ক্যারিয়ার শিক্ষা ও তথ্য-প্রযুক্তির ওপর। তার মধ্যে নবম ও দশম শ্রেণীর শিক্ষার্থীদের স্বাস্থ্যবিজ্ঞান, শারীরিক শিক্ষা, খেলাধুলার বিষয়ও পড়তে হবে। অবশ্য আগের মূল বইগুলোতে বিষয় সংকোচন করা হয়েছে। আবার নবম ও দশম শ্রেণীর বাণিজ্য বিভাগে ফিন্যান্স অ্যান্ড ব্যাংকিং যোগ করে শিক্ষার্থীদের বোঝা বাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে বলেও মনে করা যায়। অথচ এই বিষয়টি একাদশ ও দ্বাদশ শ্রেণীতে পড়ানো হয়ে থাকে।
নতুন বইয়ে এই পরিবর্তন ছাড়া পরীক্ষাক্ষেত্রেও পরিবর্তন আনা হয়েছে। আগে বছরে তিনটি পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হতো। এতে করে শিক্ষার্থীরা পুরো বইকে তিন ভাগে ভাগ করে পড়ার সুযোগ পেত। ফলে তাদের পড়ার চাপ কম থাকত। পাশাপাশি তিনটি পরীক্ষাকে কেন্দ্র করে তাদের মধ্যে প্রস্তুতি ছিল বেশি। কিন্তু এখন বছরে দুটি পরীক্ষা অনুষ্ঠানের কারণে তাদের মধ্যে মানসিক শৈথিল্য আসতে পারে, পাশাপাশি একেক পরীক্ষায় অর্ধেক বই থেকে জবাব দিতে বাধ্য হওয়ার কারণে চাপও বেড়ে যাবে। তাই বছরে দুটি পরীক্ষার পরিবর্তে তিনটি পরীক্ষা পুনর্বহাল করা উত্তম হবে বলে মনে করি। পাশাপাশি তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি এবং ক্যারিয়ার শিক্ষার ৫০ নম্বর ঠিক রেখে সিলেবাস কমিয়ে আনা গেলেও শিক্ষার্থীদের চাপ কমে যেতে পারে। নোট বইয়ের চাপ থেকে রক্ষা করার নামে তাদের যদি অতিরিক্ত বইয়ের চাপে ফেলা হয়, তাহলে হিতে বিপরীত হবে- এটা মনে রাখা প্রয়োজন। এতে করে কোচিংয়ের ওপর নির্ভরশীলতা বেড়ে যেতে বাধ্য, যা সরকারি নীতিমালাকেও ব্যাহত করবে, শিক্ষার্থীদেরও ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়াবে।
mhussain_71@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.