চৈতন্যের মুক্ত বাতায়ন-প্রাকৃতজনের সাংস্কৃতিক আন্দোলন ও কাঙ্ক্ষিত রাজনীতি by যতীন সরকার

যে ধরনের সাংস্কৃতিক আন্দোলনের অনুষঙ্গীরূপে সুস্থ রাজনীতির উদ্ভব ঘটতে পারত, স্বাধীন বাংলাদেশে তেমন সাংস্কৃতিক আন্দোলন গড়ে তুলতে আমরা ব্যর্থ হলাম কেন? এই 'কেন'র উত্তর পেতে হলে আমাদের দেশের মধ্যবিত্তের ভূমিকার স্বরূপ সন্ধান করতে হবে।


বিশেষ করে শিক্ষিত নাগরিক মধ্যবিত্তের। কারণ এই মধ্যবিত্তরাই বাংলাদেশের সমাজ ও রাষ্ট্রের সর্বত্র কর্তৃত্বশীল। এই মধ্যবিত্তদের নেতৃত্বেই এ দেশের মানুষ মুক্তিযুদ্ধ করেছিল এবং এর আগে মধ্যবিত্তরাই পাকিস্তানের ভাবাদর্শবিরোধী সাংস্কৃতিক আন্দোলনেও নেতৃত্ব দিয়েছিল। সে আন্দোলনটি যে অনেক বেগবান হয়ে সার্থকতার তুঙ্গ স্পর্শ করেছিল, সে ব্যাপারে সামান্য সন্দেহেরও অবকাশ নেই। তবে সে সঙ্গে এ কথাও কিন্তু বলতে হবে যে মধ্যবিত্তের বৃত্তসীমার বাইরে অবস্থিত প্রাকৃতজনের কোনো প্রত্যক্ষ সংযোগ সে আন্দোলনে ছিল না। তাদের পক্ষে সে আন্দোলনের সমর্থন বা বিরোধিতা- কোনোটাই করা সম্ভব ছিল না। বিদগ্ধজনের যে উচ্চ সংস্কৃতিকে লক্ষ্যবিন্দুতে রেখে সৃষ্টি হয়েছিল এ আন্দোলন, অবিদগ্ধ প্রাকৃতজনের সাধ্য ছিল না তার নাগাল পাওয়ার।
হ্যাঁ, ভাষা আন্দোলনের প্রাথমিক পর্যায়ে দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ কৃষক ও কৃষিসংশ্লিষ্ট গ্রামীণ মানুষও এর সঙ্গে একাত্মতা বোধ করেছিল বটে। কারণ এ আন্দোলনে তো তাদেরই প্রাণপ্রতিম সন্তানরা প্রাণ হারিয়েছিল। তাদের 'মুখের ভাষা কাইড়্যা নিতে চায়' যারা, সেই দুশমনদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছিল বলেই যে তাদের সন্তানদের নির্যাতনের শিকার হতে হয়- এমন ধারণা গাঁয়ের কৃষকসহ অনক্ষর বা প্রায়-অনক্ষর সব প্রাকৃতজনের মধ্যে সঞ্চারিত হয়েছিল। এই ধারণা থেকেই ভাষা আন্দোলনের সঙ্গে ঘটে তাদের পরোক্ষ সংযুক্তি।
তবে পরোক্ষ হলেও এ রকম সংযুক্তিতেই তাদের চেতনায় প্রচণ্ড ক্ষোভ ও ক্রোধের সঞ্চার ঘটেছিল। সেই ক্ষোভ ও ক্রোধই এ দেশের সব প্রাকৃতজনকে রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত করে দিয়েছিল। সে যুক্ততারই তারা প্রকৃষ্ট প্রমাণ রাখে ১৯৫৪ সালের প্রাদেশিক নির্বাচনে পাকিস্তান স্রষ্টা মুসলিম লীগের ভরাডুবি ঘটিয়ে।
মধ্যবিত্ত রাজনীতিকরা নিম্নবিত্ত ও বিত্তহীন প্রাকৃতজনের ঘাড়ে ভর করেই তাদের রাজনৈতিক (এবং অর্থনৈতিক) ফায়দা উঠিয়ে নেয়। এই মধ্যবিত্তদেরই এক গোষ্ঠী আরেক গোষ্ঠীকে ল্যাং মেরে ফেলে দেয় এবং ক্ষমতার মঞ্চটিকে দখল করে। মঞ্চাধিষ্ঠিত হওয়ার পর রাজনীতিকদের আগের রূপটি আর থাকে না, পাল্টে যায় তাঁদের বোল ও ভোল- দুই-ই। তবে ক্ষমতার মঞ্চে উঠেও কোনো রাজনৈতিক দল বা গোষ্ঠীই নিশ্চিন্তে থাকতে পারে না। সর্বদাই তাদের আশঙ্কা- 'যাহারে পেয়েছি তারে কখন হারাই!' এ রকম আশঙ্কা সত্য হয়ে উঠতেও বেশি সময় লাগে না। অনেক সময়ই প্রতিদ্বন্দ্বী রাজনৈতিক বা অরাজনৈতিক বা অনেক সময়ই রাজনীতিবিরোধী শক্তি তাদেরও ল্যাং মেরে ফেলে দেয়।
এমনটিই ঘটেছিল তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে ১৯৫৪-এর প্রাদেশিক নির্বাচনের পরও। সে সময়কার রাজনীতিকদের ন্যক্কারজনক ভূমিকার বিস্তৃত বিবরণ ও বিশ্লেষণ প্রদান আমাদের বর্তমান আলোচনার জন্য খুব প্রাসঙ্গিক নয়। আমরা সবাই জানি, ১৯৫৪-এর নির্বাচনের পরে রাজনীতিকদের ভেতরে যে খেয়োখেয়ি চলছিল, তাতে ক্রমাগত ইন্ধন জুগিয়ে যাচ্ছিল পাকিস্তানের ফৌজি কর্তারা। পরে একপর্যায়ে তারাই ক্ষমতা দখল করল, জঙ্গি আইনের নামে চালালো জংলি দুঃশাসন। রাজনীতিকদের জেলে পুরল এবং পরে তাঁদেরই কাউকে কাউকে জেল থেকে বের করে এনে মন্ত্রী বানাল।
পাকিস্তানের সেই অপরাজনীতি ও বিরাজনৈতিকীকরণ-প্রক্রিয়া চলার সময়, অন্তত ষাটের দশকের গোড়া থেকে, আমাদের এ ভূখণ্ডে যে সাংস্কৃতিক আন্দোলন তীব্রতর হয়ে উঠেছিল এবং সে আন্দোলনের সুফলরূপেই যে বাঙালির স্বাধিকারের রাজনীতির নব অভ্যুদয় ঘটেছিল- সেসব কথা আমাদের জাতির স্মৃতি থেকে কখনো মুছে যাবে না।
কিন্তু বিস্মৃত হলে চলবে না যে সে সময়কার সেই সাংস্কৃতিক আন্দোলন ছিল শিক্ষিত নাগরিক মধ্যবিত্তের ভাবাদর্শ ও আশা-আকাঙ্ক্ষারই ধারক-বাহক। প্রাকৃতজনের সঙ্গে সে আন্দোলনের ক্ষীণতম সংযোগও ছিল না। রাজনৈতিক আন্দোলন-সংগ্রামও হয়েছিল মধ্যবিত্ত নেতৃত্বেই। তাই স্বাভাবিকভাবেই স্বাধীন বাংলায় ক্ষমতার মঞ্চটিও থাকে মধ্যবিত্তেরই দখলে। স্বাধীন বাংলাদেশের মধ্যবিত্তরা আপন স্বার্থ উদ্ধারের জন্য মরিয়া হয়ে উঠে পুরো স্বাধীনতাকেই অর্থহীন করে দেয়। যারা স্বাধীনতার মূল্যবোধের কথা বলতে বলতে মুখে ফেনা তুলে ফেলে, তাদের মধ্যেও ঘাপটি মেরে আছে প্রচুর মতলববাজ। মুখের কথার সঙ্গে তাদের প্রাণের বিশ্বাসের ও বাস্তব কাজকর্মের কোনো মিল নেই।
আমার আলোচনাটি অনেক বিস্তৃত ও বিক্ষিপ্ত হয়ে যেতে পারে, এই ভয়েই প্রকৃত সংজ্ঞা ও ব্যাখ্যা না দিয়েই 'মধ্যবিত্ত' শব্দটি আমি ব্যবহার করছি। এর ফলে যে বিভ্রান্তি সৃষ্টিরও অবকাশ রয়েছে- সে কথাও অবশ্যই স্বীকার করি। শুধু বলি, মধ্যবিত্ত কোনো সুনির্দিষ্ট শ্রেণী নয়। বিশেষ করে বাংলাদেশের মধ্যবিত্ত তো সদা পরিবর্তমান-গোষ্ঠীবিশেষ। এ গোষ্ঠীর কেউ হয়তো দুই দিন আগে ছিল নিতান্তই নিম্নবিত্ত, কেউ হয়তো ঘটনাপরম্পরায় বিত্ত হারিয়ে ফেলে নিচের দিকে নেমে যাচ্ছে, আবার অনেকেই মধ্যবিত্ত থেকে রাতারাতি উচ্চবিত্তের পর্যায়ে উঠে গেছে। তাই বলতে হয়, মধ্যবিত্তের কোনো সুস্থির শ্রেণীচরিত্র নেই।
এই মধ্যবিত্তদের মধ্যেই বিদ্যমান রাজনৈতিকানয়নের শক্তিও। সেই শক্তিই পাকিস্তানের আইয়ুব-ইয়াহিয়াদের উত্তরাধিকারীরূপে বাংলাদেশেও জঙ্গি শাসন কায়েম করে, রক্তের অক্ষরে লেখা সংবিধানকে কেটেকুটে পাকিস্তানায়নের পথ খুলে দেয়। এরপর তো দেখছি বিরাজনৈতিক জঙ্গি শাসকদের তৈরি করা বিধিবিধানকেই সর্বান্তকরণে অঙ্গীকার করে নিয়েছে ক্ষমতাসীন ও আশু ক্ষমতাপ্রত্যাশী সব রাজনৈতিক গোষ্ঠী।
এ রকম রাজনৈতিক ও বিরাজনীতির হাত থেকে মুক্ত হয়ে স্বাধীন দেশের উপযোগী রাজনীতির উদ্ভব ঘটানোর জন্যই প্রয়োজন পাকিস্তান আমলের চেয়েও প্রবলতর সাংস্কৃতিক আন্দোলন গড়ে তোলা। সে প্রয়োজন সাধনের জন্য কিন্তু কোনোমতেই নাগরিক মধ্যবিত্তের মতাদর্শ ও ভাবনাধারার ওপর নির্ভর করা চলবে না। পাকিস্তানি শাসনের কালে এই নাগরিক মধ্যবিত্তের অন্তর্গত সুধীজন 'শিষ্ট' সংস্কৃতিরূপে খ্যাত ও বাঙালির উচ্চবর্গে অনুশীলিত সংস্কৃতি রক্ষার জন্য যে আন্দোলনের সূচনা ঘটিয়েছিল, সে আন্দোলনের সঙ্গে মধ্যবিত্তের গরিষ্ঠ অংশই কোনো না কোনোভাবে নিজেদের সংযুক্ত করেছিল। সে জন্য প্রশংসা তাদের অবশ্যই প্রাপ্য। তবু বলতেই হবে যে সে আন্দোলন তাদের শ্রেণীস্বার্থ রক্ষার অনুকূল ছিল বলেই এর সঙ্গে সংযুক্ত না হওয়ার কোনো উপায় ছিল না তাদের পক্ষে।
কিন্তু স্বাধীনতার পর নিজেদের শ্রেণীস্বার্থ আরো মজবুত করার গরজেই ধর্মতন্ত্রী মৌলবাদের সঙ্গে আপস করতেও মধ্যবিত্তের এতটুকু দ্বিধা হয় না। ধর্মতন্ত্রের ওপর বিশ্বাস বা আস্থা থেকে যে মধ্যবিত্তগোষ্ঠীর শাসকরা এমনটি করে বা করেছে, তা নয়। যে জঙ্গি নায়ক সংবিধানে 'রাষ্ট্রধর্মের' সংযোজক, ধর্মের ওপর তাঁর বিশ্বাস আছে কি নেই, তা আমাদের জানার কথা নয়। তাঁর বা তাঁর মতো অন্যান্য শাসকের জীবনাচরণে ধার্মিকতার প্রকাশ থাকুক বা না থাকুক, তাতেও কিছুই আসে-যায় না। যিশুখ্রিস্টের জন্মের ২০০ বছর আগেই ইতালীয় দার্শনিক সেনেকা বলেছিলেন যে শাসকরা ধর্ম মানুক আর নাই মানুক, শাসনের প্রয়োজনে তথা শাসিতকে বিভ্রান্ত করার কাজে ধর্মকে তারা সুনিপুণভাবে ব্যবহার করে। বাংলাদেশের মধ্যবিত্ত শাসকরাও যে এমনটিই করবে, তাতে বিস্ময়ের কী আছে?
আর সংস্কৃতি ও সাংস্কৃতিক আন্দোলন? পুনরাবৃত্তির অভিযোগ মাথায় নিয়েই বলি, নাগরিক মধ্যবিত্ত নয়, এখন নজর দিতে হবে গ্রামবাসী-শহরবাসী নির্বিশেষে সব প্রাকৃতজনের ওর। সেই প্রাকৃতজন অবশ্যই ধর্মবিশ্বাসী। তবে সেনেকার ইতালিরই বিশ শতকের এক প্রখ্যাত দার্শনিক গ্রামসি দেখিয়েছেন যে নিম্নবর্গের প্রাকৃতজনের ধর্মবিশ্বাস ও ধর্মাচরণের প্রকৃতি উচ্চবর্গের মানুষদের থেকে প্রায় সর্বাংশেই পৃথক। বাংলার প্রাকৃতজনের ক্ষেত্রে গ্রামসির এই বক্তব্য যে আরো বিশেষভাবে সত্য, আবহমান বাংলার ইতিহাসেই তার প্রমাণ বিদ্যমান।
হিন্দু, বৌদ্ধ, ইসলাম, খ্রিস্ট- এ রকম সব ধ্রুপদী ধর্মই বাংলায় এসেছে, বাঙালি সেসব ধর্ম গ্রহণও করেছে। কিন্তু সব ধ্রুপদী ধর্মই এ দেশের মানুষের হাতে লৌকিক রূপ ধারণ করেছে, প্রাকৃতজন তথা লোক সাধারণের ধর্ম হয়ে গেছে লোকায়ত ধর্ম। লোকায়ত মানে যা লোকের মধ্যে বিস্তৃত ও প্রবাহিত। আর 'লোক' বলতে বোঝায় 'ইহলোক' ও 'লোকসাধারণ'- এই দুটোকেই। প্রাকৃতজনের সব চিন্তা-চেতনাই ইহলোককেন্দ্রিক, লোকসাধারণের ইহলৌকিক কল্যাণ সাধনই তার মূল লক্ষ্য। বাংলার প্রাকৃতজনের ধর্মও 'বর্তমান'-এ বিশ্বাসী, 'অনুমান'-এ এর আস্থা নেই।
এ কারণেই তাদের ধর্ম পুরোপুরিই 'সেক্যুলার'। এই সেক্যুলারের প্রতিশব্দরূপে 'ধর্মনিরপেক্ষ' কথাটি ব্যবহার করে আমরা অনেক বিভ্রান্তির সৃষ্টি করেছি। এ বিভ্রান্তিরই সুযোগ গ্রহণ করেছে মতলববাজ ধর্মধ্বজি ও প্রতিক্রিয়াশীলরা। তবু শব্দটি চালু হয়ে গেছে, এর ব্যবহার আমরা বন্ধ করে দিতে পারি না। তবে এর প্রকৃত ও উদ্দিষ্ট অর্থটি উদ্ঘাটন করে বিভ্রান্তির প্রতিরোধে আমাদের মনোযোগী হতেই হবে।
প্রাকৃতজন ধর্ম নিয়ে ভণ্ডামি করে না। ধর্ম তাদের অন্তরের মানিক, সে মানিককে তারা বিপণনের পণ্য বানায় না। 'হৃদয়ের অন্তস্থলে, যে মানিক গোপনে জ্বলে/সে মানিক কভু কি কেউ বাজারে বিকায়?' বাংলার প্রাকৃতজনের এক গোষ্ঠী আরেক গোষ্ঠীর ধর্মাচরণের প্রতি অকুণ্ঠ শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করে। তারা শুধু শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানই করে না, এক গোষ্ঠী আরেক গোষ্ঠীর বিশ্বাস ও আচরণের সঙ্গে সম্মিলনও ঘটিয়ে ফেলে কোনো কোনো ক্ষেত্রে। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথের ভাষায় 'এখানে কোরানে-পুরাণে ঝগড়া বাঁধে না।' এখানে-
হিন্দুর দেবতা হয় মুসলমানের পীর।
দুই কুলে পূজা পায় হইয়া জাহির।
হিন্দু আর মুসলমান একই পিণ্ডের দড়ি।
কেহ বলে আল্লা আর কেহ বলে হরি।
বিছমিল্লা আর ছিরিবিষ্টু একই গেয়ান।
দো ফাঁক করি দিয়ে পরভু রাম রহিমান।
এ রকম আরো অনেক অনেক দৃষ্টান্ত আহরণ করে দেখানো যায় যে বাংলাদেশের ৯০ শতাংশ মানুষই ধর্মপ্রাণ অথচ অসাম্প্রদায়িক; কোনো বিশেষ ধর্মকেই তারা ছোট বা বড় মনে করে না; কোনো ধর্মকেই তারা বিশেষ মর্যাদা দিয়ে আলাদা করে তুলে ধরে না। সেক্যুলার কথাটির মূল মর্মকে ধারণ করেই তারা ধর্মনিরপেক্ষ। বিশেষ কোনো ধর্মকে 'রাষ্ট্রধর্ম' বলে গ্রহণ করলে দেশের সব মানুষ বিগড়ে যাবে- এমন যাঁরা মনে করেন, তাঁরা সম্পূর্ণ ভ্রান্ত। তাঁরা বাংলার গরিষ্ঠসংখ্যক মানুষের চিন্তা-ভাবনা তথা সংস্কৃতির মূলধারা থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন নাগরিক মধ্যবিত্তের কিছু বিভ্রান্ত মানুষ। দেশের প্রাকৃতজন যে ধর্মীয় সাম্প্রদায়িকতার অনেক ঊর্ধ্বে অবস্থান করে- বিভ্রান্ত মধ্যবিত্তগোষ্ঠীর মানুষগুলো এমনটি ভাবতেই পারে না। এই গোষ্ঠীটির উদ্ভব সম্পর্কে প্রয়াত মনীষী আহমদ শরীফ লিখেছিলেন- 'আমাদের দুর্ভাগ্য ও লজ্জার কথা এই যে ইংরেজ আমলে ইংরেজি শিক্ষিত অধিকাংশ বাঙালি লেখাপড়া করে কেবল হিন্দু হয়েছে কিংবা মুসলমান হয়েছে, বাঙালি হতে চায়নি। হিন্দুরা ছিল আর্যগৌরব ও রাজপুত-মারাঠা বীর্যের মহিমায় মুগ্ধ ও তৃপ্ত এবং মুসলমান ছিল দূর অতীতের আরব-ইরানের কৃতিত্ব-স্বপ্নে বিভোর। এরা স্বাদেশিক স্বাজাত্য ভুলেছিল, বিদেশীর জ্ঞাতিত্ব-গৌরবে ছিল তৃপ্তমন্য। এদের কেউ স্বস্থ ও সুস্থ ছিল না।'
আজও আমাদের দুঃখ, সংখ্যায় লঘু হয়েও অসুস্থ ও অস্বস্থ এই মধ্যবিত্তরাই সংখ্যাগুরু লোকসাধারণের ঘাড়ের ওপর চেপে বসে থেকে সবার মাথায় কাঁঠাল ভেঙে খাচ্ছে। তাদের দৌরাত্ম্যের সব ন্যায়নীতি আজ বিধ্বস্ত, দেশের রাজনীতি-অর্থনীতিসহ সব কিছু নীতিহীনদের নিয়ন্ত্রণে।
তাদের হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার ও সুস্থ রাজনীতির উদ্ভব ঘটানোর জন্য যে মধ্যবিত্তের বৃত্ত-বহির্ভূত প্রাকৃতজনের সাংস্কৃতিক আন্দোলনের কোনো বিকল্প নেই- এ কথাই তো এতক্ষণ ধরে বলছি। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, ঘণ্টা বাঁধবে কে? কার নেতৃত্বে গড়ে উঠবে কাঙ্ক্ষিত সেই সাংস্কৃতিক আন্দোলন?
একান্ত স্ববিরোধী মনে হলেও সুস্থির প্রত্যয় নিয়েই বলছি, এই আন্দোলনের সূচনা ঘটানোর জন্য মধ্যবিত্তেরই কোনো একটি অংশকে নেতৃত্বের ভূমিকায়- অন্তত অনুঘটকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে হবে। এ রকম ভূমিকা গ্রহণের উপযোগী মানুষ মধ্যবিত্ত সমাজে আগেও ছিল, এখনো আছে। তাদের অনেকেই নিজের শ্রেণী বা গোষ্ঠীর বাইরেকার সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের সংস্কৃতির স্বরূপ সম্পর্কে অবহিত এবং সেই সংস্কৃতিকেই প্রকৃত সংস্কৃতি বলে মান্য করে। তাই সচেতনভাবেই তারা হয় শ্রেণীচ্যুত। এই শ্রেণীচ্যুতদের সংঘবদ্ধ হয়ে প্রাকৃতজন তথা নিম্নবর্গের সঙ্গে মিলিত হয়ে নতুন সাংস্কৃতিক আন্দোলনের সূচনা ঘটাতে হবে। তাদের সূচিত আন্দোলনই প্রাকৃতজনের সাংস্কৃতিক আন্দোলনে পরিণত হবে, সে আন্দোলনের পরিপুষ্টি ঘটার পরই স্বাধীন দেশের উপযোগী সুস্থ ও স্বস্থ রাজনীতির উদ্ভব ঘটবে এবং সে রাজনীতিই মতলববাজ মধ্যবিত্তের লুটপাটতন্ত্রী অপরাজনীতির উচ্ছেদ ঘটিয়ে ৯০ শতাংশ গণমানুষের রাজনীতির পত্তন ঘটাবে। এতে নেতৃত্বসহ রাজনীতির গতি-প্রকৃতি আমূল পাল্টে যাবে। সেই রাজনীতিই সংবিধানে একই সঙ্গে ধর্মনিরপেক্ষতা ও রাষ্ট্রধর্মের বিধান সংযোজিত রাখার গোঁজামিলের অবসান ঘটাবে যেমন, তেমনই পুরো সংবিধানকেই গণমানুষের সংবিধানে পরিণত করবে, বাংলাদেশের পাকিস্তানায়নকে প্রতিহত করবে। এমনটি হয়তো এই মুহূর্তেই ঘটবে না, তবে তার জন্য যে খুব বেশি দিন অপেক্ষা করতে হবে- তাও মনে করি না।

লেখক : শিক্ষাবিদ ও প্রাবন্ধিক

No comments

Powered by Blogger.