কৃষি-কম খরচে, কম সময়ে আউশ ধান by ড. এম. জি. নিয়োগী
এক সময় আমাদের দেশে বিশাল এলাকাজুড়ে বৃষ্টিনির্ভর আউশ ধানের চাষ হতো। কিন্তু ক্রমেই সেচের এলাকা বেড়ে যাওয়ায় কৃষক সেচনির্ভর বোরো ধান চাষাবাদের দিকে ঝুঁকে পড়েন এবং বৃষ্টিনির্ভর আউশ চাষাবাদ উঠে যাচ্ছে।
বাংলাদেশে এখন ৪৮ ভাগ আমন, ৪৫ ভাগ বোরো এবং মাত্র ৯ ভাগ জমিতে আউশ ধান আবাদ হয়। এ দেশে ৪০ লাখ হেক্টর জমিতে বোরো ধানের চাষ হয়। সম্পূর্ণ সেচনির্ভর এ ধান চাষ করতে উঁচু এবং মাঝারি উঁচু অঞ্চলে প্রচুর পরিমাণ ভূগর্ভস্থ পানি সেচ কাজে ব্যবহার করা হয়। আর এই ভূগর্ভস্থ পানি তুলতে বৈদেশিক মুদ্রায় কেনা বিদ্যুৎ এবং ডিজেলের প্রয়োজন হচ্ছে। বোরো মৌসুমে এই অতিরিক্ত বিদ্যুৎ চাহিদা জোগান দিতে স্বাভাবিক বিদ্যুৎ ব্যবস্থা বন্ধ রেখে বর্ধিত জনগোষ্ঠীর খাদ্য চাহিদা মেটাতে বোরো ধানের জমিতে বিদ্যুৎ বা ডিজেলচালিত পাম্পের সাহায্যে সেচ দিয়ে দেশের খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে বাংলাদেশ সরকারকে বিশেষ কার্যক্রম হাতে নিতে হচ্ছে। উঁচু এবং মাঝারি উঁচু বোরো ধানের জমিতে ভূগর্ভস্থ পানির মাত্রাতিরিক্ত ব্যবহারের ফলে সেই এলাকার পানির স্তর প্রতি বছর ৪ সেমি হারে নেমে যাচ্ছে। এরই মধ্যে ওইসব উঁচু এলাকার অনেক শ্যালো-টিউবওয়েলে পানি আসছে না। পানির স্তরের নাগাল পেতে তাদের কুয়া কেটে শ্যালো-টিউবওয়েলকে মাটির অনেক গভীরে স্থাপন করতে হচ্ছে। এমনকি বেশ কিছু অঞ্চলে বছরের শুকনো মৌসুমে টিউবওয়েলে এখন আর পর্যাপ্ত পানি পাওয়া যাচ্ছে না। অথচ এই টিউবওয়েলের পানিই গ্রামাঞ্চলে খাওয়ার পানির একমাত্র উৎস।
এই চিত্র সামনে রেখে আমরা একটু অন্য দিকে চিন্তা করি! বাংলাদেশে বোরো ধান এপ্রিল মাসের শেষ থেকে মে মাসের প্রথম দিকে কাটা হয়। কৃষক একই জমিতে জুলাই মাসের শেষে বা আগস্ট মাসের প্রথমে আমন ধানের চারা লাগান। অর্থাৎ এপ্রিল বা মে মাসের প্রথমে বোরো ধান কাটার পর ৭০-৭৫ দিন এই জমিগুলো ফাঁকা পড়ে থাকে। অন্যদিকে বাংলাদেশে বছরে সাধারণত আড়াই হাজার মিলিমিটার বৃষ্টি হয়ে থাকে। সাধারণত মে মাসে গড়ে ৩৫০ মিমি, জুনে ৫৫০ মিমি এবং জুলাইয়ে ৫০০ মিমি বৃষ্টি হয়। অর্থাৎ মোট বৃষ্টিপাতের অর্ধেকেরও বেশি বৃষ্টির পানিকে আমরা কৃষিতে ব্যবহার করছি না, এমনকি কোনো কাজেও লাগাচ্ছি না। কারণ এ সময় বেশিরভাগ জমি এপ্রিল-মে মাসে বোরো ধান কাটার পর থেকে ফাঁকা পড়ে থাকছে। এদেশের কৃষক শত শত কোটি টাকার বিদ্যুৎ এবং জ্বালানি তেল ব্যবহার করে ভূগর্ভস্থ পানি দিয়ে অনেক ব্যয়বহুল ধান চাষ করছেন, যার উৎপাদন খরচ পর্যন্ত কৃষক তুলতে পারছেন না। অথচ বৃষ্টির পানিকে কাজে লাগানো হচ্ছে না।
এপ্রিল-মে মাসের প্রথম দিকে বোরো ধান কাটার সঙ্গে সঙ্গে বৃষ্টির পানি কাজে লাগিয়ে জমি তৈরি করে যদি ১৫-২০ দিনের স্বল্পমেয়াদি ধানের চারা রোপণ করা যায়, তাহলে চারা রোপণের ৭০-৯০ দিনের মধ্যে আউশ ধান ঘরে তোলা সম্ভব। বৃষ্টির পানিকে কাজে লাগানোর ফলে এবং এই ধান স্বল্পমেয়াদি হওয়ার কারণে বোরো ধানের অর্ধেক উৎপাদন খরচে আউশ ধান চাষ করা যায়। শুধু তাই নয়, জুলাই মাসের শেষে বা আগস্টের প্রথমে আউশ ধান কেটে একই জমিতে আমন ধানের চারা রোপণ করে বছরে তিনটি ফসল ঘরে তোলা সম্ভব।
যেহেতু এই পদ্ধতিতে কৃষক বছরে আউশ এবং আমন ধান ঘরে তুলতে পারছেন, সেহেতু উঁচু জমিতে কৃষককে বোরো ধান চাষ না করে অন্যান্য রবি ফসল যেমন_ ভুট্টা, গম, শীতকালীন সবজি, আলু ইত্যাদি চাষ করতে উৎসাহিত করা যাবে। এতে ভূগর্ভস্থ পানি উত্তোলনের ওপর চাপ কমবে। যেখানে কম সেচে বোরো ধান চাষ সম্ভব, শুধু সেখানেই বোরো ধানের চাষ উৎসাহিত করতে হবে। এতে বৈদেশিক মুদ্রায় কেনা বিদ্যুৎ ও জ্বালানি বাঁচবে। সবচেয়ে বড় কথা, আগামী প্রজন্মকে আমরা সুপেয় পানিসহ একটি কাঙ্ক্ষিত পরিবেশের নিশ্চয়তা দিয়ে যেতে পারব। বোরো এবং আমনের মাঝে আউশ মৌসুমে একটি অতিরিক্ত ধান চাষে ৭টি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো :
১. বাংলাদেশে বছরে ১০ থেকে ১৫ লাখ টন চালের ঘাটতি হয়। দক্ষিণাঞ্চলে একই জমিতে বোরো এবং আমন হয়_ এ ধরনের ৫ লাখ হেক্টর জমি আছে, যেখানে এই প্রযুক্তি বাস্তবায়নযোগ্য। এ অঞ্চলে ৫ লাখ হেক্টর জমিতে এই প্রযুক্তি বাস্তবায়ন করলে ১০-১৫ লাখ টন ধান ঘরে আসবে। সারাদেশে ৩০ লাখ হেক্টর জমিতে তিন ফসলের এই প্রযুক্তির বদৌলতে আমরা আমাদের খাদ্য ঘাটতি পূরণ করতে পারব।
২. ধান কাটা এবং মাড়াইয়ের জন্য প্রতি হেক্টরে ৪০ থেকে ৫০ জন কৃষি শ্রমিক প্রয়োজন। এ অঞ্চলে ৫ লাখ হেক্টর জমিতে এই প্রযুক্তি বাস্তবায়ন করেল প্রায় ২ কোটি কর্মদিবসের সৃষ্টি হবে। এতে ২০ লাখ কৃষি শ্রমিক ১৫ থেকে ২০ দিন কাজ পাবে।
৩. বাংলাদেশে মে, জুন ও জুলাই বৃষ্টিপাতের মাস। যেহেতু মে, জুন এবং জুলাই মাসের প্রথমার্ধে জমিতে কোনো ফসল থাকে না, তাই এই বৃষ্টিপাত বর্তমান চাষাবাদে কোনো কাজে আসছে না। তিন ফসলের এই প্রযুক্তি বাস্তবায়ন হলে মে, জুন এবং জুলাই মাসের বৃষ্টিপাতকে কাজে লাগানো যাবে। এতে ভূগর্ভস্থ পানির পরিবর্তে বৃষ্টির পানিকে সর্বোচ্চ কাজে লাগানোর ক্ষেত্রে এই প্রযুক্তি যথার্থ ভূমিকা রাখবে।
৪. সাধারণভাবে ধান চাষে দেখা যাচ্ছে, বোরো ধান চাষে একর প্রতি ৫০ হাজার ও আমন ধানে ৪০ হাজার টাকা খরচ হয়। পক্ষান্তরে আউশ ধান চাষে মাত্র ২৫ থেকে ৩০ হাজার টাকা খরচ হচ্ছে। ধানের মূল্য অন্যান্য নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের তুলনায় কম হওয়ায় কৃষক ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। যেহেতু আউশ ধান চাষ করতে উৎপাদন খরচ বোরো ধানের প্রায় অর্ধেক, সেহেতু এ ধান চাষের প্রযুক্তি সম্প্রসারণ করতে পারলে কৃষকের লাভ হবে এবং কৃষি ও দেশের উন্নতি ঘটবে।
৫. জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণে এখন প্রায় প্রতি বছর বন্যা হচ্ছে। এই ধান যেহেতু জুলাই মাসের শেষে বা আগস্টের প্রথমেই কাটা হচ্ছে, তাই বন্যা থেকে এই ধান রক্ষা পাচ্ছে। অর্থাৎ ঝুঁকিবিহীনভাবে কৃষক এই ধান চাষ করতে পারবেন।
৬. আমাদের দেশ থেকে আউশ ধান হারিয়ে যাচ্ছে, যে ধানের ভাত খেতে অত্যন্ত সুস্বাদু। এসব ধানের বেশ কিছু গুণ বা বিশেষত্ব আছে; যেমন_ কিছু আউশ ধান খুব অল্প সময়ে পাকে। অনেক ধানের জাত খরাসহিষুষ্ণ এবং পোকা-মাকড় প্রতিরোধ করতে পারে। আউশ ধান চাষ প্রযুক্তি আমাদের হারিয়ে যাওয়া মৌসুমকে পুনরুদ্ধার করতে পারে, যা পরিবেশবান্ধব বলে প্রমাণিত।
৭. মে, জুন ও জুলাই মাস বৃষ্টিপাতের সময় বিধায় এ সময় ধান ছাড়া অন্য ফসল হওয়ার সম্ভাবনা কম। তাই আউশ মৌসুমে বৃষ্টির পানিকে কাজে লাগিয়ে কম খরচে আউশ ধান চাষ করতে পারি। আউশ ধান কেটে কৃষক আমন ধান করতে পারবেন। পক্ষান্তরে উঁচু জমিতে যেখানে প্রচুর সেচ দিতে হয়, সেখানে কৃষককে অধিক উৎপাদন খরচে বোরো ধান উৎপাদন না করে অল্প পানি খরচ করে অন্যান্য রবি ফসল যেমন_ ভুট্টা, গম, শীতকালীন সবজি, আলু ইত্যাদি চাষ করতে উৎসাহিত করতে পারি। যেহেতু কৃষক একই বছরে আউশ ও আমন ধান পাচ্ছেন, তাই উঁচু জমিতে বোরো ধান না করে অন্যান্য ফসল চাষ করতে উৎসাহিত হবেন। বোরো ধান শুধু নিচু ও মাঝারি নিচু জমিতে, যেখানে পানি ধারণক্ষমতা বেশি, শুধু সেখানেই কৃষককে করতে উৎসাহিত করতে হবে। এতে আমাদের দেশের ভূগর্ভস্থ পানির ওপর চাপ কমবে। বৈদেশিক মুদ্রায় কেনা বিদ্যুৎ ও ডিজেল সাশ্রয় হবে। সরকার বোরো মৌসুমে বিদ্যুৎ ও ডিজেল সমস্যা থেকে অব্যাহতি পাবে। এতদিন পর্যন্ত স্বল্পমেয়াদি আউশ ধানের ভালো জাত আমাদের দেশে ছিল না। বর্তমানে কয়েকটি স্বল্পমেয়াদি ধানের জাত উদ্ভাবন করা হয়েছে, যার কয়েকটি আউশ মৌসুমে চাষ করলে ৯০-১১৫ দিনের মধ্যে (বীজ থেকে বীজ) ফসল ঘরে তোলা সম্ভব। কৃষকের মাঠে পরীক্ষা করে দেখা গেছে, আরও কয়েকটি স্বল্পমেয়াদি ধানের জাত আউশ মৌসুমে অপেক্ষাকৃত কম সময়ে হেক্টরপ্রতি ৩.৫ টন পর্যন্ত ফলন দিতে সক্ষম।
ইউএসএইডের সহায়তায় ইরির বীজ প্রকল্প দেশের দক্ষিণাঞ্চলে আউশ মৌসুমে কৃষকের মাঠে বেশ কয়েকটি স্বল্পমেয়াদি ধানের জাত পরীক্ষামূলকভাবে চাষ করে। এই জাতগুলো হলো_ ব্রি ধান ৫৬, ব্রি ধান ৫৭, বিনাধান-৮, ব্রি ধান ২৭, বিআর-২৬, ব্রি ধান ৪৮, পারিজা, সিআর ধান-৪০, চেহেরাং-সাব১, আইআর৬৪-সাব১ ইত্যাদি। এর মধ্যে ব্রি ধান ২৭, বিআর-২৬ এবং ব্রি ধান-৪৮ আউশ মৌসুমের জন্য অনুমোদিত। পারিজা জাতের ধানটি একটি স্বল্পমেয়াদি দেশি ধান, যা কৃষকরা আউশ মৌসুমে চাষাবাদ করতেন। গবেষণায় দেখা গেছে, আমন মৌসুমের জন্য অনুমোদিত বেশ কয়েকটি স্বল্পমেয়াদি ধানের জাত আউশ মৌসুমে চাষ করলেও অপেক্ষাকৃত কম সময়ে ৩.৫-৪ টন পর্যন্ত ফলন দিচ্ছে। সংশ্লিষ্ট কৃষকরা এসব জাত থেকে অত্যন্ত আশাব্যঞ্জক ফল পাচ্ছেন। এপ্রিলের মাঝামাঝিতে বীজতলায় বীজ ফেলে মে মাসের প্রথম দিকে বোরো ধান কেটে জমি তৈরি করে ২০-২২ দিনের চারা রোপণ করলে চারা রোপণের ৭৫-১০০ দিনের মধ্যে জুলাই মাসের শেষে বা আগস্টের প্রথমেই এই জাতগুলোর ধান কাটা সম্ভব। তাই কৃষক অনায়াসে আউশ মৌসুমে এই ধান চাষাবাদ করে পুনরায় একই জমিতে সঠিক সময়ে আমন ধানের চারা লাগাতে পারবেন।
বোরো এবং আমন মৌসুমের মাঝে আউশ মৌসুম স্বল্পমেয়াদি ধানের চাষাবাদ প্রযুক্তির এই ফলাফল কৃষি ও কৃষকের উন্নয়নে যথেষ্ট অবদান রাখবে বলে ইরির বীজ প্রকল্প মনে করে। বাংলাদেশ সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ আগামী আউশ মৌসুমে স্বল্পমেয়াদি ধানের এই জাতগুলোর গবেষণা ও সম্প্রসারণ কার্যক্রম হাতে নিলে এ দেশের খাদ্য নিরাপত্তায় তা যথেষ্ট অবদান রাখবে বলে মনে করা হচ্ছে। এক্ষেত্রে ইউএসএইড-ইরির বীজ প্রকল্প স্বল্পমেয়াদি ধানের এ জাতগুলোর আউশ মৌসুমে চাষাবাদ প্রযুক্তি বিস্তারে সমন্বয়কের ভূমিকা পালন করতে পারে। আমরা আশা করি, বৃষ্টির পানিকে কাজে লাগিয়ে কম উৎপাদন খরচে পরিবেশ সহায়ক স্বল্পমেয়াদি আউশ ধানের চাষ প্রযুক্তি এ দেশের খাদ্য নিরাপত্তায় যথেষ্ট অবদান রাখবে।
ড. এম. জি. নিয়োগী : কনসালট্যান্ট আন্তর্জাতিক ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট
এই চিত্র সামনে রেখে আমরা একটু অন্য দিকে চিন্তা করি! বাংলাদেশে বোরো ধান এপ্রিল মাসের শেষ থেকে মে মাসের প্রথম দিকে কাটা হয়। কৃষক একই জমিতে জুলাই মাসের শেষে বা আগস্ট মাসের প্রথমে আমন ধানের চারা লাগান। অর্থাৎ এপ্রিল বা মে মাসের প্রথমে বোরো ধান কাটার পর ৭০-৭৫ দিন এই জমিগুলো ফাঁকা পড়ে থাকে। অন্যদিকে বাংলাদেশে বছরে সাধারণত আড়াই হাজার মিলিমিটার বৃষ্টি হয়ে থাকে। সাধারণত মে মাসে গড়ে ৩৫০ মিমি, জুনে ৫৫০ মিমি এবং জুলাইয়ে ৫০০ মিমি বৃষ্টি হয়। অর্থাৎ মোট বৃষ্টিপাতের অর্ধেকেরও বেশি বৃষ্টির পানিকে আমরা কৃষিতে ব্যবহার করছি না, এমনকি কোনো কাজেও লাগাচ্ছি না। কারণ এ সময় বেশিরভাগ জমি এপ্রিল-মে মাসে বোরো ধান কাটার পর থেকে ফাঁকা পড়ে থাকছে। এদেশের কৃষক শত শত কোটি টাকার বিদ্যুৎ এবং জ্বালানি তেল ব্যবহার করে ভূগর্ভস্থ পানি দিয়ে অনেক ব্যয়বহুল ধান চাষ করছেন, যার উৎপাদন খরচ পর্যন্ত কৃষক তুলতে পারছেন না। অথচ বৃষ্টির পানিকে কাজে লাগানো হচ্ছে না।
এপ্রিল-মে মাসের প্রথম দিকে বোরো ধান কাটার সঙ্গে সঙ্গে বৃষ্টির পানি কাজে লাগিয়ে জমি তৈরি করে যদি ১৫-২০ দিনের স্বল্পমেয়াদি ধানের চারা রোপণ করা যায়, তাহলে চারা রোপণের ৭০-৯০ দিনের মধ্যে আউশ ধান ঘরে তোলা সম্ভব। বৃষ্টির পানিকে কাজে লাগানোর ফলে এবং এই ধান স্বল্পমেয়াদি হওয়ার কারণে বোরো ধানের অর্ধেক উৎপাদন খরচে আউশ ধান চাষ করা যায়। শুধু তাই নয়, জুলাই মাসের শেষে বা আগস্টের প্রথমে আউশ ধান কেটে একই জমিতে আমন ধানের চারা রোপণ করে বছরে তিনটি ফসল ঘরে তোলা সম্ভব।
যেহেতু এই পদ্ধতিতে কৃষক বছরে আউশ এবং আমন ধান ঘরে তুলতে পারছেন, সেহেতু উঁচু জমিতে কৃষককে বোরো ধান চাষ না করে অন্যান্য রবি ফসল যেমন_ ভুট্টা, গম, শীতকালীন সবজি, আলু ইত্যাদি চাষ করতে উৎসাহিত করা যাবে। এতে ভূগর্ভস্থ পানি উত্তোলনের ওপর চাপ কমবে। যেখানে কম সেচে বোরো ধান চাষ সম্ভব, শুধু সেখানেই বোরো ধানের চাষ উৎসাহিত করতে হবে। এতে বৈদেশিক মুদ্রায় কেনা বিদ্যুৎ ও জ্বালানি বাঁচবে। সবচেয়ে বড় কথা, আগামী প্রজন্মকে আমরা সুপেয় পানিসহ একটি কাঙ্ক্ষিত পরিবেশের নিশ্চয়তা দিয়ে যেতে পারব। বোরো এবং আমনের মাঝে আউশ মৌসুমে একটি অতিরিক্ত ধান চাষে ৭টি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো :
১. বাংলাদেশে বছরে ১০ থেকে ১৫ লাখ টন চালের ঘাটতি হয়। দক্ষিণাঞ্চলে একই জমিতে বোরো এবং আমন হয়_ এ ধরনের ৫ লাখ হেক্টর জমি আছে, যেখানে এই প্রযুক্তি বাস্তবায়নযোগ্য। এ অঞ্চলে ৫ লাখ হেক্টর জমিতে এই প্রযুক্তি বাস্তবায়ন করলে ১০-১৫ লাখ টন ধান ঘরে আসবে। সারাদেশে ৩০ লাখ হেক্টর জমিতে তিন ফসলের এই প্রযুক্তির বদৌলতে আমরা আমাদের খাদ্য ঘাটতি পূরণ করতে পারব।
২. ধান কাটা এবং মাড়াইয়ের জন্য প্রতি হেক্টরে ৪০ থেকে ৫০ জন কৃষি শ্রমিক প্রয়োজন। এ অঞ্চলে ৫ লাখ হেক্টর জমিতে এই প্রযুক্তি বাস্তবায়ন করেল প্রায় ২ কোটি কর্মদিবসের সৃষ্টি হবে। এতে ২০ লাখ কৃষি শ্রমিক ১৫ থেকে ২০ দিন কাজ পাবে।
৩. বাংলাদেশে মে, জুন ও জুলাই বৃষ্টিপাতের মাস। যেহেতু মে, জুন এবং জুলাই মাসের প্রথমার্ধে জমিতে কোনো ফসল থাকে না, তাই এই বৃষ্টিপাত বর্তমান চাষাবাদে কোনো কাজে আসছে না। তিন ফসলের এই প্রযুক্তি বাস্তবায়ন হলে মে, জুন এবং জুলাই মাসের বৃষ্টিপাতকে কাজে লাগানো যাবে। এতে ভূগর্ভস্থ পানির পরিবর্তে বৃষ্টির পানিকে সর্বোচ্চ কাজে লাগানোর ক্ষেত্রে এই প্রযুক্তি যথার্থ ভূমিকা রাখবে।
৪. সাধারণভাবে ধান চাষে দেখা যাচ্ছে, বোরো ধান চাষে একর প্রতি ৫০ হাজার ও আমন ধানে ৪০ হাজার টাকা খরচ হয়। পক্ষান্তরে আউশ ধান চাষে মাত্র ২৫ থেকে ৩০ হাজার টাকা খরচ হচ্ছে। ধানের মূল্য অন্যান্য নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের তুলনায় কম হওয়ায় কৃষক ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। যেহেতু আউশ ধান চাষ করতে উৎপাদন খরচ বোরো ধানের প্রায় অর্ধেক, সেহেতু এ ধান চাষের প্রযুক্তি সম্প্রসারণ করতে পারলে কৃষকের লাভ হবে এবং কৃষি ও দেশের উন্নতি ঘটবে।
৫. জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণে এখন প্রায় প্রতি বছর বন্যা হচ্ছে। এই ধান যেহেতু জুলাই মাসের শেষে বা আগস্টের প্রথমেই কাটা হচ্ছে, তাই বন্যা থেকে এই ধান রক্ষা পাচ্ছে। অর্থাৎ ঝুঁকিবিহীনভাবে কৃষক এই ধান চাষ করতে পারবেন।
৬. আমাদের দেশ থেকে আউশ ধান হারিয়ে যাচ্ছে, যে ধানের ভাত খেতে অত্যন্ত সুস্বাদু। এসব ধানের বেশ কিছু গুণ বা বিশেষত্ব আছে; যেমন_ কিছু আউশ ধান খুব অল্প সময়ে পাকে। অনেক ধানের জাত খরাসহিষুষ্ণ এবং পোকা-মাকড় প্রতিরোধ করতে পারে। আউশ ধান চাষ প্রযুক্তি আমাদের হারিয়ে যাওয়া মৌসুমকে পুনরুদ্ধার করতে পারে, যা পরিবেশবান্ধব বলে প্রমাণিত।
৭. মে, জুন ও জুলাই মাস বৃষ্টিপাতের সময় বিধায় এ সময় ধান ছাড়া অন্য ফসল হওয়ার সম্ভাবনা কম। তাই আউশ মৌসুমে বৃষ্টির পানিকে কাজে লাগিয়ে কম খরচে আউশ ধান চাষ করতে পারি। আউশ ধান কেটে কৃষক আমন ধান করতে পারবেন। পক্ষান্তরে উঁচু জমিতে যেখানে প্রচুর সেচ দিতে হয়, সেখানে কৃষককে অধিক উৎপাদন খরচে বোরো ধান উৎপাদন না করে অল্প পানি খরচ করে অন্যান্য রবি ফসল যেমন_ ভুট্টা, গম, শীতকালীন সবজি, আলু ইত্যাদি চাষ করতে উৎসাহিত করতে পারি। যেহেতু কৃষক একই বছরে আউশ ও আমন ধান পাচ্ছেন, তাই উঁচু জমিতে বোরো ধান না করে অন্যান্য ফসল চাষ করতে উৎসাহিত হবেন। বোরো ধান শুধু নিচু ও মাঝারি নিচু জমিতে, যেখানে পানি ধারণক্ষমতা বেশি, শুধু সেখানেই কৃষককে করতে উৎসাহিত করতে হবে। এতে আমাদের দেশের ভূগর্ভস্থ পানির ওপর চাপ কমবে। বৈদেশিক মুদ্রায় কেনা বিদ্যুৎ ও ডিজেল সাশ্রয় হবে। সরকার বোরো মৌসুমে বিদ্যুৎ ও ডিজেল সমস্যা থেকে অব্যাহতি পাবে। এতদিন পর্যন্ত স্বল্পমেয়াদি আউশ ধানের ভালো জাত আমাদের দেশে ছিল না। বর্তমানে কয়েকটি স্বল্পমেয়াদি ধানের জাত উদ্ভাবন করা হয়েছে, যার কয়েকটি আউশ মৌসুমে চাষ করলে ৯০-১১৫ দিনের মধ্যে (বীজ থেকে বীজ) ফসল ঘরে তোলা সম্ভব। কৃষকের মাঠে পরীক্ষা করে দেখা গেছে, আরও কয়েকটি স্বল্পমেয়াদি ধানের জাত আউশ মৌসুমে অপেক্ষাকৃত কম সময়ে হেক্টরপ্রতি ৩.৫ টন পর্যন্ত ফলন দিতে সক্ষম।
ইউএসএইডের সহায়তায় ইরির বীজ প্রকল্প দেশের দক্ষিণাঞ্চলে আউশ মৌসুমে কৃষকের মাঠে বেশ কয়েকটি স্বল্পমেয়াদি ধানের জাত পরীক্ষামূলকভাবে চাষ করে। এই জাতগুলো হলো_ ব্রি ধান ৫৬, ব্রি ধান ৫৭, বিনাধান-৮, ব্রি ধান ২৭, বিআর-২৬, ব্রি ধান ৪৮, পারিজা, সিআর ধান-৪০, চেহেরাং-সাব১, আইআর৬৪-সাব১ ইত্যাদি। এর মধ্যে ব্রি ধান ২৭, বিআর-২৬ এবং ব্রি ধান-৪৮ আউশ মৌসুমের জন্য অনুমোদিত। পারিজা জাতের ধানটি একটি স্বল্পমেয়াদি দেশি ধান, যা কৃষকরা আউশ মৌসুমে চাষাবাদ করতেন। গবেষণায় দেখা গেছে, আমন মৌসুমের জন্য অনুমোদিত বেশ কয়েকটি স্বল্পমেয়াদি ধানের জাত আউশ মৌসুমে চাষ করলেও অপেক্ষাকৃত কম সময়ে ৩.৫-৪ টন পর্যন্ত ফলন দিচ্ছে। সংশ্লিষ্ট কৃষকরা এসব জাত থেকে অত্যন্ত আশাব্যঞ্জক ফল পাচ্ছেন। এপ্রিলের মাঝামাঝিতে বীজতলায় বীজ ফেলে মে মাসের প্রথম দিকে বোরো ধান কেটে জমি তৈরি করে ২০-২২ দিনের চারা রোপণ করলে চারা রোপণের ৭৫-১০০ দিনের মধ্যে জুলাই মাসের শেষে বা আগস্টের প্রথমেই এই জাতগুলোর ধান কাটা সম্ভব। তাই কৃষক অনায়াসে আউশ মৌসুমে এই ধান চাষাবাদ করে পুনরায় একই জমিতে সঠিক সময়ে আমন ধানের চারা লাগাতে পারবেন।
বোরো এবং আমন মৌসুমের মাঝে আউশ মৌসুম স্বল্পমেয়াদি ধানের চাষাবাদ প্রযুক্তির এই ফলাফল কৃষি ও কৃষকের উন্নয়নে যথেষ্ট অবদান রাখবে বলে ইরির বীজ প্রকল্প মনে করে। বাংলাদেশ সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ আগামী আউশ মৌসুমে স্বল্পমেয়াদি ধানের এই জাতগুলোর গবেষণা ও সম্প্রসারণ কার্যক্রম হাতে নিলে এ দেশের খাদ্য নিরাপত্তায় তা যথেষ্ট অবদান রাখবে বলে মনে করা হচ্ছে। এক্ষেত্রে ইউএসএইড-ইরির বীজ প্রকল্প স্বল্পমেয়াদি ধানের এ জাতগুলোর আউশ মৌসুমে চাষাবাদ প্রযুক্তি বিস্তারে সমন্বয়কের ভূমিকা পালন করতে পারে। আমরা আশা করি, বৃষ্টির পানিকে কাজে লাগিয়ে কম উৎপাদন খরচে পরিবেশ সহায়ক স্বল্পমেয়াদি আউশ ধানের চাষ প্রযুক্তি এ দেশের খাদ্য নিরাপত্তায় যথেষ্ট অবদান রাখবে।
ড. এম. জি. নিয়োগী : কনসালট্যান্ট আন্তর্জাতিক ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট
No comments