নৈতিকতার প্রভাব ও মূল্যবোধ সৃষ্টি by মুফতি এনায়েতুল্লাহ
চাঁদপুরের সত্তরোর্ধ্ব এক বৃদ্ধ শিক্ষককে ছেলের ঋণের দায়ে রশি দিয়ে বেঁধে গ্রামে ঘোরানোসহ শারীরিকভাবে নির্যাতন করা হয়েছে। অমানবিকতার কাছে হেরে যাওয়া শিক্ষক মহোদয় লাজ-লজ্জায় এখন নিরুদ্দেশ। এ ঘটনা এলাকায় ব্যাপক চাঞ্চল্য সৃষ্টি করেছে।
এই নিষ্ঠুরতা আমাদের সমাজের খুব পরিচিত ছবি না হলেও এটা যে সামাজিক অবক্ষয়ের একটি দলিল, তা বলা যায় নিঃসন্দেহে। এমনি ঠুনকো অজুহাতে সামাজিক নির্যাতনের যাঁতাকলে পিষ্ট হচ্ছে দেড় বছরের শিশু থেকে শিক্ষক, সাংবাদিক, ছাত্রসহ বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার মানুষ।
ইসলামসহ কোনো ধর্মই এভাবে কাউকে অসম্মান ও কষ্ট দেওয়াকে সমর্থন করে না। ইসলাম মানবীয় মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠার পাশাপাশি ছোটদের প্রতি স্নেহ, বড়দের প্রতি শ্রদ্ধা ও সম্মান প্রদর্শন এবং পরোপকারকে প্রাধান্য দেয়। হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.) ভদ্রতা ও শিষ্টাচারের বাণী প্রদান করে এবং তা কাজেকর্মে পরিণত করে ইসলামী মূল্যবোধসম্পন্ন সমাজ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। এ প্রসঙ্গে হাদিসে ইরশাদ হচ্ছে, 'হজরত ইবনে আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিত_ হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, 'যে আমাদের ছোটদের স্নেহ করে না এবং বড়দের সম্মান করে না, সে আমার দলভুক্ত নয়।'-তিরমিজি
আরেক হাদিসে এসেছে, 'হজরত আবদুল্লাহ ইবনে আমর (রা.) থেকে বর্ণিত_ হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, দয়াবানদের প্রতি রহমানুর রহিম আল্লাহ দয়া করেন। অতএব, তোমরা পৃথিবীবাসীর প্রতি দয়া কর, তাহলে আসমানে যিনি আছেন তিনি তোমাদের প্রতি দয়া করবেন।'-তিরমিজি
এটা সত্য যে, সমাজের মানুষ দিন দিন অসহিষ্ণু হয়ে উঠছে। একে অন্যের প্রতি নিষ্ঠুরতম আচরণ করছে। ভালো-মন্দ বিচার-বিশ্লেষণ করার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলছে। কাজেই সামগ্রিক অবস্থা বিবেচনায় আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থায় মূল্যবোধের আলোকে নৈতিকতা অর্জনের বিষয়টি নিয়ে গভীরভাবে ভাবতে হবে। নৈতিকতাকে মূল্যবোধের ওপরে স্থান দিতে হবে। রাষ্ট্র যেখানে জাতিকে সভ্যতার আলোয় আলোকিত করার মানসে মানুষের দ্বারে দ্বারে শিক্ষার আলো পেঁৗছাতে ও দারিদ্র্য দূর করতে সচেষ্ট; সেখানে সমাজের এমন করুণ দৃশ্য অস্বস্তিকরই বটে। শান্তিময় সমাজ গঠনে পরস্পরকে ধৈর্যশীলতার পরিচয় দিতে হবে। প্রত্যেক নাগরিককেই নৈতিকতাসম্পন্ন হতে হবে।
আপাতদৃষ্টিতে মূল্যবোধ ও নৈতিকতার মধ্যে কোনো পার্থক্য পরিলক্ষিত হয় না। আসলে বিষয়টি তা নয়। মূল্যবোধ ও নৈতিকতার মাঝে স্পষ্ট পার্থক্য বিদ্যমান। মূল্যবোধ শুধু সুনির্দিষ্ট সমাজের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। স্থান-কাল-পাত্রভেদে এর পরিবর্তন, পরিবর্ধন, বিয়োজন ও পার্থক্য বিদ্যমান। এর প্রভাব ক্ষুদ্র বলয়ে সীমাবদ্ধ। কিন্তু নৈতিকতা অন্য বিষয়। এর প্রভাব সর্বজনীন। পৃথিবীর সর্বক্ষেত্রে, সর্বস্থানে এর প্রায়োগিক বিষয়ে কোনো পার্থক্য করা যায় না। এতে বিয়োজন, পরিবর্তন, পরিবর্ধন গ্রহণযোগ্য নয়; সম্ভবও নয়। তাই সমাজের সর্বস্তরে এবং আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থায় নৈতিকতার ওপর আরও বেশি তাগিদ দিতে হবে।
মূল্যবোধ বলতে সাধারণ ভাষায় সুনির্দিষ্ট কোনো সমাজে প্রচলিত জীবন ব্যবস্থাকে বোঝায়। এর প্রভাব শুধু নির্দিষ্ট সমাজ ও নির্দিষ্ট বলয়ে বিদ্যমান। মূল্যবোধ সময়ের বিবর্তনে পরিবর্তিত হতে পারে। সমাজের সব ব্যক্তির মূল্যবোধ এক নয়। মূল্যবোধ মূলত ব্যক্তির সামাজিক অবস্থান ও পারিপাশর্ি্বকতার ওপর নির্ভর করে এবং প্রেক্ষাপট বিবেচনায় এর পরিবর্তন হয়। ষাট বছরের বৃদ্ধ আর একজন যুবকের আচরণ এক হবে_ এমনটা আশা করা কোনো অবস্থাতেই যৌক্তিক নয়। বাবা ও ছেলের আচরণ কখনোই এক হবে না। শিক্ষক ও ছাত্রের কাছ থেকে একই মূল্যবোধ আশা করা নিতান্তই বোকামি। এটাই বাস্তবতা ও চলমান সমাজের চিত্র।
অপরদিকে সদা সত্য কথা বলা, অন্যের ক্ষতি না করা, সম্ভব হলে উপকার করা, বাবা-মায়ের সেবা করা, বয়স্কদের সম্মান করা, দেশকে ভালোবাসা ও দেশের আইনের প্রতি অনুগত থাকা_ সর্বোপরি দেশের জন্য সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকারে প্রস্তুত থাকা নৈতিকতার অন্তর্ভুক্ত। এই নৈতিকতা সবার ওপর সমানভাবে প্রযোজ্য। এখানে নারী-পুরুষ, শ্রেণী-পেশা, ধর্ম ও জাতপাতের প্রশ্ন অবান্তর। এসবের আবেদন সর্বজনীন। আমরা জানি, উন্নত দেশগুলোর শিক্ষা ব্যবস্থায় এবং রাষ্ট্রে মূল্যবোধের চেয়ে নৈতিকতার ওপর জোর দেওয়া হয় বেশি। মূল্যবোধের বিষয়টি ব্যক্তির নিজস্ব ইচ্ছা-অনিচ্ছার ওপর ছেড়ে দেওয়া হয়। অপরদিকে নৈতিকতাকে সামগ্রিকভাবে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য সর্বোচ্চ পদক্ষেপ ও কর্মপদ্ধতি গ্রহণ করা হয়। কিন্তু আমাদের দেশ এদিক থেকে ব্যতিক্রম। আমরা মূল্যবোধের আদলে নৈতিকতা অর্জন করতে চাই। কিন্তু দুটো ভিন্ন বিষয় একত্রে কীভাবে অর্জিত হবে, তা নিয়ে ভাবি না। অথচ সময়ের প্রেক্ষাপটে এই ভাবনাটাই অতীব জরুরি।
তারপরও আশার কথা হলো, আমাদের মূল্যবোধ ও নিজস্ব সংস্কৃতি এখনও সম্পূর্ণরূপে বিলীন হয়ে যায়নি। আমাদের নীতিনির্ধারকরা এসব বিষয়ের গুরুত্ব অনুধাবন করে রাষ্ট্রে নৈতিকতা প্রতিষ্ঠিত করতে ধর্মীয় মূল্যবোধ ও শিক্ষাকে বেছে নিয়েছেন। শিক্ষা ব্যবস্থায়ও নৈতিকতা অর্জনের জন্য ধর্মীয় মাধ্যমকে বেছে নেওয়া হয়েছে। পাঠ্যপুস্তকের নৈতিক শিক্ষাগুলো এখনও ধর্মভিত্তিক। এটা শুধু ধর্মীয় শিক্ষার জন্য প্রতিষ্ঠিত মাদ্রাসাগুলোর জন্য নয়; সাধারণ শিক্ষার ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। এটা আশার কথা। এই পরিকল্পনা বাস্তবায়িত হলে এভাবে আর কাউকে রশিতে বেঁধে অপমান করার মতো অবস্থা সৃষ্টি হবে না। এমনটি আমরা কামনাও করি না। এখন শুধু অপেক্ষা_ এসবের প্রতিফলন দেখার।
muftianaet@gmail.com
ইসলামসহ কোনো ধর্মই এভাবে কাউকে অসম্মান ও কষ্ট দেওয়াকে সমর্থন করে না। ইসলাম মানবীয় মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠার পাশাপাশি ছোটদের প্রতি স্নেহ, বড়দের প্রতি শ্রদ্ধা ও সম্মান প্রদর্শন এবং পরোপকারকে প্রাধান্য দেয়। হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.) ভদ্রতা ও শিষ্টাচারের বাণী প্রদান করে এবং তা কাজেকর্মে পরিণত করে ইসলামী মূল্যবোধসম্পন্ন সমাজ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। এ প্রসঙ্গে হাদিসে ইরশাদ হচ্ছে, 'হজরত ইবনে আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিত_ হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, 'যে আমাদের ছোটদের স্নেহ করে না এবং বড়দের সম্মান করে না, সে আমার দলভুক্ত নয়।'-তিরমিজি
আরেক হাদিসে এসেছে, 'হজরত আবদুল্লাহ ইবনে আমর (রা.) থেকে বর্ণিত_ হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, দয়াবানদের প্রতি রহমানুর রহিম আল্লাহ দয়া করেন। অতএব, তোমরা পৃথিবীবাসীর প্রতি দয়া কর, তাহলে আসমানে যিনি আছেন তিনি তোমাদের প্রতি দয়া করবেন।'-তিরমিজি
এটা সত্য যে, সমাজের মানুষ দিন দিন অসহিষ্ণু হয়ে উঠছে। একে অন্যের প্রতি নিষ্ঠুরতম আচরণ করছে। ভালো-মন্দ বিচার-বিশ্লেষণ করার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলছে। কাজেই সামগ্রিক অবস্থা বিবেচনায় আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থায় মূল্যবোধের আলোকে নৈতিকতা অর্জনের বিষয়টি নিয়ে গভীরভাবে ভাবতে হবে। নৈতিকতাকে মূল্যবোধের ওপরে স্থান দিতে হবে। রাষ্ট্র যেখানে জাতিকে সভ্যতার আলোয় আলোকিত করার মানসে মানুষের দ্বারে দ্বারে শিক্ষার আলো পেঁৗছাতে ও দারিদ্র্য দূর করতে সচেষ্ট; সেখানে সমাজের এমন করুণ দৃশ্য অস্বস্তিকরই বটে। শান্তিময় সমাজ গঠনে পরস্পরকে ধৈর্যশীলতার পরিচয় দিতে হবে। প্রত্যেক নাগরিককেই নৈতিকতাসম্পন্ন হতে হবে।
আপাতদৃষ্টিতে মূল্যবোধ ও নৈতিকতার মধ্যে কোনো পার্থক্য পরিলক্ষিত হয় না। আসলে বিষয়টি তা নয়। মূল্যবোধ ও নৈতিকতার মাঝে স্পষ্ট পার্থক্য বিদ্যমান। মূল্যবোধ শুধু সুনির্দিষ্ট সমাজের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। স্থান-কাল-পাত্রভেদে এর পরিবর্তন, পরিবর্ধন, বিয়োজন ও পার্থক্য বিদ্যমান। এর প্রভাব ক্ষুদ্র বলয়ে সীমাবদ্ধ। কিন্তু নৈতিকতা অন্য বিষয়। এর প্রভাব সর্বজনীন। পৃথিবীর সর্বক্ষেত্রে, সর্বস্থানে এর প্রায়োগিক বিষয়ে কোনো পার্থক্য করা যায় না। এতে বিয়োজন, পরিবর্তন, পরিবর্ধন গ্রহণযোগ্য নয়; সম্ভবও নয়। তাই সমাজের সর্বস্তরে এবং আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থায় নৈতিকতার ওপর আরও বেশি তাগিদ দিতে হবে।
মূল্যবোধ বলতে সাধারণ ভাষায় সুনির্দিষ্ট কোনো সমাজে প্রচলিত জীবন ব্যবস্থাকে বোঝায়। এর প্রভাব শুধু নির্দিষ্ট সমাজ ও নির্দিষ্ট বলয়ে বিদ্যমান। মূল্যবোধ সময়ের বিবর্তনে পরিবর্তিত হতে পারে। সমাজের সব ব্যক্তির মূল্যবোধ এক নয়। মূল্যবোধ মূলত ব্যক্তির সামাজিক অবস্থান ও পারিপাশর্ি্বকতার ওপর নির্ভর করে এবং প্রেক্ষাপট বিবেচনায় এর পরিবর্তন হয়। ষাট বছরের বৃদ্ধ আর একজন যুবকের আচরণ এক হবে_ এমনটা আশা করা কোনো অবস্থাতেই যৌক্তিক নয়। বাবা ও ছেলের আচরণ কখনোই এক হবে না। শিক্ষক ও ছাত্রের কাছ থেকে একই মূল্যবোধ আশা করা নিতান্তই বোকামি। এটাই বাস্তবতা ও চলমান সমাজের চিত্র।
অপরদিকে সদা সত্য কথা বলা, অন্যের ক্ষতি না করা, সম্ভব হলে উপকার করা, বাবা-মায়ের সেবা করা, বয়স্কদের সম্মান করা, দেশকে ভালোবাসা ও দেশের আইনের প্রতি অনুগত থাকা_ সর্বোপরি দেশের জন্য সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকারে প্রস্তুত থাকা নৈতিকতার অন্তর্ভুক্ত। এই নৈতিকতা সবার ওপর সমানভাবে প্রযোজ্য। এখানে নারী-পুরুষ, শ্রেণী-পেশা, ধর্ম ও জাতপাতের প্রশ্ন অবান্তর। এসবের আবেদন সর্বজনীন। আমরা জানি, উন্নত দেশগুলোর শিক্ষা ব্যবস্থায় এবং রাষ্ট্রে মূল্যবোধের চেয়ে নৈতিকতার ওপর জোর দেওয়া হয় বেশি। মূল্যবোধের বিষয়টি ব্যক্তির নিজস্ব ইচ্ছা-অনিচ্ছার ওপর ছেড়ে দেওয়া হয়। অপরদিকে নৈতিকতাকে সামগ্রিকভাবে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য সর্বোচ্চ পদক্ষেপ ও কর্মপদ্ধতি গ্রহণ করা হয়। কিন্তু আমাদের দেশ এদিক থেকে ব্যতিক্রম। আমরা মূল্যবোধের আদলে নৈতিকতা অর্জন করতে চাই। কিন্তু দুটো ভিন্ন বিষয় একত্রে কীভাবে অর্জিত হবে, তা নিয়ে ভাবি না। অথচ সময়ের প্রেক্ষাপটে এই ভাবনাটাই অতীব জরুরি।
তারপরও আশার কথা হলো, আমাদের মূল্যবোধ ও নিজস্ব সংস্কৃতি এখনও সম্পূর্ণরূপে বিলীন হয়ে যায়নি। আমাদের নীতিনির্ধারকরা এসব বিষয়ের গুরুত্ব অনুধাবন করে রাষ্ট্রে নৈতিকতা প্রতিষ্ঠিত করতে ধর্মীয় মূল্যবোধ ও শিক্ষাকে বেছে নিয়েছেন। শিক্ষা ব্যবস্থায়ও নৈতিকতা অর্জনের জন্য ধর্মীয় মাধ্যমকে বেছে নেওয়া হয়েছে। পাঠ্যপুস্তকের নৈতিক শিক্ষাগুলো এখনও ধর্মভিত্তিক। এটা শুধু ধর্মীয় শিক্ষার জন্য প্রতিষ্ঠিত মাদ্রাসাগুলোর জন্য নয়; সাধারণ শিক্ষার ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। এটা আশার কথা। এই পরিকল্পনা বাস্তবায়িত হলে এভাবে আর কাউকে রশিতে বেঁধে অপমান করার মতো অবস্থা সৃষ্টি হবে না। এমনটি আমরা কামনাও করি না। এখন শুধু অপেক্ষা_ এসবের প্রতিফলন দেখার।
muftianaet@gmail.com
No comments