বিপদ নদীর নয়, বিপদ মানুষের by ডক্টর তুহিন মালিক

একসময় নদীমাতৃকার প্রাণবন্ত ছোঁয়া ছিল এই রাজধানী ঢাকায়। বুড়িগঙ্গা, তুরাগ, বালু নদীর সঙ্গে সংযোগকারী প্রায় অর্ধশত খাল প্রবাহিত ছিল রাজধানী ঢাকার অভ্যন্তরে। এগুলোর একটির সঙ্গে আরেকটির ছিল চমৎকার সংযোগ।


ঢাকার নৌপথ হিসেবে ব্যবহৃত এ খালগুলো এখন কেবলই ইতিহাস। দখলের কবলে গত ৫০ বছরে হারিয়ে গেছে ১৭টি খাল। আর বাকি ২৬টির অস্তিত্বও প্রায় হারিয়ে যাওয়ার পথে। স্বাধীনতার পর থেকেই বিভিন্ন সময় এসব খাল উদ্ধারের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। কিন্তু তা সফল হয়নি। নদ-নদী, জলাভূমি ও এর পার্শ্ববর্তী এলাকার অবৈধ দখলদারদের উচ্ছেদে সরকারের ঘোষণা, দফায় দফায় উচ্ছেদ অভিযান এবং হাইকোর্টের নির্দেশনা- কোনো কিছুই আমলে নিচ্ছেন না অবৈধ দখলদাররা। উচ্ছেদের নামে চলেছে বাণিজ্য। কাজের কাজ কিছু না হলেও খাল দখল, ভরাট, ভরাটকৃত খালে বাড়িঘর বানানোর অপতৎপরতাটি যথারীতিই চলেছে।
খাল দখলের পাশাপাশি ঢাকা শহররক্ষা বাঁধের দুই-তৃতীয়াংশই চলে গেছে অবৈধ দখলে। ২৯ কিলোমিটার দীর্ঘ এই শহররক্ষা বাঁধের ১৯ কিলোমিটার অবৈধ দখলে। কোথাও কোথাও বাঁধ কেটে হাটবাজার বসিয়েছে প্রভাবশালীরা। সদরঘাট থেকে আশুলিয়া পর্যন্ত নির্মিত হয়েছে ১২ ধরনের স্থাপনা। অবৈধ দখলদাররা এসব স্থাপনা থেকে হাতিয়ে নিচ্ছে কোটি কোটি টাকা। এ অপকর্মে জড়িত রয়েছে আওয়ামী লীগ, বিএনপি ও জাতীয় পার্টি নামধারী নেতারা। নানা ধরনের সামাজিক ও রাজনৈতিক সংগঠনের নামেও চলছে দখলদারি। দখলদাররা বহু স্থানে সিমেন্টের তৈরি নিরাপত্তামূলক ব্লক তুলে ফেলেছে। খোদ বিআইডাবি্লউটিএ বুড়িগঙ্গা দখল করে অবৈধ স্থাপনা নির্মাণ করেছে বলে পত্রিকায় ছবি ছাপা হয়েছে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় নিজেই বুড়িগঙ্গা দখল করে থানা আর র‌্যাবের অফিস নির্মাণ করছে।
বুড়িগঙ্গার অস্তিত্ব বিলীন হতে চলেছে জবরদখল ও দূষণের নির্যাতনে। শিল্পবর্জ্যসহ নানা ধরনের কেমিক্যাল মিশ্রিত পানি, হাসপাতালের বর্জ্য, নদীতে চলাচলকারী নৌযান থেকে প্রতিদিন হাজার হাজার লিটার তেল ও পোড়া মবিল ফেলে বুড়িগঙ্গার পানিকে আরো বেশি দূষিত করা হচ্ছে। ২০১১ সালের ১ জুন হাইকোর্টের এক রায়ে বলা হয়েছিল, বুড়িগঙ্গা নদীর পানিদূষণ এমন একপর্যায়ে পৌঁছেছে যে এ পানিকে আর পানি বলা যায় না। আদালত মনে করেন, এতে সারা দেশের মানুষের স্বাস্থ্যের ক্ষতি হচ্ছে। রায়ে বলা হয়, এ অবস্থার আশু সমাধান না হলে নাগরিকরা আরো ব্যাধিগ্রস্ত ও ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
ঢাকা ঘিরে থাকা চার নদী- শীতলক্ষ্যা, তুরাগ, বালু ও বুড়িগঙ্গা প্রায় একই দশায় পড়েছে। বর্জ্যের মিশ্রণে নদীগুলোর পানি কালো, নীল বা লাল হয়ে গেছে। এ চার নদীকে সরকার 'প্রতিবেশ সংকটাপন্ন' ঘোষণা করেছে। আর বিশ্বব্যাংক বুড়িগঙ্গাকে অভিহিত করেছে 'মরা নদী' নামে। চামড়াশিল্পের বর্জ্য বুড়িগঙ্গা নদীকে দূষিত করে চলেছে প্রতিনিয়ত। কেবল হাজারীবাগের ট্যানারিগুলো থেকেই প্রতি মাসে গড়ে তিন হাজার মেট্রিক টন কঠিন এবং আড়াই লাখ টন তরল বর্জ্য বুড়িগঙ্গায় পড়ছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, হাজারীবাগের ২০০ ট্যানারি থেকে গড়ে প্রতিদিন ১০০ টন কঠিন বর্জ্য এবং ২০ হাজার ঘনমিটার পানি ৩০ ধরনের বিভিন্ন রাসায়নিকের মিশ্রণ নিয়ে দূষণ পদার্থ আকারে বের হচ্ছে এবং রাস্তার পার্শ্ববর্তী ড্রেনে নিক্ষিপ্ত হচ্ছে। হাজারীবাগের অপেক্ষাকৃত নিচু ভূমি এবং স্লুইসগেট পেরিয়ে গিয়ে সেগুলো পড়ছে বুড়িগঙ্গা নদীতে।
শীতলক্ষ্যা নদীতীর দখলের অশুভ প্রতিযোগিতা চলছে দীর্ঘদিন ধরে। কাঁচপুর ও সুলতানা কামাল সেতুর আশপাশের এলাকার দখলবাজরা এতই বেপরোয়া হয়ে উঠেছে যে, তাদের কারণে এ দুটি সেতুর অস্তিত্ব হুমকির মুখে পড়েছে বলে পত্রিকার রিপোর্টে জানা যায়। ২০১১ সালের ১ জানুয়ারি থেকে গত ৩১ আগস্ট পর্যন্ত পরিবেশ অধিদপ্তর নদী দখল ও দূষণের অভিযোগে ১২২টি অভিযান পরিচালনা করেছে। এসব অভিযানে ১৮৫টি প্রতিষ্ঠানকে ৩৪ কোটি ৯৫ লাখ টাকা জরিমানা করে তা আদায় করা হয়। ২২টি শিল্প ও বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের বিদ্যুৎ ও গ্যাস সংযোগ বিচ্ছিন্ন করা হয়। তার পরও দখলদারদের হাত থেকে নদী রক্ষা পাচ্ছে না।
ক্রমাগত দখলে তুরাগ নদের অস্তিত্ব এখন হুমকির মুখে। তুরাগের তীরভূমি অবাধে বালু ফেলে ভরাট করা হচ্ছে। নদের তীরে তৈরি করা হয়েছে পাকা দেয়াল ও নানা ধরনের অস্থায়ী স্থাপনা। গত ৩১ জুলাই নদী-সংক্রান্ত টাস্কফোর্সের ১৭তম সভায় নৌ-পরিবহন মন্ত্রণালয় থেকে ৬৪ ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানকে তুরাগের অবৈধ দখলদার হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। এদের বিরুদ্ধে সংশ্লিষ্ট জেলা প্রশাসকদের আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য বলা হয়েছে। নদী দখলের প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে নেই সরকারি সংস্থা, রাজনৈতিক দলের নেতা ও সমাজপতিরা। এমনকি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় নামধারী প্রতিষ্ঠানও তুরাগ দখলের অপরাধে হাত বাড়িয়েছে।
দখলের হাত থেকে রেহাই পাচ্ছে না রাজধানীর লেকগুলোও। গুলশান লেকের বেশ কিছু জায়গা ইতিমধ্যে দখল হয়ে গেছে। জায়গা দখল করে বহুতল ভবন, টিনশেড ঘর ও বস্তি তৈরি করা হয়েছে। রাজধানীর প্রাকৃতিক পরিবেশ টিকিয়ে রাখতে কয়েক বছর আগে লেকগুলো সংস্কারের মহাপরিকল্পনার অংশ হিসেবে লেক খনন, ওয়াকওয়ে নির্মাণসহ ব্যাপক পরিকল্পনা নেওয়া হয়। কিন্তু মহাপরিকল্পনা গ্রহণে সংশ্লিষ্টদের মধ্যে যে উৎসাহ কাজ করে, বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে তার দেখা পাওয়া ভার। সিটি করপোরেশন, রাজউক এবং ওয়াসার মধ্যে কাজের সমন্বয় না থাকায় এ খাতে ব্যয়িত কোটি কোটি টাকা ভেস্তে যেতে পারে- এমন আশঙ্কাও কম নয়। রাজধানীর প্রাকৃতিক লেকগুলো বাঁচাতে হলে দখল ও দূষণের আগ্রাসন বন্ধে জরুরি পদক্ষেপ নেওয়া দরকার। উত্তরার মধ্য দিয়ে বয়ে যাওয়া লেকটি উত্তরা মডেল টাউনের সৌন্দর্য ও প্রাকৃতিক পরিবেশ বজায় রাখতে সহায়তা করে। বর্তমানে লেকটি দূষণাক্রান্ত। লেকটির কিছু অংশে যুক্ত হয়েছে স্যুয়ারেজ লাইন, নির্বিচারে ফেলা হচ্ছে আবর্জনা। ঢাকার গুলশান-বারিধারা লেকটি প্রাকৃতিকভাবে ড্রেনেজ সিস্টেমের কাজ করে। পরিবেশ সংরক্ষণ ও আইনের আওতায় ২০০১ সালে লেকটিকে পরিবেশগতভাবে নাজুক এলাকা হিসেবে ঘোষণা করা হয়।
নদী দখল ও দূষণ রোধে সরাসরি দায়িত্ব প্রায় ১৫টি মন্ত্রণালয়ের। পরিবেশ অধিদপ্তরের কাজের আওতায় রয়েছে নদীর পানিদূষণ রোধ করা। বিআইডাবি্লউটিএর দায়িত্ব তীরের অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ করা। নদীর পানির কর্তৃপক্ষ পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়, তলদেশের কর্তৃপক্ষ ভূমি মন্ত্রণালয় এবং পাড়ের মালিক নৌ-পরিবহন মন্ত্রণালয়। সেখানে যেকোনো উন্নয়ন কাজ করতে গেলেই দ্বারস্থ হতে হয় পরিকল্পনা ও অর্থ মন্ত্রণালয়ের। আর দখলমুক্ত রাখতে প্রয়োজন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সক্রিয় ভূমিকা। কিন্তু মন্ত্রণালয়গুলোর সমন্বয়ের অভাবে নদী দখল ও দূষণ কোনোটাই রোধ করা যাচ্ছে না।
আমার মতে, নদী যেকোনো দেশের সার্বিক পরিবেশ রক্ষার্থে মানবদেহের রক্ত-সংবহনতন্ত্রের মতো পরিবেশকে সতেজ ও সাবলীল রাখতে সাহায্য করে। অতএব এ ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের নীরব থাকা মোটেও উচিত হবে না। অপরিকল্পিত নগরায়ণ, বহুতল ভবন নির্মাণ, যেখানে সেখানে ডিপ-টিউবওয়েলের মাধ্যমে মোটরের সাহায্যে ভূগর্ভ থেকে অব্যাহত পানি উত্তোলন, নদী-নালা, খাল-বিল ভরাট, জবরদখল, জাল-জালিয়াতিসহ এ ধরনের সব অবৈধ কর্মকাণ্ড বন্ধ করতে হবে। অবোধ নদীগুলোর ওপর সব ধরনের নির্যাতন এখনই বন্ধ করতে হবে। অন্যথায় সাবধান। বিপদ নদীর নয়, বিপদ ঘটবে মানুষের।

লেখক : সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ও সংবিধান বিশেষজ্ঞ
malik.law.associates@hotmail.com

No comments

Powered by Blogger.